عَنْ ابن عبَّاس رَضَىَ الله عنه قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم يَقُوْلُ لَيْسَ المُؤْمنُ الَّذى يَشبَعُ وجَاره جائعٌ اِلى جَنْبِه – (رواه البيهقى)

অনুবাদ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি তৃপ্তিসহকারে উদর পূর্তি করে খায় আর তারই প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়। [বায়হাকী শরীফ]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে ইসলামে প্রতিবেশীর হক তথা অধিকার প্রসঙ্গে মুমিনদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়-দায়িত্ব হক তথা তাদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের প্রতি সদয় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে মানবতার ধর্ম পবিত্র ইসলামে। মানুষের ডানে বামে সামনে ও পেছনে অর্থাৎ চারপাশের চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত যারা বসবাস করেন তারা সকলেই প্রতিবেশী। নিজের সন্তান-সন্তুতি ও স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকার ব্যাপারে যেভাবে ইসলামে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তেমনিভাবে প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি যতœবান থাকা তথা সচেতন থাকার শিক্ষা দেয়া হয়েছে ইসলামী জীবন বিধানে। ইসলামে নিজের ক্ষতি অনিষ্টতা ও অকল্যাণ যেমন সমর্থন করে না তেমনিভাবে অন্যজনের ক্ষতিসাধন তথা সুখ শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্টকারী কোন কার্যকলাপ আচার আচরণ অনুমোদন করে না। ইসলাম মানে শান্তি মুসলিম অর্থ শান্তিকামী। সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল শিক্ষা ও মহানবীর আদর্শ।
আজকের মুসলিম সমাজ ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ থেকে বিচ্যুতির কারণেই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের করুণ দুরবস্থা। মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন, চারিত্রিক অবক্ষয়, শঠতা-কপটতা, অনাচার-পাপাচার, মিথ্যাচার ইত্যাদি অবক্ষয় গর্হিত ক্রিয়াকলাপই মুসলমানদের পশ্চাদপদতা ও বিপর্যয়ের মূল কারণ। ইসলামে শুধু একজন মুসলিমের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়নি, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তার ন্যায্য পাওনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের সমাজে প্রতিবেশীর হক তথা অধিকার উপেক্ষিত। প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি চরমভাবে উদাসীন। অথচ ইসলাম এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা আরোপ করেছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى شريخ رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم والله لايؤمن والله لَايُؤْمِنُ واللهِ لايؤمن قيل من يا رسول الله قال الذى لايأمن جارهُ بوائقه- (متفق عليه)
হযরত আবু শুরাইহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম ঐ ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম ঐ ব্যক্তি ঈমানদার নয়- জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ঐ ব্যক্তি কে? তিনি উত্তর দিলেন, ঐ ব্যক্তি যার অত্যাচার ও অপকার হতে তার প্রতিবেশীরা নিরাপদে থাকে না। [বুখারী ও মুসলিম শরীফ]


প্রতিবেশীর প্রতি ভালো-মন্দ ব্যবহারের পরিণতি
সমাজে এক শ্রেণির নর-নারী আছে, যারা নামায রোজা হজ্ব যাকাত দান সাদকাহ ইত্যাদি পুন্যময় আমল করেন অথচ প্রতিবেশীর প্রতি নিকৃষ্ট আচরণ করেন। প্রতিবেশীকে গালমন্দ করেন, অশ্লীলভাষা কটূবাক্য দ্বারা প্রতিবেশীর অন্তরে কষ্ট দেয়। সামান্য বিষয় নিয়েও প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়। প্রতিবেশীর ব্যাপারে কুৎসা রটনা করে সমালোচনা করে। প্রতিবেশী দুর্বল হলে কূটকৌশলে তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেও পিছপা হয় না। বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে হয়রানি করে এ ধরনের ধার্মিকতা কোন কাজে আসবে না, বরং তার করুণ পরিণতি হবে ভয়াবহ জাহান্নাম। আর কোন বান্দার মধ্যে নামায রোজা দান সাদকার পরিমাণ কম হলেও তিনি যদি প্রতিবেশীর হক বা দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করেন এর উত্তম প্রতিদান হিসেবে তার জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। হাদীস শরীফে আছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رجل يا رسول اللهِ اِنَّ فلانَةٌ تذكَرُ من كثرة صلاتها وصيامها وصدقتها غيرانها تُوذِىْ جيرانَهَا بلسانها قال هى فى النار قال يا رسول الله اِنَّ فلانَةٌ تذكَرُ قِلَّةُ صيامها وصدقتها وصلاتها وانّها تصدّق بالاثوار من الاقط ولاتوذى بلسانها جيرانَها قال هى فى الجنّة- (رواه احمد)
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল ইয়া রাসূলাল্লাহ্! অমুক মহিলার সঠিক নামায রোজা ও দান সাদকার কারণে তাকে স্মরণ করা হয়, তবে সে তার জিহ্বা দ্বারা তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়ে থাকে। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সে জাহান্নামী। উক্ত ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো ইয়া রাসূলাল্লাহ্! অমুক মহিলার স্বল্প রোজা, স্বল্প দান-সাদকা ও স্বল্প নামাযের বিষয় মানুষের মধ্যে আলোচনা করা হয়, তবে সে পনিরের টুকরা বিশেষ দান করে থাকে এবং তার জবান দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। তিনি এরশাদ করেন সে জান্নাতী। [আহমদ]

প্রতিবেশীর অধিকার প্রসঙ্গে হযরত জিব্রাঈল (আ.)’এর তাকিদ
প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম প্রতিনিয়ত গুরুত্বারোপ করতেন। নিু বর্ণিত হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن عائشة وابن عمر رضى الله عنهما قال النبى صلى الله عليه وسلم مازال جبرائيل يوصينى بالجار حتى ظننت انه سَيُورَّثه- (رواه مسلم)
অথ: হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম সর্বদা আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে তাকিদ দিচ্ছিলেন, এমনকি আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম তিনি অনতিবিলম্বে তাদেরকে (প্রতিবেশীকে) আমার ওয়ারিশ করে দেবেন। [মুসলিম শরীফ]

প্রতিবেশীর মূল্যায়ন ভাল-মন্দের মাপকাঠি
নিজের ভাল-মন্দ কর্মের স্বীকৃতি অন্যজনের মূল্যায়ন ও মতামতের উপর নির্ভরশীল। অনেকেই প্রতিনিয়ত অন্যায় অপরাধ ও মন্দ কর্মের তথা অপকর্মে নিমজ্জিত থাকার পরও মোটেই অনুতপ্ত নন, দোষী হওয়ার পরও নিজেকে নির্দোষ মনে করেন, অন্যজনের মতামত ও মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেয় না। অন্যায় করার পরও প্রশংসা পেতে চান। এ শ্রেণির মানুষ অহংকারী দাম্ভিক। তারা অপরের মতামতকে সম্মান করে না। নিজের সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করে না। কেউ সংশোধনের পরামর্শ বা মতামত ব্যক্ত করলে তাদেরকে শত্র“ মনে করে। অন্যজনের বিশ্লেষণ পর্যালোচনা মূল্যায়ন ও প্রদর্শিত পন্থা গ্রহণ করতে পারা মহানুভবতার পরিচায়ক। প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে ভাল স্বীকৃতি পাওয়া গৌরবের ও আনন্দের। নিু বর্ণিত হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابن مسعود رضى الله عنه قال قال رجل للنبى صلى الله عليه وسلم يا رسول الله كيف لِىْ ان اَعْلَمَ اذا احسِنتُ واذا اسأتُ فقال النبى اذا سمعت جيرانَكَ يقولُونَ قد اَحسنت فقد اَحْسَنت واذا سَمِعْتَ يَقُولُوْن قد اسأت فقد اسأت- (رواه ابن ماجه)
হযরত আবদল্লাহ্ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! নবীজি এরশাদ করেন, যখন তা তুমি তোমার প্রতিবেশীকে বলতে শুনবে যে তুমি ভাল করছ তবে প্রকৃতই তুমি ভাল করেছ। আর যখন প্রতিবেশীকে বলতে শুনবে তুমি মন্দ করছ তবে মনে করবে তুমি মন্দ করেছ।
[ইবনে মাযাহ]

সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম আদর্শ নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথে সত্যান্বেষী মুক্তিকামী মানুষের সর্বাঙ্গীন সুখ শান্তি মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত। তাই আসুন মহানবীর হাদীসের আলোকে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশীর প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করি। প্রতিবেশীর কল্যাণ ও উন্নয়নে এগিয়ে আসুন। প্রতিবেশীর প্রতি সুসম্পর্ক করুন। প্রতিবেশীর প্রতি দূরত্ব নয় নিবিড়
সম্পর্ক স্থাপন করুন। তাদের সুখে দুঃখে সাড়া দিন, তাদের দাওয়াত সাদরে গ্রহণ করুন। তাদের অনুষ্ঠানাদিতে সাধ্যানুযায়ী উপহার বিনিময় করুন। তাদের বাসা বাড়িতে যাতায়তের পথে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার অমানবিক আচরণ পরিহার করুন। পারস্পরিক সহযোগিতামূলক প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী আদান প্রদানে সহযোগিতা করুন। পার্শ্ববর্তী পরিবার দরিদ্র বলে তাদেরকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞামূলক আচারণ থেকে বিরত থাকুন। মানুষ মানুষের জন্য এ নীতিতে সুন্দর শালীন ও মার্জিত আচরণ করুন। আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের কাম্য। আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে প্রতিবেশীর অধিকার সুরক্ষায় তাওফিক নসীব করুন। আ-মী-ন।


 
Top