আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পিতা নয়
প্রথম বিষয়ঃ
প্রথম বিষয়: আযর প্রসঙ্গ 
==========
উপরে বর্ণিত সমস্ত  দলিল  আদিল্লাহ দ্বারা ইহাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম  থেকে শুরু করে নমরুদের যামানা পর্যন্ত রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বপুরুষগণ প্রত্যেকে  অকাট্যভাবে মু’মিন ছিলেন। নমরূদের যামানায় ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এবং আযর। 

এখন যদি আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা হয়  তাহলে নবী মুহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নসবনামার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে। কিন্তু যদি আযর চাচা হয় তবে কোন  বিচ্ছেদ ঘটবে না। ইহাই মূলকথা। অর্থাৎ আযর ইব্রাহিম আলাইহিস  সালাম এর পিতা নন। 

ইবনে আবি হাতিম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে দুর্বল সনদে একটি বর্ণনা নকল করেছেন- 

فى قوله- واذ قال ابراهيم لا بيه ازر- قال ان ابا ابراهيم لم يكن اسمه ازر وانما كان اسمه تارح 

অর্থ: আল্লাহর বাণী (যখন ইব্রাহিম তাঁর পিতা আযরকে বললেন-) এ আয়াতের  ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস  রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতার নাম আযর ছিল না। তার নাম ছিল তারিহ। 

ইবনে আবি শাইবা, ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন। তার কোনটি সহিহ পর্যায়ের। 

عن مجاهد قال ليس ازر ابا ابراهيم 
অর্থ: মুজাহিদ বলেন- আযর  ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা ছিলেন না। 

ইবনুল মুনজির সহিহ সনদে ইবনে জুরাইজ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন- 

قال ليس ازر بابيه انما هو ابراهيم بن تيرح او تارح بن شاروخ بن ناحوربن فالخ 

অর্থ: তিনি বলেন- আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা ছিলেন না। বরং বংশ তালিকা হল এভাবে ইব্রাহিম বিন তাইরিহ অথবা তারিহ বিন শারুখ বিন নাহুর বিন ফালিখ। 

ইবনে আবি হাতিম  সহিহ সনদে সুদ্দি থেকে বর্ণনা করেছেন- 

انه قيل له اسم ابى ابراهيم ازر فقال بل اسمه تارح- وقد وجه من حيث اللغة بان العرب تطلق لفظ الاب على العم اطلاقا شائعا وان كان مجازا 

অর্থ: কেউ বললেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতার নাম হল আযর। তখন সুদ্দি বললেন- বরং তাঁর নাম হল তারিহ। ইহা  ভাষাগতভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ আরবগণ ‘আবুন’ তথা বাবা শব্দটিকে ‘আম্মুন’ তথা চাচা শব্দের উপর প্রয়োগ করে থাকে। যদিও ইহা রূপক অর্থে ব্যবহার হয়। 

‘তানযিল’ কিতাবে নিুের  আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে- 

(ام كنتم شهداء اذ حضر يعقوب الموت اذ قال لبنيه ما تعبدون من بعدى- قالوا نعبد الهك واله ابائك ابراهيم واسماعيل واسحق-) فاطلق على اسماعيل  لفظ الاب وهوعم يعقوب- كما اطلق على ابراهيم وهو جده- 

অর্থ: আল্লাহর বাণী যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয় তখন তোমরা কি উপস্থিত ছিলে?  যখন সে  সন্তানদের  বলল আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা  বলল, আমরা ইবাদত করব তোমার প্রভূর, এবং তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাইল ও ইসহাকের প্রভূর। (বাকারা- ১৩৩) 

উক্ত আয়াতে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে পিতা বলা হয়েছে। অথচ তিনি হলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম   এর চাচা। ঠিক তেমনিভাবে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকেও পিতা সম্বোধন করা হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন ইয়াকুব  আলাইহিস সালাম এর দাদা। 

ইবনে আবি হাতিম হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন- 

انه كان يقول- الجد اب- ويتلو- قالوا  نعبد الهك واله ابائك- 

অর্থ: ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন-দাদা পিতার মত। এবং তিনি  উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করতেন। 

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবুল আলিয়া  থেকে বর্ণনা করেছেন- قال سمى العم أبا অর্থ: তিনি বলেন- চাচাকে পিতা বলা হয়। এমনিভাবে মুহাম্মদ বিন কা’ব আল কারজী থেকে বর্ণনা করেছেন- 

قال- الخال والد والعم والد وتلا هذه الاية- 
অর্থ: তিনি বলেন- খালু পিতার মত এবং চাচা পিতার মত। অতঃপর  তিনি উক্ত আয়াতটি  তিলাওয়াত করলেন। 

এ হচ্ছে উক্ত বিষয়ের উপর সলফে সালেহীন সাহাবি ও তাবেয়ীনদের বক্তব্য। 

এ প্রসঙ্গে আরো একটি স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যা ইবনুল মুনযির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে সহিহ সনদে সুলাইমান বিন সারদ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি  বলেন- যখন লোকেরা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিপে করতে চাইল তখন অসংখ্য জ্বালানী সংগ্রহ করে বিরাট অগ্নিকুণ্ড তৈরি করল। অবশেষে যখন তাকে আগুনে নিপে করতে  চাইল তখন তিনি বললেন- حسبى الله ونعم الوكيل অর্থ: আমার আল্লাহ আমার জন্য কতইনা উত্তম অভিভাবক।  যখন তারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিপে করল তখন আল্লাহতায়ালা বললেন- 

يا نار كونى بردا وسلاما على ابراهيم- 
অর্থ: হে আগুন, তুমি ইব্রাহিমের উপর শীতল ও শান্তি হয়ে যাও। (আম্বিয়া- ৬৯) 

অতঃপর ইব্রাহিমের চাচা বললেন। আমার কারণেই তার   উপর থেকে বিপদ দূরিভূত হয়েছে। তখন আল্লাহতায়ালা তার উপর অগ্নিপিণ্ড নিপে করলেন। যা তার পায়ে আঘাত করল এবং জ্বালিয়ে দিল। 

উক্ত বর্ণনার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর চাচা ছিলেন। 

এখানে আরো একটি ল্যণীয় বিষয় হল  যে, আযর নিহত হয়েছিল  সে সময় যখন ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিেেপর ঘটনা   ঘটেছিল এবং আল্লাহতায়ালা  কুরআনে পাকে বর্ণনা করেছেন যে, যখন ইব্রাহিমের নিকট ব্যাপারটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, আযর আল্লাহর শত্র“ তখন তিনি তার জন্য প্রার্থনা করা বন্ধ করেছেন। আবার   হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে ইব্রাহিমের নিকট তখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে  যখন আযর মুশরিক অবস্থায়  মৃত্যুবরণ করছে। এরপর ইব্রাহিম  আলাইহিস সালাম তার জন্য আর দোয়া করেননি। 

ইবনে   আবি হাতিম সহিহ সনদে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন- 

قال ما زال ابراهيم يستغفر لابيه حتى مات فلما مات تبين له انه عدو لله فلم يستغفرله- 

অর্থ: তিনি বলেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পিতা আযরের জন্য তার মৃত্যু পর্যন্ত দোয়া করেছেন। যখন আযর মৃত্যুবরণ করল  তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে সে আল্লাহর দুশমন। অতঃপর আর দোয়া করেননি। 

আরো একটি রেওয়ায়ত মুহাম্মদ বিন কা’ব, কাতাদাহ, মুজাহিদ, হাসান এবং অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত  হয়েছে। তারা  বলেছেন- আযর জীবীত থাকাবস্থায় ইব্রাহিম আলাইহিস  সালাম তার জন্য  আকাঙ্খা করতেন। যখন সে মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল তখন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।  অতঃপর আগুনে নিক্ষেপের  ঘটনার পর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম শ্যাম দেশে চলে যান। এব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা বর্ণনা করেছেন। 

অতঃপর কিছুদিন পর তিনি  মিশরে গমন করেন। সেখানে সারা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর ব্যাপারে জালিম বাদশার সাথে বাদানুবাদ ঘটে।  অতঃপর হাজেরা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে খাদিমা হিসেবে প্রদান করা হয়। অতঃপর  আবার শ্যাম দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দেন   ইসমাইল আলাইহিস সালাম ও হাজেরা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে মক্কাশরীফে নিয়ে যাবার জন্য এবং তিনি তাই করেন। অতঃপর দোয়া করেন এভাবে- 

ربنا انى اسكنت من ذريتى بواد غير ذى زرع عند بيتك المحرم الى قوله ربنا اغفر لى ولوالدى وللمؤمنين يوم يقوم الحساب- 

অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক, আমি  আমার এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় অবস্থান করিয়েছি। হে  আমাদের প্রভু, আমার পিতা-মাতাকে ও সব মু’মিনকে মা করুন।  যেদিন হিসেব কায়েম হবে। (ইব্রাহিম- ৩৭-৪১) 

অতঃপর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম পিতা-মাতার জন্য দোয়া করেছিলেন তাঁর চাচার মৃত্যুর অনেকদিন পর। 

সুতরাং উক্ত আলোচনা থেকে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনুল  কারীমে যে কুফুরির বর্ণনা ও ইস্তেগফার থেকে বারণ করা হয়েছে তা ইব্রাহিম  আলাইহিস সালাম এর চাচার ব্যাপারে। প্রকৃত পিতার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নয়। (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)

অতঃপর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম  ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ চলতে থাকে। 

ইমাম শাহরাস্তানী- الملل والنحل  গ্রন্থে বলেছেন- আরবের বুকে দ্বীনে ইব্রাহিম ও তাওহীদ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সর্বপ্রথম আমর বিন লুয়াই ইহা পরিবর্তন করে মূর্তিপূজা চালু করে। আমি বলব এ ব্যাপারটি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন ইমাম বুখারী ও মুসলিম আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন- 

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم رأيت عمرو بن عامر الخزاعى يجر قصبة فى النار كان اول من سيب السوائب- 

অর্থ: রাসূলুল্লাহ   সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি দেখেছি আমর বিন আমির খাযায়িকে নাড়িভূঁড়ি টেনে  জাহান্নামে ফেলা হয়েছে।  সেই সর্বপ্রথম সাইয়্যিবা তথা  দেবতার নামে উৎসর্গকৃত পশুর উপাসনা শুরু করে। 

ইমাম আহমদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসনাদ গ্রন্থে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- 

ان اول من سيب السوائب وعبد الاصنام ابو خزاعة عمرو بن عامر وانى رأيته يجر امعائه فى النار- 

অর্থ: নিশ্চয় আবু খাযামা আমর বিন আমির সর্বপ্রথম সাইয়্যিবার প্রচলন এবং মূর্তিপূজা চালু করে। আমি দেখেছি তাকে নাড়িভূঁড়ি টেনে জাহান্নামে নিপে করা হচ্ছে। 

فثبت ان اباء النبى صلى الله عليه وسلم من  عهد ابراهيم الى زمان عمرو المذكور كلهم مؤمنون بيقين- 

অর্থ: অতএব ইহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হল যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বপুরুষগণ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে উল্লেখিত আমর এর যামানা পর্যন্ত প্রত্যেকেই মু’মিন ছিলেন।

 
Top