রাসুল (ﷺ) এর বিলাদত কত তারিখ?

রাসুল (ﷺ) কত তারিখ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এ বিষয়টি ইতিহাস সংক্রান্ত, তাই ঐতিহাসিকগণের মতামতের দিক বিচারে প্রমাণ করতে হবে ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফ নবী করিম (ﷺ)-এর বিলাদত (জন্ম) শরীফ-এর দিন। এটাই সবচেয়ে সহিহ ও মশহূর মত।

❏ হাদিস ১ :

হাফিয আবূ বকর ইবনে আবী শায়বাহ (২৩৫হি.) সহিহ সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন-
عن عفان عن سعيد بن مينا عن جابر وابن عباس رضى الله تعالى عنهما قالا ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم عام الفيل يوم الاثنين الثانى عشر من شهر ربيع الاول
অর্থ: “হযরত আফফান (رحمة الله) হতে বর্ণিত তিনি হযরত সাঈদ ইবনে মীনা (رحمة الله) থেকে তিনি হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, 

"রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিলাদত শরীফ ‘হস্তি বাহিনী বর্ষের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার শরীফ হয়েছিল। এ দিনেই তিনি নুবূয়্যাতেরর দায়িত্ব পেয়েছেন, এ দিনেই তিনি হিজরত করেছেন এবং মুবারাক ওফাতও এদিনেই লাভ করেছেন।”
আল্লামা ইবনে কাসীর (رحمة الله) বলেন, ইহাই প্রসিদ্ধ -মাশহুর মত।
তথ্যসূত্রঃ
● হাফেজ ইবনে কাসীর (رحمة الله), "আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া"; খন্ড ২, পৃ., ২৬০ বৈরুতে মুদ্রিত।
● মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা দ্রষ্টব্য।
● বুলূগুল আমানী ফী শরহিল ফাততিহর রব্বানী’; খণ্ড ২, পৃ.,১৮৯ বৈরুতে মুদ্রিত।

❏ হাদিস ২ :

ইমাম যুহরী বলেন, সাঈদ বিন মুসাইয়াব (রা) বলেন, রাসুল (ﷺ) ১২ ই রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। 
[ইমাম যাহাবী (رحمة الله), তারীখুল ইসলাম, অধ্যায়ঃ মাওলিদুহুল মুবারাকু (ﷺ)]

❏ হাদিস ৩ :

মা’রুফ বিন খাররাবুয (রা) বলেন, রাসুল (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
[ইমাম যাহাবী (رحمة الله), তারীখুল ইসলাম, অধ্যায়ঃ মাওলিদুহুল মুবারাকু (ﷺ)]

ঐতিহাসিকগনের অভিমত সমূহ : 

❏ ১.মুহাম্মাদ বিন ইসহাক (رحمة الله) এর মতঃ 

বিশ্বনন্দিত মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনু হিশাম (رحمة الله) বলেন,
ইমাম ইবনু ইসহাক (رحمة الله) বলেন, 
রাসুল (ﷺ) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ আমুল ফীলে (ঐ বছর, যে বছরে আবরাহা তার হস্তি বাহিনী নিয়ে মক্কা মুকাররামাহ আক্রমণ করেছিল) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
● আস-সীরাতুন নাবাওয়িয়্যাহ, পৃ., ২০৮।

পরিচিতিঃ তাঁর পুরো নাম হচ্ছে আবু বাকার মুহাম্মাদ বিন ইসহাক (رحمة الله)। তিনি ৮৫ হিজরীতে মদীনা মুনাওওয়ারায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় মদীনা শরীফে কাটিয়েছেন। তিনিই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম ঐতিহাসিক যিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মহান জীবনের উপর গ্রন্থ লিখেছিলেন। তাঁর সীরাত গ্রন্থটির নাম হচ্ছে “সীরাতু রাসুলিল্লাহ (ﷺ)”।

মুহাম্মাদ বিন ইসহাক সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত উলামাদের মন্তব্যঃ

১. ইমাম সুফিয়ান ছাওরী বলেন,
আমি ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসহাক (رحمة الله) এর মজলিসে ৭০ বছরের চেয়েও বেশীদিন বসেছিলাম। আমি কাউকে কোনদিন তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করতে দেখিনি।
● তারীখে বাগদাদ-১/২১৮।

২. ইমাম শু’বাহ বলেন,
ইমাম ইবনে ইসহাক (رحمة الله) কে হাদিস শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তির কারণে ইমামুল মুহাদ্দিসীন তথা মুহাদ্দিসগণের ইমাম বলা উচিৎ।
● তারীখে বাগদাদ-১/২১৮।

৩. ইয়াহিয়া বিন মুয়ীন বলেন,
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য।
● তারিখে বাগদাদ-১/২১৮।

❏ ২. ইমাম ইবনু কাছীর (رحمة الله) রাসুল (ﷺ)-এর জন্মতারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করেছেন, যেমন,
কেউ কেউ বলেছেন, ৮ই রবিউল আউয়াল
কেউ কেউ বলেছেন, ১০ ই রবিউল আউয়াল
কেউ কেউ বলেছেন, রামাদান মাসে
কেউ কেউ বলেছেন, সফর মাসে
তারপর ইমাম ইবনু কাছীর (رحمة الله) বলেন,
কিছু উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ১২ই রবিউল আউয়াল। ইমাম ইবনু ইসহাক (رحمة الله) এই মতকে গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া ১২ই রবিউল আউয়ালের ব্যাপারে হাদীস ও পাওয়া যায়। হযরত জাবির ও ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসুল (ﷺ) আমুল ফীলে ১২ ই রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার দিন জন্ম গ্রহণ করেছেন। 
এইদিন তিনি নবুওওয়াত লাভ করেন। এইদিন তিনি মিরাজে যান, এবং এইদিন তিইনি ইন্তেকাল করেন।
এরপর ইমাম ইবনু কাছীর (رحمة الله) বলেন,
এটাই (১২ই রবিউল আউয়াল) বেশীরভাগ উলামাগণ বলেছেন এবং এটাই সুপ্রসিদ্ধ মত।
[আস সীরাতুন নাবাওয়িয়্যাহ, ইমাম ইবনু কাছীর, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৯৯।]

❏ ৩.ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) বলেন, রাসুল (ﷺ) আমুল ফীলে ১২ই রবিউল আউয়ালে জন্মগ্রহণ করেন।
[আস সীরাতুন নাবাওয়িয়্যাতু ওয়া আখবারুল খুলাফা- পৃষ্ঠা ৭।]

❏ ৪.ইমাম, হাফিয ইবনু সায়্যিদিন নাস (رحمة الله) বলেন, রাসুল (ﷺ) আমু ফীলের ঘটনার ৫০ দিন পর ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেন।
[ইবনু সায়্যিদিন নাস, উয়ূনুল আছারি ফী ফুনূনিল মাগাযী ওয়াশ শামাইলি ওয়াস সিয়ারি। খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৮।]

❏ ৫.ইমাম সুহাইলী (رحمة الله) ইমাম ইবনু ইসহাক (رحمة الله) এর মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, রাসুল (ﷺ) আমুল ফীলে ১২ই রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেছেন।
[ইমাম সুহাইলী, আর রাউদুল উনফঃ খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩০০]

❏ ৬.ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আস সালিহী (رحمة الله) ইমাম ইবনু ইসহাক (رحمة الله) এর মতকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, রাসুল (ﷺ) আমুল ফীলে ১২ই রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন। শুধু তাই বলেই তিনি শেষ করেননি, তিনি এটাও বলেছেন, ‘আমাদেরকে এটা অনুসরণ করতে হবে’।
[সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদি ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৩৪-৩৩৬]

❏ ৭.ইমাম আবু যাকারিয়া ইমাদুদ্দীন আল আমিরী (رحمة الله) বলেন, সকল উলামা একমত হয়েছেন, রাসুল (ﷺ) সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেছেন। বেশীর ভাগ উলামা একমত হয়েছেন, রাসুল (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন, আর এটাই বিশুদ্ধ মত। [বাহজাতুল মাহাফিলি ওয়া বাগিয়্যাতুল আমাছিলি ফী তালখীসিল মু’জিযাতি ওয়াস সিয়ারি ওয়াশ শামা ইলি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৫১।]

❏ ৮.ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দীন আল হালাবী (رحمة الله) বলেন, রাসুল (ﷺ)-এর জন্মদিন ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল। তিনি আরো বলেন, আমাদেরকে এটাই অনুসরণ করতে হবে। [আস সীরাতুল হালাবিয়্যাহ ফী সীরাতিল আমীনিল মা’মূন, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৯৩]

❏ ৯.ইমাম জারীর ইবনে তাবারী (رحمة الله) ইমাম ইবনু ইসহাকের (رحمة الله) মতটি উল্লেখ পূর্বক সহমত পোষণ করে বলেন, রাসুল (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেন।
[ইমাম তাবারীঃ তারীখু তাবারী, অধ্যায়ঃ যিকরু মাওলিদি রাসূলিল্লাহ; খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৬২।]

❏ ১০.ইমাম ইবনুল আছীর (رحمة الله) ইমাম ইবনু ইসহাক (رحمة الله) এর মতটি প্রাধান্য দিয়ে বলেন, ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিন রাসুল (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেছেন।
[আল কামিলু ফিত তারীখ, অধ্যায়ঃ যিকরু মাওলিদি রাসূলিল্লাহ; খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৫৫।]

❏ ১১.বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু খালদুন (رحمة الله) রাসুল (ﷺ)-এর জন্মতারিখ সম্পর্কে বলেন, এটা ছিল আমুল ফীলের ১২ ই রবিউল আউয়াল।
[তারীখু ইবন খালদুনঃ খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭।]

❏ ১২.ইবনে জাওযী (رحمة الله) বলেন, ইবনে আসাকীর (رحمة الله) থেকে উম্মাহর প্রসিদ্ধ গ্রহনযোগ্য মতস্বরুপ আমাদর কাছে যে মতটি পোঁছেছে তা হলো রাসুল (ﷺ)-এর জন্মতারিখ ছিল আমুল ফীলের ১২ ই রবিউল আউয়াল। [আল ওয়াফা, ইবনে জাওযী, পৃ., ৮৭]

❏ ১৩.আ'লা হযরত  (رحمة الله) বলেন, রাসুল (ﷺ) জন্মতারিখ ছিল আমুল ফীলের ১২ ই রবিউল আউয়াল।
[আ'লা হযরত ফতোয়ায়ে রেজভীয়া, খণ্ড ২৬, পৃষ্ঠা ৪১১।]

❏ ১৪.সালাফীদের নেতা নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী, ইবনে জাওযীর অনূরুপ উদ্ধৃতি পেশ করে বলেন, 
রাসুল (ﷺ)-এর জন্মতারিখ ছিল আমুল ফীলের ১২ ই রবিউল আউয়াল।
[আশ শুমামাতুল আনবারিয়া ফী মওলিদী খায়রিল বারিয়া, পৃ., ৭।]

❏ ১৫.ইমাম ইবনে হাজর আল আসকালানী (رحمة الله) তিনিও অনূরুপ মত ব্যক্ত করেছেন। [ফাতহুল বারী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ১৩০]

❏ ১৬.ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) বলেন,
"প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী নিশ্চয় নবী কারিম (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার সুবহে সাদিক-এর সময় দুনিয়াতে জন্ম বা শুভাগমন করেছেন এবং এ মত হল প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইমামুল মাগাযী ইবনে ইসহাক (رحمة الله) ও অন্যান্য সকল ইমামগণের।"
[ইমাম কাস্তালামীঃ "মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া"]

❏ ১৭.ইমাম জুরকানী (رحمة الله) বলেন,
"এবং ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখেই পবিত্র মক্কা নগরীর অধিবাসীদের মাঝে নবী কারিম (ﷺ)-এর পবিত্র জন্মস্থান যিয়ারত করার আ'মাল বর্তমান সময় পর্যন্ত বহাল রয়েছে"। [শারহে আল্লামাতুল জুরকানী আলাল মাওয়াহেব; খণ্ড ১, পৃ., ২৪৮।]

❏ ১৮.ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলাভী (رحمة الله), বলেন, "আল্লামা ইমাম ত্বীবী (رحمة الله) বলেন- সমস্ত মুসলিম উম্মাহ্ এ বিষয়ের উপর একমত যে, নাবী কারিম (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে এ দুনিয়ায় শুভাগমন করেছেন"। [ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলাভী (رحمة الله), "মা সাবাতা বিস সূন্নাহ্" উর্দু গ্রন্থ, পৃ., ৮১।]

 
Top