কারবালার ঘটনাবলী
(শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারবাহিকভাবে)


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
সাইয়্যিদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পরিচয়:
সাইয়্যিদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর চতুর্থ হিজরীর শা’বান মাসের ৫ তারিখ মদীনা শরীফ-এ বিলাদত শরীফ লাভ করেন। বিলাদত শরীফ-এর পর সরকারে মদীনা, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কানে আযান দিয়ে দুআ করেছিলেন। সাতদিন পর আকীকা করে উনার নাম মুবারক ‘হুসাইন’ রাখা হয়েছিল।

হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত আছে-
الحسن والحسين اسمان من اهل الجنة
অর্থ: ‘হাসান ও হুসাইন জান্নাতী নামসমূহের দু’টি নাম।‘ এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু’ নামের প্রচলন ছিল না।

হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খুবই প্রিয় ছিলেন। আপন সন্তান থেকেও উনাদেরকে অধিক ভালবাসতেন।

হযরত আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, একদিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাকে ডানে ও স্বীয় ছাহেবজাদা হযরত ইব্রাহীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাকে বামে বসিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহ তায়ালা উনাদের দু’জনকে আপনার কাছে এক সঙ্গে থাকতে দেবেন না। উনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। অতএব আপনি উনাদের দু’জনের মধ্যে এ ব্যপারে যিনাকে ইচ্ছা পছন্দ করুন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যদি হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি বিদায় নেন, তাহলে উনার বিরহে হযরত ফাতিমাতুয যাররা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাদের খুবই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুণ হবে। আর যদি হযরত ইব্রাহীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনি বিছাল শরীফ লাভ করেন, তাহলে সবচে দুঃখ একমাত্র আমিই পাবো। এজন্য নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমি পছন্দ করি। এ ঘটনার তিন দিন পর হযরত ইব্রাহীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বিছাল শরীফ লাভ করেন।

এরপর থেকে যখনই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সমীপে আসতেন তিনি উনাকে মুবারকবাদ দিতেন এবং উনার কপাল মুবারকে চুমু দিতেন এবং উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বলতেন, আমি হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর জন্য আপন সন্তান ইব্রাহীম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উনাকে কুরবানী দিয়েছি।’(শাওয়াহিদুন্ নুবুওওয়াত)

হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন অবস্থায় বাইরে তাশরীফ আনলেন যে, উনার এক কাঁধের উপর হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনাকে এবং অন্য কাঁধের উপর হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাকে বসিয়ে ছিলেন।

এভাবে আমাদের সামনে তাশরীফ আনলেন এবং ইরশাদ করলেন-
من احبهما فقد احبنى ومن ابغضهما فقد ابغضنى
অর্থ: ‘যে উনাদের দু’জনকে মুহব্বত করলো, সে আমাকে মুহব্বত করলো। আর যে উনাদের সাথে দুশমনী করলো, সে আমার সাথে দুশমনী করলো।’

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিলাদত শরীফ-এর কিছু দিন পরই উনার শাহাদাতের কথা সবার কাছে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ফাতিমাতুয যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা, অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও আহলে বাইত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-উনাদের সংশ্লিষ্ট সকলেই হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার শৈশবাবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, উনাকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং কারবালার ময়দান উনার রক্তে রঞ্জিত হবে। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে।

হযরত উম্মুল ফজল বিনতে হারিছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা (হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আহলিয়া) বলেন, আমি একদিন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে উপস্থিত হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে উনার কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, এর কারণ কী ?

ইরশাদ করলেন, আমার কাছে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে এ খবর দিয়ে গেলেন-
ان امتى ستقتل ابنى هذا
‘নিশ্চয়ই আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।’ হযরত উম্মুল ফজল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এ শিশুকে শহীদ করবে? হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম শাহাদাত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন।

হযরত ইবনে সা’দ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শা’বী রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জঙ্গে সিফফীনের সময় কারবালার পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই জায়গার নাম জানতে চাইলেন। লোকেরা বললেন, এ জায়গার নাম কারবালা। কারবালার নাম শুনামাত্র তিনি এত কান্নাকাটি করলেন যে, চোখের পানিতে মাটি ভিজে গিয়েছিল। অতঃপর ফরমালেন, আমি একদিন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম, তিনি কাঁদছেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কেন কাঁদছেন?

ইরশাদ করলেন, এইমাত্র হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এসে আমাকে খবর দিয়ে গেলেন-
ان ولدى الحسين يقتل بشاطئ الفرأت بموضع يقال له كربلا
আমার ছেলে (দৌহিত্র) হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ফোরাত নদীর তীরে যে জায়গায় শহীদ করা হবে, সে জায়গার নাম কারবালা।’ (সাওয়ায়িকে মুর্হারাকাহ)

আর সত্যি সত্যিই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ভবিষ্যদ্বাণী মুতাবিক হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন।

ইয়াযীদের মসনদ দখল:

আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বিছাল শরীফ-এর পর ইয়াযীদ সিংহাসনে আরোহন করলো এবং আরোহন করার সাথে সাথেই তার মনের মধ্যে সীমাহীন অহঙ্কার ও গর্ববোধের সৃষ্টি হলো। যার ফলে এমন কাজ-কর্ম শুরু করলো, যা মহান দ্বীনী শরীয়তের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রায় মানুষ-ই ক্ষমতার মোহে বিভোর হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। যেমন; ফিরআউন প্রথমে গরীব ছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাদ্শা হয়ে সিংহাসনে আরোহন করার সাথে সাথে এমন অহঙ্কারী হয়ে বসলো যে, শেষ পর্যন্ত নিজেকে খোদা বলে ঘোষণা করলো (নাঊযুবিল্লাহ) । সে বলতে লাগলো, ‘আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় খোদা’। আমার পূজা, আরাধনা কর। সে-ই রক্ষা পাবে যে আমার পূজা করবে। আর যে আমার পূজা করতে অস্বীকার করবে, তাকে আমি খতম করবো। একমাত্র এ কারণেই সে অনেক লোকের গর্দান দ্বিখন্ডিত করেছিল। তাঁদের অপরাধ ছিলো, তাঁরা তার পূজা করতেন না এবং তাকে মা’বূদ মানতে অস্বীকার করেছিলেন। তদ্রুপ ইয়াযীদও যখন সিংহাসনে বসলো, সে ক্ষমতায় আরোহন করার পর পরই হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রমুখ থেকে বাইয়াত তলব করলো। একেতো উনারা ছিলেন ছাহাবী, বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি এবং উনারা বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বংশধর ছিলেন। তাই তাঁরা কিভাবে ফাসিক-ফাজির ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করতে পারেন? সুতরাং তাঁরা অস্বীকার করলেন এবং এটা তাঁদের মর্যাদাগত সদাচরণই ছিল। অস্বীকার করার পর হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফে চলে গেলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মদীনা শরীফ-এর গভর্নর ওয়ালীদের আহবানে তার দরবারে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে আলোচনা করলেন। মদীনা শরীফ-এর গভর্নর বললো, ইয়াযীদ আপনার বাইয়াত তলব করেছেন। তিনি বললেন, ‘আমি ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করতে পারি না। ইয়াযীদ হলো ফাসিক-ফাজির, এ ধরণের অনুপযুক্ত লোকের হাতে আমি বাইয়াত করতে পারি না। আমি কোন অবস্থাতেই তার হাতে বাইয়াত করতে রাজী নই।’ তিনি সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন। এটা তাঁর মর্যাদাগত সদাচরণই ছিল।
উল্লেখ্য, তিনি যদি বাইয়াত করতেন, তাহলে নিজের প্রাণ বাঁচতো, পরিবার-পরিজন বাঁচতো, হয়তো এমনও হতো যে, অগাধ সম্পত্তির মালিকও তিনি হয়ে যেতেন। কিন্তু ইসলামের আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য বৈধ হয়ে যেত এবং তাদের কাছে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আনুগত্য প্রধান দলীল হিসেবে পরিগণিত হতো। লোকেরা বলতো, হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য স্বীকার করেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা জায়িয।
কারবালার ঘটনা:

হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে কূফাবাসীর চিঠি:

মক্কা শরীফ আগমনের সাথে সাথে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে কূফা থেকে লাগাতার চিঠিপত্র এবং সংবাদ-বাহক আসতে শুরু করলো। অল্প সময়ের মধ্যে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে দেড়শত চিঠি এসে পৌঁছল। উলামায়ে কিরাম-এর কেউ কেউ তাঁদের কিতাবে বারশত চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য কিতাবে দেড়শত চিঠির কথা উল্লিখিত হয়েছে। দেড়শত চিঠিই বিশেষ নির্ভরযোগ্য। কারণ সেই যুগে ডাক আদান-প্রদান অত সহজ ছিল না। লোকেরা চিঠি-পত্র, পত্র-বাহকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো এবং পত্র-বাহক পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে গন্তব্যস্থানে চিঠি পৌঁছিয়ে দিত। এমতাবস্থায় দেড়শত চিঠি পৌঁছাটা অতটা সহজ ব্যাপার ছিল না।

যা হোক, হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে দেড়শত চিঠি পৌঁছেছিল। প্রত্যেক চিঠির বিষয়বস্তু খুবই আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিষয়বস্তুগুলো হচ্ছে এরকম, “হে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমরা আপনার সম্মানিত পিতা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারই অনুসারী এবং আহলে বাইত-এর ভক্ত। আমরাতো হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সমর্থন করিনি। তাঁর অনুপযুক্ত ছেলে ইয়াযীদকে মানার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা আপনার পিতা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও আপনার ভাই হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সমর্থনকারী। আমরা ইয়াযীদের অনুসারী নই। ইয়াযীদ এখন তখতারোহন করেছে, কিন্তু আমরা ইয়াযীদকে খলীফা বা ইমাম মানতে পারি না। আপনাকেই বরহক ইমাম, বরহক খলীফা মনে করি। আপনি মেহেরবানী করে কূফায় তাশরীফ আনুন। আমরা আপনার হাতে বাইয়াত করবো এবং আপনাকে খলীফা হিসেবে গ্রহণ করবো। আপনার জন্য আমাদের মাল-জান কুরবান করতে প্রস্তুত এবং আপনার হাতে বাইয়াত করে আপনার অনুসরণে জিন্দেগী অতিবাহিত করতে ইচ্ছুক। তাই আপনি আমাদের কাছে তাশরীফ আনুন। আমাদের প্রতি মেহেরবানী করুন এবং আমাদেরকে আপনার ছোহবতে রেখে আপনার ফয়েজ-বরকত দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করুন”।

সমস্ত কাবিলা খানদানের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে এই ধরণের চিঠি এসেছিল। অনেকেই এই ধরণের চিঠিও লিখেছিল, “হে মহান ইমাম, আপনি যদি আমাদের কাছে না আসেন, আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করতে হবে; কারণ সরকারের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাল কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ্ তা’য়ালা যখন জিজ্ঞেস করবেন- কেন আমরা নালায়েক ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম, তখন আমরা পরিস্কার বলব, হে মওলা! আমরা আপনার পেয়ারা রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম-এর দৌহিত্রের কাছে চিঠি লিখেছিলাম, সংবাদ পাঠিয়েছিলাম, মাল-জান কুরবানী করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি তাশরীফ আনেননি এবং আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করেননি। তিনি যখন অগ্রাহ্য করলেন, আমরা বাধ্য হয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করেছি। তাই হে ইমাম! আপনি স্মরণ রাখবেন, আমাদের এ বাইয়াতের জন্য আপনিই দায়ী হবেন।”

হযরত ইমাম মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কূফা গমন:

কূফাবাসীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের চিঠি লিখার পরিপ্রেক্ষিতে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু চিন্তা করলেন যে, সেখানে তিনি যাবেন কি না। তিনি অনেকের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, প্রথমে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা যাচাই করে দেখবেন যে, ওরা বাস্তবিকই উনাকে চায় কি না? উনার প্রতি সত্যিই আন্তরিক মুহব্বত ও বিশ্বাস আছে কি না? সঠিক সংবাদ পাওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন, তিনি যাবেন কি যাবেন না।
অতঃপর তিনি তাঁর চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে এ কাজের জন্য মনোনীত করলেন এবং ফরমালেন, প্রিয় মুসলিম! কূফা থেকে যেভাবে চিঠি আসছে তা যাচাই করে দেখার জন্য তোমাকে আমার প্রতিনিধি করে সেখানে পাঠানোর মনস্থ করেছি। তুমি সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা উপলব্ধি এবং যাচাই করে যদি অবস্থা বাস্তবিকই সন্তোষজনক মনে কর, তাহলে আমার কাছে চিঠি লিখবে। চিঠি পাওয়ার পর আমি রওয়ানা হবো, অন্যথায় তুমি সেখান থেকে চলে আসবে। তাঁর চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম কূফাবাসীদের কাছে একটি চিঠি লিখলেন- ‘ওহে কূফাবাসী! পরপর তোমাদের অনেক চিঠি আমার কাছে পৌঁছেছে। তাই আমি আমার চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে আমার প্রতিনিধি করে তোমাদের কাছে পাঠালাম। তোমরা সবাই তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাঁর খিদমত করো। তিনি তোমাদের মনোভাব যাচাই করে আমার কাছে চিঠি লিখবেন, যদি তোমাদের মনোভাব সন্তোষজনক হয়, তাঁর চিঠি আসার পর পরই আমিও তোমাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাব।’ এভাবে চিঠি লিখে সীল মোহর লাগিয়ে হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে দিলেন এবং উনাকে বিদায় দিলেন। হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দুই ছেলে হযরত মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইব্রাহীম রহমতুল্লাহি আলাইহিও তৈরি হয়ে গেলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, আব্বাজান! আমাদেরকে ফেলে যাবেন না, আমাদেরকেও সাথে নিয়ে যান। হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ছেলেদের অন্তরে আঘাত দিতে চাইলেন না। তাই তাঁর ছেলেদ্বয়কেও সাথে নিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ গেলেন এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করার পর কূফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।

হযরত ইমাম মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি প্রাণঢালা সংবর্ধনা:

কূফায় পৌঁছে মুখতার বিন উবায়দুল্লাহ সাক্ফী, যে আমন্ত্রণকারীদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল ও আহলে বাইত-এর অনুরক্ত ছিল, তার ঘরেই হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাশরীফ রাখলেন। যখন কূফাবাসীরা খবর পেল যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। তখন কূফাবাসীরা দলে দলে এসে তাঁর হাতে বাইয়াত হতে লাগলো। অল্প দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার লোক তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে গেল এবং এমন ভালবাসা ও মুহব্বত দেখালো যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁর পিছে পিছে লোক চলাফেরা করছে, দিন-রাত মেহমানদারী করছে, তাঁর হাতে-পায়ে চুম্বন করছে এবং একান্ত আনুগত্যের পরিচয় দিচ্ছে। এতে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হলেন এবং মনে মনে বললেন, এরাতো সত্যিই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড়ই আশিক এবং উনার জন্য একেবারে ফানা। তিনি ভাবলেন, আমাকে পেয়ে তাদের যে অবস্থা হয়েছে, জানিনা, হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসলে তারা কী যে অবস্থা করবে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সমস্ত অবস্থার বর্ণনা দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে চিঠি লিখলেন- “চল্লিশ হাজার লোক আমার কাছে বাইয়াত হয়েছে, সব সময় আমার সাথে সাথে রয়েছে, আমার যথেষ্ট খিদমত করছে এবং তাদের অন্তরে আপনার প্রতি অসীম মুহব্বত রয়েছে। তাই আপনি আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসুন। এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক।” এভাবে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নিকট চিঠি লিখলেন। এদিকে পত্র-বাহক পত্র নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। আর ঐদিকে দেখুন, তক্দীরে যা লিখা ছিল, তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

লাইক দিয়ে এক্টিভ থাকুন । কমেন্ট করুন । শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিন । ।
.
.

কিন্তু ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অস্বীকারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করে দিলেন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শত কষ্ট-যাতনা ভোগ করতে পারেন, অনেক বিপদ-আপদের মুকাবিলা করতে পারেন, এমন কী আপন পরিজনের সমস্ত লোকদের নির্দয়ভাবে শহীদ হওয়াটা অবলোকন করতে পারেন; নিজেও জালিমদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করতে পারেন, কিন্তু ইসলামের নিযাম বা বিধান ছত্রভঙ্গ হওয়া কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। নিজের নানাজান হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দ্বীন ধ্বংস হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের কাজ ও কর্মপন্থা দ্বারা তা প্রমাণ করেছেন এবং দুনিয়াবাসীকে এটা দেখিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালার মনোনীত ও খাছ বান্দাগণের এটাই শান যে, বাতিলের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং তীর তলোয়ারের সামনে বুক পেতে দেন, কিন্তু কখনও বাতিলের সামনে মাথা নত করেন না। হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের আমল দ্বারা তাঁর উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দান করেছেন এবং জনগণের সামনে নিজের পদমর্যাদা তুলে ধরেছেন।

হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মক্কা শরীফ-এর উদ্দেশ্যে মদীনা শরীফ ত্যাগ:

হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এভাবে মদীনা শরীফ-এর গভর্নর ওলীদের বেয়াদবীপূর্ণ প্রস্তাব অস্বীকার করে যখন তার দরবার থেকে নিজের আপনজনদের কাছে ফিরে আসলেন এবং সবাইকে একত্রিত করে বললেন, আমার প্রিয়জনেরা! যদি আমি পবিত্র মদীনা শহরে অবস্থান করি, এরা আমাকে ইয়াযীদের বাইয়াত করার জন্য বাধ্য করবে, কিন্তু আমি কখনও বাইয়াত গ্রহণ করতে পারবো না। তারা বাধ্য করলে নিশ্চয়ই যুদ্ধ হবে, ফাসাদ হবে; কিন্তু আমি চাইনা আমার কারণে মদীনা শরীফ-এ লড়াই বা ফাসাদ হোক। আমার মতে, এটাই সমীচীন হবে যে, এখান থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফ-এ চলে যাওয়া। নিজের আপনজনেরা বললেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক; আমাদেরকে যা হুকুম করবেন তাই মেনে নেব।’ অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আহ! অবস্থা কেমন সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল যে, ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সেই মদীনা শরীফ ত্যাগ করতে হচ্ছিল, যে মদীনা শরীফ-এ হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ অবস্থিত। তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার টাকা পয়সা ব্যয় করে, আপনজনদের বিরহ-বেদনা সহ্য করে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আসে এই পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারায়। কিন্তু আফসুস, আজ সেই মদীনা শরীফকে তিনি ত্যাগ করছেন, যেই মদীনা শরীফ ছিল উনারই। নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নয়নের মণি, আদরের দুলাল ছিলেন তিনি। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা পাক-এ উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুমতি নিয়ে আত্মীয়-পরিজন সহকারে ৬০ হিজরী ৪ঠা শা’বান তারিখে মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফ-এ চলে গেলেন।
মক্কা শরীফ-এ গমনের কারণ
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান-
ومن دخله كان امنا
অর্থ: ‘যে হেরেম শরীফ-এ প্রবেশ করলো, সে নিরাপদ আশ্রয়ে এসে গেল।’ (সূরা আলে ইমরান-৯৭) কেননা হেরেম শরীফ-এর অভ্যন্তরে ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী নাজায়িয ও হারাম। এমনকি হেরেম শরীফ-এর সীমানায় উঁকুন মারা পর্যন্ত নিষেধ। তবে সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি মারতে পারে। কিন্তু যে সব পশু-পাখি মানুষের কোন ক্ষতি করে না সেগুলো মারা জায়িয নেই। আর মু’মিনদের ইজ্জত-সম্মান তাঁদের শান-মান এটাতো অনেক ঊর্ধ্বের বিষয়। তাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম চিন্তা করলেন যে, হেরেম শরীফ-এর অভ্যন্তরে যেহেতু ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী নিষেধ সেহেতু কেউ আমার সাথে এখানে ঝগড়া-বিবাদ করতে আসবে না। তাই হেরেম শরীফ-এর সীমানায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত বন্দেগীতে বাকী জীবন কাটিয়ে দেব। এ মনোভাব নিয়ে তিনি মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ-এ চলে আসলেন।
কূফাবাসীর বেঈমানী:

ইয়াযীদের অনুসারীদের মধ্যেও অনেকে কূফায় অবস্থান করতো। তারা যখন দেখলো, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর হাতে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছে, তখন তারা ইয়াযীদকে এ ব্যাপারটা জানিয়ে উস্কানীমূলক চিঠি দিল। তারা ইয়াযীদকে লিখলো যে, ওহে ইয়াযীদ! তুমিতো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছো, আর এদিকে তোমার বিরুদ্ধে কূফায় বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে, যা তোমার পক্ষে প্রতিরোধ করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। তোমারতো খবরই নেই, তোমার বিরুদ্ধে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে এবং আরও লোক বাইয়াত হচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে এখান থেকে এমন এক ভয়ানক ঝড়-তুফানের সৃষ্টি হবে, যা তোমাকে খড়-কুটার ন্যায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাই তুমি যেভাবেই হোক এটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করো।’ যখন ইয়াযীদ চিঠির মাধ্যমে এ খবর পেল, সে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো। সে অবহিত আছে যে, রাজ-ক্ষমতা বড় জিনিস। কেউ নিজ ক্ষমতা সহজে ত্যাগ করতে চায় না। আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই ক্ষমতা, সেই সিংহাসন আঁকড়ে রাখতে চায়। তাই ইয়াযীদের কাছেও যখন তার রাজত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে হলো, তখন কূফার গভর্নর ‘নোমান বিন বশীর’ যিনি হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার নেননি, তাকে পদচ্যূত করলো এবং তার স্থলে ইবনে যিয়াদ যার আসল নাম ছিল ‘উবাইদুল্লাহ’ যে বড় যালিম ও কঠোর ব্যক্তি ছিল এবং যে বছরার গভর্নর ছিল, তাকে কূফার গভর্নর নিয়োগ করলো এবং তার কাছে চিঠি লিখলো- ‘তুমি বছরার গভর্নরও থাকবে, সাথে সাথে তোমাকে কূফারও গভর্নর নিয়োগ করা হলো। তুমি শীঘ্রই কূফা এসে আমার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেভাবে হোক দমিয়ে ফেলো, এ ব্যাপারে যা করতে হয়, তা করার জন্য তোমাকে পূর্ণ ইখতিয়ার দেয়া হলো। যেভাবেই হোক, যে ধরনের পদক্ষেপই নিতে হোক না কেন, এ বিদ্রোহকে নির্মূল করে দাও।’ ইবনে যিয়াদ ইয়াযীদের পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কূফায় আসলো। সে কূফায় এসে সর্বপ্রথম যে কাজটা করলো, তা হচ্ছে যতগুলো বড় বড় সর্দার ছিল এবং যারা হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সাথে ছিল ও বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেললো এবং বন্দী করার পর কূফার গভর্নর হাউজে নজরবন্দী করে রাখলো। তাদের এই বন্দীর কথা বিদ্যুৎ বেগে সমগ্র কূফায় ছড়িয়ে পড়লো এবং এতে সমস্ত লোক হতভম্ব ও মর্মাহত হলো। সবাই চিন্তিত হলো, এখন কি করা যায়? সমস্ত বড় বড় সর্দারকে বন্দী করছে এবং অনেককে বন্দী করে ফেলেছে। এমনকি হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিকেও বন্দী করার কৌশল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।
যখন হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি দেখলেন যে, বড় বড় সর্দারদেরকে বন্দী করা হয়েছে এবং আরও নতুন-নতুন বন্দী করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন তিনি তাঁর সমস্ত অনুসারী ও বাইয়াত গ্রহণকারীদের আহবান করলেন। তাঁর ডাকে সাথে সাথে সবাই এসে সমবেত হয়ে গেল। ঐ চল্লিশ হাজার ব্যক্তি যারা তাঁর হাতে বাইয়াত করেছিল, তারা সবাই সমবেত হলো। তিনি তাদের হুকুম দিলেন, গভর্নর ভবন ঘেরাও করো। হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই চল্লিশ হাজার অনুসারীদেরকে নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। তখন অবস্থা এমন উত্তপ্ত ছিল, তিনি একটু ইশারা করলে ঐ চল্লিশ হাজার লোক এক মূহূর্তের মধ্যে গভর্নর ভবন ধুলিস্যাৎ করে ফেলত এবং ইবনে যিয়াদ এর কোন প্রতিরোধ করতে পারতো না। কারণ, ঐ চল্লিশ হাজার লোকের মোকাবেলা করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। এমনকি তখন তার কাছে এত সৈন্যও ছিল না। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন, তা দেখে ইবনে যিয়াদ খুবই ভয় পেল। তবে সে চালাকী ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিল। যেসব বড় বড় সর্দারদেরকে গভর্নর ভবনে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল, তাদের সবাইকে একত্রিত করে বললো, দেখুন আপনারা যদি আপনাদের পরিবার-পরিজনের মঙ্গল চান তাহলে আমার পক্ষ অবলম্বন করুন। আমাকে সহযোগিতা করুন। নচেৎ আমি আপনাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং আপনাদের পরিবারের ও আপনাদের সন্তান-সন্ততিদের যে কঠিন পরিণতি হবে, তা দুনিয়াবাসী দেখবে। অতঃপর বড় বড় সর্দারেরা বললো, আপনি কি চান? কি ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা চান? ইবনে যিয়াদ বলল- যারা এ মুহূর্তে গভর্নর ভবন ঘেরাও করে রেখেছে, তারা হয়তো আপনাদের ছেলে হবে বা ভাই হবে বা অন্য আত্মীয় স্বজন হবে। আমি এখন আপনাদেরকে গভর্নর ভবনের ছাদের উপর উঠাচ্ছি, আপনারা নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডেকে বুঝান, যেন তারা ঘেরাও প্রত্যাহার করে নেয় এবং হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গ ত্যাগ করে। যদি আপনারা এই রকম না করেন, তাহলে সবার আগে আপনাদের হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং অতি সহসা আমার যে সৈন্য বাহিনী আসছে তারা কূফা আক্রমণ করবে, আপনাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং আপনাদের শিশুদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠানো হবে অর্থাৎ আপনাদের কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। তাই আমি আপনাদেরকে বলছি- আমার পক্ষ অবলম্বন করুন, যদি নিজের এবং পরিবার পরিজনের মঙ্গল চান।
এভাবে যখন সে হুমকি দিল তখন বড় বড় সর্দারেরা ঘাবড়িয়ে গেল এবং সবাই বলতে লাগল, ইবনে যিয়াদ! আপনি যা করতে বলেন আমরা তাই করবো। ইবনে যিয়াদ বললো, চলুন, ছাদে উঠুন এবং আমি যেভাবে বলি সেভাবে করুন। সর্দারেরা সাথে সাথে ছাদের উপর উঠলো এবং নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডাকতে লাগলো। ডেকে চুপি চুপি বুঝাতে লাগলো, দেখ, ক্ষমতা এখন ইয়াযীদের হাতে, সৈন্য বাহিনী ইয়াযীদের হাতে, অস্ত্র-শস্ত্র, ধন-সম্পদ ইয়াযীদের হাতে। হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অবশ্যই রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর। কিন্তু তাঁর কাছে না আছে রাজত্ব, না আছে সম্পদ, না সৈন্য-সামন্ত, না অস্ত্র-শস্ত্র। তাই তিনি সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্র-শস্ত্র ও ধন সম্পদ ব্যতিরেকে কিভাবে ইয়াযীদের মোকাবিলা করবেন? মাঝখানে আমরা বিপদগ্রস্ত হবো। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। তাই তোমরা এখন এ ঘেরাও উঠিয়ে নাও এবং হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গ ছেড়ে দাও। স্মরণ রেখ, তোমরা যদি এরকম না করো, তাহলে না তোমরা আমাদের মুখ দেখবে আর না আমরা তোমাদের মুখ দেখবো। আমাদেরকে এখনি কতল করে ফেলবে আর তোমাদের পরিণামও খুব ভয়াবহ হবে।

যখন বড় বড় সর্দারেরা নিজ নিজ আপন জনদেরকে বুঝাতে ও পরামর্শ দিতে লাগলো, তখন লোকেরা অবরোধ ছেড়ে দিয়ে নীরবে চলে যেতে লাগলো। দশ-বিশজন করে এদিক-ওদিক থেকে লোক চলে যেতে লাগলো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করেছিলেন কিন্তু আসরের পর মাগরিবের আগে মাত্র পাঁচশ জন লোক ছাড়া বাকী সব চলে গেল। এতে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি ভাবলেন, চল্লিশ হাজার লোক থেকে সাড়ে ঊনচল্লিশ হাজার চলে গেছে, কেবল পাঁচশ জন রয়ে গেল, তাদের উপরও বা কতটুকু আস্থা রাখা যায়? হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন এ অবস্থা দেখলেন, তখন যে পাঁচশ জন ছিল, তিনি তাদেরকে বললেন, চলুন আমরা জামে মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামায আদায় করি। নামাযের পর পরামর্শ করব- কি করা যায়? সবাই বললেন, ঠিক আছে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি পাঁচশ লোককে নিয়ে মসজিদে গেলেন। তখন নামাযের সময় হয়ে গেছে। আযান হয়েছে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। পাঁচশ জন পিছনে ইক্তিদা করলো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিন রাকায়াত ফরয নামায পড়ার পর যখন সালাম ফিরালেন, তখন দেখলেন, ঐ পাঁচশ জনের মধ্যে একজনও নেই।

আশ্চর্য! সকালে চল্লিশ হাজার লোক সাথে ছিল, এখন মাগরিবের পরে একজনও নেই! এরা তারাই, যারা নিজেদেরকে আহ্লে বাইত-এর একান্ত ভক্ত বলে দাবি করতো, যাদের পূর্ব পুরুষেরা আহ্লে বাইত-এর অনুসারী দাবীদার ছিল। এরাই চিঠি লিখেছিল, এরাই হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে কূফায় আসার জন্য আহবান জানিয়েছিল, এরাই জান-মাল কুরবানীর জন্য নিশ্চয়তা দিয়েছিল! এরাই হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল এবং বড় বড় শপথ করে ওয়াদা করেছিল যে, তারা জান দেবে তবুও তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করবে না। কিন্তু তাদের প্রাণও দিতে হলো না, তীর দ্বারা আহতও হতে হলো না, না তরবারি দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলো, কেবল ইবনে জিয়াদের ধমকেই হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গ ছেড়ে দিল এবং বিশ্বাসঘাতকতা করলো!
হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি নামায শেষে আল্লাহ পাককে স্মরণ করছিলেন এবং মনে মনে ভাবছিলেন, এখন কী করা যায়? সব লোকতো আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আর এদিকে আমিতো হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে চিঠি লিখে দিয়েছি যে, এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। এখানকার লোকদের মনে তাঁর প্রতি আন্তরিক ও অসীম মুহব্বত রয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক মুহূর্তও বিলম্ব করবেন না। তিনি খুব তাড়াতাড়ি এসে যাবেন। তখন কী যে প্রতিক্রিয়া হবে, যখন এসে দেখবেন এসব লোকেরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এসব চিন্তা-ভাবনা নিয়ে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজ মুরীদের কাছে গেলেন। কিন্তু যেই মুরীদের কাছেই গেলেন, দেখলেন যে, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করার পরও ঘরের দরজা খুলছে না। অথচ এরাই ঐসব লোক, যারা বড় বড় ওয়াদা করেছিল এবং আহ্লে বাইত-এর ভক্ত বলে দাবি করেছিল, এখন তারা ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখলো!

হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি রাত্রে কুফার রাস্তায় এমনভাবে অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন যেমন একজন সহায়-সম্বলহীন মুছাফির ঘুরাফিরা করে। তিনি বড় পেরেশানীর সাথে অলি-গলিতে হাঁটতে লাগলেন। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় গিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলেন, যিনি ঘরের দরজা খুলে বসেছিলেন। তিনি তার কাছে গিয়ে পানি চাইলেন। বৃদ্ধা পানি দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন এবং কোথায় যাবেন? যখন বৃদ্ধা মহিলাটি তাঁর অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তিনি অকপটে বললেন, ওহে বোন! আমি মুসলিম বিন আক্বীল, হযরত ইমাম হুসাইন বিন আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রতিনিধি হয়ে কূফায় এসেছিলাম। মহিলাটি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনি মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি এভাবে অসহায়ভাবে ঘুরাফিরা করছেন! কূফার সবাই জানে যে, আপনার হাতে হাজার হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে এবং সবাই আপনার জন্য জান-মাল কুরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমি কী দেখছি! আপনি যে এভাবে অসহায়, একাকী ঘুরাফিরা করছেন? হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘হ্যাঁ বোন’! বাস্তবিকই তা ছিল। কিন্তু তারা আমার সাথে বেঈমানী করেছে। তাই আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন। কূফার কোন ঘরের দরজা আজ আমার জন্য খোলা নেই, এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি রাত্রি যাপন করতে পারি এবং আশ্রয় নিতে পারি। বৃদ্ধা মহিলা বললেন, আমার গরীবালয় আপনার জন্য খোলা আছে। আমার জন্য এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে যে, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একজন আওলাদ আমার ঘরে মেহমান হয়েছেন। সেই বৃদ্ধাটি উনাকে ঘরে জায়গা দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনি রাত যাপন করলেন।

খোদা তায়ালার কুদরত! ঐ বৃদ্ধার এক ছেলে ছিল বড় নাফরমান। এটা খোদা তায়ালারই শান যে, নেককার থেকে বদকার এবং বদকার থেকে নেককার পয়দা হয়। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ঘরে কাফির সৃষ্টি করে দেন এবং কাফিরদের ঘরে মু’মিন। ফিরআউনের স্ত্রী শ্রেষ্ঠ ঈমানদার। আর হযরত লূত আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রী হয়ে যায় কাফির। কাফিরের ঘরে লালিত-পালিত হয়ে যান নবী-রসূল। আর হযরত নূহ আলাইহিস সালাম-এর ঘরে জন্ম ও লালিত-পালিত কেনান হয়ে যায় কাফির। বৃদ্ধা মহিলার ক্ষেত্রেও তাই। তিনি নেককার। কিন্তু তার ঘরেই জন্ম নিয়েছে এক বড় নাফরমান।

শেষ রাতে বৃদ্ধার সেই নাফরমান ছেলে ঘরে আসলো, এসে মাকে পেরেশান দেখে জিজ্ঞাসা করলো, মা তুমি চিন্তিত কেন? মা বললেন, বৎস! মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি আমাদের প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খানদানের একজন। তিনি কূফায় এসেছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রতিনিধি হয়ে। কূফাবাসী তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল। তারা তাঁর পিছে-পিছে থাকতো এবং জান-মাল কুরবানী করার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান গভর্নরের ধমকীতে সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছে এবং বেঈমানী করে সবাই তাঁর জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি অসহায় অবস্থায় অলি-গলিতে ঘুরছিলেন। যাক, খোদা তায়ালা আমাকে সৌভাগ্যবান করেছেন, আজ তিনি আমার ঘরে মেহমান এবং আমার ঘরে অবস্থান করছেন। তিনি আমার গরীবালয়ে ক্বদম রেখেছেন। এর জন্য আমি আজ গর্ববোধ করছি যে, আমি তাঁর মেহমানদারীর সুযোগ লাভ করলাম। এ জন্যই একদিকে আজ আমি খুবই আনন্দিত, আর অন্যদিকে আমি খুবই দুঃখিত যে, কূফাবাসীরা একজন সম্মানিত মেহমানের সাথে এ ধরনের বেঈমানী করতে পারলো।
বৃদ্ধা মহিলাটি যখন এসব ঘটনা বলছিলেন, তাঁর সেই নাফরমান ছেলে মনে মনে খুবই খুশি হলো এবং মনে মনে বলতে লাগলো- শিকার হাতের মুঠোয়, এটাতো বড় সৌভাগ্যের বিষয়। নাঊযুবিল্লাহ! আমার মা’ তো একজন সাধা-সিধে মহিলা। তিনি কি জানেন ইবনে জিয়াদের ঘোষণার কথা? ইবনে যিয়াদ তো ঘোষণা করেছে, যে ব্যক্তি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে গ্রেফতার করতে পারবে, তাকে এক হাজার দিরহাম পুরস্কার দেয়া হবে। যা হোক, তিনি যখন সৌভাগ্যবশতঃ আমার ঘরে এসে গেছেন, আমি খুবই সকালে গিয়ে খবর দিয়ে উনাকে আমার ঘর থেকে গ্রেফতার করাবো এবং হাজার দিরহাম পুরস্কার লাভ করবো। ছেলে এই অসৎ উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা তার মা’র কাছে গোপন রাখলো।

এদিকে সে অস্থির হয়ে পড়লো, কখন সকাল হবে, কখন খবর পৌঁছাবে এবং পুরস্কার লাভ করবে। ফজর হওয়া মাত্রই সে তার অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে ইবনে যিয়াদকে খবর দিলো যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ওর ঘরেই অবস্থান করছেন, সে হলো সংবাদদাতা এবং সেই পুরস্কারের দাবিদার। ইবনে যিয়াদ বললো, তোমার পুরস্কার তুমি নিশ্চয়ই পাবে, প্রথমে উনাকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করো। সে বললো, ঠিক আছে, আমার সাথে সিপাই পাঠিয়ে দিন। তার কথা মতো তার সাথে সত্তরজন সিপাই গেল এবং সেই মহিলাটির ঘর চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো।

হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এই অবস্থা দেখে তলোয়ার নিয়ে বের হলে সিপাইরা জঘন্যভাবে বেয়াদবী করলো এবং এমন ভাষা উচ্চারণ করলো, যা মোটেই বরদাশত্্যোগ্য নয়। ওরা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কঠোর সমালোচনা করলো এবং ইয়াযীদের প্রশংসা করলো। আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনলো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এর যথার্থ উত্তর দিলেন। কিন্তু ইত্যবসরে ওরা তীর নিক্ষেপ করলো।

হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যদি আলোচনা করতে চাও তাহলে বুদ্ধিমত্তার সাথে আলোচনা করো। আর যদি তীর নিক্ষেপ করো আমিও এর যথোচিত জবাব দিব। ওরা বললো, ঠিক আছে, শক্তি থাকলে জবাব দিন। তাদের কথা শুনে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাদের সামনা-সামনি এসে গেলেন এবং তলোয়ার চালাতে শুরু করলেন। তিনি একাই সত্তরজনের সাথে মোকাবিলা করতে লাগলেন আর এদিকে ওরা তাঁর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে হতভম্ভ হয়ে গেল এবং তারা মনে মনে বললো, আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে ভুল করলাম। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সুনিপূণ তলোয়ার চালনার সামনে ওরা টিকতে না পেরে পিছপা হলো। তবুও তিনি কয়েক জনকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন এবং অনেককে আহত করলেন। এই অবস্থায় তিনি নিজেও আহত হলেন। একটা তীরের আঘাতে উনার সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেল। রক্ত বের হচ্ছিল।
তখন তিনি বৃদ্ধা মহিলাটির কাছ থেকে পানি চাইলেন। মহিলাটি উনাকে পান করার জন্য এক পেয়ালা পানি দিলেন। যখন তিনি পানি পান করতে মুখে নিলেন, তখন সেই পানি মুখের রক্তে লালে লাল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি পানি পান করলেন না। পেয়ালাটা মাটিতে রেখে তিনি মনে মনে বললেন, “হয়তঃ দুনিয়ার পানি আমার ভাগ্যে আর নেই। আমি জান্নাতুল ফিরদাউস-এ গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবো।”

হযরত ইমাম মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শাহাদাত:
হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি পুনরায় লড়তে শুরু করলেন। এ খবর যখন ইবনে জিয়াদের কাছে পৌঁছলো তখন সে মুহম্মদ বিন আশআছকে পাঠালো এবং তাকে বললো, তুমি গিয়ে কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক পন্থায় উনাকে বন্দী করে আমার কাছে নিয়ে এসো। সে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে এসে বললো, ‘ওরা আসলে বোকামী করেছে। ওদেরকে ইবনে যিয়াদ মোকাবিলা বা লড়াই করার জন্যে পাঠায়নি। ওদেরকে পাঠানো হয়েছিল আপনাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি আমার সাথে গভর্নর ভবনে চলুন। আপনি গভর্নরের সাথে কথা বলুন, তিনি আপনার সাথে মত বিনিময় করতে চান। কারণ তিনি চাচ্ছেন, ইত্যবসরে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামও কূফায় এসে পৌঁছবেন। তাই যেন কোন ফিতনা-ফাসাদের সৃষ্টি না হয়। গভর্নরের কাছে চলুন, কথাবার্তার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হোন। মত বিনিময়ের মাধ্যমে হয়ত সন্ধিও হয়ে যেতে পারে।
হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আমিও তো তাই চাচ্ছি। তা’ না হলে আমি যখন চল্লিশ হাজার সমর্থক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করেছিলাম তখন আমার একটু ইশারাই গভর্নর ভবন তছনছ এবং ইবনে যিয়াদকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমি এটা নিজে পছন্দ করি না যে, মারামারি বা খুন-খারাবী হোক। মুহম্মদ বিন আশআছ বললো, আমার সাথে চলুন, সিপাইদেরকে ধমকের সুরে বললো, তলোয়ার খোলা রাখছো কেন? বেকুবের দল কোথাকার, তলোয়ার খাপের মধ্যে ভরে রাখো। এভাবে ওদেরকে ধমক দিল আর উনাকে সাথে নিয়ে চললো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তার সাথে গেলেন এবং গভর্নর ভবনে প্রবেশ করার সময় এই দুআটি পড়লেন-
ربنا افتح بيننا وبين قومنا بالحق وانت خير الفاتحين
‘রব্বানাফ্তাহ্ বাইনানা ওয়া বাইনা ক্বওমিনা বিল্হাক্কি ওয়া আংতা খইরুল ফাতিহীন।’ (সূরা আ’রাফ-৮৯) এই দুআটি পড়তে পড়তে যখনই তিনি গভর্নর ভবনের শাহী দরজায় প্রবেশ করলেন, এদিকে ইবনে যিয়াদ উম্মুক্ত তলোয়ারধারী কিছু সিপাহীকে দরজার দু’পাশে নিয়োজিত করে রেখেছিল এবং তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই দু’দিক থেকে আক্রমণ করে যেন উনাকে শহীদ করা হয়। নির্দেশ মত যখনই তিনি গভর্নর ভবনের দরজায় পা রাখলেন, তখনই তাঁর উপর দু’দিক থেকে তলোয়ার দ্বারা আক্রমণ করা হলো এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন)

উলামায়ে কিরাম-এর কেউ কেউ তাঁদের কিতাবে লিখেছেন যে, তিনি যথারীতি ইবনে জিয়াদের কাছে পৌঁছেছেন এবং আলোচনা করেছেন। ইবনে যিয়াদ হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বললো, দেখুন, আপনি বড় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। তথাপি একটি শর্তে আমি আপনাকে রেহাই দিতে পারি। শর্তটি হচ্ছে, আপনি ইয়াযীদের বাইয়াত গ্রহণ করুন এবং প্রতিশ্রুতি দিন যে, যখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আসবেন, উনাকেও ইয়াযীদের বাইয়াত করিয়ে দিবেন। এতে সম্মত হলে আপনাকে আমি মুক্তি দিতে পারি। অন্যথায় আপনার ও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কোন নিস্তার নেই। নাঊযুবিল্লাহ।

হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উত্তরে বললেন, ‘প্রস্তাব মন্দ নয়, তবে আমি কিংবা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে পারি না। এটা কখনো কল্পনাও করা যায় না যে, আমরা ইয়াযীদের কাছে বাইয়াত হবো। তাই তোমার যা ইচ্ছা তা করতে পার।’ ইবনে যিয়াদ পুনরায় বলল, যদি আপনি বাইয়াত গ্রহণ না করেন ও ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকেও বাইয়াত করানোর ব্যবস্থা না করেন, তাহলে আমি আপনাকে শহীদ করার নির্দেশ দিব। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি দৃঢ়কন্ঠে বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছে তা করতে পার।‘

ইবনে যিয়াদ জল্লাদকে নির্দেশ দিল, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিকে গভর্নর ভবনের ছাদের উপর নিয়ে গিয়ে শহীদ করো এবং মাথা কেটে আমার কাছে নিয়ে আসো আর দেহকে রশি বেঁধে বাজারে হেঁচড়াও, যাতে হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং লোকেরা যেন এই দৃশ্য অবলোকন করে। জল্লাদকে হুকুম করার পর, ওরা যখন উনাকে ধরতে আসল, তখন হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি দেখলেন যে, গভর্নর ভবনের চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। তারা সব এসেছে তামাশা দেখার জন্য। কিন্তু আফসুস! এদের মধ্যে অনেকে এসেছে যারা হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, যারা চিঠি লিখে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে কূফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ওদেরকে দেখে বললেন, ‘হে কূফাবাসী! তোমরা বেঈমানী করেছ; তা সত্ত্বেও এখন আমি তোমাদেরকে তিনটি কাজের দায়িত্ব দিচ্ছি। যদি পার, এই তিনটি কাজ তোমরা অবশ্যই করবে। প্রথম কাজ হচ্ছে, আমার কাছে যে হাতিয়ারগুলো আছে, এগুলো বিক্রি করে অমূক অমূককে দিও। কারণ, আমি ওদের কাছে ঋণী। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, যখন আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং আমার লাশ বাইরে নিক্ষেপ করবে, তোমরা আমার লাশটি উঠিয়ে কোন এক যথোপযুক্ত স্থানে দাফন করো। তৃতীয় কাজ হচ্ছে, যদি তোমাদের মধ্যে এক তিল পরিমাণও ঈমান থাকে এবং আহলে বাইত-এর প্রতি এক কণা পরিমাণও মুহব্বত থাকে, তাহলে যে কোন উপায়ে তোমরা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাছে সংবাদ পৌঁছে দিও, যেন তিনি কূফায় তাশরীফ না আনেন। এসব কথা শুনে ইবনে যিয়াদ খুবই রাগান্বিত হলো এবং চারিদিকে ঘুরে সবাইকে হুমকি দিতে লাগলো, খবরদার! যারা হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এই সব কথামত কাজ করবে, আমি তাদেরকে কতল করাবো এবং তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠাবো, যাতে কেউ হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কথা অনুসরণ করতে না পারে। এবং সে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিকে লক্ষ্য করে বললো, আমি আপনার হাতিয়ারগুলো আমাদের মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে বণ্টন করবো এবং আপনার লাশকে দাফন করতে দিব না। বরং কূফার অলিতে-গলিতে ঘুরাবো এবং জনগণকে দেখাবো। যারা আপনার পক্ষ অবলম্বন করবে, নিশ্চয়ই তাদের সাথে এই রকম আচরণ করা হবে। আর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে খবর দেয়া থেকে বাধা দেয়ার কারণ হলো, উনাকে এখানে আনা চাই এবং উনাকেও ইয়াযীদদ্রোহীতার স্বাদ উপভোগ করাতে চাই। নাঊযুবিল্লাহ।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ভবিষ্যত পরিণতির কথা চিন্তা করে তখন ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং কূফাবাসীর বিশ্বাস-ঘাতকতার কথা উনাকে আরও বেঁদনাক্লিষ্ট করল। এমন সময় জল্লাদরা উনাকে ধরে ছাদের এক কিনারে নিয়ে গেল। তিনি তাদের কাছে দুই রাকায়াত নফল নামায পড়ার অবকাশ চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা সেই সুযোগটাও দিল না। তিনি অশ্রু-সজল নয়নে মক্কা শরীফ-মদীনা শরীফ-এর দিকে তাকালেন এবং তাকিয়ে বললেন, ওগো আমার মাওলা হুসাইন! আমার এই অবস্থার খবর আপনাকে কে পৌঁছাবে? আমার সাথে কী যে নির্মম আচরণ করা হচ্ছে। হায়! আমি যদি আপনাকে চিঠি না লিখতাম এবং কূফার অবস্থা সন্তোষজনক না জানাতাম তাহলে আপনি এখানে কখনো আসতেন না। কূফাবাসীরা আজ আমার সাথে যেভাবে বিশ্বাস ঘাতকতা করলো, জানিনা, আপনার সাথে কি ধরণের আচরণ করবে? উনি এসব চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। আর এদিকে জল্লাদরা উনাকে ধরে ছাদে শুইয়ে শরীর মুবারক থেকে মস্তক মুবারক বিচ্ছিন্ন করে ফেললো।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কূফা গমন:

আল্লাহ তায়ালার কি যে মহিমা! যেদিন হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি কূফায় শহীদ হলেন, সেদিনই অর্থাৎ ৬০ হিজরী ৩রা যিলহজ্জ তারিখে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম প্রিয়জন ও আপনজনদের নিয়ে মক্কা শরীফ থেকে কূফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন। কারণ, উনার কাছে চিঠি পৌঁছেছিল যে, কূফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, তিনি যেন বিনা দ্বিধায় অনতিবিলম্বে কূফায় তাশরীফ নেন। তিনি তাঁর আহলিয়া, বোন, ছেলে-মেয়ে এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকেও সঙ্গে নিলেন এবং মক্কা শরীফ থেকে বের হলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাফেলায় মুখতালিফ বর্ণনা, কোন কোন বর্ণনায় ৭২ জন আর কোন কোন বর্ণনায় ৮২ জন ছিলেন। যার মধ্যে মহিলা, দুগ্ধপোষ্য শিশুও ছিলেন এবং উনার সঙ্গে কয়েকজন যুবক খাদিম-খুদ্দামও ছিলেন।

এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যুদ্ধ করার কিংবা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে কখনও বের হননি। কেননা, তিনি যদি যুদ্ধ বা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হতেন তাহলে, তিনি কখনও মেয়েলোক ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হতেন না। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার নিজের আহলিয়া ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হওয়াটা এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি যুদ্ধ কিংবা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বের হননি। তাঁর কাছে তো চিঠি এসেছে যে, সেখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছে, কূফাবাসীরা বেশ মেহমানদারী করছে। তাই তিনি তাঁর আপন-জনদেরকে নিয়ে বের হয়েছেন এবং যুদ্ধ করার কোন অস্ত্র-শস্ত্র রাখেননি। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন মক্কা শরীফ থেকে কূফার উদ্দেশ্যে বের হলেন, পথে তিনি হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শাহাদাত বরণের খবর পেলেন।

হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শাহাদাতের খবর শুনে তিনি এবং তাঁর সফরসঙ্গীগণ একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। অর্থাৎ কোথা থেকে কি হয়ে গেল। মাত্র কয়েকদিন আগে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর চিঠি আসলো, কূফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। অথচ এখন শুনতে পাচ্ছি উনাকে শহীদ করা হয়েছে। এটা কি ধরণের ঘটনা! যা হোক, উনারা পিছপা হলেন না। সম্মুখপানে অগ্রসর হলেন। উনাদের সিদ্ধান্ত হলো, ওখানে গিয়ে দেখি অবস্থা কি এবং কিভাবে এত তাড়াতাড়ি এ ধরণের ঘটনা ঘটলো, তা অবহিত হওয়া। এ মনোভাব নিয়ে উনারা সামনে অগ্রসর হলেন।

কারবালার প্রান্তরে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু আলাইহিস সালাম কূফা থেকে দুই মঞ্জিল দূরত্বে কারবালার প্রান্তরে ৬১ হিজরী ২রা মুর্হরম তারিখে পৌঁছলেন। যখন তাঁরা পৌঁছলেন, তখন হুর বিন ইয়াযীদ রিয়াহী এক হাজার সৈন্য নিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথে মোলাকাত করলো এবং বললো- হে সম্মানিত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমি আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য এসেছি। তখন ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? সে বললো, ‘তা আমি জানি না, তবে কূফার গভর্নর ইবনে যিয়াদের নির্দেশ- আপনাকে যেখানে পাওয়া যাবে, গ্রেফতার করে তার কাছে যেন পৌঁছে দেয়া হয়। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ফরমালেন, আমার কি অপরাধ? সে বললো, আপনি ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, ইয়াযীদের বিরুদ্ধে এখানে জন অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন এবং জনগণকে বাইয়াত করিয়েছেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আমি কোন জন অসন্তোষ সৃষ্টি করিনি এবং ক্ষমতা দখলেরও কোন ইচ্ছা আমার নেই। কূফাবাসীই আমার কাছে চিঠি লিখেছে, যার কারণে আমি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। তবে যদি কূফাবাসী বেঈমানী করে এবং অবস্থার যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে আমি ফিরে যেতে রাজি আছি। যখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম হুরের সঙ্গে আলোচনা করলেন এবং হুরকে সমস্ত বিষয় অবহিত করলেন, তখন সে খুবই দুঃখিত হলো। হুর বললো, এই মুহূর্তে যদি আমি আপনাকে চলে যেতে দেই, আমার সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে কেউ হয়তো ইবনে যিয়াদের কাছে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে এবং ইবনে যিয়াদ আমার উপর যুলুম করতে পারে। সে বলবে, ‘তুমি জেনে-শুনে দুশমনকে ছেড়ে দিয়েছ, আপোষে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছ।’ ফলে আমার উপর মুছীবতের পাহাড় নাযিল হবে। তাই আপনি একটা কাজ করতে পারেন- এভাবে আমার সঙ্গে সারাদিন কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকেন, যখন রাত হবে, আমার সৈন্যরা শুয়ে পড়বে এবং অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন আপনি আপনার আপনজনদের নিয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। সকালে আপনাকে খোঁজ করব না, আপনার পিছু নেব না। সোজা ইবনে যিয়াদের কাছে গিয়ে বলব, উনি রাতের অন্ধকারে আমাদের অজান্তে চলে গেছেন এবং কোন দিকে গেছেন এরও কোন খোঁজ পাইনি। এরপর যা হওয়ার আছে, তাই হবে। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, ঠিক আছে।

যখন রাত হলো, চারিদিকে অন্ধকার ঘণীভূত হলো এবং সৈন্যরা প্রায় ঘুমিয়ে পড়লো, তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম নিজের সঙ্গী সাথীদেরকে রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। সবাই বের হয়ে গেলেন। সারারাত এ কাফেলা পথ চলতে থাকল, কিন্তু খোদা তায়ালার রহস্য দেখুন, সারারাত হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাফেলা চললো, কিন্তু ভোরে তারা তাদেরকে ঐ জায়গায়ই দেখতে পেলেন, যেখান থেকে রওয়ানা শুরু করেছিলেন। এই অবস্থা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল, এটা কিভাবে হলো। আমরা সারারাত পথ চললাম, কিন্তু সকালে আবার একই জায়গায়। এ কেমন কথা! হুর তাঁদেরকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, আপনারা কি যাননি? ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আমরা সত্যিই চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু যাওয়ার পরওতো যেতে পারলাম না, দিশেহারা হয়ে আবার একই জায়গায় ফিরে আসলাম। হুর বললো, ঠিক আছে, চিন্তার কিছু নেই। আজ আমরা পুনরায় দিনভর আলোচনা করতে থাকব এবং আমার সৈন্যদেরকে বলব, আমাদের মধ্যে এখনও কোন ফায়সালা হয়নি, আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আজ রাতেই আপনি চলে যাবেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় রাত্রিতেও সঙ্গীদেরকে নিয়ে বের হলেন। সারারাত উনি ও উনার সফরসঙ্গীগণ পথ চললেন। ভোর যখন হলো, তখন পুনরায় উনারা উনাদেরকে সেই একই জায়গায় পেলেন, যেখান থেকে উনারা বের হয়েছিলেন। উপর্যুপরি তিন রাত এ রকম হলো। সারারাত উনারা পথ চলতেন, কিন্তু ভোর হতেই উনাদেরকে ঐ জায়গায় পেতেন, যেখান থেকে উনারা বের হতেন।

চতুর্থ দিন জনৈক পথিক উনাদের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিল, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে ব্যক্তি যেই জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এই জায়গাটার নাম কি? লোকটি বললো, হযরত! এই জায়গাটার নাম ‘কারবালা’। কারবালা শব্দটি বলার সাথে সাথেই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বিস্মিত হলেন এবং বললেন, ‘আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন, ‘হুসাইন আলাইহিস সালাম কারবালার ময়দানে শহীদ হবেন।’ এটাতো আমার শাহাদাতের স্থান। আমি এখান থেকে কিভাবে চলে যেতে পারি? পরপর তিন রাত্রি প্রস্থান করার পর পুনরায় একই জায়গায় প্রত্যাবর্তন এ কথাই প্রমাণ করে যে, এটা আমার শাহাদাতের স্থান। এখান থেকে আমি কিছুতেই বের হতে পারব না।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁর প্রিয়জনদের বললেন, ‘সওয়ারী থেকে অবতরণ করে তাবু খাটিয়ে নিন। নির্দেশ মত উনার সঙ্গী সাথীরা সওয়ারী থেকে অবতরণ করে তাবু খাটাতে শুরু করলেন। কিন্তু যেখানেই তাবুর খুঁটি পুঁততে গেলেন, সেখান থেকেই টাটকা রক্ত বের হতে লাগলো। এই দৃশ্য দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম যখন দেখলেন যে, মাটিতে যেখানেই খুঁটি পুঁততে যান, সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে, তখন তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে বললেন, প্রিয় ভাইজান! চলুন, আমরা এখান থেকে সরে যাই। এই রক্তাক্ত ভূমি দেখে আমার খুব ভয় করছে, আমার খুবই খারাপ লাগছে। এই রক্তাক্ত ভূমিতে অবস্থান করবেন না। চলুন, আমরা এখান থেকে অন্যত্র চলে যাই। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, ওগো আমার প্রাণ-প্রিয় বোন! এখান থেকে আমি বের হতে পারব না। এটা আমার ‘শাহাদাত গাহ’ অর্থাৎ শাহাদাতের স্থান। এখানেই আমাকে শাহাদাত বরণ করতে হবে। এখানেই আমাদের রক্তের নদী প্রবাহিত হবে। এটা সেই ভূমি, যেটা আহলে মুস্তাফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রক্তে রঞ্জিত হবে। এটাই সেই জায়গা, যেখানে ফাতিমাতুয যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের বেহেশ্্তী ফুল টুকরো টুকরো হয়ে পতিত হবে এবং তাঁদের রক্তে এই ভূমি লালে লাল হয়ে যাবে। তাই সবাই অবতরণ করো, ছবর, ধৈর্য এবং সাহসের সাথে তাবুতে অবস্থান করো। আমরা এখান থেকে কখনও যেতে পারব না। এখানেই আমাদেরকে ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। এবং এখানেই শাহাদাত বরণ করতে হবে।’ অতঃপর তাবু খাটিয়ে উনারা কারবালায় অবস্থান নিলেন।
তাঁরা অবস্থান নেয়ার পর থেকে ইবনে যিয়াদ ও ইয়াযীদের পক্ষ থেকে সৈন্যবাহিনী একদলের পর একদল আসতে লাগল। যেই দলই আসে, সবাই ইয়াযীদের পক্ষ থেকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাছে এ নির্দেশটাই নিয়ে আসল- ‘হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে গিয়ে বলো, তিনি যেন ইয়াযীদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন। যদি তিনি বাইয়াত গ্রহণ করতে রাজী হন, তখন উনাকে কিছু বলোনা, উনাকে ধরে আমার কাছে নিয়ে এসো। আর যদি বাইয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, তখন তাঁর সাথে যুদ্ধ করো এবং তাঁর মস্তক কর্তন করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ এভাবে সৈন্য বাহিনীর যেই দলটিই আসতে লাগল, তারা একই হুকুম নিয়ে আসল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, ‘এটাতো হতেই পারে না যে, আমি ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করব!

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাকে আহ্বান করা হয়েছে আমার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার জন্য। আর এখন আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত হওয়ার জন্য! এই জন্যইতো আমি মদীনা শরীফ ছেড়ে মক্কা শরীফ-এ চলে গিয়েছিলাম। তাহলে কি আমি এখন মক্কা শরীফ থেকে এখানে এসেছি ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত হওয়ার জন্য? এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমি ইয়াযীদের হাতে কখনো বাইয়াত গ্রহণ করব না।’ ওরা বলল, আপনি যদি ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে রাজী না হন, তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আমিতো যুদ্ধের জন্যও আসিনি। যুদ্ধের কোন ইচ্ছাও পোষণ করি না।’ ওরা বলল, এরকমতো কিছুতেই হতে পারে না। হয়তো বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে নতুবা যুদ্ধ করতে হবে।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন দেখলেন, এদের উদ্দেশ্য খুবই খারাপ তখন তিনি তাদের সামনে তিনটি শর্ত পেশ করলেন। তিনি বললেন, ‘শোন! কূফাবাসী আমার কাছে চিঠি লিখেছে এবং চিঠিতে এমন কথা লিখা ছিল, যার জন্য শরীয়ত মতে আমি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন যখন তারা বেঈমান হয়ে গেছে, আমি তোমাদের সামনে তিনটা শর্ত পেশ করছি; তোমাদের যেটা ইচ্ছা সেটা গ্রহণ করো এবং সে অনুসারে কার্য সম্পাদন করো- ১। হয়তো আমাকে মক্কা শরীফ-এ চলে যেতে দাও। সেখানে হেরেম শরীফ-এ অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগীতে নিয়োজিত থেকে বাকী জীবনটা অতিবাহিত করব ২। যদি মক্কা শরীফ-এ যেতে না দাও, তাহলে অন্য কোন দেশে যাওয়ার সুযোগ দাও, যেখানে কাফির বা মুশরিকরা বসবাস করে। ওখানে আমি দ্বীনী তা’লীম-তালক্বীনের কাজে নিয়োজিত থাকবো এবং ওদেরকে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকবো ৩। যদি অন্য কোন দেশেও যেতে না দাও তাহলে এমন করতে পার যে, আমাকে ইয়াযীদের কাছে নিয়ে চলো। আমি তার সাথে বসে আলোচনা করব। হয়তঃ কোন সন্ধিও হয়ে যেতে পারে, এই নাজুক অবস্থার উন্নতিও হতে পারে এবং রক্তপাতের সম্ভাবনাও দূরীভূত হতে পারে।

ইয়াযীদ বাহিনী এ তিনটি শর্ত কূফার গভর্নর ইবনে যিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিল। সে এ শর্তগুলোর কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এবং আমর বিন ইবনে সা’আদ’ যে সেনাপতি ছিল তাকে লিখল যে, আমি তোমাকে সালিশকার বা বিচারক বানিয়ে পাঠাইনি যে, তুমি আমার এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মধ্যে সন্ধি করার ব্যবস্থা করবে; আমি তোমাকে পাঠিয়েছি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে বাইয়াত গ্রহণ করতে বলার জন্য অথবা উনার সাথে যুদ্ধ করে তাঁর মস্তক আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। অথচ তুমি সন্ধির চিন্তা-ভাবনা করছো এবং এর জন্য বিভিন্ন তদবীর করছো। আমি আবার তোমাকে শেষবারের মতো নির্দেশ দিচ্ছি, ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যদি বাইয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করো এবং মস্তক কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। যখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে এই নির্দেশের কথা শুনানো হলো, তখন তিনি বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে যা প্রমাণ করার ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে এবং যা বলার ছিল তা বলা হয়েছে। এখন তোমাদের যা মর্জি তা করো। আমি ইয়াযীদের হাতে কিছুতেই বাইয়াত গ্রহণ করব না।’ ওরা বলল, তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। তিনি বললেন, ‘তোমাদের পক্ষ থেকে যা করার তোমরা কর। আমার পক্ষ থেকে যা করার আমি করব।”
ইমাম পরিবারকে অবরোধ ও ফোরাত নদীর পানি পান করতে বাধা:

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন ইয়াযীদ বাহিনীকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে, তোমাদের পক্ষ থেকে যে ব্যবস্থাই তোমরা নেও না কেন আমি কিছুতেই ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবো না। তখন ইয়াযীদ বাহিনীর মনোভাব এত জঘন্য রূপ ধারণ করল যে, তারা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার প্রিয়জনদের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিল। সেদিন ছিল ৭ই মুর্হরম ৬১ হিজরী। ইয়াযীদ বাহিনী প্রায় চার হাজার সৈন্য ফোরাত নদীর তীরে নিয়োজিত করলো। এদের মধ্যে দুই হাজার ছিল ‘স্থল বাহিনী’ আর দুই হাজার ছিল ‘অশ্বারোহী’। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উনাদেরকে যেন এক ফোঁটা পানিও নিতে দেয়া না হয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী উনাদের জন্য তারা পানি বন্ধ করে দিল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিরাশিজন সঙ্গী সাথীর মধ্যে দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলেন এবং পর্দানশীন মহিলারাও ছিলেন। তিনি শুনে আরও আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, উনাদের মোকাবিলা করার জন্য বাইশ হাজার সৈন্য এসেছে। কী আশ্চর্য! বিরাশিজনের মোকাবিলায় বাইশ হাজার সৈন্য! আবার এই বিরাশিজনের মধ্যে শিশু ও মহিলারা রয়েছেন। অথচ উনাদের মোকাবিলায় যে বাইশ হাজার সৈন্য তারা সবাই যুবক এবং তারা সকল প্রকারের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসেছে। এরপরও তারা পানি বন্ধ করে দিল। কারণ, তাদের ধারণা হল যে, উনারা যদি পানি পান করে যুদ্ধ করেন, তাহলে সম্ভবতঃ আমরা বাইশ হাজার হয়েও কামিয়াব হতে পারবো না। তাই পানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা জুলুমের উপর জুলুম ছিল।

আফসুস! ঐসব যালিমদের জন্য, যারা এমন এক মহান ব্যক্তি এবং উনার পরিবার-প্রিয়জনদের জন্যে পানি বন্ধ করে দিল, যিনি হচ্ছেন সাকিয়ে কাওছার, শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম।

ঐ কুখ্যাত ইয়াযীদ বাহিনীর প্রধান নির্দেশ দিয়েছিল যে, “মানুষ, জীব-জন্তু, বিধর্মী, গরু-ছাগল, পশু-পাখি সবাই এই ফোরাত নদীর পানি পান করবে, তোমরা বাধা দিও না। কিন্তু হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা আলাইহাস সালাম-এর এই ছেলে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে পানি পান করতে দিও না।” যেই ফোরাত নদীর পানি সবারই পান করার অনুমতি ছিল, জীব-জন্তু, পশু-পাখি কারো জন্য বাধা ছিল না। কিন্তু সেই ‘ফোরাত নদীর’ পানি পান করা থেকে বাধা দিল সাকিয়ে কাওছার, শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আনহু উনার আহবান

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন দেখলেন যে, পানিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তখন তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনীর নিকট গেলেন এবং তাদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন।
কারবালার ঐতিহাসিক ১০ই মুহররম:

হিজরী ৬১ সন, মুর্হ্রম মাসের ৯ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ দশ তারিখ রাত্রি বেলা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সফর সঙ্গীদের সবাইকে একত্রিত করলেন এবং বললেন, আমার প্রিয় সাথীরা! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট। আমি তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি যে, আজ রাতে তোমরা যে যেদিকে পার চলে যাও। এইসব ইয়াযীদী বাহিনীর লোকেরা আমার রক্ত পিপাসু। এরা একমাত্র আমার রক্তেই পরিতৃপ্ত হবে। তোমরা চলে যাও, তোমাদের জান বেঁচে যাবে। কিন্তু উনার সাথীদের মধ্যে একজনও যেতে রাজী হলেন না। তাঁরা বললেন, এ নাজুক সময়ে আপনাকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে আমরা কিভাবে চলে যেতে পারি! এ রকম পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে ফেলে আমরা চলে যাই, কাল ক্বিয়ামতের মাঠে আমরা আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কিভাবে মুখ দেখাব? না! কিছুতেই আমরা আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারি না। আমরা আপনার সাথেই থাকবো এবং আমরা আমাদের জানকে পতঙ্গের মতো উৎসর্গ করবো।

যখন কেউই যেতে রাজি হলেন না, তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, তাহলে শুন! যদি তোমরা আমার সাথে থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হও, তাহলে তোমরা ধৈর্য এবং আত্ম-বিশ্বাসে শিশাঢালা প্রাচীরের মতো অটল হয়ে যাও। এমন দৃঢ় ও অটল হয়ে যাও, যেন জুলুম-অত্যাচারের বিভীষিকা তোমাদের পদস্খলন ঘটাতে না পারে। বাতিলের সাথে মোকাবিলা করার সময়টা হলো, আমাদের পরীক্ষার সময়। আল্লাহ তা’য়ালা উনার বান্দাদের থেকে পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। এখন আমাদের সামনে মুছীবতের পাহাড় অবস্থিত। সমস্ত দুঃখ-দূর্দশা আমাদেরকে ধৈর্য সহকারে অতিক্রম করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা’র রাস্তায় অটল থাকতে হবে এবং এভাবে অটল থেকে শাহাদাতের শরবত পান করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ রেখে যেতে হবে। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার এ কথা উনার সাথীদের মধ্যে যথেষ্ট ধৈর্য ক্ষমতা সৃষ্টি করে দিলো। উনার সকল সাথী উনার জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং সকলেই শাহাদাত বরণের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে গেলেন এবং ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য দৃঢ় পাহাড় বনে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করো। সকাল বেলা আল্লাহ পাক উনার হুকুম যা হওয়ার তাই হবে।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা সবাই নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলেন এবং তিনি নিজের তাঁবুতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত শুরু করলেন। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে করতে তন্দ্রাভাব আসায় তিনি কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লেন। তখন স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ এনেছেন এবং উনাকে কোলে নিয়ে নিলেন এবং তাঁর বুকে হাত মুবারক রেখে বললেন- اللهم ات الحسين صبرا واجرا ‘আল্লাহুম্মা আতিল হুসাইনা ছব্্রাওঁ ওয়া আজ্রা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ পাক! হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ধৈর্য ও পূণ্য দান করুন’ এবং হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আরও বললেন, ‘তোমার উপর যা হচ্ছে, তা থেকে আমি বেখবর নই। আমি সবকিছু দেখছি। তোমার বিরুদ্ধে যারা তলোয়ার, তীর ইত্যাদি নিয়ে এসেছে, তারা সকলেই আমার শাফায়াত থেকে বঞ্চিত।’ নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা বলে ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার অন্তরকে ধৈর্য এবং স্থিরতার খনি বানিয়ে দিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ঘুম থেকে উঠে উনার বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার পরিজনকে স্বপ্নের কথা শুনালেন। ফজরের নামাযের পর তিনি আল্লাহ পাক উনার কাছে প্রার্থনা করছিলেন- ‘ইয়া আল্লাহ! আপনার রাস্তায় আমাকে অটল রাখুন, আমাকে ধৈর্য এবং সহনশীলতা দান করুন। হে মাওলা! জুলুম-অত্যাচারের ঝড় তুফান আমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, আপনি আমাকে অটল থাকার তাওফীক দান করুন, যেন জুলুম-অত্যাচার আমাকে পদচ্যুত করতে না পারে।’ এভাবে তিনি মুনাজাত করছিলেন আর উনার সাথীরা আমীন, আমীন বলছিলেন।

মোটকথা, একদিকে পিপাসাকাতর আল্লাহ তায়ালা’র নেক বান্দাগণ ধৈর্য এবং সহনশীলতার জন্য আল্লাহ পাক উনার কাছে প্রার্থনা করছেন, অন্যদিকে ইয়াযীদের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের মহড়া চলছে। দুর্যোগের কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, ইয়াযীদের সৈন্যরা লম্ফ-ঝম্ফ দিতে লাগল, তাদের মধ্যে কতেক জাহান্নামী কুলাঙ্গার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর আশে-পাশে চক্কর দিতে লাগল এবং গর্ব ও অহংকারভরে হুঙ্কার দিয়ে বলতে লাগল, এমন কোন বাহাদুর আছ? থাকলে আমাদের মোকাবিলায় আস। ইত্যবসরে যালিমদের মধ্যে কেউ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করল এবং মোকাবিলার জন্য হুঙ্কার দিল।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তাঁরা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁদেরকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সঙ্গীরা জিহাদের ময়দানে বীরত্ব প্রদর্শন করতে লাগলেন। তিন দিনের পিপাসাকাতর জানবাজ মর্দে মুজাহিদগণ ক্ষুধা এবং ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছিলেন। কিন্তু ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হলে কি হবে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা ছিলেন ঈমানী বলে বলীয়ান। তাঁর এক একজন সঙ্গী ইয়াযীদী বাহিনীর দশজনের থেকেও অধিক শক্তিশালী ছিলেন। প্রচ- জিহাদ শুরু হয়ে গেল এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা অনেক ইয়াযীদী বাহিনীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেরা এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম নিজের চোখের সামনে তাঁর পঞ্চাশজন সাথীর শাহাদাত বরণ দেখলেন। এত কিছু দেখার পরও তিনি সামান্য ধৈর্যচ্যুত হননি; বরং তিনি সঙ্গী-সাথীদের বুকে তীর নিক্ষেপ অবলোকন করছিলেন আর বলছিলেন- رضيت بقضائك ‘রদ্বীতু বিক্বদ্বায়িকা’ অর্থাৎ মাওলা! আমি আপনার ইচ্ছা এবং আপনার সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট।

পঞ্চাশজন সাথী শহীদ হওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মুষ্ঠিমেয় আপনজন ছাড়া আর কেউই রইলো না।
হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম -এর শাহাদাতঃ

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর শহীদী দেহ মুবারকের কাছ থেকে ফিরে এসে দেখলেন, উনার আঠারো বছরের ছেলে হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনি জিহাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে বললেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন। আমি চাই না, আপনার পর জীবিত থাকতে। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, বাবা শোন! তুমিতো আমার নানাজান মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারই প্রতিচ্ছবি, হুবহু নক্্শা। তোমাকে যখন কেউ দেখে, দিলের তৃষ্ণা মিটে যায়। তোমাকে দেখলেই আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক আকৃতি মুবারক সামনে ভেসে ওঠে। তোমাকে যদি আজ বিদায় দিই, আমাদের ঘর থেকে আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিচ্ছবি চলে যাবে। বাবা! তুমি যেয়ো না। ওরা আমারই রক্তের পিপাসু। আমার রক্তের দ্বারাই ওদের পিপাসা নিবারণ হবে। কিন্তু হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম বললেন, আব্বাজান! আমিও ওখানে যেতে চাই যেখানে আমার ভাই ক্বাসিম গেছেন, যেখানে আমার চাচাজান গেছেন। আমি কাপুরুষের মত পিছনে পড়ে থাকতে চাই না। আমিও জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ব্যাকুল। আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিন। আমাকে যালিমদের হাতে সোপর্দ করে যাবেন না। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বাধ্য হয়ে তাঁর আঠারো বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বিদায় দিলেন।
হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম রওয়ানা হলেন। আল্লাহু আকবর! ইনি কে যাচ্ছেন? সরকারে দো-আলম, নূরে মুজাস্্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিচ্ছবি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার জানের জান যাচ্ছেন। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল যাচ্ছেন। ইনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বাগানের ফুলের কলি যাচ্ছেন। হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম যেতে যেতে এটা পড়তে ছিলেন-
انا على بن الحسين بن على + نحن اهل البيت اولى بالنبى.
‘আনা আলিই-ইব্নুল হুসাইনিব্নু আলিইয়ি-নাহ্নু আহ্্লুল বাইতি আওলা বিন্নাবিইয়ি’ অর্থাৎ- ‘আমি আলী আকবর, হযরত হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ছেলে, যে হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজ্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বংশধর। আমরাই হলাম আহলে বাইত, রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সবচেয়ে প্রিয় বংশধর।’ এ ‘শে’র’ পড়তে পড়তে ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম সামনে অগ্রসর হলেন এবং ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, আমার দিকে লক্ষ্য করো! আমি ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সন্তান। আলী আকবর আমার নাম। হে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘরকে উজাড়কারী! হযরত ফাতিমাতুয্ যাহ্রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল ও কলিসমূহকে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে ছিন্ন-ভিন্নকারীরা! আমার রক্ত দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো, আমার প্রতিও তীর নিক্ষেপ করো।’ হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম বলছেন, যালিমদের সাহস নেই, এ নওজোয়ানের প্রতি তীর নিক্ষেপ করার বা তরবারী চালানোর। আমর বিন সাআদ নিজ সৈন্যদেরকে বলল, হে কাপুরুষের দল! তোমাদের কি হলো? সত্ত্বর একেও বর্শায় উঠিয়ে নাও।

আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে সকলের আগে এ নওজোয়ানকে কতল করতে পারবে, আমি তাকে ‘মোছিল’-এর রাজত্ব প্রদান করবো। এমন কোন ব্যক্তি আছে কি? যে মোছিলের শাসক হতে চায়? মোছিলের রাজত্ব পেতে চায়?
তারিক বিন শিশ্ নামক এক বদবখ্্ত পালোয়ান ছিল। ওর মনে আমরের কথায় প্রভাব সৃষ্টি করল এবং সে আগে বাড়ল, দেখি ভাগ্যে মোছিলের গভর্নরগিরি আছে কিনা। সে তীর হাতে নিয়ে হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম আলাইহিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম দৃঢ় স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। যখনই সে কাছে আসলো, হযরত আলী আকবর রহতুল্লাহি আলাইহি ঘোড়াকে ফিরায়ে ওর পিছনে এসে গেলেন এবং এমন জোরে আঘাত হানলেন যে একপলকে ওর মাথাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
এই দৃশ্য দেখে ওর ছেলে উমর বিন তারিক রাগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে তলোয়ার উচু করে এগিয়ে আসলো। যখন উভয়ের তলোয়ার একটার সাথে আর একটা আঘাতে ঝনঝনিয়ে উঠল, তখন যারা অবলোকন করেছে তারা দেখছিল, ওর লাশ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। দ্বিতীয় পুত্র তল্হা বিন তারেক সেও বাপ-ভাইয়ের খুনের বদলা নেয়ার জন্য অগ্নিশর্মা হয়ে হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম একেও জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এ তিনজনকে হত্যা করার পর হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম ঘোড়া ফিরিয়ে তাঁর আব্বাজানের খিদমতে হাজির হলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম দেখলেন, তাঁর কলিজার টুকরা জিহাদের ময়দান থেকে আসছেন। তিনি এগিয়ে এলেন, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কি খবর! হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম ঘোড়া থেকে অবতরণ করে আব্বাজানের কাছে আরজি পেশ করলেন। আব্বাজান! তৃষ্ণা খুব কষ্ট দিচ্ছে। খুবই তৃষ্ণা অনুভব করছি। যদি এক গ্লাস পানি পাওয়া যায়, তাহলে এদের সবাইকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আব্বাজান! আমি ওদের তিন বদবখত্্ যোদ্ধাকে হত্যা করে এসেছি, কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গেছে, আমার গলাও শুকিয়ে গেছে, আমার নিশ্বাসটাও সহজভাবে আসছে না। আমি খুবই কাহিল হয়ে গেছি।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, প্রিয় বৎস! ধৈর্য ধারণ কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে যাবে এবং হাউজে কাওছারের পানি দ্বারা তোমার তৃষ্ণা মিটাবে। কিন্তু বাবা! তুমি যখন আমার কাছে এসেছ, এসো, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, মুখ খোল! হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম মুখ খুললেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শুষ্ক জিহ্বা মুবারক ছেলের মুখের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার জিহ্বাটা চুষে নাও, হয়তো কিছুটা আরামবোধ করবে। হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনার আব্বাজানের জিহ্বা চুষতে লাগলেন। জিহ্বা চুষে কিছুটা আরামবোধ করলেন।

এরপর হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম পুনরায় জিহাদের ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম জিহাদের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি শেরে খোদার দৌহিত্র। তাঁর শিরা-উপশিরায় হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার রক্ত মুবারক রয়েছে এবং তাঁর চোখে হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার শক্তি কাজ করছে। তিনি আশি জন ইয়াযীদী বাহিনীকে হত্যা করে নিজে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে শাহাদাত বরণ করার আগ মুহূর্তে ডাক দিয়ে বললেন- يا ابتاه ادركنى ‘ইয়া আবাতাহ! আদ্রিক্নী’ অর্থাৎ ‘ওহে আব্বাজান! আমাকে ধরুন, আমাকে নিয়ে যান, আপনার আলী আকবর পড়ে যাচ্ছে।’ এ আহবান শুনে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম দৌঁড়ে যান। তিনি ছেলের কাছে পৌঁছার আগে যালিমরা হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারক থেকে মাথা মুবারক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ছেলের শহীদী দেহের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের পানি ফেলছিলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে ছেলের শহীদী দেহ কাঁধে উঠিয়ে তাঁবুর পার্শে¦ নিয়ে আসলেন। হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনার এ শাহাদাতে প্রত্যেকেই দারুণভাবে আঘাত পেলেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে হযরত ইমাম আলী আকবর আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর শহীদী দেহ মুবারক দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আহ! যালিমরা প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিচ্ছবিকেও শেষ করে দিল।’




হযরত আলী আছগর আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর শাহাদাতঃ

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম ভাতিজা হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে কাঁদছিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বোনের হাত ধরে তাঁবুর অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘বোন! ছবর করো, আল্লাহ তায়ালা ছবরকারীদের সাথে আছেন। ছবর এবং ধৈর্যের আঁচল হাতছাড়া করো না। যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা’র পক্ষ থেকে হচ্ছে। আমাদের ছবর ও ধৈর্যের মাধ্যমে কামিয়াবী হাছিল করতে হবে। এটা আল্লাহ তায়ালা’র পক্ষ থেকে মহাপরীক্ষা।’
বোনকে নিয়ে যখন তাঁবুর অভ্যন্তরে গেলেন, তখন হযরত শহরবানু আলাইহাস সালাম হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সামনে এসে বললেন, আপনার ছেলে আলী আছগর পানির তৃষ্ণায় কেমন যেন করছে, গিয়ে দেখুন। পানির তৃষ্ণায় তাঁর অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে গেছে। কোন রকম নড়াচড়া করতে পারছে না। কাঁদছেন কিন্তু চোখে পানি আসছে না। মুখ হা করে আছেন, কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেছে। শুনুন, যালিমেরা হয়তো জানে না যে, আমাদের সাথে ছোট ছোট শিশুরাও রয়েছেন। আমার মনে হয়, এ ছোট শিশুকে কোলে করে আপনি ওদের সামনে নিয়ে গেলে নিশ্চয় ওদের দিলে রহম হতে পারে। কারণ এ রকম শিশু ওদের ঘরেও রয়েছে। তাই আপনি এ শিশুকে কোলে করে ওদের সামনে নিয়ে যান এবং বলুন, আমাকে পানি দিও না, তোমাদের হাতে কয়েক ফোঁটা পানি এ শিশুর মুখে দাও। তাহলে তারা নিশ্চয় দিবে। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, ‘শহরবানু! তোমার যদি এটা আরজু এবং ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে তোমার এ ইচ্ছা পূর্ণ করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু ঐ বদবখ্তদের প্রতি আমার আদৌ আস্থা নেই।’
যা হোক, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কোলে নিয়ে ইয়াযীদ বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, ‘দেখ! ইনি ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশু। ইনি আমার ছেলে আলী আছগর। ইনি তোমাদের সেই নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর, তোমরা যার কলিমা পাঠ করো। শোন! আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করে থাকলে, আমার থেকে তোমরা এর বদলা নেবে। কিন্তু এ মাছূম শিশুতো তোমাদের কোন ক্ষতি করেননি। ইনি পানির তৃষ্ণায় ছটফট করছেন, কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না। শোন! আমার হাতে কোন পানির পেয়ালা দিও না, তোমাদের হাতে এ শিশুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দাও। আর এ শিশু পানি পান করার পর তৃষ্ণা মিটে গেলে তলোয়ার হাতে নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। তাই উনার তৃষ্ণাটা নিবারণ করো। তাঁবুর পর্দানশীন মহিলাদের কাকুতি-মিনতিতে টিকতে না পেরে আমি একে নিয়ে এসেছি। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম এ করুণ বর্ণনা দিচ্ছিলেন, আর এদিকে আলী আছগর আলাইহিস সালাম আলাইহিকে লক্ষ্য করে ‘হরমিলা বিন্্ কাহিল’ নামক এক বদবখ্্ত যালিম তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেই তীর এসে আলী আছগর আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর গলায় বিধল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম দেখলেন, শিশুটি একটু গা-নাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন, বলতে লাগলেন, ‘ওহে যালিমেরা! তোমরাতো তোমাদের নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিও কোন সমীহ করলে না। তোমাদের মনতো কাফিরদের থেকেও কঠোর। শিশুদের প্রতি কাফিরেরাও সহানুভূতি দেখায়। তোমরাতো নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করো। এসব কথা বলে তিনি ছেলের গলা থেকে তীর বের করলেন এবং নিথর দেহ মুবারক মাটিতে রেখে বললেন, মাওলা! এ লোকেরা যা কিছু করছে, এর জন্য আমি আপনাকে সাক্ষ্য করছি। দেহ মুবারক কাঁধে করে তাঁবুর কাছে নিয়ে এসে হযরত আলী আকবর আলাইহিস সালাম উনার পাশে রেখে ডাক দিয়ে বললেন, ‘ওহে শহরবানু! ওহে যয়নাব! আলী আছগর আর ছটফট করবেন না এবং তৃষ্ণার কারণে হাত পা নড়াচড়া করবেন না। উনার তৃষ্ণার্ত অবস্থা থেকে তোমাদের অস্থিরতা আর বৃদ্ধি পাবে না। সে জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে উনার দাদীজান আলাইহাস সালাম উনার কোলে বসে হাউজে কাওছারের পানি পান করছেন।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার জিহাদের ময়দানে গমনঃ

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁবুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছেলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলী আওসাত আলাইহিস সালাম, যিনি মারাত্মক রোগ ও জ্বরে ভুগছিলেন, হেলিয়ে দুলিয়ে কোন মতে আব্বাজানের সামনে এসে আরজ করলেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন, আমিও শাহাদাত বরণ করতে চাই। তিনি নিজের অসুস্থ ছেলেকে সান্ত¡না দিলেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, যাইনুল আবিদীন! তোমাকেও যদি বিদায় দিই, তাহলে ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ‘সিলসিলা’ কার থেকে জারি হবে? বাবা শোন! তোমার থেকেই আমার বংশের ‘সিলসিলা’ জারি হবে। আমি দুআ করছি, আল্লাহ পাক তোমাকে জীবিত রাখুন এবং তোমার থেকে আমার বংশধরের ‘সিলসিলা’ জারি রাখুন। তিনি উনাকে বাতিনী খিলাফত ও ইমামত প্রদান করলেন। উনাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বাতিনী নিয়ামত প্রদান করলেন এবং কিছু ওছীয়ত করার পর ফরমালেন, প্রিয় বৎস! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনা শরীফ-এ পৌঁছার যদি সৌভাগ্য হয়, তাহলে সবার আগে তোমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ-এ গিয়ে সর্বপ্রথম আমার সালাম বলবে এবং কারবালায় তোমার দেখা সমস্ত ঘটনা উনাকে শুনাবে।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, দেখ, আমি কে? আমি হলাম জান্নাতের যুবকদের সাইয়্যিদ। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁকে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন এবং বলতেন, এটা আমার ফুল। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁর মা সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁর পিতা হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যিনি খাইবর বিজয়ী। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যখন আল্লাহ পাক উনার নবী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদারত অবস্থায় থাকতেন, আমি উনার পিঠ মুবারকের উপর সওয়ার হয়ে যেতাম আর তখন উনি সিজদাকে দীর্ঘায়িত করতেন। ওহে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘরকে উচ্ছেদকারীরা! ওহে হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার বাগানের ফুলকে ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে নিক্ষেপকারীরা! এসো, আমার রক্তের দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো। আমার পিছনে আর কেউ নেই। একমাত্র আমিই রয়েছি। এগিয়ে এসো। তখন ওরা তলোয়ার খাপ থেকে বের করে তীর উত্তোলন করে এগিয়ে আসলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ওদের উপর আক্রমণ করলেন, তখন ওরা মেষের মত ছুটে পালাতে লাগলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তলোয়ার বিদ্যুৎ বেগে ওদের উপর চলতে শুরু করলো এবং ওদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনভাবে পতিত হতে লাগলো যেমন শীতকালে বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। শেরে খোদার আওলাদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম লাশের স্তূপ করে ফেললেন। তিনি নিজে তীরের আঘাতে জর্জরিত এবং তিনদিনের তৃষ্ণায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তলোয়ার ‘যুলফিকার’ তখনও সেই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল, যেভাবে বদরের যুদ্ধে দেখিয়েছিল। বদরের যুদ্ধে এ তলোয়ার যখন শেরে খোদা হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হাতে ছিল এবং চালানো হচ্ছিল, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসছিল- ‘লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লা যুল্ফিকার’ অর্থাৎ ‘ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মত যেমন কোন জওয়ান নেই, তেমনি ‘যুলফিকার-এর মত কোন তলোয়ার নেই।’ বদর যুদ্ধের ন্যায় কারবালার ময়দানেও সেই তলোয়ার নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল।
মোট কথা, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম লাশের স্তুপ করে ফেললেন। ইয়াযীদী বাহিনীকে কেটে কেটে মাটি রঞ্জিত করে ফেললেন। একদিকে তিনি যেমন অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে কচুকাটা করে ছিলেন অন্যদিকে ওরাও উনাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললো।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতঃ

ইয়াযীদী বাহিনীর মারাত্মক পরিণতির কথা উপলব্ধি করে আমর বিন সা’আদ নির্দেশ দিল, সবাই মিলে চারিদিক থেকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করো। নির্দেশমত ইয়াযীদী বাহিনী উনাকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো। ফলে চারিদিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে আঘাত হানতে লাগলো। কোনটা ঘোড়ার গায়েও লাগছিল, কোনটা উনার নিজের গায়ে পড়ছিল। এভাবে যখন তীরের আঘাতে উনার পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ফিনকি দিয়ে সারা শরীর মুবারক থেকে রক্ত বের হতে লাগলো। তখন উনি বার বার মুখে হাত দিয়ে বললেন, বদবখতের দল! তোমরাতো তোমাদের নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার লেহাজও করলে না। তোমরা নিজের নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধরকে কতল করছো! এভাবে যখন তিনি আর একবার মুখের উপর হাত দিলেন, তাঁর চোখের সামনে আর এক দৃশ্য ভেসে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন, স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত মুবারকে একটি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাও পার্শ্বে আছেন আর বলছেন, ‘হুসাইন! আমাদের দিকে তাকাও, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি।’

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই রক্ত বোতলে ভরে নিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ পাক! হুসাইনকে পরম ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করুন।’ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে পড়লেন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহ পাক উনার আরশ দুলতে লাগলো, হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার আত্মা মুবারক যেন ছটফট করতে লাগলো, হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার রূহ মুবারক থেকে যেন ‘আহ’ শব্দ উচ্চারিত হলো। সেই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যমীনে পড়ে গেলেন, যাকে প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কাঁধ মুবারকে নিতেন। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর কমবখ্্ত সীমার, হাওলা বিন ইয়াযীদ, সেনান বিন আনাস প্রমুখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারকের উপর চেপে বসলো। সীমার বুকের উপর বসলো। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন, ‘এক হিংস্র কুকুর আমার আহলে বাইতের রক্তের উপর মুখ দিচ্ছে’, আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা মুবারক নির্ঘাত সত্য, তুমিই আমাকে শহীদকারী। আজ জুমুয়ার দিন। এ সময় লোকেরা আল্লাহ পাক উনার দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করো, যখন আমিও সিজদারত থাকি।’

আল্লাহু আকবর! দেখুন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম জীবন সায়াহ্নের সেই মুহূর্তেও পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, নিজের ছেলেমেয়েকে দেখার জন্য আরজু করেননি, সেই সময়ও আকাঙ্খা বা আরজু এটাই ছিল যে, আমার মাথা নত হলে যেন আল্লাহ পাক উনার সমীপেই নত হয়।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম সিজদায় মাথা রাখলেন এবং سبحان ربى الاعلى ‘সুবহানা রব্বিইয়াল আ’লা’ তাসবীহ পাঠ করে বললেন, মাওলা! যদি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কুরবানী আপনার দরবারে গৃহীত হয়, তা’হলে এর ছওয়াব নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতের উপর বখশিশ করে দিন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো, তখন উনার ঘোড়া স্বীয় কপালকে উনার রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগল, তখন সীমার লোকদেরকে বলল, ঘোড়াটিকে ধরো, কিন্তু যতজন লোক ঘোড়াটি ধরতে এগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমণ করল এবং দাঁত আর পা দিয়ে জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতের জন লোককে এভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল, ছেড়ে দাও, দেখি কি করে? ঘোড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না ও চিৎকার করতে লাগলো।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারকের পার্শ্বে হযরত যয়নাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাঃ

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম যখন ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন তিনি হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহাকে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবতঃ তোমার আব্বা এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে দেখলেন, ঘোড়ার জীন খালি এবং ঘোড়ার কপাল রক্তে রঞ্জিত। তা দেখে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম বুঝতে পারলেন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন- واه حسينا ‘ওয়াহ্্ হুসাইনা’ واه غريبا ‘ওয়াহ্্ গরীবা।’ তাঁর এ আওয়াজ শুনার সাথে সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের রোল পড়ে গেলো। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম ডাক দিয়ে বললেন, শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে যাচ্ছি।
হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার কন্যা হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম; যার মাথার ওড়নাও কোন অপরিচিত ব্যক্তি কখনো দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি থেকে কখনো বের হননি, আজ পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের উপর পর্দা ফেলে ভাইয়ের শহীদী দেহ মুবারক দেখার জন্য কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে চললেন। যেতে যেতে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ওহে যালিমেরা! পথ ছেড়ে দাও, আমার ভাইকে দেখতে দাও।’ ওরা বলল, আপনি উনাকে কি দেখবেন? উনার মাথা মুবারক শরীর মুবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম গিয়ে ভাইয়ের রূহবিহীন, মস্তকবিহীন দেহ মুবারক দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, ভাইজান! আপনিতো আমাদেরকে যালিমদের হাওলা করে চলে গেলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারক কারবালার যমীনে পড়ে রইল। যেসব লোকেরা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারক দাফন করেছিলেন, তারা বলেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারকে চৌঁত্রিশটি বর্শার ছিদ্র , চল্লিশটা তলোয়ারের আঘাত এবং একশত একুশটি তীরের জখম ছিল।

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম নিজের ভাইয়ের শহীদী দেহ মুবারকের পাশে বিভোর হয়ে পড়ে রইলেন; এদিকে হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহা, হযরত শহরবানু আলাইহাস সালাম থেকে নিজেকে মুক্ত করে কারবালার ময়দানের দিকে অঝোর নয়নে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে আসলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ফুফু! আপনি কোথায়? আমার আব্বু কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু ডাক দিলেন, বেটি! এদিকে এসো, তোমার মজলুম ফুফু তোমার আব্বুর পাশে বসে আছেন। হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহা যখন নিজের আব্বাজানকে দেখলেন, চিনতে পারলেন না। কারণ উনার সমস্ত শরীর মুবারক রক্তে রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক শরীর থেকে বিছিন্ন ছিল। মা’ছুমা সখিনা রহমতুল্লাহি আলাইহা আব্বাজানের দেহ মুবারকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত সখিনা আলাইহাস সালাম উনার হাত টেনে ধরে বললেন, মা সখিনা! ওঠ, আমি তোমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি। আমার ভাই, আমাকে বলেছিলেন, তোমাকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য। উনি জোর করে হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহাকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বুক মুবারক থেকে ছাড়িয়ে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের শহীদী দেহ মুবারক কারবালার ময়দানে পড়ে রইলো। ইয়াযীদী বাহিনীরা, যারা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে, বাস্তবে তাদের এমন পরাজয়ই হয়েছে যা আর কারো হয়নি। কারণ তারা চিরতরের জন্য আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শাফায়াত ও জান্নাত থেকে বঞ্চিত। যাক, তারা এক রাত সেখানে অবস্থান করলো। যখন তারা শুয়ে পড়ল, হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম মুখে পর্দা ফেলে তাঁবু থেকে পুনরায় বের হলেন। দেখলেন, হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার বাগানের জান্নাতী ফুল কারবালার প্রান্তরে পড়ে রয়েছেন। নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নয়নের মণি চকমক করছেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম এক পলক সকল প্রিয়জনকে দেখলেন। ছবর ও ধৈর্যে অটল থাকা সত্ত্বেও অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক জনকে দেখে দেখে শেষে ভাইয়ের দেহ মুবারকের পাশে আসলেন এবং বসে পড়ে বললেন, ‘ওহে আমার ভাইজান! আমি অসহায়, অপারগ, ভিন-দেশের মুসাফির। মদীনা মুনাওওয়ারা অনেক দূর। আমি কিভাবে ওখানে আপনার খবর পৌঁছাবো? আমি কিভাবে আপনার দাফন করবো?’

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম মদীনা মুনাওওয়ারার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় হাত তুলে বলতে লাগলেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তকবিহীন দেহ মুবারক কাফন ও দাফন বিহীন রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।’ আর এদিকে রুগ্ন হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম হাত তুলে বলছেন-
للعالـمين- ادركنى زين العابدين يارحمة
‘ইয়া রহমতাল্লিল আলামীন! আদরিকী যাইনাল আবিদীন’ অর্থাৎ ‘হে রহমাতুল্লিল আলামীন ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার উপর রহম করুন।’ এভাবে রাত্রি অতিবাহিত করলেন।
উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন যে, ‘হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের সময় সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আসমান ঘোর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে তারকারাজি দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশ কালো থেকে লাল বর্ণে পরিণত হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত বর্ষিত হয়েছিল। সাতদিন পর্যন্ত এ রক্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। সমস্ত ঘর বাড়ির দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং যেসব কাপড়ের উপর রক্ত পতিত হয়েছিল, সেসব কাপড় ছিড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার পরও সেই রক্তের লালিমা যায়নি। যমীনও কান্নাকাটি করেছিল। বায়তুল মুকাদ্দাসে যে পাথরটা উঠানো হতো, সেই পাথরের নিচ থেকে তাজা রক্ত বের হতো। পানি ভর্তি কলস রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইয়াযীদী বাহিনীরা যখন উট যবেহ করেছিল তখন সে উটের ভিতর থেকে রক্তের পরিবর্তে আগুনের লেলিহান শিখা বের হয়েছিল। জিনদের মধ্যেও শোক-বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।

অনেক বেদনাবিধূর, রোমহর্ষক ঘটনার কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাত অপরিসীম হৃদয় বিদারক। এর কল্পনা করাও যায় না। এর স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন-প্রাণ শিউরে ওঠে।
ইমাম পরিবারকে কূফায় আনয়নঃ

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের পর ইয়াযীদী বাহিনী একরাত কারবালার প্রান্তরে অবস্থান করেছিল। পরের দিন সকালে তারা তাদের মৃতদেরকে দাফন করেছিল। কিন্তু শহীদদের দেহ মুবারকগুলো দাফন ও কাফন বিহীন অবস্থায় যেমনি ছিল, তেমনি অবস্থায় ফেলে রেখে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার পরিবারের অবশিষ্ট মহিলা ও শিশুদেরকে বন্দি করে উটের উপর আরোহণ করিয়ে কূফার দিকে রওয়ানা দিল। চলতে চলতে তারা রাত্রি বেলা কূফার কাছে গিয়ে পৌঁছল। ঐখান থেকে মাত্র দুই মঞ্জিল দূরত্বে ছিল কূফার রাজধানী।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক নিয়ে ‘হাওয়া বিন ইয়াযীদ’ যখন রাত্রে কূফার রাজধানীতে এসে পৌঁছেছিল, তখন গভর্নর ভবনের শাহী দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর জিম্মাদারী যেহেতু ওর হাতে, সেহেতু অন্য কাউকে হস্তান্তর না করে মস্তক মুবারক তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি মাটির বাসনের নিচে মস্তক মুবারক রেখে দিল। ওর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এনেছ? সে উত্তরে হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মস্তক মুবারকের কথা বললো। এটা শুনে তার স্ত্রী শিউরে উঠলো এবং বলল, ‘কী জঘন্য ব্যাপার! তোমার ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে। হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মস্তক মুবারক! নবী মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রের মস্তক মুবারক তুমি মাটির থালার নিচে রাখতে পেরেছ! আফসুস! মানুষ ঘরে সোনা-চান্দি আনে, আর তুমি এনেছ নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রের ছিন্ন মস্তক মুবারক? আর এভাবে বেয়াদবী এবং অবজ্ঞাভরে রেখে দিয়েছ! আমি তোমার মত বদবখত্ লোকের সাথে থাকতে চাই না’- এ বলে তিনি মস্তক মুবারকের কাছে এসে সসম্মানে তা মাটি থেকে উঠিয়ে উচ্চ স্থানে রাখলেন এবং পাশে বসে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় চিন্তা করতে লাগলেন, কী জানি আমাদের ঘরে আল্লাহ তায়ালা’র কোন্ গযব নাযিল হয়। এমন সময় তিনি কী দেখতে পেলেন, তা তার ভাষায় শুনুন- আমি দেখলাম, আসমান থেকে ছোট ছোট সাদা পাখির আগমন হলো এবং সেগুলো উনার মস্তক মুবারকের এদিক সেদিক উড়ছিল এবং ঘুরাঘুরি করছিল। একবার চলে যেত, আবার আসত। সারা রাত এ অবস্থায় ছিল। আর মাঝে মধ্যে মস্তক মুবারক থেকে এমন উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখলাম, যা আসমান পর্যন্ত আলোকিত করে ফেলত।

ইবনে যিয়াদের নিষ্ঠুর আচরণঃ

রাত অতিবাহিত হওয়ার পর সকাল হলো। ইবনে যিয়াদ সভাগৃহে আগমন করল এবং তাকে কারবালার তথাকথিত বিজয় সম্পর্কে অবহিত করল। হাওলা বিন ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক নিয়ে একটা পাত্রের উপর রেখে তা’ ইবনে জিয়াদের সামনে রাখল। তখন ইবনে যিয়াদের হাতে একটি ছড়ি ছিল। সে ছড়ির মাথা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ঠোঁট মুবারকের উপর লাগাল এবং দাঁত মুবারকের সাথে ঘষতে লাগল। সেই সময় তার সভাগৃহে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একজন বৃদ্ধ ছাহাবী হযরত যায়িদ বিন হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ বেয়াদবী দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বলে উঠলেন, ‘হে ইবনে যিয়াদ! যে ঠোঁট এবং দাঁত মুবারকের উপর তুমি আঘাত হানছো, খোদার কছম করে বলছি- আমি স্বয়ং দেখেছি, সে দাঁত ও ঠোঁট মুবারকের উপর নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন। আর আজ তুমি সে ঠোঁট এবং দাঁত মুবারকের সাথে বেয়াদবী করছ?’ ভর মজলিসে এ কথাগুলো বলার কারণে ইবনে যিয়াদ খুবই রাগান্বিত হল এবং বলল, এ বৃদ্ধকে এখান থেকে বের করে দাও। বৃদ্ধ না হলে আমি এ মুহূর্তে গর্দান দ্বিখ-িত করে ফেলতাম। হযরত যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, ‘তোমার জন্য আফসুস! তুমি আমাকে বৃদ্ধ হিসেবে সহানুভূতি দেখালে, কিন্তু রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শরাফতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলে না! আমি বৃদ্ধ বলে তুমি আমাকে রেহাই দিলে, কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কলিজার টুকরা ও দৌহিত্র হওয়া সত্ত্বেও কোন সমীহ করলে না!’ উনার কথার প্রতি কোনরূপ কর্ণপাত না করে ইবনে জিয়াদের অনুচরেরা উনাকে বেত্রাঘাত করে দরবার থেকে বের করে দিল। (নাঊযুবিল্লাহ)

ইবনে যিয়াদ দরবারে দাঁড়িয়ে কয়েকটি দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলল। যেমন- ‘সব প্রশংসা সেই আল্লাহ’র জন্যে, যিনি দুশমনকে নাজেহাল করেছেন, নাঊযুবিল্লাহ! যিনি দুশমনকে পরাজিত করেছেন, নাঊযুবিল্লাহ! এবং ইবনে যিয়াদকে বিজয় দান করেছেন, নাঊযুবিল্লাহ! এ ধরনের কথা সে বলছিল। সেই সময় খায়বর বিজয়ী বীরের কন্যা হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম সেখানে কয়েদী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন- ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ পাক উনার জন্যে, যিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর হওয়ার কারণে আমাদের সম্মানিত করেছেন। আর যিনি আমাদের সম্পর্কে আয়াতে কারীমা নাযিল করেছেন এবং আমাদের পূত-পবিত্রতার কথা ঘোষণা করেছেন।’ ইবনে যিয়াদ বলে উঠল, তুমি কি এখনও সেই কথা বলছো! তুমি কি দেখনি তোমার ভাইয়ের কি পরিণতি হয়েছে? হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম কেঁদে দিলেন এবং কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে ইবনে যিয়াদ! সেই সময় বেশি দূরে নয়, যখন হাশরের ময়দানে একদিকে নবীয়ে দো’জাহান হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থাকবেন আর একদিকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম থাকবেন; তখন তুমি দেখবে যালিমদের কী পরিণতি হয়। আমাদের আরজি আল্লাহ তায়ালা’র দরবারে পেশ করেছি’ এ কথাগুলো বলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

ইত্যবসরে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ইব্নে জিয়াদের চোখ পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করলো, এ কে? ইয়াযীদ বাহিনীরা বলল, এ হলো হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ছেলে। ইব্নে যিয়াদ বলল, তোমরা একে কেন রেখে দিয়েছ? একে কেন কতল করোনি? ওরা বলল, এ অসুস্থ ছিল এবং আমাদের সাথে মোকাবেলা করতে আসেনি। এজন্য আমরা একে কতল করিনি। ইবনে যিয়াদ বলল, একেও কতল করে দাও। আমি চাই না যে, এদের একজনও বেঁচে থাকুক। পাপিষ্ঠ ইবনে যিয়াদ এ কথাগুলো বলার সাথে সাথে জল্লাদ তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসলো। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম আলাইহিকে জড়িয়ে নিলেন এবং বললেন, ওহে যালিমেরা! আমাদের সাথে কোন পুরুষ মাহরাম (আপনজন) নেই। এ একমাত্র আমাদের মাহরাম। যদি তোমরা একেও কতল করো, আমাদের সাথে কোন মাহরাম থাকবে না। তাই তোমরা এটা জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আমাকে কতল না করবে, এর আগে তোমরা এর কাছেও পৌঁছতে পারবে না। যদি একে কতল করতে চাও তাহলে প্রথমে আমাকে কতল করো। ওহে যালিমেরা! একে বাঁচতে দাও। যদি তোমরা একেও কতল করে ফেল, তাহলে আওলাদে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ‘সিলসিলা’ কিভাবে জারি থাকবে? এ কথাগুলো বলার পর আল্লাহ তায়ালা ইব্নে জিয়াদের অন্তরে এমন এক ভীতি সৃষ্টি করে দিলেন, শেষ পর্যন্ত সে তার এ ঘৃণিত সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রইলো।

এরপর ইবনে যিয়াদ কূফা শহরে সাধারণ সমাবেশের আয়োজন করলো এবং সমবেত লোকদের ধমকী ও হুমকী দিয়ে বলল, দেখ! যারা ইয়াযীদের বিরোধিতা করেছে, তাদের কী পরিণতি হয়েছে। তোমরাও যদি ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলো, তাহলে তোমাদেরও একই পরিণতি হবে। সে নির্দেশ দিল, শহীদদের মস্তকসমূহ বর্শার অগ্রভাগে নিয়ে এবং আহলে বাইত-এর সদস্যদেরকে উটের পিঠে উঠিয়ে কূফার অলিতে-গলিতে যেন ঘুরানো হয়, যাতে লোকেরা দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং আগামীতে ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করার সাহস না পায়। নির্দেশ মুতাবিক মহান শহীদগণের পবিত্র মস্তকসমূহ বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে কূফার অলিতে-গলিতে ঘুরানো হলো এবং সাথে আহলে বাইত-এর সেই পর্দানশীন সম্মানিতা মহিলাগণও ছিলেন, যাদের দোপাট্টা পর্যন্ত লোকেরা আগে কখনও দেখার সুযোগ পায়নি। দুঃখের বিষয়! আজ তাদেরকে বেপর্দাভাবে কুফার অলিতে-গলিতে ঘুরানো হচ্ছে!
যখন তাঁদেরকে ঘুরানো হচ্ছিল তখন ঐসমস্ত কূফাবাসী, যারা চিঠি লিখে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে দাওয়াত দিয়েছিল, যারা হযরত ইমাম মুসলিম আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল এবং যারা বড় বড় শপথ করে বলেছিল, ‘জান-মাল উৎসর্গ করে দিব তবুও আপনার সঙ্গ ত্যাগ করবো না।’ যারা আহলে বাইত-এর মুহব্বতের বড় দাবিদার ছিল, যারা নিজেদেরকে আহলে বাইত-এর প্রেমিক বলতো, সেই কূফাবাসীরা, পবিত্র মস্তকসমূহ বর্শার অগ্রভাগে নিয়ে এবং আহলে বাইত-এর সদস্যগণকে একান্ত অমানবিকভাবে কূফার অলিতে-গলিতে যখন ঘুরাতে দেখলো, তখন তারা নিজেদের ঘরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে, কেউ ঘরের জানালার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল।

যখন হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম তাদের এ কান্না ও চিৎকার করতে দেখলেন, তখন তিনি উটকে থামাতে বললেন এবং ওদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে কুফাবাসী! আজ তোমরা কেন কান্না-রোনাজারি করছো? হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাছে চিঠি প্রেরণকারী ছিল কারা? উনাকে কূফায় আসার জন্য দাওয়াত দানকারী ছিল কারা? হযরত ইমাম মুসলিমকে যখন প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়েছিল, তখন তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল কারা? এবং মুখে বড় বড় কথা বলে শপথ করে জান-মাল কুরবানী করার নিশ্চয়তা দানকারী ছিল কারা? নাফরমানরা! তোমরাইতো চিঠি লিখেছিলে, তোমরাইতো নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে দাওয়াত করে এনেছিলে। এরপর তোমরাইতো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলে এবং উনাদেরকে যালিমদের হাতে সোপর্দ করেছিলে, ফলে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে একান্ত অমানবিকভাবে শহীদ হতে হলো। আর এখন তোমরা অশ্রুপাত করছ! বিশ্বাসঘাতকের দল! তোমরা কি মনে করেছো, তোমাদের এ অশ্রুপাতের ফলে তোমাদের কপাল থেকে আহলে বাইত-এর রক্তের দাগ মুছে যাবে? না! কক্ষনো তা হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তোমরা কাঁদতে থাকলেও তোমাদের ললাট থেকে এ রক্তের দাগ মুছবে না। আমি আল্লাহ পাক উনার নিকট ফরিয়াদ করছি, তোমরা কিয়ামত পর্যন্ত এভাবে কাঁদতে ও চিৎকার করতে থাক। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম কথাগুলো বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

শহীদ পরিবার ও খন্ডিত মস্তক মুবারক দামেস্কে প্রেরণঃ

এভাবে তিনদিন পর্যন্ত মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের সদস্যগণকে ঘুরানোর পর ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিল, এবার এ মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে দামেস্কে ইয়াযীদের কাছে নিয়ে যাও। ইবনে যিয়াদ আরো বলল যে, পথের মধ্যে কোন গ্রাম, বাজার, কোন লোক বসতি সামনে পড়লে যেন তাকবীর ইত্যাদি বলে শোরগোল করে যাওয়া হয়, যাতে লোকেরা ভয় পায় এবং ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করার সাহস না পায়।
অতঃপর ইয়াযীদী বাহিনী মস্তক সমূহ বর্শায় বিদ্ধ করে এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে উটের উপর উঠিয়ে কূফা থেকে দামেস্কের পথে রওয়ানা দিল। চলতে চলতে রাত্রিবেলা এক গীর্জার সন্নিকটে উপনীত হলো। যে সময় এ কাফেলা গীর্জার কাছে পৌঁছল, সে সময় গীর্জা থেকে এর প্রধান পাদ্রী বের হয়ে ওদের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কে? কোথা থেকে আসতেছ? এ মস্তকগুলো কাদের? এ মহিলাগণ কারা? তোমরা যাচ্ছ কোথায়? ঘটনা কি? তারা সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল। পাদ্রী সম্পূর্ণ ঘটনা শুনার পর বলল, তোমরা চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, রাতটা এখানেই কাটাও এবং এক রাতের জন্য হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারকটি আমার কাছে আমানত রাখ এবং এসব পুত-পবিত্র মহিলাগণ যারা আছেন উনাদের খিদমত করারও আমাকে সুযোগ দাও। ওরা বলল, তা কিছুতেই হতে পারে না। সরকারের গুরু দায়িত্ব আমাদের কাঁধে অর্পণ করা হয়েছে। এ মস্তক আমরা কারো কাছে দিতে পারি না। মস্তক ও এদেরকে ইয়াযীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। পাদ্রী বলল, ঠিক আছে পৌঁছাবে, কিন্তু এ রাত্রেতো আর পৌঁছাতে পারবে না। ওরা বলল, আমরা এখানে রাত অতিবাহিত করতে রাজী আছি। কিন্তু মস্তক দিতে রাজী নই। পাদ্রী বলল, আমার থেকে টাকা নিয়ে হলেও এক রাত্রের জন্যে মস্তকটি আমার হিফাজতে দাও এবং আমি ওয়াদা করছি, তোমাদের মস্তক ফিরিয়ে দিব। ওরা বলল, আমাদেরকে কত টাকা দিবেন? পাদ্রী বলল, আমার কাছে আমার সারা জীবনের উপার্জন আশি হাজার দিরহাম জমা রয়েছে। আমি সব তোমাদেরকে দিয়ে দিব। তোমরা শুধু এক রাত্রের জন্যে মস্তকটি দাও। ওরা চিন্তা করল, ইয়াযীদ থেকে তো বখশিশ পাবই, আর এদিকে নগদ আশি হাজার দিরহাম হাতছাড়া করবো কেন? শেষ পর্যন্ত তারা রাজী হয়ে গেল এবং এক রাত্রের জন্যে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারকটি উক্ত পাদ্রীকে দিয়ে দিল।

পাদ্রী গীর্জার এক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কামরা আহলে বাইত-এর সম্মানিত সদস্যগণকে বিশ্রামের জন্য দিয়ে দিল এবং উনাদের খিদমত করার জন্য কয়েকজন খাদিম নিয়োজিত করে তাদেরকে বলে দিল যেন উনাদের কোন কষ্ট না হয়। আহলে বাইত-এর সদস্যগণ পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাদ্রী সাহেব! আমাদের আগমনের খবর আপনি কিভাবে জানতে পারলেন? পাদ্রী বলল, আমি ভিতরে বসা ছিলাম, তখন আপনাদের কাফেলা বেশ কিছু দূরে ছিল, আমি হঠাৎ শুনলাম, আমার গীর্জার বড় দেয়ালটা কাঁদছে। আমি আমার জীবনে এ রকম কান্না আরও কয়েকবার শুনেছি। কান্না শুনার পর আমি বুঝতে পারলাম, কোন একটা অঘটন ঘটেছে। তখন আমি বের হলাম, কি ঘটনা ঘটল তা দেখার জন্য। তখন আমি আপনাদের কাফেলা দেখতে পেলাম। এবং সমস্ত ঘটনা শুনে বুঝতে পারলাম, আপনাদের প্রতি অমানুষিক জুলুম করা হয়েছে। নবী মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে নিদারুণ অত্যাচারের সাথে শহীদ করা হয়েছে এ জন্যই বড় দেয়ালটা কাঁদছিল।

অতঃপর পাদ্রী উনাদেরকে ধৈর্যধারণের কথা বললেন এবং বললেন, আল্লাহ তায়ালা’র নেক বান্দাগণের প্রতি এরকম মুছিবত আগেও এসেছে, বর্তমানেও আসছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। আপনাদেরকে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের নাম কিয়ামত পর্যন্ত চির জাগরুক রাখবেন।

এরপর পাদ্রী ইয়াযীদ বাহিনীকে আশি হাজার দিরহাম দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক নিয়ে নিলেন। মস্তক মুবারক নিয়ে তিনি তার উপাসনালয়ে চলে গেলেন। চেহারা মুবারকে যেসব রক্তের দাগ ছিল, তিনি সব পরিষ্কার করলেন এবং নিজের কাছে যা সুগন্ধি ছিল সব হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার চুল ও দাড়ী মুবারকে ঢেলে দিলেন এবং একটি রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে উঁচু জায়গায় রাখলেন আর সারা রাত তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন ও কান্না-কাটি করলেন। তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারকের যথাসাধ্য যত্ন নিলেন এবং যথাযথ সম্মান করলেন।

মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতের শান দেখুন, সকাল বেলা পাদ্রীর মুখ থেকে কালিমা তাইয়্যিবাহ্ জারি হয়ে গেল। মস্তক মুবারকের তা’যীম করার ফলে আল্লাহ তায়ালা উনাকে ঈমানী দৌলত দ্বারা পরিতুষ্ট করলেন এবং তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। তিনি দুনিয়াবী দৌলত ত্যাগ করলেন, আল্লাহ তায়ালা উনাকে ঈমানী দৌলত দান করলেন। তিনি অস্থায়ী দৌলত (আশি হাজার দিরহাম) ব্যয় করলেন, আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে উনাকে স্থায়ী দৌলত (ঈমান) দান করলেন।

সকালে ইয়াযীদী বাহিনী পবিত্র মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের সদস্যগণকে নিয়ে পুনরায় রওয়ানা দিল। কিছু দূর যাওয়ার পর ইয়াযীদী বাহিনী পরস্পর শলা-পরামর্শ করে পাদ্রী প্রদত্ত আশি হাজার দিরহাম তাদের মধ্যে বণ্টন করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, ইয়াযীদ জানতে পারলে সব দিরহাম নিয়ে নিতে পারে। সিদ্ধান্ত মুতাবিক বণ্টন করার জন্য যেইমাত্র দিরহামের পুটলি খুলল, তখন দেখতে পেল সব মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা এবং প্রতিটি টুকরার দুই পিঠে পবিত্র কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ লিখা। এক পিঠে লিখা ছিল-
وسيعلم الذين ظلموا اى منقلب ينقلبون
অর্থ: ‘যুুলুমকারীরা অতিসত্ত্বর জানতে পারবে, তারা কোন দিক হয়ে বসে আছে।’ (সূরা শুয়ারা-২২৭)
অপর পিঠে লিখা ছিল- ولاتحسبن الله غافلا عما يعمل الظالمون
অর্থ: ‘আল্লাহ তায়ালাকে যালিমের কাজকর্মের প্রতি উদাসীন মনে করো না। যালিমরা যা কিছু করছে, আল্লাহ তায়ালা সব জানেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে বেখবর মনে করো না।’ (সূরা ইবরাহীম-৪২)

দেখুন, আশি হাজার দিরহাম ওরা নিয়েছিল, কিন্তু তা মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা হয়ে গেল। তারাতো দ্বীনের পরিবর্তে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, সেটাতো বিফল হলো। কিন্তু যারা দুনিয়াকে অবজ্ঞা করে দ্বীনকে আঁকড়িয়ে ধরে, দুনিয়াবাসী তাঁদের পিছনে ঝুঁকে পড়ে, সম্পদ তাঁদের পদতলে গড়াগড়ি খায়।

ইয়াযীদের দরবারে শহীদ পরিবার ও ইয়াযীদের ভন্ডামীঃ

ইয়াযীদী বাহিনী আশি হাজার দিরহামের অনুশোচনা করতে করতে দামেস্কে পৌঁছল এবং ইয়াযীদের দরবারে গিয়ে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিল। ইয়াযীদ সমস্ত ঘটনা শুনে বলল, ইবনে যিয়াদ খুবই বাড়াবাড়ি করেছে। আমি ওকে এতটুকু করতে বলিনি। এমনকি অনেক কিতাবে লিখা হয়েছে যে, ইবনে যিয়াদের প্রতি ইয়াযীদ লা’নত দিয়েছিল। অর্থাৎ সে বলেছিল, আল্লাহ তায়ালা ইবনে যিয়াদের উপর লা’নত করুন। ইবনে যিয়াদ খুবই অত্যাচার করেছে, আমার উদ্দেশ্য তা ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে যেন নজর বন্দী করে রাখা হয়, যাতে লোকেরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে। কিন্তু এ ধরনের কথার দ্বারা ইয়াযীদ রেহাই পেতে পারে না। যা কিছু হয়েছে ইয়াযীদের ইঙ্গিতেই হয়েছে। সে ইবনে যিয়াদকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছিল যেন সে যা প্রয়োজন হয়, তা করে। যাতে তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠা বিদ্রোহ দমন হয়ে যায়। ইয়াযীদ ভনিতাপূর্ণ দরদমাখা কথা-বার্তা এজন্যে বলেছিল, যাতে লোকজন তার বিরুদ্ধে চলে না যায় এবং লোকেরা যেন মনে করে, সে এ ধরনের আচরণ করার পক্ষপাতি ছিল না। এসব কথার কারণে অনেক লোক ইয়াযীদকে ভাল বলে আখ্যায়িত করে তাদের রচিত কিতাবে লিখেছে যে, ‘ইয়াযীদ এ শাহাদাতে রাজী ছিল না। সুতরাং, ইয়াযীদ নয় বরং ইবনে যিয়াদই এ ঘটনার জন্য দায়ী।’

মূলতঃ এ ঘটনার জন্য ইয়াযীদই দায়ী ছিল। যার কারণে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘কিতাবুল আক্বায়িদ’-এ লিখা হয়েছে, ইয়াযীদের উপর, ইবনে যিয়াদের উপর, আহলে বাইত-এর সদস্যগণের শহীদকারীদের উপর লা’নত বর্ষিত হোক। যদি ইয়াযীদ নির্দোষ ও নিষ্পাপ হতো তাহলে হযরত ইমাম নাসাফী আলাইহিস সালাম তাঁর ‘কিতাবুল আক্বায়িদ’-এ এ ধরনের কথা কখনও লিখতেন না। আর ইয়াযীদের পরবর্তী পদক্ষেপে তার আসল রূপ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতকিছু বলার পরও সে শহীদগণের মস্তক মুবারক গুলোকে রাতে রাষ্ট্রীয় ভবনের শাহী দরজায় টাঙ্গানোর জন্য এবং দিনে দামেস্কের অলিতে-গলিতে ঘুরানোর নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশ মত মস্তক মুবারকসমূহ দামেস্কের অলি-গলিতে ঘুরানো হয়েছিল।

নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত মিনহাল বিন্ আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, খোদার কসম! আমি স্বচক্ষে দেখেছি যে, যখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে দামেস্কের গলিতে এবং বাজারসমূহে ঘুরানো হচ্ছিল, তখন মিছিলের আগে আগে এক ব্যক্তি কুরআন শরীফ-এর সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিল। যখন সে এ আয়াতে কারীমা-
ام حسبت ان اصحاب الكهف والرقيم كانوا من ايتنا عجبا
অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আছহাবে কাহাফ ও রক্বীম আমার নিদর্শনসমূহের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক নিদর্শন ছিল’ (সূরা কাহাফ-৯) পাঠ করছিল তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিচ্ছিন্ন মস্তক মুবারক থেকে আওয়াজ বের হলো- اعجب من اصحاب الكهف قتلى وحملى অর্থাৎ ‘আছহাবে কাহাফ-এর ঘটনা থেকে আমার শাহাদাত এবং আমার মস্তক নিয়ে ঘুরাফেরা আরও অধিক আশ্চর্যজনক।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান- ولاتقولوا لمن يقتل فى سبيل الله اموات ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে, তাদেরকে মৃত বলো না।’ (সূরা বাক্বারা-১৫৪) হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবরাক তা প্রমাণ করে দিল।
শহীদ পরিবারের মদীনা শরীফ প্রত্যাবর্তন:

এরপর ইয়াযীদ হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তলব করল, যিনি একজন বিশিষ্ট ছাহাবী ছিলেন। উনাকে ডেকে বলল, আপনার সাথে আরো ত্রিশজন লোক নিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে বাহনযোগে মদীনা মুনাওওয়ারায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসুন। হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ প্রস্তাবকে সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করলেন। অতঃপর ত্রিশজন সহকর্মীসহ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে মদীনা মুনাওওয়ারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললেন, আমাদেরকে কারবালার পথ দিয়ে নিয়ে যান। আমরা দেখে যেতে চাই, আমাদের শহীদদের দেহ মুবারক সেইভাবে পড়ে আছে, না কেউ দাফন করেছে। যদি দাফনবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, প্রথমে আমরা তাঁদেরকে দাফন করবো, এরপর ওখান থেকে রওয়ানা হবো। আর যদি কেউ দাফন করে থাকে, তাহলে তা দেখে অন্ততঃ কিছুটা সান্ত¡না পাব। হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম-এর কথার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করলেন এবং কারবালার পথ ধরলেন। কারবালায় গিয়ে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম সেই প্রান্তর যখন দেখলেন, যেই প্রান্তরে উনাদের আপনজনদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছিল, হঠাৎ উনি অপ্রত্যাশিতভাবে চিৎকার করে উঠলেন এবং অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, এখানে হযরত আলী আছগরের দেহ মুবারক পড়েছিল, ওখানে হযরত আলী আকবরের দেহ মুবারক পড়ে ছিল, এখানে আমার ভাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার দেহ মুবারক পড়েছিল। তিনি এভাবে যখন হাতের আঙ্গুল দ্বারা দেখিয়ে দেখিয়ে দেহ মুবারকগুলোর অবস্থানের কথা বলছিলেন, তখন সবারই মুখ থেকে ক্রন্দনের করুণ আওয়াজ বের হচ্ছিল।

কারবালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম ছিল, যার নাম ছিল আমরিয়া। ইয়াযীদ বাহিনী চলে যাওয়ার পর ঐ আমরিয়া গ্রামের অধিবাসীরা এসে শহীদদের দেহ মুবারকসমূহ দাফন করেছিল। মদীনা শরীফ থেকেও একটি দল হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নেতৃত্বে কারবালায় এসে পৌঁছেছিল। শহীদ পরিবারের কাফেলা যখন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছল, সেই সময় মদীনা শরীফ থেকে আগত দল ও আমরিয়া গ্রামের অধিবাসীরাও উপস্থিত ছিল। তারা যখন এ মজলুম কাফেলাকে দেখলো তখন আর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হল। ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল ২০শে সফর অর্থাৎ শহীদদের ‘চেহলামের’ দিন। কাফেলার সবাই সেই রাত সেখানেই অতিবাহিত করেন। সারা রাত তাঁরা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করেন, দুয়া-দুরূদ শরীফ পাঠ করেন এবং খাবারের জন্য খিচুড়ী পাকান। আজকাল মুসলমানগণ যেরূপ কারো ইন্তিকালের পর ফাতিহা পাঠ বা ঈছালে ছওয়াব উপলক্ষে খিচুড়ী বা অন্য তাবারুকের ব্যবস্থা করে থাকেন। এটা মূলতঃ উনাদেরই স্মৃতিচারণ।

শহীদ পরিবার কারবালার প্রান্তরে একদিন এক রাত অবস্থানের পর মদীনা মুনাওওয়ারার পথে রওয়ানা হলেন। কাফেলা যখন মদীনা মুনাওওয়ারার সন্নিকটে পৌঁছল এবং চোখের সামনে মদীনা শরীফ-এর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল, তখন সবারই চোখ আবার অশ্রু সজল হয়ে উঠলো এবং একান্ত ধৈর্য ও ছবরের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অগ্রসর হলেন। এদিকে তাঁদের আগমনের খবর বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র মদীনা মুনাওওয়ারায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড় মেয়ে হযরত ফাতিমা আলাইহিস সালাম আলাইহা মদীনা শরীফ-এ ছিলেন, যাঁর সাথে হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বড় ছেলের বিবাহ হয়েছিল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ভাই হযরত মুহম্মদ বিন হানাফিয়া আলাইহিস সালাম আলাইহিও মদীনা শরীফ-এ ছিলেন, হযরত মুসলিম বিন আকিল আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর মেয়ে ও বোনেরাও তখন মদীনা শরীফ-এ ছিলেন। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আহলিয়া উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাও মদীনা শরীফ-এ ছিলেন। উনারা সকলেই এবং মদীনা শরীফ-এর প্রতিটি ঘরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রত্যেকেই মজলুম কাফেলাকে এক নজর দেখার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড় মেয়ে হযরত ফাতিমা আলাইহিস সালাম আলাইহা যখন মজলুম কাফেলাকে এগুতে দেখলেন, তখন একান্ত ছবর ও ধৈর্যশীলা হওয়া সত্ত্বেও অজান্তে হু হু করে কেঁদে উঠলেন এবং ফুফু হযরত যয়নাব আলাইহাস সালামকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, ফুফু! আমার আব্বাজানকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার ভাই আলী আছগর ও আলী আকবরকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার চাচাতো ভাই ক্বাসিমকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার আব্বাস চাচাজান কোথায়? আমাদের ভরপুর ঘর কোথায় লুণ্ঠিত হলো? হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার সুশোভিত বাগানকে কারা ছিন্নভিন্ন করলো? এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন তখন এমন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল যে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনেকে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। লোকেরা অনেক সান্তনা দিয়ে, ছবর ও ধৈর্যের কথা বলে কাফেলাকে মদীনা শরীফ-এ নিয়ে আসলেন।

হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম উনার রওজা শরীফ-এ উপস্থিতি:

মজলুম কাফেলার সকলেই যখন কান্নায় ভেঙে পড়লেন তখন কাফেলার একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম শোকে পাথর হয়ে এক কিনারে দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই যখন উনাকে ঘরে যাওয়ার জন্য জোর করলেন, তিনি বললেন, আমার আব্বাজান ওছীয়ত করেছেন, মদীনা শরীফ পৌঁছে যেন সবার আগে তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওজা শরীফ-এ হাজিরা দিই। তাই আমি রওজা পাকে যাওয়ার আগে কোথাও যাব না। অতঃপর তিনি রওজা শরীফ-এ গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম যিনি এতক্ষণ পর্যন্ত ছবর ও ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিশ্চুপ ছিলেন, তিনি রওজা পাক-এর সামনে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শুধু এতটুকু বলতে পারছিলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সালাম গ্রহণ করুন। এরপর তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল এবং অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের দেখা কারবালার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন। আর তাঁর কান্নার সাথে সাথে মদীনা শরীফ-এর সমস্ত দেয়াল থেকে কান্নার রোল বের হচ্ছিল এবং রওজা মুবারকও থরথর করে কাঁপছিল এবং সেখান থেকে আওয়াজ বের হলো, যাইনুল আবিদীন! তুমি আমাকে কী শুনাচ্ছ? আমি তো সব কিছু স্বচক্ষে দেখেছি।

মদীনাবাসী হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম উনাকে ধৈর্য ধারণের কথা বললেন, আল্লাহ তায়ালা’র যা হুকুম ছিল, তা হয়েছে। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিতা আহলিয়া উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম তিনি বর্ণনা করেন, মদীনা শরীফ-এ একবার সেই দিন ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেই দিন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালা’র সান্নিধ্যে গমন করেছিলেন। আর একদিন ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হলো, যেদিন হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম কারবালা থেকে ফিরে এসেছেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আরো বর্ণনা করেন, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর দিন অদৃশ্য থেকে যেভাবে ক্রন্দনের আওয়াজ শুনা গিয়েছিল, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের সময় একইভাবে অদৃশ্য থেকে কান্নার আওয়াজ শুনা গিয়েছিল।

রওজা শরীফ-এ হাজিরা দিয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম ঘরে গেলেন এবং একান্ত ছবর ও ধৈর্য সহকারে মদীনা শরীফ-এ অবস্থান করতে লাগলেন। হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম-এর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, যখন তিনি পানি দেখতেন সীমাহীন কান্নাকাটি করতেন এবং বলতেন, এই সেই পানি, যা আলী আছগরের ভাগ্যে জোটেনি, হযরত আলী আকবরের ভাগ্যে জোটেনি, আহলে বাইত-এর সদস্যদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। উনার সামনে যখন খাবার আনা হতো তিনি দু’ এক লোকমা মুখে দিয়ে অবশিষ্টগুলো সামনে থেকে নিয়ে যেতে বলতেন। সবসময় একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। সাধারণ লোকদের সাথে মেলামেশা করতেন না এবং যতদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন, কোনদিন হাসেননি। উনার ছেলে হযরত ইমাম মুহম্মদ বাকির আলাইহিস সালাম একদিন উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আব্বাজান! কী ব্যাপার? আমি আপনাকে কোনদিন হাসতে দেখিনি। তিনি বললেন, বৎস! আমার চোখের সামনে কারবালার যে দৃশ্য ফুটে রয়েছে, তা দেখলে তোমার মুখ থেকেও চিরদিনের জন্য হাসি বন্ধ হয়ে যেত! তুমিও সারা জীবনে কোনদিন হাসতে না। বৎস! আমি পুতঃপবিত্র শরীর মুবারককে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখেছি, প্রিয় নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নকশা মুবারককে দাফন-কাফনবিহীন অবস্থায় কারবালার প্রান্তরে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্রকে আঘাতে জর্জরিত হয়ে কারবালার তপ্ত বালি-রাশির উপর দাফন-কাফনবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি।

হযরত উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন, এই পৃথিবীতে পাঁচজন ব্যক্তি খুব বেশি কান্নাকাটি করেছেন। তাঁরা হলেন- এক. হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম, জান্নাত থেকে যমীনে তাশরীফ আনার পর খুবই কান্নাকাটি করেছেন। দুই. হযরত ইয়াহ্ইয়া আলাইহিস্ সালাম, আল্লাহ তায়ালা’র ভয়ে খুবই কেঁদেছিলেন। তিনি এত বেশি কান্নাকাটি করেছিলেন যে, দু’ গাল মুবারক বেয়ে চোখের পানি পড়তে পড়তে চেহারা মুবারকে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিন. হযরত ইয়া’কূব আলাইহিস সালাম, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর বিচ্ছেদের কারণে খুবই কেঁদেছিলেন এবং অজস্র ধারায় চোখের পানি ফেলেছিলেন। চার. সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহ্লিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর পর খুবই কেঁদেছিলেন। পাঁচ. হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম কারবালার ঘটনার পর অনেক কেঁদেছিলেন।

আহলে বাইত-এর প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই মদীনাবাসীগণ কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা জেনে গিয়েছিলেন:
আহলে বাইত-এর প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই মদীনাবাসীগণ কারবালা ময়দানের মর্মান্তিক ঘটনা জেনে গিয়েছিলেন। স্বয়ং আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাস্্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তাদেরকে স্বপ্নযোগে এই খবর জানিয়েছিলেন। ইমাম বায়হাকী আলাইহিস সালাম ‘দালায়িলুন নুবুওওয়াত’ গ্রন্থে সনদ সহকারে একটি রিওয়ায়িত উদ্ধৃত করেছেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম কূফা গমনের পর এক রাত্রে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্বপ্নে দেখলেন, যেন দুপুর বেলা নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর চেহারা মুবারক মলিন, কেশ মুবারক উস্ক-খুস্ক। একটি শিশি হাতে নিয়ে তিনি এসেছেন। শিশিটিতে রক্ত ভরা ছিল। হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার হাত মুবারকে ঐ শিশিটিতে কি রয়েছে? নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘এটাতে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার রক্ত মুবারক রয়েছে। আমি এটা আল্লাহ পাক উনার দরবারে পেশ করে বিচার চাইবো।’ হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তৎক্ষণাৎ লোকদের জানিয়েছিলেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শাহাদাত বরণ করেছেন।

ইমাম তিরমিযী আলাইহিস সালাম বর্ণনা করেন- উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, একদা আমি খাবে (স্বপ্নে) দেখলাম যে, নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর চুল-দাঁড়ি মুবারকে মাটি লেগে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার এই অবস্থা কেন? তিনি বললেন, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে শহীদ করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

এসব স্বপ্ন ও তার পরবর্তী বিভিন্ন লোকের নিকট হতে পাওয়া খবরাখবর হতে মদীনাবাসীরা জেনেছিলেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শহীদ হয়েছেন। আর তাই তখন থেকে মদীনা শরীফ-এর মধ্যে শোকের ছায়া বিরাজ করছিল। অলিতে গলিতে, পথে-ঘাটে সবখানেই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার আলোচনা। শত্রু-মিত্র সকলেই এজন্য শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর যখন আহলে বাইত-এর লোকজন মদীনা শরীফ-এ তাশরীফ নিয়ে এসে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় এই মর্মান্তিক ঘটনার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করলেন তখন সমগ্র মদীনা শরীফ-এ শোকের ছায়া নেমে এলো।

কূফা গমনের সময় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার দুই পুত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সঙ্গী হয়েছিলেন। কারবালার মাটিতে তাঁদেরও রক্ত মুবারক ঝরেছে। তাঁরাও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। আহলে বাইত-এর মদীনা শরীফ ফিরে আসার পর যখন এই ভ্রাতাদ্বয়ের শাহাদাতের খবর প্রকাশিত হলো তখন একদল লোক হযরত আব্দুল্লাহু ইবনে জা’ফর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য তাঁর বাড়িতে গমন করলো। তাদের মধ্যে একজন কথার ফাঁকে হঠাৎ বলে ফেলল, “হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কারণেই আজ আপনার উপর এই বিপদ।” নাঊযুবিল্লাহ। কথাটা শুনামাত্রই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পায়ের সেন্ডেল খুললেন এবং সেটা ঐ ব্যক্তির দিকে ছুঁড়ে মেরে বললেন, কমবখত্! তুমি এমন কথাও বলতে পারলে! অথচ আমি নিজেই যদি সেখানে থাকতাম তবে আমার জীবনও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার জন্য কুরবান করে দিতাম। আল্লাহ তায়ালার কসম! আজ আমার বড় সান্ত¡না এই যে, আমি নিজে জীবন দিতে না পারলেও আমার পুত্র দু’টি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার জন্য জীবন দিয়েছে। সুবহানাল্লাহ।

ইবনে আছীর প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের পর প্রায় তিন মাস প্রকৃতিতে এক আজব অবস্থা বিরাজ করছিল। সূর্য যখন উদয় হতো এবং তার রশ্মি দূরদূরান্তে লোকের ঘরের দেওয়ালে ও দরজার কপাটে ছড়িয়ে পড়তো তখন মনে হতো যেন কেউ তাজা রক্ত দিয়ে ঐগুলো রঙ্গীন করে দিয়েছে।
কারবালার ঘটনা থেকে উপলব্ধি ও শিক্ষা:

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাতের ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে জানলেন। এর মধ্যে আপনারা একদিকে দেখেছেন সত্যের ঝান্ডা উচ্চে তুলে ধরার জন্য মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের অপূর্ব আত্মত্যাগ, অন্যদিকে দেখেছেন যালিমশাহীর প্রচ- প্রতিরোধ। যালিমের যুলুমের সামনে সত্য মার খেয়েছে দেখে যদি মনে করে থাকেন যে, জগতে যুলুমই সবসময় জয়লাভ করে তাহলে ভুল করবেন। আসল চক্ষু খুলে দেখলে দেখতে পাবেন, কারবালার মরুভূমিতে সেদিন যালিমশাহীদেরই ভরাডুবি হয়েছে এবং ন্যায় দীপ্ততেজে নতুন ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। যালিমরা মারতে গিয়ে নিজেরাই মরেছে এবং মযলুম কাফেলা শহীদ হয়ে অমর হয়ে আছেন।

ইবনে যিয়াদ এবং ইয়াযীদের অত্যাচারী বাহিনী চেয়েছিল, সত্যের ঝা-াবাহী হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও তাঁর মুষ্টিমেয় সঙ্গীদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তারা পানি বন্ধ করে তাঁদেরকে কষ্ট দিয়েছে, তীর নিক্ষেপ করে তাঁদের শরীর মুবারক ঝাঁঝরা করেছে, তরবারী চালিয়ে তাঁদের শির মুবারক দ্বিখন্ডিত করেছে- তবুও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আজও জীবিত, তাঁর সঙ্গীগণ অমর।

প্রতিটি ঘরে ঘরে আজও তাঁদের আলোচনা। প্রতিটি মানুষ তাঁদের অপূর্ব আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে থাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। সুদীর্ঘ দেড় হাজার বৎসর পরেও আজ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার হক্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আত্মত্যাগের নজিরবিহীন দৃষ্টান্তের কথা শুনতে পাই। সমুদ্রে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার নাম মুবারক উচ্চারিত হয়।

পক্ষান্তরে যালিমশাহী ইয়াযীদ কারাবালা ময়দানে জুলুম করে কি করল? দুনিয়ার মানুষের কাছে সে আজ ধিকৃত, লাঞ্ছিত, ঘৃণিত। মানুষ তাকে অভিশাপ দেয়, লা’নত সহকারে তার নাম উচ্চারণ করে। এতে বুঝা যায় যে, সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে সাময়িকভাবে সত্যের কণ্ঠস্বর যদিও রুদ্ধ হয়ে যায় কিংবা সত্যানুসারীরা মিথ্যাবাদীদের সামনে সত্য প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হন তবুও তাতে ভগ্নোৎসাহ হবার কারণ নেই। সত্য নিজ মহিমায় দীপ্তিমান। তার প্রচ- তেজ দমিয়ে রাখার সাধ্য কারো নেই। একদিন না একদিন তা আপন তেজে জ্বলে উঠবেই। আর সে এমন প্রচ- মহিমায় তার সামনে মিথ্যা ধূলিসাৎ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনাটা যেভাবে ও যে পরিস্থিতিতে সংঘটিত হয়েছে, তাতে মুসলিম উম্মাহর জন্য যথেষ্ট শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এ বিষাদময় ঘটনা থেকে যেসব শিক্ষা চিহ্নিত করা যায় তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ‘শাসন ক্ষমতায় যে ধরনের লোক অধিষ্ঠিত থাকে, জনগণ সে ধরনের নিরাপত্তা, ইনসাফ ও ন্যায়বিচার লাভ করে এবং সে ধরনের যুলুমেরও শিকার হয়ে থাকে।’

শাসন ক্ষমতায় যদি খোদাভীরু, সৎ, ঈমানদার ও চরিত্রবান লোকেরা অধিষ্ঠিত থাকে, তবে জনগণের ইনসাফ পাওয়া ও যুলুম, অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়া যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি জনগণের নৈতিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পক্ষান্তরে শাসক মহল যদি দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিবাজ ও অত্যাচারী হয়, তা হলে সমাজে যত সৎ লোকই থাক, ইনসাফ ও সততা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এ কারণেই ইয়াযীদের আমলে মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চল মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ ও ইরাক যুলুম, অত্যাচার, দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যকলাপের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।

হিজরী প্রথম শতকের এই সময়টাতে বিপুল সংখ্যক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম জীবিত ছিলেন। যারা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সর্বোচ্চ মানের সততা ও তাক্বওয়ার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু অসৎ লোকদের ক্ষমতায় আরোহণের সুযোগ পাওয়ার কারণে ইসলামের মূলনীতিগুলো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। অথচ খিলাফতে রাশিদার আমলে ইসলামের নীতিমালা সমাজের সকল স্তরে বাস্তবায়িত হয়েছে। খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উছমান যুন্ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার শাসনামলে সামান্য কিছু ফিৎনা শুরু হলেও কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা থাকায় ঐ ফিৎনা ব্যাপক ও স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারেনি। সুতরাং এ ঘটনার অন্যতম শিক্ষা হলো যে, সর্বপর্যায়ে খোদাভীরু, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ লোকদের শাসন কায়িমের জন্য কোশেশ করা। পরামর্শ অর্থাৎ মজলিসে শূরা বহাল রাখা এবং কোন ক্রমেই অসৎ, ফাসিক-ফুজ্জার লোকদের হাতে ক্ষমতার চাবি-কাঠি অর্পণ না করা।

বিশেষতঃ খিলাফতের আওতাধীন সকল স্তরের ব্যবস্থাপনাকে অমুসলিমদের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা জরুরী। কেননা যারা অমুসলিম তথা ইহুদী-খ্রিস্টান-মুশরিক ইত্যাদি প্রত্যেকেই মুসলমানদের শত্রু। তা কালামুল্লাহ শরীফ-এও ঘোষণা করা হয়েছে।

ইতিহাস সাক্ষী যে, ইয়াযীদের খ্রিস্টান কোন কোন মতে ইহুদী উপদেষ্টার পরামর্শ অনুযায়ী ইবনে যিয়াদকে কূফার গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। যদি ইয়াযীদের খ্রিস্টান বা ইহুদী উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ না করা হতো তাহলে ইবনে যিয়াদ গভর্নর নিযুক্ত হতো না এবং মুনাফিকরা মুনাফিকী কার্যক্রম সংঘটিত করতে পারতো না।

সাইয়্যিদু শাবাবি আহ্লিল জান্নাহ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের পিছনে যে কারণগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা যায় তা হলো-

১. ইয়াযীদ-এর নেতৃত্বে ইসলামী খিলাফতের যে নৈতিক ও আদর্শিক ক্ষতি ও বিকৃতি ঘটতে যাচ্ছিল, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম সেই বিকৃতির বিরুদ্ধে ছিলেন। ইয়াযীদের অসৎ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপোসহীন ছিলেন।

২. সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম প্রতিবাদে আপোসহীন হলেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে কারবালা প্রান্তরে হাজিরও হননি। তা সত্ত্বেও ইয়াযীদের বাহিনী উনাকে নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করে। তিনি মদীনা শরীফ যাওয়ার অথবা ইয়াযীদের সাথে সাক্ষাত করার অথবা অন্য কোন দেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করা সত্ত্বেও ইয়াযীদী বাহিনী তাঁর কোন কথায় কর্ণপাত করেনি।

৩. ফোরাত নদীর পানি অবরোধসহ নারী ও শিশুদের প্রতি চরম অমানবিক আচরণ করে কষ্ট ও দুর্বল করে দেয়ার কারণে যে নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল, নুবুওওয়াতের এত কাছাকাছি সময়ে এমন বর্বরতা স্বয়ং মুসলিম নামধারীদের দ্বারা ঘটতে পারে, তা কারো কল্পনায়ও আসেনি। বিশেষতঃ নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্রের প্রতি এ আচরণ পরবর্তী মুসলিম প্রজন্মকে নিদারুণভাবে ব্যথিত করেছে।

৪. বহু সংখ্যক নিষ্ঠাবান ছাহাবী ও তাবিয়ীগণ বেঁচে থাকা সত্ত্বেও সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার এই অভিযানে একেবারেই নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়াটা মুসলিম জনমানসে আরো বেশি মর্মবেদনা ও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।
কারবালার মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকে ইয়াযীদকে দোষারোপ করার সাথে সাথে তার পিতা যিনি জলীলুল ক্বদর ছাহাবী হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকেও দোষারোপ করে থাকে। নাঊযুবিল্লাহ!

এখানে একটা বিষয় মনে রাখা জরুরী যে, আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামসহ আহলে বাইত-এর অন্যান্য সদস্য ও সঙ্গীগণের মর্মান্তিক শাহাদাতে মুসলিম উম্মাহ্র অন্তর ব্যথাতুর হবে তা চরম সত্য কথা এবং এটি ঈমান মজবুতির আলামতও বটে। কিন্তু এজন্য আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দোষারোপ করা কস্মিনকালেও শরীয়ত সম্মত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ولاتزر وازرة وزر اخرى ‘একজনের পাপের বোঝা অপরজন বহন করবে না।’ (সূরা বণী ইসরাইল-১৫)

এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, “সন্তানের অপরাধের জন্য পিতাকে এবং পিতার অপরাধের জন্য সন্তানকে দায়ী করা বৈধ নয়।” কাবিলের অপরাধের জন্য হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে, কেনানের অপরাধের জন্য হযরত নূহ আলাইহিস্ সালামকে দায়ী করা যেমন বৈধ নয়, তেমনি ইয়াযীদের অপরাধের জন্য হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দায়ী করাও বৈধ নয়। বরং তা সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ليغيظبهم اللكفار ‘কাফিরেরাই ছাহাবায়ে কিরামগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে।’ (সূরা ফাতহ্-২৯)

হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-
< p class=”a”>عن مالك بن انس رحمة الله عليه قال من غاظ اصحاب محمد صلى الله عليه وسلم فهو كافر

অর্থ: ‘হযরত মালিক ইবনে আনাস আলাইহিস সালাম বর্ণনা করেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছাহাবায়ে কিরামগণের প্রতি যে ব্যক্তি বিদ্বেষ পোষণ করে, সে কাফির।’ (নাসীমুর রিয়াদ্ব)

হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن ابي سعيد الخدرى رضي الله تعالي عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ¬¬¬ لاتسبوا اصحابى فلو ان احدكم انفق مثل احد ذهبا ما بلغ مد احدهم ولا نصيفه

অর্থ: হযরত আবু সায়ীদ খুদুরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা আমার ছাহাবায়ে কিরামগণকে গাল-মন্দ বা দোষারোপ করো না। যদি তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় দান করো, তবুও ছাহাবায়ে কিরামগণের এক মুদ বা অর্ধ মুদ গম দান করার ফযীলতের সমপরিমাণ ফযীলত অর্জন করতে পারবে না।’ (বুখারী শরীফ)
.

হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن عويمر بن ساعدة رضي الله تعالى عنه انه صلى الله عليه و سلم قال ان الله اختارنى واختار لى اصحابا فجعل لى منهم وزراء وانصارا واصهارا فمن سبهم فعليه لعنة الله والـملئكة والناس اجمعين ولايقبل الله منهم صرفا وعدلا

অর্থ: হযরত উয়াইমির ইবনে সায়িদাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক আমাকে মনোনীত করেছেন এবং আমার ছাহাবায়ে কিরামগণকে মনোনীত করেছেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে আমার কার্য সম্পাদনকারী, খিদমতকারী ও বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়বর্গ নির্ধারণ করেছেন। অতএব, যে ব্যক্তি তাঁদেরকে গালি দিবে বা দোষারোপ করবে, তার প্রতি আল্লাহ পাক উনার, ফেরেশ্তা ও মানুষ সকলেরই লা’নত। এবং তার কোন ফরয ও নফল ইবাদত আল্লাহ পাক কবুল করবেন না।’ (তবারানী, হাকিম)

যারা সাইয়্যিদুনা হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দোষারোপ করে তারা মূলতঃ তাঁর সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে নেহায়েতই জাহিল বা অজ্ঞ।

হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছাহাবীগণের মধ্যে একজন বিশেষ শ্রেণীর ছাহাবী, যাঁকে উলুল আযম্ বা জলীলুল ক্বদর ছাহাবী বলা হয়। তিনি ছিলেন আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, কাতিবীনে ওহীর সদস্য, হাদীছ শরীফ-এর রাবী, ফক্বীহ্ ইত্যাদি মর্যাদার অধিকারী। তাঁর ইল্মের পূর্ণতা, হিদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা, তাঁর দ্বারা লোকদের হিদায়েত লাভ, কিতাব শিক্ষাদান এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ব্যাপারে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার নিকট দুআ করেছেন।

যেমন হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-

عن ام حرام رضى الله تعالى عنها انها سمعت النبى صلى الله عليه وسلم يقول اول جيش من امتى يغزون البحر قد اوجبوا

অর্থ: হযরত উম্মু হারাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছন, আমার উম্মতের প্রথম যে দল সমুদ্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব।’ (বুখারী শরীফ)

হযরত ইমাম তাবারী আলাইহিস সালাম বলেন, “হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ২৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম সমুদ্র যুদ্ধের মাধ্যমে কাবরাসের উপর আক্রমণ করেন এবং কাবরাস তিনিই বিজয় করেন।”

হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মর্যাদা-মর্তবার মধ্যে অন্যতম মর্যাদা হলো- তিনি ছিলেন একজন আদিল বা ইনসাফগার খলীফা। তাঁর ন্যায় বিচার ও ইনসাফ সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ করা হয় যে, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-

ما رايت احدا بعد عثمان اقضى بحق من صاحب هذا الباب

‘আমার দৃষ্টিতে হযরত উছমান যুন্ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, এরপর হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার চেয়ে অধিক ন্যায় বিচারক কেউ নেই।’

এক ব্যক্তি বিশিষ্ট ফক্বীহ্্ হযরত মুয়াফা ইবনে ইমরান আলাইহিস সালাম আলাইহিকে জিজ্ঞেস করলো, ন্যায় বিচারের দিক দিয়ে হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? একথা শুনে তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন, “হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সাথে কোন প্রকার ক্বিয়াস করা যাবে না। হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তো হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছাহাবী, কাতিবে ওহী ও আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ‘আমীন’ (আমানতদার)।” আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক আলাইহিস সালাম আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, “হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শ্রেষ্ঠ, না হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয আলাইহিস সালাম শ্রেষ্ঠ? জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহ পাক উনার কসম! হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে ঘোড়ায় চড়ে জিহাদে যেতেন, তখন ঘোড়ার নাকে যে ধূলোবালিগুলো প্রবেশ করতো, সে ধূলোবালিগুলোও হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয আলাইহিস সালাম হতে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।”

সুতরাং, এত সব মর্যাদা ও মর্তবার পরও যারা হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, উনাকে নাক্বিছ বলে গালি দেয়, তাদের জন্যে হযরত ইমাম শিহাবুদ্দীন খাফ্ফাযী আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর কথাই অধিক প্রযোজ্য। তিনি বলেন-

من يكون يطعن فى معاوية فذلك كلب من كلاب الحاوية

‘যে ব্যক্তি হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে উনাকে গালি দেয়, নাক্বিছ বলে, সমালোচনা করে, সে হাবিয়া দোযখের কুকুরসমূহের মধ্য হতে একটি কুকুর।’ (নাসীমুর রিয়াদ্ব)

উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শুধু ছাহাবীই ছিলেন না বরং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, জলীলুল ক্বদর ছাহাবী ও খলীফা ছিলেন। সুতরাং হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ সকল ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সম্পর্কে সাবধানে কথা বলতে হবে। মূলতঃ তাঁদের সকলের প্রতিই সুধারণা পোষণ করতে হবে, মুহব্বত করতে হবে এবং তাঁদেরকে অনুসরণ-অনুকরণও করতে হবে। কেননা তাঁরা হলেন দ্বীনের ইমাম এবং নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন।

অনেকে ইয়াযীদকে খলীফা নিযুক্ত করার কারণে বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দোষারোপ করে বলে যে, তিনি খিলাফতের পরিবর্তে রাজতন্ত্র ও রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। নাঊযুবিল্লাহ।

মূলতঃ যারা হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে রাজতন্ত্র ও রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতারূপে চিহ্নিত করতে চায় প্রকৃতপক্ষে তারা চরম শ্রেণীর জাহিল। কারণ রাজবংশ বা রাজতন্ত্র ইসলামের অনেক পূর্বকাল থেকেই চলে আসছে। যা আমরা হাদীছ শরীফ-এ দেখতে পাই যে, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোম, পারস্য, আবিসিনিয়া, চীন, মালাবার, গুজরাট ইত্যাদির সম্রাট বা রাজাদের নিকট ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত পত্র পাঠিয়েছেন।

উল্লেখ্য, ‘রাজতন্ত্র’ অর্থ হলো- ‘রাজ’ অর্থ ‘রাজা’, আর ‘তন্ত্র’ অর্থ ‘নিয়ম-নীতি’। যিনি রাজা হন সাধারণতঃ তিনি তার নিজস্ব মনগড়া নিয়ম-নীতিই তার কর্তৃত্বাধীন এলাকায় প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন করে থাকেন, তাকেই রাজতন্ত্র বলে। আর ‘রাজবংশ’ বলতে ‘রাজার বংশকে‘ বুঝানো হয়।


অথচ হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি নিজেও রাজা ছিলেন না এবং অন্য কাউকেও রাজা মনোনীত করেননি। বরং তিনি স্বয়ং নিজের, উনার পরিবার, উনার সমাজ এবং তাঁর কর্তৃত্বাধীন সমগ্র এলাকার উপর কুরআন-সুন্নাহ’র বিধানই জারি বা বাস্তবায়ন করেছিলেন, যাকে ‘খিলাফত আলা মিন্হাজিন্ নুবুওওয়াহ্’ বলা হয়।

মূলতঃ তাঁর খিলাফত পূর্ববর্তী খলীফাগণেরই অনুরূপ ছিল এবং তাঁর খলীফা হওয়ার বিষয়টি ছিলো স্বয়ং আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ভবিষ্যদ্বাণীর ফসল।

হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেই বর্ণনা করেন, আমি একদা আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে ছিলাম। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে মুআবিয়া! কখনো যদি তোমার হাতে জনগণের কর্তৃত্বভার আসে তখন তাদের প্রতি ইনছাফ করো।” হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “আমি তখনই নিশ্চিত হলাম যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উক্ত কথা বাস্তবায়িত হবেই।”

আর সত্যিই তিনি প্রথমে দু’খলীফা হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত উছমান যুন্ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার খিলাফতকালে আমীরে শু’বা বা প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। অতঃপর চতুর্থ খলীফা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার শাহাদাতের পর প্রায় ছয় মাস তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খিলাফত পরিচালনা করেন। অতঃপর তিনি ষষ্ঠ খলীফা হিসেবে হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এই শর্তে খিলাফত দেন বা মনোনীত করেন যে, “আপনার পর আমি অথবা আমার ভাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম অর্থাৎ দু’জনের একজন হায়াতে থাকলে আমাদেরকে খিলাফত ফিরিয়ে দিতে হবে।”

অতঃপর ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার শাহাদাতের সময় তিনি তাঁর ছোট ভাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে নছীহত করেন যে, “দেখুন, খিলাফতের জন্যেই আমাদের পিতা শহীদ হয়েছেন, আমিও শহীদ হচ্ছি, সুতরাং আপনি আর খিলাফতের যিম্মাদারী নিবেন না। আপনি দ্বীনি তা’লীম-এর কাজে নিয়োজিত থাকুন, হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অন্য যাকে ভাল মনে করেন তাকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে যাবেন।”

হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রদত্ত শর্ত মুতাবিক হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলীফা মনোনীত হয়ে সঠিকভাবে খিলাফত পরিচালনা করেন এবং পরবর্তিতে খিলাফত পরিচালনার যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ছেলেকে খলীফা মনোনীত করেন।

অতএব, এটা অবশ্যই সত্য যে, হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর ছেলে ইয়াযীদকে যখন খলীফা নিযুক্ত করেন তখন ইয়াযীদ ভাল ছিল। কিন্তু মুনাফিকদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে পরবর্তিতে ইয়াযীদ গুমরাহ হয়ে যায়।

অতএব, কেউ যদি ছেলের বদ আমলের কারণে পিতাকে দোষারোপ করে অর্থাৎ ইয়াযীদের জন্য বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দোষারোপ করে তবে তা সম্পূর্ণরূপে কুফরী হবে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
ولاتزر وازرة وزر اخرى
‘একজনের গুনাহ্র বোঝা অন্যজন বহন করবে না।’ (সূরা বণী ইসরাঈল-১৫)

এখন পিতার পর ছেলে খলীফা হলে যদি রাজতন্ত্র ও রাজবংশ প্রতিষ্ঠাকারী হয় তাহলে তো দেখা যায় আল্লাহ পাকই রাজতন্ত্র ও রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যান। নাঊযুবিল্লাহ।

কারণ আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত দাউদ আলাইহিস্ সালাম যিনি ছিলেন খলীফাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ পাক উনার খলীফা এবং তাঁর বিদায়ের পর তাঁর ছেলে হযরত সুলাইমান আলাইহিস্ সালামকে আল্লাহ পাক সারা পৃথিবীর খলীফা নিযুক্ত করেন।

এছাড়া হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পর উনার ছেলে হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও তো খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাই বলে কি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে রাজতন্ত্র ও রাজবংশ জারি হয়েছে? নাঊযুবিল্লাহ।

মূলতঃ আল্লাহ পাক, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম আলাইহিস সালাম আলাইহিম কেউই রাজতন্ত্র ও রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নন। যদি কেউ উল্লিখিত কাউকে রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলে তবে সেটা হবে তাঁর প্রতি প্রকাশ্য তোহমত এবং কুফরীর শামীল।

অতএব, সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রাজতন্ত্র কিংবা রাজবংশ কোনটিরই প্রতিষ্ঠাতা নন বা ছিলেন না।
হযরত ইমাম যাহাবী আলাইহিস সালাম বলেছেন, কারবালার শাহাদাতের ঘটনা অতঃপর মদীনা শরীফ আক্রমণের পর ইয়াযীদের বিরুদ্ধে প্রচ- গণবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তার আয়ুও ছিল খুব কম। মাত্র তিন বছর কর্তৃত্ব করার পর সে ৪০ বছর বয়সে মারা যায়। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদকারীদের কেউই আল্লাহ পাক উনার গযব থেকে রক্ষা পায়নি। লা’নতে পরে কেউ নিহত হয়েছে এবং কেউ এমন কষ্টদায়ক অবস্থার শিকার হয়েছে যে, মৃত্যুও তার চেয়ে অনেক ভাল ছিলো।

হযরত ইমাম ইবনুল জাওযী আলাইহিস সালাম বলেছেন: “হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদকারীদের সকলেই কোন না কোন প্রকারে দুনিয়াতেই শাস্তি পেয়েছে। কেউ নিহত হয়েছে, কেউ অন্ধ হয়ে গেছে। আর ক্ষমতাসীনরা অল্প সময়েই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।”

বিশিষ্ট তাফসীরবিদ হযরত ইবনে কাছীর আলাইহিস সালাম বলেন: “হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের পর যে সকল দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার বর্ণনা ইতিহাসে পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগই সত্য। উনার শহীদকারীদের প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে আযাব ভোগ করেছে। অনেকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অধিকাংশই উন্মাদ হয়ে মরেছে।”

আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে যখন মুখতার সাকাফী কূফার শাসক হলেন, তখন তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতে অংশগ্রহণকারীদেরকে এবং উনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া বাহিনীতে যোগদানকারীদেরকে বেছে বেছে হত্যা করেন। এমনকি একদিনেই তিনি এ ধরনের দুইশ’ চল্লিশ ব্যক্তিকে হত্যা করেন। আমর বিন হাজ্জাজ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদকারী ছিলো। সে কূফা থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারেনি। মুখতার সাকাফীর লোকদের হাতে নিহত হয়েছে। মুখতার সাকাফীর লোকেরা পাপিষ্ঠ সিমারকে হত্যা করে তার লাশ কুকুরকে খাইয়ে দিয়েছেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদকারীদেরকে মুখতারের কাছে আনা হতো এবং তিনি তাদেরকে অত্যন্ত কষ্টদায়ক পদ্ধতিতে হত্যা করার নির্দেশ দিতেন। কাউকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারতেন। কাউকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে রেখে দিতেন এবং ছটফট করে করে মরে যেতো। খাওলী বিন ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মাথা মুবারক কাটার চেষ্টা করেছিল। মুখতার তাকে হত্যা করে তার লাশ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ইবনে যিয়াদও মুখতারের সেনাপতি আল আশতারের হাতে নিহত হয় এবং তার মস্তকও মুখতারের কাছে পাঠানো হয়। ইবনে যিয়াদের বাহিনীর অধিনায়ক আমর বিন সা’দকে এবং তার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদকারীদের যারা পালিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছে, মুখতার সাকাফী তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে ও জ্বালিয়ে দেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কণ্ঠনালীতে তীর নিক্ষেপকারী হাসিন বিন নুমাইরও তার হাতে নিহত হয়। ইবনে যিয়াদ ও আমর বিন সা’দ-এর মাথা কেটে মুখতার সাকাফী হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ছেলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম-এর কাছে প্রেরণ করলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম সিজদায় চলে যান এবং বলেন, ‘আল্লাহ পাক উনার শোকর, যিনি আমার শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছেন।” মোট কথা, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণকারী প্রত্যেককেই আল্লাহ পাক ধ্বংস করে দেন।

কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-
ومن يقتل مؤمنا متعمدا فجزاءه جهنم
অর্থ: ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন মু’মিনকে কতল করে সে জাহান্নামী।’ (সূরা নিসা-৯৩)

হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-
عن عبد الله بن مسعود رضي الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم سباب المسلم فسوق وقتاله كفر
অর্থ: ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসিকী আর কতল করা কুফরী।’ (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)

কাজেই, সাধারণ মু’মিন মুসলমানকে কতল করা যদি কুফরী ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ হয় তাহলে আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার লখতে জিগার, সাইয়্যিদু শাবাবি আহ্লিল জান্নাহ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামসহ আহলে বাইত-এর অন্যান্য সম্মানিত সদস্য ও সঙ্গীগণকে যারা শহীদ করেছে তাদের ফায়সালা কি হবে? তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তারা সকলেই কাট্টা কাফির ও চির জাহান্নামী।


আহলে বাইতগণের প্রতি মুহব্বত ঈমানের অঙ্গ আর বিদ্বেষ পোষণ কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। স্বয়ং আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাক-এ ইরশাদ করেন-
قل لااسئلكم عليه اجرا الا المودة فى القربى
অর্থ: ‘হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি উম্মতদেরকে বলুন, আমি তোমাদের নিকট নুবুওওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য কোন প্রতিদান চাই না। তবে আমার নিকটজন তথা আহলে বাইত, তাঁদের প্রতি তোমরা সদাচরণ করবে।’ (সূরা শূরা-২৩)

হাদীছ শরীফ-এ আহলে বাইত ও আওলাদে রসূলগণ-এর অপরিসীম ফযীলত-মর্যাদা-মর্তবার কথা বর্ণিত রয়েছে।

সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আহলে বাইত-এর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। উনার সম্পর্কে কিতাবে বর্ণিত রয়েছে- রঈসুল মুহাদ্দিছীন হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথে চলাচল করতেন, উঠাবসা করতেন। কোন এক প্রসঙ্গে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে বলেছিলেন, ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। এটা শুনে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন এবং বিষয়টা ফায়সালার জন্য উনার পিতা যিনি খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন উনাকে জানালেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আমাকে বলেছেন, ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, বেশ ভালো কথা। তুমি যখন ফায়ছালা চাচ্ছো, তাহলে মুখের কথায় তো হবে না। এটা লিখিত আনতে হবে, কাগজে-কলমে থাকতে হবে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার নিকট গিয়ে বললেন, হে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম! আপনি যে আমাকে বলেছেন, ‘গোলামের ছেলে গোলাম’ এটা লিখিত দিতে হবে। আমি খলীফার কাছে ব্যাপারটা পেশ করেছি। তিনি বললেন ঠিক আছে, অসুবিধা নেই। আমি লিখিত দিব। সত্যিই তিনি একটা কাগজে লিখে দিলেন, ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। সেটা নিয়ে পেশ করা হলো খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি এর ফায়ছালা করবো। বিষয়টি নিয়ে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সকলেই চিন্তিত হলেন। তাঁরা চিন্তিত হলেন যে, হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জালালী তবিয়তের, তিনি ইনছাফগার হিসেবে মশহুর, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশিষ্ট ছাহাবী, নবীদের পরে দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব।

একদিকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম, আরেকদিকে হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। সকলেই চিন্তিত হলেন, বিষয়টি কীভাবে ফায়ছালা করা হবে? হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইনছাফ করে থাকেন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার করে থাকেন। তিনি কী বিচার করবেন? নির্দিষ্ট স্থান, সময়, দিন, তারিখ সব ঘোষণা করা হলো। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম, হযরত তাবিয়ীনে কিরাম যাঁরা ছিলেন সকলেই সেখানে জমা হয়ে গেলেন যে, কী ফায়ছালা করা হয় সেটা জানার জন্য।

এদিকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তিনি উপস্থিত হলেন। তিনি যখন উপস্থিত হলেন, হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে তা’যীম-তাকরীম করে একটা সম্মানিত স্থানে বসালেন। আর হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন আসলেন, উনাকেও বসতে বললেন। লোকজন সকলেই উপস্থিত। বিচারের নিদিষ্ট সময় যখন উপস্থিত হলো, খলীফাতুল মুসলিমীন তাঁর পকেট থেকে কাগজটা বের করে বললেন যে, একটা কাগজ আমার কাছে পেঁৗঁছানো হয়েছে, এ কাগজের মধ্যে লিখিত রয়েছে ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। কাগজটা দিয়েছেন আমার ছেলে হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে- হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে বলেছেন- ‘গোলামের ছেলে গোলাম’।

এ বিষয়ে ফায়ছালার জন্য এ কাগজটা আমার নিকট পেশ করা হয়েছে। তখন হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি আপনি লিখেছেন? তিনি বললেন যে, হ্যাঁ। এটা আমার লিখিত, আমি বলেছি এবং লিখেছি। যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, জবাব নেয়া হলো। বিষয়টা সবাইকে জানানো হলো যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তিনি বলেছেন এবং লিখেছেন। এটা লোকজন শুনলেন। তখন হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন যে, এটা এখন ফায়ছালা করা হবে। সকলেই শুনে তো স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মনে হয়েছে যেন বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, সকলেই একদৃষ্টিতে খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার দিকে চেয়ে রয়েছেন। এটা তিনি কীভাবে ফায়ছালা করেন, এটার কী ফায়ছালা রয়েছে?

হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ঘোষণা করলেন, এই যে কাগজটা যার মধ্যে লিখিত রয়েছে, ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। অর্থাৎ আহলে বাইত-এর যিনি অন্যতম ব্যক্তিত্ব হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তিনি আমার ছেলেকে বলেছেন, ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। এর অর্থ হচ্ছে খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন তিনি হচ্ছেন গোলাম আর তাঁর ছেলে হচ্ছে ‘গোলামের ছেলে গোলাম’। এর ফায়ছালা হচ্ছে- আপনারা সকলেই সাক্ষী থাকুন, আমি আমার যিন্দিগীর অনেক সময় অতিবাহিত করেছি, পূর্ববর্তী কুফরী যিন্দিগী বাদ দিয়েছি, আমার অতীতের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যা ছিল সেটা আমি ত্যাগ করেছি, শরীয়তের নির্দেশবহির্ভূত স্ত্রী ছিল তাদেরকেও ত্যাগ করেছি আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টির জন্য। আমার চাওয়া এবং পাওয়ার বিষয় এটাই ছিল যে, আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি এবং আল্লাহ পাক উনার হাবীব-এর সন্তুষ্টি। আল্লাহ পাক যতটুকু দিয়েছেন ততটুকু পাওয়া হয়েছে। তবে আমার একটা লিখিত দলীল প্রয়োজন ছিল, যে লিখিত দলীলের আমি প্রত্যাশা করেছিলাম। আজকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম এটা লিখিত দিয়েছেন। এখন থেকে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমি উনাদের গোলাম।

কাজেই, আমি ইন্তিকাল করলে এই কাগজখানা আমার কাফনের ভিতরে, আমার সিনার উপর রেখে দিবেন। এটা আমার ওছীয়ত। আমি ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক উনার হাবীব-এর কাছে আরজু করবো যে, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার যিনি লখতে জিগার হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনি আমাকে লিখিত দিয়েছেন যে, ‘আমি গোলাম’। কাজেই, আমার আমল যা-ই রয়েছে কমপক্ষে এই দলীলের খাতিরে আমাকে গোলাম হিসেবে কবুল করা হোক। সুবহানাল্লাহ!

উনি যখন এটা ফায়ছালা করলেন, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং তাবিয়ীনে কিরাম আলাইহিস সালাম আলাইহিম যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন সকলেই লা-জাওয়াব হয়ে গেলেন।

মূলতঃ এ ঘটনাটির মাধ্যমে যে বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে তা হলো- আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে প্রত্যেক উম্মতের জন্য দায়িত্ব হলো আহলে বাইত এবং আওলাদে রসূলগণ-এর প্রতি সুধারণা পোষণ করা, উনাদেরকে মুহব্বত করা ও সম্মান-ইজ্জত করা।
আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।।

~*~*~*~*আসুন সৎকর্মের প্রতিযোগিতা করি*~*~*~*~
 
Top