আগন্তুক (৫)

- মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির তানভীর 

৪র্থ পর্ব


যাই হোক, তার গবেষণার বাচ্চাদের ব্যপারে উনি বলছেন, কোন শব্দ বা অক্ষর বলা হলে তারা সেটার মানসিক আকৃতি দিতে পারত না। এই জিনিসটা ব্যখ্যা করি, কল্পনার ভেতর কোন জিনিস দেখা। যেমন, যারা গাড়ি চালায়, যদি একটা ম্যাপ উল্টা থাকে আপনি মনে মনে ম্যাপটাকে সোজা করে পথটা বুঝে নিবেন। একে বলে স্প্যাশিয়াল অ্যাবিলিটি (SPATIAL ABILITY)। এটা মস্তিষ্কে গড়ে তুলতে হয়। মনের এই কল্পনাশক্তিটা জন্ম না নিলে এই দক্ষতাটা আসবে না। আর এটা আসবে না, যদি কেউ হাঁ করে বসে থেকে সারাদিন টিভি দেখে। যার এই দক্ষতা যত বেশি সে তত ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাথমেটিশিয়ান হতে পারবে। এরপর উনি বলছেন, যদি তিনি তাদের কয়েকটা অক্ষর দেখিয়ে একটা বের করতে বলতেন, তাহলে তারা সেটা পারত; কিন্তু না দেখালে তারা আর পারছে না। এই সকল বাচ্চারাই অনেক টিভি, ভিডিও দেখত আর কম্পিউটার গেম খেলত – কেন পারেনি তার মূল কারণ হচ্ছে এসব।


আপনি মনে করবেন না কম্পিউটার গেম নিরাপদ, তা না কিন্তু! অনেক ‘ঢিসুম-ঢাসুম’ আছে। তখন উনি চিন্তা করতে শুরু করলেন টিভির সামনে বাচ্চাদের রাখলে কী সমস্যা হয় তাদের? সমস্যাটা হচ্ছে, মস্তিষ্কের জন্য আর করার কিছু থাকে না, এর চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার কিছু নাই। জানেন তো, মানুষের বাচ্চাকে দশ-বিশ বছর কোন কাজ করতে না দিলে, চেয়ারে বেঁধে রেখে দিলে সে কিন্তু আর দাঁড়াতেও পারবে না, হাঁটতে পারবে না – আল্লাহ মানুষকে এভাবেই বানিয়েছেন। গরু-ছাগলের বাচ্চা জন্মগতভাবেই ডাক দিতে, হাঁটতে, দৌড়াতে পারে কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে শেখাতে হয়। এই কারণে বলছেন, মানুষের বাচ্চা যখন টিভি দেখে, তখন সবকিছু তার মাথার ভেতরে ঢুকছে, সে নিজে চিন্তা করে কিছু বের করে না।


এরপর উনি বলছেন, শিশুদের দেখা, শোনা, স্বাদ নেয়া, গন্ধ নেয়া, স্পর্শ করা এই পঞ্চন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটা কাজে লাগে এমন ব্যপারে নিয়োজিত করতে হবে। এখানে আমি আমার নিজের জীবনের একটা গল্প বলি: আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল, তখন শীতকালে একবার সে আম খেতে চাইল। তার মা বলল এখন তো আম পাওয়া যাবে না। সে বলে উঠল, দোকানে গেলে পাওয়া যাবে না? এখন, এই বিষয়টা আসলে কী? তার মাথায় আছে পয়সা দিলে দোকানে সব পাওয়া যায়। একে আমরা বলি “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন”, অর্থাৎ আমার এক্ষুণি দরকার, এক্ষুণি চাই, তুমি যেখান থেকে পার এনে দাও। এটা কিন্তু চরিত্রটাকে নষ্ট করে দেয়। সে সবকিছু রেডিমেড পেতে, দেখতে ও কিনতে শেখে। অপরদিকে, সে যদি প্রকৃতির মাঝে থাকত তাহলে কী দেখত? প্রথমে দেখত আমের মুকুল আসছে, তারপর দেখত কিছু ঝরে গেছে আর কিছু রইল, তারপর আমের গুটি আসছে, সেখান থেকেও কিছু ঝরে গেল, এরপর কিছু কাঁচা আম এলো, তারপর বৈশাখের ঝড়ে কিছু ঝরে গেল কিছু রইল, যা টিকল সেটা পাকল, পাকার পর সেটা পাড়া হোল ও সবাই ভাগ করে খেলো। এর মাঝে কী নিহিত আছে? ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় জিনিসটা – সবর বা ধৈর্য! আজকাল দেখবেন আমাদের সবর নাই কারণ আমরা মনে করি পয়সা দিলেই তো সব পাওয়া যায়। আমরা একটা ধৈর্যহীন প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছি।


পড়াশোনা করব তারপর ভালো রেজাল্ট হবে, তার চেয়ে নকল করলেই তো হয়ে যায়! এসবই কিন্তু “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” বা “তৎক্ষনাৎ তৃপ্তি” লাভের প্রবণতার ফল। আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন ছিল, “কোকোলা লজেন্স এক্ষুনি আনো”! এই কথাটা কিন্তু খুবই ইসলাম বিরোধী! কেন? আমাদের আল্লাহ কী বলেছেন? এই দুনিয়ায় সবকিছু পাবে না, দুনিয়া থেকে আমরা ততটুকু নিব, যতটুকু বাঁচার জন্য দরকার। সমস্ত প্রতিজ্ঞা আখিরাতের জন্য। এখন ধৈর্য ধরবেন, পরবর্তীতে পাবেন – এটা হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ আপনাকে যা এখানে নিষেধ করছেন, সেটা কিন্তু বলছেন জান্নাতে পাওয়া যাবে। দুনিয়া হচ্ছে ধৈর্যের ব্যপার, অপেক্ষা করার ব্যপার, “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” উল্টা জিনিস এটা।


এরপর লেখিকা বলছেন, বাচ্চাদের ইন্দ্রিয়গুলো স্পঞ্জের মতো হয়; যা দেখবে তাই শুষে নেয় এবং তাদের কোন একটা ইন্দ্রিয়কে বেশি উত্তেজিত করলে, অন্যগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। যদি শুধু চোখ আর কান এক জায়গায় আটকে দেয়া হয় তাহলে বাকিগুলো ব্যবহৃত না হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। সবকয়টা ইন্দ্রিয়ের দরকার আছে; সে প্রকৃতির কাছে যাবে, একটা কিছু ধরবে, একটা পিঁপড়া কামড় দেবে – এর দরকার আছে। একটা ফুলের ঘ্রাণ সুন্দর আরেকটার বাজে, এর দরকার আছে; একটা জিনিসের স্বাদ ভালো আর একটার স্বাদ কষটা, এর দরকার আছে। প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতার দরকার আছে। বাচ্চা বড় হবে ও সেই সাথে তার সব ইন্দ্রিয়গুলো গড়ে উঠবে – এটাই বলছেন তিনি। এরপর লেখিকা বলছেন, ছোটবেলায় সবকিছুই সে গ্রহণ করবে, এর মাঝে বাছবিচার করতে শিখবে না সে। শব্দের ব্যপারটাই ধরুন, প্রচন্ড সশব্দ মিউজিকে আপনি পাশের বাসায় বসে টিকতে পারছেন না, কিন্তু একটা বাচ্চা তার মাঝেই বসে আছে! এর মানে কী? সে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখন আর স্বাভাবিক শব্দের মাত্রা তার ভালো লাগবে না। আর, স্পর্শের ইন্দ্রিয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা ও মাটি এই দুটা ছাড়া কোন বাচ্চা প্রাকৃতিকভাবে বড় হতেই পারে না। এই মহিলা বিধর্মী তাও বলছেন, মানুষ হওয়ার জন্য মায়ের স্পর্শে থাকতে হবে। মাটি ধরবে, মলিন হবে এবং মায়ের কাছে থাকবে – এসবকিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার।



 
Top