শহীদ নূরুল ইসলাম ফারুকী রহঃ এর জীবনী (৫৫ বছর)
ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী

★ জন্ম যে পরিবারেঃ
মা শাকিউন নেছা। হাফেজা শাকিউন নেছা। সে যুগেই স্বনামধন্য মাদ্রাসা থেকে উলা পাশ করা আলেমাহ। পুরো নাম হাফেজাহ আলেমাহ শাকিউন নেছা। তখন মাদ্রাসা শিক্ষা দেওবন্দের সিলেবাসেই হতো। আলিয়া মাদ্রাসার পদ্ধতি হাতেগোনা কিছু কিছু জায়গায় ছিল। তাও কেবলমাত্র শুরুর পর্যায়ে। বাবা মাওলানা জামসেদ আলী। তিনিও স্বনামধন্য আলেম। পশ্চিম বঙ্গের ছাহরানপুর মাদ্রাসা থেকে উলা পাশ করেন। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়ও কিছুদিন পড়ালেখা করেন, তবে ওই সময় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি হলে তিনি ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন জাঁদরেল আলেম। চারিদিকে যার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। সর্বভারতের কুচবিহারে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবার। মাওলানা জামসেদ আলীর বাবাও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। চাচাও তৎকালীন সময়ের খুব আলোচিত আলেম এবং বক্তা ছিলেন। এই পরিবারটি অন্যান্য মুসলিম পরিবার থেকে আলাদা ছিল। ঘরে কুরআনের আলো। সে আলো চারপাশে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। দেওবন্দ সিলেবাসে পড়াশুনা হলেও আক্বীদায় পরিপূর্ণ সুন্নী। সে যুগেই মিলাদ ও কিয়াম করতেন মাওলানা জামসেদ আলী। নামাজের পর মোনাজাত করতেন। শবে বারাত, শবে মে'রাজ পালন করতেন। নবীজী [ﷺ]-এঁর বেলাদত উপলক্ষ্যে মিলাদুন্নাবী পালন করতেন।

কিন্তু এর মধ্যেই দেশ ভাগের সংগ্রামে শহরের সাথে সাথে মফস্বল শহরও উত্তাল। উত্তাল গ্রাম, গঞ্জ ও বন্দর। উত্তাল চারপাশ। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের কথা বলছি। দেশ ভাগ হবে বলে চারিদিকে রব। ভারত হিন্দুস্তান, কাজেই তা হবে হিন্দুদের জন্য। আর মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হবে পাকিস্তান। সেখানে থাকবে মুসলমানগণ। ভারত থেকে মুসলমান পরিবার পাকিস্তানে হিজরত করবে। আর পাকিস্তান থেকে হিন্দু পরিবার ভারতে হিজরত করবে। এ ছিল সিদ্ধান্ত। যারা হিজরত করতে চায়, তারা করবে, যারা নিজ আবাসভূমিতে থেকে যেতে চায়, তারা থাকতে পারবে। তবে নিরাপত্তার অভাব হিন্দু-মুসলমান সবার জন্য সমান উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দেখা দিল।

মাওলানা জামসেদ আলী তার পরিবার নিয়ে পাকিস্তানে পারি দেবার সিদ্ধান নিলেন। পূর্ব বাংলা তখন পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। কুচবিহার সীমান্ত পার হলেই পূর্ব-পাকিস্তান। বর্তমান বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন দিনাজপুরে হিজরত করলেন মাওলানা জামসেদ আলীর পরিবার। বর্তমানে দিনাজপুর ভাগ হয়ে নতুন জেলার নাম হয়েছে পঞ্চগড়।

এই পঞ্চগড় জেলার বড়শশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে সম্ভ্রান্ত সুন্নি পরিবারে জন্ম নেন আলোচ্য ব্যক্তিত্ব শহীদে মিল্লাম আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী [রাহমাতুল্লাহি আলাইহি]। তার পিতা সপরিবারে তৎকালীন পাকিস্তানে হিজরত করার পর তৎকালীন দিনাজপুরের জমিদারের কাছ থেকে ৯৯ বিঘা জমি লীজ নেন। মানে খাজনা এবং নামেমাত্র মূল্যে ক্রয় করেন। জমানো অর্থ থেকে কিছু পরিশোধ করেন এবং বাকি টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ পান। ফারুকী রহঃ-এর পিতা মাওলানা জামসেদ আলী নতুন আবাসস্থল নাউতারী নবাবগঞ্জ জামে মসজিদে ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এ দায়িত্ব তিনি পালন করেন দীর্ঘ ৩৫ বছর। ইমাম এবং খতীব হিসেবে তিনি যে হাদিয়া লাভ করতেন, ক্রমে সে অর্থ থেকেই জমিদারের পাওনা পরিশোধ করে ৯৯ বিঘা জমি সম্পূর্ণ নিজ অধীনে নিতে সক্ষম হন।

নতুন অঞ্চলে মাওলানা জামসেদ আলীর ডাকনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত নিয়ে অত্র অঞ্চলের এক আলেমের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। সে আলেমের মতে এগুলো বিদআত। আর বিদআত মানেই জাহান্নামে যাবার সহজ রাস্তা। মাওলানা জামসেদ আলী সেই আলেমকে চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন। জানালেন হয় বাহাসে আসো না হয় আমার সিদ্ধান্ত মেনে নাও। অত্র আলেম বাহাসে বসার সিদ্ধান নিলেন। তিনি ভেবেছিলেন মাওলানা সাহেব আর এতো কি দলীল দিতে পারবেন? তিনি মাওলানা জামসেদ আলীকে ভালো করে জানতেন না। নির্ধারিত দিনে মাওলানা জামসেদ আলী নিজ মসজিদের মুসুল্লিদের নিয়ে মহিষের গাড়ি বোঝাই করে কিতাব নিয়ে হাযির হলেন। বাহাসের স্ক্রিপ্ট তৈরি করে দিয়েছিলেন পুণ্যবতী আলেমাহ স্ত্রী। সেখানে গিয়ে দেখেন সেই মাওলানা আর তার এক অনুসারী হাযির। মাওলানা জামসেদ আলীর মহিষের গাড়ির উপর এত্তো এত্তো কিতাব দেখে মাওলানার শাগরেদ কাউকে কিছু না বলে পলায়ন করলো। উপায়ান্তর না দেখে সেই মাওলানা ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে রক্ষা পেলেন। ১৯৬৪ সালে ৯৯ বিঘা জমি থেকে ২৫ বিঘা জমি বিক্রয় করে মাওলানা জামসেদ আলী নৌপথে হজে গমন করেন।

বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর উপস্থাপক শাইখ আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী ১৯৫৯ সালের ২৪ নবেম্বর পঞ্চগড় জেলার বড়শ্বশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে আলহাজ্ব মাওলানা জামশেদ আলীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৫ ভাই এবং ৪ বোনের মধ্যে ফারুকী রহঃ তৃতীয়। ৫ ভাই এবং ৪ বোনের মধ্যে ফারুকী রহঃ তৃতীয়।

★ শৈশব ও শিক্ষাজীবনঃ
হাফেজাহ আলেমাহ মায়ের কাছেই ফারুকী রহঃ এবং তার সহোদরদের হাতেখড়ি। তার অন্যান্য ভাইবোনদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করেই আলেম ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানগুলো কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে তাদের পড়ালেখা শুরু করেন। রাসূল [ﷺ] বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে নিজে কুরআন পড়ে এবং অন্যকে শেখায়"। এই পরিবারের শিশুদের তাই ছোটবেলা থেকেই শুদ্ধ করে কুরআন পড়ার রেওয়াজ চালু হয়। হাফেজাহ মায়ের কাছ থেকে তালিম নিয়ে। সন্তানদের দীনি এই শিক্ষা পরবর্তী জীবনে টনিকের মতো কাজে লেগেছিল। আলেম পরিবারের সন্তানগুলো আলেম হয়েই বড় হতে লাগলো। মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী এবং তার অনুজ মাওলানা আব্দুর রউফ রোজি রোজগারের তাগিদে ঢাকায় পাড়ি দেন। অন্য দুই ভাই গ্রামেই নিজেদের স্থায়ী আবাস বেছে নেন। বোনদের বিয়ে হয় আশেপাশেই।

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে থাকেন শিশু নূরুল ইসলাম। সেখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে নীলফামারী জেলাধীন ডোমার থানার অন্তর্গত চিলাহাটি জামেউল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দাখিল এবং ১৯৭৫ সালে আলিম পাশ করেন। ১৯৭৯ সালে প্রাচীনতম ঐতিহাসিক সারসিনা দারুস সুন্নাত আলীয়া মাদরাসা (বরিশাল) থেকে হাদিস বিভাগে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরপরই ১৯৮১ সালে নীলফামরী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জগন্নাথ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পারিবারিক ঐতিহ্য, ইসলামিক পরিবেশ, দীনি শিক্ষা লাভ এবং সাথে সাথে সাধারণ শিক্ষায় ডিগ্রী অর্জন করে নিজেকে যুগের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলেন আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী রহঃ।

অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠের অধিকারী মাওলানা ফারুকী রহঃ খুব সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারতেন। ওই সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে কির'আত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর পূর্বে জেলা পর্যায়েও তিনি অন্য সব প্রতিযোগীকে ডিঙিয়ে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ভাবে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন তিনি।

★ কর্মজীবনঃ
শহীদে মিল্লাত আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী [রহঃ] কর্মজীবন শুরু করেন মালিবাগ রেলগেট জামে মসজিদ ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। কিছুদিন পর পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার নাসির উদ্দিন সরদার লেন জামে মুসজিদের খতিব হিসেবে যোগ দান করেন। এরপর সদরঘাট ওয়াইজঘাট জামে মসজিদে ইমামতি এবং খতীবের প্রস্তাব পান। পুরান ঢাকার মসজিদ ছেড়ে সদরঘাট ওয়াইজঘাট জামে মসজিদে যোগদান করেন। পাশাপাশি সেখানে অবস্থিত নূরীয়া চিশতিয়া আলিয়া মাদ্রাসার সুপার হিসেবে কর্মরত থাকেন। এরপর ঢাকা পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদে দীর্ঘ ১৬ বছর ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় এখানে তিনি একটি মক্তব, হাফেজীয়া এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে রহমতে আলম ইসলামী মিশন কামিল মাদ্রাসায় আরবির প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

এছাড়া ১৯৮৯ সালে প্রথম হজ্জে গমনের উদ্দেশে মক্কায় যান তিনি। সেই বছর তিনি জেদ্দা বিমানবন্দরে মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পান। পরপর তিন বছর হজের সময় হলে তিনি এ দায়িত্ব পালন করতেন। হজ-মৌসুম অতিক্রান্ত হলে ঢাকায় ফেরত আসতেন। এই সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন মসজিদে ৩৩ বছর ইমাম ও খতিবের দায়ত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন আলীয়া মাদ্রাসায় ১৫ বছর শিক্ষকতা, রেডিও-টেলিভিশনে ২৫ বছর ওয়াজ নসিয়তের অনুষ্ঠান করেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে 'কাফেলা'র জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। রমজান এলে এখনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ইফতারের পূর্বে টেলিভিশনের সামনে বসে যান আল্লামা ফারুকী রহঃ এর 'কাফেলা' দেখার জন্য। তাঁর শাদাতের পর তাঁর সুযোগ সাহেবজাদা আহমেদ রেজা ফারুকী এখন এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। এই অনুষ্ঠানের তথ্য ও চিত্র ধারণের জন্য তিনি দেশে বিদেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। ইসলাম এবং মুসলমানদের যেসব স্মৃতি বিশ্বের আনাচাকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তিনি তা খুঁজে খুঁজে ধর্মপ্রাণ, মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী সাধারণ মুসলমানদের জন্য উপস্থাপন করেছেন। 'কাফেলা' তাই জীবন্ত এক প্রমান্যচিত্রের নাম। মুসলমানদের আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য তিনি একেক করে তুলে ধরেছেন। শ্রীলংকার জাবালে আদমে, দীর্ঘ তেরো ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ধারণ করেছেন আদম [আলাইহিস সালাম]-এর পায়ের ছাপের পবিত্র পাথরের চিত্র। হযরত আদম [আলাইহিস সালাম] থেকে শুরু করে বিভিন্ন নবী ও রাসূলগণের মাকাম, স্মৃতি চিহ্ন, তাদের মাজার এবং কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত তাদের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ 'কাফেলা' অনুষ্ঠানের মূল বিষয়।

ফলে এক শ্রেণী ধর্মব্যবসায়ী তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। কিছু ঘোমটা মৌ-লোভী টেলিভিশনের পর্দায় বসে সৌদি আরবের দুম্বা-রুটির লোভে বিভিন্ন ভাবে মিথ্যাচার করে মানুষকে যে ভুল তথ্য দিয়ে আসছিল, আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকীর কাফেলা তা সচিত্র প্রতিবেদনের মাধ্যমে সত্য উন্মোচন করে দিচ্ছিলেন। ফলে তাদের মিথ্যাচার সহজেই মানুষের চোখে ধরা পড়ছিল। এ কারণেই মূলত ওই ধর্ম-ব্যবসায়ীরা তাঁর পিছু লাগে এবং উপায়ন্তর না দেখে তাকে শহীদ করে দেবার চূড়ান্ত সিদ্ধান নেয়।

বাংলাদেশের মানুষের সুন্দর ও সঠিক নিয়মে পবিত্র হজ্জ পালনের নিমিত্তে ২৫ বছর ধরে হজ্জ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি। মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী মক্কা মোয়াজ্জামায় বসবাসরত আওলাদে রাসূল আল্লামা সায়েদ মোহাম্মদ মালিকি আলাভী (রা.-এর রওজায় প্রতি ভ্রমণেই জিয়ারত করতেন। এছাড়া সারসিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ রহঃ-এর সাথে অসংখ্য প্রোগ্রাম এবং দীনি মাহফিলে অংশ নেন। গজল পরিবেশনের পর আবু জাফর সালেহী রহঃ উনাকে বুলবুলি বলে অভিহিত করেন। শেষ জীবনে শাহাদতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি গাউসে পাক [রাদ্বিঃ]-এর সাহেবজাদা খাজা হযরত শরফুদ্দিন চিশতি রহঃ-র মাজার সংলগ্ন তথা সুপ্রিমকোর্ট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়ত্ব পালন করেন।

★উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ
শহীদ আল্লামা ফারুকী রহঃ মূলত মিডিয়ায় এবং দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে দীনি দাওয়া কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তবে এতো ব্যস্ততার মাঝেও তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। তার বইগুলো সুফিবাদ ভিত্তিক। সর্বশেষে ‘মারেফুল হারামাইন’ বইটি লিখেছেন। “হুব্বে রাসূল” নামে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি সম্পন্ন করেন তবে তা প্রকাশিত হয়নি। বইগুলোতে ইসলামের আদি বা অবিক্রিত রূপগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন।

★সংসারজীবনঃ
মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী সংসার জীবনে দুই বিয়ে করেন। তার দুই সংসারে চার ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। ছেলেরা হলেন- মাসুদ বিন নূর, আহমেদ রেজা ফারুকী, ফয়সাল ফারুকী এবং মোঃ ফুয়াদ ফারুকী। মেয়েরা হলেন- হুমায়রা তাবাচ্ছুম তুবা এবং লাবিবা হোসনা লুবা।

★শাহদাতঃ
নূরুল ইসলাম ফারুকী (রহঃ)'র ছেলে ফয়সাল ফারুকী জানান, সন্ধ্যার পর বাসায় দু'জন অতিথি আসেন। তারা তার (ফয়সাল) বাবার সঙ্গে হজ্বে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় তার বাবা  ড্রয়িং রুমে বসা ছিলেন। পরনে ছিল লুঙ্গি আর সাদাকালো স্ট্রাইপের পাঞ্জাবি। গলায় ছিল পাগড়ি। এর পর ওই দুইজন জানান, তাদের আরও কয়েকজন বড় ভাই আছেন, যারা হজ্বে যেতে চান। ফয়সাল বলেন, এর কিছুক্ষণ পর তারা দরজায় নক করে। আব্বা দরজা খোলার পর ৭-৮ জন লোক পিস্তল এবং রামদা, চাপাতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ওই সময় পরিবারের ৫ জন সদস্য বাসায় ছিলেন। প্রথমে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং পরে সবার হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। ওই ড্রয়িং রুম থেকে তার বাবাকে পাগড়ি দিয়ে গলা বেঁধে টেনে হিঁচড়ে ডাইনিং রুমে এনে ডাইনিং টেবিলের নিচে গলা কেটে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। তার রক্তের প্রবাহে গোটা রুম ভেসে যায়। গতকালও ডাইনিং রুমের ফ্রিজ ও মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখা যায়। এ ঘটনার দুইদিন আগেও ওই দুইজন বাসায় এসে কথা বলে গেছেন বলে জানান তিনি।

কী কারণে খুন করা হয়েছে জানতে চাইলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ‘আব্বা ধর্মের কথা বলতেন, সত্যের কথা বলতেন। আব্বার কথা যারা অপছন্দ করতেন তারাই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।’ তার দাবি, ধর্মীয় কারণেই তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকান্ডটি পরিকল্পিত দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। সত্যের কথা বলার কারণে আব্বাকে বিভিন্ন সময় মোবাইল ফোনে হুমকিও দেয়া হয়েছে।

★ব্যক্তিত্বঃ
মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রেসিডিয়াম সদস্য, মোফাসসিরে কুরআন, পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদের সাবেক খতিব, ইসলামিক মিডিয়া জনকল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান, মেঘনা ট্রাভেলস (লাইসেন্স নং-২৯১) ম্যানেজিং পার্টনার, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর ধর্মীয় অনুষ্ঠান কাফেলার উপস্থাপক ও পরিচালক, রেডিও বাংলাদেশের ধারা ভাষ্যকার, সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব ও ফারুকী ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস-এর এমডি। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও ইসলামিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন।

শহীদ আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রহঃ) ছিলেন সৎ-সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, কর্তব্যপরায়ণ, দায়িত্বশীল এবং রাসূলপ্রেমে সিক্ত এক বিদগ্ধ আলেমে দীন। তিনি ছিলেন নবী কারীম হযরত মুহাম্মদ [ﷺ]-এঁর একজন প্রকৃত আশেক। অপরদিকে তিনি ছিলেন দুষমনে রাসূলদের জন্য চরম শত্রু। সুন্নীয়তের উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে তিনি তাঁর অবস্থান মজবুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুন্নীয়তের পক্ষে তিনি ছিলেন বলিষ্ট কন্ঠস্বর। ন্যায় এবং সত্য কথা বলতে কখনো তিনি ভয় পেতেন না।

তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। প্রতি বছর বারই রবিউল আওয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে জশনে জুলুশে তার অবদান ছিল লক্ষণীয়।

মিডিয়া জগতে যখন বাতেল ফের্কার ঘোমটা মৌ-লোভীগুলো সাধারণ মুসলমানকে গোমরাহির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি ইসলামের সঠিক ইতিহাস এবং কুরআন-হাদিসের সঠিক ব্যাখা তুলে ধরে তাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। সমগ্র পৃথিবী পরিভ্রমণ করে ইসলামের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস এবং নবী-রাসুল ও সাহাবী গণের মাজার এবং গুরুত্বপূর্ন জায়গার ইতিহাস কুরআন- হাদিসের আলোকে তার কাফেলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরতেন।

সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন নির্ভীক এবং দুঃসাহসী। ইসলামের জন্য নিবেদীত প্রাণ। সব সময় তিনি শাদাতের মৃত্যুর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে। আল্লাহ্‌ পাক তাঁর সে প্রার্থনা কবুল করেছেন এবং শাহাদাতের মৃত্যু নসীব করেছেন। শাহাদাতের মাত্র কিছুদিন পূর্বেও তিনি চট্টগ্রামের এক মাহফিলে তাঁর শাহাদাতের আশংকার কথা প্রকাশ করেছিলেন।

শহীদ আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী (রহঃ) ছিলেন সুন্নীয়তের নয়নমনি। আল্লাহ আপনি নূরুল ইসলাম ফারুকী রহঃ কে জান্নাতের সর্বোচ্চ মকাম দান করুন (আমিন)। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আপনার প্রেমিক কে কবুল করুন। পৃথিবীর জমিনে যদি খুনিদের শাস্তি নাও হয় আল্লাহ আপনার বিচারে খুনিদের কঠিন শাস্তি দিন।
(আমিন)।

 
Top