বৃদ্ধাশ্রম ও পিতা-মাতার অধিকার –


পিতা-মাতা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আপনজন, যাদের মাধ্যমে একটি সন্তান এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখে। তারাই হলেন সন্তানের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ ও দয়া প্রদর্শনকারী। তাদেরকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, ভক্তি করা প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়; বরং এগুলো তাদের অধিকার। তাদের খেদমত করতে পারা বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। সন্তান যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করার পাশাপাশি পিতা-মাতার সেবা-যত্ন এবং উত্তম আচরণ করে; তবে সে দুনিয়া ও পরকালে সাফল্য লাভ করবে। আর যদি মা-বাবার সঙ্গে অসদাচরণ করে অথবা সন্তানের কোনো কাজের কারণে পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হয়, তবে তার জন্য জাহান্নাম সুনিশ্চিত। সন্তানের প্রতি এমন নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পিতা-মাতার সাথে খারাপ ব্যবহার করার যথেষ্ট চিত্র রয়েছে বর্তমান সমাজে। মাতা-পিতার ব্যয়ভার বহন না করে তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে বা বস্তায় ভরে লঞ্চ বা রেল স্টেশনে ফেলে যাওয়ার চিত্রও রয়েছে এ সমাজে। যারা তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, তারা আর যাই হোক মানুষ নয়। তাদের পরিণতির চিত্রও ভয়াবহ। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা তুলে ধরা কষ্টকর। পিতা-মাতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের সুফল এবং মন্দ আচরণের ক্ষতিকর কিছু দিক কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।

উন্নত পশ্চিমাবিশ্বে বৃদ্ধাশ্রম আছে। সেগুলোতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের লালন-পালন করা হয়। সার্বিক সেবা প্রদান করা হয়। কারণ পাশ্চাত্য দেশসমূহে ছেলে-মেয়ের বয়স ১৮ পেরিয়ে যাবার পর বাবা-মার সঙ্গে থাকার বা সম্পর্ক রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রুজি-রোজগার করে সে অর্থ পিতা-মাতাকে দেয়ার কোনো বাধকতা নেই। কেউ তার মা-বাবার সঙ্গে থাকা কিংবা টাকা-পয়সা দেওয়াটা তার একান্ত নিজস্ব^ ব্যাপার। কিন্তু এ রকম কোন প্রথা নেই, নেই কোন সংস্কৃতি। ফলে সেখানকার প্রবীণরা জীবনের এক পর্যায়ে এসে চরম হতাশা ও অসহায়ত্বের শিকার হন। এ কারণেই বৃদ্ধাশ্রমের উদ্ভব ও ব্যবস্থাপনা। এ বৃদ্ধাশ্রমগুলো দু’ধরনের। কিছু এমন আছে, যেগুলো সেবা দেয় টাকার বিনিময়ে। যেন এটা একটা ব্যবসা। আর কিছু এমন আছে, যেগুলো সরকার চালায় কিংবা কোনো দাতব্যসংস্থা চালায়। তারা কেবল সেসব প্রবীণদের বিনা পয়সায় সেবা দেয়, যাদের কেউ নেই, কোনো স্বজন নেই। এ ধরনের বৃদ্ধাশ্রমগুলো পাশ্চাত্যে আছে, থাকবে। কারণ, তাদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি এমনই। হয়ত কোনো সন্তান তার মা-বাবাকে চেনেও না কিংবা কেউ মাকে চিনলেও পিতা কে- তা জানে না। তাই পাশ্চাত্যে বৃদ্ধাশ্রম হতে পারে। কিন্তু এগুলো মুলিমবিশ্বে সংক্রমিত হবে কেন? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি আছে! মুসলিম রীতি-নীতি তো এমন নয়। ইসলামী সংস্কৃতিও এমন নয়। মুসলিমরা এটা গ্রহণ করবে কেন? এ ব্যবস্থাপনায় বাবা-মার হক কি আদায় হবে? এতে তারা কি শান্তি পাবে? আমি স্ত্রী- সন্তানসহ নিজ বাসায় স্বজনদের মনোরম পরিবেশে অবস্থান করলাম। আর মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলাম। যদিও তাদের ভরণ-পোষণ এবং চিকিৎসাসহ যাতীয় খরচ বহন করছি। কিন্তু ওখানে তারা যে সেবা পাবে, সেই সেবা হলো প্রাণহীন, নীরস। সেই সেবা হবে কাম্য ভালোবাসাহীন, নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধাহীন। বৃদ্ধাশ্রমওয়ালারাও হয়ত স্নেহ- শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। কিন্তু তাদের প্রদর্শিত স্নেহ-মমতা প্রবীণদের কাছে পরম কাম্য নয়। কারণ, ওরা আপন নয়, ওরা পর। এরা যা প্রদর্শন করে তা কৃত্রিম ও লৌকিকতা। নিষ্ঠ খাঁটি ও প্রাণোৎসারিত নয়। মা-বাবাকে আশ্রমে তোলে দিলাম। কিন্তু তারা প্রত্যহ তো দূরে, কখনো সপ্তাহ, পক্ষ বা মাস চলে যায়, সন্তানদের দেখে না, ছেলেবৌ দেখে না, নাতি-নাতনিদের দেখে না। তাদের স্পর্শ পায় না। কল-কোলাহল শোনে না। নাতি-নাতনিদের আদর-সোহাগ করতে পারে না। আশ্রমে বাহ্যিক যতই তারা ভালো থাকুক, প্রকৃতপক্ষে এটা ভালো থাকা নয়। একটা অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা এবং অভাববোধ সর্বদা তাদের তাড়িত করবে। সন্তানের মুখে আব্বা-আম্মা ডাক যখন মা-বাবা শোনে; নাতি-নাতনির মুখে যখন দাদু ডাক তারা শোনে, তখন তাদের মনে যে তৃপ্তি শান্তি ও মিষ্টতা অনুভব করে, সেটা তারা আশ্রমে কোথায় পাবে?

কুরআনুল করিমে পিতা-মাতা সম্পর্কে তিন ধরনের আয়াত এসেছে।

 প্রথমত: শুধু মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব সম্পর্কিত আয়াত (কি করতে হবে)।
 দ্বিতীয়ত: পিতা-মাতার অধিকার ও অন্যান্যদের অধিকার (একসঙ্গে) সম্পর্কিত আয়াত। 
তৃতীয়ত: বাবা-মার অধিকারের সীমা সম্পর্কিত আয়াত (কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা-মাতার কোনো অধিকার নেই)।

মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে নির্দেশ প্রদান পূর্বক ইরশাদ করেন: আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো। অন্যত্র ইরশাদ করেন: তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ (বিরক্তিসূচক ও অবজ্ঞামূলক কথা) বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দেবে না; তাদের সঙ্গে সম্মানের সাথে কথা বলবে। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছে।

পিতা তার রিযিক ও জীবিকার জন্য প্রচেষ্টা করে। অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সন্তানের ঘুমের জন্য মাতা-পিতা রাত জাগরণ করে। তার প্রশান্তির জন্য তারা উভয়ে কষ্ট করে। তার সব ধরনের সুব্যবস্থার জন্য নিজেদের ওপর সার্বিক চাপ সহ্য করে। সন্তানের সুখের জন্য বিভিন্ন কষ্ট স্বীকার করে। তার পরিপক্বতা ও পরিপূর্ণতার জন্য তাকে সুশিক্ষা প্রদান করে। আর মা তার পেছনে সবচেয়ে বড় বড় তিনটি কষ্ট স্বীকার করে থাকেন। এজন্য হাদীস শরীফে মাকে তিনগুণ অধিকার দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি বারেগাহে রিসালতে আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সাহচর্যে সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমার পিতা। অতঃপর ধারাবাহিকভাবে নিকট আত্মীয়। আল্লামা ইবনে কাছীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে বলেন, এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সন্তানের ওপর জননীর অধিকার পিতার চেয়ে তিন গুণ বেশি। কেননা, রাসূলুল্লাহ মায়ের কথা তিনবার উল্লেখ করেছেন, চতুর্থবারে পিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও মায়ের অধিকার বেশি হওয়ার স্বতন্ত্র কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক. গর্ভধারণের কষ্ট। দুই. প্রসবকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তান প্রসবের কষ্ট । তিন. দুগ্ধপান করানো এবং সন্তানের সেবা-যত্নে নিয়োজিত থাকার কষ্ট। এসব কারণ পিতার মধ্যে বিদ্যমান নেই। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। আর দুধপান করানো, এটা তো আল্লাহ তাআলার নিদর্শনগুলির একটি। ইরশাদ হচ্ছে: জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বৎসরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।

মাতা-পিতা জান্নাতপ্রাপ্তির প্রধান মাধ্যম। যে তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তার নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, তার নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, তার নাক ধূলায় ধূসরিত হোক। বলা হলো- ইয়া রাসূলাল্লাহ! কার? তিনি বললেন, যে তার মাতা-পিতাকে অথবা দুইজনের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অথচ জান্নাতে যেতে পারল না। যদি মাতা-পিতাকে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে আল্লাহ তাআলাও সন্তুষ্ট হন। নুরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে। এক ব্যক্তি রাসূলে আরাবিকে জিজ্ঞাসা করল, সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক কী? উত্তরে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। অর্থাৎ যারা পিতামাতার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে, তারা সফলকাম। আর যারা তাদের অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে তাদের জন্য লাঞ্ছনা। এমনকি যদি কারো পিতা-মাতা অমুসলিম হয়, তাহলে তাদের সাথেও সদ্ব্যবহার করার জন্যও ইসলাম জোর নির্দেশ দিয়েছে। হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট আসলেন, আমি হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মা আমার নিকট দেখা করতে আসেন, আমি কি তার সাথে সদাচরণ করতে পারবো? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ! তার সাথে সদ্ব্যবহার করো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি তার আয়ু ও রিযিক বৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক, সে যেন তার বাবা-মার সাথে ভাল ব্যবহার করে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। মাতা-পিতার অধিকার ও কর্তব্য যথাযথ আদায় করা কখনও সম্ভব নয়। তবে একটি অবস্থা আছে যার মাধ্যমে তাদের প্রতি কর্তব্য আদায় করা সম্ভব। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: সন্তান তার পিতার অবদানের মূল্য তখন দিতে পারবে, যখন সে তার পিতাকে দাস পেয়ে ক্রয় করে মুক্ত করবে।

পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যগুলি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। 
যেমন-জীবিত অবস্থায় তাদের প্রতি সন্তানের উল্লেখযোগ্য কর্তব্যগুলি হলো- ক) তাদের সাথে নরম স্বরে কথা বলা, খ)তাদেরকে কষ্ট না দেওয়া, গ) তাদেরকে ধমক না দেওয়া। ঘ)পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করা এবং সংযত আচরণ করা। ঙ) তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করা। চ) তাদের অবাধ্য না হওয়া। ছ)তাদের অভিশাপে অভিশপ্ত হওয়ার কারণ না হওয়া। এবং জ) মাতা-পিতা থেকে দূরে থাকলে যে কোনভাবে যোগাযোগ করা কিংবা তাদের খোঁজ-খবর নেয়া এবং তাদের জন্য সামর্থ অনুযায়ী খরচের টাকা পাঠানো। ঝ) তাদের আশা-আকাক্ষা পূরণ করার চেষ্টা করা ইত্যাদি। পিতা-মাতার ইন্তেকালের পরেও তাদের প্রতি সন্তানের বহুবিধ কর্তব্য রয়েছে। যেমন-ক) তাদের জানাযা ও দাফন-কাফনের উত্তম ব্যবস্থা করা। খ) তাদের ঋণ পরিশোধ করা। গ) তাদের অসিয়াত পূর্ণ করা। ঘ) তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা ও তাদের কবর জিয়ারত করা। ঙ) তাদের পক্ষে দান-সদকা করা, তাদের কৃত মানত পূরণ করা। চ) তাদের সঙ্গী-সাথী ও আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য করা, সম্মান করা এবং ভাল স¤পর্ক রাখা। ইত্যাদি। আর উপরোক্ত যে কোন বিষয়ের বিপরীত করাই হচ্ছে তাদের সঙ্গে অবাধ্যতা ও অসদাচরণ। তবে পিতা-মাতা যদি অন্যায় কাজের আদেশ করে তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করা যাবে না। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সাথে কাউকে শরীক করতে যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সৎভাবে বসবাস করবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই। হাদিস শরীফে আরো এসেছে- যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পিতা-মাতার আনুগত্য করে তার জন্য জান্নাতের দুটি দরজা খোলা থাকবে; আর যে ব্যক্তি তাদের অবাধ্য হয় তার জন্য জাহান্নামের দুটি দরজা খোলা থাকবে। এ কথা শুনে এক ব্যক্তি প্রিয়নবীকে প্রশ্ন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জাহান্নামের এ শাস্তির বাণী কি তখনো বলবৎ থাকবে? পিতা-মাতা যখন এ ব্যক্তির প্রতি জুলুম করে। উত্তরে রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: এই শাস্তির বিধান তখনো প্রযোজ্য হবে।

পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা যেমন সন্তানের কর্তব্য, তেমনি তাদের সাথে সম্পর্কছেদ করা কবীরা গুনাহ। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে অবগত করব না? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা, পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা। আর মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়ার পরিণতিও খুবই ভয়াবহ। যেমন – ১. দোযখে প্রবেশের কারণ। ২. এতে দুনিয়া এবং আখেরাতের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে যায়। ৩. নিজ সন্তানও অনুরূপ অবাধ্য হয়। ৪. সমস্ত কাজে ও নিজ বয়সের বরকত নষ্ট হয়ে যায়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: সমস্ত গোনাহের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা যেগুলো ইচ্ছা করেন কিয়ামত পর্যন্ত পিছিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু পিতা-মাতার হক্ব নষ্ট করা এবং তাদের প্রতি অবাধ্য আচরণ করা এর ব্যতিক্রম। এর শাস্তি পরকালের পূর্বে ইহকালেও দেয়া হয়। তিনি আরো ইরশাদ করেন: পিতা-মাতার আবাধ্যতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি দুনিয়াতে অন্যান্য পাপের চেয়ে দ্রুত অপরাধীর উপর কার্যকর হয়। পরকালের শাস্তি তো আছেই। মাতা-পিতার সঙ্গে অবাধ্যতা বেড়ে যাওয়া হচ্ছে কিয়ামাতের আলামত। আর মাতা-পিতার সঙ্গে সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা হচ্ছে, সন্তান আপন মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ ও সেবা-যত্ন বাদ দিয়ে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া। এটা ঈমানদারের চরিত্র নয়, এছাড়া বড় অবাধ্যতা হচ্ছে, মাতা-পিতার সঙ্গে অহঙ্কার করা, তাদের মারধর করা গালমন্দ, অপমান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম ইরশাদ করেন: ৫০ হাজার বছরের দূরত্বে জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু অবাধ্য (সন্তান) এ ঘ্রাণও পাবে না।

অনেকে নিজে অহরহ নিজের বাবা -মার সাথে ধমকের সুরে কথা বলে, রেগে গেলে রূঢ় আচরণ করে; কিন্তু স্ত্রীকে নির্যাতন করে এই অজুহাতে যে, সে তার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর সঙ্গে যথেষ্ট ভালো আচরণ করছে না এবং আমাদের সমাজে এমন আচরণকে অনেক ক্ষেত্রেই খোদা ভীরু আচরণ মনে করা হয়। মনে করা হয় তারা এটা করছেন নিজের বাবা মায়ের সাথে তার স্ত্রীর ভালো ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য। অনেকে শুধু স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হন না বরং এই অজুহাতে নিজ শ্বশুড়-শাশুড়ীর সাথেও খারাপ আচরণ করে। এই ধরণের আচরণকারী তিন ভাবে কোরআনের বিরুদ্ধ আচরণ করছে-
 ১. কোরআন সবার আগে বলেছে নিজেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে নম্র ভাষায় ব্যবহার করতে ও বিনয়াবনত থাকতে কিন্তু লোকটি তা করছে না ।
 
২. স্ত্রীর উপর নির্যাতন করছে,অথচ কুরআনে তার সাথে সুন্দর আচরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

৩. নিজে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর সাথে সদ্ব্যবহার করছে না (অথচ স্ত্রীর কাছে চাইছে- সে তার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর সাথে ভালো ব্যবহার করুক)। ইরশাদ হচ্ছে-“এবং পিতা-মাতা , আত্মীয়-স্বজন , ইয়াতিম , অভাব গ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী সাথী , পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে।”

পিতা-মাতার খেদমত যেমন ইবাদত, তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও সমবয়সীদের খেদমত করাও অনুরূপ ইবাদত। যেহেতু মেয়েরা স্বামীর সংসারে গেলে পিতা-মাতার সরাসরি খেদমত করার সুযোগ কম থাকে, তাই শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করলে পিতা-মাতার খেদমতের সওয়াবের অধিকারী হবে। পুত্রবধূর ওপর শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা নফল। নফল ইবাদতে কাউকে বাধ্য করা যায় না বা জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। যেহেতু সংসারের রীতি অনুযায়ী নারীদের নিজ পিতা-মাতা ছেড়ে স্বামীর সংসারে যেতে হয় এবং তার পিতা-মাতার সংসারে অন্য আরেকজন নারী বধূ হয়ে আসে; তাই প্রত্যেক নারী যদি শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতা জ্ঞান করে সেবা ও খেদমত করেন, তবে সব পিতা-মাতা ও সব শ্বশুর-শাশুড়ি সমানভাবে সেবা ও খেদমত পাবে। শ্বশুর-শাশুড়িরও উচিত পুত্রবধূকে মেয়ে মনে করা এবং সেইরূপ আচরণ করা। সবাই সবার আপন আপন দায়িত্ব পালন করলেই সবার নিজ নিজ অধিকার সংরক্ষিত হয়। মনে রাখতে হবে, ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়। ¯েœহ করলে সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়া যায় আর সেবা ও খেদমত করলে ¯স্নেহাশীষ হওয়া যায়। এভাবেই সংসারজীবন ও দাম্পত্য জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে, সমাজ স্থিতিশীল হবে। আজ যারা সন্তান, আগামী দিনে তারাই হবে পিতা-মাতা। আজ যারা বধূ বা জামাতা, আগামীকাল তারাই হবে শ্বশুর বা শাশুড়ি। সুতরাং, আজকের সন্তানেরা যদি তাদের পিতা-মাতার খেদমত করে, তবে তাদের সন্তানেরা তাদের থেকে দেখে শিখবে কীভাবে পিতা-মাতার খেদমত করতে হয় এবং তাদের বার্ধক্যেও তারা তাদের সন্তানের কাছ থেকে অনুরূপ খেদমত পাবে। আজকের বধূ ও জামাতারা যদি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হয়, তবে পরবর্তী প্রজন্ম তা দেখে শিখবে এবং তারা যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হবে, তখন সেইরূপ সেবা ও সম্মান পাবে। এভাবেই গড়ে উঠবে সুখী, সুন্দর ও আনন্দময় পারিবারিক পরিবেশ। জান্নাতি সুখে ভরে উঠবে দুনিয়ার পরিবেশ।

পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন

বিগত সরকারের সংসদ সদস্য মজিবুল হক চুন্নু ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে একটি বেসরকারি বিল হিসাবে উত্থাপন করেন। বেসরকারি বিল হিসাবে এই বিলটি ছিল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিল। বিলটি নিয়ে সংসদীয় কমিটি যাচাই বাছাই ও কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করার পর বিলটি পাস করার জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে । এই আইনের শুরুতই বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণ পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো, পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে সেই ক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার ভরণ পোষণ নিশ্চিত করবে। এছাড়াও এই আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তান তার পিতা-মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে, যা আমাদের পিতা-মাতারা যুগে যুগে করে এসেছেন। আমাদের শত ব্যস্ততায় যেন আমরা পিতা-মাতার শারীরিক সুস্থতার কথা বিবেচনায় রাখি সেই উদ্দেশ্যেই আইনের এই ধারাটি। আইনের ৪ নং ধারায় পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ভরণ পোষণের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের এই ভরণ-পোষণ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ হিসেবে গণ্য হবে। আইনটি এতটাই মানবিক যে, এই আইনের ৬নং ধারায় যদি কোনো সন্তান পিতা-মাতার থেকে দূরেও বাস করে সেক্ষেত্রেও পিতা-মাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা বা সাক্ষাৎ করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। যদি পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে সেক্ষেত্রে সন্তান তার দৈনন্দিন/মাসিক/বাৎসরিক আয় রোজগার থেকে কমপক্ষে ১০% পিতা-মাতাকে প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনো অভিযোগ যদি এ ধরনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন না হয় সেক্ষেত্রে বিচারিক আদালতেই বিষয়টির পুনরায় বিচার কাজ শুরু হবে। আইনটিতে সংঘটিত অপরাধকে আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য ও আপসযোগ্য বলে গৃহীত হয়েছে। কেবলমাত্র সন্তানই এই অভিযোগে অভিযুক্ত হবে সেটা নয়, যদি এমন হয় যে সন্তান এই সকল দায়িত্ব পিতা-মাতা বা তাঁদের অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা-নানীর প্রতিও পালন করতে পারছে না কিংবা তাকে তার স্বামী/স্ত্রী পালন করতে দিচ্ছে না অথবা দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করছে, সেক্ষেত্রে এই আইন অনুযায়ী পিতা-মাতার ভরণ পোষণের বাধা প্রদানের দায়ে এবং ভরণ পোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করার কারণে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তি স্বামী বা স্ত্রী যেই হোক উক্ত অপরাধ সংঘটনের দায়ে দন্ডিত হবে। তবে আইন সব সময়ই মানুষকে রক্ষা করার জন্যই সৃষ্টি হয়, সেই হিসাবে এই অপরাধের সাজার মাত্রা খুবই সীমিত করা হয়েছে। মাত্র তিন মাসের কারাদন্ড এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা এর সাজার পরিমাণ। তবে এই আইনের অধীনে মামলা দায়ের হলে ৭ দিনের মধ্যেই চার্জশীট দাখিল করতে হবে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এটি একটি মানবিক গুণাবলি সমৃদ্ধ আইন, যা একদিকে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে তাদের বার্ধক্য জীবনের অনিশ্চয়তার হাত থেকে নিরাপদ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে, অপরদিকে সন্তানকে তার নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। আইনটি আমাদের নগর জীবনে তো বটেই অসহায় যে পিতা-মাতা গভীর দুঃখ-কষ্ট করে সন্তান লালন-পালন করে সন্তানকে দিয়েছে এক আলোকময় জীবন, সেই সন্তান যখন পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে তাদের জন্যও নতুন আলোকবর্তিকা হিসাবেই কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

সন্তান তার পিতা-মাতার খেদমত করবে, তাদের ভরণ-পোষণ ও দেখভাল করবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে- এটাই স্বভাব ও প্রকৃতির চাহিদা মানবতার দাবি। ইসলামের বিধান ও স্রষ্টার নির্দেশ। সন্তান যত বড় শিক্ষিত, জ্ঞানীগুণী আধুনিক আর প্রগতিশীলই হোক- সে যদি তার পিতা-মাতাকে মর্যাদা না দেয়, খেদমত না করে, সে তো মানুষই না। অন্যান্য বহুবিধ গুণ তার থাকলেও মনুষ্যত্ব বা মানবতা-গুণ থেকে সে বঞ্চিত। সন্তানের কাছে এমন অসদগুণ থাকা অপ্রত্যাশিত। যে সেবার মধ্যে স্নেহ-মমতা আছে, সম্মান-শ্রদ্ধা আছে, সংবেদনশীল দরদ আছে- সেটিই খেদমত। সেটিই প্রত্যাশিত যে সেবা এসব থেকে মুক্ত, সেটা খেদমত নয়। খেদমত নাম দিলেও, খেদমতের সুরতে করা হলেও- সেটা খেদমত নয়। এমন খেদমতে পিতা-মাতা শান্তি পান না; সন্তুষ্ট হন না। নিজেদের বরং পরনির্ভরশীল, অন্যের ঘাড়ে বোঝা মনে করে কষ্ট পান। মর্মযাতনায় ভোগেন। সন্তানের কাছ থেকে বর্ণিত অর্থে খেদমত পাওয়া- এ তো সন্তানের ওপর মা-বাবার অধিকার। এটা সন্তানের কোনো অনুগ্রহ নয়, দয়া-দাক্ষিণ্য নয়। এটা আদায় না করলে আল্লাহর আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে।
 
Top