অধ্যায় ৯ :



রওজা মোবারক - কে ঘিরে উসীলা ও ইস্তিগাসা (সাহায্য প্রার্থনার শরয়ী বিধান) :


                   নবীগন ও অলীগনের আল্লাহ প্রদত্ত রুহানী
                       সাহায্য বিশ্বাস করা শিরিক নয় জায়েয :


[ইমাম বায়হাকী]


[হাদীস নং ৩৮৭৯] আবূ এসহাক আল-কারশী (রা:) বর্ণনা করেন, মদীনা মোনাওয়ারায় আমাদের সাথে এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি যখন-ই এমন কোনো খারাপ কাজ সংঘটিত হতে দেখতেন যাকে তিনি বাধা দিতে অক্ষম, তৎক্ষণাৎ তিনি মহানবী (দ:)-এর মোবারক রওযায় যেতেন এবং আরয করতেন, ‘হে মাযারের অধিবাসীবৃন্দ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং শায়খাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) এবং আমাদের সাহায্যকারীমণ্ডলী! আমাদের অবস্থার দিকে কৃপাদৃষ্টি করুন।’ ....

[হাদীস নং ৩৮৮০] আবূ হারব হেলালী (রা:) বর্ণনা করেন যে এক আরবী ব্যক্তি হজ্জ্ব সম্পন্ন করে মসজিদে নববীর দরজায় আসেন। তিনি সেখানে তাঁর উট বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পবিত্র রওযার সামনে চলে আসেন। তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-এর কদম মোবারকের কাছে দাঁড়িয়ে আরয করেন: ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:), আপনার প্রতি সালাম।’ অতঃপর তিনি হযরত আবূ বকর (রা:) ও হযরত উমর (রা:)-এর প্রতিও সালাম-সম্ভাষণ জানান। এরপর তিনি আবার বিশ্বনবী (দ:)-এর দিকে ফিরে আরয করেন: ”এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনার জন্যে আমার পিতা ও মাতা কোরবান হোন। আমি আপনার দরবারে এসেছি, কারণ আমি পাপকর্ম ও ভুলত্রুটিতে নিমজ্জিত, আর এমতাবস্থায় আপনাকে আল্লাহর কাছে যেন অসীলা করতে পারি এবং আপনিও আমার পক্ষে শাফায়াত করতে পারেন। কেননা, আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: ’

বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত। [সুরা নিসা: ৬৪]

[আল-কুরআন, ৪:৬৪]” অতঃপর ওই ব্যক্তি সাহাবী (রা:)-দের এক বড় দলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে থাকেন, ’ওহে সেরা ব্যক্তিবৃন্দ যাঁরা (মাটির) গভীরে শায়িত’; ‘যাঁদের সুগন্ধিতে মাটির অভ্যন্তরভাগ ও বহির্ভাগ মিষ্ট স্বাদ পরিগ্রহ করেছে’; ’আপনি যে মাযারে শায়িত তার জন্যে আমার জান কোরবান’; ‘আর যে মাযার-রওযায় পবিত্রতা, রহমত-বরকত ও অপরিমিত দানশীলতা পাওয়া যায়।’

[‘শুয়াবুল ঈমান, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৬০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৩৮৭৯, ৩৮৮০]



                   রওজা মোবারক ও উসীলা :


★★★ বৃষ্টির জন্য ইস্তিগাসা : ঈমানদারদের মা হযরত আয়েশা  সিদ্দিকা (রা:) হতে প্রমাণ :

ইমাম দারিমী বর্ণনা করেন হযরত আবূল জাওযা’ আউস ইবনে আব্দিল্লাহ (রা:) হতে, ‍যিনি বলেন: মদীনাবাসীগণ একবার দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন। তাঁরা মা আয়েশা (রা:)-এর কাছে এ (শোচনীয় অবস্থার) ব্যাপারে ফরিয়াদ করেন। তিনি তাঁদেরকে মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফে গিয়ে ওর ছাদে একটি ছিদ্র করতে বলেন এবং রওযা পাক ও আকাশের মাঝে কোনো বাধা না রাখতে নির্দেশ দেন। তাঁরা তা-ই করেন। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি নামে। এতে সর্বত্র সবুজ ঘাস জন্মায় এবং উট হৃষ্টপুষ্ট হয়ে মনে হয় যেন চর্বিতে ফেটে পড়বে। এই বছরটিকে ‘প্রাচুর্যের বছর’ বলা হয়। [সুনানে দারিমী, ১ম খণ্ড, ২২৭ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৯৩]

রেফারেন্স:

* শায়খ মোহাম্মদ বিন আলাউইয়ী মালেকী (মক্কা শরীফ) বলেন, “এই রওয়ায়াতের এসনাদ ভাল; বরঞ্চ, আমার মতে, এটি সহীহ (বিশুদ্ধ)। উলেমাবৃন্দ এর নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টি সমর্থন করেছেন এবং প্রায় সমকক্ষ বিশ্বস্ত প্রামাণিক দলিল দ্বারা এর খাঁটি হবার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন।” [শেফা’উল ফু’য়াদ বি-যেয়ারতে খায়রিল এ’বাদ, ১৫৩ পৃষ্ঠা]

* ইবনে আল-জাওযী, আল-ওয়াফা’ বি-আহওয়ালিল্ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) [২:৮০১]

* ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী (রহ:) কৃত ‘শেফাউস্ সেকাম ফী যেয়ারাতে খায়রিল আনাম’ [১২৮ পৃষ্ঠা]

* ইমাম কসতলানী (রহ:) প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ’ [৪:২৭৬]; এবং ইমাম যুরকানী মালেকী (রহ:) ‘শরহে মাওয়াহিব’ [১১:১৫০]

সনদ: “আবূ নুয়াইম এই বর্ণনা শুনেছিলেন সাঈদ ইবনে যায়দ হতে; তিনি আ’মর ইবনে মালেক আল-নুকরী হতে; তিনি হযরত আবূল জাওযা আউস্ বিন আবদিল্লাহ (রা:) হতে, যিনি এটি বর্ণনা করেন।



★★★ রাসুলুল্লাহ (সা) এর নিকট খাদ্যের জন্য প্রার্থনা :



হাফেয ইবনে জাওযী কৃত ‘কিতাব আল-ওয়াফা’

আবূ বকর মিনকারী বলেন: আমি কিছুটুকু পেরেশানি অবস্থায় হাফেয আত্ তাবারানী ও আবূল শায়খের সাথে মসজিদে নববীর ভেতরে অবস্থান করছিলাম। ওই সময় আমরা ভীষণ অভুক্ত ছিলাম। ওই দিন এবং ওর আগের দিন কিছুই আমরা খাইনি। এশা’র নামাযের সময় হলে আমি রাসূলে খোদা (দ:)-এর রওযা পাকের সামনে অগ্রসর হই এবং আরয করি, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমরা ক্ষুধার্ত, আমরা ক্ষুধার্ত (এয়া রাসূলাল্লাহ আল-জু’ আল-জু’)!’ অতঃপর আমি সরে আসি। আবূ শায়খ আমাকে বলেন, ’বসুন। হয় আমাদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা হবে, নয়তো এখানেই মারা যাবো।’ এমতাবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি এবং আবূ আল-শায়খও ঘুমিয়ে পড়েন। আত্ তাবারানী জেগে থেকে কিছু একটি নিয়ে অধ্যয়ন করছিলেন। ওই সময় এক আলাউইয়ী (হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র বংশধর) দরজায় এসে উপস্থিত; তাঁর সাথে ছিল দুইজন বালক, যাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল খাবারভর্তি একখানা তাল-পাতার ঝুড়ি। আমরা উঠে বসে খাবার গ্রহণ আরম্ভ করলাম। আমরা মনে করেছিলাম, বাচ্চা দু’জন অবশিষ্ট খাবার ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু তারা সবই রেখে যায়। আমাদের খাওয়া শেষ হলে ওই আলাউইয়ী বলেন, ‘ওহে মানব সকল, আপনারা কি রাসূলুল্রাহ (দ:)-এর কাছে আরয করেছিলেন? আমি তাঁকে স্বপ্নে দেখি, আর তিনি আমাকে আপনাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসতে বলেন। [হাফেয ইবনে জাওযী, ‘কিতাব আল-ওয়াফা, ৮১৮ পৃষ্ঠা; # ১৫৩৬]

জ্ঞাতব্য: ইবনে জাওযী ছিলেন ’আল-জারহ ওয়াত্ তাদীল’-এর কঠোরপন্থী আলেমদের অন্যতম; আর তিনি এই বইয়ের প্রারম্ভেই উল্লেখ করেন যে তিনি বিশুদ্ধ রওয়ায়াতের সাথে মিথ্যে বিবরণগুলোর সংমিশ্রণ করেননি। (মানে তিনি শুধু বিশুদ্ধ বর্ণনাসম্বলিত ’সীরাহ’-বিষয়ক এ বইটি লিখেছেন; এতে সন্নিবেশিত হাদীসগুলো সহীহ বা হাসান পর্যায়ভুক্ত, যা সনদ কিংবা শওয়াহিদ (সাক্ষ্য)-সূত্রে ওই পর্যায়ে পৌঁছেছে)



★★★ ক্ষমার জন্য রওজা মোবারক উসীলা স্বরুপ :


ইমাম কুরতুবী (রহ:) হযরত আবূ সাদেক (রা:) থেকে বর্ণনা করেন যে ইমাম আলী (ক:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর বেসালের (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হবার) তিন দিন পর জনৈক আরব এসে তাঁর রওযা মোবারকের ওপর পড়ে যান এবং তা থেকে মাটি নিয়ে মাথায় মাখতে থাকেন। তিনি আরয করেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি বলেছিলেন আর আমরাও শুনেছিলাম, আপনি আল্লাহর কাছ থেকে জেনেছিলেন আর আমরাও আপনার কাছ থেকে জেনেছিলাম; আপনার কাছে আল্লাহর প্রেরিত দানগুলোর মধ্যে ছিল তাঁর-ই পাক কালাম - আর যদি কখনো তারা (মো’মেনগণ) নিজেদের আত্মার প্রতি যুলুম করে, তখন হে মাহবুব, তারা আপনার দরবারে হাজির হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল (দ:)-ও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে অত্যন্ত তওবা কবুলকারী, দয়ালু হিসেবে পাবে (আল-কুরআন, ৪:৬৪)। আমি একজন পাপী, আর এক্ষণে আপনার-ই দরবারে আগত, যাতে আপনার সুপারিশ আমি পেতে পারি।’ এই আরযির পরিপ্রেক্ষিতে রওযা মোবারক থেকে জবাব এলো, ‘কোনো সন্দেহ-ই নেই তুমি ক্ষমাপ্রাপ্ত!’

[তাফসীরে কুরতুবী, আল-জামে’ লি আহকাম-ইল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উক্ত আল-কুরআনের ৪:৬৪-এর তাফসীর]


                            NOTE :



হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, কেউ আমাকে সালাম জানালে আল্লাহ আমার রূহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন এবং আমি তার সালামের প্রত্যুত্তর দেই। [আবূ দাউদ শরীফ, ৪র্থ বই, হাদীস নং ২০৩৬]

ইমাম নববী (রহ:) এ হাদীস সম্পর্কে বলেন, “আবূ দাউদ (রহ:) এটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।” [রিয়াযুস্ সালেহীন, ১:২৫৫, হাদীস # ১৪০২]

গায়রে মুকাল্লিদীন তথা লা-মযহাবী (আহলে হাদীস/’সালাফী’) গোষ্ঠীর নেতা কাজী শওকানী এই হাদীস বর্ণনার আগে বলে, “এটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) সহীহ এবং মারফু’ সনদে হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) থেকে বর্ণনা করেন।” [নায়ল আল-আওতার, ৫:১৬৪]




                         অধ্যায় ১০ :



নবীগনের অলীগনের মাযার ও ইস্তিগাসা সম্পর্কিত ফতোয়া :


★★★ মাযারকে ঘিরে উসীলা ও ইস্তিগাসার বিধান সম্পর্কে ইমামগনের ভাষ্য :


হুজ্জাতুল ইসলাম (৩ লক্ষ হাদিসের হাফেজ) ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর ভাষ্য :


ইমাম গাযযালী (রহ:) বলেন :
★★ “কারো যখন কোনো অসুবিধা (তথা পেরেশানি) হয়, তখন তার উচিত মাযারস্থ আউলিয়াবৃন্দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা; এঁরা হলেন সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁরা দুনিয়া থেকে বেসাল হয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-ই নেই, যে ব্যক্তি তাঁদের মাযার যেয়ারত করেন, তিনি তাঁদের কাছ থেকে রূহানী মদদ (আধ্যাত্মিক সাহায্য) লাভ করেন এবং বরকত তথা আশীর্বাদও প্রাপ্ত হন; আর বহুবার আল্লাহর দরবারে তাঁদের অসীলা পেশ হবার দরুন মসিবত বা অসুবিধা দূর হয়েছে।” [তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ৩০তম খণ্ড, ২৪ পৃষ্ঠা]

জ্ঞাতব্য: ‘এসতেগাসাহ’ তথা আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আহলুস্ সুন্নাহ’র ওয়েবসাইটের ‘ফেকাহ’ বিভাগে ‘আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-এর রূহানী মদদ’ শীর্ষক লেখাটি দেখুন।



শায়খুল ইসলাম হাফেয ইমাম নববী (রহ:) এর ভাষ্য :



ইমাম সাহেব নিজ ’কিতাবুল আযকার’ পুস্তকের ‘মহানবী (দ:)-এর মোবারক রওযা যেয়ারত ও সেখানে পালিত যিকর’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখেন: “এ কথা জ্ঞাত হওয়া উচিত, ’যে কেউ’ হজ্জ্ব পালন করলে তাকে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা মোবারক যেয়ারত করতে হবে, ’তা তার  গন্তব্য পথের ওপর হোক বা না-ই হোক’; কারণ যেয়ারতে রাসূল (দ:) হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবাদতগুলোর অন্যতম, সবচেয়ে পুরস্কৃত আমল, এবং সবচেয়ে ইপ্সিত লক্ষ্য। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে কেউ বের হলে পথে বেশি বেশি সালাত ও সালাম পড়া উচিত। আর মদীনা মোনাওয়ারার গাছ, পবিত্র স্থান ও সীমানার চিহ্ন দৃশ্যমান হওয়ামাত্র-ই সালাত-সালাম আরও বেশি বেশি পড়তে হবে তার; অধিকন্তু এই ‘যেয়ারত’ দ্বারা যাতে নিজের উপকার হয়, সে জন্যে আল্লাহর দরবারে তার ফরিয়াদ করাও উচিত; আল্লাহ যেন তাকে এই যেয়ারতের মাধ্যমে ইহ-জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ দান করেন, এই কামনা তাকে করতে হবে। তার বলা উচিত, ‘এয়া আল্লাহ! আপনার করুণার দ্বার আমার জন্যে অবারিত করুন, এবং রওযায়ে আকদস যেয়ারতের মাধ্যমে সেই আশীর্বাদ আমায় মঞ্জুর করুন, যেটি আপনি মঞ্জুর করেছেন আপনার-ই বন্ধুদের প্রতি, যাঁরা আপনাকে মানেন।
★★ যাঁদের কাছে চাওয়া হয় তাঁদের মধ্যে ওহে সেরা সত্তা, আমায় ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন।” [ইমাম নববী রচিত ‘কিতাবুল আযকার’, ১৭৮ পৃষ্ঠা]


ইমাম ইবনুল হজ্জ (রহ) : [century 1250-1336] ওনার ভাষ্য :


ইমাম ইবনুল হাজ্জ্ব (রহ:) বলেন: সালেহীন তথা পুণ্যবানদের মাযার-রওযা হতে বরকত আদায় (আশীর্বাদ লাভ) করার লক্ষ্যে যেয়ারত করতে বলা হয়েছে। কেননা, বুযূর্গদের হায়াতে জিন্দেগীর সময় যে বরকত আদায় করা যেতো, তা তাঁদের বেসালের পরও লাভ করা যায়। উলেমাবৃন্দ ও মোহাক্কিক্কীন (খোদার নৈকট্যপ্রাপ্তজন) এই রীতি অনুসরণ করতেন যে তাঁরা আউলিয়াবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারত করে তাঁদের শাফায়াত (সুপারিশ) কামনা করতেন......কারো কোনো হাজত বা প্রয়োজন থাকলে তার উচিত আউলিয়া কেরামের মাযার-রওযা যেয়ারত করে তাঁদেরকে অসীলা করা। আর এ কাজে (বাধা দিতে) এই যুক্তি দেখানো উচিত নয় যে মহানবী (দ:) তিনটি মসজিদ (মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা) ছাড়া অন্য কোথাও সফর করতে নিষেধ করেছিলেন। মহান ইমাম আবূ হামীদ আল-গাযযালী (রহ:) নিজ ‘এহইয়া’ পুস্তকের ’আদাব আস্ সফর’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেন যে হজ্জ্ব ও জেহাদের মতো এবাদতগুলোর ক্ষেত্রে সফর করা বাধ্যতামূলক। অতঃপর তিনি বলেন, ‘এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আম্বিয়া (আ:), সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাবেঈন (রহ:) ও সকল আউলিয়া ও হক্কানী উলেমাবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর।
★★ যাঁর কাছে তাঁর যাহেরী জীবদ্দশায় সাহায্য চাওয়া জায়েয ছিল, তাঁর কাছে তাঁর বেসালের পরও (যেয়ারত করে) সাহায্য চাওয়া জায়েয’। [ইমাম ইবনুল হাজ্জ্ব প্রণীত আল-মাদখাল, ১ম খণ্ড, ২১৬ পৃষ্ঠা]


ইমাম আবূ আবদিল্লাহ ইবনিল হাজ্জ্ব আল-মালেকী (রহ:) আউলিয়া ও সালেহীনবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারত সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রচনা করেন। তাতে তিনি লেখেন: মুতা’লিম (শিক্ষার্থী)-দের উচিত আউলিয়া ও সালেহীনবৃন্দের সান্নিধ্যে যাওয়া; কেননা তাঁদের দেখা পাওয়াতে অন্তর জীবন লাভ করে, যেমনিভাবে বৃষ্টি দ্বারা মাটি উর্বর হয়। তাঁদের সন্দর্শন দ্বারা পাষাণ হৃদয়ও নরম বা বিগলিত হয়। কারণ তাঁরা আল্লাহ পাকেরই বরগাহে সর্বদা উপস্থিত থাকেন, যে মহাপ্রভু পরম করুণাময়। তিনি কখনােই তাঁদের এবাদত-বন্দেগী বা নিয়্যতকে প্রত্যাখ্যান করেন না, কিংবা যারা তাঁদের মাহফিলে হাজির হন ও তাঁদেরকে চিনতে পারেন এবং তাঁদেরকে ভালোবোসেন, তাদেরকেও প্রত্যাখ্যান করেন না। এটি এ কারণে যে তাঁরা হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর পরে রহমতস্বরূপ, যে রহমত আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্যে অবারিত। অতএব, কেউ যদি এই গুণে গুণান্বিত হন, তাহলে সর্বসাধারণের উচিত ত্বরিত তাঁর কাছ থেকে বরকত আদায় করা। কেননা, যারা এই আল্লাহ-ওয়ালাদের দেখা পান, তারা এমন রহমত-বরকত, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও স্মৃতিশক্তি লাভ করেন যা ব্যাখ্যার অতীত। আপনারা দেখবেন ওই একই মা’আনী দ্বারা যে কেউ অনেক মানুষকে জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও জযবা (ঐশী ভাব)-এর ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করতে দেখতে পাবেন। যে ব্যক্তি এই রহমত-বরকতকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করেন, তিনি কখনোই তা থেকে দূরে থাকেন না (মানে বঞ্চিত হন না)। তবে শর্ত হলো এই যে, যাঁর সান্নিধ্য তলব করা হবে, তাঁকে অবশ্যই সুন্নাতের পায়রুবী করতে হবে এবং সুন্নাহ’কে হেফাযত তথা সমুন্নত রাখতে হবে; আর তা নিজের কর্মেও প্রতিফলিত করতে হবে। [ইবনুল হাজ্জ্ব রচিত আল-মাদখাল, ২য় খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা]


Mullah Ali Qari (Rehmatullah Alaih) writes:


“Anyone who builds a mosque near the grave of an upright person or prays in the tomb, or intends to ask for help through the Ruh (soul) of that upright person or intends to seek barakah (blessing) from his leftovers, if he does all that without the intention of giving him Tazeem or doing tawajuh towards him (in prayer) then there is nothing wrong in that. Don't you see that the Grave of Hazrat Ismail (A.S) is inside the Masjid ul Haram near the Hateem, and to pray there is superior than anything else. However to pray near the graves is only forbidden when the soil becomes dirty because of Najasat of deceased. In the Hateem near Hajr al Aswad and Mizaab there are the graves of 70 Prophets.”
[Mirqat, Sharh al Mishqaat, Volume No. 2, Page No. 202]


The belief of Shah Abdul Azeez Dehlawi (d. 1239 H) :


Shah Abdul Azeez writes: "It is in Sharh Maqasid that visiting graves is beneficial and the souls of the pious cause benefit. Indeed, after death the soul has a connection with the body and the grave. Hence, when someone comes to visit this shrine and turns towards the soul of the inmate, then the two souls (of the visitor and the inmate) form a connection. It is a point of contention whether the help of the living is stronger or that of the deceased. Some scholars have said that the deceased can help more and some have proved this from a narration from the dear Prophet (sallallahu 'alaihi wasallam) that when you need help in a matter, seek it from the people of the grave. The great Shaykh, Shah Abdul Haq Dehlwi (rahmatullah `alaih) has stated in Sharh Mishkat that there is nothing in the Qur'an and Sunnah nor the sayings of the Salaf which contradicts this position and forms a proof against it.
(Fatawa Aziziya, vol.2 p.108)




                         অধ্যায় ১১ :



নবীগন তাদের সম্মানিত রওজার ভিতর নামাজ পড়েন :


★★★ হাদিস থেকে :

হযরত আবূ হোরায়রা (রা:)-এর সূত্রে বর্ণিত; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “আমি নিজেকে ’হিজর’-এর মধ্যে পেলাম এবং কোরাইশ গোত্র আমাকে মে’রাজের রাতের ভ্রমণ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল। আমাকে বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়, যা আমার স্মৃতিতে রক্ষিত ছিল না। এতে আমি পেরেশানগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম; এমন পর্যায়ের পেরেশানির মুখোমুখি ইতিপূর্বে কখনো-ই হই নি। অতঃপর আল্লাহ পাক এটিকে (বায়তুল মাকদিসকে) আমার চোখের সামনে মেলে ধরেন। আমি তখন এর দিকে তাকিয়ে তারা (কুরাইশবর্গ) যা যা প্রশ্ন করছিল সবগুলোরই উত্তর দেই। আমি ওই সময় আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের জমায়েতে নিজেকে দেখতে পাই। আমি হযরত মূসা (আ:)-কে নামায পড়তে দেখি। তিনি দেখতে সুদর্শন (সুঠাম দেহের অধিকারী) ছিলেন, যেন শানু’য়া গোত্রের কোনো পুরুষ। আমি মরিয়ম তনয় ঈসা মসীহ (আ:)-কে দেখি নামায আদায় করতে; সকল মানবের মাঝে তাঁর (চেহারার) সবচেয়ে বেশি সাযুজ্য হলো উরওয়া ইবনে মাস’উদ আস্ সাকাফী (রা:)-এর সাথে। আমি হযরত ইবরাহীম (আ:)-কেও সালাত আদায় করতে দেখি; মানুষের মাঝে তাঁর (চেহারার) সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য হলো তোমাদের সাথী (মহানবী স্বয়ং)-এর সাথে। নামাযের সময় হলে পরে আমি তাতে ইমামতি করি। নামাযশেষে কেউ একজন বল্লেন, ‘এই হলেন মালেক (ফেরেশতা), জাহান্নামের রক্ষণাবেক্ষণকারী; তাঁকে সালাম জানান।’ আমি তাঁর দিকে ফিরতেই তিনি আমার আগে (আমাকে) সালাম জানান।”

[সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, হাদীস নং ৩২৮; ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:)-ও এটিকে নিজ ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৮৩ পৃষ্ঠায় সমর্থন দিয়েছেন]


★★★ মুহাদ্দিসগন থেকে :


ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) :

আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযায় তাঁদের রূহানী হায়াত সম্পর্কে হযরত ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা মোবারকে তাঁর রূহানী জীবন এবং অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের নিজ নিজ মাযার-রওযায় অনুরূপ জীবন সম্পর্কে যে জ্ঞান আমরা লাভ করেছি তা ‘চূড়ান্ত জ্ঞান’ (এলমান কাতে’য়্যান)। এগুলোর প্রমাণ হচ্ছে ‘তাওয়াতুর’ (সর্বত্র জনশ্রুতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত)। ইমাম বায়হাকী (রহ:) আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মাযার-রওযায় তাঁদের পরকালীন জীবন সম্পর্কে একটি ’জুয’ (আলাদা অংশ/অধ্যায়) লিখেছেন। তাতে প্রদত্ত প্রমাণাদির মধ্যে রয়েছে যেমন,

১/ - সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) বর্ণিত একটি হাদীসে হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, ’মে’রাজ রাতে আমি হযরত মূসা (আ:)-এর (রওযার) পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং ওই সময় তাঁকে দেখতে পাই তিনি তাঁর মাযারে সালাত আদায় করছিলেন’;

২/ - আবূ নুয়াইম নিজ ‘হিলইয়া’ পুস্তকে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে একটি বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, যা’তে ওই সাহাবী রাসূলে খোদা (দ:)-কে বলতে শোনেন, ’আমি হযরত মূসা (আ:)-এর (রওযার) পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁকে নামাযে দণ্ডায়মান দেখতে পাই’;

৩/ - আবূ ইয়ালার ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে ও ইমাম বায়হাকী (রহ:)-এর ‘হায়াত আল-আম্বিয়া’ পুস্তকে হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত আছে যে নবী করীম (দ:) এরশাদ ফরমান: ’আম্বিয়া (আ:) তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিত আছেন এবং তাঁরা (সেখানে) সালাত আদায় করেন’।”

[ইমাম সৈয়ুতী কৃত ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাউইয়ী’, ২য় খণ্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠা]



ইমাম হায়তামী (রহ:) ওপরে বর্ণিত সর্বশেষ হাদীস সম্পর্কে বলেন, “আবূ ইয়ালা ও বাযযার এটি বর্ণনা করেছেন এবং আবূ ইয়ালার এসনাদে সকল বর্ণনাকারী-ই আস্থাভাজন।”

[ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:)-ও এই রওয়ায়াতকে সমর্থন দিয়েছেন নিজ ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৮৩ পৃষ্ঠায়।] [কাদিমী কুতুবখানা সংস্করণের ৬০২-৬০৩ পৃষ্ঠায়]



                         অধ্যায় ১২ :



নবীগনের রওজায় সমস্ত নবীগনই জীবিত আছেন :

হযরত আবূ দারদা (রা:) হতে বর্ণিত; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

“আল্লাহ পাক আম্বিয়া (আ:)-এর মোবারক শরীরকে মাটির জন্যে হারাম করে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিতাস্থায় আছেন এবং সেখানে তাঁরা রিযক-ও পেয়ে থাকেন।”

রেফারেন্স

* হযরত আবূদ্ দারদা (রা:) বর্ণিত ও তিরমিযী শরীফে লিপিবদ্ধ;  হাদীস নং ১৩৬৬

* সুনানে ইবনে মাজাহ, ১ম খণ্ড, হাদীস নং ১৬২৬

* আবূ দাউদ শরীফ, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ১৫২৬



                         অধ্যায় ১৩ :



ওফাতের পর বিভিন্ন ঘটনা সমুহ :



★★★ রওজা মোবারক এর ভিতর থেক আযান ও ইকামাতের শব্দ :


হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রা:) বলেন, “মসজিদে নববী শরীফে যেদিন (অর্থাৎ, ’হাররা’র ঘটনার দিন; ৬১ হিজরীর ওই দিনে এয়াজীদী বাহিনী মদীনাবাসীর ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছিল) আযান দেয়া যায়নি এবং নামায পড়া যায়নি, সেদিন ’আল-হুজরাত আন্ নববীয়্যা’ (রওযা শরীফ) হতে আযান ও একামত পাঠ করতে শোনা গিয়েছিল।”

রেফারেন্স

ইবনে তাইমিয়া (মৃত্যু: ৭২৮ হিজরী/১৩২৮ খৃষ্টাব্দ)-ও নিজ ‘একতেদা’ আস্ সিরাতিল্ মুসতাকিম’ পুস্তকে এ ঘটনা বর্ণনা করেছে।


★★★ রওজা মোবারক থেকে সালামের জবাব :


ইবরাহিম ইবনে শায়বান বলেন: আমি কোনো এক বছর হজ্জ্বে গেলে মদীনা মোনাওয়ারায় মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফেও যেয়ারত উদ্দেশ্যে যাই। তাঁকে সালাম জানানোর পরে ’হুজরাহ আস্ সাআদা’র ভেতর থেকে জবাব শুনতে পাই: ‘ওয়া আলাইকুম আস্ সালাম’।

রেফারেন্স :

* মোহাম্মদ ইবনে হিব্বান (রহ:)-এর সূত্রে আবূ নু’য়াইম তাঁর কৃত ‘আত্ তারগিব’ (# ১০২) পুস্তকে;
* ইবনে আন্ নাজ্জার নিজ ‘আখবার আল-মদীনা’ গ্রন্থে (১৪৬ পৃষ্ঠা)।
* ইবনে জাওযী স্বরচিত ‘মুতির আল-গারাম’ বইয়ে (৪৮৬-৪৯৮ পৃষ্ঠা) এটি উদ্ধৃত করেন;
* আল-ফায়রোযাবাদী এ রওয়ায়াত তার ‘আল-সিলাত ওয়াল্ বুশর’ পুস্তকে (৫৪ পৃষ্ঠা) এবং
* ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘এয়াতেদা’ আল-সীরাত আল-মুস্তাকীম’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৭৩-৩৭৪) এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে।



★★★ মাযারস্থ অলীগনের কারামত ও ঘটনাসমুহ :


ইবনে কাসীর লিখেছে, “ইবনে আসাকির হযরত আমর ইবনে জামাহ (রহ:)-এর জীবনীগ্রন্থে বর্ণনা করেন: ‘এক তরুণ বয়সী ব্যক্তি নামায পড়তে নিয়মিত মসজিদে আসতেন। একদিন এক নারী তাঁকে অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ গৃহে আমন্ত্রণ করে। তিনি যখন ওই নারীর ঘরে ছিলেন, তখন তিনি উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করেন কুরআনের আয়াত - নিশ্চয় ওই সব মানুষ যারা তাকওয়ার অধিকারী হন, যখন-ই তাদেরকে কোনো শয়তানী খেয়ালের ছোঁয়া স্পর্শ করে, তখন তারা সাবধান হয়ে যান; তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায় (৭:২০১)। অতঃপর তিনি মূর্ছা যান এবং আল্লাহর ভয়ে ইন্তেকাল করেন। মানুষেরা তাঁর জানাযার নামায পড়েন এবং তাঁকে দাফনও করেন। হযরত উমর (রা:) এমতাবস্থায় একদিন জিজ্ঞেস করেন, নিয়মিত মসজিদে নামায পড়ার জন্যে আগমনকারী ওই তরুণ কোথায়? মানুষেরা জবাব দেন, তিনি ইন্তেকাল করেছেন এবং আমরা তাঁকে দাফন করেছি। এ কথা শুনে হযরত উমর (রা:) ওই তরুণের কবরে যান এবং তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়ে নিম্নের কুরআনের আয়াতটি তেলাওয়াত করেন - এবং যে ব্যক্তি আপন রবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেন, তার জন্যে রয়েছে দুটি জান্নাত (৫৫:৪৬)। ওই তরুণ নিজ কবর থেকে জবাব দেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে দুটি জান্নাত দান করেছেন’।” [তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৪৯৬ পৃষ্ঠা, আল-কুরআন ৭:২০১-এর ব্যাখ্যায়]



ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা নিজ ‘কিতাবুর রূহ’ পুস্তকে ইবনে আবিদ্ দুনইয়া (রহ:)-এর সূত্রে সাদাকাহ ইবনে সুলাইমান (রা:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বর্ণনা করেন: একবার তিনি (সাদাকাহ) একটি কুৎসিত চারিত্রিক দোষে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার ইন্তেকালের পরে তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত হন। অতঃপর তিনি তাঁর পিতাকে স্বপ্নে দেখেন। তাঁর পিতা বলেন, প্রিয় পুত্র, আমি তোমার নেক আমলের কারণে কবরে শান্তিতে ছিলাম। তোমার নেক আমল আমাদেরকে দেখানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি তুমি যা করেছ, তা আমাকে আমার ইন্তেকালপ্রাপ্ত সঙ্গিদের কাছে অত্যন্ত শরমিন্দা (লজ্জিত) করেছে। আমাকে আর তুমি আমার ইন্তেকালপ্রাপ্ত সঙ্গিদের সামনে লজ্জিত করো না। [কিতাবুর রূহ, বাংলা সংস্করণ, ১১ পৃষ্ঠা, ১৯৯৮]



The belief of Shah Waliullah Dehlawi (radiyallahu ta'ala anhu)
(d. 1176 H)
Shah Waliullah writes that his father, Shah Abdur Raheem, said that he once went to the shrine of Hadrat Khwaja Qutbuddin Bakhtyar Kaaki (rahmatullah `alaih). The soul of Bakhtyar Kaaki became apparent and told me that I shall have a son and that I should name him Qutbuddin Ahmad. At this time, my wife had become elderly and was beyond child bearing age. On hearing this, I thought to myself that maybe I shall have a grandson. The soul of Bakhtyar Kaaki got to know of my thinking and removed my doubt and said that it did not give me tidings of a grandson, rather, this child will be my very own. Some time later, I married again and from this marriage was born (Shah) Waliullah. At the time of my birth, my father had forgotten about this event and named me Waliullah. When he came to recall this event, he gave a second name of Qutbuddin Ahmad. (Anfaas al-`Arifeen, p.110)




                         অধ্যায় ১৪ :



মাযারে শায়িত অলিগন কি মানুষ তাকে নিয়ে প্রার্থনা করে , দোয়া-দুরুদ পড়ে, তেলাওয়াত করে, ডাকে এগুলো কি শুনতে পায়?


এই জবাবটা ওহাবী-আহলে হাদিস দের বিখ্যাত ইমামদের থেকে দেখুন :-


ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানবৃন্দ তাঁদের যেয়ারতকারীদেরকে চিনতে পারেন কি-না। সে জবাবে বলে: “যেয়ারতকারীদেরকে যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানবৃন্দ চিনতে পারেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-ই নেই।” তার কথার সমর্থনে সে নিম্নের হাদীসটি পেশ করে, “ইন্তেকালপ্রাপ্তদের সচেতনতার পক্ষে প্রামাণিক দলিল হচ্ছে বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত একখানা হাদীস, যা’তে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ করেন যে কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানকে দাফনের পরে ঘরে প্রত্যাবর্তনকারী মানুষের পায়ের জুতোর শব্দ ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি শুনতে পান।” [ইবনে তাইমিয়ার ‘মজমুয়া’ আল-ফাতাওয়া’, ২৪তম খণ্ড, ৩৬২ পৃষ্ঠা]


[ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা]

(ইবনে কাইয়্যেম ‘সালাফী’দের গুরু। সে তার শিক্ষক ইবনে তাইমিয়্যার ধ্যান-ধারণার গোঁড়া সমর্থক, যার দরুন সে তার ইমামের সেরা শিষ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে)

ইবনে কাইয়্যেম লেখে:

“প্রথম অধ্যায় - ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ তাঁদের কবর যেয়ারতকারীদেরকে চিনতে পারেন কি-না এবং তাঁদের সালামের উত্তর দিতে পারেন কি-না?    

”হযরত ইবনু আবদিল বার (রহ:) থেকে বর্ণিত: নবী করীম (দ:) এরশাদ ফরমান, কোনো মুসলমান যখন তাঁর কোনো পূর্ব-পরিচিত ভাইয়ের কবরের পাশে যান এবং তাঁকে সালাম জানান, তখন আল্লাহতা’লা ওই সালামের জবাব দেয়ার জন্যে মরহুমের রূহকে কবরে ফিরিয়ে দেন এবং তিনি সে সালামের জবাব দেন। এর দ্বারা বোঝা গেল যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেয়ারতকারীকে চিনতে পারেন এবং তাঁর সালামের জবাবও দিয়ে থাকেন।

”বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে, মহানবী (দ:) বদর যুদ্ধে নিহত কাফেরদের লাশ একটি কূপে নিক্ষেপ করার আদেশ দেন। এরপর তিনি সেই কূপের কাছে গিয়ে দাঁড়ান এবং এক এক করে তাদের নাম ধরে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে অমুকের পুত্র তমুক, হে অমুকের পুত্র তমুক, তোমরা কি তোমাদের রবের (প্রভুর) প্রতিশ্রুতি সঠিকভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের ওয়াদা ঠিকই পেয়েছি।’ তা শুনে হযরত উমর ফারূক (রা:) বল্লেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (দ:), আপনি কি এমন লোকদেরকে সম্বোধন করছেন যারা লাশে পরিণত হয়েছে?’ হুযূর পাক (দ:) বল্লেন, ‘যিনি আমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ, আমার কথাগুলো তারা তোমাদের চেয়েও অধিকতর স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছে; কিন্তু তারা এর উত্তর দিতে অক্ষম।’ প্রিয়নবী (দ:) থেকে আরও বর্ণিত আছে, কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দাফন করার পর লোকেরা যখন ফিরে আসতে থাকে, তখন সেই ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদের জুতোর শব্দ পর্যন্ত শুনতে পান। (আল-ফাতহুল কবীর, ১ম খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা)


”এছাড়া রাসূলে মকবূল (দ:) তাঁর উম্মতদেরকে এ শিক্ষাও দিয়েছেন, যখন তাঁরা কবরবাসীকে সালাম দেবেন, তখন যেন সামনে উপস্থিত মানুষদেরকে যেভাবে সালাম দেন, ঠিক সেভাবে সালাম দেবেন। তাঁরা যেন বলেন, ‘আস্ সালামু আলাইকুম দারা কাওমিম্ মু’মিনীন।’ অর্থাৎ, ‘হে কবরবাসী মু’মিনবৃন্দ, আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ এ ধরনের সম্বোধন তাদেরকেই করা হয় যারা শুনতে পান এবং বুঝতেও পারেন। নতুবা কবরবাসীকে এভাবে সম্বোধন করা হবে জড় পদার্থকে সম্বোধন করার-ই শামিল। [ইবনে কাইয়্যেম কৃত ’কিতাবুর রূহ’ - রূহের রহস্য, ৭-৮ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দ, অনুবাদক - মওলানা লোকমান আহমদ আমীমী]

ইবনে কাইয়্যেম আরও লেখে:

”হযরত ফযল (রা:) ছিলেন হযরত ইবনে উবায়না (রা:)-এর মামাতো ভাই। তিনি বর্ণনা করেন, যখন আমার পিতার ইন্তেকাল হলো, তখন আমি তাঁর সম্পর্কে খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি প্রত্যহ তাঁর কবর যেয়ারত করতাম। ঘটনাক্রমে আমি কিছুদিন তাঁর কবর যেয়ারত করতে যেতে পারিনি। পরে একদিন আমি তাঁর কবরের কাছে এসে বসলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে আমি দেখলাম, আমার পিতার কবরটি যেন হঠাৎ ফেটে গেলো। তিনি কবরের মধ্যে কাফনে আবৃত অবস্থায় বসে আছেন। তাঁকে দেখতে মৃতদের মতোই মনে হচ্ছিলো। এ দৃশ্য দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয় বৎস, তুমি এতোদিন পরে এলে কেন? আমি বল্লাম, বাবা, আমার আসার খবর কি আপনি জানতে পারেন? তিনি বল্লেন, তুমি যখন-ই এখানে আসো, তোমার খবর আমি পেয়ে যাই। তোমার যেয়ারত ও দোয়ার বরকতে আমি শুধু উপকৃত হই না, আমার আশপাশে যাঁরা সমাহিত, তাঁরাও উল্লসিত, আনন্দিত এবং উপকৃত হন। এ স্বপ্ন দেখার পর আমি সব সময় আমার পিতার কবর যেয়ারত করতে থাকি।” [ প্রাগুক্ত, ৯-১০ পৃষ্ঠা]


ইবনে কাইয়্যেম আরও লেখে:

”অতীতকাল থেকে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে কবরে তালকীন করার নিয়ম চলে আসছে। অর্থাৎ,কলেমা-এ-তাইয়্যেবাহ তাঁদেরকে পড়ে শোনানো হয়ে থাকে। ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ যে ইন্তেকালের পরে শুনতে পান, তালকীনের মাধ্যমেও তা প্রমাণিত হয়। এছাড়া তালকীনের দ্বারা ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ উপকৃত হন; তা না হলে তালকীন করার কোনো অর্থ-ই হয় না।

”উক্ত (তালকীনের) বিষয়ে ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ:)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে তালকীন করা একটি নেক কাজ; মানুষের আ’মল থেকে তা প্রমাণিত হয়। তালকীন সম্পর্কে মু’জাম তাবরানী গ্রন্থের মধ্যে হযরত আবূ উমামা (রা:) থেকে বর্ণিত একটি দুর্বল হাদীসও রয়েছে। হাদীসটি হলো, নূরনবী (দ:) এরশাদ ফরমান: ‘কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কবরে মাটি দেয়ার পর তোমাদের একজন তাঁর শিয়রের দিকে দাঁড়িয়ে তাঁর নাম ও তাঁর মায়ের নাম ধরে ডাক দেবে। কেননা, ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি তা শুনতে পান, কিন্তু উত্তর দিতে পারেন না। দ্বিতীয়বার তাঁর নাম ধরে ডাক দিলে তিনি উঠে বসেন। আর তৃতীয়বার ডাক দিলে তিনি উত্তর দেন, কিন্তু তোমরা তা শুনতে পাও না। তোমরা তালকীনের মাধ্যমে বলবে, আল্লাহ পাক আপনার প্রতি রহম করুন, আমাদের তালকীনের দ্বারা আপনি উপকৃত হোন। তারপর বলবে, আপনি তাওহীদ ও রেসালাতের যে স্বীকৃতি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তা স্মরণ করুন। অর্থাৎ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বাক্যটি পাঠ করুন ও তা স্মরণ রাখুন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন, দ্বীনে ইসলাম, হযরত মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুয়্যত এবং কুরআন মজীদ যে আমাদের পথপ্রদর্শনকারী, এ সব বিষয়ে যে আপনি রাজি ছিলেন, তাও স্মরণ করুন।’ এই তালকীন শুনে মুনকার-নকীর ফেরেশতা দু’জন সেখান থেকে সরে যান এবং বলেন, চলো, আমরা ফিরে যাই; এর কাছে থাকার আমাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এ ব্যক্তিকে তাঁর ঈমান ও আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে সব কিছুই স্মরণ কয়ে দেয়া হয়েছে। আর তাই তিনি তালকীনের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন।” [প্রাগুক্ত, ২০ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ]



                            অধ্যায় ১৫ :


নবীগন ও অলীগনের রুহানী অবস্তা :


[ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:)]

ইমাম ইবনে আল-মোবারক নিজ ‘আয্ যুহদ’ পুস্তকে, হাকীম তিরমিযী তাঁর ‘নওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে, ইবনে আবিদ্ দুনইয়া ও ইবনে মুনদাহ বর্ণনা করেন সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রহ:) থেকে; তিনি হযরত সালমান ফারিসী (রা:) হতে, যিনি বলেন: ”মো’মেনীনবৃন্দের রূহ (আত্মা)-সমূহ এ পৃথিবীর ’বরযখে’ অবস্থান করেন এবং তাঁরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন; পক্ষান্তরে ’কুফফার’দের আত্মাগুলো ’সিজ্জিনে’ অবস্থিত....।”

হাকীম তিরমিযী আরও অনুরূপ রওয়ায়াতসমূহ হযরত সালমান ফারিসী (রা:) থেকে বর্ণনা করেন।

ইবনে আবিদ্ দুনইয়া হযরত মালেক ইবনে আনাস (ইমাম মালেক) থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: “এই রওয়ায়াত আমার কাছে এসেছে এভাবে যে মো’মেনীনবৃন্দের আত্মাসমূহ মুক্ত এবং তাঁরা যেখানে চান যেতে পারেন।” [ইমাম সৈয়ুতী রচিত ‘শরহে সুদূর’, ১৬৭ পৃষ্ঠা]

অধিকন্তু, ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা-ও নিজ ‘কিতাবুর রূহ’ বইয়ে এ বিষয়টি সপ্রমাণ করেছে [২৪৪ পৃষ্ঠা, দার-এ-ইবনে-কাসীর, দামেশ্ক, সিরিয়া হতে প্রকাশিত]









 
Top