আজকাল সম্মিলিতভাবে যিকির করাকে বিদাত বলতে শুনা যায় অথচ বুখারী মুসলিমেই সম্মিলিত যিকির জায়েজ হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণাদি বিদ্যমান রয়েছে। সরাসরি হাদিসে না গিয়েও মুসলিম শরীফের কয়েকটা পরিচ্ছেদের নাম দেখলেও কেউ এটাকে বিদাত বলার মত ভ্রষ্টতা কিংবা ধৃষ্টতা দেখানোর কথা না। কিন্তু ঐসব ভন্ড আলেমরা কি এসব দেখেনা!! নিশ্চয়ই এরা জানে কিন্তু গোপন করে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা'র-ই ঘোষণা মুনাফিকরা সৎকাজে বাধা প্রদান করে। আসুন আমরা সম্মিলিত যিকিরের পক্ষে কিছু প্রমাণাদি দেখে নিই।

আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) বলেন, মুয়াবিয়া (রাঃ) মসজিদে একটি হালকায় (মজলিসে) আসলেন। অতঃপর তিনি বললেন, কিসে তোমাদেরকে এখানে বসিয়েছে (তোমরা এখানে বসেছ কেন)? তারা বলল, আমরা আল্লাহর স্মরণ (যিকর) করতে বসেছি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এছাড়া আর কোন বিষয় তোমাদেরকে বসায়নি? (তোমরা কি শুধু এ জন্যেই বসেছ?) তারা বললেন, আল্লাহর কসম! এছাড়া অন্য কোন বিষয় আমাদেরকে বসায়নি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের প্রতি (মিথ্যার) সন্দেহ পোষণ (করে তা নিরসনের সে উদ্দেশ্যে) কসম করতে বলিনি। কোন ব্যক্তি এমন নেই, যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর নিকট আমার সমমর্যাদা লাভ করেছে এবং আমার থেকে কম হাদিস বর্ণনা করেছে।

(অতঃপর মুয়াবিয়া রাঃ বললেন) একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সাহাবাদের একটি ‘হালকা’র নিকটে গিয়ে বললেন, কিসে তোমাদের বসিয়েছে? তারা বলল, আমরা বসেছি আল্লাহর স্মরণ (যিকর) ও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। যেহেতু তিনি আমাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখিয়েছেন এবং আমাদের উপর তিনি ইহসান করেছেন। [উক্ত প্রসঙ্গে সূনান আন নাসাঈ ৫৪২৬ নং হাদিসে রয়েছে, তারা বললেনঃ আমরা আল্লাহ্‌র স্মরণে এবং তিনি যে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন এবং আপনাকে প্রেরণ করে আল্লাহ তা'আলা আমাদের উপর যে ইহসান (অনুগ্রহ) করেছেন তার শোকর আদায় করার জন্য বসেছি। (হ্যা, আমরাও সাহাবাদের অনুসরণে এভাবে মিলাদ মাহফিল তথা মজলিসের আয়োজন করে থাকি যেখানে জিকির, দরুদ ও সালাম, দোয়া ইত্যাদি হয়ে থাকে)]

তিনি ﷺ বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে কি শুধু এ বিষয়েই বসিয়েছে? তারা বললেন, আল্লাহর কসম! আমাদেরকে একমাত্র ঐ বিষয়ই বসিয়েছে। তিনি বললেন, আমি তোমাদের প্রতি (মিথ্যার) সন্দেহ পোষণ (করে তা নিরসনের সে উদ্দেশ্যে) কসম করতে বলিনি বরং আমার নিকট জিবরীল (আলায়হিস সালাম) এসে অবহিত করেছেন যে, আল্লাহ ফেরেশতাগণের নিকট তোমাদের মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করছেন। (সহীহ মুসলিম ৬৭৫০; বাবু ফাদ্বলি ইজতিমায়ি আ'লা তিলাওয়াতিল কুরআনি ওয়া আ'লায-যিকরি অর্থাৎ কুরআন পাঠ ও যিকরের জন্য একত্রিত হওয়ার মর্যাদা)

আবু হুরাইরা রাঃ ও আবূ সাঈদ আল খুদরী রাঃ
তারা উভয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নবী ﷺ বলেনঃ কোন সম্প্রদায় আল্লাহ'র যিকর করতে বসলে একদল ফেরেশতা তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়। আর তাদের উপর শান্তি নাযিল হয় এবং আল্লাহ তা’আলা তার নিকটস্থ ফেরেশতাগণের মধ্যে তাদের আলোচনা করেন।
(সহীহ মুসলিম ৬৭৪৮)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহর একদল ফেরেশতা আছেন, যাঁরা আল্লাহর যিকরে রত লোকেদের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়ান। যখন তাঁরা কোথাও আল্লাহর যিকরে রত লোকেদের দেখতে পান, তখন ফেরেশতারা পরস্পরকে ডাক দিয়ে বলেন, তোমরা আপন আপন কাজ করার জন্য এগিয়ে এসো। তখন তাঁরা তাঁদের ডানাগুলো দিয়ে সেই লোকদের ঢেকে ফেলেন নিকটবর্তী আসমান পর্যন্ত। তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন (যদিও ফেরেশতাদের চেয়ে তিনিই অধিক জানেন) আমার বান্দারা কী বলছে?

তখন তাঁরা বলে, তারা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছে, তারা আপনার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে, তারা আপনার গুণগান করছে এবং তারা আপনার মাহাত্ম্য প্রকাশ করছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? তখন তাঁরা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার শপথ! তারা আপনাকে দেখেনি। তিনি বলবেন, আচ্ছা, তবে যদি তারা আমাকে দেখত? তাঁরা বলবেন, যদি তারা আপনাকে দেখত, তবে তারা আরও অধিক পরিমাণে আপনার ‘ইবাদাত করত, আরো অধিক আপনার মাহাত্ম্য ঘোষণা করত, আরো অধিক পরিমাণে আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করত।

বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহ বলবেন, তারা আমার কাছে কী চায়? তাঁরা বলবে, তারা আপনার কাছে জান্নাত চায়। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফেরেশতারা বলবেন, না। আপনার সত্তার কসম! হে রব! তারা তা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা দেখত তবে তারা কী করত? তাঁরা বলবে, যদি তারা তা দেখত তাহলে তারা জান্নাতের আরো অধিক লোভ করত, আরো বেশি চাইত এবং এর জন্য আরো বেশি বেশি আকৃষ্ট হত।। আল্লাহ্ তা‘আলা জিজ্ঞেস করবেন, তারা কী থেকে আল্লাহর আশ্রয় চায়? ফেরেশতাগণ বলবেন, জাহান্নাম থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? তাঁরা জবাব দেবে, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা জাহান্নাম দেখেনি।

তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা তা দেখত তখন তাদের কী হত? তাঁরা বলবে, যদি তারা তা দেখত, তাহলে তারা তাত্থেকে দ্রুত পালিয়ে যেত এবং একে অত্যন্ত বেশি ভয় করত। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বলবেন, আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। তখন ফেরেশতাদের একজন বলবে, তাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি আছে, যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং সে কোন প্রয়োজনে এসেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলবেন, তাদের সাথে বসা কোন ব্যক্তিই তা থেকে বঞ্চিত হবে না (তারা তো এমন একটি কওম যাদের সঙ্গীরা দুর্ভাগা হয় না)। (সহীহ বুখারী ৬৪০৮)

উক্ত হাদিস সহীহ মুসলিমের "যিকর, দু’আ, তাওবাহ ও ইস্তিগফার" অধ্যায়ের "বাবু ফাদ্বলি মাজালিশিয-যিকর" তথা যিকিরের মজলিসের ফযীলত পরিচ্ছেদে এভাবে এসেছে,

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ'র একদল ভ্রাম্যমান বিশেষ ফিরিশতা আছে। তারা যিকরের মজলিসসমূহ অনুসন্ধান করে বেড়ায়। তাঁরা যখন কোন যিকরের মজলিস পায় তখন সেখানে তাদের (যিকিরকারীদের) সঙ্গে বসে যায়। আর তারা একে অপরকে তাদের পাখা বিস্তার করে বেষ্টন করে নেয়। এমনিভাবে তাঁরা তাদের ও নিকটবর্তী আসমানের ফাঁকা স্থান পূর্ণ করে ফেলে।... (সহীহ মুসলিম ৬৭৩২)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমরা যখন জান্নাতের বাগানে যাবে, তখন তোমরা বাগানের ফল খাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ﷺ! জান্নাতের বাগান কি? তিনি বললেন, যিকিরের হালকা বা মজলিশ।(মিশকাতুল মাসাবীহ ২২৭১, সূনান আত তিরমিযী ৩৫১০, মুসনাদে আহমাদ ১২৫২৩, শু‘আবূল ঈমান ৫২৬) (হাসান লিগয়রিহী)

সুতরাং প্রমাণিত হল একত্রিত হয়ে যিকির করলে কিংবা যিকিরের মজলিশ সাজানোতে কোন বাধা কিংবা নিষেধাজ্ঞা নেই।

আবার এটাও দেখা যায় যে, অনেকেই কুরআনের কিছু আয়াত এবং হাদিসকে উপস্থাপন করে এটা প্রমাণ করতে চায় যে, উচ্চৈঃস্বরে যিকির করা নাজায়েজ বা বিদাত। বস্তুত, যিকির উচ্চৈঃস্বরে হোক আর নিম্নস্বরে হোক উভয়ভাবেই জায়েজ।

ইবনে ‘আববাস (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী ﷺ এঁর সময় (যুগে) মুসল্লীগণ ফরজ নামাজ শেষ হলে উচ্চঃস্বরে যিকর করতেন। ইবনে ‘আববাস (রাঃ) বলেন, আমি এরূপ শুনে বুঝতাম, মুসল্লীগণ নামাজ শেষ করেছেন (যখন ইবনে আব্বাস রাঃ কম বয়সী ছিলেন)। (সহীহ বুখারী ৮৪১)

জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, একদা রাতের বেলায় কবরস্থানে আলো দেখতে পেয়ে লোকেরা সেখানে এসে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কবরের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলো। তিনি বললেনঃ তোমাদের সাথীকে আমার কাছে দাও (কবরে রাখার জন্য)। আর তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহর যিকির করতেন। (সুনান আবূ দাউদ ৩১৬৪)

নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহ. বলেন, জামাআতে যিকির করলে আওয়াজ তো হবেই। উনার "আল হাবী লিল ফাতাওয়া" থেকে আরো জানা যায় যে,

ইমাম জালালুদ্দিন সূয়ুতী রহঃ উচ্চৈঃস্বরে জিকির করা সম্পর্কে বলেন, প্রকৃতপক্ষে এতে (উচ্চৈঃস্বরে যিকিরে) অপছন্দের কিছুই নেই। তিনি উচ্চস্বরে এবং নিম্নস্বরে উভয়ভাবে জিকিরের কথা হাদিসে আছে বলে উল্লেখ করেন এবং উভয় পদ্ধতিকেই সঠিক তথা জায়েজ বলে উল্লেখ করেন। 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন, 

"যারা ঈমান আনে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ প্রশান্ত হয়।" (সূরা রা'দঃ ২৮)

"যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে।" (সূরা তাওবাহ ৪৭)

"আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা যমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না’, তারা বলে, 'আমরা তো কেবল সংশোধনকারী।" (সূরা বাকারাহঃ ১১)

"এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।" (সূরা মুনাফিকুনঃ ১)

"সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু এরা তা অনুভব করতে পারে না।" (সূরা বাকারাহঃ ১২)

"আল্লাহ ও ঈমানদারদের তারা ধোঁকা দিতে চায়,আসলে তারা অন্য কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না বরং নিজেদেরই প্রতারিত করছে,অথচ তাদের সে অনুভূতি নেই।" (সূরা বাকারাহ ৯)

"তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আর এ উপায়ে তারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করে তা কতই না মন্দ! তা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছিল তারপর কুফরী করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না।" (সূরা মুনাফিকুন ২, ৩)

"যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে আমি কি তাদেরকে যমীনে বিপর্যয় (ফ্যাসাদ) সৃষ্টিকারীদের সমতুল্য গণ্য করব? নাকি আমি মুত্তাকীদেরকে পাপাচারীদের সমতুল্য গণ্য করব?" (সূরা ছোয়াদ ৩৮ঃ ২৮)

"সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহগুলোকে স্মরণ করো এবং পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না।" (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৭৪)

"ওহে যারা ঈমান এনেছ! ভালো বিষয়গুলো যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য বৈধ করেছেন সেসব তোমরা নিষিদ্ধ করো না, আবার বাড়াবাড়িও (সীমালঙ্ঘন) করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ভালোবাসেন না সীমালঙ্ঘন কারীদের।" (সূরা আল মায়িদাহঃ ৮৭)
 
Top