তা‘যিমী সিজদার বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১১৫: সিজদায়ে তা‘যিমী বা কবর সিজদা করার প্রকার কতটি এবং তা বিস্তারিত আলোচনা কর। 
❏ প্রশ্ন-১১৬: কোন ওলি, সুফি বা আলিমের সামনে সিজদা করার হুকুম কী?

বিবাহের বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১১৭: দ্বিতীয় বিবাহ কাকে বলে? বিস্তারিত আলোচনা কর?
❏ প্রশ্ন-১১৮: গোপন বিবাহ কাকে বলে?
❏ প্রশ্ন-১১৯: নিকাহ অর্থ কি? নিকাহ কাকে বলে?

ওয়ালিমা এবং যিয়াফতের বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১২০: ওয়ালিমা কাকে বলে? ওয়ালিমা অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১২১: যিয়াফত বা ভোজ্যানুষ্ঠান কী? এবং কখন হতে এর প্রচলন শুরু হয়?

ওলির বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১২২: ‘ওলি’ অর্থ কী? ওলি কাকে বলে? এবং ওলির সংজ্ঞা কী?

মাযার সমূহের ওপর ঘর নির্মাণ করার বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১২৩: আউলিয়া-ই কিরামের মাযারসমূহের ওপর ভবন বা ঘর নির্মাণ করা কেমন?
❏ প্রশ্ন-১২৪: মাযারসমূহ গোসল দেয়া জায়েযের সপক্ষে কী কোন দলিল আছে?

তাজিমার্থে দাঁড়ানো ও না‘রা দেয়া 

❏ প্রশ্ন-১২৫: কোন সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির আগমনে না‘রা বা তাকবীর দেয়ার বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১২৬: কোন মজলিসে সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে সমাবেশে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে হযরাত ওলামায়ে কিরামের মতামত কী?

সেমা’র বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১২৭: সেমা তথা ধর্ম-সঙ্গীত সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের অভিমত কি এবং এর ফয়সালার পদ্ধতি কি?

ওহাবী ফেরকার বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১২৮: সংক্ষিপ্তাকারে ওহাবী সম্প্রদায়ের পরিপূর্ণ অবস্থা এবং তারা কতভাগে বিভক্ত হয়েছে তা যথাযথভাবে বর্ণনা কর।

বিভিন্ন প্রকারের মাসায়েল এর বর্ণনা

❏ প্রশ্ন-১২৯: অভিশপ্ত ইবলিশ কি সিজদার আদেশের মুকাল্লাফ (আজ্ঞাবহ) ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৩০: জনৈক ব্যক্তির বিবাহের জন্য সঞ্চিত অর্থ যদি বছর ঘুরে আসে তবে সেই অর্থের ওপর  যাকাত ওয়াজিব হবে নাকি হবে না?
❏ প্রশ্ন-১৩১: সূরা ইয়াসিন এর তেলাওয়াত কখন ও কিভাবে করতে হয় এবং এর উপকার কী- দলিলসহ বর্ণনা কর ?
❏ প্রশ্ন-১৩২: উম্মতে মুহাম্মদীর   ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হাকীকত কী?
❏ প্রশ্ন-১৩৩: বর্ণনাকারী এবং বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হাদিস কত প্রকার?
❏ প্রশ্ন-১৩৪: সূরা ইনশিরাহ এর আয়াত وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি’ এর ব্যবহার  বা প্রয়োগ ব্যাপকার্থে সবার জন্য করা কেমন?
❏ প্রশ্ন-১৩৫: ইসলামে শিরকের অবস্থান কী? উম্মতে মুহাম্মদীয়া হতে শির্ক প্রতীয়মান হতে পারে কি?
❏ প্রশ্ন-১৩৬: ‘এটি (সূর্য) এভাবে চলতে চলতে আরশের নিচে সিজদাবনত হয়’ অত্র হাদিসটির মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা কী হবে?
❏ প্রশ্ন-১৩৭: ফিতনার সময় ঈমান, আক্বীদা ও আধ্যাত্মিক বা আত্মিক আমলসমূহ হিফাযতের জন্য ফিত্না-ফাসাদ হতে দূরে পালানোর ধরনটা কি রকম?
❏ প্রশ্ন-১৩৮: দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে কোন কিছু খাওয়ার হুকুম কী?
❏ প্রশ্ন-১৩৯: বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচ্য অঞ্চলের লোকেরা শেষ যামানায় হযরত সাইয়েদুনা ইমাম মাহদীর (عليه السلام) সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে। একথা কি কোনো দলিল দ্বারা প্রমাণিত নাকি কেবল জনশ্রুতি?
❏ প্রশ্ন-১৪০: ইবলিশ শয়তান কি বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলো?
❏ প্রশ্ন-১৪১: হযরত ইবরাহিম (عليه السلام), ইসমাইল (عليه السلام) এর স্থলে যে দুম্বাটি জবাই করেছিলেন ওই দুম্বাটির গোশত কারা ভক্ষণ করেছিলো?
❏ প্রশ্ন-১৪২: কে শাসন ক্ষমতার জন্য অধিক যোগ্য  হবেন? অনভিজ্ঞ মুত্তাকী ও আলেমে দ্বীন নাকি অভিজ্ঞতা আলেম নন এমন মানুষ?
❏ প্রশ্ন-১৪৩: الاستمناء باليد তথা হাত দ্বারা বীর্যপাত করা অর্থাৎ হাত দ্বারা বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করা, শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এর বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৪৪: মুরতাদদেরকে মুসলমান মনে করে তাদের সঙ্গ দেওয়া, তাদের নিকট হতে উন্নতি ও উপকারের আশা করা, শরীয়তে এগুলোর বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৪৫: নকশবন্দিয়া খান্দানে খতমে খাজেগান সর্বদা দৈনিক পড়া হয়। কোন কোন সময় সহিংসতা, অস্থিরতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহকালে ফজরের নামাযে ইমাম সাহেব মসজিদে কুনুতে নাযেলাও পড়েন
❏ প্রশ্ন-১৪৬: কোন নামাযের পর খতমে খাজেগানের পাঠকে নিয়মিত অযিফা বানিয়ে নেওয়া কেমন?
❏ প্রশ্ন-১৪৭: বিয়েতে প্রস্তাবের উত্তরে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বলা কেমন?
❏ প্রশ্ন-১৪৮: হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله عنها ) কর্তৃক তাঁকে (ﷺ) রওজায়ে আকদাসে দাফন করার ব্যাপারে নিষেধ করার কারণ কী ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৪৯: কোরআন মজিদ খোলার পূর্বে কিছু লোক তাতে চুমো খায়। এই কাজটি জায়েয বা সঠিক কিনা?
❏ প্রশ্ন-১৫০: مُحَدَّثْ মুহাদ্দাস (দাল বর্ণের ওপর তাশদীদ ও যবর সহকারে) শব্দের অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৫১: বারো মাসের গণনা প্রথা কখন হতে শুরু হয়? 
❏ প্রশ্ন-১৫২: আরববাসীগণ নিজেদের চান্দ্র মাসের কী কী নাম রেখেছিলেন?
❏ প্রশ্ন-১৫৩: شاه ‘শাহ’ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং তা কোথায় ব্যবহার করা হয়?
❏ প্রশ্ন-১৫৪: শাহাদাত কাকে বলে, এর সংজ্ঞা কী এবং শাহাদাতের সংখ্যা কত?
❏ প্রশ্ন-১৫৫: হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতার নাম কি ছিল? তারুখ তাঁর পিতার নাম এবং আযর তাঁর চাচা,একথা বলা সঠিক কিনা?
❏ প্রশ্ন-১৫৬: হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) কর্তৃক বর্ণিত পুরো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চারজন নারী কারা কারা ছিলেন? আছিয়া কে ছিলেন?
❏ প্রশ্ন-১৫৭: আসফ বিন বরখিয়া কে ছিলেন, তার অবস্থা ও কাহিনী বর্ণনা কর?
❏ প্রশ্ন-১৫৮: হযরত মুসা (عليه السلام) এর মাতার নাম কি ছিল?
❏ প্রশ্ন-১৫৯: হযরত শুয়াইব (عليه السلام)কে কোন্ জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল?
❏ প্রশ্ন-১৬০: আসহাবে আইকা বলা হয় কাদেরকে, আইকা শব্দের অর্থ কী?
❏ প্রশ্ন-১৬১: وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ ...... فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ   (সূরা মায়েদা, পারা নং-৬) আয়াতটির তাফসীর কী?
❏ প্রশ্ন-১৬২: شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ শব্দটির অর্থ কী, তার ব্যবহার জায়েয নাকি না-জায়েয?
❏ প্রশ্ন-১৬৩: শীশ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং অর্থ কী? 
❏ প্রশ্ন-১৬৪: ‘শায়খ’ শব্দের ব্যাখ্যা কী এবং ‘শায়খ’ কাকে বলা হয়?
❏ প্রশ্ন-১৬৫: দস্তারবন্দি মাহফিল আয়োজন করার বিধান কী? 
❏ প্রশ্ন-১৬৬: اُم الولد ‘উম্মুল ওয়ালাদ’ কাকে বলা হয় এবং এর সংজ্ঞা ও বিধান কী?
❏ প্রশ্ন-১৬৭:  امّ هانىউম্মে হানীর মূল বা প্রকৃত নাম কি? হুযূর   তাঁর ঘর হতে কিভাবে মি‘রাজে গেলেন?
❏ প্রশ্ন-১৬৮: হযরত উম্মে সালমা কে ছিলেন? তার ব্যাপারে কিছু আলোচনা কর।
❏ প্রশ্ন-১৬৯: ‘জাম্উল জামা’ কাকে বলা হয়?


তা‘যিমী সিজদার বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১১৫: সিজদায়ে তা‘যিমী বা কবর সিজদা করার প্রকার কতটি এবং তা বিস্তারিত আলোচনা কর। 

✍ উত্তর: কবরকে সামনে রেখে সিজদা তিন প্রকার:-
এক. কবরকে সামনে রেখে সিজদা করা- যদি কবর এবং সিজদাকারীর মাঝখানে কোন আড়াল বা পর্দা না থাকে তাহলে মাকরূহে তাহরিমী। এতে সিজদাকারী গুনাহগার হবে। 
দুই. কবরকে সিজদায়ে তা‘যিমী করা হারাম। এতে সিজদাকারীর তাওবা করা আবশ্যক। 
তিন. ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করা শির্ক। এতে সিজদাকারীকে নতুনভাবে ঈমান আনতে হবে। কেউ কেউ সিজদায়ে তা‘যিমীকেও শির্ক বলেছেন। 
অতএব, যে কোন কবরকে সিজদা করা থেকে বিরত থাকা উচিত এবং যারা সিজদা করে তাদেরকে বাধা দিতে হবে। এর জন্য তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার উপদেশ দেয়া উচিত। ফতোয়া হিন্দীয়াতে আছে, 

من سجد للسلطان علٰى وجه التحية او قبل الارض بين يديه لايكفر ولكن يأثم لارتكا به الكبيرة وهو المختار . وقال ابو جعفر رحمة الله وان سجد للسلطان بنية العبادة او لم يحقر النية فقد كفر، كذا فى جوهر الاخلاطى .
وفى الخلاصة ومن سجد لهم اراد به التعظيم كتعظيم الله سبحانه وتعالٰى كفر. وان اراد به التحية اختار العلماء انه لايكفر . اقول هذا هو الاظهر . 

‘কেহ বাদশাহ এর সম্মানার্থে মাথানত বা সিজদা করলে কিংবা তাঁর সামনে জমিন চুম্বন করলে কাফির হবে না, তবে কবিরা গোনাহ হবে। এটাই উত্তম অভিমত। ইমাম আবু জাফর তাহাবী বলেন, ইবাদতের নিয়তে বাদশাহকে সিজদা করলে অথবা নিয়তে পোক্ত থাকলে কাফির হয়ে যাবে।"
157. ফাত্ওয়া হিন্দিয়া, খন্ড-৫, বাদশাহর সঙ্গে মোলাকাত অধ্যায়। অনুরূপ জাওহারুল আখলাতীতে রয়েছে।

খোলাছা গ্রন্থে আছে, যারা আল্লাহর মত সম্মান প্রদর্শন করে সিজদা করে তারা কাফির হবে। আর স্বাভাবিক সম্মান প্রদর্শন করলে কাফির হবে না, এটাই উত্তম মত।’ 
158. শরহে ফিকহে আকবর, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কুফরী পরিচ্ছেদ; রদ্দুল মুহতার, কিতাবুল কারাহিয়া, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮৩

❏ প্রশ্ন-১১৬: কোন ওলি, সুফি বা আলিমের সামনে সিজদা করার হুকুম কী?

✍ উত্তর: ইসলামী সকল কিতাবসমূহে লিখা আছে যে, আল্লাহ্ ব্যতীত যে কোন ওলি, পীর-মুর্শিদ ও সুফির সামনে সিজদা করা হারাম। ফুকাহা-ই কিরাম একথাও বলেছেন যে, মহান আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো সামনে ইবাদতের নিয়্যতে সিজদা করলে, সিজদাকারী কাফির হয়ে যাবে। যদি তা‘যিম বা সম্মানের উদ্দেশ্যে সিজদা করে থাকে, তাতেও ফাসিক হবে।
মানুষ মানুষকে সিজদা করার সর্বপ্রথম কুপ্রথা চালু করেন ফেরআউনের উজির হামান। তিনিই সর্বপ্রথম মিশরের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ফেরাউনকে সিজদা করেছিলেন এবং ফেরাউনের জন্য সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন।
আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত সা‘দ (رضى الله تعالي عنه)-এর ছেলে কুফার নিকটবর্তী একটি শহর ‘হিরা’য় গিয়েছিলেন, সেখানে দেখতে পেলেন, লোকেরা তাদের সরদার বা দলপতিকে সিজদা করছে। সা‘দ বলেন, তখন আমি মনস্থ করলাম যে, রাসূল (ﷺ)ই সিজদার অধিক হকদার। সুতরাং আমি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট এসে আরয করলাম যে, আমি হিরা শহরে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, লোকেরা তাদের সরদারকে সিজদা করছে। অথচ আপনিই সিজদার অধিকতর হকদার। তাই আমরা আপনাকে সিজদা করতে চাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ভাল! তোমরা আমার কবরের পার্শ্বদিয়ে যাওয়ার সময় কী উহাকে সিজদা করবে? আমি আরয করলাম, না। তখন আল্লাহ'র প্রিয় হাবীব (ﷺ) বলেন, এমন করো না। আমি যদি কাউকে সিজদা করার হুকুম দিতাম, তাহলে স্ত্রীদেরকে স্ব-স্ব স্বামীকে সিজদা করার হুকুম দিতাম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা স্বামীর হক স্ত্রীর ওপর রেখেছেন।
কোরআন মজীদের ৪১তম সূরার নামও সিজদা। যা এভাবেই আরম্ভ হয়েছে حـٰـمٓ । এ হুকুম রাহমানুর রহীম মহান আল্লাহ'র পক্ষ হতে ঘোষণা করা হয়েছে। 
একথা প্রতীয়মান হয় যে, ফিরিশতারা হযরত আদম (عليه السلام)কে যে সিজদা করেছিলেন, তা হযরত আদম (عليه السلام)-এর জন্য ছিল না বরং তা ছিল মূলতঃ আল্লাহর হুকুম পালনার্থে। যা আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় কুদরতের একটি নতুন পদ্ধতি ও নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ হযরত আদম (عليه السلام)কে পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে সৃষ্টি করার প্রেক্ষাপটে তাদেরকে হুকুম দিয়েছিলেন।
অনুরূপভাবে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)কে তাঁর ভাইয়েরা যে সিজদা করেছিলেন, তা মূলতঃ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যে তাদের ভুল ও অপরাধকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তার শুকরিয়া হিসেবে মহান আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে সিজদা করেছিলেন। সারকথা হচ্ছে, যে কোন ব্যক্তির কোন প্রকারের সিজদা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা জায়েয নেই।
হ্যাঁ! কোন আলিম বুযূর্গ ও আল্লাহর ওলির হাত-পা চুম্বন করা এবং মা-বাবা কিংবা তাদের কবরকে চুম্বন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। যা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।



বিবাহের বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১১৭: দ্বিতীয় বিবাহ কাকে বলে? বিস্তারিত আলোচনা কর?

✍ উত্তর: যদি স্ত্রীকে এক তালাক বা দুই তালাক দেয়ার পর ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর নিজ স্বামীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার আক্বদ নিকাহ করার নাম- দ্বিতীয় নিকাহ বা বিবাহ। আর এটা জায়েযও আছে। যদি তিন তালাক দেয়া হয়, তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে তার সঙ্গে সহবাস করার পর যদি সে তালাক দিয়ে দেয় এবং ইদ্দত শেষ হয়ে যায়, তবে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ জায়েয হবে। অন্যথায় প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ শুদ্ধ হবে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَنْ يُقِيْمَا حُدُودَ للهِ.

‘যদি স্বামী স্ত্রীকে তিন তালাক প্রদান করে, অতঃপর স্ত্রী যতক্ষণ দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রথম স্বামী তার জন্য হালাল বা বৈধ হবে না। হ্যাঁ! যদি দ্বিতীয় স্বামী সহবাসের পর তাকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য কোন গোনাহ হবে না। অতঃপর দ্বিতীয় বিবাহের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি ফিরে যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, তারা উভয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার নির্ধারিত বিধি-বিধানের ওপর অটল থাকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে।"
159. সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৩০।

হিন্দুদের মধ্যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল এবং বর্তমানেও আছে যে, বিধবা মহিলাদের দ্বিতীয় বিবাহ-শাদীর সুযোগ দেয়া হয় না। এ হতভাগা মহিলারা এমনিতেই ঘরের আন্দর মহলে একাকিত্ব জীবন কাটাতে হয় এবং জীবনের মূল্যবান সময় ও আশা-ভরসা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যেও এমন কিছু সম্প্রদায় রয়েছে যারা নিজেদেরকে উচ্চ পর্যায়ের ভদ্র, সভ্য ও কৃষ্টিমনা মনে করে থাকে। তারা হিন্দুদের এই কুপ্রথাকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করে। একথা তারা কখনো চিন্তাও করেনি যে, ইসলামে বিধবাদের সম্পর্কে কী বিধান রয়েছে। অথচ পবিত্র হাদীস শরীফে এসেছে যে, তোমরা বিধবাদের খুব তাড়াতাড়ি বিবাহের ব্যবস্থা করো।

❏ প্রশ্ন-১১৮: গোপন বিবাহ কাকে বলে?

✍ উত্তর: গোপনীয়ভাবে বিবাহ হওয়াকে نكاح السّر বা গোপন বিবাহ বলে। আর গোপন বিবাহ হচ্ছে যা লোকসমাজে প্রকাশ্যভাবে ও জানাজানি করে করা হয়না।

❏ প্রশ্ন-১১৯: নিকাহ অর্থ কি? নিকাহ কাকে বলে?

✍ উত্তর: নিকাহ অর্থ- মিলানো, একত্রিত করা। শরীয়তের পরিভাষায় একজন পুরুষ অপর মহিলার সঙ্গে যৌন মিলনের উপকারিতা উপভোগ করার লক্ষ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে নিকাহ বলা হয়। অথবা একজন পুরুষ ও একজন মহিলা পরস্পর সুখে-শান্তিতে ও মনোতুষ্টি নিয়ে বসবাস করা এবং সন্তানদের মা-বাবা হওয়া এবং জীবনের প্রয়োজনে পরস্পর সহযোগিতা প্রসারিত করার নিমিত্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে নিকাহ বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় বিবাহ করা সুন্নাত এবং কামভাব প্রবল ও নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত হলে বিবাহ করা ওয়াজিব। 
160. কান্যুদ্ দাক্বাইক্ব।

ওয়ালিমা এবং যিয়াফতের বর্ণনা-


❏ প্রশ্ন-১২০: ওয়ালিমা কাকে বলে? ওয়ালিমা অর্থ কী?

✍ উত্তর: ওয়ালিমা শব্দটি ايتلام থেকে নির্গত। ايتلام অর্থ- একত্রিত হওয়া। কেননা এটা স্বামী-স্ত্রী একত্রিত হওয়ার সময় খাওয়ানো হয়, তাই এটাকে ওয়ালিমা বা বৌ-ভাত বলা হয়। অতএব, ওয়ালিমা সে ভোজ্যানুষ্ঠানকে বলা হয়, যা বিবাহ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। অধিকাংশ ওলামার মতে, ওয়ালিমা সুন্নাত। কারো মতে, মুস্তাহাব। আর কেউ কেউ ওয়াজিব বলেছেন।
ওয়ালিমা সম্পর্কে ওলামাদের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। কারো মতে, স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাতের পরের খাবারই ওয়ালিমা। কেউ বলেন, আক্দের সময় খাবারকে ওয়ালিমা বলে। আবার কারো মতে, আক্দের সময় এবং স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাতের পর- উভয় খাবারের নাম ওয়ালিমা। তবে গ্রহণযোগ্য অভিমত হলো- বিবাহোত্তর স্বামীর সামর্থানুযায়ী বৌ-ভাত খাওয়ানোকে ওয়ালিমা বলে।

❏ প্রশ্ন-১২১: যিয়াফত বা ভোজ্যানুষ্ঠান কী? এবং কখন হতে এর প্রচলন শুরু হয়?

✍ উত্তর: هوالمستعان ‘মজমাউল বাহার’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, যিয়াফত হচ্ছে সে খাবার যা কোন কারণ ছাড়া কেবল যিয়াফত ও আতিথিয়েতার উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয় এবং এটা মুস্তাহাব।

যিয়াফত আট প্রকার:
১.ওয়ালিমা: যা বিবাহ উপলক্ষে করা হয়।
২.খুর্স: যা নবজাত শিশুর জন্মের খুশিতে করা হয়।
৩.ই‘যার (اعذار): খৎনা বা মুসলমানী উপলক্ষে যে খাবার প্রস্তুত করা হয়।
৪.নতুন ঘর নির্মাণ উপলক্ষে তৈরীকৃত খাবার।
৫.নকী‘য়াহ (نقيعه): মুসাফির সফর থেকে ফিরে আসার পর তৈরীকৃত খাবার। যা মুসাফির নিজে তৈরী করুক বা অন্য কেউ তার আগমনে তৈরী করুক।
৬.ওযীমাহ (وضيمه): বিপদের সময় তৈরীকৃত কাঙ্গালীভোজ।
৭.আক্বীক্বা (عقيقة): নবজাত শিশুর নামকরণের সময় তৈরীকৃত খাবার।
৮.মা’দাবাহ (مأدبه): যা কোন উপলক্ষ ছাড়া শুধু মেহমানদারী আতিথিয়েতার জন্য তৈরীকৃত খাবার। 

উপরোক্ত সকল প্রকারের খাবারের ব্যবস্থা করা সুন্নাত। কারো মতে, ওয়ালিমা খাওয়ানো ওয়াজিব। তবে বিশুদ্ধ মতে ওয়ালিমা সুন্নাত। হুযূর মুহাম্মাদুর  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এবং সকল সাহাবা-ই কিরাম তা করতেন।
কতেক ওলামার মতে, ওয়ালিমাতে যাওয়া ওয়াজিব। না গেলে গুণাহগার হবে। আবার কারো মতে, মুস্তাহাব। খাবার খাওয়া আবশ্যক নয়, অপারগ হলে না খেলেও অসুবিধা নেই।  
161. ইসলামী মা‘লুমাত, খন্ড-২, পৃষ্ঠা- ৭৯৮।


ওলির বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১২২: ‘ওলি’ অর্থ কী? ওলি কাকে বলে? এবং ওলির সংজ্ঞা কী?

✍ উত্তর: ওলি (ولى) অর্থ- বন্ধু, সহচর, ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ। ওলি (ولى) এটা فعيل ,এর ওযনে فاعل তথা কতৃকারক অর্থে ব্যবহৃত। শাব্দিক অর্থ- বন্ধু ও সহচর। পরিভাষায় ওলি বলা হয়, যার মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে আনুগত্য পাওয়া যাবে এবং মাঝখানে কোন ধরনের গুণাহ পাওয়া যাবে না। অথবা এটা مفعول তথা কর্মকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা ওই ব্যক্তি উদ্দেশ্য- যার ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহ'র অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে। 
ওই ব্যক্তিকেও ওলি বলা হয়, যিনি আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখেন, ইবাদতে সর্বদা নিমগ্ন থাকেন, সর্বদা পাপাচার ও গুণাহ থেকে বেঁচে থাকেন এবং জৈবিক চাহিদা, কামভাব ও কুপ্রবৃত্তি পরিহার করেন।
ولى একবচন, বহুবচনে اولياء আসে। কোরআন মজিদে শব্দটি এভাবে এসেছে,

أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ .

‘আল্লাহ্ তা‘আলার অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী খাস বান্দা সম্পর্কে সাবধান যে, কিয়ামত দিবসে তাঁরা এমন নিরাপদে থাকবেন যে, তাদের না কোন ভয়-ভীতি থাকবে আর না তারা চিন্তিত ও ব্যথিত হবেন।’ 
162. সূরা ইউনুস, আয়াত: ৬২।

الولى ‘আল-ওলিয়্যু’ আল্লাহ্ তা‘আলার একটি গুণাহবাচক নামও। কেননা আল্লাহ্ ঈমানদার, পরহেজগার ও খোদাভীরুদের বন্ধু এবং তিনি তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন, একারণে তাদেরকে ওলি বলা হয়।
ولى শব্দটি متولى অর্থেও আসে। যার অর্থ অভিভাবক ও ব্যবস্থাপক। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা পূণ্যবান ও নেককার ব্যক্তিদের কার্যাদির متولى বা ব্যবস্থাপক। ولى শব্দটি নিকটবর্তী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত পূণ্যবানদের নিকটতম হয়ে থাকে।




মাযার সমূহের ওপর ঘর নির্মাণ করার বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১২৩: আউলিয়া-ই কিরামের মাযারসমূহের ওপর ভবন বা ঘর নির্মাণ করা কেমন? অথচ স্পষ্ট বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা এর নিষেধ করা হয়েছে। মসজিদসমূহ অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বিশাল আকারের এবং এতে গম্বুজ ও বিভিন্ন প্রকারের আকর্ষণীয় স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্য দ্বারা সুসজ্জিত করে নির্মাণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কি-না? অথচ হাদীস শরীফে এরকম কারুকার্য মাকরূহ বলা হয়েছে। কারণ যাতে মুসলি­দের ধ্যান কারুকার্যের সৌন্দর্য্যের দিকে ধাবিত না হয় অথবা অযথা অর্থের অপচয় না হয়। অনুরূপভাবে মসজিদের ওপর গম্বুজ নির্মাণ করার বিধান কী?

✍ উত্তর: আউলিয়া-ই কিরামের মাযার এবং মসজিদ সমূহের সুউচ্চ ইমারত বর্তমানে সেগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং দূর-দূরান্ত থেকে এই ইসলামি নিদর্শনসমূহের ওপর অবহিত হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে এটাই অন্যতম কারণ। তাছাড়া তা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে মানুষের মাঝে যে নিত্য নতুন অবস্থার সৃষ্টি হতে চলেছে, অনুরূপভাবে তাদের জন্য ফতোয়াও নতুন নতুন হচ্ছে। বর্তমানে মুসলিম এবং কাফিরসহ সকল জাতি নিজ নিজ বাড়ী-ঘর সুউচ্চ ইমারত ও অট্টালিকা তৈরীর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। আর আমরা মুসলমানরা যদি আকর্ষণীয় উচ্চ ইমারতের মাঝে কাঁচা ইটের নিচু দেয়ালের মসজিদ নির্মাণ করি অথবা তালিজোড়া দিয়ে ঝোপড়ির ন্যায় তৈরী করা হয় এবং আকর্ষণীয় গম্বুজ এবং সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করা না হয়। এতে বিশেষ করে অমুসলিমদের দৃষ্টিতে তা হেয়প্রতিপন্ন হবে। আর মসজিদের অবমূল্যায়ন করা মানে পক্ষান্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের অবমাননা ও অবমূল্যায়নের শামিল। যা পবিত্র শরীয়তের দৃষ্টিতে কখনো পছন্দনীয় নয়।
এই পবিত্র দলিল ও মর্যাদাপূর্ণ নিদর্শনের কারণে মুসলিম জাতিসত্তার সম্মান রক্ষার্থে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ইমাম ও ওলামায়ে কিরাম এগুলোকে জায়েয বলেছেন। যা বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে নিদ্বির্ধায় প্রচলিত নিয়ম-নীতিতে পরিণত হয়েছে। 
ماراه المسلمون حسنا فهو عند الله حسن -এর অন্তভুর্ক্ত হয়েছে।

‘জওয়াহিরে ইখলাতি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,

وان كان احداثا فهو بدعة حسنة وكم من شئ كان احداثا وهو بدعة حسنة وكم من شئ يختلف باختلاف الزمان والمكان .

যদিও এটা নতুন আবিষ্কার। তবুও بدعة حسنة বা ভাল আবিষ্কার। এমন অনেক বস্তু রয়েছে যা নতুন আবিষ্কার, অথচ উহা উত্তম বিদআত বৈ আর কিছু নয়। অনেক বিধান এমনও আছে যা স্থান-কাল পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত হয়, এমতাবস্থায় পূর্বযুগের বিধানাবলী থেকে দলিল পেশ করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। যুগের চাহিদা অনুপাতে হুকুম প্রদান করা উচিৎ। যেমন- উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) বলেছেন যে, যদি  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বর্তমানে মহিলারা যেসব কর্মকান্ড বের করেছেন তা উপলব্ধি করতেন, তা হলে তাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন। যেমনিভাবে বনি ইসরাঈলের মহিলাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। পরিশেষে আইম্মায়ে কিরাম ও মুহাক্কিক আলিমগণ মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। অথচ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার বন্দিনীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করিও না।" 
163. সহীহ মুসলিম।

আইম্মা-ই কিরাম এবং ওলামায়ে মুহাক্কিকীনরা যুগের চাহিদা মোতাবেক অবস্থার প্রেক্ষাপটে যে হুকুম প্রদান করেছেন, তবে এটাকে কী হাদীসের বিপরীত বলা যাবে? এটা কখনো হতে পারে না? আল্লাহ্ না করুক, এমন কথা নির্বোধ ও বোকা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। এ জন্যে আউলিয়া-ই কিরামের মাযার সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামগণ যে ফতোয়া দিয়েছেন তা যুগের মুহাক্কিক হযরত আল্লামা ইউসুফ নাব্হানি (رحمه الله تعالي ) ‘মাজমাউ বিহারুল আনওয়ার’ গ্রন্থের তৃতীয় খন্ড বলেছেন, 

قد اباح السلف البناء علي قبور الفضلاء الاولياء والعلماء ليزورهم الناس ويستريحون فيه .

‘নিশ্চয়ই পূর্ববর্তী ইমামগণ সম্মানিত আউলিয়া ও ওলামায়ে কিরামের যিয়ারতের স্থানে মাযার ও অবকাঠামো নির্মাণ করা বৈধ বলে ফতোয়া প্রদান করেছেন। যাতে লোকজন তাঁদের কবর যিয়ারত করতে পারে এবং তাতে প্রশান্তি লাভ করে। সলফে সালেহীন তথা পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের পবিত্র আত্মাসমূহ শা‘আয়িরুল্লাহ বা আল্লাহ'র নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান পূর্ণমাত্রায় ছিল। বাহ্যিক শান-শওকত, সম্মান-প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্যতার মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তাদের সময় এগুলো ছিল অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। প্রত্যেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় মাকরূহ এবং এতে অর্থ ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
বর্তমান যুগে বাহ্যিক শান-শওকত, জাকজঁমক ও আড়ম্বরতা ব্যতীত সাধারণ মানুষের অন্তরে মর্যাদার স্থান পাওয়া যায় না বিধায় উক্ত বিষয়াদির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেমন- কোরআন শরীফের ওপর অক্ষর স্বর্ণখচিত করার অনুমতি হয়েছে, মসজিদ সমূহে সোনালী গম্বুজ এবং স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা কারুকার্য করার অনুমতি হয়েছে এবং আউলিয়া-ই কিরামের মাযারে চাদর, গিলাফ পরিধান করা এবং আলোক সজ্জা করার অনুমতি হয়েছে। সে ভিত্তিতে তাঁদের মাযারে গম্বুজ নির্মাণের বৈধতার হুকুম দেয়া হয়েছে। উপরোক্ত সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেও বর্ণিত হাদীস এবং প্রাথমিক যুগের বিধানাবলী পেশ করা মূর্খতা ও নিবুর্দ্ধিতা ছাড়া আর কি হতে পারে? উক্ত ইমারত নির্মাণের ফলে মাটি ও ইট-পাথরের প্রতি কখনো সম্মান প্রদর্শন হতে পারে না, বরং আল্লাহ্ পাকের নৈকট্য লাভে ধন্য এবং তাঁর প্রিয় বান্দার পবিত্র আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন উদ্দেশ্য। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ। আর আমলের ভিত্তি নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইমাম আবদুল গণি নাবুলুসী (رحمه الله تعالي ) তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ববিখ্যাত ‘হাদিকাতুন নাদিয়্যাহ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 

تعظيما لروحه المشرفة على نواب جسده الخ .

অর্থাৎ- আউলিয়া-ই কিরামের মাযার শরীফে আলোক সজ্জা করা, তাঁর পবিত্র আত্মার প্রতি সম্মান জ্ঞাপনার্থে। যা স্বীয় শরীর মোবারকের সাথে মিলিত মাটিতে আকাশের সূর্যের ন্যায় আলোকরশ্মি দান করছেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, এখানে কোন ওলি-আল্লাহ'র মাযার আছে। ফলে এখান থেকে বরকত হাসিল করতে পারবে এবং সেখানে গিয়ে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে, তার দু‘আ কবুল হবে। যেমন, ইমাম শাফেঈ (رحمه الله تعالي ) হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) এর মাযার শরীফে গিয়ে তাঁর পবিত্র কবর সামনে রেখে দু‘আ করতেন, যা তিরয়াক্ব পাথরের ন্যায় অতি দ্রুত কবুল হতো। হযরত আবদুল গণি নাবুলুসি (رحمه الله تعالي ) সকল প্রশ্নের উত্তর ওই দু’টি শব্দের দ্বারা দিয়ে দিয়েছেন যে, تعظيما لروحه উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহ'র প্রিয় মাহবুব বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন; মাটি, ইট ও পাথরের নয়। তাই উক্ত সম্মান প্রদর্শনকে ইবাদত আখ্যা দেয়া এবং নৈকট্যকে ইবাদত বন্দেগী মনে করা মানে হাজার হাজার আল্লাহর ওলি ও বুযূর্গানে দ্বীনকে শিরক ও কুফরীর সাথে লিপ্ত করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কুধারণা থেকে রক্ষা করুন। যেমন- তাবুতে সকিনার কাহিনী আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজিদে উল্লেখ করেছেন। ফলে স্পষ্টতঃ একথা প্রতীয়মান হয় যে, বুযূর্গানে দ্বীনের তাবার্রুকাতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক। তাঁদের বরকতে মানুষের দু‘আ কবুল এবং হাজত পূর্ণ হয়। আর তাবাররুকাতের অবমাননা করা পথভ্রষ্টতারই কাজ এবং যা ধ্বংস হওয়াকে আবশ্যক করে। 
164. তাওযীহাত-ই হাফত মাসআলা, পৃষ্ঠা-২২২।

আউলিয়া-ই কিরামের মাযারের ওপর গম্বুজ নির্মাণ সম্পর্কে আল্লামা গোলাম দস্তগীর কুরাইশী হাশেমী (رحمه الله تعالي ) ‘তারীখে মক্কা মুয়ায্যমা’ গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, আমার তত্ত্বাবধানে ‘তোহাফায়ে ওহাবী’ নামক একটি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে।
النَّاسُ عَلٰى دِيْنِ مُلُوْكِهِمْ . বাক্যের সত্যতা দেখুন যে, হিন্দুস্তান ও বাংলার ওহাবীরা প্রাথমিক যুগে বা প্রথম প্রথম তাদেরকে ওহাবী বললে খুব রেগে যেত এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতো। কিন্তু বর্তমানে তারা অত্যন্ত গর্বের সাথে কিতাবের নাম ‘তোহফাতুল ওহাবীয়্যাহ’ রাখছেন। নজদীরা হিজাযে এসে হিন্দী আহলে হাদীসের জন্যে ওহাবী শব্দটির উপাধি ও সম্বোধন অত্যন্ত সম্মানের ফাঁদে ও তোড়ায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে ওহাবী শব্দটি তাদের জন্য গালিগালাজ ও বদনাম ছিল।
‘তোহফাতুল ওহাবীয়্যাহ’ গ্রন্থের ৫৯ পৃষ্ঠায় লিখা আছে যে, সালেহীন ও বুযূর্গানে দ্বীনের কবরের ওপর যে গম্বুজ ও মীনার নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোও এক প্রকারের মূর্তি। অথচ কোরআন মজিদে মূর্তি ও প্রতিমাগুলোকে নাপাক ও অপবিত্র বলা হয়েছে। লোকেরা এগুলো হতে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দু‘আ করে থাকে। তাই এগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। নজদিরা বুযূর্গানে দ্বীনের মাযারসমূহ যা যিয়ারত করা ওয়াজিব, এগুলোকে মূর্তির সাথে তুলনা করে এবং নাপাক ও অপবিত্র বলে জঘন্যতম অপরাধ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও বেআদবী করেছে। আমরা কাউকে কখনো কবর থেকে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রার্থনা করতে দেখিনি এবং শুনিনি বরং সাহেবে মাযার আউলিয়া-ই কিরামকে উসিলা বানিয়ে মুনাজাত করে থাকে। কবরসমূহকে ইমারত দ্বারা হিফাযত ও সংরক্ষণ করার বিষয়টি নবুয়তের যুগ এবং সাহাবা-ই কিরামের যুগ থেকে প্রমাণিত আছে

১. হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম(ﷺ)ইন্তিকালের স্থান উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها)-এর হুজরায়, সেখানেই তাঁর রওজা শরীফ।

২. হযরাত আম্বিয়া-ই কিরামের পর সর্বোত্তম মানব হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضى الله تعالي عنه)-এর মাযার শরীফও হুযূর(ﷺ)-এর একই ছাদযুক্ত স্থানে হয়েছে।

৩. হযরত ফারুকে আযম ওমর (رضى الله تعالي عنه)-এর ইন্তিকাল নিকটবর্তী হলে তিনি অসিয়ত করেন যে, আমাকেও হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম   ও সিদ্দীকে আকবর (رضى الله تعالي عنه)-এর পাশেই পবিত্র হুজরা শরীফে যেন দাফন করা হয়।

৪. উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা (رضى الله تعالي عنها)কে ৩৮ হিজরীতে মক্কা মকার্রমা থেকে দশ মাইল দূরে অবস্থিত শরফ নামক স্থানের ওই ঘরে দাফন করা হয়, যেখানে তিনি হুযূর(ﷺ)-এর সাথে বাসর ঘরে আরাম করেছিলেন। 
165. তিরমিযী শরীফ, باب ترويج المحرام , খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১১০।

যে ঘটনাটি হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)-এর খিলাফতকালে সংঘটিত হয়। যার সম্পর্কে নজদীরা প্রচার করে যে, তাঁকে উঁচু কবরসমূহ বিলীন করে দেয়ার হুকুম দেয়া হয়েছিল। পক্ষান্তরে এ হুকুমটি ছিল মুশরিকদের কবর সম্পর্কে। একথার ওপর কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই যে, তিনি কোন মুসলমানের কবর বিলীন করে দিয়েছিলেন। 
166. জওহরুন নক্বী, পৃষ্ঠা-২৬৫।

বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, হুযূর   হযরত ওসমান বিন মাযউন (رضى الله تعالي عنه)-এর কবরের ওপর অনেক বড় পাথর দিয়ে উঁচু করে দিয়েছিলেন। যাতে হুযূর সৈয়্যদে ‘আলম(ﷺ)-এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সাহাবা-ই কিরামের কবর তাঁর পাশে দেয়া যেতে পারে।
আফসোস! পরিতাপের বিষয়!! নজদিরা সে সকল কবরসমূহ যা মদিনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাক্বীতে ছিল, সব কবরই বিদীর্ণ ও চুরমার করে বিলীন করে দিয়েছে। প্রথম দিকে কবরসমূহের ইমারতের চারিপার্শ্ব সাধারণ কাঁচা ইট দ্বারা নির্মিত ছিল। ক্রমান্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে ধন-দৌলত দান করেন। ফলে তারা মসজিদ সমূহকে পাকা ও কারুকার্য দ্বারা শোভাবর্ধন করেন। আর বুযূর্গানে দ্বীনের বিশ্রামস্থল ও মাযারকেও তাঁদের শান ও মর্যাদা অনুপাতে বিশাল ও জাঁক-জমকপূর্ণ করে তৈরী করেন। এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোন আলেমদ্বীন অভিযোগ উত্থাপন করেননি। এখানকার ভারত-বাংলার যে সকল ওহাবী মোল্লারা হজ্ব করতে যেতো তারাও ফিরে এসে কখনো উক্ত ইমারত ও নির্মাণকে নাজায়েয বলে ভেঙ্গে ফেলার ফতোয়া প্রদান করেননি। কিন্তু যখনই নজদিরা মক্কা মুয়ায্যমার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল, তখন থেকেই তারা ওই সকল বুযূর্গানে দ্বীনের শান-মান হ্রাস ও খর্ব করার নিমিত্তে তাঁদের পবিত্র মাযার ও নিদর্শনাবলিকে ভেঙ্গে বিলীন করে দিল।
কিন্তু হিন্দুস্থানের আহলে হাদীসরা অত্যন্ত কঠিন ভাষায় তাদের চরম বিরোধিতা করেছিলেন যে, এমন কখনো হতে পারে না। এতদ্সত্ত্বেও নজদি শায়খের বংশধরেরা তাদের হিংসাত্মক কার্যক্রম খুব দ্রুত বেগে প্রকাশ করল। তখন মসজিদ ও মাযার সমূহের বিভিন্ন নিদর্শনাবলী চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ভেঙ্গে দেয়ার পক্ষে জায়েয ফতোয়া প্রদানে তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সিলসিলা শুরু হয়। তখন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের আলিম-ওলামারা ফতোয়া প্রদান করতে থাকেন যেমন, সৈয়্যদুনা মাযহার হুসাইন লাহোরীসহ শীর্ষ আলিমরা, তখন তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রতি উত্তর আসেনি। বরং তাদের থিওরী ছিল যে, কারো কোন কথা শুনবে না এবং নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে এবং শায়খে নজদির মিশনকে সহযোগিতা ও বাস্তবায়ন করে যাবে।

❏ প্রশ্ন-১২৪: মাযারসমূহ গোসল দেয়া জায়েযের সপক্ষে কী কোন দলিল আছে?

✍ উত্তর: وبه نستعين মাযারসমূহ গোসল দেয়া জায়েযের সপক্ষে এতটুকু দলিলই যথেষ্ট যে, যারা এটাকে নাজায়েয বলেছে তাদের হাতেই বর্তমানেও পবিত্র কা’বা শরীফকে গোসল দেয়া ও গিলাফ লাগানো হচ্ছে। সুতরাং شعائرالله কে সম্মান প্রদর্শন বিশেষ করে আউলিয়ায়ে কিরামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন মূলতঃ বিশ্ব প্রতিপালকের প্রিয় বান্দাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনরই অন্তভুর্ক্ত।



কোন সম্মানী ব্যক্তির আগমনে দাঁড়ানো এবং 
না‘রা বা তাকবীর ধ্বনি দেয়ার বর্ণনা-



❏ প্রশ্ন-১২৫: কোন সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির আগমনে না‘রা বা তাকবীর দেয়ার বিধান কী?

✍ উত্তর: এটা সুন্নাত ও সওয়াবের কাজ। আর উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উত্তম আদর্শ ও ভদ্রতার পরিচায়ক। পবিত্র কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণকালে সৃষ্ট জটিলতা হুযূর   কর্তৃক নিরসন ও সমাধানের পর আনন্দিত হয়ে উপস্থিত সবাই না‘রা দেয়। যখন হুযূর এর বয়স ৩২ বছর তখন কুরাইশগণ কা’বা শরীফকে নতুন করে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেহেতু পূর্বের নির্মাণ এত সুদৃঢ় ও মজবুত ছিল না যে, বন্যার প্লাবন মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। আর পবিত্র কা’বাও ছিল তখন সকল গোত্রের উপসনালয়। সে কারণে সকলেই আগ্রহী ছিল যে, উক্ত পূণ্যময় নির্মাণ কাজের সৌভাগ্য অর্জন করবে। তাই প্রত্যেক গোত্রের লোকেরা ভাগাভাগি করে কা’বা শরীফের দেয়াল নির্মাণ করেন। কিন্তু ‘হাজরে আসওয়াদ’ নির্ধারিত স্থানে রাখার প্রাক্কালে চরম জটিলতা দেখা দেয় এবং বিরোধ ও ঝগড়া চরম পর্যায়ে চলে যাওয়ার কারণে যুদ্ধ বেধে যাওয়া উপক্রম হয়ে যায়। পরিশেষে কুরাইশ গোত্রের সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য ব্যক্তি আবু ইলাহিয়া ইবনে মুগীরা সিদ্ধান্ত দেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সবার আগে হেরম শরীফে প্রবেশ করবেন তিনিই উক্ত সমস্যার ফয়সালা করবেন এবং তিনিই উক্ত কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন। মহান আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছেও ছিল যে, কা’বা শরীফের নির্মাণ কাজ তাঁর প্রিয় হাবীব   এর মাধ্যমে সমাপ্ত ও পূর্ণতা দান করবেন।

সুতরাং আগামীকাল সকালে সর্বপ্রথম যিনি হেরেম শরীফে তাশরীফ নিলেন, তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রিয় হাবীব মোস্তফা(ﷺ)  । তাঁর আগমণে সকলেই খুশী হয়ে উচ্চস্বরে ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন এবং বলতে থাকেন- এসেছেন আল-আমীন অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তাদানকারী এসেছেন। তিনি যা সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সকলেই তা মেনে নেব। আর হুযূর (ﷺ) এমনভাবে সিদ্ধান্ত দিলেন যে, তা সকলেই সানন্দে গ্রহণ করেন এবং মেনে নেন।

❏ প্রশ্ন-১২৬: কোন মজলিসে সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে সমাবেশে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে হযরাত ওলামায়ে কিরামের মতামত কী? যা বর্তমানে প্রচলিত আছে। শরীয়তের বিধান মতে তা জায়েয কিনা? এটির ওপর কিয়াস করে মিলাদুন্নবী  -এর মাহফিলে দাঁড়িয়ে কিয়াম করার হুকুম কি? 
প্রথমতঃ মিলাদুন্নবী  -এর যিকির করার পর দাঁড়ানো। আর 
দ্বিতীয়তঃ সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে দাঁড়ানো। 
উভয়টি কিন্তু এক নয়। কোন প্রকারের পার্থক্য ছাড়া একই হুকুম আরোপ করা কী? বিস্তারিত বর্ণনা কর।

✍ উত্তর: عليه التكلان وهو المستعان কিয়াম শব্দের অর্থ দাঁড়ানো। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য সে কিয়াম যা কোন সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তির আগমনে করা হয়। যা বর্তমানে সুপরিচিত ও প্রচলিত আছে যে, কোন সম্মানিত ব্যক্তি মজলিসে প্রবেশ করলে সমাবেশে উপস্থিত সকলেই তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যায়।
এ সম্পর্কে ‘আশি‘আতুল লুম‘আত’ ৪র্থ খন্ডর ৮ম পৃষ্ঠায় শায়খ মুহাক্কিক হযরত মুহাদ্দিস আবদুল হক দেহলভী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন যে, উক্ত মাসআলার ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারো মতে, মাহফিলে প্রবেশকারীর সম্মানার্থে দাঁড়ানো সুন্নাত। তারা দলিল হিসেবে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদীসটি উপস্থাপন করেন। হুযূর মোস্তফা(ﷺ)   হযরত সা‘দ বিন মু‘আজ (رضى الله تعالي عنه)-এর আগমনে সাহাবা-ই কিরামদেরকে হুকুম দিয়েছিলেন-

قوموا الى سيدكم الخ

অর্থাৎ-‘তোমরা তোমাদের সরদার সা‘দের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও।’

কতেক আলেম বলেন, এটা মাকরূহ, বিদ‘আত ও নিষিদ্ধ। তারা দলিল হিসেবে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদীস পেশ করেন যে, হুযূর সৈয়্যদুল কাউনাইন (ﷺ) সাহাবা-ই কিরামদেরকে দন্ডায়মান হতে নিষেধ করেছেন এবং একথাও বলেছেন যে, তোমরা অনারব লোকদের মতো অন্যের সম্মানার্থে দাঁড়াইও না।
অবশ্য অত্র অধ্যায়ে উভয় প্রকারের হাদীস বিদ্যমান আছে। বর্ণিত আছে যে, কখনো হুযূর মোস্তফা(ﷺ)   হুকুম করেছেন এবং কখনো অবস্থার প্রেক্ষাপটে নিষেধও করেছেন। সুমহান উত্তম চরিত্রের অধিকারী হুযূর মোস্তফা(ﷺ)  -এর সাহাবা-ই কিরামগণও কখনো কারো সম্মানার্থে দাঁড়িয়েছেন আবার কখনো দাঁড়ান নি।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম উভয় হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্ব ও দ্বন্দ্ব এভাবে নিরসন করেছেন। কোন কোন ওলামা বলেছেন, এ সমাধান সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আসল কথা হলো, উভয় হাদীসের সমন্বয় এভাবে করা যায় যে, রাসূলে পাক   উম্মতকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে- بعثت لاتمم مكارم الاخلاق ‘আমি উত্তম চরিত্র পূর্ণতাদানের নিমিত্তে প্রেরিত হয়েছি।’ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকৃতির লোক। কেউ রয়েছেন উত্তম ও উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ তা‘আলা সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর অন্যরা তাদের মোকাবিলায় নিকৃষ্ট ও অধম। যাদেরকে এ সম্মান দেয়া হয়নি। স্বাভাবিকতঃ একথা স্পষ্ট যে, এ জাতীয় অবস্থার তারতম্যের কারণে স্বভাব-চরিত্রেও তারতম্য ও তফাত হওয়া আবশ্যক। যেমন- মুকীম বা স্থায়ী বসবাসকারীর হুকুম মুসাফিরের জন্য সমীচীন নয়। অনুরূপভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ফকির আর স্বাস্থ্যবান ও রোগীর জন্য একই বিধান কখনো প্রযোজ্য নয়। অনুরূপভাবে সম্মানিত ও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি; তাদের উৎকৃষ্টতা তাদেরকে নিম্নস্তরের লোকদের থেকে সম্মান প্রদর্শন কামনা করে। এমনকি তাদেরকে অহংকারী, দাম্ভিক ও আত্ম-পূজারী করে তোলে। তাই উৎকৃষ্টদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, অন্যদের থেকে সম্মান তালাশ করো না এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর অহংকার করো না। আর অন্যদেরকে শিক্ষা দিলেন যে, এ প্রকৃতির লোকদের তোমরা সম্মান করো না। যাতে মুসলমানদের মাঝে অধঃস্তনদের পক্ষ হতে সম্মান পাওয়ার মতো মহামারি ব্যাধি বিস্তার লাভ করতে না পারে। তাই হুযূর মোস্তফা (ﷺ)   প্রভূর পক্ষ হতে শিক্ষার ওপর ক্ষান্ত না হয়ে স্বয়ং নিজেই বাস্তব নমুনা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহর মহান রাসূল (ﷺ) হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় তা‘যিমের জন্য মানুষজন দন্ডায়মান হওয়াকে জায়েয রাখেন নি। এটা ছিল আল্লাহর প্রিয় হাবীব (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ের বিনয়-নম্রতা ও মিনতির সুস্পষ্ট প্রমাণ

الله اكبر وصلّى الله على سيدنا محمد وعلى اٰله واصحابه اجمعين-اللهم صل على سيدنا محمد صلّى الله عليه وسلّم ابدًا ابدًا.

হযরাত সাহাবা-ই কিরামগণ (رضى الله تعالي عنه) সৈয়্যদুল মুরসালীন মোস্তফা(ﷺ)  -এর তা‘যিম ও সম্মানার্থে এ কারণে দাঁড়াতেন না যে, হুযূর তা পছন্দ করতেন না। অথচ তাঁদের চেয়ে অধিক সম্মান হুযূর  -এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মতো আর কে আছে? কারণ তাঁরা ভয় ও আদব রক্ষার্থে হুযূর (ﷺ)-এর সামনে উচ্চস্বরে কথাও বলতেন না।
অবশ্য আমাদের একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিয়ামের অনুমতি এবং তা নিষিদ্ধকরণের হুকুম দুই শ্রেণীর লোককে সম্বোধন করে দেয়া হয়েছে। আর কিয়াম হচ্ছে সম্মান প্রদর্শনের একটি নিয়ম ও রীতি মাত্র। কিয়াম ছাড়াও আরো অনেক নিয়ম ও মাধ্যম রয়েছে যা অবলম্বনে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা যায়। ভদ্র, উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাবান লোকদের ক্ষেত্রে এটি অবলম্বন করা আমলযোগ্য ও অপরিহার্য বিষয়।
কিয়ামে তা‘যিমী তথা সম্মানার্থে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমাদের কিয়ামের কথাও স্মরণে এসেছে যে, যা মওলুদ শরীফের মাহফিলে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর বিলাদত শরীফের যিকিরের পর করা হয়। উক্ত কিয়ামের ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের মাঝে মতানৈক্য ও মতভেদ বৃদ্ধি পেয়ে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে উপনীত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে কম-বেশি, হ্রাস-বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত প্রত্যেক পক্ষেই আছে।
নিষ্পত্তি ও সমাধানমূলক কথা এই যে, হুযূর পাক (ﷺ) -এর বিলাদত শরীফের আলোচনা এটা যিকিরে মাহফিলের অন্তভুর্ক্ত। তবে শর্ত হলো জাল হাদীস এবং বানোয়াট ঘটনা যেন না হয়। যাতে বিশুদ্ধ হাদীসের রেওয়ায়েত ও সঠিক ঘটনার পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণিত হয় এবং হুযূর পাক  -এর বরকতময় জীবনের ঐ সকল দিকসমূহ বর্ণনা করা হয়, যার প্রেক্ষিতে মুসলমানদের স্বীয় জীবনের বিভ্রান্ত দিকগুলো সংশোধনের দিকে উৎসাহিত ও দৃষ্টি দিতে পারে। মহান আল্লাহর বাণী,

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ . 

আয়াতের বাস্তবতা প্রকাশ

167. সূরা তাওবা, আয়াত: ১২৮।




 সেমা’র বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১২৭: সেমা তথা ধর্ম-সঙ্গীত সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের অভিমত কি এবং এর ফয়সালার পদ্ধতি কি? বর্ণনা কর।

✍ উত্তর: هوالمستعان সুর সংযোজন করে সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত পরিবেশন করার মাসআলা প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াত ও পবিত্র হাদীস শরীফ পরস্পর বিরোধী ও বৈপরীত্য অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ . 

‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ 
168. সূরা লোকমান, আয়াত: ৬।

এই পবিত্র আয়াত সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে।
হযরত আবু উমামা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যখন কোন ব্যক্তি সুর ধ্বনি দিয়ে আওয়াজ উঁচু করে, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তার কাঁধের ওপর দু’জন শয়তান পাঠিয়ে দেন যারা তার বক্ষের ওপর গোড়ালী দ্বারা আঘাত করে, যাতে সে সুর সঙ্গীত থেকে ফিরে আসে। 
169. তাবরানী রচিত আল-কবীর।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা গায়িকা রমণী, তার ক্রয়ক্রিয়া, উপার্জন এবং শিক্ষা বিষয়কে হারাম করে দিয়েছেন। 
170. তাবরানী রচিত আওসত।

হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, গান বা সুর সঙ্গীত মানুষের অন্তরে পাপের জন্ম দেয়, যেমনিভাবে পানি ক্ষেত উৎপাদন করে। 
171. শু‘আবুল ঈমান।

গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার ব্যাপারে আরো অনেক দলিল রয়েছে। 
এখন সেমা বা সুর-সঙ্গীত মুবাহ হওয়ার দলিলসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ 
উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ সেমা, গান, সুর-সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এমনও কতিপয় হাদীস শরীফ রয়েছে যা এটি জায়েয ও মুবাহ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে তাশরিফ আনলেন, সে সময় দু’জন বালিকা আমার নিকট গান গাইতেছিল। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে।)
অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) তাঁর নিকট আসলেন। এমন সময় দু’জন বালিকা আমার নিকট দফ্ বা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিল। আর রাসূলুল্লাহ   তাঁর কাপড় দ্বারা মুখমন্ডল মুবারক ঢেকে রাখেন। তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) গায়িকা বালিকাদেরকে নিষেধ করেন। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেহারা মুবারক হতে কাপড় সরিয়ে বললেন, আবু বকর তাদেরকে ছেড়ে দাও। যেহেতু আজ খুশির দিন।
‘সবিলুর রাশাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, যখন রাসূলে পাক   মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ নিয়ে বনু নাজ্জার গোত্রে আরাম করছিলেন। তখন উক্ত গোত্রের মেয়েরা গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন

نحن جوار من بنى نجّار ۞  وحبذا محمد من جار .

‘আমরা হলাম বনি নাজ্জার গোত্রের রমণি। কি যে মুবারক ও সৌভাগ্যের কথা যে, আল্লাহ'র নবী মুহাম্মদ (ﷺ) হয়েছেন আমাদের প্রতিবেশী।’

ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) ‘দলাইলুন্ নবুয়ত’ গ্রন্থে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে হাদীস বর্ণনা করেন। যা হুযূর(ﷺ)তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় নাজ্জার গোত্রের রমণীরা নিম্নোক্ত কবিতা ছন্দাকারে পাঠ করার বর্ণনা রয়েছে। 

طلع البدر علينا ۞ من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينا ۞ ما دعى لله داع .

‘সনইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’
ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) তাঁর কবিতা চর্চা, দফ বাজানো এবং সুরেলা কন্ঠ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। 
মুহাম্মদ বিন হাতেব (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিবাহে সবাই দফ্ বাজাবে এবং গান-বাজনা করবে। 
172. জামে‘ তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফ।

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলে পাক(ﷺ)ইরশাদ করেছেন, উক্ত বিবাহের প্রচার কর। আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه) একদা এক নতুন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ঢোলের আওয়াজ শুনে জিজ্ঞেস করলেন যে, এখানে কি হচ্ছে কিসের শব্দ? উত্তরে বলা হলো, খৎনার উৎসব। তখন তিনি নিরবতা অবলম্বন করেন এবং নিষেধও করেন নি।
ফয়সালা: এখন যেহেতু সেমা বা সুর-সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে হালাল-হারাম নিয়ে বিপরীতমুখী দলিল এসেছে। তাই সৈয়্যদুনা ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) সতর্কতামূলক এটাকে হারাম বলেছেন। যেমন, উসূলে ফিকহের কায়েদা বা মূলনীতি হচ্ছে, দলিল পরস্পর বিপরীতমুখী হলে, তখন হারামকে হালালের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। এমনকি তিনি ওয়ালিমাতেও গান জায়েয রাখেন নি। 
173. হেদায়া-মাকরূহ অধ্যায়।

যে ব্যক্তি ওয়ালিমা কিংবা অন্য কোন যিয়াফতে আমন্ত্রিত হয়ে দাওয়াতে গিয়ে সেখানে গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধূলা দেখতে পান। তখন সেখানে বসে তার খাবার গ্রহণ করাতে কোন অসুবিধা নেই।
ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) বলেন, আমি নিজেই এরকম অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম, তবে আমি ধৈর্যধারণ করেছিলাম। হিদায়া গ্রন্থকার বলেন, উক্ত মাসআলা একথা প্রমাণ করে যে, খেলাধূলার সকল সামগ্রী হারাম। এমনকি বাঁশি বাজিয়ে গান করাও হারাম। এজন্য ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) ‘নিজে লিপ্ত হয়েছি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেননা ‘লিপ্ত হওয়া’ শব্দটি হারাম বিষয়ে ব্যবহার করা হয়।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (رحمه الله تعالي ) সুর দিয়ে গান করার ওই সকল হাদীসকে নিষিদ্ধ বলেছেন, যা শুধু গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধূলার আনন্দ উপভোগ করার নিমিত্তে করা হয় অথবা যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফিৎনা-ফাসাদের আশঙ্কা থাকে। আর যে সকল গান-বাজনা সৎ উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। যেমন, বিবাহের প্রচার করা কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন বিষয়ের ওপর করা হয়, তাঁর মতে এটা মুবাহ। হানাফী মাযহাবের কিতাবসমূহেও এমন বর্ণনা বিদ্যমান আছে। অতএব হিদায়া গ্রন্থের ‘কিতাবুল গজব’ অধ্যায়ে লিখা আছে যে, গাজীদের লুন্ঠিত মাল এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে দফ বা সুরেলা কন্ঠে গান-বাজনা করা মুবাহ। এগুলো নষ্ট করাতে দায়িত্বশীলতাকে আবশ্যক করে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) ‘ইহইয়াউল উলূম’ শরীফে বলেছেন যে, গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম সম্পর্কে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা ওই সকল গান-বাজনার ওপর প্রযোজ্য হবে, যা কেবল কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থের নিমিত্তে এবং রূপক ইশ্ক প্রেম দ্বারা শয়তানী চাহিদা ও উদ্দেশ্য পূরণে করা হয়। কিন্তু যে গান ও বাদ্যযন্ত্র আল্লাহর মুহাব্বত সৃষ্টি করে, তা সত্তাগতভাবে বৈধ ও মুবাহ। যখন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান-বাজনা দ্বারা আনন্দ উৎসব বৃদ্ধি পায়; এ রকম আনন্দ উপভোগ করা যদি মুবাহ ও বৈধ হয়, তাহলে গান-বাজনা করাও মুবাহ ও বৈধ।
সুতরাং ঈদের দিন, বিবাহের দিন, প্রিয়জনের আগমনের দিন, ওয়ালিমার দাওয়াতে, সন্তান জন্ম লাভের উৎসবে, আকীকাহ, সুন্নাতে খাৎনা এবং কোরআন মজিদ হিফজ সমাপ্ত হওয়ার দিন ইত্যাদি খুশির দিনে গান-বাজনা ও খেলাধূলা করা বৈধ ও মুবাহ। 
‘খযানাহ্’ ও ‘কাফি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি নিষিদ্ধের ভিত্তি শুধুমাত্র খেলাধূলার সাথে সীমাবদ্ধ। আর গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে করা হয় যেমন, বিবাহের সময়, ওয়ালিমায়, মুজাহিদদের বিজয়ে, সৈন্যবাহিনীর আগমনে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দা সুফি দর্শনে অনুসারীদের আত্মার কোমলতা সৃষ্টির লক্ষে যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সব ধরনের নিয়ম-পদ্ধতি অবলম্বন করা হানাফি মাযহাব মতে হারাম নয়।
ইম্সা‘ কিতাবে উল্লেখ আছে, গান ও ধর্ম-সঙ্গীত শুনাতে অন্তরের কোমলতা, আল্লাহভীতি এবং আল্লাহর দিদার লাভের আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার উদ্ভব হয় এবং আল্লাহ'র গজব ও আযাবের ভীতি সৃষ্টি হয়। অতএব যে কাজের ফলাফল ইবাদতই হয়। যদি গান-বাজনা শুনাতে অবস্থা যদি এরকমই হয়, তাহলে সেখানে খেলাধূলা ও অনর্থক কাজের স্থানই বা কোথায়?
আলিমকুল শিরোমণি অলিকুল সরদার হযরত সৈয়দ শায়খ সিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمه الله تعالي ) ‘আওয়ারিফুল মু‘আরিফ’ শরীফে বলেছেন, 

السماع يستحب الرحمة من الله الكريم 

‘সেমা আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত নিয়ে আসে।’

হযরত খাজায়ে খাজেগান খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (رحمه الله تعالي ) সেমা সম্পর্কে বলেন যে,  

ونہ انكار ميكنم ونہ ايں كار ميكنم 

অর্থাৎ ‘আমি এটাকে অস্বীকারও করিনা এবং আমি এটা নিজেও করি না।’

যেহেতু তার তরিকার ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে সুন্নাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, বিধায় তিনি তা করতেন না। নিঃসন্দেহে গান শ্রবণ করা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)এবং সাহাবা-ই কিরামের নিয়ম ও রীতি ছিল না। তাই তিনি নিষেধ করতে গিয়ে বলেন, نہ ايں كار ميكنم অর্থাৎ- ‘আমি এ কাজ বা আমল করি না’। আর যেহেতু তাঁর নিকট সেমা হারাম হওয়ার প্রমাণ ছিল না, তাই বলেছেন, نہ انكار ميكنم অর্থাৎ- ‘আমি অস্বীকারও করি না’। যদি তিনি হারাম মনে করতেন তাহলে অবশ্যই অস্বীকার করতেন। অতএব বলা যায় বিবাহ প্রচারকল্পে যদি দফ্ বাজানো হালাল বা মুস্তাহাব হয়ে থাকে, তাহলে ঢোল, সঁাতারা ও বাঁশী ইত্যাদি বাজানো দফের স্থলে তা হলে পার্থক্যটা কি? খেলাধূলা ও অনর্থক পাপাচারের ক্ষেত্রে সব কিছুই হারাম। আর সৎ উদ্দেশ্য ও পূণ্য কাজের জন্য সবই জায়েয।
বিবাহ-শাদীর প্রচার সকল কিছু দ্বারা করা যায়। দফ্ ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য করা এটা অযৌক্তিক কথা। বাদ্য-বাজনা ও গীত-বাঁশী বাজানো নিষিদ্ধ মেনে নিলেও তা অকাট্য দলিল দ্বারা হারাম নয়। কেননা কেবল অকাট্য দলিল কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াত, মুতাওয়াতির হাদীস এবং ইজমা-ই উম্মত দ্বারা প্রমাণিত হয়।
যদি বলা হয় যে, সেমা বা বাদ্যযন্ত্র সহকারে ধর্ম-সঙ্গীত পরিবেশন করা মুবাহ বা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে এটির আহ্ল বা উপযুক্ত হওয়া শর্ত। তবে এটা সত্য। কিন্তু বর্তমান যুগের অধিকাংশ দরবেশ লোক এটির আহ্ল বা উপযুক্ত নয়, বরং তারা বানোয়াট ও নামে মাত্র লোক দেখানো ওয়াজদ্ বা উম্মত্ততা প্রকাশ করে।
তার জবাব হচ্ছে, এমন কথা বলা উচিত হবে না যে, বর্তমান যুগে এমন লোক কেউ নেই, যারা এর উপযুক্ত। কেননা রাসূলুল্লাহ   ইরশাদ করেছেন, 

لا يزال من أمتي قائمة 

আমার উম্মতের মধ্যে বরাবরই এমন একটি দল প্রত্যেক যুগে বিদ্যমান থাকবেন যারা আল্লাহ'র হুকুমের ওপর অটল ও অবিচল থাকবে। তাদেরকে পরিত্যাগকারী কিংবা বিরোধীতাকারী ব্যক্তি তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তিনি   আরো বলেন, 

مثل امتى كمثل المطر لايدرى اوّلها او اخرها . 

‘আমার উম্মতের উদাহরণ ওই বৃষ্টি বারিধারা ন্যায়, যা সম্পর্কে ধারণা করা যায় না যে, এটির প্রথম উত্তম, না শেষাংশ উত্তম।’ 

জেনে রাখা আবশ্যক যে, আহলে ওয়াজদ বা খোদা প্রেমে আসক্তি তিন প্রকার:
প্রথমতঃ আহলে কামাল বা পূর্ণ উৎকর্ষতার অধিকারী দল। যাদের অন্তরাত্মায় আল্লাহ্ প্রেমের অযীফা ও যিকিরের সৃষ্টি হয় এবং যা তাদেরকে ইচ্ছাশক্তি বহির্ভূত ও ক্ষমতাহীন করে দেয়। এঁরা হচ্ছেন আল্লাহর দল। এঁদের অস্বীকার করা অবশ্যই দ্বীনের ক্ষতি সাধনকে আবশ্যক করে। 

দ্বিতীয়তঃ ওই সকল লোক যারা উত্তম অবস্থা সৃষ্টির লক্ষে গান-বাজনা ও ধর্ম-সঙ্গীত শুনেন এবং চেষ্টা করেন যে, উক্ত কর্মপন্থা অবলম্বন করে খোদা প্রেমের উত্তম অবস্থা অর্জন করা যায়। এটাও প্রশংসিত দল।
তৃতীয়তঃ ওই সকল লোক যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আবেগাপ্লুত ও ভাবোদ্দীপনার ভাব দেখায়, যাতে লোকেরা তাকে আহলে কামাল বা পূর্ণ উৎকর্ষতা অর্জনকারী লোক মনে করে। এরা হলেন ফাসিক, বদকার ও বিদ‘আতী।
ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, বানোয়াট ও লোক দেখানো ওয়াজদ্ বা ভাবোদ্দীপনা ভাব দেখানো এক প্রকার মন্দ ও নিন্দনীয়। আর তা হচ্ছে, বানোয়াটির মাধ্যমে লোক দেখানো অতীব ভদ্র ও প্রশংসিত অবস্থা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করা। আর এটা একদিক দিয়ে প্রশংসিত- যারা উক্ত অবস্থা অর্জন করার আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যয় নিয়ে এ পন্থা অবলম্বন করেন। তাদের উক্ত অবস্থা এ ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া এবং আধ্যাত্মিকতা অর্জন করা। কেননা অব্যাহত প্রচেষ্টা ও অর্জনের মাধ্যমে অবস্থার সৃষ্টি করার সফলতা আসে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সকল কোরআন তিলাওয়াতকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, কোরআন তিলাওয়াতের সময় যাদের কান্না না আসে, তারা যেন ইচ্ছে করে অন্তরে কোমলতা সৃষ্টির লক্ষে কান্নার ভান করে এবং চিন্তিত, বিষণ্ন চেহরা ও অনুতপ্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করে। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় যদিও ছলনা ও কৃত্রিমতার মাধ্যমে করা হলেও পরিশেষে বাস্তবিকপক্ষে সত্যি সত্যিই ওই প্রকৃত অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়।
স্মতর্ব্য যে, সেমার সময় যাদের ওয়াজদ্ বা ভাবাবেগ সৃষ্টি হতে দেখা যায়, তাদের অস্বীকার করা উচিত নয়। 
174. কাজী ছানা উল্লাহ পানিপথি রহ রচিত ‘আস-সেমা’ গ্রন্থ হতে সংকলিত।

মাহবুবে ইলাহী হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (رحمه الله تعالي ) ‘ফাওয়াইদুল ফুয়াদ’ গ্রন্থে বলেছেন, বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গান বাজনা ও ধর্ম-সঙ্গীত নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে জায়েয।

১. সঙ্গীত গায়ক নারী ও বালক না হওয়া। 
2.অশ্লীল ও অনর্থক কথা গানের মধ্যে না থাকা।
৩. সঙ্গীত শ্রবণকারী সকলই আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকা এবং এতে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা পূরণকারী না থাকা।
৪. পেশাদার বাদ্যযন্ত্রকার ও গায়ক দ্বারা বাদ্য বাজনা না করা। 

অতএব, উপরোক্ত শর্তাবলীর কোন একটি না থাকলে সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত শ্রবণ করা হারাম।




ওহাবী ফেরকার বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১২৮: সংক্ষিপ্তাকারে ওহাবী সম্প্রদায়ের পরিপূর্ণ অবস্থা এবং তারা কতভাগে বিভক্ত হয়েছে তা যথাযথভাবে বর্ণনা কর।

✍ উত্তর: عليه التكلان وهو المستعان ওহাবী একটি দল বা সম্প্রদায়ের নাম। যার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব। যিনি নজদের উআইনিয়া এলাকায় ১৬৯১ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অনেক কষ্ট করে তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তারপর তিনি মক্কা মুয়ায্যমা ও বসরা শহরে গিয়ে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। সিহাহ সিত্তাসহ বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর তাঁর পিতার সঙ্গে মক্কা শরীফে হজ্বব্রত পালন করেন এবং মদীনা তাইয়্যেবা যিয়ারত শেষে শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীমের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং এক বছর পর্যন্ত তার থেকে ফিক্বহ্ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। অতঃপর নিজ দেশে ফিরে যান এবং সেখানকার মুজতাহিদ হন। তিনি প্রকাশ্যভাবে ইসলামী শরীয়তের অনুসরণ এবং এর মূলনীতিতে কোন ধরনের প্রার্থক্য করেন নি। কিন্তু যে সকল লোক ফাল (গণনা করে ভবিষ্যতের কথা বলা) দেখতেন, শগুন (শুভাশুভের নিদর্শন) মানতেন, মাযারসমূহকে সুসজ্জিত ও সম্মান করতেন, তামাক ব্যবহার করতেন এবং রেশমি কাপড় পরিধান করতেন তাদেরকে খারাপ বলতেন। কেননা এগুলো  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর শরীয়তের পরিপন্থী। কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ পাঠ করে তিনি ধারণা করেন যে, শরীয়তের মূলনীতিতে বিভিন্ন অবস্থার সংমিশ্রণের কারণে বিশাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন যে, মানুষদেরকে বিশেষ নিয়ম এবং ইসলামী শরীয়তের বিধান ও নীতিমালা এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমল করেছেন। তার মতে, দুনিয়ার সকল মুসলমান পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। যে সকল পীর আউলিয়া-ই কিরামের কথা ও কাজের অনুসরণ করছে, তারা এ প্রথা নিজেদের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই প্রচলন করতেছে।
তিনি ইমাম চতুষ্টয়ের আনীত নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছেন। কেবল পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফকে নিজের রাহনুমা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। লোকেরা তার কথা মেনে তার অনুসৃত নীতি অনুসরণ করতে লাগলো। যখন তার সঙ্গে আরো অন্যান্য দল একত্রিত হলো, তখনকার গভর্ণরের সঙ্গে মতবিরোধ হয়। অবস্থা জটিল ও বেগতিক দেখে তিনি তখনকার দরিনার প্রভাবশালী নেতা মুহাম্মদ বিন সউদ-এর নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইবনে সউদের সহযোগিতায় ওহাবী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। দরিনার শাসক নতুন মাযহাবের উদ্ভাবকের সঙ্গে বংশীয় আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপন করে তাকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন। দরিনার এই নেতার পুত্র আবদুল আজিজ একজন প্রসিদ্ধ ওহাবী হন। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে যখন ইবনে আবদুল ওহাব ও দরিনার নেতার ইন্তিকাল হয়, তখন আবদুল আজিজ তাদের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ওহাবী জামাআতকে আরো শক্তিশালী ও অগ্রগামী করলেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ জয় করেন। আবদুল আজীজ বীর সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না। ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দে এক ইরানী তাকে হত্যা করেন। তারপর আবদুল আজীজের বড় সন্তান সউদ তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং তুমুল যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। তিনি সমস্ত তুর্কী সম্রাজ্য জয় করার সংকল্প করেন এবং যুদ্ধ কৌশল অবলম্বনে কোন আপোষ করতেন না। তিনি বাল্যকাল থেকেই তরবারী হাতে নেন। সে বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ‘কারবালায়ে মুআল্লা’তে আক্রমণ করেন এবং সেখানকার কাফির ও মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। ইমামে হুম্মাম সৈয়্যদুশ শুহাদা আমীর হামযা আলাইহিস সালামের পবিত্র রওজা মুবারকের প্রতিও কোন ধরনের আদব ও সম্মান প্রদর্শন করেনি। নগদ টাকা, মণি-মুক্তা ও খনিজ সম্পদ সহ যা কিছু রওজা শরীফে সংরক্ষিত ছিল সব ওহাবীরা নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী বৎসর মক্কা অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ওহাবী মতবাদ ও রীতি-নীতি চালু করে দেয়। হুক্কা, তাসবিহ, তাবিজ এবং রেশমী কাপড়ের টুকরোগুলো জোরপূর্বক সকল থেকে কেড়ে নিতেন এবং সকলের সামনে এগুলো জ্বালিয়ে দিতেন। নামাযের সময় হলে শরয়ী লোকেরা চাবুক ও বেত নিয়ে বের হতেন, ফলে লোকজন মসজিদে গিয়ে  পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন।
মক্কা মুয়াযযামায় যখন তার মিশন পূর্ণতা লাভ করল এবং একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জিত হল, তখন রোম সম্রাটের নিকট তার বিজয়ী সংবাদের চিঠি এভাবেই লিখে পাঠান যে, 
‘সউদের পক্ষ হতে কন্স্টানটিনোপল সরকারের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি ৪ঠা মুহাররম ১২১৮ হিজরী মোতাবেক পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করি এবং সেখানকার অধিবাসীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। আমি এই বরকতময় স্থান হতে ঐ সকল বস্তু অপসারণ করেছি যেগুলোকে মানুষ মূর্তির ন্যায় পূজা করতো। আমি যাবতীয় শুল্ক ও টেক্স মাফ করে দিয়েছি। আমি নবী করীম   কর্তৃক প্রবর্তিত সকল নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছি, যা আপনি করেছিলেন। আমার ঐকান্তিক ইচ্ছে যে, আপনি সিরিয়া ও মিশরের গভর্ণরদের নির্দেশ দিবেন যে, সেখানকার লোকেরা যেন ঢোল-তবলা ও বাদ্য-যন্ত্র নিয়ে এখানে না আসে।’
দ্বিতীয় বছর মদিনা মুনাওয়ারায় বিজয়ী লাভ করে। তার মিশন এমন ভাবে পরিপূর্ণতার সাথে পরিচালনা করে যে, এমন কোন সেক্টর বা বিষয় ছিল না- যেখানে তার শাসন ক্ষমতা একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করেনি। এমন কি রাসূলে পাক  -এর রওজা মুবারক ও বিশ্রাম স্থল থেকে চাঁদর মুবারক ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নযোগে সুসংবাদ পেল যে, হুযূর রহমতে ‘আলম বলেছেন, সাবধান! এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাক। তাই সে উক্ত মত পরিবর্তন করেন। এখানে দীর্ঘ নয় বছর ইবনে সাউদ শাসন পরিচালনা করেন। ওহাবী দল সংখ্যায় এতো বেশী পৌঁছে গিয়েছিল যে, তুরস্ক সরকারের স্বীয় রাজত্ব হারানোর ভয় হয়। তাই সরকার আলী পাশাকে নির্দেশ দিলেন যে, বাতিল ওহাবী সম্প্রদায়কে পবিত্র স্থান থেকে জোরপূর্বক সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে আক্রমণ করা হোক। আলী পাশা হুকুম মোতাবেক সৈন্য বাহিনী জমায়েত করে তাদের হারামাইন শরীফাইন থেকে বের করে দিলেন। ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দে ইবনে সাউদ মারা গেলে ছেলে আবদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হন। যদিও সে কুচক্রী ও অসৎ প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী ছিলেন না। সব কিছুতেই সন্দেহ পোষণ করতেন। পরিশেষে ইবরাহীম পাশা তাকে গ্রেফতার করে কনস্টানটিনোপলে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। অতঃপর তার পুত্র ফয়সল তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। তারপর পুত্র আবদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। অতঃপর ওহাবী দলের সামরিক শক্তি একেবারে হারিয়ে যায়। পরিশেষে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব মনগড়া যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল, তা কিছু সংখ্যক মাযহাবের নেতা অনুসরণ করেছিল।
ওহাবীরা নিজেদেরকে- আহলে হাদীস, আহলে সুন্নাত, মুহাদ্দিস, হাদীস চর্চাকারী ও গবেষক এবং মওয়াহ্হিদ বা একত্ববাদী বলে থাকে এবং তাদের পরিপন্থী ও বিরোধীতাকারীদেরকে বিদ‘আতী বলে। আর আজকাল ওহাবী গাইরে মুকালি­দরা, হানাফী মুকালি­দ নামে প্রসিদ্ধ।
বর্তমানে এই দলটি বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্বঘোষিত নবী দাবীদার মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারী। কেউ কেউ গোলাম নবী ছকরালভীর মাযহাবের অনুসারী, যারা নিজেদেরকে আহলে কোরআন বলে। তাদের নিকট হাদীস শরীফের কোন মূল্য নেই। তারা প্রত্যেক মাসআলা কোরআন মজিদ থেকে দলিল পেশ করতে চায়। এ সকল অপকর্ম ও ভ্রষ্টতার কারণে তারা তাকলীদ বা মাযহাব ছেড়ে দিয়েছে। ওহাবী ফেরকা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আমার লিখিত ‘সংক্ষিপ্ত নজদি ওহাবীদের ইতিহাস’ গ্রন্থখানা অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি।





বিভিন্ন প্রকারের মাসায়েল এর বর্ণনা-

❏ প্রশ্ন-১২৯: অভিশপ্ত ইবলিশ কি সিজদার আদেশের মুকাল্লাফ (আজ্ঞাবহ) ছিল? কোরআন কারিমের পূর্বাপর বর্ণনা হতে বুঝা যাচ্ছে যে, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا الخ. ‘যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা করো’ আয়াতাংশে প্রদত্ত আদেশটি কেবল ফেরেশতাদের ওপর প্রযোজ্য ছিল। অথচ ইবলিশ ফেরেশতাদের স্বজাতিভূক্ত ছিল না। তাই সিজদা না করার কারণে তাকে কেন অভিশপ্ত করা হল?

✍ উত্তর: দৃশ্যতঃ আয়াতে যদিও কেবল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখ রয়েছে, তবে এটা শাব্দিক আধিক্য, নচেৎ আদেশ ইবলিশের ওপরও করা হয়েছিল। আল্লাহ্ তা‘আলার নিন্দা ও ক্রোধ এবং প্রশ্নোত্তর একথার প্রমাণ বহন করে বা নজির স্থাপন করে। অনেক সময় নজির স্থাপনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির ওপর আদেশদাতার পক্ষ হতে আদেশ প্রমাণিত হয়। এই পদ্ধতিতে সেও ওই আদেশের আজ্ঞাবহ ছিল। যে বিষয়ে নজির স্থাপিত হয়, সে বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। আর এখানে কাহিনীর মধ্যে নজির বিদ্যমান রয়েছে। আর তা হচ্ছে যখন তার ওপর ক্রোধ ও নিন্দার কাহিনীটি বর্ণনা করা হলো, তখন এতে বুঝা গেলো যে, সেও ওই হুকুমের আজ্ঞাবহ ছিলো। 
আবার সূরা আ‘রাফের এই আয়াতটিতে রয়েছে যে, 

مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ. 

‘যখন আমি আদেশ করলাম তখন তোমাকে সিজদা করতে কিসে বারণ করল’, এতে আদেশ দেওয়ার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। প্রথম দলিলটি হচ্ছে আকলি বা বুদ্ধিভিত্তিক এবং দ্বিতীয় দলিলটি হচ্ছে দালিলিক বা তাত্ত্বিক। 
175. ইমদাদুল ফতওয়া, খন্ড নং-৫, পৃষ্ঠা নং-১২; ফাতওয়ায়ে হক্কানীয়া, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং- ১৬৭, ।

❏ প্রশ্ন-১৩০: জনৈক ব্যক্তি বিবাহের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করলো এবং তা নিসাবের সীমা অতিক্রম করলো। আর এই অর্থ কয়েক বছর যাবত তার নিকট গচ্ছিত রইলো। তবে পুরো বছর বিয়ে করার সুযোগ না হওয়ায় সে এখনো বিয়ে করেনি। তার এই সঞ্চিত অর্থ বিয়ের প্রয়োজন নির্বাহের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন এই অর্থের ওপর একটি বছর অতিক্রান্ত হলে যাকাত ওয়াজিব হবে নাকি হবে না?

✍ উত্তর: যতক্ষণ পর্যন্ত এই অর্থ ব্যয় করা হবেনা ততক্ষণ বিয়ের প্রয়োজনাদি যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। বরং ওই ব্যক্তির ওপর যথারীতি যাকাত ওয়াজিব হবে। অনুরূপ পিতা তার সন্তান অর্থাৎ পুত্র-কন্যার বিয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করলে এবং তা যাকাতের নিসাব পরিমাণ পৌঁছালে একটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। 

وسبب لزوم ادائها توجه الخطاب 

যাকাত প্রদান ওয়াজিব হওয়ার কারণ হচ্ছে আল্লাহ'র সম্বোধন অর্থাৎ আল্লাহ'র বাণী,

واٰتو الزكوٰة . وشرطه اى شرط افتراض ادائها حولان حول وهو فى ملكه وثمنية المال كالدراهم والدنانير الخ .

‘তোমরা যাকাত প্রদান করো’ এবং আদায় করা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত হচ্ছে সম্পদ ও সম্পদের মূল্য যেমন- দিরহাম ও দিনারের ওপর পূর্ণ একটি বছর অতিক্রান্ত হওয়া। 
176. হাশিয়া আত্-তাহ্তাভী, খন্ড নং-১, পৃষ্ঠা নং ২৬৭ ও হিন্দিয়া ইত্যাদি।

❏ প্রশ্ন-১৩১: সূরা ইয়াসিন এর তেলাওয়াত কখন ও কিভাবে করতে হয় এবং এর উপকার কী- দলিলসহ বর্ণনা কর ?

✍ উত্তর: শায়খ ইবনে হাইয়ান (رحمه الله تعالي ) ‘কিতাবুস্ সাওয়াব’-এ স্বীয় সনদে একটি রেওয়ায়ত এনেছেন,

حدثنا ابن ابى عاصم قال حدثنا عمر بن حفص الوصائى قال حدثنا سعيد بن موسى قال حدثنا رباح بن زيد عن معمر عن الزهرى عن انس رضى الله تعالٰى عنه قال قال رسول الله صلّى الله عليه وسلّم انى فرضت على امّتى قرأة يٰس كل ليلة فمن دوام على قرأتها كل ليلة ثم مات، مات شهيدًا .

অর্থাৎ উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ   ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রতি রাতে সূরা ইয়াসিন এর পাঠ স্বীয় উম্মত এর ওপর ফরয করেছি। যে ব্যক্তি সর্বদা প্রতি রাতে নিয়মিত এই সূরাটি পাঠ করবে, অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করলে শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে অর্থাৎ তার শহীদী মৃত্যু নসীব হবে।’
যে সব বিষয় ও জিনিসের মধ্যে উম্মতে মুহাম্মদীর কপালে কল্যাণ রয়েছে তা ফরয করে দেওয়ার অধিকার রাসূলুল্লাহ'র (ﷺ) নিকট রয়েছে। এই রেওয়ায়তটিতে, انى فرضتُ على امّتى “আমি স্বীয় উম্মতের ওপর ফরয করেছি” বাক্যটি দ্বারা এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি আল্লাহ'র হুকুম এবং একই সঙ্গে নফলের ওপর নিয়মানুবর্তিতার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়ে গেলো। فمن دوام على قرأتها “যে ব্যক্তি নিয়মিত এই সূরাটি পাঠ করবে” হাদিসের অংশটি হতে শায়খুল মাশায়েখ ইবনে হিব্বান এই হাদিসটি হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) হতে স্বীয় সনদে রেওয়ায়ত করেন।  
177. সীরাতে মুস্তাফা, জানে রহমত, ইখতিয়ারাতে মুস্তাফা, খন্ড নং-৪, পৃষ্ঠা নং-২০৯, ।

নোট: ফরয দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমলী (কর্মগত) ফরয, বিশ্বাসগত ফরয নয়। কারণ তা পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে শাস্তির কোন প্রসঙ্গ আসেনি।

❏ প্রশ্ন-১৩২: উম্মতে মুহাম্মদীর   ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হাকীকত কী?

✍ উত্তর: এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে,  পাঁচ ওয়াক্ত নামায হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার ওই মহান নেয়ামত যা তিনি আপন করুণা-অনুগ্রহে বিশেষভাবে আমাদেরকে দান করেছেন। আমাদের পূর্ববর্তী কোন উম্মত তা পায়নি। 
যেমন-আসমানী গ্রন্থসমূহের মধ্যে আমাদেরকে দান করেছেন উম্মুল কিতাব (মূলগ্রন্থ) আল-কোরআন এবং রাসূলদের মধ্যে দান করেছেন তাঁকে যিনি নবী-রাসূলগণের সরদার। আর মাখলুকের মধ্যে দান করেছেন সর্বপ্রথম সৃষ্টি নবীগণের শ্রেষ্ঠ নবীকে। বাণী সমূহের মধ্যে দান করেছেন সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী। আর আমাদেরকে দান করেছেন সর্বপ্রথম ঘরটি। সূরা সমূহের মধ্যে দান করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা সূরায়ে ফাতিহা। কালেমা সমূহের মধ্যে দান করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কালিমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’।
এভাবে যাবতীয় উত্তম ও শ্রেষ্ঠ নেয়ামতসমূহ আমাদেরকে দান করেছেন। অনুরূপ যে সব ইবাদত আল্লাহ'র দরবারে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ সে সব আমরা পেয়েছি। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য যিনি শাশ্বত ও চিরন্তন الحمدُ للهِ حمدًا كثيرًا كثيرًا। নচেৎ বনি ইসরাঈলের ওপর দুই ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল, তাও কেবল চার রাকাত; দু’রাকাত সকালে এবং দু’রাকাত বিকেলে। কিন্তু তাও তারা আদায় করেনি।

নাসায়ী শরীফে হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে,রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হাদিসে মি’রাজে বলেন,

فانّه فرض على بنى اسرائيل صلاتين فما قاموا بهما .

‘বনি ইসরাঈলের ওপর দুই ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল। কিন্তু তাও তারা আদায় করেনি।’ 

যখন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ করা হল, তখন হযরত মুসা (عليه السلام) হুযূরকে (ﷺ) বললেন, আপনি আবার যান এবং স্বীয় রবের নিকট এতে হ্রাসের প্রার্থনা করুন। কারণ তিনি বনি ইসরাঈলের ওপর দুই ওয়াক্ত নামায ফরয করেছিলেন। কিন্তু তারা তাও আদায় করেনি।
মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, বনি ইসরাঈলের ওপর চার রাকাত নামায ফরয করা হয়েছিল; দুই রাকাত সকালে এবং দুই রাকাত বিকেলে। আর কথিত আছে, দুই রাকাত অপরাহ্নে। ‘খাসায়েসে উম্মতে মরহুমা’ গ্রন্থে রয়েছে যে,  

ومنها مجموع الصلوات الخمس ولم تجمع لاحد غيرهم .

‘অনুগ্রহপ্রাপ্ত উম্মতের অন্যতম মাহাত্ম্য হচ্ছে  পাঁচ ওয়াক্ত নামায। এই উম্মত ছাড়া অন্য কারো জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করা হয়নি।’
ইমাম যারকানী (رحمه الله تعالي ) নাসায়ীর হাদিসটির সূত্রে বলেন, 

هذا هو الصواب وما وقع فى البيضاوى انه فرض عليهم خمسون صلاة فى اليوم والليلة، قال السيوطى هذا غلط ولم يفرض على بنى اسرائيل خمسون صلاة قط بل ولاخمس صلاة ولم تجمع الخمس الا لهذا الامة وانما فرض على بنى اسرائيل صلاتان فقط كما فى الحديث .

‘এটাই সঠিক। আর যে কথাটি বায়যাভীতে রয়েছে যে, বনি ইসরাঈলের ওপর দিবা-রাত্রি পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয করা হয়েছিল- সে ব্যাপারে ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী বলেন, একথাটি অশুদ্ধ। বনি ইসরাঈলের ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায কখনো ফরয করা হয়নি। বরং  পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও ফরয করা হয়নি। পাঁচ ওয়াক্ত নামায কেবল এই অনুগ্রহপ্রাপ্ত উম্মতের জন্য একত্রিত করা হয়েছে। হ্যাঁ! বনি ইসরাঈলের ওপর কেবল দুই ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে।’
শায়খ মুহাক্কিকসহ অন্যান্য বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বলেন, 

مجموع هذه الخمس من خصوصياتنا .

‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একত্রীকরণ হচ্ছে, আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।’ ‘আশআতুল লুম‘আত’ নামক গ্রন্থে রয়েছে যে,

 مجموع خمس اوقات مخصوص ايں امت است . 

‘ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একত্রীকরণ হচ্ছে এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য।’
আবু দাউদ শরীফ, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ইত্যাদি হাদিসের কিতাবে হাসান সনদ সহকারে হযরত মুয়ায বিন জাবাল (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, হুযূর (ﷺ) ইশার নামাযের ব্যাপারে বলেন:

 اعتموا بهذه الصلاة فانكم فضلتم بها على سائر الامم ولم تصلها امة قبلكم. 

‘তোমরা ইশার নামায দেরী করে পড়ো। কারণ এর বদৌলতে তোমাদেরকে অন্যান্য সকল উম্মতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। তোমাদের পূর্ববর্তী কোন উম্মত এই নামায পড়েনি।’

❏ প্রশ্ন-১৩৩: বর্ণনাকারী এবং বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হাদিস কত প্রকার?

✍ উত্তর: বর্ণনাকারী বিবেচনায় হাদিস চার প্রকার। যথাঃ মুতাওয়াতির, মাশহুর, আজিজ ও গরীব। বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হাদিস চার প্রকার। যথাঃ সহীহ লি-যাতিহী, সহীহ লি-গায়রিহী, হাসান লি-যাতিহী ও হাসান লি-গায়রিহী। 

❏ প্রশ্ন-১৩৪: সূরা ইনশিরাহ এর আয়াত وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি’ এর ব্যবহার  বা প্রয়োগ ব্যাপকার্থে করা। আয়াতটি দ্বারা একথা বলা যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল হুযূর   নন, বরং যে সব ব্যক্তি জীবনের এই কাঠামোবদ্ধ সময়কালে চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে কর্ম করে উঁচু মর্যাদা অর্জন করেছেন, তারাও এই উচ্চতা-সমুচ্চতায় অন্তভুর্ক্ত। এই আয়াতটির এরূপ অর্থ-মর্মার্থ গ্রহণ করা কি সঠিক নয়? যেমন, বর্তমান যুগে কতিপয় নাস্তিক্যবাদী বিশ্বাস পোষণকারী এবং  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর সাথে সমতুল্য হওয়ার দাবীদার লোকেরা এরূপ মনে করে এবং এই আয়াতটি হতে এরূপ অর্থ-মর্মার্থ গ্রহণ করে, এটা সঠিক কি না?

✍ উত্তর: এই আয়াতটি বিশেষতঃ  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর সুউচ্চ মর্যাদার ব্যাপারে প্রশংসার স্থলে অবতীর্ণ হয়, সেখানে অন্য কারো জন্য কোনরূপ অর্থের অবকাশ নেই। 
যেহেতু وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ এর ك ‘ক্বাফ’ বর্ণটি মধ্যম পুরুষবাচক একবচনের সর্বনাম যা দ্বারা কাউকে সম্বোধন করা হয় এবং এই আয়াতে সম্বোধিত ব্যক্তি হচ্ছেন বিশেষ ও এককভাবে হুযূর (ﷺ)। তাই এই আয়াতটিকে ব্যাপক বা সার্বজনীন অর্থে ব্যবহার করা এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে এতে অন্তভুর্ক্ত করা একধরনের বিকৃতি। সুতরাং তা সঠিক নয়। অত্র আয়াতে সমুচ্চ আলোচনা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, হুযূর   এর বরকতময় নামটি আযান, কালেমা ও তাশাহ্হুদ ইত্যাদিতে আল্লাহর নামের সাথে উচ্চারণ বা স্মরণ করা উদ্দেশ্য, যা অন্য কেউ লাভ করতে পারেনা।  
178. আহকামুল কোরআন, কুরতুবী, সূরা ইনশিরাহ, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-১০৬। 

এই আয়াতটি সূত্রে ইমাম মুহাম্মদ বিন আহমদ হযরত ইমাম দাহহাক হতে রেওয়ায়ত করেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছেঃ

 قال يقول له لاذكرتُ الاذكرتَ معى فى الاذان والاقامة والتشهد ويوم الجمعة على المنابر. 

‘আল্লাহর নামের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র নাম অবশ্যই আযান, ইকামত, তাশাহ্হুদ ও জুমার দিন মিম্বরে উচ্চারণ বা স্মরণ করা হয়।’ 
179. ফাতাওয়া হক্কানীয়া, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং- ১৫৮।

❏ প্রশ্ন-১৩৫: ইসলামে শিরকের অবস্থান কী? উম্মতে মুহাম্মদীয়া হতে শির্ক প্রতীয়মান হতে পারে কি?

✍ উত্তর: শিরক আল্লাহর পবিত্র সত্তার সাথে একটি মহা অন্যায় ও অপরাধ কর্ম। إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ আল্লাহ্ তা‘আলা  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর মাধ্যমে শিরক নির্মুল করেছেন। ماحى الشرك والكفر তাই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ  

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِنَّهُ خَرَجَ يَوْمًا فَصَلَّى عَلَى أَهْلِ أُحُدٍ صَلَاتَهُ عَلَى الْمَيِّتِ ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ إِنِّي فَرَطُكُمْ وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ إِنِّي وَاللهِ لَأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِي الْآنَ وَإِنِّي قَدْ أُعْطِيتُ خَزَائِنَ مَفَاتِيحِ الْأَرْضِ وَإِنِّي وَاللهِ مَا أَخَافُ بَعْدِي أَنْ تُشْرِكُوا وَلَكِنْ أَخَافُ أَنْ تَنَافَسُوا .

‘হযরত উকবা বিন আমের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বাইরে গেলেন এবং উহুদের (যুদ্ধের) শহীদগণের জন্য এভাবে নামায পড়লেন যেভাবে জানাযার নামায পড়া হয়। এরপর মিম্বরে সমাসীন হয়ে বললেন, আমি তোমাদের অগ্রপথিক অর্থাৎ আগে গিয়ে ব্যবস্থাপনাকারী এবং আমি তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্যদাতা। নিশ্চয় আমি এখন হাউযে কাওসার দেখতে পাচ্ছি এবং আমাকে দুনিয়ার (সম্পদরাজির) ভান্ডারসমূহের চাবি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ'র কসম! আমার নিকট এরূপ কোন ভয় নেই যে, তোমরা শিরক করবে। তবে আমার ভয় হচ্ছে তোমরা দুনিয়াকে ভালবাসতে থাকবে।’ দুনিয়ার মোহে বিমোহিত হবে। 
180. বুখারী শরীফ, কিতাবু বদ’উল খলক, কিতাবুল মানকিব, খন্ড-১, হাদীস নং-৩৩৬৭।

❏ প্রশ্ন-১৩৬: নিম্নোক্ত হাদিসের অংশ,
فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ ‘এটি (সূর্য) এভাবে চলতে চলতে আরশের নিচে সিজদাবনত হয়’ (বুখারী শরীফ)। হযরত আবু যর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেনঃ 

قَالَ كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ عِنْدَ غُرُوبِ الشَّمْسِ فَقَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ أَتَدْرِي أَيْنَ تَغْرُبُ الشَّمْسُ قُلْتُ اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ فَذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ.

সূর্যাস্তের সময় আমি  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর সাথে মসজিদে ছিলাম। তখন তিনি   বললেন, হে আবু যর! তুমি কি জানো সূর্য কোথায় অস্ত যায়। আমি বললাম, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই   সমধিক জ্ঞাত। তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, সূর্য চলতে চলতে আরশের নিচে সিজদাবনত হয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন করে। এটা মহাপরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বের সকল দেশের সময় তো আলাদা আলাদা বা ভিন্ন ভিন্ন যেমন- আমাদের এখানে বাংলাদেশে রাত হলে তো অন্য কোন দেশে দিন হয়। এখন যদি আমরা এখান থেকে রাত ১২টা কিংবা ১টার সময় এই খবর প্রচার করি যে, সূর্য আরশের নিচে সিজদাবনত অবস্থায় আছে, তখন হয়ত অন্য কোন দেশে সকাল ৮টা বা ৯টা বাজবে এবং ওই দেশের লোকেরা বলবে যে, এখানে তো সূর্যকে উদিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং একথা সঠিক নয় যে, সূর্য আরশের নিচে সিজদাবনত অবস্থায় আছে। এখন অত্র হাদিসটির মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা কী হবে?

✍ উত্তর: এই প্রশ্নটি নিরসনের জন্য ওলামায়ে কেরাম এই হাদিসটির নানা ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যেমন, সাইয়েদ মাহমুদ আলুসী বাগদাদী (رحمه الله تعالي ) বলেন, সূর্যের আত্মা ঊর্ধ্ব জগতে গিয়ে সিজদা করে যা সূর্যের আবর্তনের সাথে সাংঘর্ষিক বা বিপরীত নয় বিশেষতঃ যখন এই অস্ত যাওয়ার বিষয়টি দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান কাজে আদিষ্ট হওয়া। এটি ‘বিকল্প প্রতিস্থাপন’ নীতিতে আল্লাহর কুদরতী শক্তির বদৌলতে সংঘটিত হয়। তাতে দৃষ্টিশক্তির কোন ভূমিকা নেই। কোন কোন আলেম এই ব্যাখ্যাটি প্রদান করেছেন যে, যেহেতু আরশের অবস্থান হচ্ছে গোটা বিশ্ব জগত ও সৃষ্টি জগতের ওপর, তাই সূর্য স্বীয় আবর্তনের সময় অবশ্যই আল্লাহ'র আরশের নিচ দিয়ে অতিক্রম করবে। এজন্য এতে কোন কথা বিবেক ও বুদ্ধি পরিপন্থী নয়, অবশ্যই বিবেক-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। যেহেতু এই সংবাদটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দিয়েছেন যার সম্পর্ক আল্লাহর ওহীর সাথে, তাই তা উপলব্ধি করার ও প্রত্যক্ষ করার অবকাশ নেই। বরং এর ওপর ঈমান আনা আমাদের জন্য আবশ্যক।
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (رحمه الله تعالي ) ‘উমদাতুল কারী’ পৃষ্ঠা নং ১১৯, খন্ড নং-৫, চন্দ্র-সূর্যের গণনাবাচক গুণ বিষয়ক অধ্যায়, সৃষ্টির সূচনা বিষয়ক কিতাব এবং অন্যান্য বর্ণনায় বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই   সমধিক জ্ঞাত।

❏ প্রশ্ন-১৩৭: ফিতনার সময় ঈমান, আক্বীদা ও আধ্যাত্মিক বা আত্মিক আমলসমূহ হিফাযতের জন্য ফিত্না-ফাসাদ হতে দূরে পালানোর ধরনটা কি রকম?

✍ উত্তর: ফিতনা হতে দূরে পালানোও দ্বীনের অন্তভুর্ক্ত বিষয় এবং এটা নবীগণের (عليه السلام) সুন্নত, যদিও তা এক বিঘত পরিমাণ হয়। ঈমান, আক্বীদা ও বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার পরিবেশ যেখানে বিরাজমান হিজরত করে ওই ভাল পরিবেশে যাওয়া  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র সুন্নত। যেখানে অনুকূল পরিবেশ, কোরআন-সুন্নাহ ও বুযূর্গানে দ্বীনের রীতি-নীতির পরিবেশ এবং বিশেষতঃ বিশুদ্ধ ও সঠিক ঈমান ও আক্বীদার অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান, সেখানে হিজরত করতে হবে। নষ্ট ও বাতিল আক্বীদা হতে দূরে পালিয়ে থাকা জরুরী ও ওয়াজিব। আল্লাহ্ পাক সকলকে হেফাজত করুক। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ 

يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنْ الْفِتَنِ.

‘অতি শীঘ্রই মুসলমানদের সর্বোত্তম সম্পদ হবে ওই বকরীগুলো যেগুলো নিয়ে তারা পাহাড়ের চূড়ায় বা উপত্যকায় জীবন কাটাবে, যাতে তারা স্বীয় বিশুদ্ধ দ্বীনকে ওই যামানার ফিতনাসমূহ হতে সংরক্ষিত রাখতে পারে।’ 
181. বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড।

দ্বীনের সার্বিক ও সামগ্রিক উপকার ও সুবিধার প্রেক্ষাপটে সমাজবদ্ধ জীবন ইসলামে অধিক প্রিয় এবং নবীগণের (عليه السلام) কর্মপদ্ধতিও এটা যে, সমাজে অবস্থান করে নিজের ও সমাজের পরিশুদ্ধি ও সংশোধনের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। 

❏ প্রশ্ন-১৩৮: দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে কোন কিছু খাওয়ার হুকুম কী?

✍ উত্তর: যমযম এর পানি ছাড়া অন্য সব পানাহার দাড়িয়ে বা হেঁটে খাওয়া মাকরূহ। যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। অন্য সব পানাহার বসে খাওয়া উত্তম।

عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كُنَّا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَأْكُلُ وَنَحْنُ نَمْشِي وَنَشْرَبُ وَنَحْنُ قِيَامٌ .

‘হাদীস শরীফে হযরত ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, আমরা  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র যামানায় হেঁটে হেঁটে আহার করতাম এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করতাম।’ 
183. ইবনে মাজাহ।

বুঝা গেল যে, দাঁড়ানো অবস্থায় বা হাঁটা-চলা অবস্থায় পানাহার করা জায়েয।  তবে ফকীহগণ যমযমের পানি ছাড়া অন্য কিছু পানাহার করাকে মাকরূহ বলেছেন। যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান না করা মাকরূহ। অন্যান্য সব পানি বসে পান করা উত্তম। দাঁড়ানো অবস্থায় বা হেঁটে হেঁটে আহার করা অনুত্তম এবং শিষ্টাচার পরিপন্থী। আর এতে ‘আদালত বা ন্যায়পরায়ণতা রহিত হয়ে যাবার আশংকা থাকে।
বুযূর্গদের তাবারুক এবং ওযুর উচ্ছিষ্ট পানিও দাঁড়িয়ে পান করা  মুস্তাহাব। অবশিষ্ট যাবতীয় পানি বসে পান করা উচিত। হযরত শা‘বী (رحمه الله تعالي ) ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) হতে রেওয়ায়ত করেন যে, আমি হুযূরকে   যমযম এর পানি পান করালাম, তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করলেন। 
শা‘বী বলেন, আমি এই হাদিসটি ইকরামা হতে বর্ণনা করছি যে, তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বললেন যে, রাসূলুল্লাহ   এরূপ করেননি। হযরত ইকরামা নিজের ধারণা ও খেয়াল অনুযায়ী শপথ করেছেন, নতুবা প্রসিদ্ধ রেওয়ায়ত সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি   যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন। ওলামায়ে কেরাম বলেন, যমযমের পানি ও ওজুর উচ্ছিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। অনুরূপ বুযূর্গদের তাবারুকও দাঁড়িয়ে পান বা আহার করা মুস্তাহাব। আর অবশিষ্ট সব কিছু বসে পান বা আহার করা উচিত।
হযরত ইকরামার পক্ষ হতে ইবনে ওমর (رضى الله تعالي عنه) বর্ণিত হাদিসটির জবাবে বলা হয় যে, এতে এই সম্ভাবনাটি রয়েছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) দাঁড়িয়ে যে যমযমের পানিটুকু পান করেছিলেন, তা হয়তো কোন অসুবিধার কারণে করেছিলেন। সেখানে হয় তো বসার জায়গা ছিলনা কিংবা ভীড়ের কারণে দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, দাঁড়িয়ে পানি পান করা প্রথমে নিষেধ ছিল। পরে এই নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়ে গেলো। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রথমে জায়েয ছিলো, পরে নিষিদ্ধ হলো। হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে এধরনের কথা বর্ণিত রয়েছে। মোদ্দাকথা বসে পান করা উত্তম। তবে প্রয়োজনের সময় দাঁড়িয়ে পান করা যাবে। এই হুকুমটি উপরোক্ত পানি ব্যতীত সাধারণ পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

❏ প্রশ্ন-১৩৯: বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচ্য অঞ্চলের লোকেরা শেষ যামানায় হযরত সাইয়েদুনা ইমাম মাহদীর (عليه السلام) সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে। একথা কি কোনো দলিল দ্বারা প্রমাণিত নাকি কেবল জনশ্রুতি?

✍ উত্তর: হ্যাঁ, ইবনে মাজাহ শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ বিন হারেস বিন জুমআ হতে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ   বলেনঃ

يَخْرُجُ نَاسٌ مِنْ الْمَشْرِقِ فَيُوَطِّئُونَ لِلْمَهْدِيِّ .

‘প্রাচ্য দেশ হতে কিছু লোক বের হবে এবং তারা (ইমাম) মাহদীর (عليه السلام) সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে অর্থাৎ তাকে সাহায্য করবে।’

বুঝা গেলো যে, ইমাম মাহদী (عليه السلام)’র বড় সাহায্যকারী হবে প্রাচ্য অঞ্চলের লোকেরা। মদীনা মুনাওয়ারা হতে এসব দেশ পূর্ব দিকে অবস্থিত যেমন- ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি। সম্ভবতঃ ওই সব দেশের সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাসের মুসলমানগণ তার সাথে যোগ দিবে। হযরত ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আহবানে তার সাথে যোগ দেওয়া এবং তার সাহায্যকারী হওয়া বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রাচ্যের এই ফরমানটি ব্যাপক এবং এতে কোন অঞ্চল বা এলাকা নির্দিষ্ট নয়। হযরতের সাহায্যকারী হওয়া কোন নগন্য ব্যাপার নয়।
কতিপয় মুহাদ্দেসীনে কেরাম বলেন, খৃস্টানদের শৌর্য-বীর্য ও সাম্রাজ্য কিয়ামতাবধি অটুট থাকবে অর্থাৎ ইমাম মাহদীর (عليه السلام) সময়কাল পর্যন্ত। একটি হাদিসে একথা পাওয়া যায় যে, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ খৃস্টান না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।
বুঝা গেলো যে, ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আগমনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত খৃস্টানদের শৌর্য-বীর্য ও সাম্রাজ্য অটুট থাকবে। অধিকাংশ লোক খৃস্টানদের সাথে মেলবন্ধন বজায় রাখবে। খৃস্টানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অধিক হবে। তাদের একটি পক্ষ ইহুদীদের সাহায্য করবে এবং অন্য পক্ষ মুসলমানদের সাথে নাম সর্বস্ব মৈত্রী স্থাপন করবে। এ কারণে হযরত ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আগমনকালীন সময় পর্যন্ত তাদের শৌর্য-বীর্য বাড়তে থাকবে। মদীনা শরীফ হতে পূর্ব দিকে অবস্থিত অঞ্চলের লোকেরা তার সাহায্যকারী হবে। ইমাম মাহদীর (عليه السلام) আর্বিভাবের পর তাদের (খৃস্টানদের) শৌর্য-বীর্য খতম হয়ে যাবে। যদিও হাদিসটি দূর্বল, তবে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কিছুটা শক্তিশালী বলে মনে হয়।
কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সমধিক জ্ঞাত।

❏ প্রশ্ন-১৪০: ইবলিশ শয়তান কি বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলো?

✍ উত্তর: তাফসীরে ইবনে কাসিরে নানা ধরনের বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে যা দ্বারা একথাটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, 

شيطان قبل المسخ من اشراف الملائكة وخازن الجنةو سلطان السماء الدنيا والارض. 

‘শয়তান বিতাড়িত হওয়ার পূর্বে ছিলো ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জান্নাতের কোষাধ্যক্ষ এবং পৃথিবীর সন্নিকটস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সম্রাট। আর ইলমে ইজতিহাদে সে ছিলো ফেরেশতাদের চেয়ে এগিয়ে।’
ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) বলেন, 

قال ابن عباس رضى الله عنه كان ابليس من اشرف الملائكة واكرمهم قبيلة، وكان خازنا على الجنان وكان له سلطان السماء الدنيا وكان له سلطان الارض. 

‘ইবলিশ ছিলো ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, গোত্রীয় দিক দিয়ে তাদের চেয়ে সম্মানিত, জান্নাতসমূহের কোষাধ্যক্ষ। তার অধীনে ছিলো পৃথিবী ও আকাশের রাজত্ব।’ 
184. আহকামুল মারজান, পৃষ্ঠা নং-১৫৫, হায়াতুল হাইওয়ান দামিরী, খন্ড নং-১, পৃষ্ঠা নং-২৯৮; তাফসীরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা নং-৭৫, ফেরেশতাগণ কর্তৃক আদমকে সিজদা সম্পর্কীত অধ্যায়।

كان من اشدهم اى اشد الملائكة اجتهادًا واكثرهم علما، كان اشرف الملائكة من ذوالاجنحة الاربعة كان من اشراف الملائكة واكرمهم قبيلة وكان خازنا على الجنان . كان له سلطان السماء الدنيا وكان له سلطان الارض . وكان يسوس ما بين السماء والارض فعصى فمسخه اللهُ شيطانا رجيما كان ابليس رئيس الملائكة السماء الدنيا.

‘সে ইজতিহাদের দিক দিয়ে ফেরেশতাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলো এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে ছিলো তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞানের অধিকারী। সে ফেরেশতাদের মধ্যে মর্যাদাশীল চার ফেরেশতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলো এবং গোত্রীয় দিক দিয়ে তাদের চেয়ে সম্মানিত। সে ছিলো জান্নাতসমূহের কোষাধ্যক্ষ। তার হাতে ছিলো পৃথিবীর সন্নিকটস্থ আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব। আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী অবস্থিত সকল কিছুর ওপর চলত তার শাসন ক্ষমতা। অতঃপর সে আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করলো। এরপর আল্লাহ্ শয়তানকে অভিশপ্ত অবস্থায় বিতাড়িত করলেন। ইবলিশ ছিলো পৃথিবীর সন্নিকটস্থ আসমানের ফেরেশতাদের সরদার।’

❏ প্রশ্ন-১৪১: হযরত ইবরাহিম (عليه السلام), ইসমাইল (عليه السلام) এর স্থলে যে দুম্বাটি জবাই করেছিলেন ওই দুম্বাটির গোশত কারা ভক্ষণ করেছিলো?

✍ উত্তর: হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) কর্তৃক জবাইকৃত পশুটির গোশতের ব্যাপারে আল্লামা শায়খ আহমদ সাভী (رحمه الله تعالي ) লিখেন, এই পশুটির গোশত ভক্ষণ করেছিলো জীব-জন্তু ও পক্ষীকুল। কারণ তা রান্না করা ছিলো কঠিন, বরং এক প্রকার অসম্ভবই ছিলো। কেননা জান্নাতী গোশতের ওপর আগুনের কোন ধরনের প্রভাব থাকেনা। 

وبقىٰ قرناه معلقين على الكعبة الى ان احترق البيت فى زمن ابن الزبير وما بقىٰ من الكبش اكلته السباع والطيور لان النار لا تؤثر فيها وهو من الجنة .

‘ইবনে যুবায়ের (رحمه الله تعالي ) এর শাসনকালে বায়তুল্লাহ শরীফে অগ্নিকান্ড হওয়া পর্যন্ত সময়ে এই পশুর শিং দু’টি কা’বা শরীফের ওপর লটকানো অবস্থায় ছিলো এবং এর অবশিষ্টাংশটুকু জীব-জন্তু ও পক্ষীকুল ভক্ষণ করেছিলো। কারণ আগুন পশুটির ওপর কোন প্রভাব রাখতে পারে না।  যেহেতু তা ছিলো জান্নাতী পশু।’ 
185. তাফসীরে সাভী, খন্ড নং-৪, পৃষ্ঠা নং-৩৪, ।

তাফসীরে জুমল এর ৩য় খন্ড ৫৪৯নং পৃষ্ঠায় সূরা আস্-সাফ্ফাত এর তাফসীরে রয়েছে যে,

وقد بقىٰ قرناهُ معلقين على الكعبة الى ان احترق البيت فى زمن ابن الزبير ومن المعلوم المقرر ان كل ماهو من الجنة لا نؤ ثر فيه النار فلم يطبخ لحم الكبش بل اكلته السباع والطيور.

‘ইবনে যুবায়ের (رحمه الله تعالي )এর শাসনকালে বায়তুল্লাহ শরীফে অগ্নিকান্ড ঘটা পর্যন্ত এই পশুটির শিং দু’টি কা’বা শরীফের ওপর লটকানো অবস্থায় ছিলো। এ কথাটি স্বীকৃত যে, এই পশুটি ছিলো জান্নাতী। আগুন যার ওপর কোন প্রভাব রাখেনা। দুম্বাটির গোশত রান্না করা হয়নি। বরং তা জীব-জন্তু ও পক্ষীকুল ভক্ষণ করেছিলো।’ 
185. বাদায়ে আল যাহুর, পৃষ্ঠা নং-৮০; সূরা আস্-সাফ্ফাত, হযরত ইসমাইল (আ) এর জবেহের কাহিনী। 

❏ প্রশ্ন-১৪২: কে শাসন ক্ষমতার জন্য অধিক যোগ্য  হবেন? অনভিজ্ঞ মুত্তাকী ও আলেমে দ্বীন নাকি অভিজ্ঞতা আলেম নন এমন মানুষ?
---
কোন দেশে যদি এমন একজন ব্যক্তি থাকেন যিনি মুত্তাকী, পরহেযগার ও আলেমে দ্বীন, তবে অনভিজ্ঞ। আবার যদি এমন একজন ব্যক্তি থাকেন যিনি মুত্তাকী ও আলেমে দ্বীন নন, তবে শাসনকার্য ও ব্যবস্থাপনা কার্যে ব্যাপক অভিজ্ঞতার অধিকারী- এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতদুভয়ের মধ্যে কে শাসন ক্ষমতার জন্য অধিক যোগ্য ও অধিকারী হবেন?

✍ উত্তর: কালাম শাস্ত্রের কিতাবাদিতে রয়েছে যে, খিলাফত ও শাসন ক্ষমতার প্রধান হওয়ার জন্য নিষ্পাপ হওয়া শর্ত নয়, অনুরূপ এটাও শর্ত নয় যে, তাকে সমকালীনদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি দক্ষ ও রাষ্ট্রের শাসন কার্যের ব্যাপারে অভিজ্ঞ, সে আলেম ও মুত্তাকী না হলেও তাকে শাসন ক্ষমতার প্রধান বা আমির বানানো জায়েয। তবে যে ব্যক্তি শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন করে, তাকে আমির বানানো জায়েয নয়। 
186. শরহুল আক্বায়েদ, পৃষ্ঠা নং-১৫৬

‘আল-খিলাফাহ ওয়াল ইমারাহ’ গ্রন্থে রয়েছে যে, 

ولا يشترط فى الامام ان يكون افضل من اهل زمانه لان المساوى فى الفضيلة بل المفضول الاقل علما وعملا اى كان اعرف بمصالح الامامة ومفاسدها واقدر على القيام بمواجبها خصوصًا اذا كان المفضول ادفع للشر وابعد عن اثارة الفتنة . 

‘নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য এটা শর্ত নয় যে, তাকে সমকালীনদের মধ্যে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হতে হবে। কেননা মর্যাদায় সমকক্ষ ব্যক্তি, বরং ইলম ও আমলে কম মর্যাদাবান ব্যক্তিও যিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন বিশেষতঃ যিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে পারেন এবং ফিতনার আলামত দূর করতে পারেন- এমন ব্যক্তি স্বল্প জ্ঞানী হলেও তাঁকে রাষ্ট্র প্রধান করা জায়েয।’

‘শরহুল মুজাল্লাহ্’ গ্রন্থে রয়েছে যে, 

يجوز تقليد الفاسق وتنفذ قضاياه اذالم يجاوز فيها حدالشرع .

‘ফাসিক ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মেনে চলা এবং তার সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা জায়েয।’ 
187. শরহুল আক্বায়েদ, পৃষ্ঠা নং-১৬৪

আমাদের আবেদন! যারা  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র মান-মর্যাদায় বেয়াদবী করে এবং অশালীন ও অশ্রাব্য কথাবার্তা বলে, বাংলাদেশের আইনে তাদের মৃত্যুদন্ডের শাস্তি সংসদে পাশ করার জন্য সুপারিশ করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। তাই ক্ষমতাসীনদের নিকট আমাদের জোর আবেদন হচ্ছে, এই আইনটি সংশোধন করতঃ  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র মান-মর্যাদায় যারা বেয়াদবী করে তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের শাস্তির বিধান করা হোক। কারণ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র পবিত্র মান-মর্যাদার ব্যাপারে অনুচিত শব্দ ব্যবহার করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাই মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে যারা রাসূলুল্লাহ'র শানে বেয়াদবী করে তারা মুরতাদ এবং তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব।

ফতোয়ায়ে শামীতে রয়েছে,

 اجمع المسلمون ان شاتمه كافر

‘রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে গালমন্দকারী মুসলমানদের সর্বসম্মত মতে কাফির।’ তার বিধান হচ্ছে মুরতাদের বিধানের অনুরূপ ان حكمه كالمرتد এবং তার ওপর মুরতাদের বিধান প্রয়োগ করা হবে। 
188. দুররুল মুখতার, মুরতাদ অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং-৩১৮

ফতোয়ায়ে শামীতে একথাও রয়েছে যে,

 اجمع المسلمون ان شاتمه كافر وحكمه القتل ومن شك فى عذابه كافر. 

‘এটা মুসলমানদের সর্বসম্মত মত যে, যে ব্যক্তি  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে গালমন্দ করে সে কাফির এবং যে ব্যক্তি তার (গালমন্দকারী) কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে সেও কাফির।’

ফতোয়ায়ে আলমগিরীতে রয়েছে যে,

 اهانة النبى صلّى الله عليه وسلّم بالاجماع كفر .

 ‘ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)   কে অসম্মান করা সর্বসম্মত মতে কুফরী।’ 
189.দুররুল মুখতার, মুরতাদ অধ্যায়, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-২৬৩

উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ হতে প্রতীয়মান হয় যে, যে ব্যক্তি  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র শানে (মান-মর্যাদা) বেয়াদবী করে, সে সর্বসম্মতভাবে কাফির ও মুরতাদ এবং যে ব্যক্তি তার কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে সেও কাফির এবং ইসলাম হতে বহিষ্কৃত। আর মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। সুতরাং  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারীদের শাস্তি মৃত্যুদন্ডই। 

হাদিস শরীফে বর্ণিত রয়েছে যে, 

من بدّل دينه فاقتلوهُ 

‘যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীন (ধর্ম) পরিবর্তন করলো, তাকে হত্যা করো।’রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)’র ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম এ বিষয়ের ওপর সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্য পোষণ করলেন যে, মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড।"
190. বাদায়েয়ুস সানায়ে, মুরতাদ অধ্যায়।

‘রাসায়েলে ইবনে আবেদীন’ এর মধ্যে রয়েছে যে, মুসলিম উম্মাহ একথার ওপর ঐকমত্য পোষণ করে যে, মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ডই। ‘বাহরুর রায়েক্ব’ গ্রন্থের মুরতাদ অধ্যায়ে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ   এর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে কিংবা তাঁকে গালমন্দ করবে, সে কাফির ও মুরতাদ এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। 
191. বাদায়েয়ুস সানায়ে, মুরতাদ অধ্যায়।

অনুরূপ নবীগণের মধ্যে কোন নবীকে গালমন্দকারী কাফির। ‘উকূদুদ দুররিয়াহ ফি তানকিহিল হামিদ’ গ্রন্থে রয়েছে যে, 

سب النبى صلّى الله عليه وسلّم او احد من الانبياء عليهم السلام كفر

‘ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)    কিংবা নবীগণের (عليهم السلام) কোন একজন নবীকে (عليه السلام) গালমন্দ করা কুফরী।’

ওলামায়ে দেওবন্দের অভিমত: এখন ওলামায়ে দেওবন্দ এর মতামত ও ফতোয়া পেশ করছি। তারাও এ বিষয়ে একমত। মুফতী কেফায়াতুল্লাহ সাহেবও ‘কেফায়তুল মুফতী’ নামক গ্রন্থে এই মাসআলাটির ব্যাখ্যা-বিশে­ষণ দিয়েছেন। তিনি বলেন,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কিংবা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنه) এর মহান মর্যাদায় শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি কিংবা এরূপ শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তির প্রতি যে ব্যক্তি অসন্তোষ প্রকাশ করবেনা, সেও কাফির। ফোকাহায়ে কেরাম (رحمه الله تعالي ) এ বিষয়ে একমত যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র পবিত্র মান-মর্যাদার প্রতি শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি কাফির। 
192. কেফায়াতুল মুফতি, মুরতাদ অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং-৭১, খন্ড নং-১।

মুফতী মাহমুদ দেওবন্দী গাঙ্গুহী সংকলিত ‘ফতোয়া মাহমুদিয়া ’ এর মধ্যে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি হুযূর (ﷺ) এর পবিত্র মান-মর্যাদায় গালমন্দ করবে এবং অশালীন কথাবার্তা বলবে, সে মুরতাদ এবং ইসলামের পরিসীমা হতে বহিষ্কৃত। তাওবা করা তার জন্য আবশ্যক। আর যদি সে তাওবা না করে, তাহলে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। 
193. ফতওয়া মাহমুদিয়া, পৃষ্ঠা নং-১৬২, খন্ড নং-১২

থানভী দেওবন্দী কর্তৃক সংকলিত ‘এমদাদুল ফাতাওয়া’ এর মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও বেয়াদবী করা কুফরী। 
194. এমদাদুল ফতওয়া, আকায়েদ অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং-৩৯১, খন্ড নং-৫।

‘ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ’ কিতাবের মুরতাদ অধ্যায়ে রয়েছে যে, নবী করিমকে (ﷺ) গালমন্দ করা কুফরী। 
195. এমদাদুল ফতওয়া, পৃষ্ঠা নং-৩৫৯

রাসূলুল্লাহ(ﷺ)’র শানে শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি সর্বসম্মত মতে কাফির ও মুরতাদ এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব।
তবে মতানৈক্য কেবল এ বিষয়ে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’র শানে শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি কি তাওবার কারণে মৃত্যুদন্ড হতে রেহাই পাবে নাকি পাবেনা। ‘ফতোয়ায়ে শামী’ এর মধ্যে রয়েছে যে,  

اجمع المسلمون ان شاتمه كافر وحكمه القتل 

"রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)   ’র শানে বিয়াদবী প্রদর্শনকারী ব্যক্তি কাফির এবং তার বিধান হচ্ছে হত্যা বা মৃত্যুদন্ড।’

‘আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের’ গ্রন্থে রয়েছে যে,

 لا تصح ردة السكران الاالردة بسب النبى صلّى الله عليه وسلّم فانه يقتل ولايعفى عنه . كذا فى البزازية كل كافر تاب فتوبته مقبولة فى الدنيا والاخرة الاجماعة الكافر يسب النبى صلّى الله عليه وسلّم وسائر الانبياء يعقب .

‘নবী করিম (ﷺ) কে গালমন্দ করা কুফরী যদিও কেউ মাতাল অবস্থায় গালমন্দ করে থাকুক। আর নবী করিম (ﷺ) কে গালমন্দকারী ব্যক্তির তাওবা কবুল হবে না।’ 
196. এমদাদুল ফতওয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা নং-২৮৬।

‘ফতোয়া হিন্দিয়া’ এর মধ্যে রয়েছে যে,  

استخفاف النبى صلّى اللهُ عليه وسلّم كفر. 

নবী করিম  কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কুফরী।’

 ‘ফতোয়ায়ে কাযীখান’ এর মধ্যে রয়েছে যে,

اذا عاب الرجل النبى صلّى الله عليه وسلّم فى شئى كان كافرا وتكر فى الاصل ان شتم النبى صلّى الله عليه وسلّم كفر . 

রাসূলুল্লাহ  কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও গালমন্দ করা কুফরী ও ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়ার কাজ)। কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে হুযূর (ﷺ) এর দোষ-ত্রুটি রটালে কিংবা মর্যাদাহানিকর কোন কথাবার্তা বললে সে কাফির।
সাবধান! মুখ হিফাজত করা ফরয। এই মাসআলাটি ঈমানের মাপকঠি। যেমন তেমন কথা বলা যাবেনা। মুফতী আব্দুল হক দেওবন্দীও যথেষ্ট ব্যাখ্যা,বিশে­ষণ করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ  ’র শানে শিষ্টাচার বিবর্জিত আচরণকারী ব্যক্তি সর্বসম্মত মতে কাফির ও মুরতাদ এবং তার কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তিও কাফির এবং ইসলামের পরিসীমা হতে বহিষ্কৃত। মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে হত্যা বা মৃত্যুদন্ড। সুতরাং  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ’র প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারী ব্যক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ডই। 
197. ফাতওয়া হক্কানীয়া, খন্ড নং-২, পৃষ্ঠা নং-৩৭৫, মুফতী আব্দুল হক সাহেব, প্রতিষ্ঠাতা: জামে দারুল উলুম হক্কানীয়া, আকোড়া খটক, নও শাহরা জেলা, পাকিস্তান।

❏ প্রশ্ন-১৪৩: الاستمناء باليد তথা হাত দ্বারা বীর্যপাত করা অর্থাৎ হাত দ্বারা বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করা, শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এর বিধান কী?

✍ উত্তর: কোরআন-হাদিসের বর্ণনা এবং ওলামায়ে কেরাম এর বক্তব্য মতে হস্তমৈথুন প্রবলতর ওজর ব্যতীত হারাম ও না-জায়েয। হস্তমৈথুনকারী ব্যক্তি শাস্তির যোগ্য। যখন কোন ফেতনায় পড়ার আশংকা থাকে, তখন এমতাবস্থায় ‘দু’টি বিপদ থেকে সহজটি বেছে নেওয়া’ নীতির আলোকে অনুমতি থাকতে পারে।
‘রুদ্দুল মুখতার’ গ্রন্থের হুদুদ অধ্যায়ের শাস্তি সম্পর্কীত পরিচ্ছেদে রয়েছে যে, الاستمناء حرام وفيه التعزيرُ বীর্যপাত করা (বাইরে ফেলে দেয়া) হারাম এবং তাতে শাস্তি আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।  التعزير لا يسقط بالتوبة كالحد-‘হদ (কোরআন বর্ণিত শাস্তির) এর মত তাওবার মাধ্যমে তাযির (শাস্তি) রহিত হয়ে যায় না।’ 
198. দুররুল মুখতার, শাস্তি অধ্যায়।

اى بالكف اذا كان لاستجلاب الشهوة اما اذا غلبته الشهوة وليس له زوجة ولا امة ففعل ذلك لتسكينها فالرجاء انه لاوبال عليه . وكذا اختلف فى استمناء الرجل بيده ويسمى الخضخضة وجلد عميرهة . فجمهور الائمة على تحريمه وهو عندهم داخل فيما وراء ذلك، قال ابن الهمام يحرم فان غلبه الشهوة ففعل ارادة تسكينها به، فالرجاء لايعاقب .

‘হস্তমৈথুন যখন প্রবল যৌন উত্তেজনার কারণে করা হয় এবং হস্তমৈথুনকারী ব্যক্তির স্ত্রী বা দাসী না থাকলে সে প্রশান্তি লাভের জন্য এরূপ করে থাকলে আশা করি তার ওপর কোন শাস্তি প্রয়োগ করা হবেনা।’ 
199. ফতওয়া শামী, হুদুদ অধ্যায়, শাস্তি সম্পর্কীত পরিচ্ছেদ; তাফসীরে রুহুল মা‘আনী,200. সূরা আল-মুমিনুন, পৃষ্ঠা নং-১০, খন্ড নং-১৮; অনুরূপ তাফসীরে মাযহারী,200. সূরা আল-মুমিনুন।

অনুরূপ পুরুষের হস্তমৈথুনের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। একে ‘খাদ্খাদাহ’ বা নাড়ানো বলা হয়। এর কারণে ওমর (رضى الله تعالي عنه) বেত্রাঘাত করেছেন। জমহুর এর মতে হস্তমৈথুন হারাম এবং তা অন্যান্য হারামের মত হারামের অন্তভুর্ক্ত। ইবনুল হুমাম বলেন, হস্তমৈথুন হারাম। যদি প্রবল যৌন উত্তেজনায় প্রশান্তি লাভের আশায় তা করা হয়, তাহলে আশা করি সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে না।

❏ প্রশ্ন-১৪৪: এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত এর ওলামায়ে কেরাম কী বলেন যে, আমাদের দেশে ইসলামী কনফারেন্স, মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যেগুলোর মূল উদ্যোক্তা, সংগঠক, নেতা, কর্মী ও অনুসারীগণ হচ্ছে কলেজ-ইউনির্ভাসিটির বিভিন্ন চিন্তা-দর্শন ও মাযহাবপন্থী ছাত্ররা। এসব সংগঠনে ওয়াহাবী-সুন্নী নির্বিশেষে প্রত্যেক কলেমা উচ্চারণকারী রাফেযী, ওয়াহাবী, নজদী, কাদিয়ানী, মওদূদী বিভিন্ন মতাবলম্বী সদস্য হতে পারে। সুন্নী জনতা কর্তৃক এরূপ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা, এগুলোতে অংশগ্রহণ করা, জান-মাল দিয়ে এসব সংগঠনকে সাহায্য করা, এগুলোর সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করা, বদ-দ্বীন ও মুরতাদদেরকে মুসলমান মনে করে তাদের সঙ্গ দেওয়া, তাদেরকে মুসলমান মনে করা এবং তাদের সাথে মৈত্রী বা মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তাদের নিকট হতে উন্নতি ও উপকারের আশা করা, শরীয়তে এগুলোর বিধান কী? বিষয়টি আমাদের ধর্মীয় নেতাগণ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে সহজ-সরল মুসলমানদেরকে গুমরাহী হতে বাঁচিয়ে উভয় জগতের কল্যাণ লাভ করতে পারেন।

✍ উত্তর: এ ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা। এতে অংশগ্রহণ করা হারাম এবং বদ মাযহাবীদের সাথে মেলামেশা ও মৈত্রী স্থাপন করা অগ্নির মত বিপদ। এসব সংগঠনে থাকে ভয়ংকর আগুনের দিকে টেনে টেনে নিয়ে যাবার লোক। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,

 وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ .

‘যদি শয়তান আপনাকে বিস্মৃত করে বা ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর যালিমদের সাথে বসবেন না।’  
200. সূরা: আন্-আম, আয়াত: ৬৮।

‘তাফসীরে আহমদীয়া’ এর মধ্যে রয়েছে যে,

 دخل فيه الكافر والمبتدع والفاسق، القعود مع كلهم ممتنع . 

 এই আয়াতের আদেশের আওতায় প্রত্যেক কাফের, বিদ‘আতী ও ফাসেক অন্তভুর্ক্ত। তাদের কারো সাথে বসার অনুমতি নেই। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,

وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ 

‘যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না, পড়লে আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে।’  
201. সূরা: হুদ, আয়াত: ১১৩।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদিসে রয়েছে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন, 

اياكم واياهم لايضلونكم ولايفتنونكم 

‘তাদের নিকট থেকে দূরে থাকো এবং তাদেরকে তোমাদের নিকট থেকে দূরে রাখো, যাতে তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে এবং তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখে পতিত না করে।’ 
মুসলমানদের ঈমান হচ্ছে, আল্লাহ্ ও রাসূল   ব্যতীত আমাদের অধিক কল্যাণকামী আর কেউ নেই। তারা যে দিকে আমাদেরকে আহ্বান করেন সুনিশ্চিতভাবে সেদিকে আমাদের কল্যাণ নিহিত থাকে এবং যে সব বিষয় হতে আমাদের বারণ করেন নিঃসন্দেহে তাতে রয়েছে আমাদের সুস্পষ্ট ক্ষতি, অনিষ্ট ও বিপদ। মুসলমানের আকৃতি ধারণ করে যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের   বিধানের বিরুদ্ধে মানুষকে আহ্বান করবে, জেনে রেখো; নিঃসন্দেহে তারা ডাকাত, তাদের অপব্যাখ্যায় কখনো কান দেবেনা। তারা ছিনতাইকারী যারা মুসলমানদেরকে স্বীয় জামাত থেকে বের করে ছিনতাই করে নিয়ে যেতে চায়। তারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কথাবার্তা বলবে। যখন কেউ তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে তাদের দলে ভিড়বে, তখন তার গর্দান কেটে নিবে এবং তার সর্বস্ব লুটে নিবে। বাঘের পশম পরিধান করতঃ বাঘের বেশ ধারণ করে যে আসলো সে তাদের দলে ভিড়ে গেলো।
হুযূর (ﷺ) তোমাদের বারণ করেন। তিনি তোমাদের প্রাণাধিক কল্যাণকামী।
 عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ  
‘তোমাদের যে কোন বিপদ তার পবিত্র অন্তরে অসহ্য যন্ত্রণা সৃষ্টি করে।’  
202. সূরা তাওবা, আয়াত: ১৮২।

তিনি অতি দয়ালু। স্বীয় সন্তানের প্রতি তোমরা যেরূপ দয়ালু, আল্লাহ ও তিনি (ﷺ) তোমাদের প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়ালু। তিনি (ﷺ) বলেন, 

ايَّاكُم وَايَّاهم لايضلونكم ولايفتنونكم 

‘তাদের নিকট হতে দূরে থাকো এবং তাদেরকে নিজেদের নিকট হতে দূরে রাখো, যাতে তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে না দেয় এবং তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখে পতিত না করে।’

ইমাম ইবনে হিব্বান, তাবারানী ও ওকাইলীর হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

  لاتواكلوهم ولاتشاربوهم ولاتجالسوهم ولاتناكحوهم واذا مرضوا فلاتعودوهم واذا ماتوا فلاتشهدوهم، ولاتصلوٰ عليهم ولاتصلوٰ معهم . 
‘তাদের সাথে খাবার খেয়োনা, পানি পান করোনা, তাদের নিকট বসোনা, তাদের সাথে বিবাহ বন্ধন স্থাপন করোনা, তারা অসুস্থ হলে খবর নিতে যেয়োনা, মারা গেলে তাদের লাশ দেখতে যেয়োনা, তাদের জানাযা পড়োনা এবং তাদের সাথে নামায পড়োনা। 
আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর ফারুক (رضى الله تعالي عنه) মসজিদে নববীতে মাগরিবের নামাযের পর কোন বুভূক্ষ বা ক্ষুধার্ত বা নিজের সাথে খিলাফতের পতাকা বহনকারী মুসাফিরের জন্য খাবার তলব করলেন। যখন সে খাবার খেতে বসলো তখন তার নিকট হতে কোনরূপ বদ মযহাবী কথাবার্তা প্রকাশ পেলো। এমতাবস্থায় তিনি তৎক্ষণাৎ খাবার সরিয়ে নেওয়ার এবং তাকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর তার সম্মুখ দিক হতে খাবার সরিয়ে দেওয়া হল এবং তাকে বের করে দেওয়া হলো। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (رضى الله تعالي عنه) এর নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে বললো যে, অমুক ব্যক্তি আপনাকে সালাম বলেছে। তখন তিনি বললেন, لاتقرأ منى السلام فانى سمعتُ انه احدث  ‘আমার নিকট হতে তাকে সালাম বলোনা। আমি শুনেছি যে, সে কিছু কুসংস্কার (বিদআত) আবিষ্কার করেছে।’
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) এর শাগরেদ হযরত সাঈদ বিন জুবাইর পথিমধ্যে একজন বদ-মযহাবী (বিদআতী) এর দেখা পেলো, ওই বিদআতী বললো, আমি কিছু বলতে চাই। তখন তিনি বললেন, আমি কিছু শুনতে চাইনা। তখন সে আবার বললো, একটি শব্দ বলতে চাই। তখন তিনি কনিষ্ঠ আঙ্গুলি মাথায় রেখে বললেন, لا نصف كلمته আধা শব্দও নয়। লোকেরা প্রশ্ন করলো এর কারণ কী? কারণ সে ছিল এদের দলভূক্ত। 
হযরত আনাস বিন মালেক (رضى الله تعالي عنه) এর শাগরেদ ইমাম মুহাম্মদ বিন সিরীনের নিকট ওই বিদআতী লোকটি আসলো, সে আরয করলো, কুরআনের কিছু আয়াত আমাকে শুনান। তিনি বললেন, আমি শুনাতে চাইনা। সে (বিদআতী) আবার বললো, রাসূলুল্লাহ'র   কয়েকটা হাদিস শুনান। তিনি বললেন, আমি শুনাতে চাইনা। সে বার বার জোরাজোরি করলে তিনি বললেন, হয়তো তুমি ওঠে যাও নচেৎ আমি ওঠে যাচ্ছি। পরিশেষে সে হতাশ হয়ে চলে গেলো। লোকেরা বললো, হে ইমাম! আপনার কী অসুবিধা হতো যদি তাকে দু’য়েকটি আয়াত বা হাদিস শুনাতেন? তখন তিনি একথার উত্তরে বললেন, আমি আশংকা করেছি যে, সে ওই আয়াত ও হাদিস সমূহের সাথে নিজের কিছু অপব্যাখ্যা যুক্ত করবে এবং তা আমার অন্তরে গেঁথে যাবে, তখন আমি ধ্বংস হয়ে যাবো। যখন ইমামগণের নিকট এই ভীতি ও আশংকা ছিল তখন সাধারণ জনগণের নিকট এই সাহস কোথায়?

لَا حَولَ وَلَا قوةَ اِلّا بِاللهِ .

এ ধরনের সংগঠন ও জায়গায় অর্থ দেওয়ার বিষয়টি ওই লোকই পছন্দ করবে যার কোন দ্বীন ও জ্ঞান-বুদ্ধি নেই। সে তার উভয় জগত নষ্ট করলো- অর্থও হারালো এবং আখিরাতে শাস্তির উপযুক্তও হলো। 
203. ইযাফাতে ইমাম আহমদ রেযা কাদেরী।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,  

فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَىٰ مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ. 

স্মরণ হওয়ার পর যালিমদের সাথে বসবেন না এবং প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেন,  ايَّاكُمْ وَ ايَّاهم‘তাদের নিকট হতে দূরে থাকো এবং তাদেরকে নিজেদের নিকট হতে দূরে রাখো।’ 
204. ইযাফাতে ইমাম আহমদ রেযা কাদেরী।

এখন গভীরভাবে চিন্তা করো, বিশেষভাবে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফের বিশিষ্টতার এটাও একটা কারণ যে, যাবতীয় নেয়ামতরাজির বিদ্যমানতা হুযূর   এর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং পুরো সৃষ্টি জগতের বিদ্যমানতা ও নির্ভরশীলতা হুযূর (ﷺ) এর অস্তিত্বের ওপর। সুতরাং যেহেতু দুনিয়া-আখিরাত এর ছোট-বড় এবং শারীরিক-আত্মিক যাবতীয় নেয়ামত রাসূলুল্লাহ'র   উসিলায় পাওয়া গেছে। তাই এই দিনটা ঈদের দিনের চেয়েও উত্তম হলো। কারণ তাঁর উসিলায় তো ঈদের দিনটা ঈদের দিন হলো। এ কারণে সোমবারের রোজা রাখার কারণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, فِيْهِ ولِدْتُ‘ ওই দিন আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছি।’ 

❏ প্রশ্ন-১৪৫: নকশবন্দিয়া খান্দানে খতমে খাজেগান সর্বদা দৈনিক পড়া হয়। কোন কোন সময় সহিংসতা, অস্থিরতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহকালে ফজরের নামাযে ইমাম সাহেব মসজিদে কুনুতে নাযেলাও পড়েন এবং ফজরের নামাযের পর মুক্তাদিদের নিয়ে খতমও পড়েন। এই ইমাম সাহেব কোন সিলসিলার সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। যদি কেউ এই মর্মে প্রশ্ন করে যে, তার এই কাজটা শরীয়ত পরিপন্থী। কারণ যে কাজ কোরআন, হাদিস ও ফিকাহে নেই তা শরীয়ত বিরোধী।

✍ উত্তর: খতমে খাজেগান হচ্ছে উপরোক্ত দরূদ ও ওজিফার সমন্বয়। এতে শরীয়ত বিরোধী কোন শব্দ অন্তভুর্ক্ত নেই। সুতরাং তা পড়লে কোন অসুবিধা নেই। তবে তা কোন শরয়ী হুকুমের ফাত্ওয়া দেওয়া যাবেনা। বর্জনকারীকে ভর্ৎসনাও করা যাবে না।
কোন ব্যক্তি খুশিতে শরীক হলে ঠিক আছে। আর শরীক না হলে তার ওপর কোন অপবাদ দেওয়া যাবে না। কোন বিষয় বিদআত ও নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য আবশ্যক হচ্ছে ওই বিষয়টা শরয়ী দিক দিয়ে প্রমাণিত হবেনা এবং তা যদি দ্বীনের হুকুম বা বিধান বানিয়ে নেওয়া হয় এবং তা বর্জনকারীকে নিন্দিত বলে সাব্যস্ত করা হয়। 
205. মুফতী আব্দুস সাত্তার দেওবন্দী, নায়েবে মুফতী : খায়রুল মাদারিস, মুলতান, পাকিস্তান, খায়রুল ফাতাওয়া, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৩৩৯


❏ প্রশ্ন-১৪৬: কোন নামাযের পর খতমে খাজেগানের পাঠকে নিয়মিত অযিফা বানিয়ে নেওয়া কেমন?

✍ উত্তর: হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (رحمه الله تعالي ) রচিত ‘যিয়াউল কুলূব’ গ্রন্থে চিশতীয়া ও কাদেরীয়া তরিকার খতমে খাজেগান বিদ্যমান রয়েছে। হযরত শায়খুল হাদিস ও তার কতিপয় খলিফার নিকট রমযানুল মুবারকের ইতিকাফের সময় জোহরের নামাযের পর চিশতীয়া তরিকার খতমে খাজেগান পাঠ করা হয়। খায়রুল মাদারিস মুলতানে দৈনিক আছরের নামাযের পর তা পাঠের অভ্যাস রয়েছে। দীর্ঘ দিন হতে একটি মসজিদে খতমে খাজেগানের পাঠভ্যাস ছিল। কিছু কিছু লোক যারা নিজেদেরকে ওলামায়ে দেওবন্দ বলে দাবী করে তারা একথা বলে এই খতম শরীফ বন্ধ করে দিলো যে, এটা বিদআত। উল্লেখিত মসজিদের অনুরূপ যেখানে এটার পাঠভ্যাস নিয়মিত হয়েছে সেখানে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ এটা বিদআত।

❏ প্রশ্ন-১৪৭: বিয়েতে প্রস্তাবের উত্তরে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বলা কেমন? এক পক্ষ হতে প্রস্তাব দেওয়ার পর দ্বিতীয় পক্ষ হতে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে নাকি হবে না? কতিপয় আলেম বলেন, আলহমাদুলিল্লাহ শব্দটি ‘তামলিকে আইন’ তথা হুবহু মালিকানাকে নির্দেশ করেনা, তাই বিয়ে শুদ্ধ হবে না। আবার কতিপয় আলেম বলেন, যেহেতু আমাদের এলাকার প্রথায় আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি ‘কবুল’ শব্দটি বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, তাই এর দ্বারা বিয়ে শুদ্ধ হওয়া উচিত।

✍ উত্তর: বিয়ের নিয়তে ‘কবুল’ শব্দের পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বললে বিয়ে শুদ্ধ বা অনুষ্ঠিত হবে কিনা? ফতোয়ায়ে আলমগীরির ১ম খন্ডর ২৭২নং পৃষ্ঠায় রয়েছে যে, 

امرأة قالت لرجل تزوجت نفسى منك فقال الرجلُ بخداوند كارى پذيرفتم يصح النكاح ولو لم يقل الرجل ذلك لكنه قال لها شاباش ان لم يقل بطريق الطنزِ يصح النكاح كذا فى الخلاصة .

কোন পুরুষকে লক্ষ্য করে একথা বললে আমি তোমাকে বিয়ে করলাম এবং পুরুষ লোকটি একথা বললে আল্লাহর ফজলে আমি কবুল করলাম, এক্ষেত্রে বিয়ে শুদ্ধ হবে। আর যদি পুরুষ লোকটি একথা না বলে, নারী লোকটিকে লক্ষ্য করে সাবাশ বলে এবং যদি তা ঠাট্টা হিসেবে না বলে, তাহলে এই বিয়ে শুদ্ধ হবে। অনুরূপ বর্ণনা ফতোয়া ‘খোলাসা’ গ্রন্থে পাওয়া যায়।
ইজাব ও কবুল শব্দদ্বয় ‘তামলিকে আইন’ তথা হুবহু মালিকানা বুঝানোর জন্য উদ্ভাবিত হওয়া আবশ্যক নয়। বরং কেবল ইজাব এরকম হওয়া যথেষ্ট। অন্যথায় কবুল বললেও কবুল গ্রহণযোগ্য না হওয়া উচিত। কারণ এতে এই সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক যে, কবুলের জন্য সুস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করতে হবে। কেননা ব্যাপারটি হচ্ছে বিয়ের। হতে পারে সে প্রয়োজনের সময় অস্বীকার করে বসবে যখন সে আটকে যাবে।

❏ প্রশ্ন-১৪৮: হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله عنها ) কর্তৃক তাঁকে (ﷺ) রওজায়ে আকদাসে দাফন করার ব্যাপারে নিষেধ করার কারণ কী ছিল? বুখারী শরীফের ১ম খন্ডর কিতাবুল জানায়েয এর মধ্যে একটি হাদিস রয়েছে যার ওপর শিয়ারা এই মর্মে আপত্তি তোলে যে, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) বলেন, আমাকে হুযূর   এর সাথে দাফন করবে না। কারণ আমি তাঁকে পবিত্র মনে করিনা। শিয়াদের এই প্রশ্ন কি সঠিক, দলিল সহকারে বর্ণনা কর ?

✍ উত্তর:  عليه التكلان وهو المستعان আল্লাহর ওপর নির্ভর করছি। তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী। প্রশ্নে উল্লেখিত হাদিসটি সঠিকভাবে উদ্ধৃত করা হয়নি। হাদিসটির মূল ও প্রকৃত শব্দ হচ্ছে,

لا تدفنّى معهم وادفنى مع صواحبى بالبقيع لا ازكىٰ به ابدًا .

হাদিসটির অনুবাদও ভুল, বরং বিকৃত। হাদিসটিতে এরূপ কোন বাক্য নেই যার অনুবাদ হচ্ছে, আমি তাকে পবিত্র মনে করিনা। সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ওমাদাতুল ক্বারী’ এর মধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে,  لا ازكىٰ শব্দটি হচ্ছে, যার অর্থ হচ্ছে, لااثنٰى علّى بسببه ‘যাতে এর দ্বারা আমি প্রশংসিত না হই।’  
206. ওমদাতুল ক্বারী, খন্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং- ২৩৮।

যার মর্মার্থই উদ্দেশ্য। 
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) বিনয় প্রকাশ করতে একথা বলেছেন। এধরনের শব্দ (صيغه مجهول বা কর্মবাচ্যের রূপ) বিনয় ও নম্রতা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, যদি আমাকে হুযূর   এর রাওজায়ে আকদাসে দাফন করা হয়, তাহলে এই দাফনের কারণে মানুষ এই মর্মে আমার প্রশংসা করবে যে, রাসূলুল্লাহ'র (ﷺ) অন্যান্য বিবিগণের এই মর্যাদা ছিলনা যা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضى الله تعالي عنها) এর জন্য ছিল, তাই হযরত আয়েশাকে (رضى الله تعالي عنها) হুযূরের   রাওজায়ে আকদাসে দাফন করা হয় এবং অন্যান্য বিবিগণকে জান্নাতুল বাক্বী বা অন্যান্য জায়গায় দাফন করা হয়। আমি নিজের জন্য এই প্রশংসা চাইনা।
তাই রাওজা পাকে হুযূর (ﷺ), হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) এর সাথে আমাকে যেন দাফন করা না হয় এবং জান্নাতুল বাক্বীতে হুযূরের (ﷺ) অন্যান্য বিবিগণের সাথে দাফন করা হয়।

قال ابن بطال فيه معنى التواضع كرهت عائشة ان يقال انها مدفونة مع النبى صلّى الله عليه وسلّم فيكون فى ذلك تعظيما لها .

ইবনে বাত্তাল বলেন, এর অর্থ হচ্ছে বিনয়। হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها) তাকে রাসূলুল্লাহ'র   সাথে দাফন করার কথা বলতে অপছন্দ করেছেন। এরূপ হলে তা তার জন্য সম্মানের কারণ হয়ে যেত।"
207. ওমদাতুল ক্বারী, খন্ড নং-৮, পৃষ্ঠা নং-২২৮।

তদুপরি আইনীতে ‘তাকমালা লি ইবনিল আবাদ’ এর সূত্রে হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها)-এর কথা- আমাকে হুযূর  , হযরত আবু বকর (رضى الله تعالي عنه) ও হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) এর সাথে দাফন করবে না, এর কারণ হিসেবেও একটি হাদিস বর্ণিত রয়েছে। হুযূর   এর রাওজা পাকে যার যার দাফনের বিষয়টি পূর্ব নির্ধারিত ছিল হুযূর স্বয়ং তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।  

عن عائشة رضى الله عنها قالت قلتُ للنبى صلّى الله عليه وسلّم انى لا ارانى الا ساكون بعدك فتأذن لى ان ادفن الى جانبك . قال و انى لك ذلك الموضع ما فيه الا قبرى وقبر ابي بكر وعمر وفيه عيسىٰ بن مريم عليه السلام.

 হযরত আয়েশা (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেনঃ আমি হুযূরকে (ﷺ) বললাম, মনে হয় আমি আপনার পরে মৃত্যুবরণ করব। সুতরাং আপনার পাশে আমাকে দাফন করার জন্য আপনি অনুমতি দিন, আপনি অনুমতি দিন, তখন হুযূর (ﷺ) বললেন, ওই স্থানে আমার কবর, হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও হযরত ঈসা ইবনে মারইয়ামের কবরের জায়গা ছাড়া আর কোন জায়গা নেই।"
208. ‘আইনী শরহে বুখারী, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-২২৮।

এতে বুঝা গেলো যে, যদিও পূর্বে বা শুরুতে হযরত আয়েশার (رضى الله تعالي عنها) নিকট রাওজায়ে মুস্তাফা   এর মধ্যে দাফন হওয়ার আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ'র হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে দাফন করতে নিষেধ করেন। মোদ্দাকথা তাকে আমি পবিত্র মনে করিনা, এটা হাদিসটির মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য নয়। বরং তা হচ্ছে সাহাবা বিদ্বেষী ইসলামের কোন শত্রুর মস্তিষ্ক প্রসূত কথা।

❏ প্রশ্ন-১৪৯: কোরআন মজিদ খোলার পূর্বে কিছু লোক তাতে চুমো খায়। এই কাজটি জায়েয বা সঠিক কিনা?

✍ উত্তর: আল্লাহই আমাদের সাহায্যকারী। কোরআন মজিদকে চুমো খাওয়া জায়েয।   

 روى عن عمر رضى الله عنهُ انه كان يأخذ المصحف كل غداة ويقبله الخ .

হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি প্রতিদিন সকালে কোরআন নিতেন এবং তাতে চুমো খেতেন। 
209. দুররে মুখতার আলাশ-শামী: খন্ড নং ৫, পৃষ্ঠা নং-২৪৬।

❏ প্রশ্ন-১৫০: مُحَدَّثْ মুহাদ্দাস (দাল বর্ণের ওপর তাশদীদ ও যবর সহকারে) শব্দের অর্থ কী?

✍ উত্তর: مُحَدَّثْ মুহাদ্দাস (দাল বর্ণের ওপর তাশদীদ ও যবর সহকারে)ঃ মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যিনি নিজের পরিশুদ্ধ আত্মার কারণে যে ব্যাপারটি যেরূপ অনুমান করেন বাস্তবেও সেরূপ সংঘটিত হয়, যেনো আলমে মালাকুত হতে তার  অন্তরে ওই ব্যাপারটি ঢেলে দেওয়া হয়। সাইয়েদ শরীফ কৃত মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শরহে মাসাবিহ’ এর মধ্যে বলা হয়েছে, মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার অনুমান এরূপ সত্য হয় যেনো ঊর্ধ্ব জগত হতে তাকে একথা বলা হয়েছে।
‘মাজমাউল বাহার’ নামক গ্রন্থে মুহাদ্দাস শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে ‘মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার অন্তরে আল্লাহর পক্ষ হতে কোন কথা ঢেলে দেওয়া হয় তখন তিনি নিজের ঈমানী দূরদর্শিতার সুবাদে একথার সংবাদ দেন।’
কারো কারো মতে, মুহাদ্দাস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার সাথে ফেরেশতারা কথা বলে।
‘দাল’ বর্ণে তাশদীদ ও যের সহকারে শব্দটির অর্থ হচ্ছে, মুহাদ্দিস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন, পড়েছেন, শুনে আত্মস্থ করেছেন এবং নানা শহর ও অঞ্চল পরিভ্রমণ করতঃ হাদিস শাস্ত্রের নীতিমালা অর্জন করে হাদিসের সনদ, দোষ-ত্রুটি ও ইতিহাসের প্রায় হাজারো কিতাবাদির মাধ্যমে অসংখ্য প্রাসঙ্গিক মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন।
কারো কারো মতে, মুহাদ্দিস বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যিনি হাদিসের বর্ণনাকারী হওয়া ছাড়াও যুক্তির নিরিখেও হাদিসের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। 
210. শরহে নুখবাতুল ফিকির।

❏ প্রশ্ন-১৫১: বারো মাসের গণনা প্রথা কখন হতে শুরু হয়? 

✍ উত্তর: শাহরুন শব্দের অর্থ হল মাস। এর বহুবচন হচ্ছে শুহুর বা আশহুর। মুসলমানদের নিকট মাসের সংখ্যা হচ্ছে বারোটি। তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে নিষিদ্ধ মাস তথা শিষ্টাচার ও জননিরাপত্তার মাস। এগুলোতে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ।

কোরআন মজিদে বর্ণিত রয়েছে,

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ .

অর্থাৎ যে দিন আল্লাহ তা‘আলা আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন তখন হতে আল্লাহ'র নিকট মাসের গণনা বা সংখ্যা কিতাবুল্লাহ তথা লওহে মাহফুজে বারো মাস লিপিবদ্ধ আছে। তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে শিষ্টাচার ও জননিরাপত্তার মাস। শিষ্টাচার ও জন নিরাপত্তার মাস দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব।  
211. সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬।

❏ প্রশ্ন-১৫২: আরববাসীগণ নিজেদের চান্দ্র মাসের কী কী নাম রেখেছিলেন?

✍ উত্তর: আরববাসীগণ নিজেদের চান্দ্র মাসের নাম রেখেছিলেনঃ তাতিক, নুফাইল, তালিক, আছাখ, আসাখ, হালাক, তারহিব (রজব), কাসাজ, যাহের, নুত, হরফ ও লাফিস। তাতিক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মুহররম এবং নুফাইল দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সফর। অন্যান্য মাসসমূহ এর ওপর অনুমান করতে হবে। এরপর আরববাসীগণ নিজেদের মাসসমূহের জন্য ওই নাম নির্ধারণ করলেন যা বর্তমানে প্রসিদ্ধ অর্থাৎ মুহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউল উখরা, জুমাদাল উলা, জুমাদাল উখরা, রজব, শা’বান, রমযান, শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব।

মুহররম: মুহররম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিষিদ্ধ। যেহেতু আইয়ামে জাহেলিয়াতে এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ও হারাম ছিল, তাই মাসটির নামকরণ করা হল মুহররম।

সফর: সফর শব্দটি ‘সিফির’ শব্দ হতে গঠিত। এর অর্থ হচ্ছে শূন্য। যেহেতু এই মাসটি আসে মুহররমের পর এবং হুযূর   এর আবির্ভাবের পূর্বে মুহররম মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল আর আরবের লোকেরা এ মাসে যুদ্ধ করার জন্য বের হতো এবং তাদের ঘর-বাড়ি খালি অবস্থায় রেখে যেতো, তাই এই মাসটির নামকরণ করা হলো সফর। কেউ কেউ বলেন, এ মাসটির নামকরণ করার সময়টি ছিল হেমন্তকাল। এই ঋতুতে গাছের পত্রপল­ব হলুদ বর্ণ ধারণ করে। তাই এ মাসটির নামকরণ করা হলো সফর। এমতাবস্থায় সফর শব্দটি গঠিত হবে সাফরুন শব্দ হতে। এর অর্থ হচ্ছে হলুদ বর্ণ। হানাজাতুত তারাব গ্রন্থ প্রণেতা লিখেন, সফর মাসে আরববাসীগণ নিজেদের ঘর বাড়িকে হলুদ বর্ণে বর্ণিল করতো। কেননা তারা এ মাস হতে যুদ্ধে যাবার ইচ্ছা পোষণ করতো।

রবিউল আউয়াল: যেহেতু এ মাসটির নামকরণ করার সময়টি ছিল বসন্তকালের প্রারম্ভকাল, তাই মাসটিকে এ নামে নামকরণ করা হলো।

রবিউল আখর: ‘খা’ বর্ণে যবর বিশিষ্ট। মনে রেখো, সাধারণ জনগণ যেরূপ ‘রবিউস সানি’ ব্যবহার করে তা সঠিক নয়। কেননা অধিকাংশ আরববাসী ‘রবিউল আখর’ ব্যবহার করে। কারো কারো মতে, ‘ছানি (দ্বিতীয়)’ শব্দটির ব্যবহার ওই স্থানেই করা হয় যেখানে ‘ছালেছ’ (তৃতীয়) শব্দটি পরবর্তীতে থাকে। যেহেতু এ মাসটির নামকরণ করার সময়টি ছিল বসন্তকালের শেষ সময়, তাই এই মাসটির নামকরণ করা হলো রবিউল আখর।

জুমাদাল উলা: সাধারণ লোকের মুখে এ মাসটির নাম জুমাদাল আউয়াল বলে শুনা যায়। তা ভুল ও সঠিক নয়, কেননা জুমাদা শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ, কারণ শব্দটির শেষে রয়েছে আলিফে মাকছুরা, তাই এর বিশেষণও আউয়াল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ উলা ব্যবহার করতে হবে। যাতে বিশেষ্য ও বিশেষণের মধ্যে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বিষয়ক বিধানের সমন্বয় সাধিত হয়। যেহেতু মাসটির নামকরণ করা হয় এমন মৌসুমের শুরুতে যখন পানি জমাটবদ্ধ হয়ে যেতো, তাই মাসটির নামকরণ করা হলো জুমাদাল উলা।

জুমাদাল উখরা: আরবগণ জুমাদাল উখরা বা জুমাদাল আখেরাহ ব্যবহার করে। আর জুমাদাস ছানি নামটি যেরূপ প্রসিদ্ধ আছে তা কিন্তু সঠিক নয়। যেহেতু এ মাসটির নামকরণ করা হয় এমন মৌসুমের বিদায়লগ্নে যখন পানি জমাটবদ্ধ হয়ে যেতো, তাই মাসটির নামকরণ করা হলো জুমাদাস ছানি।

রজব: ‘রা’ ও ‘জিম’ বর্ণে যবর বিশিষ্ট। এই শব্দটি ‘তারজিব’ শব্দ হতে গঠিত। যার অর্থ হচ্ছে সম্মান ও মহান। যেহেতু আরবের লোকেরা এ মাসটিকে ‘শাহার’ বলতো এবং সম্মান করতো, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো। হুযূর   বলেন, রজব হচ্ছে জান্নাতের একটি হ্রদ যার পানি মধুর চেয়ে সুমিষ্ট এবং বরফের চেয়ে সাদা। যে ব্যক্তি এ মাসে রোযা রাখবে কিয়ামতের দিন তাকে ওই হ্রদ হতে পানি পান করানো হবে। 

শা‘বান: যেহেতু এ মাসে অপার কল্যাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং জগতের যাবতীয় নির্ধারিত বিষয়াবলী আলাদা হয়ে পড়ে, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো।

রমযান: তিনো বর্ণে যবর বিশিষ্ট শব্দটি ‘রামাদুন’ শব্দ হতে গঠিত। এর অর্থ জ্বালানো। এটি باب ضرب এর অন্তভুর্ক্ত। যেহেতু এ মাসটি পাপসমূহ পুড়িয়ে দেয়, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো কিংবা রমযান শব্দটি নামবাচক বিশেষ্য যা রামাদাউন শব্দ হতে গঠিত। রামাদাউন বলা হয় জ্বলন্ত ভূমিকে। এ মাসে প্রচন্ড গরম পড়ে। তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো।
ওলামায়ে কেরাম বলেন, মাহে রমাদানকে কেবল রমাদান বলা জায়েয নয়। কেননা হাদিস শরীফে রয়েছে যে, মাহে রামাযানকে কেবল রামাযান বলো না। কেননা এটা আল্লাহর নাম। বরং এভাবে বলো, শাহরু রামাযান অর্থাৎ আল্লাহর মাস।

শাওয়াল: শাওয়াল শব্দটি ‘শাওলুন’ শব্দ হতে গঠিত, যার অর্থ স্থানান্তরিত হওয়া। যেহেতু এ মাসে আরবের লোকেরা ভ্রমণ ও শিকারে যেতো এবং ঘরবাড়ির বাইরে চলে যেতো, তাই এ নামে মাসটির নামকরণ করা হলো। কিংবা শব্দটি ‘শুলুন’ শব্দ হতে গঠিত যার অর্থ হচ্ছে উটের লেজ তোলা বা উঠানো। এটি باب نصر এর মাসদার। এ মাসে উটের যৌন চাহিদা বেড়ে যায়। 

জিলক্বদ: যেহেতু এ মাসটি পুরোপুরি একটি নিষিদ্ধ মাস, তাই আরবগণ এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতে বিরত থাকে। এ কারণে এই নামে মাসটির নামকরণ করা হলো।

জিলহজ্ব: যেহেতু এ মাসে হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়, তাই মাসটির নামকরণ করা হলো জিলহজ্ব। 
212. ইসলামী মা’লুমাত, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ১২৪১, মৌলভী মাহবুব আলম।

❏ প্রশ্ন-১৫৩: شاه ‘শাহ’ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং তা কোথায় ব্যবহার করা হয়?

✍ উত্তর: ‘শাহ’ শব্দটি ফার্সী ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে মূল, গোড়া, মালিক, মুনিব, বাদশাহ এবং তা ফকীরদের উপাধি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। বংশীয় মর্যাদার দিক দিয়ে সাইয়েদগণের জন্যও শব্দটির ব্যবহার সর্বজনবিদিত যেমন, শাহ ওয়ালি উল্লাহ, শাহ আব্দুল আজিজ। পাঞ্জাবে সাইয়েদগণের নামের অংশ হিসেবে শব্দটি ব্যবহার করা হয় যেমন, সাইয়েদ আকবর শাহ, সাইয়েদ ওয়ালি শাহ, সাইয়েদ আসগর শাহ। শাহ সাহেব বা শাহজী ইত্যাদি উঁচু স্তরের দরবেশগণের উপাধি।

❏ প্রশ্ন-১৫৪: শাহাদাত কাকে বলে, এর সংজ্ঞা কী এবং শাহাদাতের সংখ্যা কত?

✍ উত্তর: هو المستعان واليه المأب والتكلان . শাহাদাত শব্দের অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য। কোরআন মজিদে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, দু’জন পুরুষের সাক্ষ্যগ্রহণ করো। যদি দু’জন পুরুষ পাওয়া না যায়, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী। 
কোরআন মজিদে সত্য সাক্ষ্য গোপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই হুকুম দেওয়া হয়েছে, 

وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ 

সাক্ষ্য গোপন করোনা। আর যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করবে, তা হচ্ছে অন্তরের পাপ ও অপবিত্রতা। 
213. সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৩।

সূরা নিসার ২০তম রুকুতে আদেশ দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর ওয়াস্তে সাক্ষ্য দাও যদিও তা তোমার নিজের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়ে থাকুক। সূরা ফুরকানে মিথ্যা সাক্ষ্যদান হতে নিষেধ করা হয়েছে।
হাদিস শরীফে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সর্বোত্তম সাক্ষীর ব্যাপারে সংবাদ দেবোনা। সে হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে সাক্ষ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পূর্বে নিজের সাক্ষ্য প্রদান করে।
শাহাদাত ফরয। তা প্রদান করা সাক্ষীদের জন্য আবশ্যক। তবে কিসাস (মৃত্যুদন্ড) ও হুদুদ (কুরআনে বর্ণিত শাস্তি) এর সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে তা প্রকাশ বা গোপন করার অধিকার সাক্ষীর নিকট রয়েছে। তবে চুরির ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রদান করা ওয়াজিব। আর এতে একথা বলবে যে, সে মাল নিয়েছিল, একথা বলবেনা যে, সে মাল চুরি করেছিল। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী প্রয়োজন। ব্যভিচারের বেলায় নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যান্য হকের বেলায় দু’জন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দু’জন নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য, হোক তা সম্পত্তির অধিকার কিংবা সম্পত্তি বর্হিভূত অন্যান্য অধিকার যেমন, বিয়ে, তালাক, ওসিয়ত, ওকালা (আমমোক্তার নামা), গোলাম আযাদ, সন্তান জন্মদান ও নারীর সতীত্ব। আর নারীদের যে সব দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে পুরুষকে অবহিত করা যায়না, তাতে কেবল একজন নারীর সাক্ষ্যই যথেষ্ট।

নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়ঃ

(১) অন্ধ।
(২) অধীন দাস।
(৩) যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে যিনার (ব্যভিচারের) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে, যদিও সে তাওবা করেছে।
(৪) পিতার সাক্ষ্য পুত্রের বেলায়। দাদা-নানার সাক্ষ্য নাতীর বেলায়। পুত্র ও নাতীর সাক্ষ্য পিতা-মাতা এবং দাদা-নানা প্রমূখের বেলায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একের সাক্ষ্য অপরের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ভাইয়ের সাক্ষ্য ভাইয়ের বেলায় এবং ভাতিজার সাক্ষ্য চাচার বেলায় গ্রহণযোগ্য নয়।
(৫) এক অংশীদারের সাক্ষ্য অপর অংশীদারের বেলায় বৈধ নয়।
(৬) হিজড়া।
(৭) বিলাপকারী নারী।
(৮) গায়িকা নারী।
(৯) সর্বদা মদ্যপানকারী ব্যক্তি।
(১০) কবুতর, মোরগ ও ভেড়ার খেলবাজ।
(১১) এরূপ কবীরা গুণাহকারী ব্যক্তি যার ওপর হদ (শাস্তি) আবশ্যক। 
(১২) গোসলখানায় নগ্ন হয়ে গমনকারী ব্যক্তি।
(১৩) সুদখোর।
(১৪) যে ব্যক্তি পাশা, দাবা ইত্যাদি খেলে।
(১৫) যে ব্যক্তি কোন মাকরূহ ও অপছন্দনীয় কাজ করে যেমন, রাস্তায় হাঁটার সময় কোন কিছু খায় কিংবা জনসাধারণের চলাচলের পথে পেশাব করার জন্য বসে যায়।
(১৬) যে ব্যক্তি পূর্বসুরী বুযূর্গদের প্রকাশ্য গালমন্দ করে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। 

খতনা বিহীন ব্যক্তি, নপুংসক, জ্বীন হাজিরকারী ব্যক্তি ও অবৈধ সন্তানের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য।
যদি বিচারকের রায় প্রদানের পূর্বে সাক্ষ্যদাতা নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে তার সাক্ষ্য রহিত হয়ে যাবে। আর যদি বিচারকের রায় প্রদানের পর সাক্ষী নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে রায় বা সিদ্ধান্ত বাতিল হবেনা। যদি কারো সম্পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সাক্ষ্যদাতা নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে সে যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল ওই ব্যক্তির সম্পদের জন্য দায়ী হবে।
শাহাদাত শব্দটি শহীদ হয়ে যাবার অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
هذا ما ظهرلى والعلم عند الله العليم .

❏ প্রশ্ন-১৫৫: হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতার নাম কি ছিল? তারুখ তাঁর পিতার নাম এবং আযর তাঁর চাচা,একথা বলা সঠিক কিনা?

✍ উত্তর: হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতার নাম তারুখ এবং আযর তার উপাধি কিংবা এর বিপরীত। আর একথা বলা যে, আযর ছিল তাঁর চাচা আর তারুখ তাঁর পিতা, কারণ কোন নবীর পিতা মুশরিক ছিলনা। এটা কেবল কৃত্রিম ও বানোয়াট কথা। 
সূরা মারইয়ামের তৃতীয় রুকুতে আযরের উল্লেখ ইবরাহিম (عليه السلام) এর প্রশ্নোত্তরের ভিতরে এসেছে যার অনুবাদ হচ্ছে: যখন তিনি অর্থাৎ ইবরাহিম (عليه السلام) নিজের পিতা অর্থাৎ আযরকে বললেন, হে পিতা! আপনি কেন এই মূর্তিগুলোর পূজা-অর্চনা করছেন যেগুলো না কোন কিছু শুনে আর না দেখে আর যেগুলো না আপনার কোন উপকারে আসতে পারে। হে পিতা! আমি আল্লাহর পক্ষ হতে এরূপ জ্ঞান অর্জন করেছি যে জ্ঞান আপনার নিকট নেই। তাই আপনি আমাকে অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে দ্বীনের সহজ-সরল পথ দেখাবো। হে পিতা! শয়তানের কথায় পড়ে মূর্তিগুলোকে পূজা-অর্চনা করবেন না। কেননা শয়তান আল্লাহর বিদ্রোহী। হে পিতা! আমি এ বিষয়ে ভয় করছি যে, কখনো যেন এরূপ না হয় যে, আচমকা আল্লাহর পক্ষ হতে কোন আযাব আপনার ওপর এসে পড়ে এবং আপনার পরিণাম শয়তানের সঙ্গে জাহান্নামে হয়। হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) এর পিতা বললেন, ইবরাহিম! তুমি কি আমার মাবুদদের নিকট হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো?
তুমি যদি এরূপ কথাবার্তা হতে ফিরে না এসো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দিবো। আর যদি তুমি কল্যাণ চাও, তাহলে আমার সম্মুখ হতে দূর হও।

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُونَ .

আর একদা ইবরাহিম নিজ পিতা ও স্বজাতির লোকদেরকে বললো, তোমরা যে সব মূর্তির পূজা-অর্চনা করো এগুলোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। 
214. সূরা যুহরফ, আয়াত: ২৬

❏ প্রশ্ন-১৫৬: হযরত আনাস (رضى الله تعالي عنه) কর্তৃক বর্ণিত পুরো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চারজন নারী কারা কারা ছিলেন? আছিয়া কে ছিলেন?

✍ উত্তর:  وهو المستعانআছিয়া হচ্ছেন খোদা দাবীকারী মিসরের প্রসিদ্ধ কাফির ফিরাউনের স্ত্রীর নাম। যিনি ছিলেন খুবই পুতঃপবিত্র, আল্লাহর ইবাদতগুজার এবং হযরত মুসা (عليه السلام)’র শরীয়তের অনুসারী। তিনি হচ্ছেন ওই সব নারীদের অন্যতম যাদের প্রশংসা অসংখ্য হাদিসে এসেছে। তারা হচ্ছেন:

(১) হযরত মারইয়াম (عليه السلام)।
(২) হযরত খাদিজা (رضى الله تعالي عنه)।
(৩) হযরত ফাতেমা (رضى الله تعالي عنه)।
(৪) হযরত আছিয়া (عليه السلام)।

হযরত আনাস বিন মালেক (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ   বলেন, তোমাদের জন্য সমগ্র দুনিয়ার নারীদের মধ্যে কেবল এই চারজনের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যথেষ্ট: মারইয়াম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ এবং ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া।"
215. মিশকাত শরীফ।

কোরআন মজিদের সূরা মারইয়ামের ৪র্থ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 

وَضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ.

‘মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়ার উদাহরণ দিচ্ছেন যে, তার স্ত্রী দু‘আ করলো, হে আমার প্রতিপালক! আমার জন্য বেহেশতে আপনার নিকট একটি ঘর তৈরী করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কর্মকান্ড হতে মুক্তি দিন। আর আমাকে যালিমদের নিকট হতে নিষ্কৃতি দিন।’ 
216. সূরা আত্তাহরীম, আয়াত: ১১

❏ প্রশ্ন-১৫৭: আসফ বিন বরখিয়া কে ছিলেন, তার অবস্থা ও কাহিনী বর্ণনা কর?

✍ উত্তর: আসফ বিন বরখিয়া হচ্ছে হযরত সুলায়মান ইবনে দাউদ (عليه السلام) এর প্রধানমন্ত্রীর নাম, যিনি ইসমে আযমের সুবাদে কাজ করতেন। তিনি ইসমে আযমের বরকতে ও সুবাদে মুহূর্তের মধ্যে অনেক দূরবর্তী এলাকা হতে রাণী বিলকিসের সিংহাসন হযরত সুলায়মান (عليه السلام) এর দরবারে হাজির করেছিলেন। বিলকিস হচ্ছে সাবা অঞ্চলের রাণীর নাম, যিনি হযরত সুলায়মান (عليه السلام) এর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তাঁর (عليه السلام) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তার কাহিনীটি সূরা নমলে বর্ণিত রয়েছে। কোরআন মজিদের নিম্নোক্ত আয়াতে আসফ বিন বরখিয়ার এই কাহিনীটি উল্লেখ রয়েছে।  

قَالَ الَّذِي عِنْدَهُ عِلْمٌ مِنَ الْكِتَابِ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ .

‘জনৈক ব্যক্তি যার নিকট কিতাবের জ্ঞান তথা ইসমে আযম জানা ছিলো সে বললো, হে বাদশা! আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি সিংহাসনটি আপনার দরবারে হাজির করছি।’ 
217. সূরা নমল, আয়াত: ৪০ 

মাসআলা: কেরামতে আউলিয়া অস্বীকারকারীদের উচিত এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং হঠকারিতা ও জিদ হতে ফিরে আসা।  وَاللهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়ত দান করেন।’ 

❏ প্রশ্ন-১৫৮: হযরত মুসা (عليه السلام) এর মাতার নাম কি ছিল?

✍ উত্তর: হযরত মুসা (عليه السلام)’র মাতার নাম ছিল ইউজানয, পিতার নাম ইমরান এবং বোনের নাম মারইয়াম। তবে মনে রাখতে হবে তিনি ওই মারইয়াম নন যিনি ছিলেন হযরত ঈসা (عليه السلام) এর মাতা। তিনি জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুসা (عليه السلام)’র বোনের হাজারো বছর পর। 
218. তফসীরে সাভী, ৩য় খন্ড।

❏ প্রশ্ন-১৫৯: হযরত শুয়াইব (عليه السلام)কে কোন্ জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল?

✍ উত্তর: জেনে রাখা উচিত যে, হযরত শুয়াইব (عليه السلام) মাদইয়ান ও আইকা নামক দু’টি জাতির নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। এতদুভয় জাতি তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলো এবং তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করতঃ তাঁর সাথে বেয়াদবী ও অসদাচরণ করেছিলো। ফলে আল্লাহর আযাবে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। 
আসহাবে মাদইয়ানের ওপর এই আযাবটি আসলো যে,  فاخذتهم الصيحة. অর্থাৎ হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) এর চিৎকারের ভয়ংকর আওয়াজে জমিন প্রকম্পিত হয়ে ওঠলো এবং মানুষের অন্তর ভয়ে পথহারা হয়ে গেলো এবং সকলে উপুড় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলো। 
আর আসহাবে আইকাকে  عذاب يوم الظلمة .অন্ধকার দিনের আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেওয়া হলো, যার বর্ণনা তাফসীরে সাভীর ৩য় খন্ডর ১৫০নং পৃষ্ঠায় রয়েছে।
তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করতঃ রাসূলকে বললো, যদি তুমি সত্য নবী হও, তাহলে আসমান হতে কোন অগ্নি টুকরো এসে যদি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতো!
এরপর মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওই ক্রোধপূর্ণ আযাব ওই জাতির ওপর এসে পড়লো যার বর্ণনা হাদিসে এসেছে যে, ওই সব লোকদের ওপর জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দেওয়া হলো। যার কারণে পুরো লোকালয়ে তীব্র গরম ও লু হাওয়ার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো এবং বস্তিবাসীদের দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। লোকেরা নিজেদের ঘরের অভ্যন্তরে বসবাস করতে লাগলো এবং নিজেদের ওপর পানি ছিটাতে লাগলো। তবে পানি ও ছায়ার মধ্যে তারা প্রশান্তি পেলো না। গরমের উষ্ণতায় তারা পুড়ে যাচ্ছিলো। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা একটি মেঘ খন্ড পাঠালেন যেটি তাঁবুর ন্যায় পুরো লোকালয়ে ছেয়ে গেলো। এই মেঘ খন্ডর ভিতর ছিলো হিমশীতল প্রশান্তিদায়ক বাতাস। এটা দেখে সকলে ঘর হতে বের হয়ে মেঘ খন্ডর তাঁবুর নীচে জমায়েত হলো। যখন সকল লোক মেঘের নীচে এসে পড়লো, তখন ভূমিকম্প হলো এবং আসমান হতে আগুন বর্ষিত হলো, যাতে সকলে পঙ্গপালের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে জ্বলে-পুড়ে গেলো।
তারা নিজেদের অবাধ্যতা প্রদর্শন করে বলেছিলো যে, হে শুয়াইব! তুমি সত্য নবী হলে দেখাও আসমানের কোন অগ্নি টুকরো এসে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিক। সুতরাং ওই আযাবটি উক্তরূপে এই অবাধ্য জাতির ওপর এসে পড়লো এবং সকলে জ্বলে-পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ বনে গেলো। 
219. তাফসীরে সাভী, পৃষ্ঠা নং-১৫০, খন্ড নং-৩, গারায়িবুল কোরআন, পৃষ্ঠা নং-১২৪।

❏ প্রশ্ন-১৬০: আসহাবে আইকা বলা হয় কাদেরকে, আইকা শব্দের অর্থ কী? 

✍ উত্তর: আইকা শব্দের অর্থ বন। এসব লোকদের আবাস ছিলো সবুজ-শ্যামল বন ও ফলবান বৃক্ষের মধ্যখানে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে হেদায়ত দানের জন্য শুয়াইব (عليه السلام)কে প্রেরণ করেন। তিনি আসহাবে আইকার সম্মুখে যে ওয়াজ করেন তা কোরআন মজিদে এভাবে বর্ণনা করা হয়: الا تتقون ، انى لكم رسول آمين ‘মনে রেখো, আমি তোমাদের প্রতি বিশ্বস্ত প্রেরিত রাসূল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, খোদাভীরু হও।’ 
220. সূরা শুয়ারা, রুকু নং-১।

মোদ্দাকথা হলো আসহাবে আইকা হযরত শুয়াইব (عليه السلام)এর সংশোধনমূলক নসিহত শুনে তাঁর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলো এবং অবাধ্যতা ও অহংবোধ প্রদর্শন করতঃ নিজেদের রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। তাদের অবাধ্যাচরণের ধরণ এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো যে, এক পর্যায়ে তারা রাসূলকে বললো যে, যদি তুমি সত্য নবী হও, তাহলে আসমান হতে কোন আযাবী টুকরো যদি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতো! এরপর উল্লেখিত শক্তিশালী আযাবটি তাদের ওপর এসে পড়ে।
উক্ত ঘটনা বিস্তারিত জানার জন্য আমার লিখিত ‘মুনিয়াতুল মুসলেমীন’ ২য় খন্ড দেখার অনুরোধ রইল।

❏ প্রশ্ন-১৬১: وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ ...... فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ   (সূরা মায়েদা, পারা নং-৬) আয়াতটির তাফসীর কী?

✍ উত্তর: হে হাবিব! ওই সব লোকদেরকে হযরত আদমের দু’পুত্র হাবিল ও কাবিল এর বাস্তব ঘটনা ও কাহিনী পড়ে শোনান। যখন তারা আল্লাহর সমীপে উৎসর্গ নিবেদন করে তখন তাদের মধ্যে একজনের অর্থাৎ হাবিলের উৎসর্গ কবুল হয় এবং অন্যজনের অর্থাৎ কাবিলের উৎসর্গ কবুল হয়নি, তখন কাবিল হিংসার ক্রোধে বলতে লাগলো যে, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করবো। উত্তরে সে বললো, আল্লাহ কেবল পরহেযগারদের উৎসর্গ কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার দিকে হাত প্রসারিত করো, তবে আমি কিন্তু তোমার দিকে হাত প্রসারিত করবো না, কেননা আমি আল্লাহকে ভয় করি। আমি তো চাই তুমি আমার ও তোমার নিজের উভয়ের পাপের বোঝা বহন করো এবং জাহান্নামীদের সাথে গিয়ে মিলো। আর এটাই হচ্ছে যালিমদের শাস্তি।
একথা বলা সত্ত্বেও তার মন নিজ ভাইকে হত্যার প্রতি প্ররোচিত করলো। অবশেষে তাকে হত্যা করে নিজের আস্তানায় চলে আসলো। এরপর আল্লাহ তা‘আলা একটি কাক পাঠালেন। কাকটি মাটি খুঁড়তে লাগলো যাতে নিজের ভাইয়ের লাশ কিভাবে দাফন করতে হয় তা ওই ঘাতককে দেখিয়ে দেওয়া হয়। কাকটি কর্তৃক মাটি খোঁড়ার বিষয়টি দেখে সে আফসোসের স্বরে বলে ওঠলো, হায় বদ-নসীব! আমি এই কাকটির চেয়ে অধম, যদি আমি এই কাকটির মতোও বুদ্ধিমান হতাম! তাহলে নিজের ভাইয়ের লাশটি দাফন করতে পারতাম।
হাবিল শব্দটি হিব্রু ভাষার শব্দ এবং হযরত আদম (عليه السلام)’র পুত্রের নাম। হাবিল ও কাবিল দু’জন ছিলো ভাই। কাবিল করতো ক্ষেত-খামার এবং হাবিল ছাগল পালন করতো। তারা উভয়ে আল্লাহর সমীপে উৎসর্গ নিবেদন করে। কাবিল তার উৎসর্গের মধ্যে দিলো নিম্নমানের নিকৃষ্ট মাল এবং হাবিল দিলো তার বকরী পালের মধ্য হতে সর্বোত্তমটি। কাবিলের উৎসর্গ নামঞ্জুর হলো। ফলে কাবিলের মধ্যে প্রচন্ড ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হলো। এই হিংসার আগুন তার মনে জ্বলতে রইলো। এক পর্যায়ে হযরত আদম (عليه السلام) হজ্বে গেলে সুযোগ পেয়ে সে নিজের ভাইকে হত্যা করলো এবং নিহত ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। কেননা পৃথিবীর বুকে এটা ছিলো সর্বপ্রথম মৃত্যুর ঘটনা। অবশেষে সে কাকের নিকট হতে দাফনের বিষয়টি জেনে নিলো। সে নিজের কাজ, অবস্থা ও পরিস্থিতির ব্যাপারে খুবই লজ্জিত হলো। কোরআন মজিদে এই কাহিনীটি এসব শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে।

❏ প্রশ্ন-১৬২: شهنشاه ‘শাহিনশাহ’ শব্দটির অর্থ কী, তার ব্যবহার জায়েয নাকি না-জায়েয?

✍ উত্তর: شهنشاه শাহিনশাহ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রাজাধিরাজ। এটি শাহান শাহ শব্দদ্বয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ। এ নামটি ধরে কাউকে ডাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সুতরাং রাসূলুল্লাহ   বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট যাবতীয় নাম সমূহের মধ্যে সর্বাধিক অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট নাম হচ্ছে ‘মালাকুল আমলাক’ অর্থাৎ শাহিনশাহ নামটি। তার কারণ হচ্ছে এই নামটির সঠিক প্রয়োগস্থল কেবল আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তিনিই রাজাধিরাজ, শাসকদের শাসক এবং আসমান-জমিনের অধিপতি।
وهو احكم الحاكمين له الملك فى السمٰوٰت والارض . 

❏ প্রশ্ন-১৬৩: শীশ শব্দটি কোন ভাষার শব্দ এবং অর্থ কী? 

✍ উত্তর: এই নামটি সুরইয়ানী ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর দান। কারো কারো মতে, এটা অনারবী শব্দ। বনি ইসরাইলের কিতাবসমূহে এর অর্থ পাওয়া যায় বদলা বা বিনিময় অর্থাৎ হাবিলের বিনিময় বা বিকল্প। তিনি হাবিলের হত্যাকান্ডের ৫ ( পাঁচ) বছর পর জন্মগ্রহণ করেন যখন হযরত আদম (عليه السلام) এর বয়স হয়েছিল দু’শ ত্রিশ বছর।
ইবনে কুতাইবা মা’রিফ গ্রন্থে লিখেছেন যে, হযরত শীশ (عليه السلام) ছিলেন হযরত আদম (عليه السلام)’র সন্তানদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু ও সুন্দর। তিনি ছিলেন হযরত আদম (عليه السلام)-এর অধিক সদৃশ। অন্যান্য সন্তানদের বিপরীতে তিনি এককভাবে বা একা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 
তারীখে তাবারীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, বনি আদমের বংশধর তুফানের পর তাঁর উপরেই সমাপ্ত হয়। তাঁর ওপর পঞ্চাশটি সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনি প্রথমে প্রথমে ইবরানী ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর ওপর যে সব সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলোতে ছিল বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সংগীত, গণিত, জ্যোর্তিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিদ্যা ও শাস্ত্র। তাই ইউনানী হেকিমী শাস্ত্রের তাকে প্রথম শিক্ষক বা জনক বলে।
‘যাইনুল কাসাস’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত শীশ (عليه السلام)কে প্রচুর সম্পদ দিয়েছিলেন। তিনি তা দিয়ে ব্যবসা করতেন এবং অধিকাংশ সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় করতেন।
কতিপয় মুহাক্কিক ‘ফুসূসুল হিকম’ গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন, যখন হযরত আদম (عليه السلام) মৃত্যু শয্যায় আসীন হলেন তখন তার মনে জান্নাতী ফলের আকাঙ্খা সৃষ্টি হলো। হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) একটি পাত্রে জান্নাতী ফল নিয়ে আসলেন। ওই পাত্রটি ছিল একটি হুরের (জান্নাতী রমণী) মাথার ওপর। হযরত আদম (عليه السلام) ফল খাওয়ার পর দু‘আ করলেন, হে আল্লাহ্! এই হুরটির সাথে শীশের বিয়ে হোক। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দু‘আ কবুল করেন এবং হুরটির সাথে হযরত শীশ (عليه السلام) এর বিয়ে হলো। তিনি বয়স পেয়েছিলেন ৯১৩ বছর। অনুরূপ উল্লেখ রয়েছে ‘আল-আখবারুল আউয়াল’ গ্রন্থের মধ্যে।
হযরত মাওলানা রফিউদ্দিন দেহলভীর মতে হযরত আদমের    ইন্তিকাল হতে তিনি ১২৪৩ বছর বয়সে ওফাত লাভ করেন।
কেউ কেউ বলেন, তাঁকে নিজের পিতার কবরে দাফন করা হয়। আবার কারো মতে, তাঁকে বালাবাক্কা অঞ্চলের সুরাইন আমাল গ্রামে দাফন করা হয়। সেখানে মানুষ তাঁর কবর যিয়ারত করার জন্য যায়। 
221. ইসলামী মা’লুমাত, পৃষ্ঠা নং-৪৪৩।

❏ প্রশ্ন-১৬৪: ‘শায়খ’ শব্দের ব্যাখ্যা কী এবং ‘শায়খ’ কাকে বলা হয়?

✍ উত্তর: شيخ ‘শায়খ’ বলা হয় বৃদ্ধ লোককে। যার বহুবচন হচ্ছেشيوخ  ‘শুয়ুখ’ বা اشياخ‘আশয়াখ’। কেউ কেউ বলেন, ‘শায়খ’ বলা হয় পঞ্চাশ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোককে। আবার কারো কারো মতে, একষট্টি বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোককে ‘শায়খ’ বলা হয়। 
‘শায়খে ফানি’ বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যে দৈনন্দিন দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে। ফিকহে হানাফীর পরিভাষায় ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) ও ইমাম আবু ইউসুফকে (رحمه الله تعالي ) ‘শায়খাইন’ বলা হয়।
‘আহলে হাদীস’ শায়খ বলে ওই ব্যক্তিকে যার নিকট হতে হাদীস রেওয়ায়ত করা হয়। তাদের পরিভাষায় ইমাম বুখারী (رحمه الله تعالي ) ও ইমাম মুসলিমকে (رحمه الله تعالي ) শায়খাইন বলা হয়। ‘আহলে তাসাউফ’ এর মতে শায়খ হচ্ছেন ওই ব্যক্তি যিনি  অন্তর—দৃষ্টির শক্তি বলে দুনিয়া ইত্যাদির জং-ময়লা মুরিদের অন্তর হতে দূর ও পরিষ্কার করে দেন।
দর্শন শাস্ত্রের ইমাম ও শিক্ষক, জাতির নেতা এবং নও মুসলিমকেও শায়খ বলা হয়। 
পরিভাষায় কামিল মুকাম্মিল দরবেশকেও শায়খ বলা হয়। কেউ কেউ শায়খ শব্দের সংজ্ঞা দিয়েছেন এরূপ هو من يحى العظام الرميمة অর্থাৎ ‘ওই ব্যক্তিকে শায়খ বলা যায় যিনি মৃত হাড়কে জীবিত করতে পারেন।’

❏ প্রশ্ন-১৬৫: দস্তারবন্দি মাহফিল আয়োজন করার বিধান কী? 

✍ উত্তর: ভারত ও মধ্য এশিয়ার আলেমদের মধ্যে এই প্রথাটির প্রচলন রয়েছে এবং এটা বিদআত। কোরআন-হাদীস এবং সাহাবাদের জীবনাচারে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে এটা একটা সার্বজনীন প্রথা যে, যখন কোন ছাত্র ইলমে দ্বীনের ডিগ্রী অর্জন করে তখন তাকে সম্মানিত আলেমদের একটি বিশেষ মজলিসে মর্যাদার পাগড়ি পরিধান করানো হয় যার বদৌলতে সে আনুষ্ঠানিকভাবে আলেমদের জামাতে অন্তভুর্ক্ত হয়। তখন তাকে জ্ঞানের বিকাশ সাধন, ফতোয়া লিখা এবং শরয়ী মাসায়েল অনুযায়ী বিধি-বিধান শুনানোর যোগ্য বলে মনে করা হয়। এই প্রথাটি এক ধরনের বিদআতে হাসনাহ। এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। ইসলামের বিকাশ কালে এর কোন নজির বা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়না। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই কর্ম পদ্ধতির মধ্যে অসংখ্য শরয়ী ও ইলমী স্বার্থ নিহিত রয়েছে যেগুলো লক্ষ্য করে পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম এই প্রথার প্রচলন ঘটিয়েছেন। 

ما راهُ المؤمنون حسنا فهو عند اللهِ حسنٌ . هو ماظهرلى والعلم عندالله .

‘মু’মিনগণ যা উত্তম মনে করেন তা আল্লাহর নিকটও উত্তম।’ আমার নিকট এরূপ প্রতীয়মান হয়েছে। সঠিক জ্ঞান আল্লাহর নিকট রয়েছে। 
222. ইসলামী উলুম কা মাখযান, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২২।

❏ প্রশ্ন-১৬৬: اُم الولد ‘উম্মুল ওয়ালাদ’ কাকে বলা হয় এবং এর সংজ্ঞা ও বিধান কী?

✍ উত্তর: ‘উম্মুল ওয়ালাদ’ বলা হয় ওই দাসীকে যার গর্ভে মনিবের সন্তান ভূমিষ্ট হয়। ওই দাসীকে বিক্রয় ও দান করা বৈধ নয়। তবে তার সাথে সহবাস করা, তার সেবা গ্রহণ করা, তাকে ভাড়া দেওয়া ও বিয়ে দেওয়া বৈধ।

❏ প্রশ্ন-১৬৭:  امّ هانىউম্মে হানীর মূল বা প্রকৃত নাম কি? হুযূর   তাঁর ঘর হতে কিভাবে মি‘রাজে গেলেন?

✍ উত্তর: উম্মে হানী হচ্ছেন হযরত আলী (رضى الله تعالي عنه)’র বোন এবং আবু তালিবের কন্যা। তার প্রকৃত নামের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কারো কারো মতে, তার নাম হচ্ছে হিন্দা কিংবা ফাতেমা বা ফাখতাহ। তার স্বামীর নাম হচ্ছে হুবায়রা বিন ওমর আল-মাখযুঈ। সে মুশরিক ছিল। মক্কা বিজয়ের দিন সে পালিয়ে গিয়েছিল, আর ওই সময়েই হযরত উম্মে হানী ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন। তার নিকট হতে ৪৬টি হাদীস বর্ণিত আছে। মি‘রাজের রাতে হুযূর (ﷺ)  তার ঘরে তাশরীফ নিয়েছিলেন।

❏ প্রশ্ন-১৬৮: হযরত উম্মে সালমা কে ছিলেন? তার ব্যাপারে কিছু আলোচনা কর।

✍ উত্তর: উম্মে সালমা ছিলেন হুযূর (ﷺ) এর অন্যতম স্ত্রী। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল হিন্দা। পিতার নাম আবু উমাইয়া এবং মাতার নাম আতেকা বিনতে আমের।
তিনি প্রথমে আবু সালমার বৈবাহিক বন্ধনে ছিলেন। তবে আবু সালমা যখন উহুদ যুদ্ধে শহীদ হলেন তখন হযরত আবু বকর (رضى الله تعالي عنه) তার নিকট বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। এতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করলেন। এরপর হযরত ওমর (رضى الله تعالي عنه) রাসূলুল্লাহ  ’র পক্ষে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তখন উম্মে সালমা বললেন, রাসূলুল্লাহ কে স্বাগতম। তবে আমি বৃদ্ধা। তদুপরি আমার একজন এতিম পুত্রও রয়েছে। আমার স্বভাবে আত্মসম্ভ্রমবোধও প্রবল এবং আমার পৃষ্ঠপোষক বা মুরব্বীও বিদ্যমান নেই।
এই জবাব পেয়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নিকট তাশরীফ নিলেন এবং বললেন, বয়সে আমি তোমার চেয়ে বড়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হচ্ছেন এতিমদের অভিভাবক। আত্মসম্ভ্রমবোধ আল্লাহ তা‘আলা দূর করে দিবেন। মুরব্বী বা বড়দের উপস্থিতি প্রয়োজন। কেননা আমি এমন কোন ব্যক্তি নই যে আমার ব্যাপারে অসম্মতি জানাবে। তখন উম্মে সালমা স্বীয় নাবালেগ পুত্র ওমরকে বললো, আমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র সাথে বিয়ে করিয়ে দাও। সে বিয়ে করিয়ে দিলো। হুযূর (ﷺ) তাকে যায়নাব (رضى الله تعالي عنه)-এর ঘরে রাখলেন। কেননা তখন তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তার ঘরটি খালি ছিল। এই ঘটনাটি ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসের ২ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। হাদীসের কিতাবাদিতে তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা হচ্ছে ৩৭৪টি। মুত্তাফাক আলাইহি ১৩টি, এককভাবে সহীহ বুখারীতে ১৩টি, এককভাবে সহীহ মুসলিমে ১৩টি এবং অবশিষ্ট হাদীসসমূহ অন্যান্য কিতাবে রয়েছে। তিনি ৫৬ হিজরী মতান্তরে ৬২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। হযরত আবু হুরায়রা (رضى الله تعالي عنه) তার জানাযার নামায পড়ান এবং জান্নাতুল বকীতে তাকে দাফন করা হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)’র অবশিষ্ট সকল স্ত্রীগণের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 
223. তিরমিযী শরীফ।

❏ প্রশ্ন-১৬৯: ‘জাম্উল জামা’ কাকে বলা হয়?

✍ উত্তর: جمع الجمع এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বহুবচনের বহুবচন। সুফিয়ায়ে কেরামদের মতে, আল্লাহর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিলীন হওয়াকে جمع الجمع ‘জামউল জামা’ বলা হয়।

 
Top