রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাতা-পিতা জান্নাতী না জাহান্নামী?

কৃতঃ খায়রুল হুদা খান


রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ) এর পিতামাতা নাজাতপ্রাপ্ত- এটাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বা বিশ্বাস। ইনশাআল্লাহ, এ নিবন্ধে কুরআন হাদীসের আলোকে রাসূলে পাক (ﷺ) এর সম্মানিত পিতামাতা যে ঈমানদার ছিলেন এবং তাঁরা যে জাহান্নাম থেকে নাজাতপ্রাপ্ত তা আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি যারা বলেন আল্লাহর রাসূলের মাতা-পিতা জাহান্নামী তাদের দলীলগুলো আলোচনা করা হবে এবং তার জবাব প্রদান করা হবে।


নাজাতের পদ্ধতি


✦ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (رحمة الله) কুরআন-হাদীসের দলীল ও মুহাদ্দিসীনে কিরামের মতামতের ভিত্তিতে রাসূলে পাক (ﷺ) এর মাতা-পিতা মুক্তিপ্রাপ্ত এবং জান্নাতী হওয়ার ব্যাপারে তিনটি পন্থা আলোচনা করেছেন।


প্রথম পন্থা : রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা এমন সময়ে দুনিয়াতে ছিলেন যখন আরবে কোন নবী-রাসূল ছিলেন না, যে সময়কে কুরআন মজীদের ভাষায় ‘ফাতরাতের যুগ’ বলা হয়। এ অবস্থায় কেউ থাকলে আল্লাহ তাআলার বাণী অনুযায়ী তাঁদের শাস্তি দেওয়া হবে না।


দ্বিতীয় পন্থা : রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা এবং পূর্ব পুরুষগণ ইবরাহীম (عليه السلام) এর অনুসারী হিসেবে ‘হানীফ’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।


তৃতীয় পন্থা : রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতাকে আল্লাহ তাআলা আবার জীবিত করেছিলেন অত:পর তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত আবার ইন্তেকাল করেছেন।


ফাতরাতের যুগের হিসেবে নাজাতপ্রাপ্ত


রাসূলে পাক (ﷺ)-এর পিতা-মাতা ফাতরাতের যুগ তথা নবী-রাসূল আগমনের মধ্যবর্তী যুগের হিসেবে নাজাতপ্রাপ্ত। কারণ তারা কোন নবী-রাসূল পাননি। এ মতের পক্ষে ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ দলীল পেশ করেন যে, 


✦আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন-

-‘আল্লাহপাক কোন জাতিকে ধ্বংস করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মাঝে কোনো রাসূল প্রেরণ না করেন।’


✦অন্য আয়াতে এসেছে-

‘আমি কাউকে শাস্তি দেই না যতক্ষণ না কোনো রাসূল প্রেরণ করেছি।’


রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতার সময়ে কিংবা এর নিকটবর্তী অতীতে আরবে কোন নবী-রাসূল আগমন করেননি। তাছাড়া যদিও ঈসা (عليه السلام) রাসূলে পাক (ﷺ) এর পূর্বে সবচেয়ে নিকটবর্তী নবী ছিলেন কিন্তু তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাঈলের জন্য নবী ছিলেন, আরবের জন্য নয়। সুতরাং তাঁর শরীআত আরববাসীর জন্য প্রযোজ্য নয় এবং সে দাওয়াতও তাদের কাছে পৌঁছেনি। সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা অনুযায়ী সেই সময়ের মানুষকে আল্লাহ পাক শাস্তি দেবেন না। এ হিসেবে রাসূল (ﷺ)-এর পিতা-মাতাও নাজাতপ্রাপ্ত।


✦কেউ কেউ বলেন, আহলে ফাতরাত তথা নবী-রাসূল আসেননি এমন গোত্রের লোকদের আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন পরীক্ষা করবেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবেন তারা জান্নাতী হবেন এবং যারা উত্তীর্ণ হবেন না তারা জাহান্নামী হবেন। 


✦এ ব্যাপারে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,

-‘এ ক্ষেত্রে প্রবল ধারণা করা যায় যে, রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা আল্লাহর আনুগত্যেও ভিত্তিতে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন।’ ফলে তারা জান্নাতী হবেন।


✦ইমাম তাবারী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে তাবারীতে বর্ণনা করেন, কুরআন কারীমের আয়াত ‘আপনার প্রতিপালক আপনাকে দিতে থাকবেন যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্ট হবেন’ এর ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, ‘রাসূলে পাক (ﷺ) এর সন্তুষ্টির মধ্যে অন্যতম সন্তুষ্টি হবে যাতে তাঁর কোনো পরিবার-পরিজন জাহান্নামে না যান।’ 


✦অন্য হাদীসে রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে দাবি করে যে আমার পরিবার-পরিজনের জন্য আমার শাফাআত কাজে আসবে না?’ কুরআন কারীমের পূর্বোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা এবং রাসূলে পাক (ﷺ) এর হাদীসের ভিত্তিতে অনুধাবন করা যায় যে, রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য সুপারিশ করবেন এবং আল্লাহ পাক তাঁর দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী তাঁর হাবীবকে সন্তুষ্ট করবেন। আর রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর পরিবার পরিজনের জন্য সুপারিশ করবেন অথচ তাঁর মা-বাবার জন্য সুপরিশ করবেন না, তা কি ভাবা যায়?


হানীফ সম্প্রদায়ভুক্ত হিসেবে নাজাতপ্রাপ্ত


দ্বিতীয় পন্থা হচ্ছে, রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা মাতা ‘হানীফ’ দলভুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) এর ধর্মের উপর ছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে কোন শিরক সংঘটিত হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ নেই।

উলামায়ে কিরামের বড় এক অংশের অভিমত এটি। 


✦এক্ষেত্রে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) কুরআন মজীদ থেকে দলীল পেশ করে বলেন, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-

-‘আপনি যখন নামাযে দ-ায়মান হন তখন যিনি দেখেন তিনি দেখেছেন সিজদাকারীদের মধ্যে আপনার স্থানান্তর’। 


✦এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) বলেন, এখানে আল্লাহর রাসূলের নূর মুবারাক স্থানান্তরিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাদের মাধ্যমে রাসূলে পাক (ﷺ) এর নূর স্থানান্তরিত হয়েছে তাঁদের আল্লাহ পাক ‘সিজদাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, আদম (عليه السلام) থেকে হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল পূর্বপুরুষই মুমিন ছিলেন (যাদের মাধ্যমে তিনি স্থানান্তরিত হয়েছেন)।


✦রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,

‘আল্লাহ তাআলা আমাকে সর্বদা পুত:পবিত্র পৃষ্ঠদেশ থেকে পবিত্র গর্ভেই স্থানান্তরিত করেছেন। পবিত্র পরিচ্ছন্ন দু’টি বংশ ধারার উভয়টির মধ্যেই আমি উত্তম বংশের অন্তর্ভুক্ত।’


✦হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি প্রতিটি যুগে মানবজাতির সর্বস্তরের সর্বশ্রেষ্ঠ বংশে আবির্ভূত হয়েছি।’ (বুখারী)


রাসূলে পাক (ﷺ)-এর বংশধারা জাহিলী যুগের ব্যভিচার থেকে পুত:পবিত্র


✦রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘জাহিলী যুগে ‘সিফাহ’ নামে যেসব অপকর্ম চলত সেগুলোর কোনোটার মাধ্যমেই আমি জন্মগ্রহণ করিনি।’ (বায়হাকী)


সিফাহ শব্দটির অর্থ হল ব্যভিচার। আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারযুগে এটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু রাসূল (ﷺ)-এর পুর্বপুরুষ ছিলেন যারা তারা সকলেই এ থেকে পবিত্র ছিলেন সর্বদাই।


✦হাদীস শরীফে আছে,-হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘হযরত আদম (আ) এর যুগ থেকে পিতা-মাতার মাধ্যমে আমার জন্ম পর্যন্ত পবিত্র নিকাহের মাধ্যমেই আমি এসেছি। অপবিত্র ‘সিফাহ’ এর মাধ্যমে নয়। আমার পিতৃপুরুষগণ আজীবন সিফাহ (ব্যভিচার) থেকে পবিত্র ছিলেন।’ (তাবারানী)


✦অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,

-‘আমি সর্বদাই ইসলামী নিকাহের মত বিবাহ সম্পর্কের মাধ্যমে এসেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত আমার মাতা-পিতার ঘরে জন্ম নিয়েছি।’


পুর্বপুরুষ কেউই মুশরিক ছিলেন না


উপরোক্ত হাদীসগুলো এবং এরকম সমার্থক আরো বহু হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা থেকে আদম (عليه السلام) পর্যন্ত সমস্ত বংশধারা পবিত্র ছিলো। আর যারা পবিত্র তারা মুশরিক হতে পারেন না। 


✦যেহেতু আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে মুশরিকরা অপবিত্র।’


✦তাছাড়া উপরোক্ত হাদীসগুলোতে দেখা যায়, রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর বংশকে শ্রেষ্ঠ বংশ বলেছেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের শ্রেষ্ঠ মানুষ বলেছেন। যদি তারা মুশরিক হতেন তাহলে তাঁদের শ্রেষ্ঠ বলা যেত না।


✦অন্য হাদীসে রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,

-‘আমি সত্য নবী এবং আমি মিথ্যাবাদী নই। আর আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান।’ এ হাদীসে দেখা যায় রাসূলে পাক (ﷺ) নিজের দাদা আবদুল মুত্তালিবকে নিয়ে গর্ববোধ করেছেন। যদি তাঁর দাদা মুশরকি হতেন তাহলে তিনি তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতেন না।


✦ইবরাহীম (عليه السلام) যখন ইসমাইল (عليه السلام) কে নিয়ে কা’বা শরীফ নির্মান শেষ করেন তখন তাঁরা যে দু’আ করেন তার একটি অংশ ছিল-

-‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুজনকে তোমার অনুগত (মুসলিম) বানাও, আর আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও এক দল লোককে তোমার অনুগত (মুসলিম) বানাও।’ (সূরা বাকারা)


✦এ দু’আর পরবর্তী অংশে তিনি উল্লেখ করেন-

-‘হে আমাদের প্রতিপালক, তাদের মধ্য থেকে তাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করো।’


এখানে প্রথম দু’আ থেকে প্রমাণিত হয়, ইবরাহীম (عليه السلام) এবং ইসমাইল (عليه السلام) এর বংশে সর্বযুগে একদল লোক ‘উম্মতে মুসলিমাহ’ থাকবেন এবং পরবর্তী দু’আয় শব্দকে কেউ কেউ উম্মতে মুসলিমাহ এর দিকে সম্পর্কিত কওে বলেন, থেকে প্রমাণিত হয়, রাসূল যিনি আসবেন তিনি সেই ‘উম্মতে মুসলিমাহ’র মধ্য থেকে আসবেন। সুতরাং ইবরাহীম (عليه السلام) এর দু’আর ফসল হলেন হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এবং তাঁরই দু’আ অনুযায়ী তাঁর পিতা-মাতা এবং পূর্ব পুরুষগণ সেই ‘উম্মতে মুসলিমাহ’র অন্তর্ভুক্ত।


✦তাছাড়া সূরা ইবরাহীমে উল্লেখিত হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) অপর দু’আঃ

-‘হে প্রতিপালক! আমাকে নামাযী বানাও এবং আমার বংশধরদের থেকেও এক দল লোককে নামাযী বানাও’। এ আয়াতে ‘একদল লোক’ দ্বারা প্রমাণিত হয় কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগে ইবরাহীম (عليه السلام) এর বংশে নামাযী এবং ঈমানদার একদল লোক বেঁচে ছিলেন এবং থাকবেন। 


আর একথা প্রণিধানযোগ্য যে, কোনো যুগে ইবরাহীম (عليه السلام) এর বংশধর একদল মানুষ ঈমানদার থাকবেন অথচ সেই রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা সেই ঈমানদার দলের অন্তর্ভূক্ত হবেন না, সে কথা চিন্তাও করা যায় না।


✦অন্য হাদীসে রাসূলে পাক (ﷺ) গর্ববোধ করে বলেছেন, ‘আমি দুই কুরবানীকৃত ব্যক্তির সন্তান’। আর এরা হলেন তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাইল (عليه السلام) এবং তাঁর স্বীয় পিতা হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه)। 


এ হাদীসে দেখা যায় রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর পিতাকে নিয়ে গর্ববোধ করেছেন। যদি তিনি মুশরিক হতেন, তাহলে কুরবানীর জন্য আল্লাহ পাক তাঁকে মনোনীত করতেন না এবং তাকে নিয়ে রাসূলে পাক (ﷺ) গৌরববোধ করে বাণী প্রদান করতেন না।


আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ‘আবদুল্লাহ’ নামের অর্থ হল ‘আল্লাহর বান্দা’ আর ‘আমিনা’ নামের অর্থ হল বিশ্বস্ত, আমানতদার, আল্লাহর উপর ভরসাকারীনী, সংরক্ষিতা। সুবাহানাল্লাহ! নাম থেকেই তাদের ইমানদার হওয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, যারা এ নাম রেখেছেন তারাও নিশ্চয়ই ঈমানদার ছিলেন। তা না হলে এমন পবিত্র নাম কিভাবে রাখলেন? অথচ সে সময় তো মূর্তির নামের সাথে মিলিয়ে ‘আবদুল ওজ্জা’ ‘আবদুল লাত’ ইত্যাদি নাম রাখা হতো।


আল্লাহর হুকুমে জীবিত হয়ে ঈমান আনয়নের ভিত্তিতে নাজাতপ্রাপ্ত


তৃতীয় পন্থা হচ্ছে, রাসূলে পাক (ﷺ) এর আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁর পিতা-মাতাকে আল্লাহ পাক জীবিত করেছিলেন এবং তাঁরা রাসূলে পাক (ﷺ) এর উপর ঈমান আনয়ন করেছিলেন। মুহাদ্দিসীনে কিরামের বড় এক অংশ এই মতের প্রবক্তা। 


✦তাঁদের মধ্যে হাফিয ইবনে শাহিন, হাফিয আবু বকর আল বাগদাদী, আবুল কাসিম আস সুহায়লী, ইমাম আল কুরতুবী, ইমাম তাবারানী, ইবনে আসাকির (رحمة الله) প্রমুখ।


✦এ সম্পর্কে হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) আমাদের নিয়ে হজ্জ আদায় করলেন। অতপর তিনি আমাকে নিয়ে ‘আকাবায়ে হুযুন’ এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এসময় তিনি অত্যন্ত দুঃখন্ডভারাক্রান্ত হয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। তিনি সেখানে অবতরণ করলেন এবং আমার কাছ থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য চলে গেলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তখন তিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল এবং আনন্দিত। আমি তাঁর কাছে এর কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আমি আমার মায়ের কবরের কাছে গেলাম এবং আল্লাহর কাছে আরজ করলাম আমার মাকে জীবিত করে দেওয়ার জন্য। আল্লাহ পাক তাঁকে জীবিত করে দিলেন, তিনি আমার উপর ঈমান আনলেন এবং আবার মৃত্যুবরণ করলেন।’


✦অন্য হাদীসে আয়িশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) আল্লাহর কাছে আরজ করলেন তাঁর মা-বাবাকে জীবিত করার জন্য। আল্লাহ পাক তাদের জীবিত করে দিলেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর উপর ঈমান আনলেন এবং আবার মৃত্যুবরণ করলেন।

মুহাদ্দিসীনে কেরামের কেউ কেউ এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে বলেন, এ হাদীসটি যয়ীফ। কিন্তু এ হাদীসের বর্ণনার আধিক্যের কারণে এটি ‘হাসান’ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।


✦এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন, মৃত ব্যক্তিকে কি এভাবে জীবিত করা সম্ভব এবং মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঈমানের স্বাক্ষী কি গ্রহণযোগ্য? এর জবাবে ইমাম কুরতুবী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন মজীদে বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির হত্যাকারীর অনুসন্ধানে গরু জবাইয়ের দীর্ঘ আলোচনা এসছে সে ঘটনায় মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা হয়েছিল এবং সে তার হত্যাকারীর ব্যপারে স্বাক্ষী প্রদান করেছিল। তাছাড়া ঈসা (عليه السلام) আল্লাহর হুকুমে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন এবং আমাদের নবী (ﷺ)ও আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবিত করেছিলেন। এ রকম বিভিন্ন ঘটনা রয়েছে।


✦ফতোয়ায়ে শামী প্রণেতা আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী হানাফী (رحمة الله) বলেন, তোমরা কি একথা জানো না যে, আল্লাহ তা’আলা রাসূলে করীম (ﷺ) কে ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি নিজ পিতা-মাতাকে পুনরায় জীবিত করেছেন এবং তারাও রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর নবুওয়াত এর উপর ঈমান এনেছেন। (রদ্দুল মুহতার শরহে দুররুল মুখতার)


✦ইমাম আবদুল বাকী যুরকানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন, রাসূলে করীম (ﷺ)-এর পিতা-মাতা কখনোই কাফির কিংবা মুশরিক ছিলেন না। তাঁরা কুফর ও মুর্তিপুজা থেকে সর্বদাই পবিত্র ছিলেন। (যুরকানী, শরহে মাওয়াহিবে লাদুনিয়্যাহ, ১ম খন্ড)


✦বিখ্যাত মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিস শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله) লিখেছেন, ‘উলামায়ে কিরাম একথাই প্রমাণসহ প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পিতামাতা, উর্ধ্বতন পিতা-মাতা ও পিতা-মাতামহগণ এমনকি আদম (عليه السلام) পর্যন্ত তাঁর সমগ্র পিতৃপুরুষই (রাসূলের বংশের সবাই) সত্যধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। (আশি’আতুল লুমআত : ১ম খন্ড)


✦ইমাম কালবী (رحمة الله) বলেন, ‘আমি রাসূলে করীম (ﷺ)-এর উর্ধ্বতন পাঁচশত বছরের মাতাগণের জীবনী লিখেছি। কোনো যুগেই তাদের মধ্যে জাহিলিয়াতের কোনো অপবিত্রতা ও চরিত্রহীনতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। (কিতাবুশ শিফা)


✦এখানে আরেকটি হাদীস লক্ষ্যণীয় যে, সহীহ বুখারী শরীফে এসেছে, আবূ লাহাব মারা যাওয়ার পর একদিন তার পরিবারের কিছু লোক তাকে স্বপ্নে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখল। প্রশ্ন করা হলো, তুমি কি অবস্থায় আছো? সে বলল, তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে আসার পর আমার ভাগ্যে ভাল কিছু নসীব হয়নি। তবে প্রতি সোমবার আমার (শাহাদাত) আঙ্গুলি হতে পানি পাওয়া যায়। কেননা (এর দ্বারা) আমি আমার দাসী সুয়াইবাকে আযাদ করে দিয়েছিলাম। (সহীহ বুখারী)


যেখানে আবু লাহাবের মত কাফির রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের সংবাদে খুশি হয়ে দাসী সুয়াইবাকে মুক্ত করে দেওয়ায় প্রতি সপ্তাহে একদিন সোমবার আল্লাহ তার শাস্তি হালকা করে দিয়েছেন তাহলে যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জন্ম দিয়েছেন তাঁদের সম্মান আল্লাহ কি কম দিবেন নাকি বেশি দিবেন? তারা কি জাহান্নামী হতে পারেন? (নাউযুবিল্লাহ)


পরিশেষে বলা যায়, আল্লাহ পাক কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে এবং রাসূলে পাক (ﷺ) বিভিন্ন হাদীসে মাতা-পিতার সম্মান এবং তাঁদের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা আলোচনা করেছেন। সে সম্মান এবং দায়িত্ববোধ থেকেই প্রত্যেকটি মানুষই চায় তার পিতা-মাতা জান্নাতী হোক। সেক্ষেত্রে স্বীয় পিতা-মাতার প্রতি রাসূলে পাক (ﷺ)-এর সম্মান ও দায়িত্ববোধ বহুগুণ বেশি ছিল। 


✦তাঁদের প্রতি সে দায়িত্ববোধের সম্মানেই আল্লাহপাক তাঁর হাবীবকে নির্দেশ দিয়েছেন, -‘হে নবী! আপনি বলুন, হে আমার রব, আমার পিতা-মাতা উভয়কে এমনভাবে রহম করো যেরূপ ছোটবেলা তারা আমাকে লালন পালন করেছেন’। 

যদি তাঁরা ঈমানদার না হতেন তাহলে আল্লাহ এরূপ দোয়ার নির্দেশ দিতেন না।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা-মাতাকে জাহান্নামী বলা তাঁকে কষ্ট দেয়ার নামান্তর


আল্লাহর রাসূলের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ পাক নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহর রাসূলের সম্মানহানী হয় এমন কোন কথা বলা কিংবা কোনো কাজ করা ঈমান বিনষ্টের কারণ হয়ে যাবে। আল্লাহর রাসূলের সম্মানিত পিতামাতাকে জাহান্নামী বলা প্রকারান্তরে তাঁর সম্মানহানী ও তাঁকে কষ্ট দেওয়ার নামান্তর। 


✦যেমন মালিকী মাযহাবের অন্যতম ইমাম কাযী আবূ বকর ইবনে আরাবী (رحمة الله) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সে ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কি বলেন যে বলে রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা জাহান্নামী? তিনি জবাবে বলেন,

-‘এই ব্যক্তি মাল’উন (অভিশপ্ত)। কেননা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ পাক তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশাপ দেন,’ আর তাঁকে এর চেয়ে বড় কষ্ট কিভাবে দেওয়া যেতে পারে যে তাঁকে বলা হবে তাঁর পিতা জাহান্নামী।’’


✦আল্লামা আলুসী (رحمة الله) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে আমি তার কুফরের আশংকা করি।’ (তাফসীরে রূহুল মা‘আনী ১ম খন্ড)


যারা রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতামাতা নাজাতপ্রাপ্ত নন বলেন তাদের দলীল ও জবাব


যারা রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতামাতাকে জাহান্নামী বলেন তারা দুটি দলীল পেশ করে থাকেন।


প্রথম দলীল ও এর জবাব


বিরোধীদের প্রথম দলীল হলো-

-‘একদিন এক সাহাবী রাসূলে পাক (ﷺ) এর কাছে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার পিতা কোথায়? রাসূলে পাক (ﷺ) জবাব দিলেন, তোমার পিতা জাহান্নামে। সে ব্যক্তি নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁকে ডেকে বললেন, নিশ্চয়ই আমার পিতা এবং তোমার পিতা জাহান্নামে।’


উপরোক্ত দলীলের জবাব উলামায়ে কিরামের বক্তব্য নিম্নরূপঃ


হাদীসটি খবরে ওয়াহিদ, যা কুরআনের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য নয়


ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ প্রথম হাদীসের জবাব দেন এভাবে যে, প্রথম হাদীসটি যদিও সহীহ কিন্তু এটি ‘আহাদ হাদীস’। আর উসূলে হাদীসের পরিভাষায় ‘আহাদ হাদীস’ দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করা যায় না, যদি তার বিপরীতে কুরআন মজীদের কোনো আয়াত পাওয়া যায়। যেহেতু আল্লাহর রাসূলের পূর্বপুরুষদের ঈমান এবং পবিত্রতা সম্পর্কে কুরআন মজীদ এবং বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনা রয়েছে সুতরাং এ হাদীসের অর্থ এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।


ঈমান আনয়নের হাদীস দ্বারা অন্য সকল হাদীস মানসূখ


ইবনে আবিদীনসহ ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ উল্লেখ করেন যে, এক হাদীসে এসেছে, রাসূলে পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতাকে আল্লাহ পাক তাঁর হাবীবের আকাক্সক্ষার কারণে বিদায় হজ্জের সময় জীবিত করেছেন এবং তাঁরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। সুতরাং প্রথম হাদীসে যদিও আল্লাহর রাসূলের পিতাকে জাহান্নামে বলা হয়েছে সেই ঘটনা ছিল আগের এবং তাঁদের ঈমান আনয়নের ঘটনা বিদায় হজ্জের সময়ের অর্থাৎ রাসূলে পাক (ﷺ) এর ইন্তেকালের মাত্র তিন মাস আগের, যা পূর্ববর্তী হাদীসের হুকুমকে রহিত করে দিয়েছে।


আরবী ‘আবুন‘ শব্দ দ্বারা চাচাকেও বুঝানো হয়


ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ উল্লেখ করেন যে, উল্লেখিত হাদীসে ‘আমার পিতা’ বলে রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর চাচা আবু তালিবকে বুঝিয়েছেন। কেননা কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে পিতা বলে চাচাকে বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া মক্কা শরীফের মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে ‘আবূ তালিবের ছেলে’ বলে সম্বোধন করত, যেহেতু রাসূলে পাক (ﷺ) আবূ তালিবের লালন-পালনে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। 


✦যেমন তারা তাঁর চাচা আবূ তালিবকে এসে বলেছিল-

‘তোমার ছেলেকে বলো সে যেন আমাদের মূর্তিদের নিন্দা না করে।’ আর একথা সুপ্রসিদ্ধ যে আবূ তালিব কুফুরীর উপর মৃত্যুবরণ করেছেন।


সুতরাং এ হাদীসে রাসূলে পাক (ﷺ) ‘আমার পিতা এবং তোমার পিতা জাহান্নামে’ দ্বারা তাঁর চাচা আবু তালিবের কথা বুঝিয়েছেন।


দ্বিতীয় দলীল ও এর জবাব


বিরোধীদের দ্বিতীয় দলীল হচ্ছে,

রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি আমার মাতার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চাইলাম, তিনি আমাকে অনুমতি দেননি। তখন আমি তাঁর কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলাম, তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন।’


এর জবাবে মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, এ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহপাক রাসূলে পাক (ﷺ) কে মায়ের কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়েছেন। যদি তিনি মুশরিক হতেন তাহলে আল্লাহ পাক তাঁকে কবর যিয়ারতের অনুমতি দিতেন না। 


✦কারণ কুরআনে কারীমে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন,

‘আর তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে কখনও তার জানাযার নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না। তাঁরা তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি কুফুরী করেছে এবং নাফরমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে।’


এ আয়াতে দেখা যায়, যারা কুফুরীর উপর মারা যায় তাদের কবরে দাঁড়ানোকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন, অথচ আল্লাহ পাক রাসূল (ﷺ) কে তাঁর মাতার কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়েছেন। যদি তিনি মুশরিক হতেন তাহলে তাঁকে এ অনুমতি দেওয়া হতো না।


তাছাড়া দ্বিতীয় হাদীসের ক্ষেত্রে এ কথাও প্রযোজ্য যে, ক্ষমা প্রার্থনার নিষেধাজ্ঞা ঈমান আনয়নের হাদীস দ্বারা মানসুখ।


আল্লাহ পাক আমাদের তাঁর হাবীবের প্রতি যথাযথ ঈমান আনার তাওফীক দান করুন এবং তাঁর সম্মানহানী হয় এমন ঈমানবিধ্বংসী মন্তব্য ও বিশ্বাস থেকে হিফাযত করুন। আমীন।

 
Top