❏ প্রশ্ন-৫২ঃ পবিত্র কুরআনের যে কয়টি আয়াতে শাফা‘আত বা সুপারিশের কথা উল্লেখ রয়েছে। সে আয়াতগুলো কি কি? বর্ণনা কর।


✍ উত্তরঃ 

১- لَا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمٰنِ عَهْدًا . 

‘যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না।’  

68. সূরা মরয়ম, আল কোরআন, আয়াতঃ ৮৭।


২- يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا. 

‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না।’ 

69. আল কোরআন, সূরা ত্বা-হা, আয়াতঃ ১০৯।


-وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ حَتَّى إِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ-৩ قَالُوا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوا الْحَقَّ . 

‘যার জন্যে অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্যে ব্যতীত আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। যখন তাদের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে, তখন তারা পরস্পরে বলবে, তোমাদের পালনকর্তা কি বললেন? তারা বলবে, তিনি সত্য বলেছেন এবং তিনিই সবার উপরে মহান।’ 

70. আল কোরআন, সূরা সাবা, আয়াতঃ ২৩।


قُلْ لِلهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيْعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-৪

‘তাদেরকে বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ 

71. আল কোরআন, সূরা যুমার, আয়াতঃ ৪৪।


يَوْمَ يَقُوْمُ الرُّوْحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُوْنَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ৫   وَقَالَ صَوَابًا . 

‘যেদিন রূহ (জিবরাঈল) ও ফেরেশতাগণ তাঁর সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন, সে ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সত্যকথা বলবে।’ 

72. আল কোরআন, সূরা নাবা, আয়াতঃ ৩৮।


আরবের মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা-সন্তান (নাউযুবিল্লাহ)। কিয়ামত দিবসে তারা সুপারিশ করবে। এখানে তাদের সে-বক্তব্যটি খন্ডন করা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহর অনুমতি বিনে মুখ খোলারও সাহস করবে না কেউ। দ্বিতীয়ত অনুমতি পেলেও সুপারিশ যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। অর্থাৎ- শুধু একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং প্রকৃত সুপারিশের হকদারদের জন্য সুপারিশ করতে পারবে। হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান, কিয়ামত দিবসে আমার সুপারিশ পাওয়ার জন্য সবার্পেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি হলো যে একনিষ্ঠভাবে অন্তর থেকে বলেছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। 

73. সহীহ বুখারী।


হযরত ইমরান বিন হুসাইন (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত অপর এক রেওয়াতে আছে, মুখতারে কুল নবী করীম (ﷺ) এর সুপারিশের সুবাদে একটি দলকে জাহান্নাম থেকে নিস্তার দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তাদেরকে জাহান্নামী বলা হবে। 

74. সহীহ বুখারী শরীফ।


হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকও থাকবে যে একটি বিশাল দলের পক্ষে সুপারিশ করবে। এদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও হবে যে শুধু একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য সুপারিশ করবে, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। 

75. জামে‘ তিরমিযী শরীফ।


হযরত উসমান বিন আফ্ফান (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবে কিবরিয়া নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, কিয়ামত দিবসে তিন প্রকারের মানুষ সুপারিশ করবেঃ 

এক. নবীগণ, 

দুই. আলেমগণ এবং

তিন. শহীদান।  


76. মিশকাত শরীফ।


কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির পক্ষে নবীগণ এবং পূণ্যবান ব্যক্তিদের সুপারিশের কথা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অবশ্য মু’তাজিলা নামক দলটি এর বিরোধিতা করে। তাদের ভাষ্য হলো, সুপারিশে কোন লাভ হবে না। মতানৈক্যের মূল ভিত্তি হলো অপর একটি বিষয়ের ওপর, তা হলো- আমাদের মতে সুপারিশ ব্যতীত ক্ষমা সম্ভব। সুতরাং, সুপারিশ থাকলে তো আরও ভালো।

পক্ষান্তরে মু’তাজিলা দলের মতে কবিরা গোনাহ ক্ষমাযোগ্য নয়। সুতরাং, সুপারিশেও কোন কাজ হবে না। এ-প্রসঙ্গে আমাদের প্রমাণ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি প্রণিধানযোগ্য। 


এরশাদ হচ্ছে, 


وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَا


হে মুহাম্মদ  ! আপনি ক্ষমাপ্রার্থনা করুন নিজের ত্রুটির জন্যে এবং মু’মিন পুরুষ ও নারীদের জন্যে। 

77. আল কোরআন, সূরা মুহাম্মদ, আয়াতঃ ১৯।


এ-থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের পক্ষে নবীজির ক্ষমাপ্রার্থনা লাভজনক ও ফলপ্রসু। 


অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, 

فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ.

‘সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না।’  

78. আল কোরআন, সূরা মুদ্দাসির, আয়াতঃ ৪৮।


এই আয়াতে কাফিরদের দুর্দশা ও দুর্ভাগ্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। বাক্য ভঙ্গি থেকে সাধারণত সুপারিশ যে কাজে আসবে তা প্রমাণিত হচ্ছে। অর্থাৎ- সুপারিশ অনেকের কাজে আসবে। অবশ্যই এ-দ্বারা কাফিরদের কোন লাভ হবে না। যদি তা না হত, তাহলে কাফিরদের সুপারিশ কাজে না আসার বিষয়টির উল্লেখ দ্বারা বিশেষ কোন ফায়দা হতো না। কারণ এখানে তাদের বিশেষ একটি ব্যর্থতার বর্ণনাই উদ্দেশ্য। সবাই যে ব্যর্থতায় শরীক তা বর্ণনা উদ্দেশ্য নয়।


পবিত্র হাদিসে একথাও এসেছে, 


شَفَاعَتِىْ لِاَهْلِ الْكَبَائِرِ مِن اُمَّتِىْ 


নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘আমার উম্মতের কবীরা গোনাহকারীদের জন্যে আমার সুপারিশ আম থাকবে’।


যেহেতু মূল শাফা‘আত ও ক্ষমার কথা কোরআন-হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তা অস্বীকার করা অসম্ভব। এ কারণে মু’তাজিলা দলও মূল ক্ষমার কথা স্বীকার করে। তাদের ভাষ্য হলো ছোট গুনাহের ক্ষমা হবে শুধু। অবশ্য ঐ-সব বড় গোনাহও ক্ষমা করা হবে যার জন্য তাওবা করা হয়েছে। সুপারিশের মাধ্যমে কেবল পূণ্য বৃদ্ধি হতে পারে, গোনাহ ক্ষমা হয় না।

সূফীয়া-ই কিরামের আক্বীদা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীগণ, অলিগণ ও নেককার ব্যক্তিগণকে যে-কোন সময় কোন নির্দিষ্ট দল কিংবা ব্যক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওয়াহাবী-আহলে হাদিসের মত হলো, কিয়ামতের পূর্বে সুপারিশ হতেই পারে না। আর কিয়ামত দিবসেও আল্লাহর অনুমতি বিনে কোন সুপারিশ হবে না।

হাদিস শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) বলেন, 


انا سيد ولد آدم ولافخرو اول من تنشق الارض عنه يوم القيامة ولا فخر وانا اوّل شافع واول مشفع ولا فخر ولواء الحمد بيدى-. 


‘আমি আদম-সন্তানদের সরদার, এটা অহংকার নয়। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমিই ভূ-গর্ভ (কবর) থেকে উঠব, এটা অহংকার নয়। সর্বপ্রথম আমিই সুপারিশ করব এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম গ্রহণ করা হবে, এটা অহংকার নয়। আমার হাতে লিওয়াউল হামদ বা আল্লাহ'র প্রশংসা মুখর পতাকা থাকবে।’

এটাও হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমাকে অর্ধেক উম্মতের গোনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে কিংবা সুপারিশের ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আমি সুপারিশ করার বিষয়টি গ্রহণ করেছি।

কোরআন মজিদে যে ‘মাকামে মাহমুদ’ বা প্রশংসিত স্থানের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, মুফাস্সিরদের সর্বসম্মতিক্রমে তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সুপারিশের স্থান। নবী করীম (ﷺ) নিজ উম্মতের জন্য সুপারিশ করবেন- এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অণু পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে থাকবে, তিনি তাকেও ক্ষমা করিয়ে নিবেন। 

79. ইসলামী মালুমাত কা মাখযান, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ৪২২।


اللهم ارزقنا شفاعَة حبيبكَ المصطفىٰ صَلّى اللهُ عَليهِ وسلَّم بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَفَضْلِكَ وَجُوْدِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ .


আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। হে দয়াময় আল্লাহ! আমাদেরকে আপনি দয়া, অনুগ্রহ ও দানের মাধ্যমে আপনার প্রিয়তম রাসূল (ﷺ)-এর সুপারিশ । 

 
Top