শেয়াল-কুমিরের গল্প। শিশুকালে শুনেছি। বালক বেলায় পড়েছি। আপনাদের মনে করাই।

শেয়াল খুলেছে পাঠশালা। বাচ্চাদের পড়াবে। পশুপাখিরা বাচ্ছা আনছে। ভর্তি করাচ্ছে পাঠশালায়। নদীতে ছিল কুমির। সেও জানলো খবরটা। তাঁর ছিল সাতটা বাচ্চা। সবকটাকে ভর্তি করালো। শেয়াল মধুমাখা মুখে বলে, চিন্তা করবেন না। সপ্তাহ পরপর আসবেন। বাচ্চাদের দেখবেন। আমি তো আছি।
কুমির সরল প্রাণি। মনে শান্তি পায়। নদীতে ফেরে। এদিকে ঘটনা ভিন্ন। শেয়াল মানেই চালাক। শুধু চালাক না, ধূর্তও। এজন্যই শয়তান লোকদের শেয়াল বলে।
যা-হোক, শেয়ালের পরিকল্পনা ভিন্ন। কুমিরের বাচ্চা তার প্রিয়। খাবার হিসেবে প্রিয়। নদীর ধারে ঘুরত। কিন্তু চুরি সম্ভব ছিল না। কুমির পাহারা দিত। দু-একবার ধ্যাতানিও খেয়েছে। তাই বুদ্ধি করে স্কুল খুলে।
এখন চুরি করতে হয় না। পশুপাখিদের বাচ্চা তার কাছে। যখন মন চায়, ধরে ধরে খায়। প্রতিদিন একটা কুমিরের বাচ্চা। এভাবে সপ্তাহ হলো। আজ সপ্তম দিন। শেষ বাচ্চাটা খাবে। তখনি কুমির দরজায় হাজির।
- শেয়াল সাব! কই আছেন! বাচ্চাগুলারে দেহান। কইলজা শুকায় গেছে।
- হে হে কি যে কন কুমির সাব। সারাদিন পানিতেই থাহেন। তবুও কইলজা হুকাইছে।
- হইছে! কথা রাহেন!বাচ্চা দেহান!
শেয়ালের মহাবিপদ। বাচ্চা পাবে কই। তখনি বুদ্ধি এলো। একটা বাচ্চা আছে। সেটা নিয়ে জানালায় দাঁড়াল।
- কুমির সাব! আপনার শরীর তো মাশাল্লা। একদম এভারেস্ট। আমার গর্তে ঢুকবো না। ওই হানেই খাঁড়ান। আমি জানালা দিয়া একটা একটা কইরা বাচ্চা দেহাইতেছি।
আগেই বলেছি, কুমির বোকাসোকা। সে মেনে নিল। জানাল থেকে অল্প দূরে দাঁড়াল। এবার শেয়াল বাচ্চাটা উঁচিয়ে ধরল। বলল- কুমির সাব প্রথম বাচ্চা। কুমিরও মাথা নাড়ায়। বাচ্চাটাকে নামাল। জানালার নিচে তো কুমির দেখে না। শেয়াল আবার বাচ্চাটা উঁচালো। একই বাচ্চা। কারণ বাচ্চা তো একটাই। বলল- দুই নাম্বার। এভাবে সাতবার উঠাল-নামাল।
- কি কুমির সাব, বাচ্চা দেখলেন, শান্তি হইছে? দেখছেন আমার যত্ন। বাচ্চাগো ক্যামন আদরে রাখছি।
- জ্বে শেয়াল সাব। আপনি মহান। কত্ত মহান। আমাগো অশিক্ষিত বনেরে শিক্ষিত করতাছেন। এই বনে কেউ আপনার জুতার যোগ্য না।
________
বর্তমান পরিস্থিতি এ গল্পের মত। শেয়াল হচ্ছে ধূর্ত ধর্ম-ধান্দাবাজ। শিক্ষাকে ধর্ম হিসেবে ধরুন। আর কুমির হচ্ছে আমজনতা। সহজ-সরল।
ওহাবি-সালাফিরা শেয়ালের মত। বলে- আসুন, ধর্ম শিখুন। মানুষও ঝাপায়-লাফায়। টুকরা (piece) টিভি এদের পাঠশালা। একজন শেয়াল আছে। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাটক করে। ফটাফট রেফারেন্স ঝারে। বলে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। ইসলাম এতটাই শর্টকাট। মানুষ কয় আরিব্বাস! এ দেখি বিদ্যার টাইটানিক। এটা ভাবে না কথার পিঠেও কথা থাকে। দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। আবার শূণ্যও হয়।
যদি কেউ বিরোধীতা করে। বলে সে ঈমান চোর। তখন পাবলিক চেঁচায়। বলে- তুই তার জুতার যোগ্য না। সে কত মুসলমান বানাইছে। তুই কয়টা বানাইছস? এই মুসলমান বানানোটা, কুমিরের বাচ্চা দেখানোর মত। যত দোষই হোক, সাফাই একটাই। সে মুসলিম বানিয়েছে। একটা-দুইটা মুসলিম বানানোর নাটক করে। বারবার দেখায়। ভেতরে ভেতরে যে ইমান গায়েব করছে, সে খবর কে রাখে। যতই যাই হোক, সে মুসলমান বানিয়েছে।
সে বলবে- আজকের যুগে নবী (দ) কে মানা আমাদের জন্য হারাম। মানুষ বলবে বিষয় না। জিহ্বার ভুল, সে মুসলিম বানিয়েছে। সে শ্রীলঙ্কায় ধরা খাবে। লেজ গুঁটিয়ে পালাবে। আরে বিষয় না, সে মুসলমান বানিয়েছে। হলি আর্টিজেনের নিব্রাস তাকে গুরু মানবে। কোনো বিষয় না, সে মুসলমান বানিয়েছে। কুমিরের বাচ্চা দেখিয়েছে। সেলুকাস! ভারত বড়ই বিচিত্র!
একটা হিসেব করুন। দেখুন তো 'শেয়াল সাব' কতজন মুসলিম করেছে। সব মিলয়ে শ’খানেক। তর্কের খাতিরে হাজার ধরলাম। এবার সূফীদের ধরুন। ভারতে ইসলাম এনেছে খাজা গরিবে নেওয়াজ। জানা যায় তিনি ৯৫ লক্ষ মুসলিম করেছেন। আমার-আপনার চোদ্দ পুরুষ তাঁর হাতে মুসলিম। এভাবে বাবা শাহ জালাল, শাহ আমানতেরা কত করেছেন খোদা মালুম!
এখন কইবেন রেফারেন্স দেন। আচ্ছা এ কথা বাদ দিলাম। তারা অনেক আগের। সুনির্দিষ্ট হিসেব নেই। সেটাও একটা কথা। তাহলে আসুন, হাল জামানা দেখি।
আমাদৌ বাম্বা। নামটা শুনেছেন? জন্মেছিলেন সেনেগালে। আফ্রিকান দেশে। ১৮৫৩ সালে। ১৯২৭ সালে তাঁর ওফাত। বেশি আগের না। তিনি পুরাই সূফি। সুন্নি ছিলেন। মাযহাবী ছিলেন। মাযার জিয়ারত, মিলাদুন্নাবী করতেন। মজার বিষয় অন্যখানে। তাঁর নাম আমাদৌ বাম্বা। কিন্তু তাঁকে মানুষ চিনে ভিন্ন নামে। ‘খাদেমুর রাসূল’ বা ‘রাসুলের দাস ও সেবক’ নামেই অধিক পরিচিত। সালাফিরা যাঁর পুরো বিপরীত। পুরো সেনেগাল, প্রায় আফ্রিকায় কোটি কয়েক মুসলমান করেছেন। রেফারেন্স চান? গুগোল করুন।
হাবীব আহমাদ মাশহুর আল-হাদ্দাদ। ইন্দোনেশিয়াতে জন্মান। ১৯০৭ সাল। ওফাত ১৯৯৫ তে। জীবন কাটান আফ্রিকায়। আফ্রিকায় তখন মিশনারিদের জয়জয়কার। মানুষ দলে দলে খৃষ্টান হচ্ছে। এমনকি মুসলিমরাও। তিনি সে স্রোতে বাঁধ দেন। তিন লক্ষ মুসলিম করেন। তিনিও পুরাই সূফী।
আফ্রিকা অনেক হল। ভারতে আসুন। মুফতি মাহমুদ জান। ইমাম আ’লা হযরত এঁর খলিফা, শিষ্য। আ’লা হযরতের গম্বুজ তো দেখেছেন। সাদা-কালো, ডোরাকাটা। অনবদ্য নকশা। সে গম্বুজের ডিজাইনার তিনি। আ’লা হযরত তাঁকে গুজরাটে পাঠান। জামজোধপুর এলাকায়। হিন্দু এলাকা। প্রায় পুরো এলাকাই মুসলমান হয়। মাহমুদ জানকে একবার দেখে। সংখ্যাটা কয়েক লক্ষ। ঘটনাটা ১৯০০ সালের পরে।
ইতিহাস অনেক হয়েছে। বর্তমানে আসুন। হুযুর কেবলা তাহের শাহ। বছরে বাংলাদেশে আসেন। তাঁর হাতে কতজন যে মুসলিম হয় তার খবর কে রাখে।! আমার এক ভাই। সৈয়দপুর, নীলফামারীতে বাড়ি। ইমাম মানুষ। তাঁর হাতে একটি হিন্দু পরিবার সবাই মুসলিম হয়েছে।
এভাবে আশপাশে দেখুন। ভুরিভুরি নমুনা পাবেন। মুসলিম বানানোই যদি দলীল হয়, তবে এই মানুষগুলো সেই শেয়ালের থেকে কম কিসে? বরঞ্চ তাঁরা শেয়ালের থেকে হাজারগুণ বেশি মুসলমান করেছেন। কিন্তু না, শেয়ালের কথাই শুনতে হবে। কুমিরের মত সরল আমজনতাকে কে বুঝায় এসব।
শত-হাজার বছর আগে এসেছেন সূফীরা। ঘর-জন্মভূমি ছেড়েছেন। মায়ের আঁচল, পিতার আশ্রয় ছেড়েছেন। ঘরে ফেরা হয় নি আর। তখন রাস্তাই ছিল না। রেল-বিমান পরে কথা। পাহাড়-জঙ্গল, বাঘ-সাপের দূর্গম পথ। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোদ-বৃষ্টির অসহ্য যন্ত্রণা। কেউ এসেছেন ইয়ামেন থেকে। কেউ ইরাক থেকে। আমাদের ইসলাম দিয়েছেন।
আর আজকের শেয়াল সাহেব! এসি ঘরে বসে, সৌদ্দাদের পেট্রোডলারের টিভি খুলে কমেডি করে। মানুষ তাঁকে নিয়েই লাফায়। বলে সূফীরা তার জুতোর যোগ্য না। আহারে! আহহা! কতটা অকৃতজ্ঞ এরা! হবে না কেন? কেউ অভিশপ্ত হলে, তার অভিশাপের প্রথম প্রকাশ হচ্ছে অকৃতজ্ঞতা। আর ওহাবি-সালাফিরা যে অকৃতজ্ঞ, শয়তানের শিং; তা মদিনা-মুনিব (দ) পবিত্র কণ্ঠেই বলেছেন।
আজকে যাদের স্লোগান “ক'জন মুসলিম বানাইছেন”, ভবিষ্যতে এরাই বলবে “ক'জন নাস্তিক-মুশরেক মারছেন”।
কারণ “মুসলিম বানাইছেন” গোষ্ঠি হলি আর্টিজেনে নিব্রাস হয়। মানুষ মেরে ইসলাম কায়েম করে। আল্লামা ফারুকিকে শহীদ করে। এরাই আইএস, জেএমবি হয়। “বানাইছেন” থেকে “মারছেন” পর্যায়ে আসতে সময় লাগবে না। বাঁধ ভাঙলে পানি গড়াবেই। বন্যা আসবেই।
প্রজন্ম! ফিরে এসো। দেখো ইসলামের প্রেমময়, মানবতা স্নিগ্ধ আহলে সুন্নাত কে। দেখো মদিনা-মুনিব (দ) এঁর দাসত্ব কতটা প্রশান্তির। তোমাকে ডাকছে ইসলাম। বলছে মদিনায় মিশেতে। শরণ, আশ্রয় নিতে ডাকছে।
আজ লে উনসে পানাহ আজ মাদাদ মাঙ্গ উনসে
ফির না মানেঙ্গে আগার কেয়ামত মে মান গ্যায়া

- আজ নে সাহায্য তাঁর, আজ নে তাঁর শরণ
কেয়ামতে মানলেও আর পাবি না মুক্তি তখন।

                                                                                                                        লিখেছেন- কবি মাহ্‌দী গালিব                                                 
 
Top