প্রিয় নবী ﷺ গর্তবাসীদের (বদর যুদ্ধে নিহত মুশরিক দলনেতা আবূ জাহেল গঙদের) দিকে ঝুঁকে দেখে বললেনঃ “তোমাদের সাথে রব যে ওয়াদা করেছিলেন, তা তোমরা বাস্তবে পেয়েছ তো?” (সূরা আল-আ’রাফ ৭: ৪৪)। তখন তাঁকে বলা হল, আপনি মৃতদের ডেকে কথা বলছেন? (ওরা কি শুনতে পায়?) তিনি বললেনঃ “তোমরা তাদের চেয়ে অধিক শুনতে পাও না, তবে তারা জবাব দিতে পারছে না”। (সহিহ বুখারী ১৩৭০)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ বান্দাকে যখন তার ক্ববরে রাখা হয় এবং তার সাথীরা এতটুকু মাত্র দূরে যায় যে, সে তখনও তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়। এ সময় দু’জন ফেরেশ্তা তার নিকট এসে তাকে বসান এবং তাঁরা বলেন, এ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহাম্মদ ﷺ সম্পর্কে তুমি কী বলতে বা ধারণা পোষণ করতে? তখন মু’মিন ব্যক্তি বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহ্‌র বান্দা এবং তাঁর রাসূল। তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থান স্থলটির দিকে নজর কর, আল্লাহ্ তোমাকে তার বদলে জান্নাতের একটি অবস্থান স্থল দান করেছেন। তখন সে দু’টি স্থলের দিকেই দৃষ্টি করে দেখবে। কাতাদাহ (রাঃ) বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে ব্যক্তির জন্য তাঁর ক্ববর প্রশস্ত করে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি (কাতাদাহ রাঃ) পুনরায় আনাস (রাঃ)-এঁর হাদীসের বর্ণনায় ফিরে আসেন। তিনি [(আনাস) (রাঃ)] বলেন, আর মুনাফিক বা কাফির ব্যক্তিকেও প্রশ্ন করা হবে তুমি এ ব্যক্তি (ﷺ) সম্পর্কে কী বলতে বা কি ধারণা পোষণ করতে? সে উত্তরে বলবে, আমি জানি না। লোকেরা যা বলত আমি তা-ই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, তুমি না নিজে জেনেছ, না পড়েছ/ শিখেছ। আর তাকে লোহার মুগুর দ্বারা এমনভাবে আঘাত করা হবে, যার ফলে সে এমন বিকট চিৎকার করে উঠবে যে, দু’ জাতি (মানুষ ও জ্বিন) ছাড়া তার আশপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে। (সহিহ বুখারী ১৩৭৪, ১৩৩৮)

জানা গেল, আল্লাহ তায়ালা চাইলে কবরবাসীকে দুনিয়াবাসীর আওয়াজ শুনাতে পারেন। আচ্ছা, দুনিয়াবাসী কি কবরবাসীর আওয়াজ শুনতে পারে বা কবরবাসী কি জবাব দিতে পারে!! হ্যা পারে, কিন্তু সবাই না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা যাদেরকে ক্ষমতা দেন।

সাঈদ ইবনে আব্দুল আযীয রহঃ বলেন,
‘আইয়ামুল হাররা’য় (এ সময়ে ইয়াজিদ মদীনা শরীফের উপর অত্যাচার চালিয়ে ছিল) মসজিদে নববী ﷺ এ তিন দিন পর্যন্ত আযান ও জামা’আতে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়নি। সে সময় সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব (রহঃ) মসজিদেই আটকা পড়েছিলেন। কিন্তু নামাজের ওয়াক্ত নির্ধারণ করতে পারতেন না, তবে (নামাজের ওয়াক্ত হলে) তিনি নবী ﷺ এঁর রওজা হতে গুণগুণ শব্দ শুনতে পেতেন। (সুবহান আল্লাহ) (সুনান আদ-দারেমী ৯৪)

[আল-মুদাইনী রহঃ বলেন যে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব রহঃ কে নিয়ে আসা হয় মুসলিম বিন উকবার সামনে (মুসলিম ইবনে উকবা, ইয়াজিদের আদেশে মদীনা মুনাওয়ারার আক্রমণকে ‘বৈধতা’ দিয়েছিল তিন দিনের জন্যে)। সে তাঁকে তার কাছে বায়াত গ্রহণ করতে বলে। তিনি এর জবাবে বলেন, “আমি (শুধু) সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ বকর রা. ও সাইয়্যেদুনা হযরত উমর রা. এঁর সীরাতের (আদর্শের) প্রতি বায়াত নিতে পারি।” এমতাবস্থায় ইবনে উকবা তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কেউ একজন (তাঁকে বাঁচাবার জন্যে) বলেন যে এই ব্যক্তি (হযরত সাঈদ) পাগল। এতে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। (ইবনে কাসীর : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮:২৮১)]

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ কোন এক সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর এক সাহাবী একটি কবরের উপর তার তাবু খাটান। তিনি জানতেন না যে, তা একটি কবর। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন যে, কবরে একটি লোক সূরা আল-মূলক পাঠ করছে। সে তা পাঠ করে সমাপ্ত করলো। তারপর তিনি নবী ﷺ এঁর নিকটে এসে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি একটি কবরের উপর তাঁবু খাটাই। আমি জানতাম না যে, তা কবর। হঠাৎ বুঝতে পারি যে, একটি লোক সূরা আল-মুলক পাঠ করছে এবং তা সমাপ্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ এ সূরাটি প্রতিরোধকারী, নাজাত দানকারী। এটা কবরের আযাব হতে তিলাওয়াতকারীকে নাজাত দান করে। (সূনান আত তিরমিজী ২৮৯০)

[সুবহানাল্লাহ!! আল্লাহ'র প্রিয় বান্দাদের কবরজীবন আর সাধারণদের কবরজীবন এক নয়। বিখ্যাত ফকিহ ও হাদিস বিশারদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ উল্লেখ করেন, আউলিয়াদের ইহকালীন জীবনের অবস্থা এবং পরকালীন জীবনের অবস্থার মাঝে কোন পার্থক্য নাই, এজন্য বলা হয় আল্লাহর ওলীগণ (প্রিয় বান্দাগণ, সাধারণদের মতো) মৃত্যুবরণ করেন না বরং (মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে দুনিয়া হতে পর্দা করে) তারা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবর্তন হন মাত্র। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইমাম বায়হাকী রহঃ বলেন, নবীগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হতে পারেন এটা আকল দ্বারাও বৈধ, যেমনিভাবে হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। (মিশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাতের ৩য় খন্ড, ৪১৪-৪১৫ পৃষ্ঠা)]

আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমরা জুমু‘আর দিন আমার ওপর বেশি পরিমাণ করে দরূদ পড়ো। কেননা তা আমার নিকট পৌঁছানো হয়, ফেরেশতাগণ তা পৌঁছে দেন। যে ব্যক্তি আমার ওপর দরূদ পাঠ করে, তার দরূদ আমার কাছে পেশ করা হতে থাকে, যে পর্যন্ত সে এর থেকে অবসর না হয়। জিজ্ঞেস করা হল, (আপনার) ওফাতের পরও কি? তিনি ﷺ বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা নবীদের শরীর ভক্ষণ করা মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। নবীগণ কবরে জীবিত এবং তাদেরকে রিযিক দেয়া হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ ১৬৩৭, আবূ দাউদ ১০৪৭, মিশকাত ১৩৬৬.......)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, নবীগণ তাদের কবরে জীবিত। তারা সেখানে সালাত আদায় করেন। [মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৩৪২৫; হায়াতুল আম্বিয়া লিল বাইহাকী, হাদীস ১-৪, ফাতহুল বারী ৬/৬০৫ (সহিহ)]

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আমার হায়াত তোমাদের জন্য উত্তম বা রহমত। কেননা আমি তোমাদের সাথে কথা বলি তোমরাও আমার সাথে কথা বলতে পারছ। এমনকি আমার ওফাতও তোমাদের জন্য উত্তম বা নেয়ামত। কেননা তোমাদের আমল আমার নিকট পেশ করা হবে এবং আমি তা দেখবো। যদি তোমাদের কোন ভালো আমল দেখি তাহলে আমি আল্লাহর নিকট প্রশংসা করবো, আর তোমাদের মন্দ কাজ দেখলে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবো। (ইমাম বাযযার রহঃ আল-মুসনাদঃ ৫/৩০৮ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ১৯২৫, জালালুদ্দিন সুয়ূতি রহঃ জামিউস সগীরঃ ১/২৮২ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৩৭৭০-৭১, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৫৭ পৃষ্ঠা,...)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যে রাত্রে আমার মি‘রাজ হয়েছিল সে রাত্রে আমি মূসা আলায়হিস সালাম এঁর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি লাল বালুকা স্তুপের নিকট তাঁর রওজায় দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। (সহিহ মুসলিম ৬০৫১)

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলছেন, "আর আমি তো রাসূল এ কারণেই পাঠিয়েছি, যেন আল্লাহর আদেশে তাঁর আনুগত্য করে। তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করার পর যদি আপনার কাছে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও (তাদের জন্য) ক্ষমা চাইতেন, তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল, দয়ালু পেত।” (সূরা নিসাঃ ৬৪)

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহ:) হযরত আবূ সাদেক (রা:) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইমাম আলী (রাঃ) বলেন, “মহানবী ﷺ এঁর ওফাতের তিন দিন পর জনৈক আরব এসে তাঁর রওজা মোবারকের ওপর পড়ে যান এবং তা থেকে মাটি নিয়ে মাথায় মাখতে থাকেন। তিনি আরজ করেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আপনি বলেছিলেন আর আমরাও শুনেছিলাম, আপনি আল্লাহর কাছ থেকে জেনেছিলেন আর আমরাও আপনার কাছ থেকে জেনেছিলাম; আপনার কাছে আল্লাহর প্রেরিত দানগুলোর মধ্যে ছিল তাঁর-ই পাক কালাম – আর যদি কখনো তারা (মুমিনগণ) নিজেদের আত্মার প্রতি জুলুম করে, তখন (হে মাহবুব!) তারা আপনার দরবারে হাজির হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল ﷺও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী, দয়ালু হিসেবে পাবে (আল-কুরআন, ৪:৬৪)। আমি একজন পাপী, আর এক্ষণে আপনার-ই দরবারে আগত, যাতে আপনার সুপারিশ আমি পেতে পারি।’ এই আরজির পরিপ্রেক্ষিতে রওজা মোবারক থেকে জবাব এলো, তোমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। [তাফসীরে কুরতুবী, আল-জামে’ লি আহকাম-ইল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উক্ত আল-কুরআনের ৪:৬৪-এর তাফসীর]

শুধু তাই-ই নয়, তাঁর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম যে, তাঁর দরবারে গিয়ে আরজি জানাতেন, এ প্রসঙ্গে আরো হাদিস বর্ণনা করেন বুখারীর প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার ইবনে হাজর আসকালানী রহঃ সহিহ বুখারীর ১০১০ নং হাদিস (যে হাদিসে হযরত উমার রাঃ নবীজির চাচা হযরত আব্বাস রাঃ এঁর উসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন বলে উল্লেখ আছে) এর ব্যাখ্যায়।

মদিনাবাসীগণ একবার হযরত উমার (রা.) এঁর খেলাফতকালে অনাবৃষ্টির কারনে দূর্ভিক্ষে পতিত হন। হযরত বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) নামক জনৈক সাহাবী নবী করিম ﷺ-এঁর রওজা মােবারকে গিয়ে আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ﷺ! আপনার উম্মতেরা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। আপনি তাঁদের জন্য বৃষ্টির দোয়া করুন। অতঃপর রাত্রে স্বপ্নে এসে নবী করিম ﷺ বেলাল (রা.) কে বললেনঃ তুমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) এঁর নিকট গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে বলো- তাঁরা বৃষ্টি পাবে। স্বপ্ন দেখে বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) হযরত উমার (রা.) কে এ শুভ সংবাদ দিলেন। হযরত উমার (রা.) এ সংবাদ শুনে কেঁদে ফেললেন। মদিনাবাসীগণ রহমতের বৃষ্টি লাভ করলেন।” (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহ হা/৩২৬৬৫/৩২০০২, ইমাম বায়হাক্বীঃ দালায়েলুন নবুয়াত, হা/ ৩০৩০/ ২৯৭৪, ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ১০১০ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)
 
Top