রমজানে ও রোজায় সাহাবিদের কান্ড: পড়ুন আর উপভোগ করুন 


যখন এই আয়াত নাযিল হলঃ “তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ কাল রেখা হতে সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়।” তখন সওম পালন করতে ইচ্ছুক লোকেরা একটা কান্ড করে বসলেন। নিজেদের দুই পায়ে একটি কাল এবং একটি সাদা সুতলি বেঁধে নিতেন এবং সাদা কাল এই দু’টির মধ্যে পার্থক্য না দেখা পর্যন্ত তাঁরা পানাহার করতে থাকতেন। 😀

আদী ইব্‌নু হাতিম (রাঃ) আরো সহজ বুদ্ধি করলেন। তিনি একটি কাল এবং একটি সাদা রশি নিলেন। এবং রশি দুটিকে বালিশের নিচে রেখে দিলেন। রাতে তিনি এগুলোর দিকে বারবার তাকাতে থাকতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তিনি এ'দুয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারছিলেন না। ভোর হয়ে গেলেও 😀।  সকালেই আল্লাহ্‌র রসূল ﷺ-এর নিকট গিয়ে এ বিষয় বললেন। তিনি বুঝিয়ে বললেনঃ "এতো (কাল রেখা বলতে) রাতের আঁধার এবং (সাদা রেখা বলতে) দিনের আলো।" সাদা কালো রশি না। 😀 (বুখারী ১৯১৭, ১৯১৬)

এ তো গেল সেহরি নিয়ে। ইফতার নিয়েও এমন মজার ঘটনা আছে। কোন এক সফরে কয়েকজন সাহাবী নবী ﷺ এর সঙ্গে ছিলেন। 
- নবী ﷺ এক ব্যক্তিকে বললেনঃ সওয়ারী হতে নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। 
- সে বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! সূর্য এখনো অস্ত যায়নি। 
- তিনি বললেনঃ সওয়ারী হতে নেমে আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। 
- সে বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! সূর্য এখনো ডুবেনি। 
- তৃতীবারের মত বললেনঃ সওয়ারী হতে নামো এবং আমার জন্য ছাতু গুলিয়ে আন। 
অতঃপর সে সাওয়ারী হতে নেমে ছাতু গুলিয়ে আনলে তিনি তা পান করলেন এবং হাতের ইঙ্গিতে বললেনঃ যখন দেখবে রাত এদিক হতে (পূর্বদিক) ঘনিয়ে আসছে তখন বুঝবে, সওম পালনকারী ব্যক্তির ইফতারের সময় হয়েছে। (বুখারী ১৯৪১)

সম্ভবত সাহাবীর কষ্ট হচ্ছিল 😀। মায়াজাল্লাহ।

রমজানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারেও মজার ঘটনা আছে। এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। 
- তিনি ﷺ বললেনঃ তোমার কি হয়েছে?
- আমি সায়িম অবস্থায় আমার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছি। 
- কোন ক্রীতদাস তুমি মুক্ত করতে পারবে কি? 
- সে বলল, না। 
- তুমি কি একাধারে দু’মাস সওম পালন করতে পারবে? 
- সে বলল, না। 
- এরপর তিনি বললেনঃ ষাটজন মিসকীন খাওয়াতে পারবে কি? 
- না। 
এ অবস্থায় উপস্থিত সবাই থেমে গেলেন। এ সময় নবী ﷺ এর কাছে এক আরাক পেশ করা হল যাতে খেজুর ছিল। ‘আরাক হল ঝুড়ি। 
- নবী ﷺ বললেনঃ প্রশ্নকারী কোথায়? 
- সে বলল, আমি। 
- এগুলো নিয়ে সদাকাহ করে দাও। 
- তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমার চাইতেও বেশি অভাবগ্রস্থকে সদাকাহ করব? আল্লাহ্‌র শপথ, মাদীনার উভয় লাবা অর্থাৎ উভয় প্রান্তের মধ্যে আমার পরিবারের চেয়ে অভাবগ্রস্থ কেউ নেই। 
- আল্লাহ্‌র রাসূল ﷺ হেসে উঠলেন এবং তাঁর দাঁত (আইনয়াব) দেখা গেল। অতঃপর তিনি বললেনঃ এগুলো তোমার পরিবারকে খাওয়াও ❤। (বুখারী ১৯৩৬)

এটাই ছিল সাহাবীর শাস্তি। 😀 আমার নবি ﷺ থেকে যিনি যেভাবে পেরেছেন বিধানগুলো সহজ করে নিয়েছেন। কিন্তু সাবধান, সামর্থবানদের জন্য কিন্তু নিজ পরিবারকে খাওয়ালে চলবে না 😀

এবার দেখুন এর বিপরীত আরেকটি ঘটনা।
 
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইব্‌নুল ‘আস (রাঃ) প্রতিদিন রোজা রাখতেন। আবার সারারাত নামাজ পড়তেন। এ ঘটনা শুনে রাসুল ﷺ তাকে বললেনঃ 
- হে ‘আবদুল্লাহ! আমি এ সংবাদ পেয়েছি যে, তুমি প্রতিদিন সওম পালন কর এবং সারা রাত সালাত আদায় করে থাকো। 
- ঠিক (শুনেছেন) হে আল্লাহ্‌র রসূল! 
- তিনি বললেনঃ এরূপ করবে না (বরং মাঝে মাঝে) সওম পালন করো আবার ছেড়েও দাও। (রাতে) সালাত আদায় কর আবার ঘুমাও। কেননা তোমার উপর তোমার শরীরের হাক্ব রয়েছে, তোমার চোখের হাক্ব রয়েছে, তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হাক্ব আছে, তোমার মেহমানের হাক্ব আছে। তোমার জন্য যথেষ্ট যে, তুমি প্রত্যেক মাসে তিন দিন সওম পালন কর। কেননা নেক ‘আমলের বদলে তোমার জন্য রয়েছে দশগুণ নেকী। এভাবে সারা বছরের সওম হয়ে যায়। 
- আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বললেন, আমি এর চেয়েও কঠোর ‘আমল করতে সক্ষম। 
তখন তাকে আরও কঠিন ‘আমলের অনুমতি দেয়া হল।
- আবার বললেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমি আরো বেশী শক্তি রাখি। 
- তিনি ﷺ বললেনঃ তবে আল্লাহ্‌র নবী দাউদ (আঃ)-এর সওম পালন করো, এর হতে বেশী করতে যেয়ো না। 
- আল্লাহ্‌র নবী দাউদ (আঃ)-এর সওম কেমন? 
- তিনি বললেনঃ অর্ধেক বছর। 

আব্দুল্লাহ (রাঃ) বৃদ্ধ বয়সে বলতেন, আহা! আমি যদি নবী ﷺ প্রদত্ত রুখসত (সহজতর বিধান) কবূল করে নিতাম ! 😀 (বুখারী, ১৯৭৫)

নবি ﷺ যেটা বলেন সেটাই শরিয়ত। সাহাবী না পারছেন আর এত কষ্ট করতেন। না পারছেন রাসুলের স্বীকৃতিকে ফেলে দিতে 😀। যদিও তাঁর উপর এটা আবশ্যক হয়ে যায়নি।

সাহাবায়ে আজমাইনের পাগলামি এমন ছিল যে, নবি ﷺ যা করবেন, সাহাবীরাও সেটা করবেন তো করবেনই। যেভাবেই হোক। এমন একটা মাজার ঘটনা দেখুন। 

রাসুল ﷺ সওমে বিসাল করতেন। সওমে বিসাল হচ্ছে না খেয়ে একটানা রোজা। দিনের পর দিন। সাহাবীরা দেখলেন, নবি ﷺ এভাবে রোজা রাখছেন। আমরা কি দোষ করলাম, আমরাও এভাবেই রোজা থাকবো। রাসুল ﷺ নিষেধ করলেন। এরুপ করোনা। তোমরা পারবে না। তবুও সাহাবীরা নাছোড়বান্দা। সাহাবীরা সওমে বিসাল করা হতে বিরত থাকল না। তখন তিনি তাদেরকে নিয়ে দিনের পর দিন (লাগাতার) সওমে বিসাল করতে থাকলেন। দু'দিনে তাঁদের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল 😀। দূর্বল হয়ে পড়লেন। ইতিমধ্যে শওয়ালের চাঁদ দেখা গেল। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। নবিজী ﷺ ইরশাদ করলেন, "আল্লাহর কসম! যদি  মাস দীর্ঘায়িত হতো, তবে আমি এমনভাবে সওমে বিসাল করতাম যার ফলে সীমালঙ্ঘনকারীগণ সওমে বিসাল করা ছেড়ে দিত।" এটা ছিল তাঁদের শাস্তি 😀। আয়েশা রাঃ বলেন- তিনি দয়াপরবশ হয়ে তোমাদেরকে সওমে বিসাল করতে নিষেধ করেছেন।

বুখারীর ১৯৬১-১৯৬৭ পর্যন্ত ৭ টি হাদিস এবং মুসলিমের কয়েকটি হাদিসে সওমে বিসালের বহু হাদিস এসেছে। হাদিসগুসমূহে এ শব্দগুলো ঘুরে ফিরে লক্ষ্যণীয়-
لست كاحد منكم - আমি তোমাদের কারো মত নই
كست كهيئتكم - আমি তোমাদের মত নই
لست متْلكم - আমি তোমাদের অনুরূপ নই
ايكم متْلى - তোমাদের মধ্যে কে আছ আমার মত

মাসয়ালাঃ আমরা কেউই রাসুলে আকরাম ﷺ এর মত নই। আমাদের মত বলার কোন সুযোগ নেই। তিনি মানুষের মধ্যেই দুনিয়ায় এসেছেন। তিনি মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমাদের মত না। 

তবে দেখুন সুরা ইয়াছিন, ১৫ নং আয়াত। "" কাফেররা (নবিদের) বলতো, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। রহমান কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। তোমরা নিরেট মিথ্যুক (মিথ্যা বলছো)।" এবার দেখুন, সুরা কাহাফের সে পরিচিত আয়াত। "আপনি বলুন, আমি তো তোমাদের মত (সুরতে) একজন মানুষ, তবে আমার উপর ওহী নাযিল হয়। তোমাদের ইলাহ একমাত্র আল্লাহ।"

আয়াত দুটি দেখলে যে কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারবে। কাফেররা তাদের মত মনে করছে, তারা বলে আপনার উপর ওহী আসেনা। সুতরাং আপনি বলে দিন, ঠিক আছে, আমি তোমাদের মত। তবে আমার উপর ওহী নাযিল হয়।" এটা এজন্য যে, তিনি আল্লাহ ও হবেন না, ফেরেশতা ও না। তিনি তো মানুষ। হাদিস সমূহ বলে, তিনি কারো মত নন। তাছাড়া, 'আপনি বলুন' বলে এখানে রাসুলের জন্য খাস করা হয়েছে। আমাদের মত বলার সুযোগ আমাদের নেই। 

তবু, এ নিয়ে যদি সন্দেহ থাকে তবে সুরা হুজরতের সে আয়াতটি স্বরণ করুন (আয়াত ২) "হে ইমানদারগণ! নবির কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বরকে উঁচু করো না। তোমরা পরষ্পরের সাথে যে ভাবে কথা বল তাঁর সাথে (শানে) সেভাবে কথা বলো না। কারণ, এতে তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে অথচ তোমরা টেরও পাবে না।"

ভালবাসা হবে সাহাবিদের মত। পাগলামি ও হবে তাঁদের মতই। 

রমজানুল মুবারকের শুভেচ্ছা! 😍
 
Top