মাদকাসক্তি ও আমাদের করণীয়-২
——————————–
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম।

بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين. أما بعد
পবিত্র বা হালাল বস্তু মানুষের দেহ ও মনকে সংকীর্ণতা থেকে বাঁচিয়ে রাখে, উদার ও মানব কল্যাণে কাজ করার সহায়ক ও অনুভূতিশীল করে তোলে। হারাম বস্তু মানুষকে বিপদগামী করে, স্বার্থপর করে তোলে। মানুষের প্রয়োজন মেটানো ও উপকারার্থে প্রয়োজন হলো এমন হালাল দ্রব্যকে ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, পবিত্র, উত্তম ও উপাদেয়। তাই তিনি হালাল করে দিয়েছেন পবিত্র বস্তু সমূহ এবং হারাম করে দিয়েছেন অপবিত্র ও নাপাক বস্তুকে, তাই যা অকল্যাণকর তা বর্জন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘তোমাদের যা দান করেছি তা হতে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং এ বিষয়ে সীমালংঘন করো না।’’ (সুরা তাহা-৮১)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, (হে আমার প্রিয় রাসূল!) তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে তাদের জন্য কি হালাল করা হয়েছে? আপনি বলে দিন তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে। (আল মায়েদাহঃ ৪)

মহান আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “তিনি তাদেরকে ন্যায়ের আদেশ করেন ও অন্যায় থেকে নিষেধ করেন এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন ও তাদের উপর নাপাক বস্তু হারাম করেন।” (আল্ আরাফঃ ১৫৭)

আল্লাহ তাআলা বলেন, (হে আমার হাবীব!) “আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে তার মধ্যে কোন হারাম খাদ্য আমি পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্য, যা সে ভক্ষন করে; মৃত বা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের মাংস ছাড়া- কেননা এ সব অপবিত্র- অথবা যা অবৈধ, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম (আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করার কারণে) নেওয়ার কারণে, তবে কেউ অবাধ্য না হয়ে এবং সীমালংঘন না করে তা গ্রহণে বাধ্য হলে আপনার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আনয়াম: ১৪৫)

মদ বা মাদকদ্রব্য ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কেননা মাদকদ্রব্য মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়। মাদকাসক্তরা সমাজে নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। তাদের সুস্থ বিবেক থাকেনা, মানসিকতায় নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ইসলাম সুস্থ বিবেক ও মানসিক উৎকর্ষ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটায়, অর্থের অপচয় হয়, স্বাভাবিক জীবন যাপনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এমন কোনো দ্রব্য গ্রহণ ইসলামের আদর্শবিরোধী।

মদ পান করলে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও বিবেচনা শক্তিকে দুর্বল করে দেয়, তার যে আর মদ পান করা উচিৎ নয়, এ বোধটুকুও মাদকাসক্ত ব্যক্তি হারিয়ে ফেলে। তার নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে থাকে। নিজের শরীর, সন্তান-সন্ততি, পরিবার, ভবিষ্যৎ বংশধর এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এজন্য চরম ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যকে হারাম করেছেন।

তাই সূরা মায়েদার ৯০-৯১ নং আয়াতে এগুলোকে ঘৃন্যবস্তু ও শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। মাদক ও জুয়ার নেশার মন্দ স্বভাব থেকে দূরে থাকার সাথে সাথে এর ভয়ংকর প্রভাব থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলা ঐশীবাণী প্রেরণের মাধ্যমে বারবার সাবধান করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “নিজের ক্ষতি করবে না, অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।” (আহমদ, ইবনে মাজাহ)

হালাল খাদ্য ছাড়া কোন কিছু পান করা বা খাওয়া ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মুসলমানের জন্য যা ইচ্ছা তা খাওয়ার সুযোগ নেই। যে কোন কাজে অর্থ ব্যয় করার অধিকার নেই। নিজের ইচ্ছা মত কোন কিছু করারও উপায় নেই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “ধনুগ্রহের খোঁটাদানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং সদা মদ্যপানকারী জান্নাতে যাবে না।” (নসাঈ ও আহমদ)

এক ব্যক্তি ইয়ামন দেশ হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন এবং ‘মিযর’ নামে এক প্রকার মদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“তাতে কি নেশা হয়? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।র্ সূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নেশা সৃষ্টিকরে এমন প্রত্যেক জিনিসই হারাম। আর নেশাকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ ‘তীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের গায়ের ঘাম অথবা রক্ত ও পুঁজ পান করাবেন।’’ (মুসলিম, মিশকাত/৩১৭)

মদ্যপের ৪০ দিনের নামাজ কবুল হয় না: আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তার ৪০ দিন নামাজ কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহ’লে সে জাহান্নামে যাবে। যদি তওবাহ করে তাহ’লে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন।


মদপানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “সর্বদা মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না” (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৬, )

হজরত ইবনে ওমার হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “তিন শ্রেনীর লোকদের জন্য আল্লাহ্ বেহেশত হারাম করে দিয়েছেন। নিত্য মদপানকারী (মদ্যপায়ী), পিতা-মাতার নাফারমান-অবাধ্য লোক এবং দাইউস্ অর্থাৎ যে লোক তার পরিবারের কুকর্মকে স্বীকৃতি দেয় (আহমাদ, নাসায়ী, মিশকাত)।

মদ্যপান করা আর মূর্তিপূজা করা এ দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই: হযরত আবু মুসা আশ্আরী সব সময় বলতেন, “আমার নিকিট এ দু’য়ের মধ্যে কোন প্রভেদ নাই, আমি মদ পান করব অথবা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এ খুঁটির (দেবী) পূজা করব (নাসায়ী,)।

ক্বিয়ামতের পূর্বে মদের ব্যাপকতা: ক্বিয়ামতের পূর্বে মাদকতা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে মদ পানকারীরা তা পান করাকে অপরাধ মনে করবে না। হাদীসে এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, “ক্বিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে, ইলম উঠে যাবে, মূর্খতা, ব্যভিচার ও মদ্যপান বেড়ে যাবে । পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি পঞ্চাশ জন মহিলার পরিচালক হবে একজন পুরুষ”। (মিশকাত হা/৫৪৩৭, ‘ফিতান’)

শুধু তাই নয়; শেষ যামানায় মানুষ মদকে বিভিন্ন নামের ছদ্মাবরণে পান করবে বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।(ইবনু মাজাহ হা/৩৩৮৪)

মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তো নিষিদ্ধই, যে মজলিসে মদপান করা হয় ওই মজলিসে উপস্থিত থাকাও নিষিদ্ধ। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, “যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে সে যেন ওই দস্তরখানে না বসে যাতে মদ পান করা হয়।” (দারিমি, মুসতাদরাক )

ওমর ইবনে আবদুল আযীয রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে শরাব পানকারী কিছু লোককে হাজির করা হলো। তিনি তাদের প্রহারের আদেশ দিলেন। বলা হল এদের মধ্যে একজন আছে, যে ‘সাইম’ (অর্থাৎ মজলিসে উপস্থিত থাকলেও সে মদ পান করেনি)। তিনি বললেন, ওকে দিয়েই শুরু কর। এরপর তার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি কি কোরআনের এ আয়াত শোননি- তিনি তো কিতাবে তোমাদের প্রতি (এ বিধান) নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে এবং তার সঙ্গে বিদ্রুপ করা হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মতো (গণ্য) হবে। (নিসা ৪ : ১৪০)

অতএব, আমাদের করণীয় হলোঃ যাবতীয় নেশা জাতীয় বস্তু থেকে নিজে সতর্ক থাকা ও অপরকে তা থেকে সতর্ক করা এবং যে তাতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে তার কর্তব্য আল্লাহর নিকট তাওবাহ করা। বস্তুতঃ যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে তাওবাহ করে আল্লাহ তার তাওবাহ গ্রহণ করেন। এরশাদ হচ্ছেঃ “আর তোমরা আল্লহর নিকট তাওবাহ কর হে মুমিনগণ! যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” (সূরা আন্ নূরঃ ৩১) মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে মুমিনগণ আল্লাহর নিকট তোমরা তাওবাহ কর তবেই তোমরা সফলকাম হবে।” (সূরা নূরঃ ৩১) তিনি আরো বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধভাবে তাওবা কর।” (সূরা তাহরীমঃ ০৮) তিনি আরো বলেনঃ “নিশ্চয় আমি ক্ষমাশীল ঐ ব্যক্তির জন্য যে তাওবাহ করে, ঈমান আনে অতঃপর সঠিক পথে চলে।” (ত্বাহাঃ ৮২) “অতঃপর যারা অজ্ঞতাবশত কোন গুনাহের কাজ করলো, এরপর (অন্যায় বুঝতে পেরে) তওবা করে নিল এবং নিজেদেরকে সংশোধনও করে নিল, আপনার মালিক অবশ্যই এরপর তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (১৬ : ১১৯)

মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম। যে সমাজে ইসলামের আলো প্রথম বিকশিত হয়েছিল, সে সমাজে মাদক ছিল জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাদক ছাড়া আরব্য আভিজাত্য ও সংস্কৃতির কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। অথচ ইসলামের কল্যাণে সেই সমাজ থেকে মাদক ও মাদকের ব্যবহার শুধু নির্মূলই হলো না, চরম ঘৃণিত ও অপবিত্র বস্তুতে পরিণত হলো। আর মাদকাসক্ত সমাজের চোখে চরম ঘৃণিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত ও দন্ডপ্রাপ্ত আসামির স্থানে নেমে এল। মাদকের বিষয়ে মদিনা সমাজের এই আমূল পরিবর্তন একমাত্র ইসলাম ও ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই অবদান।

صلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.
 
Top