জালিয়াতির আরেক রূপ

আল্লামা আলবানী একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বুখারী শরীফের টীকায় আহসানুল্লাহ বিন সানাউল্লাহ দীর্ঘ সতের পৃষ্ঠাব্যাপী এ মাসআলা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এতে সহীহ-যঈফ সবধরনের বর্ণনা জমা করা হয়েছে। রাবী ও কিতাবের নাম বিকৃতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কিছু তুলে ধরা হলো:

১.৫৫৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, উবাদাহ ইবনু সামিত (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করল না তার সলাত হল না। (ইমাম বায়হাকীর কিতাবুল ক্বিরাআত, পৃ. ৫৬)

এ হাদীস সম্পর্কে মন্তব্যে খ নম্বরে বলা হয়েছে, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরী (রহ.) বলেন, এ হাদীস ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পড়ার পক্ষে আংটির চমকদার মতির ন্যায় উজ্জ্বল। (ফাসলুল খিতাব, পৃ. ১৪৭)

এটা একটা জালিয়াতি। কাশমিরী এ হাদীস সম্পর্কে বরং বলেছেন,

وتصحيحه لهذه الزيادة من حيث صنعة المحدث في غاية الاستعجاب فإن هذه الزيادة مدرجة قطعا ولو حلف أحد بإدراجها لكان بارا وما حنث

অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণের রীতি অনুসারে ‘ইমামের পেছনে’ এই বাড়তি অংশকে সহীহ বলা বড়ই আশ্চর্য বিষয়। কারণ এই বাড়তি অংশটুকু নিঃসন্দেহে রাবীর পক্ষ থেকে সংযোজিত। কেউ যদি এর সংযোজনের পক্ষে হলফ করে তবে তার হলফ ঠিক থাকবে। ভঙ্গ হবে না। (পৃ. ১২০)

এরপর কাশমিরী রহ. বলেছেন, এ সংযোজন খুব সম্ভব মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহয়া ইবনুস সাফফার এর পক্ষ থেকে ঘটানো হয়েছে। কিংবা মুহাম্মদ ইবনে সুলায়মান ইবনে ফারিসের পক্ষ থেকে।

অতঃপর তিনি বলেন,

كيف! لو كانت هذه الزيادة عند الزهري لما خالفها ، وقد أخرج عنه البيهقي في الكتاب عن عبد الله بن المبارك نا يونس عن الزهري قال : لا يقرأ من وراء الإمام فيما يجهر به الإمام القراءة يكفيهم قراءة الإمام وإن لم يسمعهم صوته ولكنهم يقرؤون فيما لا يجهر به سرا في أنفسهم ولا يصلح لأحد ممن خلفه أن يقرأ معه فيما جهر به سرا ولا علانية ، قال الله تعالى : وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون

অর্থাৎ এটি কিভাবে বিশুদ্ধ হতে পারে? যুহরী রহ.এর নিকট (ঐ হাদীসটি তার সূত্রেই বর্ণিত) যদি এ বাড়তি অংশ থাকত, তবে তিনি এর বিপরীত কথা বলতেন না। অথচ বায়হাকী তার উক্ত গ্রন্থেই আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ইউনুস আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, যুহরী রহ. বলেছেন, যেসব নামাযে ইমাম জোরে কিরাআত পড়ে সেসব নামাযে ইমামের পেছনে কেউ কিরাআত পড়বে না। তাদের পক্ষে ইমামের পাঠই যথেষ্ট হবে। যদিও ইমাম তার আওয়াজ তাদেরকে না শুনিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, যেসব নামাযে ইমাম সরবে কিরাআত পড়েন না সেসব নামাযে তাঁরা মনে মনে বা চুপে চুপে পড়বেন। তবে জাহরী নামাযে ইমামের পেছনে কোন ব্যক্তির জন্যই সরবে বা নীরবে কিরাআত পড়া সঙ্গত হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যখন কুরআন পড়া হয় তখন তোমরা কান পেতে শোন ও চুপ থাক, তাহলে তোমাদের প্রতি রহম করা হবে। (দ্র. পৃ. ১২১)

২.ইমামগণের মাযহাব ও মত বর্ণনা প্রসঙ্গে ৫৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ইমাম মালেক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেছেন, সূরা ফাতিহা ছাড়া (মুক্তাদীর) সলাত সহীহ হবে না, যেরূপ ইমাম ও মুনফারিদের সলাত সূরাহ ফাতিহা ছাড়া সহীহ হয় না। (তাফসীরে মাজহারী, ১/১১৮)

এ হলো আরেকটি জালিয়াতি। তাফসীরে মাজহারীতে ঐ কথা নেই, থাকতেও পারে না। সেখানে বরং বলা হয়েছে,

هل يجب القراءة على المقتدى أم لا فقال الشافعي يجب عليه قراءة الفاتحة كالامام والمنفرد قال البغوي كذا روى عن عمر وعثمان وعلى وابن عباس ومعاذ رض وقال أبو حنيفة ومالك وأحمد لا يجب ثم اختلفوا فقال أبو حنيفة يكره مطلقا وقال مالك واحمد يكره فى الجهرية فقط وقال أحمد يستحب فى السرية وكذا فى الجهرية عند سكتات الامام ان سكت لا مع قراءته وبه قال الزهري ومالك وابن المبارك

অর্থাৎ মুক্তাদির উপর কিরাআত জরুরী কি না? ইমাম শাফিঈ বলেন, ইমাম ও মুনফারিদ (একাকী নামায আদায়কারী)এর ন্যায় মুক্তাদির উপরও সূরা ফাতিহা পড়া জরুরী। ইমাম আবূ হানীফা, মালেক ও আহমাদ বলেন, জরুরী নয়। এই তিনজনের মধ্যে আবার দ্বিমত হয়েছে। আবূ হানীফা বলেছেন, সব নামাযেই মাকরূহ, আর মালেক ও আহমাদ বলেছেন, শুধু জাহরী নামাযে মাকরূহ। ইমাম আহমাদ এও বলেছেন, সিররী নামাযে মুস্তাহাব, আর জাহরী নামাযেও ইমাম যদি বিরতি দেন তবে বিরতির মধ্যে পড়া মুস্তাহাব। ইমামের সঙ্গে সঙ্গে পড়বে না। যুহরী, মালেক ও ইবনুল মুবারকের মতও তাই।

৩.একই পৃষ্ঠার শেষে লেখক ‘আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা’আহ’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম শাফিঈ, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ (রহ.) এ হুকুমের উপর একমত যে, সলাতের প্রত্যেক রাকআতে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করা ফারয। কোন মুসল্লী ইচ্ছাকৃতভাবে ফাতিহা পড়া ছেড়ে দিলে তার সলাত বাতিল হয়ে যাবে।

এখানেও লেখক ধোঁকার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ পূর্বোক্ত কথাগুলো উক্ত গ্রন্থের লেখক বলেছেন ‘সূরা ফাতিহা নামাযের কোন পর্যায়ের অংগ’ এ কথা তুলে ধরার জন্য। এরপরই তিনি একই পৃষ্ঠায় মুক্তাদির জন্য সূরা ফাতিহা পাঠের বিধান কী: সেটি উল্লেখ করেছেন এবং উপরে তাফসীরে মাজহারী থেকে আমরা যা উদ্ধৃত করেছি তিনি সেই একইভাবে মাযহাব বর্ণনা করেছেন।

৪.হানাফী মাযহাবের পীর-সূফী ও বিখ্যাত আলেমগণের তালিকায় আব্দুল কাদির জিলানী ও ইমাম গাযযালীকে উল্লেখ করা হয়েছে। (দ্র. পৃ. ৫৬৫) অথচ আব্দুল কাদের জিলানী ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী, আর ইমাম গাযযালী ছিলেন শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী।

৫.হানাফী ফিক্বাহ গ্রন্থাবলীতে ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পড়ার পক্ষে ফাতাওয়াহ শিরোনামে ‘ক’ ধারায় লেখা হয়েছে, হাদীসের দৃষ্টিতে সূরা ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব। (উসূলুশ শাশী, ৮/১০১)

এখানে কয়েকটি ধোঁকা রয়েছে।

ক. উসূলুশ শাশী হানাফী ফিকার কিতাব নয়, বরং ফেকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ।

খ. এটি এক খন্ডের ছোট একটি কিতাব। লেখক ৮ খ-ের এত বড় কিতাব কোথায় পেলেন, তা তিনিই ভাল জানেন।

গ. উদ্ধৃত অংশে মুক্তাদীর কথা বলা হয় নি। বরং বলা হয়েছে, হানাফীদের নিকট নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব, ফরজ হলো কুরআনের যে কোন অংশ পাঠ করা। (দ্র. পৃ. ২৩)

৬.৫৬০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ইমাম মুসলিম (রহ.) বলেন, সহীহ কথা এই যে, সব উলামায়ে সালফ ও খালফ (সহীহ হবে, সালাফ ও খালাফ) এর উপর একমত হয়েছেন যে, সূরা ফাতিহা প্রত্যেক রাকআতে পাঠ করা ওয়াজিব। তা রাসূলুল্লাহ স. এর এ ফরমানের জন্য যে, ثم افعل ذلك في صلاتك كلها (সহীহ মুসলিম শরাহ, ১/১৭০)

এটা মস্তবড় জালিয়াতি। এ কথাগুলো মুসলিম শরীফের ভাষ্যকার ইমাম নববীর। সপ্তম শতকের ভাষ্যকারের বক্তব্যটি লেখক কীভাবে তৃতীয় শতকের ইমাম মুসলিমের নামে চালিয়ে দিয়েছেন!? কেউ মিথ্যা বললে কি এতটা খোলাখুলি! ইমাম নববীর আরবী পাঠ হলো,

والصحيح الذي عليه جمهور العلماء من السلف والخلف وجوب الفاتحة في كل ركعة لقوله صلى الله عليه و سلم للأعرابي ثم افعل ذلك في صلاتك كلها

এখানে আরেকটি ধোঁকা হলো, ইমাম নববী এ বক্তব্যে মুক্তাদীর ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে আলোচনা করেন নি। বরং এই আলোচনা করেছেন যে, সূরা ফাতিহা পাঠ করা নামাযের সব রাকআতে জরুরী, নাকি বিশেষ কোন রাকআতে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, (ইমাম সুফিয়ান) ছাওরী, আওযায়ী ও আবূ হানীফার মতে প্রথম দু’রাকআতে জরুরী, ২য় দু’রাকআতে নয়। সহীহ কথা এই যে, ...।

ইমাম নববী এর পূর্বে একই স্থানে আরো দুটি মাসআলা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। ১. নামাযে ফাতিহা পড়া ফরয। ইমাম মালেক, শাফিঈ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মত এটি। আর আবূ হানীফা বলেছেন, ফরজ হলো একটি আয়াত পাঠ করা। (অর্থাৎ সূরা ফাতিহা পড়া ফরজ নয়, ওয়াজিব।)

২. ফাতিহা পাঠ মুক্তাদীর উপর ফরজ কি না: এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ইমাম শাফিঈর মতে ফরজ।

এসব কথা একই স্থানে উদ্ধৃত হয়েছে। লেখক আহসানুল্লাহ যদি না বুঝে থাকেন, তবে তো তার মেধার উপর ক্রন্দন করা চাই। আর যদি বুঝে শুনে এমন ধোঁকার আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তবে তো কথাই নেই। তবে এই যোগ্যতা নিয়ে বুখারী শরীফের মতো মহান হাদীস গ্রন্থের টীকা লিখতে দুঃসাহস করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত তা ভেবে দেখা দরকার।

৭.রাবী, লেখক ও কিতাবের নাম তিনি যেভাবে বিকৃতরূপে পেশ করেছেন তাও তার যোগ্যতার সাক্ষর বহন করে বৈ কি। শারহুল মুহাযযাব-কে তিনি মাহযাব বলেছেন। আরফুশ শাযীকে তিনি উরফুশ শাযী নামে উল্লেখ করেছেন। কাযী ইয়াযকে তিনি আইয়ায বানিয়েছেন। এভাবে আবু নাদরা (أبو نضرة)কে আবূ নাসরাহ, রাজা ইবনে হায়ওয়াহকে হাইওয়াতাহ, বুওয়ায়তীকে বুয়ূতী, আবূ মিজলাযকে আবূ মুজাল্লিয, মুনাবীকে মুনাদী বানিয়েছেন। একটি মাসআলা আলোচনায় এতগুলো ভুল ও জালিয়াতি! এরাই হলেন সুযোগ্য আলেম এবং আহলে হাদীস!!

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

 
Top