রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা আমার সামনে সারা দুনিয়াকে তুলে ধরেছেন। তখন আমি এ দুনিয়াকে এবং এতে কিয়ামত পর্যন্ত যা’ কিছু হবে এমনভাবে দেখতে পেয়েছি, যেভাবে আমি আমার নিজ হাতকে দেখতে পাচ্ছি।

{ক. ইমাম আবু নঈমঃ হুলিয়াতুল আউলিয়াঃ ৬/১০১ পৃ.; খ. ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ খাছায়েসুল কোবরাঃ ২/১৮৫ পৃ.; গ. ইমাম তাবরানীঃ মু’জামুল কবীরঃ ১/৩৮২; ঘ. মুত্তাকী হিন্দিীঃ কানযুল উম্মালঃ ১১/৪২০ হাদিসঃ ৩১৯৭১; ঙ.  ইমাম কুস্তালানীঃ মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়াঃ ৩/৯৫ পৃ.; চ. ইমাম জুরকানীঃ শরহুল মত্তিয়াহেবঃ ৭/২০৪ পৃ.; ছ. মুত্তাকী হিন্দীঃ কানযুল উম্মালঃ ১১/১৩৭৮ হাদিসঃ ৩১৮১০; জ. আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামীঃ মাযমাউদ যাওয়াহিদঃ ৮/২৮৭ পৃ.; ঝ. আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ জামিউল কবীরঃ হাদীসঃ ৪৮৪৯; ঞ. আবু নঈম ইস্পাহানীঃ তারগীব তারহীবঃ ২/২১১ পৃ.}




এই হাদিসটা সিহাহ সিত্তাতে আসেনি। আমি যদি এই হাদিসটা দিয়ে দাবী করি যে, "আমাদের প্রিয় নবী ﷺ আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সবকিছু জানতেন"- তাহলে আমার অভিজ্ঞতা বলছে, অনেকেই বলে বসবে এত গুরুত্বপূর্ণ হাদিস সিহাহ সিত্তাতে আসেনি কেন?? এটা বানোয়াট, জাল, যঈফ। 

আসলেই কি সিহাহ সিত্তাতে না আসলে বানোয়াট হয়ে যায়!! নিশ্চয়ই নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে যেসব হাদিস তাদের নিকট অপরিচিত (মোল্লারা গোপন করে রাখে), সেগুলো যে, বুখারী মুসলিমে আছে, সেটা দেখিয়ে দিলেও তাদের কাছে বানোয়াট, টেম্পার্ড মনে হয়। হ্যা, আমি এর প্রমাণ পেয়েছি, বুখারী মুসলিমে বর্ণিত আল্লাহ'র প্রিয় বান্দাগণ কর্তৃক শাফায়াতের কথা বলতে গিয়ে, মুসলিম-তিরমিজী শরীফে বর্ণিত বিদায় হজ্জের ভাষণে আহলে বাইতের কথাও বলা হয়েছে- এটা বলতে গিয়ে। কিন্তু মজার বিষয় কি জানেন!! এরা যে,  শুধু "কুরআন ও সুন্নাহ"কে রেখে যাওয়ার কথা বলে এটাও কিন্তু সিহাহ সিত্তাতে নেই, আছে মুসতাদরেক হাকিমে। কিন্তু এটা যেহেতু আমার নবীর ফরমান, তা কোথায় আছে সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়, প্রমাণিত হওয়াটাই বিবেচ্য। আমাদের নিকট কুরআন, আহলে বাইত, সুন্নাহ তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ।

আচ্ছা, যে হাদিসটা দিলাম, সে প্রসঙ্গেই ফিরে যাই। বলছিলাম, আমার মন বলছে অনেকের অন্তরে এই হাদিসটাকে স্থান দিতে খুব কষ্ট হবে। তাদের জন্য কিছু কথা বলি। যদিওবা সরাসরি এই শব্দে হাদিসখানা সিহাহ সিত্তায় বর্ণিত হয়নি কিন্তু এটার মূল বিষয় বুখারী মুসলিমের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এবার মিলিয়ে নিনঃ

💠 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা গোটা পৃথিবীকে ভাজ করে আমার সামনে রেখে দিলেন। অতঃপর আমি এর পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত দেখে নিয়েছি। পৃথিবীর যে পরিমাণ অংশ গুটিয়ে আমার সম্মুখে রাখা হয়েছিল সে পর্যন্ত আমার উম্মতের রাজত্ব পৌছবে। আমাকে লাল ও সাদা দুই প্রকারের ধনাগার দেয়া হয়েছে। (সহীহ মুসলিম ৭১৫০)

💠 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার সামনে সকল উম্মতকে পেশ করা হয়েছিল। (সহীহ বুখারী ৫৭০৫) 

💠 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার উম্মতের সমস্ত আমল আমার সামনে পেশ করা হয়েছিল। (সহীহ মুসলিম ১১২০)

💠 আম্মাজান আয়িশাহ্ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ এমন কোন জিনিস নেই যা আমাকে দেখানো হয়নি আমি এ জায়গা হতে সব কিছুই দেখেছি। এমন কি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখলাম। (সহীহ বুখারী ৯২২)

এবার দেখে নিন কিয়ামত পর্যন্ত সকল কিছু বর্ণনার হাদিসগুলোঃ

💠 রাসূলুল্লাহ ﷺ ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নামাজসমূহ আদায়ের পরপর মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা (বর্ণনা) দিতে থাকেন। এতে তিনি পূর্বে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে সব জানিয়ে দেন। (সহীহ মুসলিম ৭১৫৯) 

💠 তিনি ﷺ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন। অবশেষে তিনি জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসীর নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করার কথাও উল্লেখ করেন। যাদের স্মরণশক্তি ভাল ছিল, তারা এগুলো স্মরণ রাখতে পেরেছেন। (সহীহ বুখারী ৩১৯২) 

💠 তিনি ﷺ কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে বলে জানান সেসবের কিছু ঘটলেই সাহাবায়ে কেরাম তা স্মরণ করতে পারতেন যেভাবে কেউ তার পরিচিত লোকের অনুপস্থিতিতে তার চেহারা স্মরণ রাখে। অতঃপর তাকে দেখা মাত্র চিনে ফেলে। (সুনান আবূ দাউদ ৪২৪০) 

💠 হুযায়ফা (রাঃ) আল্লাহ্‌র কসম করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ কিয়ামত পর্যন্ত ফিতনা সৃষ্টিকারী কোন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করতে বাদ দেননি, যাদের সংখ্যা হবে তিনশ’রও বেশী। তিনি তাদের নাম, তাদের পিতার নাম এবং তাদের গোত্রের নামও উল্লেখ করেন। (সূনান আবু দাউদ ৪২৪১) 

💠 এছাড়াও রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, দাজ্জালের সংবাদ সংগ্রাহক দলের প্রতিটি ব্যক্তির নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও তিনি অবগত আছেন। (সহীহ মুসলিম ৭১৭)

💠 প্রিয় নবী ﷺ মিম্বরে আরোহণ করে ঘোষণা করলেন, তোমরা আমাকে যা-ই প্রশ্ন করবে, আমি তারই উত্তর প্রদান করব। অতঃপর এমন এক ব্যক্তি, যাকে পারস্পরিক বাকবিতণ্ডার সময় অন্য এক ব্যক্তির (যে প্রকৃতপক্ষে তার পিতা নয়) সন্তান বলে সম্বোধন করা হতো, (তিনি) উঠে তার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি ﷺ উত্তর দিলেন, তোমার পিতা হুযাফা। (সহীহ বুখারী ৭০৮৯) 

কেন এমন করতে হয়েছিল জানেন...!

কারণ শুধুমাত্র বর্তমানের মুনাফিকরাই তাঁর জ্ঞান সমালোচনা করে এমন নই বরং আমার নবীজির যুগেও এমন মুনাফিকরা ছিল।

💠 তাফসীরে খাযেনে, "(হে সর্বসাধারণ!) আল্লাহর শান/রীতি এ নয় যে, তোমাদেরকে অদৃশ্যের জ্ঞান দিয়ে দেবেন। তবে আল্লাহ নির্বাচিত করে নেন তার রাসূলগণের মধ্য থেকে যাঁকে চান। সুতরাং ঈমান আনো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং যদি তোমরা ঈমান আনো এবং পরহেযগারী অবলম্বন করো, তবে তোমাদের জন্য মহা প্রতিদান রয়েছে।" (সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৯) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে, 

(একদিন) প্রিয় নবী ﷺ বলেন, আমাকে বলে দেয়া হয়েছে কে আমার উপর ঈমান আনবে আর কে আমাকে অস্বীকার করবে। যখন এ খবর মুনাফিকদের কাছে পৌঁছালো, তখন তারা হেসে বলতে লাগলো, হুযুর ﷺ ওসব লোকদের জন্মের আগেই তাদের মুমিন ও কাফির হওয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন, অথচ আমরা তাঁর সাথেই আছি কিন্তু আমাদেরকে চিনতে পারেন নি।’ এ খবর যখন হুযুর ﷺ এঁর নিকট পৌঁছলো, তখন তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ইরশাদ ফরমান এসব লোকদের কি যে হলো, আমার জ্ঞান নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন বিষয় সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাস করো, আমি অবশ্যই বলে দিব।’’ [ইমাম খাযেন: লুকাবুত তা’ভীল: ১/৩২৪ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪১৫হি.]

এখন আবার অনেকের মনে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি হতে পারে, এত অল্প সময়ে এতকিছুর বর্ণনা কি সম্ভব?? লক্ষ্য করুন-

💠 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, দাউদ (‘আলায়হিস সালাম) এঁর জন্য কুরআন (যাবুর) তেলাওয়াত সহজ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর পশুযানে গদি বাঁধার আদেশ করতেন, তখন তার উপর গদি বাঁধা হতো। অতঃপর তাঁর পশুযানের উপর গদি বাঁধার পূর্বেই তিনি যাবুর তিলাওয়াত করে শেষ করে ফেলতেন। তিনি নিজ হাতে উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। (সহিহ বুখারী ৩৪১৭)

💠 হযরত মাওলা আলী রাঃ ঘোড়ার উপর আরোহন করার সময় এক রিকাবে পা রাখতেন তখন কুরআন তিলাওয়াত শুরু করতেন আর অপর রিকাবে কদম রাখার আগে আগে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করে নিতেন। (শাওয়াহেদুন নবুওয়াত, পৃষ্ঠা ২১২)

💠 সুনান আত তিরমিজির ২৯৪৬ নং হাদিসের শেষের দিকে ইমাম তিরমিজী রহঃ উল্লেখ করেন, হযরত উসমান (রাঃ) বিতরের শেষ রাকাআতে সম্পূর্ণ কুরআন শেষ করতেন। সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাঃ) কা'বা শরীফে এক রাকাআতে সম্পূর্ণ কুরআন শেষ করেছেন। তবে ধীরেসুস্থে সহীহশুদ্ধ করে কুরআন তিলাওয়াত করা সকল আলিমদের মতে বেশি পছন্দনীয়। (হ্যা, আমরাও বলি সাধারণদের পক্ষে শুদ্ধভাবে এত তাড়াতাড়ি কুরআন খতম সম্ভব নয়)

💠 ইমাম নববী রহ. বলেছেন, "যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ এক রাকাতে পুরো কুরআন খতম করেছেন তাদের সংখ্যা গণনার যোগ্য নয় তাদের আধিক্যতার কারণে। তাদের মধ্যে রয়েছেন উসমান ইবনে আফফান, তামিম আদ-দারী, সাঈদ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুম।"[আল আযকার, পৃষ্ঠা ১১৮]

হ্যাঁ, এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের অসংখ্য ক্ষমতা (মু'জিযা ও কারামত) দিয়ে থাকেন। এছাড়াও 

💠 প্রিয় নবী ﷺ বলেনঃ আমি ‘জাওয়ামিউল কালিম (ব্যাপক অর্থবহ সংক্ষিপ্ত কথা) সহ প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। (অর্থাৎ তিনি এমন সংক্ষিপ্ত কথা বলতেন যা শব্দ বা উচ্চারণের দিক থেকে হত অল্প কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক) একবার আমি ঘুমের অবস্থায় দেখলাম, পৃথিবীর ভান্ডারগুলোর চাবি আমাকে দেয়া হয়েছে এবং তা আমার হাতে রেখে দেয়া হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ ওফাত বরণ করে গেছেন। আর তোমরা তা ব্যবহার করছ কিংবা বলেছিলেন তোমরা তা থেকে উপকার লাভ করছ কিংবা তিনি এরকমই কোন কথা বলেছিলেন। (সহীহ বুখারী ৭২৭৩)

 
Top