কিতাবঃ আশ শিফা


মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)


অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


[Bengali translation of Imam Qadi Iyad’s book “Shifa” as found in Ayesha Abd al-Rahman Bewley’s English translation. Translator: Kazi Saifuddin Hossain]


অনুবাদকের আরয


সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহতা’লারই প্রাপ্য, যিনি পরম দয়ালু, দাতা। অসংখ্য সালাত-সালাম জানাই মহান রাব্বুল আলামীনের খাস্ রহমত হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি, যাঁর অসীলায় এবং সুপারিশে আমরা গুনাহগার উম্মত নাজাত তথা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি অর্জন করার আশা রাখি। অতঃপর নূরে মোজাসসাম হযরত রাসূলে করীম (ﷺ)-এর পুণ্যবান আহল-এ-বায়ত (رضي الله عنه), আসহাব-এ-কেরাম (رضي الله عنه), আযওয়াজে মোতাহহারাত (পবিত্র বিবি সাহেবাবৃন্দ) ও বুযূর্গানে দ্বীন (رحمة الله)-মণ্ডলীর প্রতি নিবেদন করি আমাদের ভক্তিপূর্ণ সালাম। বিশেষ করে আমার পীর ও মোর্শেদহযরতুল আল্লামা শাহ সূফী সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল–কাদেরী আল–চিশ্তীরাহমাতুল্লাহে আলাইহের প্রতি নিবেদন করি আমার অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য।


এ বইটি আন্দালুসিয়া (স্পেন)-এর বিচারক ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله) প্রায় হাজার বছর আগে প্রণয়ন করেছিলেন। মহানবী (ﷺ) সম্পর্কে লিখিত এটা অদ্বিতীয় মৌলিক গ্রন্থ। এর ইংরেজি অনুবাদ করেন মোহতারামা আয়েশা আবদ্ আল-রাহমান বিউলী।


আল্লাহতা’লা সবাইকে এ মহামূল্যবান গ্রন্থটি পাঠ করে এর মর্মবাণী উপলব্ধি করার তাওফীক দিন এবং এ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ কবূল করুন, আমীন!


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম


লেখকের মুখবন্ধ


[হে আল্লাহ, রাসূলুল্রাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ওতাঁর পরিবারবর্গের প্রতি সালাম ও আশীর্বাদ বর্ষণ করুন]


অতঃপর বলেন ফকীহ ও কাজী, ইমাম ও হাফেয, আবূল ফযল আয়াজ ইবনে মূসা ইবনে আয়াজ আল-এয়াহসুবী (رحمة الله):


আল্লাহরই প্রতি সকল প্রশংসা, যিনি তাঁর সুন্দরতম নামের অধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং একমাত্র তিনি-ই মহাপরাক্রমশালী। তাঁর (নৈকট্যের) চেয়ে কম কোনো অভীষ্ট লক্ষ্য নেই এবং তাঁর (রেযামন্দী হাসিলের) পরে আর কোনো অভীষ্ট লক্ষ্য নেই। ধারণা ও কল্পনা ব্যবহারের প্রয়োজন ছাড়াই তিনি প্রকাশ্য এবং অনস্তিত্ব সৃষ্টিকারক বস্তু হতে নির্মল থেকেই তিনি অপ্রকাশ্য। তাঁর দয়া ও জ্ঞান দ্বারা তিনি সকল বস্তুকে ঘিরে রেখেছেন। তাঁর বন্ধুদের প্রতি তিনি অসীম করুণা (রহমত) বর্ষণ করছেন। তিনি তাঁদের মধ্য থেকে আরব ও অনারব উভয়েরই জন্যে এমন এক পয়গম্বর (ﷺ) প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁদের মধ্যে মহানতম, প্রকৃতি ও শিক্ষা-দীক্ষায় সবচেয়ে খাঁটি ও নির্মল, বুদ্ধি ও ধৈর্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, জ্ঞান ও উপলব্ধিতে সর্বাধিক পরিপূর্ণ, বিশ্বাস ‍ও আস্থায় সবচেয়ে অটল-অবিচল, যিনি তাঁদের প্রতি সর্বাধিক দয়াবান ও করুণাশীল।


আল্লাহতা’লা তাঁকে আত্মা ও শরীরে পুতঃপবিত্র করে সকল দোষত্রুটি থেকে মুক্ত রেখেছিলেন এবং তাঁকে জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও বিচার-বিবেচনা ক্ষমতা দান করেছিলেন। তাঁরই মাধ্যমে আল্লাহতা’লা সে সকল চোখকে দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন যেগুলো ছিল অন্ধ; সে সকল অন্তরকে করেছেন উন্মুক্ত যেগুলো ছিল আবৃত; আর সে সকল কানকে শ্রবণশক্তি দিয়েছেন যেগুলো ছিল বধির। তিনি মানুষজনকে তাঁর এই রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিয়েছেন। আল্লাহতা’লার রহমতের অংশের যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁরা তাঁকে সম্মান ও সাহায্য করতেন। আল্লাহ যাদের ভাগ্যে অভিশাপ লেখেছেন, তারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং অাল্লাহর নিদর্শনগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। “এদুনিয়ায় যে ব্যক্তি অন্ধ, সে আখেরাতেও অন্ধ” [আল-কুরআন, ১৭:৭৩]। আল্লাহ পাক তাঁকে এমন এক নেয়ামত দান করুন যা বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি লাভ করে এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও আসহাব-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কেও তা দান করুন এবং তাঁদের প্রতি শান্তি বর্ষণ করুন।


মহান আল্লাহতা’লা আমার ও আপনার অন্তরকে নিশ্চয়তার আলো দ্বারা আলোকোজ্জ্বল করুন! তাঁর বন্ধুবর্গ যাঁরা তাঁকে ভয় করেন এবং যাঁদের তিনি তাঁর সম্পূর্ণ পবিত্রতার আতিথ্য দ্বারা সম্মানিত করেছেন এবং যাঁদেরকে তিনি তাঁর নৈকট্য দান করে তাঁরই অন্যান্য সৃষ্টি থেকে পৃথক করেছেন, সেই সকল বন্ধুর মতো তিনি যেন আমার ও আপনার প্রতি রহমত (করুণা) বর্ষণ করেন। তাঁর রহস্যময় জ্ঞানের জন্যে এবং তাঁর মালাকুত-এর কিছু অত্যাশ্চর্য দর্শনের জন্যে এবং তাঁর ক্ষমতার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্যে তিনি তাঁদেরকে আলাদা করে নিয়েছেন। এটা তাঁদের অন্তরগুলোকে খুশিতে পরিপূর্ণ করে এবং আল্লাহতা’লার বিশালত্বে তাঁদের মস্তিষ্কগুলো নিজেদের হারিয়ে ফেলে। তাঁরা আল্লাহতা’লাকেই নিজেদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এ পৃথিবী ও পরবর্তী জগতে তাঁকেই প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর সৌন্দর্য ও রাজকীয়তা দর্শনে তাঁরা আশীর্বাদধন্য এবং তাঁর ক্ষমতা ও বিশালত্বের অত্যাশ্চর্যের মাঝে তাঁরা নিজেদের আবদ্ধ রাখেন। তাঁর প্রতি নিবেদিত হয়ে এবং তাঁর ওপর ভরসা করে তাঁরা আনন্দিত। তাঁরা নিবেদিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরই কালামের বাস্তব রূপ – “এঁরা হচ্ছেন এমন মানুষ যাঁদেরকেআল্লাহ হেদায়াত করেছেন; সুতরাং তোমরা তাঁদেরইপথে চলো।” [সূরা আনআম, ৯১ আয়াত]


আপনি বারবার আমাকে অনুরোধ করেছেন এমন কিছু লেখতে যা দ্বারা মহানবী (ﷺ)-এর প্রকৃত শান-মান ও তাঁর প্রাপ্য ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং তাঁর শানে ন্যূনতম বে-আদবি সংঘটনকারীর প্রতি ফায়সালার সাথে পাঠকমণ্ডলীকে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমাদের পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীন ও ইমামবৃন্দের এতদসংক্রান্ত ভাষ্য সঙ্কলন করতেও আমাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে; আমি সেগুলোকে আয়াতে করীমা ও অন্যান্য উদাহরণ দ্বারা সমর্থন দেবো।


জেনে রাখুন, আল্লাহ আপনাকে সমুন্নত করবেন। আপনি আমাকে একটা কঠিন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আপনি আমাকে এতো ভারী কাজের মুখোমুখি করেছেন যার ভয়ে আমার চিত্ত দুরু দুরু করছে!


এ বিষয়ে লেখার জন্যে প্রয়োজন প্রাথমিক উৎসগুলোর মূল্যায়ন, পরবর্তী উৎসগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের গভীরতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা; কী কী বিষয় তাঁর প্রতি আরোপ করা যাবে এবং তাঁর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ কিম্বা বৈধ হবে তা-ও বিবেচনা করা; আর রেসালাত ও নবুওয়্যতের গভীর জ্ঞান, এ সুমহান পদমর্যাদার বিশেষ গুণাবলী, এর ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সম্পর্কেও মূল্যায়ন প্রয়োজন।


আমরা এমন-ই এক বিশাল বন্ধুর মরুভূমির সামনে উপস্থিত যেখানে মরু-মোরগও দিশেহারা হবে; এ মরুভূমি পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়; এটা এমন-ই এক স্থান যেখানে স্বপ্নগুলো বিচ্যুত হয় – যদি না সেগুলো জ্ঞানের দিকনির্দেশনা এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টির সহায়তা পায়; এটা এমন-ই পিচ্ছিল ঢালু এক জায়গা যেখানে পা ফসকে পড়তে হবে – যদি না শুধু আল্লাহতা’লার প্রদত্ত সাফল্য ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করা হয়। তবে এ প্রশ্নটির জবাব দেয়ার ব্যাপারে এবং মহানবী (ﷺ)-এর অনুপম চরিত্র-মাহাত্ম্য ও বিশেষ গুণাবলী প্রকাশ করার বিষয়ে আপনার ও আমার একটি বড় পুরস্কারপ্রাপ্তির ব্যাপারে আমি দারুণ আশাবাদী। কোনো সৃষ্টি-ই এ সকল গুণের অধিকারী কখনো হতে পারেনি। হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে প্রদত্ত দায়িত্ব যা সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব-ই, তা আমি উল্লেখ করছি – “এ জন্যে যে, কিতাবী (ঐশী শাস্ত্রলিপির অনুসারী লোক)-দের মনেদৃঢ় বিশ্বাস আসবে এবং ঈমানদারবৃন্দের ঈমান বৃদ্ধিপাবে।” [আল-কুরআন, ৭৪:৩১]


যেসব লোককে কেতাব (ঐশীগ্রন্থ) দেয়া হয়েছে, তাদের প্রতি আল্লাহ অবশ্যকর্তব্য করেছেন যে তারা তা প্রকাশ করবে এবং গোপন করবে না, যা আবূল ওয়ালীদ হিশাম ইবনে আহমদ ফকীহ (ফেকাহবিদ) কর্তৃক আমার কাছে বর্ণিত হাদীস শরীফে প্রতিভাত হয়। ওই সময় আমি তাঁর অধীনে অধ্যয়নরত ছিলাম। তিনি বলেন: আমি জ্ঞাত হয়েছি আল-হুসাইন ইবনে মোহাম্মদ হতে, তিনি আবূ উমর নূমাইরী হতে, তিনি আবূ মোহাম্মদ ইবনে আব্দিল মো’মেন হতে, তিনি আবূ বকর মোহাম্মদ ইবনে বকর হতে, তিনি সুলাইমান ইবনে আল-আশ’আত হতে, তিনি মূসা ইবনে ইসমাঈল হতে, তিনি হাম্মাদ হতে, তিনি আলী ইবনে আল-হাকাম হতে, তিনি আতা’ হতে এই মর্মে যে, হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন –“যে ব্যক্তিকে জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় এবং সেতা গোপন করে, তাকে আল্লাহতা’লা পুনরুত্থান দিবসেআগুনের রাশ দ্বারা আটক করবেন।” [আল-হাদীস]


এ কারণে আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুবার উদ্দেশ্যে এবং আমার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্যে আমি কিছু পরিষ্কার উপাখ্যান তালাশ করা জরুরি বিবেচনা করেছি। আমি সেগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছি। কেননা, কোনো মানুষ তার জীবনে যে কঠিন পরীক্ষা ও দুঃখকষ্টের মুখোমুখি হয়, তাতে তার দেহ ও মস্তিষ্ক এতোই ব্যতিব্যস্ত থাকে যে সে ফরয (আবশ্যিক) এবং নফল (অতিরিক্ত) কার্যক্রম থেকে প্রায় বিচ্যুত হওয়ার উপক্রম হয় এবং সেরা অবস্থায় উপনীত হওয়ার পরও তাকে তা সর্বনিকৃষ্ট পর্যায়ে অধঃপতিত করে।


আল্লাহতা’লা যদি মানুষের মঙ্গল চান, তাহলে তিনি পরলোকে যা কিছু প্রশংসিত হবে এবং সমালোচিত হবে না, তা নিয়ে তাকে ব্যস্ত রাখেন। সেদিন শুধু থাকবে নেয়ামতের আলোকোচ্ছ্বটা এবং জাহিমের শাস্তি। সুতরাং কোনো মানুষের উচিত নিজ কর্মের ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং নিজ আত্মার নাজাত (পরিত্রাণ) অন্বেষণ করা; আর নিজের ভালো কর্মগুলোর বৃদ্ধি সাধন এবং নিজের ও মানুষের কল্যাণকর, উপকারী জ্ঞান অন্বেষণ করাও তার জন্যে জরুরি।


আল্লাহতা’লা-ই আমাদের ভগ্ন হৃদয়গুলোকে জোড়া লাগিয়ে দেন, আমাদের বড় বড় ভুল কাজগুলোকে ক্ষমা করেন, তাঁর কাছে ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি সুসম্পন্ন করেন, তাঁর নৈকট্য হাসিলের এবং আমাদেরকে রক্ষা করার জন্যে কাজ করার উপলক্ষ সৃষ্টি করে দেন এবং আমাদের প্রতি তাঁর দয়া ও ক্ষমা মঞ্জুর করেন।


অতএব, এ কাজের নিয়্যত (উদ্দেশ্য) করেই আমি অধ্যায়গুলো বিন্যস্ত করেছি। এ গ্রন্থের নাম দিয়েছি ‘আশ্শিফা বিত্ তা’রিফে হুকুকে মোস্তফা’ (মনোনীত জনের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতির মাঝে নিহিত নিরাময়)।


সূচিপত্র


প্রথম খণ্ড


বাক্য ও কর্মে প্রকাশিত মহানবী (ﷺ) সম্পর্কেআল্লাহতা’লার সুউচ্চ মূল্যায়ন


প্রথম অধ্যায়: রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে আল্লাহরপ্রশংসাস্তুতি ও সুউচ্চ মূল্যায়ন


পরিচ্ছেদ – ১/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসাস্তুতি ও তাঁর অসংখ্য মহৎ গুণাবলী


পরিচ্ছেদ – ২/ তাঁকে শাহেদ (সাক্ষী) হিসেবে আল্লাহর দেয়া বর্ণনা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত প্রশংসা ও মর্যাদা


পরিচ্ছেদ – ৩/ তাঁর প্রতি আল্লাহতা’লার দয়া ও নম্র মনোভাব


পরিচ্ছেদ – ৪/ তাঁর মহান সত্তার নামে আল্লাহর কৃত কসম-সম্পর্কিত


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁকে নিজের পাশে জায়গা দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কৃত শপথ


পরিচ্ছেদ – ৬/ মহানবী (ﷺ)-কে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে আল্লাহতা’লার দয়া ও মহানুভবতা


পরিচ্ছেদ – ৭/ রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে আল্লাহর প্রশংসাস্তুতি এবং তাঁর অগণিত মহৎ গুণাবলী


পরিচ্ছেদ – ৮/ রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি সালাওয়াত পাঠের জন্যে সৃষ্টিকুলের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এবং তাঁকে আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ ও তাঁরই অসীলায় শাস্তি মওকুফ করা


পরিচ্ছেদ – ৯/ সূরা ফাতহ-এ মহানবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত মর্যাদাপূর্ণ চিহ্নগুলো সম্পর্কে


পরিচ্ছেদ – ১০/ আল্লাহর মহান কেতাবে বিশ্বনবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত মহা সম্মান এবং তাঁরই পাশে রাসূল (ﷺ)-এর মাকাম (পদমর্যাদা) ও রাসূল (ﷺ)-কে তাঁরই প্রদত্ত অন্যান্য বস্তু সম্পর্কে ব্যাখ্যা


দ্বিতীয় অধ্যায়: মহানবী (ﷺ)-এর সুমহান চারিত্রিকবৈশিষ্ট্য ও গঠনকে আল্লাহর পূর্ণতাদান এবং দ্বীন ওদুনিয়ার যাবতীয় সুন্দর নৈতিকতা দ্বারা তাঁকেসমৃদ্ধকরণ


পরিচ্ছেদ – ১/ মুখবন্ধ


পরিচ্ছেদ – ২/ মহানবী (ﷺ)-এর শারীরিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডলী


পরিচ্ছেদ – ৩/ তাঁর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা


পরিচ্ছেদ – ৪/ তাঁর বুদ্ধিমত্তা, বাগ্মিতা ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তি


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁর সুন্দর বাচনভঙ্গি ও স্পষ্ট আরবী ভাষা


পরিচ্ছেদ – ৬/ তাঁর বংশগত আভিজাত্য; তাঁর জন্মস্থানের ও বেড়ে ওঠার স্থানের সম্মান ও মর্যাদা


পরিচ্ছেদ – ৭/ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কর্মের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থা


পরিচ্ছেদ – ৮/ বিয়ে ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াদি


পরিচ্ছেদ – ৯/ অর্থসম্পদ সংক্রান্ত বিষয়াদি


পরিচ্ছেদ – ১০/ তাঁর প্রশংসনীয় গুণাবলী


পরিচ্ছেদ – ১১/ তাঁর বুদ্ধিমত্তা


পরিচ্ছেদ – ১২/ তাঁর ধৈর্য, দীর্ঘ দুঃখকষ্ট ও ক্ষমা প্রদর্শন


পরিচ্ছেদ – ১৩/ তাঁর দয়া ও উদারতা


পরিচ্ছেদ – ১৪/ তাঁর সাহস ও পরাক্রম


পরিচ্ছেদ – ১৫/ তাঁর হায়া-শরম ও দৃষ্টি অবনতকরণ


পরিচ্ছেদ – ১৬/ তাঁর সৎ সঙ্গ, শিষ্ট আচার-ব্যবহার ও সৎ স্বভাব


পরিচ্ছেদ – ১৭/ তাঁর করুণাশীলতা


পরিচ্ছেদ – ১৮/ চুক্তি রক্ষায় ও আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখায় তাঁর সাধুতা


পরিচ্ছেদ – ১৯/ তাঁর বিনয়


পরিচ্ছেদ – ২০/ তাঁর ন্যায়বিচার, বিশ্বস্ততা, শালীনতা ও সত্যপরায়ণতা


পরিচ্ছেদ – ২১/ তাঁর গম্ভীরতা, মৌনতা, চিন্তাশীলতা, পৌরুষসূচক গুণাবলী ও সুন্দর আচার-ব্যবহার


পরিচ্ছেদ -২২/ পার্থিব বিষয়াদিতে তাঁর অসম্পৃক্ততা


পরিচ্ছেদ -২৩/ তাঁর খোদাভীরুতা, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও এবাদত-বন্দেগীর গভীরতা


পরিচ্ছেদ – ২৪/ আম্বিয়া (عليه السلام)-এর গুণাবলী


পরিচ্ছেদ – ২৫/ নবী করীম (ﷺ)-এর গুণাবলীর ক্ষেত্রে ইবনে আবি হালা হতে আল-হাসানের বর্ণিত হাদীস শরীফ


তৃতীয় অধ্যায়: আল্লাহ কর্তৃক মহানবী (ﷺ) – এর মহামূল্যায়ন, তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও উভয় লোকে তাঁর উচ্চপদমর্যাদা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ  রেওয়ায়াত/বর্ণনাসমূহ


পরিচ্ছেদ – ১/ তাঁর মকাম (স্থান)


পরিচ্ছেদ – ২/ মে’রাজ তথা রাত্রি-ভ্রমণের অলৌকিক ঘটনা


পরিচ্ছেদ – ৩/ রাত্রি-ভ্রমণের বাস্তবতা


পরিচ্ছেদ – ৪/ যারা একে স্বপ্ন বলে তাদের খণ্ডন


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁর প্রভুর দর্শন


পরিচ্ছেদ – ৬/ আল্লাহর সকাশে ঘনিষ্ঠ আলাপ


পরিচ্ছেদ – ৭/ তাঁর নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতা


পরিচ্ছেদ – ৮/ পুনরুত্থান দিবসে তাঁর মানুষের অগ্রবর্তী হওয়া


পরিচ্ছেদ – ৯/ আল্লাহর ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের জন্যে তাঁকে বেছে নেয়া


পরিচ্ছেদ – ১০/ তাঁকে ‘মাকামে মাহমূদ’ (প্রশংসিত স্থান) ও শাফায়াত দান


পরিচ্ছেদ – ১১/ আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁকে বেহেস্তে মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা, উচ্চ মর্যাদা ও ‘কাউসার’ দান


পরিচ্ছেদ – ১২/ আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে নিষেধকারী হাদীসসমূহ


পরিচ্ছেদ – ১৩/ মহানবী (ﷺ)-এর নাম মোবারক ও নামের শ্রেষ্ঠত্ব


পরিচ্ছেদ – ১৪/ আল্লাহতা’লা কর্তৃ নিজের কিছু সুন্দর নাম ও মহানতম গুণাবলী দ্বারা মহানবী (ﷺ)-কে সম্মানিতকরণের বর্ণনা


পরিচ্ছেদ – ১৫/ স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির গুণাবলীর পুনঃআলোচনা


চতুর্থ অধ্যায়: মহানবী (ﷺ)-এর হাত মোবারক দ্বারাআল্লাহতা’লা যেসব মো’জেযা দেখিয়েছেন এবং যেকারামত (সম্মান) তাঁকে দান করেছেন


পরিচ্ছেদ – ১/ মুখবন্ধ


পরিচ্ছেদ – ২/ নবুওয়্যত ও রেসালাত


পরিচ্ছেদ – ৩/ মো’জেযার অর্থ


পরিচ্ছেদ – ৪/ কুরআন মজীদের অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে


পরিচ্ছেদ – ৫/ কুরআন মজীদের গঠনশৈলী ও ধারার অনুকরণীয় দিক


পরিচ্ছেদ – ৬/ গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান) সম্পর্কে তথ্য


পরিচ্ছেদ – ৭/ পূর্ববর্তী প্রজন্ম ও বিগত জাতিগুলোর দেয়া খবর


পরিচ্ছেদ – ৮/ আরবদের প্রতি চ্যালেন্জ ও প্রত্যুত্তর দানে তাদের অক্ষমতা এবং তাদেরকে এ মর্মে অবহিতকরণ যে তারা প্রত্যুত্তর দিতে সক্ষম হবে না


পরিচ্ছেদ – ৯/ কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণে আল্লাহ-ভীতি সঞ্চার ও মানুষের অন্তরে এর অনুপ্রেরণা


পরিচ্ছেদ – ১০/ কুরআন মজীদ চিরকাল বিদ্যমান থাকার বিষয়


পরিচ্ছেদ – ১১/ কুরআন মজীদ অনুকরণীয় হওয়ার অন্যান্য দিক


পরিচ্ছেদ – ১২/ চাঁদ দ্বিখণ্ডিতকরণ ও সূর্যকে আটকে রাখা


পরিচ্ছেদ – ১৩/ মহানবী (ﷺ)-এর আঙ্গুল মোবারক হতে পানির নহর প্রবাহিত হওয়া এবং তাঁর বরকতে তা বৃদ্ধি পাওয়া


পরিচ্ছেদ – ১৪/ হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর বরকতে পানি প্রবাহিত হওয়া


পরিচ্ছেদ – ১৫/ রাসূলে করীম (ﷺ)-এর বরকতে ও দোয়ায় খাদ্য সামগ্রীর প্রাচুর্য


পরিচ্ছেদ – ১৬/ গাছের বাক্ শক্তি ও তাঁর নবুওয়্যতের প্রতি সাক্ষ্য প্রদান এবং তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়া


পরিচ্ছেদ – ১৭/ তালগাছের গুঁড়ির আকাঙ্ক্ষাসম্পর্কিত ঘটনা


পরিচ্ছেদ – ১৮/ অন্যান্য জড় পদার্থের অনুরূপ ঘটনাবলী


পরিচ্ছেদ – ১৯/ বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের সাথে সম্পৃক্ত নিদর্শনসমূহ


পরিচ্ছেদ – ২০/ মৃতকে পুনরায় জীবিত করা, মৃতদের বাক্ শক্তি, দুধের শিশুদের দ্বারা কথা বলা ও তাঁর নবুওয়্যতের প্রতি সাক্ষ্য প্রদান


পরিচ্ছেদ – ২১/ অসুস্থ ও পঙ্গুদের আরোগ্য দান


পরিচ্ছেদ – ২২/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রার্থনা কবুল হওয়া প্রসঙ্গে


পরিচ্ছেদ – ২৩/ বিশ্বনবী (ﷺ)-এর কারামত ও বরকত এবং তাঁর দ্বারা স্পর্শকৃত বস্তু তাঁরই জন্যে পরিবর্তিত হওয়া প্রসঙ্গে


পরিচ্ছেদ – ২৪/ গায়ব ও ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্পর্কে মহানবী (ﷺ)-এর জ্ঞান


পরিচ্ছেদ – ২৫/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণকারী লোকদের ক্ষতি থেকে আল্লাহ প্রদত্ত সুরক্ষা ও আল্লাহ একাই যথেষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে


পরিচ্ছেদ – ২৬/ মহানবী (ﷺ)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা


পরিচ্ছেদ – ২৭/ ফেরেশতা ও জ্বিনের সাথে মহানবী (ﷺ)-এর আলাপসম্পর্কিত বর্ণনা


পরিচ্ছেদ – ২৮/ মহানবী (ﷺ)-এর গুণাবলী ও তাঁর নবুওয়্যতের নিদর্শনসমূহ


পরিচ্ছেদ – ২৯/ বিশ্বনবী (ﷺ)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) বৃত্তান্ত


পরিচ্ছেদ – ৩০/ পরিসমাপ্তি ও সংযুক্তি


দ্বিতীয় খণ্ড


মানুষের ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের অধিকার


প্রথম অধ্যায়: মহানবী (ﷺ)-কে বিশ্বাস করা, মান্য করাও তাঁর সুন্নাহকে অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা


পরিচ্ছেদ – ১/ তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের বাধ্যবাধকতা


পরিচ্ছেদ – ২/ তাঁকে মানার বাধ্যবাধকতা


পরিচ্ছেদ – ৩/ তাঁকে অনুসরণের এবং তাঁর সুন্নাহ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা


পরিচ্ছেদ – ৪/ তাঁর সুন্নাহ মেনে চলার, তাঁর হেদায়াত (পথপ্রদর্শন) ও সীরাহ (জীবনচরিত) অনুসরণের ব্যাপারে সালাফ-বৃন্দের এবং ইমামমণ্ডলীর বর্ণনাসমূহ


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁর আদেশের বিরোধিতা করার বিপদ


দ্বিতীয় অধ্যায়: মহানবী (ﷺ)-কে ভালোবাসারপ্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে


পরিচ্ছেদ – ১/ তাঁকে ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত


পরিচ্ছেদ – ২/ মহানবী (ﷺ)-কে ভালোবাসার পুরস্কার প্রসঙ্গে


পরিচ্ছেদ – ৩/ সালাফ ও ইমামবৃন্দ কর্তৃক মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি অন্তরে মহব্বত পোষণের ও তাঁর রেযামন্দি হাসিলের পক্ষে তাঁদেরই বর্ণিত প্রামাণ্য দলিল


পরিচ্ছেদ – ৪/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসার আলামত বা চিহ্ন


পরিচ্ছেদ – ৫/ নবীপ্রেমের অর্থ ও বাস্তবতা


পরিচ্ছেদ -৬/ মহানবী (ﷺ)-এর খাতিরে নসীহতেরবাধ্যবাধকতা


তৃতীয় অধ্যায়: তাঁর মর্যাদা তুলে ধরা এবং তাঁকে ভক্তি–শ্রদ্ধা করার প্রয়োজনীয়তা


পরিচ্ছেদ – ১/ এ বিষয়ে কুরআনের আয়াতসমূহ


পরিচ্ছেদ – ২/ তাঁর প্রাপ্য ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান (তা’যিম)


পরিচ্ছেদ – ৩/ মহানবী (ﷺ)-এর বেসালের পরে তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা


পরিচ্ছেদ – ৪/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সালাফ-বৃন্দের শ্রদ্ধা প্রদর্শন


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁর পরিবারবর্গ, বংশধর ও বিবি সাহেবানের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা


পরিচ্ছেদ – ৬/ তাঁর আসহাব-মণ্ডলীর প্রতি সম্মান, ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং তাঁদের প্রাপ্য সম্মানের স্বীকৃতি


পরিচ্ছেদ – ৭/ মহানবী (ﷺ)-এর সাথে সম্পর্কিত বস্তু ও স্থানের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা


চতুর্থ অধ্যায়: রাসূলুল্লাহ (দ;)-এর প্রতি সালাত–সালাম পাঠ এবং এর বাধ্যবাধকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব


পরিচ্ছেদ – ১/ বিশ্বনবী (ﷺ)-এর প্রতি সালাওয়াতের অর্থ


পরিচ্ছেদ – ২/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি প্রেরিত সালাওয়াতের বিচার


পরিচ্ছেদ – ৩/ যেসব পরিস্থিতিতে হুযূর পাক (ﷺ)-এর প্রতি সালাওয়াত পাঠ করা উত্তম বলা হয়েছে


পরিচ্ছেদ – ৪/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণের পদ্ধতিসম্পর্কিত বর্ণনা


পরিচ্ছেদ – ৫/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি প্রেরিত সালাত-সালামের শ্রেষ্ঠত্ব


পরিচ্ছেদ – ৬/ তাঁর প্রতি সালাওয়াত যারা পাঠ করে না তাদের সমালোচনা এবং তাদের ভ্রান্ত কর্ম


পরিচ্ছেদ – ৭/ রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি প্রেরিত সালাওয়াত তাঁর কাছে প্রকাশিত হওয়ায় তাঁরই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য


পরিচ্ছেদ – ৮/ নবী করীম (ﷺ) ভিন্ন অন্যদের প্রতি এবং অন্যান্য নবী (عليه السلام)-বৃন্দের প্রতি প্রেরিত সালামের ব্যাপারে মতপার্থক্য


পরিচ্ছেদ – ৯/ মহানবী (ﷺ)-এর রওযা পাক যেয়ারত, যেয়ারতকারীদের উৎকর্ষ ও তাঁকে সম্ভাষণ জানানোর রীতি


পরিচ্ছেদ – ১০/ মসজিদে নববীতে প্রবেশের আদব ও তার উৎকর্ষ


তৃতীয় খণ্ড


নবী (ﷺ)-এর জন্যে যেসব বিষয় জরুরি এবং যেগুলোঅসম্ভব; যেসব বিষয় অনুমতিপ্রাপ্ত এবং যেগুলোনিষিদ্ধ; আর তাঁর প্রতি আরোপযোগ্য বৈধ মানবীয়বিষয়াদি


এটা এ বইয়ের গোপনীয় রহস্যময় অংশ এবং ফলের শাঁস-ও। এর আগে যা এসেছে তা এর ভিত্তি রচনা করেছে এবং আমরা যেসব সুস্পষ্ট বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করবো তার প্রামাণিক দলিল ওতে প্রদান করা হয়েছিল। এটার পরে যা কিছু আসছে তাকে এটা পরিচালনা করছে এবং এ বইয়ের লক্ষ্য অর্জন করছে। এর প্রতিশ্রুতির যখন পরীক্ষা নেয়া হবে এবং এর কর্তব্য পালনও পূর্ণ হবে, তখন অভিসম্পাতপ্রাপ্ত শত্রুর বক্ষ সংকুচিত হয়ে যাবে, আর ঈমানদারের অন্তর নিশ্চয়তার আলো দ্বারা আলোকিত হবে এবং তাঁর বক্ষ এর জ্যোতিতে পূর্ণ হবে। এমতাবস্থায় বুদ্ধিসম্পন্ন মানবকুল মহানবী (ﷺ)-কে যেভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, সেভাবে মূল্যায়ন করবেন।


প্রথম অধ্যায়: দ্বীনী বিষয়াদি ও ত্রুটিবিচ্যুতিহতে মহানবী (ﷺ)-এর রক্ষাপ্রাপ্ত হওয়ার প্রসঙ্গ


পরিচ্ছেদ – ১/ নবুওয়্যতের সূচনালগ্ন হতেই রাসূল (ﷺ)-এর অন্তরের বিশ্বাসসম্পর্কিত বিষয়


পরিচ্ছেদ – ২/ নবুওয়্যতের আগে ভুলভ্রান্তি থেকে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের হেফাযতপ্রাপ্তির বিষয়


পরিচ্ছেদ – ৩/ দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জ্ঞান


পরিচ্ছেদ – ৪/ শয়তান হতে রক্ষাপ্রাপ্তি


পরিচ্ছেদ – ৫/ সকল অবস্থায় নবী করীম (ﷺ)-এর সত্যবাদিতা


পরিচ্ছেদ – ৬/ নির্দিষ্ট কিছু সন্দেহের অপনোদন


পরিচ্ছেদ – ৭/ এ পৃথিবী সংক্রান্ত বর্ণনাবিষয়ক তাঁর আহওয়াল (হাল/অবস্থা)


পরিচ্ছেদ – ৮/ কতিপয় আপত্তির ফায়সালা


পরিচ্ছেদ – ৯/ মহা ভ্রান্তিপূর্ণ কর্ম হতে মহানবী (ﷺ)-এর রক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া


পরিচ্ছেদ – ১০/ পয়গম্বর হওয়ার আগে খোদাদ্রোহিতামূলক কর্ম হতে আম্বিয়া (عليه السلام)-এর রক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া


পরিচ্ছেদ – ১১/ কাজ-কর্মে বিস্মৃত হওয়া বা অসাবধানতাবশতঃ খেয়াল না করা প্রসঙ্গ


পরিচ্ছেদ – ১২/ মহানবী (ﷺ)-এর বে-খেয়াল হওয়া সংক্রান্ত হাদীসসমূহ


পরিচ্ছেদ – ১৩/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্যে ছোট-খাটো ভুল কাজ অনুমতিপ্রাপ্ত যারা বলে, তাদের খণ্ডন এবং তাদের যুক্তি যাচাই


পরিচ্ছেদ – ১৪/ (আল্লাহ-) ভীতি ও এস্তেগফারের পর্যায়ে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের আহওয়াল (অবস্থাসমূহ)


পরিচ্ছেদ – ১৫/ ভুল-ভ্রান্তি হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুরক্ষাপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি যাচাইকারী পরিচ্ছেদগুলোর উপকারিতা


পরিচ্ছেদ – ১৬/ ফেরেশতাদের হেফাযত প্রসঙ্গ


দ্বিতীয় অধ্যায়: এ জগতের প্রেক্ষিতে মহানবী (ﷺ)-এরঅবস্থাসমূহ এবং তাঁর যেসব অনত্যাবশ্যকীয় মানব–সুরতের বৈশিষ্ট্য হতে পারে


পরিচ্ছেদ – ১/ মানব-সুরত অবস্থার প্রেক্ষিতে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের অবস্থা


পরিচ্ছেদ – ২/ জাদু-টোনার প্রেক্ষিতে তাঁর অবস্থা


পরিচ্ছেদ – ৩/ দুনিয়াবী বিষয়াদির প্রেক্ষিতে মহানবী (ﷺ)-এর অবস্থাসমূহ


পরিচ্ছেদ – ৪/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিচার-বিবেচনা


পরিচ্ছেদ – ৫/ এই জগতের সাথে সম্পর্কিত নবী করীম (ﷺ)-এর বর্ণনাসমূহ


পরিচ্ছেদ – ৬/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অসিয়ত (উইল)-বিষয়ক হাদীস


পরিচ্ছেদ – ৭/ অন্যান্য হাদীসের অধ্যয়ন


পরিচ্ছেদ – ৮/ এ পৃথিবীতে মহানবী (ﷺ)-এর কর্মসমূহ


পরিচ্ছেদ – ৯/ পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের রোগ-ব্যাধি ও বিপদ-আপদের মধ্যে নিহিত (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা


চতুর্থ খণ্ড


মহানবী (ﷺ)-কে যারা ভুলত্রুটিপূর্ণ মনে করে কিম্বাঅভিসম্পাত দেয়, তাদের সম্পর্কে ফায়সালা


প্রথম অধ্যায়: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অভিসম্পাত দেয়ারঅথবা ইঙ্গিতে বা স্পষ্টভাবে ভুলত্রুটিপূর্ণ বলার ব্যাখ্যা


পরিচ্ছেদ – ১/ মহানবী (ﷺ)-কে অভিসম্পাত দান অথবা হেয় প্রতিপন্নকারী ব্যক্তি সম্পর্কে শরীয়তের সিদ্ধান্ত


পরিচ্ছেদ – ২/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি অভিসম্পাতদাতা বা তাঁর সমালোচনাকারীকে হত্যা করার প্রয়োজনীয়তা প্রতীয়মানকারী প্রামাণ্য দলিল


পরিচ্ছেদ – ৩/ মহানবী (ﷺ)-এর ক্ষতি সাধনকারী কিছু লোককে তাঁর ক্ষমা প্রদর্শন করার কারণসমুহ


পরিচ্ছেদ – ৪/ অনিচ্ছাকৃতভাবে বা কোনো প্রকৃত বিশ্বাস ছাড়াই মহানবী (ﷺ)-কে হেয়কারীর ব্যাপারে মীমাংসা


পরিচ্ছেদ – ৫/ এ ধরনের উক্তিকারী কি কাফের (অবিশ্বাসী), না মুরতাদ্দ (ধর্মত্যাগী)?


পরিচ্ছেদ – ৬/ যেসব কথা অভিসম্পাত বলে ধরা হবে, সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত


পরিচ্ছেদ – ৭/ পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের কোনো একটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করার দাবি যে ব্যক্তি করে, তার ব্যাপারে ফায়সালা


পরিচ্ছেদ – ৮/ যে ব্যক্তি ওই ধরনের কথা অন্য কারো কাছ থেকে উদ্ধৃত করে, তার ব্যাপারে মীমাংসা


পরিচ্ছেদ – ৯/ দিকনির্দেশনার খাতিরে মহানবী (ﷺ)-এর যেসব হাল (অবস্থা) উল্লেখ করা জায়েয


পরিচ্ছেদ – ১০/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-সম্পর্কিত রেওয়ায়াত (বর্ণনা)-সমূহ উদ্ধৃত করার সময় পালনীয় আদব


দ্বিতীয় অধ্যায়: যে ব্যক্তি মহানবী (ﷺ)-কে অভিসম্পাতদেয়, গালাগাল করে, হেয় প্রতিপন্ন করে বা তাঁর ক্ষতিকরে, তার বিরুদ্ধে রায় এবং তাকে যেভাবে শাস্তি দেয়াউচিত; তাকে তওবা করতে বলা এবং তার উত্তরাধিকারসংক্রান্ত


পরিচ্ছেদ – ১/ মহানবী (ﷺ)-কে অভিসম্পাতদাতা বা হেয় প্রতিপন্নকারীর ফায়সালা-বিষয়ক বক্তব্য ও মতামতসমূহ


পরিচ্ছেদ – ২/ তওবাকারী মুরতাদ্দ (ধর্মত্যাগী)-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত


পরিচ্ছেদ – ৩/ ধর্মত্যাগের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এমন মুরতাদ্দদের ব্যাপারে ফায়সালা


পরিচ্ছেদ – ৪/ এতদসংক্রান্ত বিষয়ে জিম্মিদের ব্যাপারে মীমাংসা


পরিচ্ছেদ – ৫/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি অভিসম্পাতদানের কারণে যে ব্যক্তিকে কতল করা হয়, তার উত্তরাধিকার, গোসল দান ও জানাযা আদায় সংক্রান্ত বিষয়


তৃতীয় অধ্যায়: আল্লাহতা’লা, তাঁর ফেরেশতাকুল, পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দ, আসমানী কেতাব সকল, মহানবী(ﷺ)-এর আহলে বায়ত (رضي الله عنه) ও আসহাব (رضي الله عنه)-মণ্ডলীর প্রতি অভিসম্পাতদাতার ব্যাপারে ফায়সালা


পরিচ্ছেদ – ১/ আল্লাহকে লা’নত দানকারীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং তাকে তওবা করতে বলার ব্যাপারে বিধান


পরিচ্ছেদ – ২/ এজতেহাদ ও ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্বারা আল্লাহর শান-মানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো কিছু তাঁর প্রতি আরোপ করার ব্যাপারে বিধান


পরিচ্ছেদ – ৩/ ভুল ব্যাখ্যাকারীকে কাফের বিবেচনা করার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই


পরিচ্ছেদ – ৪/ কোন্ বক্তব্য কুফরীর শামিল, কোনটি নিঃসন্দেহ নয় বা মতভেদপূর্ণ, এবং কোনটি কুফরী নয়, সেসব বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা


পরিচ্ছেদ – ৫/ আল্লাহর প্রতি অভিসম্পাতদাতা আজিম্মি (জিম্মি)-দের ব্যাপারে বিধান


পরিচ্ছেদ – ৬/ যে ব্যক্তি খোদায়ী দাবি করে বা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে, তার সম্পর্কে রায়


পরিচ্ছেদ – ৭/ মহাপ্রভুর শান-মানের প্রতি অনিচ্ছাকৃতভাবে হেয়কর কথাবার্তা উচ্চারণকারী ও আহাম্মকীপূর্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশকারী ব্যক্তির ব্যাপারে ফায়সালা


পরিচ্ছেদ – ৮/ আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দ ও ফেরেশ্তাকুলকে সার্বিকভাবে অভিসম্পাতদাতা ব্যক্তির ব্যাপারে রায়


পরিচ্ছেদ – ৯/ কুরআন মজীদের ভিত্তিতে রায়


পরিচ্ছেদ – ১০/ মহানবী (ﷺ)-এর আহলে বায়ত (رضي الله عنه), আযওয়াজে মোতাহহারাত (رضي الله عنه) ও আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه)-মণ্ডলীর প্রতি অভিসম্পাতদাতার ব্যাপারে ফায়সালা


অতঃপর এখানেই বইটির সমাপ্তি: এটা ঈমানদারির ভ্রূতে উজ্জ্বল জ্যোতি; ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের রাজমুকুটে অমূল্য এক মুক্তো; বিভ্রান্তির অপনোদক ও প্রতিটি ধারণার ব্যাখ্যাকারক; ঈমানদার-বৃন্দের অন্তরের নিরাময়। এটা জনসমক্ষে সত্য উদ্ঘাটন করে এবং অজ্ঞদেরকে তা দ্বারা মোকাবেলা করে।


আমি আল্লাহরই সাহায্য প্রার্থনা করি – নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য মা’বূদ নেই।


পরিশিষ্ট


আরবী শব্দের টীকাপুঞ্জ


গ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীস সংকলনের টীকাপুঞ্জ


গ্রন্থে উল্লেখিত ব্যক্তিদের টীকাপুঞ্জ


পরিচ্ছেদের বিষয়াদির সারাংশ


’শেফা’ গ্রন্থপ্রণেতার সংক্ষিপ্ত জীবনী


প্রথম খণ্ড


বাক্য ও কর্মে প্রকাশিত মহানবী (ﷺ) সম্পর্কেআল্লাহতা’লার সুউচ্চ মূল্যায়ন


পরিচিতি


আল্লাহতা’লা যে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেন এবং তাঁকে অসংখ্য মহৎ গুণ দ্বারা আশীর্বাদধন্য করেছেন, তা অনুধাবন করার ন্যূনতম চেষ্টাকারীও তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তাঁর মূল্যায়ন করা আমাদের জিহ্বা কিংবা কলম দ্বারা সম্ভব নয়।


আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে কী পর্যায়ে মূল্যায়ন করেন তা কুরআন মজীদে কিঞ্চিত প্রতিভাত হয়। এতে তাঁর চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রিয়নবী (ﷺ)-কে আঁকড়ে ধরতে এবং তাঁর আরোপিত বিধান অনুসরণ করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। একমাত্র আল্লাহতা’লাই রাসূলে আকরাম (ﷺ)-কে মহাসম্মানিত করেছেন ও পছন্দ করে নিয়েছেন এবং এ কারণে তাঁর প্রশংসা করে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ পুরস্কার দ্বারা পুরস্কৃত করেছেন। আল্লাহতা’লাই প্রারম্ভ ও প্রত্যাবর্তনের সময় দয়ালু দাতা এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য।


মহানবী (ﷺ) সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুউচ্চ মূল্যায়ন আরও দৃষ্টিগোচর হবে এই ক্ষেত্রে যে, আল্লাহ পাক তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকুলের চোখের সামনে পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও মহান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং তাঁর মাঝে সন্নিবেশিত করেছেন সুন্দরতম গুণাবলী, প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ, সু-মতামত ও অগণিত নৈতিক গুণাবলী। তিনি নূরনবী (ﷺ)-কে চোখ-ধাঁধানো মো’জেযা (অলৌকিকত্ব), সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সম্মানের প্রকাশ্য চিহ্নসমূহ দ্বারা সমর্থন যুগিয়েছেন। নবী করীম (ﷺ)-এর সমসাময়িক মানুষেরা ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه) এবং তাঁর পরবর্তী সময়ে আগত মানুষেরা এগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিলেন, যার দরুন এগুলোর বাস্তবতার জ্ঞান আমাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং এগুলোর জ্যোতি আমাদেরকে আলোকিত করেছে। আল্লাহর রহমত তাঁর প্রতি বর্ষিত হোক, আমীন!


হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) বলেন যে মে’রাজের রাতে বোরাক (নবী করীম যে বাহনে চড়ে মক্কা হতে জেরুজালেমে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সাত আসমানে খোদাতা’লার সান্নিধ্যে গমন করেন তাকে বোরাক বলে)-কে লাগাম দিয়ে আসন বসিয়ে নবী পাক (ﷺ)-এর কাছে আনা হয়। এতে বোরাক মহানবী (ﷺ)-এর কাছ থেকে লজ্জায় দূরে সরে যায়। এমতাবস্থায় হযরত জিবরীল আমীন (عليه السلام) তাকে বলেন, “তুমি রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সাথে এ কী আচরণ করছো? আল্লাহ কর্তৃক তাঁর চেয়ে বেশি সম্মানিত আর কেউই তোমার পিঠে সওয়ার হননি।” হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) আরও বর্ণনা করেন যে বোরাক এ কথায় ঘর্মাক্ত হয়ে যায়। [তিরমিযী শরীফ]


প্রথম অধ্যায়: রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে আল্লাহরপ্রশংসাস্তুতি ও সুউচ্চ মূল্যায়ন


এ অধ্যায়টিতে রাসূলে খোদা (ﷺ) সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসাসম্বলিত বেশ কিছু সুস্পষ্ট আয়াতে করীমা উপস্থাপন করা হয়েছে, যেগুলো তাঁর সুন্দর গুণাবলীর বর্ণনা দেয় ও আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চ মর্যাদার বিবরণও দেয়, আর তাঁর প্রশংসাও করে।


পরিচ্ছেদ – ১/ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসাস্তুতি ওতাঁর অসংখ্য মহৎ গুণাবলী


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় তোমাদের কাছেএসেছেন তোমাদেরই মধ্য হতে ওই রাসূল (ﷺ)”। [সূরা তওবা, ১২৮ আয়াত]


মহান রাব্বুল আলামীন জ্ঞাত করেছেন ঈমানদার মুসলমানদের, কিম্বা আরবীয়দের, অথবা মক্কাবাসীদের, বা সমগ্র মানবজাতিকে (আয়াতটির বিভিন্ন তাফসীর অনুযায়ী) এ মর্মে যে, তাঁদের কাছে একজন রাসূল (ﷺ) এসেছেন যাঁকে তাঁরা চেনেন-জানেন, যাঁর পদমর্যাদা সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত এবং যাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা তাঁরা স্বীকার না করে পারেন না। অতএব, যেহেতু তিনি তাঁদেরই মধ্য হতে আবির্ভূত, সেহেতু মিথ্যাচার অথবা সৎ উপদেশ না দেয়ার ব্যাপারে তাঁরা যেন তাঁকে সন্দেহ না করেন। রাসূল (ﷺ)-এর সাথে বংশীয়সূত্রে কিম্বা আত্মিয়তার বন্ধনে আবদ্ধ নয় এমন কোনো আরবীয় গোত্র-ই নেই। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও অন্যান্যদের মতানুযায়ী এটাই হলো ‘নিকটাত্মীয়তার ভালোবাসা’ শীর্ষক কুরঅানের আয়াত (৪২:২৩)-টির ভাবার্থ। তিনি তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হতে আগত। আয়াতে উল্লেখিত প্রশংসা হতে অধিক প্রশংসা কি আর হতে পারে?


অতঃপর আল্লাহতা’লা আয়াতে করীমায় তাঁর প্রতি সকল প্রকার প্রশংসনীয় গুণাবলী আরোপ করেছেন এবং মানুষজনকে ইসলামের দিকে হেদায়াত দানের প্রতি মহানবী (ﷺ)-এর আগ্রহ, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের ওপর পতিত ক্ষতি ও দুর্ভোগ সম্পর্কে তাঁর গভীর উদ্বেগ এবং মো’মেন মুসলমানদের প্রতি তাঁর দয়া ও করুণা সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।


জ্ঞান বিশারদদের অন্যতম হুসাইন ইবনে ফযল (رحمة الله) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে তাঁরই নিজের দুটো নাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন: ‘রাউফ’ তথা দয়ালু ও ‘রাহীম’, অর্থাৎ, করুণাশীল।” অপর একটি আয়াতে করীমায় একই কথা বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আল্লাহর মহানঅনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে, তাদের মধ্যেতাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল (ﷺ) প্রেরণকরেছেন” [সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত]। আরেকটি আয়াতে এরশাদ হয়েছে: “তিনি–ই হন (আল্লাহ) যিনিউম্মী লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল (ﷺ) প্রেরণ করেন” [সূরা জুমু’আহ, ২ নং আয়াত]। আল্লাহ পাক আরও এরশাদ ফরমান: “যেমন আমিতোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল (ﷺ)তোমাদেরই মধ্য থেকে” [সূরা বাকারা, ১৫১ আয়াত]।


বর্ণিত হয়েছে যে হযরত আলী (ক:) বলেছেন ‘তোমাদেরমধ্য থেকে’ – আল্লাহর এই কালামের অর্থ ‘খানদানের ক্ষেত্রে, বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং বংশীয় ক্ষেত্রে (তিনি তোমাদের মধ্য থেকে)। তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে হযরত আদম (عليه السلام)-এর সময় থেকে শুরু করে কেউই ব্যভিচারী ছিলেন না। তাঁদের সবাই যথাযথভাবে বিয়ে-শাদী করেছিলেন।’


ইবনে কালবী বলেন, “আমি মহানবী (ﷺ)-এর পাঁচ’শ জন মহিলা পূর্বপুরুষের নাম লিপিবদ্ধ করেছি। তাঁদের মধ্যে আমি কোনো ব্যভিচার খুঁজে পাইনি কিংবা জাহেলীয়্যা যুগে বিরাজমান কোনো মন্দ জিনিসও খুঁজে পাইনি।”


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে “যিনি (আল্লাহ) দেখেন নামাযীদের মধ্যে আপনার পরিদর্শনার্থেভ্রমণকেও” (আল-কুরঅান, সূরা শুয়ারা, ২১৯ আয়াত) – আল্লাহতা’লার এ কালামের অর্থ “পয়গম্বর হতে পয়গম্বর পর্যন্ত, যতোক্ষণ না আমি আপনাকে পয়গম্বর হিসেবে প্রেরণ করেছি।” (ইবনে সা’দ, বাযযার ও আবূ নুয়াইম)


হযরত জা’ফর সাদেক (رحمة الله) বলেন, “আল্লাহতা’লা জানতেন যে তাঁর সৃষ্টিকুল তাঁর বাধ্যতা পুরোপুরি অর্জন করতে পারবে না; তাই তিনি এ কথা বলেছেন যাতে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে তারা কখনোই তাঁর খেদমতে সম্পূর্ণ পবিত্রতা তথা শুচিতা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। তাঁর ও সৃষ্টিকুলের মাঝে তিনি তাদেরই একজনকে স্থাপন করেছেন এবং তাঁরই দয়া ও করুণার গুণাবলী দ্বারা তিনি তাঁকে বিভূষিত করেছেন। তিনি তাঁকে একজন সত্যবাদী প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টিকুলের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং এমন ব্যবস্থা জারি করেছেন যে তাঁকে কেউ মান্য করলে আল্লাহকেই মান্য করা হয় এবং তাঁর সাথে কেউ একমত হলে আল্লাহর সাথেই একমত হওয়ার শামিল হয়। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: ‘যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশমান্য করেছে, নিশ্চয় সে আল্লাহর নির্দেশই মান্যকরেছে’ [সূরা নিসা, ৮০ আয়াত]।”


আল্লাহ পাক বলেন, “এবং আমি আপনাকে প্রেরণকরিনি, বিশ্বগজতের জন্যে রহমত (করুণা) ব্যতিরেকে” [সূরা আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত]। আবূ বকর মোহাম্মদ ইবনে তাহের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহতা’লা রাসূলে করীম (ﷺ)-এর মাঝে করুণাপূর্ণ (ঐশী) অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, ফলে তাঁর সমগ্র সত্তা-ই ছিল করুণা এবং তাঁর সিফাত তথা গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যগুলো সকল সৃষ্টির প্রতি করুণাময় ছিল। তাঁর করুণার যে কোনো দিক দ্বারা কেউ যদি আশীর্বাদধন্য হয়, তবে উভয় জগতে ঘৃণিত প্রতিটি বস্তু হতে সে রক্ষা পায় এবং তার প্রিয় প্রতিটি বস্তু সে অর্জন করে। আপনি কি দেখেননি যে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেছেন: “এবং আমিআপনাকে প্রেরণ করিনি, বিশ্বগজতের জন্যে রহমত(করুণা) ব্যতিরেকে”? তাঁর যাহেরী জিন্দেগী ছিল করুণা, তাঁর বেসাল শরীফ (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তি)-ও করুণা; যেমনটি মহানবী (ﷺ) ঘোষণা করেন, “হায়াতী খায়রুল্লাকুম, ওয়া মামাতীখায়রুল্লাকুম”, অর্থাৎ, “আমার (যাহেরী) জিন্দেগী তোমাদের জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ, আমার বেসাল-প্রাপ্তিও তদনুরূপ” (আল-হারিস ইবনে আবি উসামা হতে সহীহ সনদে আল-বাযযার)। হুযূর পূর নূর (ﷺ) আরো এরশাদ ফরমান: “যখন আল্লাহতা’লা কোনো জাতির প্রতি করুণা বর্ষণ করতে চান, তখন তিনি তাদের প্রতি তাঁর মনোনীত পয়গম্বরকে তাদের সামনে নিয়ে যান এবং তাঁকে দিয়ে তাদের রাস্তা প্রস্তুত তথা পথনির্দেশনা দানের ব্যবস্থা করেন।” (মুসলিম শরীফ)


আস্ সামারকান্দী ব্যাখ্যা করেন যে “জগতসমূহের জন্যেরহমত” – খোদায়ী এ কালামে (’জগতসমূহ’ শব্দে) উদ্দেশ্য করা হয়েছে জ্বিন ও ইনসান উভয়কেই। আরো বলা হয়েছে যে এর দ্বারা সমগ্র সৃষ্টিকুলকেই বুঝিয়েছে। তিনি মো’মেন (বিশ্বাসী) মুসলমানদের কাছে রহমত (করুণা) হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শন দ্বারা, তিনি মোনাফেক (কপট) লোকদের কাছে রহমত নিহত হওয়ার আশঙ্কা হতে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে, আর কাফের (অবিশ্বাসী) লোকদের কাছে তিনি রহমত তাদের শাস্তি বিলম্বিত করার দরুন। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “তিনি মো’মেন ও কাফের উভয় সম্প্রদায়ের প্রতি রহমত, কেননা তারা উভয়ই মিথ্যাবাদী অন্যান্য (পূর্ববর্তী) সম্প্রদায়ের পরিণতি হতে রক্ষাপ্রাপ্ত।”


বর্ণিত আছে যে মহানবী (ﷺ) হযরত জিবরীল (عليه السلام)-কে বলেন, “এ রহমতের কোনো দিক কি আপনাকে ছুঁয়ে গিয়েছে?” তিনি উত্তর দেন, “হ্যাঁ।  ভবিষ্যতে আমার কী ফায়সালা হবে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু এখন আমি দুশ্চিন্তামুক্ত ও নিরাপদ অনুভব করছি; কেননা আল্লাহতা’লা আমার প্রশংসায় এরশাদ করেছেন, ‘যিনি(জিবরীল আমীন) শক্তিশালী; আরশ অধিপতিরদরবারে সম্মানিত; সেখানে তার আদেশ পালন করা হয়যিনি আমানতদার (আল্লাহর ওহীর)’ [সূরা তাকভীর, ২০-২১ আয়াত]।”


হযরত জা’ফর সাদেক (رحمة الله)-এর কথা বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন যে “হে প্রিয় রাসূল (ﷺ), আপনার প্রতি’সালাম’ হোক ডান পার্শ্বস্থদের কাছ থেকে” [আল-কুরআন, ৫৬:৯১] – খোদায়ী এ কালামের অর্থ ‘আপনারই জন্যে হে মোহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। তাঁদের এ শান্তির কারণ হলো রাসূলে পাক (ﷺ)-এর প্রতি অর্পিত মহাসম্মান।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ নূর (আলো) আসমানসমূহ ও জমিনের। তাঁর আলোর উপমা এমনইযেমন একটা দীপাধার, যার মধ্যে রয়েছে প্রদীপ। ওইপ্রদীপ একটা ফানুসের মধ্যে স্থাপিত। ওই ফানুস যেনএকটা নক্ষত্র, মুক্তোর মতো উজ্জ্বল হয় বরকতময় বৃক্ষযায়তুন দ্বারা; যা না প্রাচ্যের, না প্রতীচ্যের; এরনিকটবর্তী যে, সেটার তেল প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠবে – যদিও আগুন সেটাকে স্পর্শ না করে; আলোর ওপরআলো। আল্লাহ আপন আলোর প্রতি পথ/দিকনির্দেশনাদান করেন যাকে ইচ্ছা করেন; এবং মানুষের জন্যেআল্লাহ উপমাসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সবকিছুজানেন।” [সূরা নূর, ৩৫ আয়াত]


হযরত কা’আব আল-আহবার (رضي الله عنه) ও হযরত ইবনে জুবাইর (رضي الله عنه) বলেন, “দ্বিতীয় ‘নূর’ (আলো) শব্দটি দ্বারা আল্লাহ তাঁর হাবীব (ﷺ)-কে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর আলোর উপমা’ – অর্থাৎ, মহানবী (ﷺ)-এর নূর (আলো)।”


সাহল ইবনে আবদিল্লাহ আত্ তুসতুরী (رحمة الله) বলেন যে পৃথিবীর মানুষ ও আসমানের ফেরেশতাদের জন্যে আল্লাহ হলেন পথপ্রদর্শক; এ আয়াতে তা-ই বোঝানো হয়েছে। এরপর সাহল (رحمة الله) বলেন, “…রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নূরের মতো যখন তা স্থাপিত হয়েছিল কোষার মধ্যে – ‍ঠিক যেন একটি দীপাধারে। প্রদীপ দ্বারা আল্লাহতা’লা বোঝাচ্ছেন নবী করীম (ﷺ)-এর অন্তরকে। ফানুসটি তাঁরই বক্ষ। এটা যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র যা এর ধারণকৃত বিশ্বাস ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা সমৃদ্ধ এবং যা একটি বরকতময় তথা আশীর্বাদধন্য গাছ, অর্থাৎ, হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর আলো দ্বারা প্রজ্জ্বলিত। খোদাতা’লা বরকতময় গাছের সাথে তুলনা করেন এবং এরশাদ করেন, ‘সেটার তেল প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠবে’; অর্থাৎ, রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর নবুওয়্যত মানুষের কাছে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর কিছু বলার আগেই, যেমনিভাবে হয়েছে এ তেল।”


এ আয়াতটি সম্পর্কে আরও বহু ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তবে এর মর্মার্থ সম্পর্কে আল্লাহতা’লাই ভালো জানেন।


কুরআন মজীদের অন্যত্র আল্লাহ পাক হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে নূর (জ্যোতি) এবং প্রোজ্জ্বল তথা আলো বিচ্ছুরণকারী এক প্রদীপ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এরশাদ করেন: “নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকেএসেছেন এক নূর (রাসূলে খোদা) ও মহান কেতাব(আল–কুরআন)” [সূরা মা-ইদা, ১৫ আয়াত]। আল্লাহ আরো এরশাদ করেন: “হে অদৃশ্যের সংবাদ দানকারীনবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি উপস্থিতপর্যবেক্ষণকারী (হাযের–নাযের) করে, শুভসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর প্রতিতাঁরই নির্দেশে আহ্বানকারী ও প্রোজ্জ্বল প্রদীপহিসেবে” [সূরা আহযাব, ৪৫-৬ আয়াত]।


এ কারণেই আল্লাহ পাক বলেন: “আমি কি আপনার(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বক্ষপ্রশস্ত করিনি?” [আল-কুরআন, ৯৪:০১] আরবী ‘শারাহা’ শব্দটির অর্থ প্রশস্ত বা বিস্তৃত করা। ‘সদর’ বা ‘বক্ষ’ শব্দটি দ্বারা আল্লাহতা’লা অন্তর বা হৃদয়কে বুঝিয়েছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “তিনি একে প্রশস্ত করেছেন ইসলামের নূর দ্বারা।” সাহল্ আত্ তুসতরী (رحمة الله) বলেন, “ঐশী বাণীর আলো দ্বারা।” হযরত হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অন্তরকে জ্ঞান ও বিচার-বিবেচনা দ্বারা পরিপূর্ণ করেন।” এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ “আপনার অন্তরকে আমি কি পুতঃপবিত্র করিনি, যাতে তা শয়তানের ওয়াসওয়াসা তথা ধোকায় পড়ে না যায়?”


সূরাটিতে আরো বিবৃত হয়েছে: “এবং আমি আপনারওপর থেকে আপনার সেই বোঝা নামিয়ে দিয়েছি, যাআপনার পৃষ্ঠ ভেঙ্গেছিল” [সূরা এনশেরাহ, ২-৩ আয়াত]। এ কথা বলা হয়েছে যে এর মানে তাঁর নবুওয়্যত-পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ড; এ কথাও বলা হয়েছে এর দ্বারা জাহেলীয়্যা যুগের বোঝাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে এর মানে হলো ঐশী বাণীর বোঝা যা তিনি প্রচার করার আগে তাঁর পিঠকে নুয়ে দিচ্ছিল। এটা আল-মাওয়ার্দী ও আস্ সুলামীর অভিমত। এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ, “আমি আপনাকে রক্ষা করেছি, নইলে ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড আপনার পিঠে বোঝা হয়ে বসতো।” এ কথা আস্ সামারকান্দী বর্ণনা করেছেন। [আনুবাদকের নোট: ইমাম আহমদ রেযা খান সাহেব তাঁর ‘তাফসীরে কানযুল ঈমান’ গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, “এ বোঝা দ্বারা হয়তো ওই দুঃখ বোঝানো হয়েছে যা কাফেররা ঈমান না আনার কারণে তাঁর পবিত্র অন্তরে বিরাজ করতো। কিংবা উম্মতদের পাপসমূহের চিন্তাও হতে পারে যা নিয়ে তাঁর কলব্ (অন্তর) মোবারক সর্বদা ব্যস্ত থাকতো। এর অর্থ এই যে, ‘আমি আপনাকে মকবূল তথা গ্রহণীয় সুপারিশকারীর মর্যাদা দান করে সেই দুঃখের বোঝা দূর করে দিয়েছি।” (কানযুল ঈমান, বাংলা সংস্করণ, ১০৮৬ পৃষ্ঠা]


আল্লাহ পাক সূরা এনশেরাহ’তে আরো এরশাদ ফরমান: “এবং আমি আপনার জন্যে আপনার যিকর (স্মরণ)-কে সমুন্নত করেছি” [৪র্থ আয়াত]। ইয়াহইয়া ইবনে আদম বলেন এর অর্থ নবুওয়্যত দান। আরও বলা হয়েছে যে এর মানে নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়াআর কোনো উপাস্য নেই, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়া সাল্লাম তাঁরই প্রেরিত পয়গম্বর) – এ বাক্যটিতেযখন আমাকে (আল্লাহকে) স্মরণ করা হয়, হে রাসূল(ﷺ), তখন আপনাকেও তাতে স্মরণ করা হয়।” আরো বলা হয়েছে যে আযানেও একই রকম করা হয়।


এসব কথায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি বর্ষিত আল্লাহতা’লার মহা নেয়ামত (আশীর্বাদ), মহাপ্রভুর পাশে তাঁর মহান মর্যাদা ও আল্লাহর দৃষ্টিতে তাঁর মহাসম্মান সম্পর্কে আল্লাহ স্বয়ং সমর্থনসূচক ভাষ্য প্রদান করেছেন। খোদাতা’লা তাঁর পবিত্র বক্ষকে বিশ্বাস ও হেদায়াতের দিকে প্রশস্ত করেছেন এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার বানিয়েছেন। ’জাহেলীয়্যা’ যুগের সকল বিষয়ের বোঝা তাঁর কাছ থেকে তিনি অপসারণ করেছেন এবং অন্যান্য দ্বীনের ওপর তাঁর দ্বীনকে বিজয় দান করে মহানবী (ﷺ)-এর কাছে জাহেলীয়্যা যুগের বিষয়গুলো ঘৃণিত করে দিয়েছেন। খোদাতা’লা নবুওয়্যত ও ঐশী বাণীর গুরুদায়িত্বকে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর জন্যে লাঘব করে দিয়েছেন, যাতে তিনি মানুষের কাছে তা-ই পৌঁছে দিতে সক্ষম হন যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনি প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সুমহান মর্যাদা, সুউচ্চ মকাম সম্পর্কে নিজ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং তাঁর নামের সাথে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর নাম মোবারককে সংযুক্ত করেছেন।


হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর হাবীব (ﷺ)-এর খ্যাতিকে এ দুনিয়ায় এবং পরবর্তী জগতে সমুন্নত করেছেন। এমন কোনো বক্তা, সাক্ষী কিংবা নামাযী নেই, যে না-কি এ বাক্য বলতে ব্যর্থ হয় – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”


হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে রাসূলে খোদা (ﷺ) এরশাদ করেছেন: জিবরীল (عليه السلام) আমার কাছে এসে বল্লেন, আমার ও আপনার প্রভু আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান – ‘আপনি কি জানেন, আমি আপনার(প্রিয়নবীর) খ্যাতি কতোখানি সমুন্নত করেছি?’ আমি (জিবরীল) বল্লাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-ই ভালো জানেন। আল্লাহ বল্লেন, ‘যখন আমাকে স্মরণ করা হয়, তখন আমার সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হয়।’ [ইবনে হিব্বানের ’সহীহ’ ও আবূ এয়ালার ‘মুসনাদ’ গ্রন্থগুলোতে উদ্ধৃত]


ইবনে আতা’ একটি হাদীসে কুদসী উদ্ধৃত করেন যা’তে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “আমি আপনার স্মরণকেআমার স্মরণের সাথে যুক্ত করে ঈমান (বিশ্বাস)-কেপূর্ণতা দিয়েছি।” অপর এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক বলেন, “আপনার স্মরণকে আমি আমারই স্মরণেরঅংশ করেছি, যার দরুন যে কেউ আমাকে স্মরণ করলেআপনাকেও স্মরণ করে।”


হযরত ইমাম জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ সাদেক (رحمة الله) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে (খোদাতা’লা) প্রভু হিসেবে স্মরণ করে, সে আপনাকে (রাসূলকে) পয়গম্বর হিসেবে স্মরণ না করে পারে না।”


আল-মাওয়ার্দীর মতো কিছু জ্ঞানী পণ্ডিত অভিমত ব্যক্ত করেন যে এর দ্বারা শাফায়াত তথা সুপারিশের মহান মর্যাদা বোঝানো হয়েছে।


আল্লাহতা’লার যিকরের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্মরণ সরাসরি যুক্ত হওয়ার বিষয়টি পরিস্ফুট করে যে আল্লাহতা’লার আনুগত্যের সাথে রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর আনুগত্য ও তাঁর নামের সাথে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:“হুকুম মান্য করো আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর” [সূরা আলে ইমরান, ৩২ আয়াত]। অন্যত্র তিনি এরশাদ ফরমান: “হে ঈমানদারবর্গ! ঈমান রাখো আল্লাহও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি” [সূরা নিসা, ১৩৬ আয়াত]। আল্লাহতা’লা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে তাঁর সাথে সংযুক্ত করেছেন আরবী ‘ওয়া’ (ও/এবং) শব্দটি দ্বারা, যেটা অংশীদারের অর্থ জ্ঞাপক। নবী করীম (ﷺ) ভিন্ন অন্য কারো ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে ‘ওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করার অনুমতি নেই।


হুযায়ফা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের কেউই এরকম বলো না – যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন এবং (ওয়া) অমুক ইচ্ছা করেন। বরং (এ কথা) বলো – যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন। অতঃপর থেমে বলো – অমুক যা ইচ্ছা করেন।” (আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে আবি শায়বা)


আল-খাত্তাবী বলেন, “মহানবী (ﷺ) সবার ইচ্ছার ওপরে খোদাতা’লার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার শিক্ষা আপনাদের দিয়েছেন। তিনি ‘সুম্মা’ শব্দটিকে পছন্দ করেছেন যার অর্থ ‘অতঃপর’, আর অংশীদারিত্ব জ্ঞাপক ‘ওয়া’ (এবং) শব্দটি বর্জন করেছেন। অপর একটি হাদীস শরীফে অনুরূপ কথা বলা হয়েছে। কেউ একজন (সাবেত ইবনে কায়েস্ বলে কথিত) রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর দরবারে বলেন, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে যে ব্যক্তি মান্য করেন, তিনি সঠিক পথপ্রাপ্ত; আর যে ব্যক্তি তাঁদের  (‘হুমা’ তথা দ্বিবচন ব্যবহার করে বলেছিলেন) সাথে বিদ্রোহ করে….।” মহানবী (ﷺ) তাঁকে বলেন, “তুমি কতোই না বাজে বক্তা! ওঠে দাঁড়াও!” (কিম্বা তিনি বলেছিলেন: “বেরিয়ে যাও!”) [আবূ দাউদ, নাসাঈ ও মুসলিম বর্ণিত হাদীস]


আবূ সুলাইমান বলেন, “রাসূলে করীম (ﷺ) দুটো নামকে ওভাবে সংযুক্ত দেখতে পছন্দ করেননি, কেননা এতে অংশীদারিত্ব বোঝায়।” অপর এক জ্ঞানী পণ্ডিত মনে করেন যে “তাঁদের সাথে বিদ্রোহ করে” বলে থামাকেই মহানবী (ﷺ) অপছন্দ করেছিলেন। তবে আবূ সুলাইমানের কথাই নির্ভরযোগ্য, কারণ হাদীসটির আরেকটি নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যামূলক বর্ণনায় বিবৃত হয় যে বক্তা (সাবেত ইবনে কায়েস বলে কথিত) “আর যে ব্যক্তি তাঁদের সাথে বিদ্রোহ করে, সে ভুল করে” – এ বাক্যটিতে “তাঁদের সাথে বিদ্রোহ করে” – বাক্যাংশটি বলার পর না থেমেই বাকি অংশ বলেছিলেন।


”নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরুদ পড়েন ওইঅদৃশ্য সংবাদ জ্ঞাপনকারী (নবী)-এর প্রতি” (সূরা আহযাব, ৫৬ আয়াত) – খোদায়ী এ কালামের মধ্যে ‘ইউসাল্লুনা’ (বহুবচনে দরুদ পাঠ) শব্দটি খোদাতা’লা এবং ফেরেশতাদের উভয়ের প্রতি আরোপিত কি না, তা নিয়ে তাফসীরবিদ ও শব্দার্থ বিশারদদের বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের কেউ কেউ উভয়ের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহৃত হওয়াকে অনুমতি দেন, আর অন্যান্যরা অংশীদারিত্বের ধারণায় তা নিষেধ করেন। তাঁরা সর্বনামটিকে ফেরেশতাদের প্রতি এককভাবে নির্দেশ করেন এবং আয়াতটিকে এভাবে বোঝেন – “আল্লাহতা’লা দরুদ পড়েন এবং তাঁর ফেরেশতাকুল-ও।”


বর্ণিত আছে যে হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) রাসূলে খোদা (ﷺ)-কে বলেছিলেন, “আল্লাহর সাথে আপনার মাহাত্ম্যের অংশবিশেষ হলো এই যে, তিনি আপনার প্রতি আনুগত্যকে তাঁরই প্রতি আনুগত্য বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: ‘যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ মান্যকরেছে, নিঃসন্দেহে সে আল্লাহর নির্দেশ–ই মান্যকরেছে’ [সূরা নিসা, ৮০ আয়াত] এবং ‘হে রাসূল (ﷺ), আপনি বলে দিন: ওহে মানবকুল, যদি তোমরাআল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তবে আমার অনুগত হও; আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন’।” [সূরা আলে ইমরান, ৩১ আয়াত] বর্ণিত আছে যে যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, তখন মানুষেরা বলাবলি করতে শুরু করে, “মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চান খৃষ্টানরা যেভাবে ঈসা (عليه السلام)-কে গ্রহণ করেছিল, ঠিক সেভাবে আমরাও যেন তাঁকে করুণা (রহমত) হিসেবে গ্রহণ করি।” এমতাবস্থায় আল্লাহ আয়াত নাযেল করেন: “হে রাসূল, বলুন: হুকুম মান্য করো আল্লাহ ও রাসূলের (সূরা আলে ইমরান, ৩২ আয়াত) [নোট: এ বর্ণনা ইবনে জাওযীর]। মানুষেরা যা বলাবলি করেছিল, তা সত্ত্বেও আল্লাহতা’লা তাঁর নিজের আনুগত্যের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্যকে যুক্ত করেছেন।


সূরা ফাতেহার “আমাদেরকে সহজ, সরল পথেপরিচালিত করুন; তাঁদেরই পথে যাঁদের প্রতি আপনি(খোদাতা’লা) অনুগ্রহ করেছেন” – খোদায়ী এ কালামের অর্থ সম্পর্কে তাফসীরবিদবৃন্দ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। আবূল আলীয়্যা (رحمة الله) এবং হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, “সহজ, সরল পথ (সিরাতাল মোস্তাকীম) হলেন মহানবী (ﷺ), তাঁর আহলে বায়ত (ঘরের মানুষজন তথা আত্মীয়স্বজন) এবং তাঁরই আসহাবে কেরাম (সম্মানিত সাথীবৃন্দ)।” আবূল আলীয়্যা ও হাসান বসরী থেকে আল-মাওয়ার্দী বর্ণনা করেন, “সহজ, সরল পথ হলেন রাসূলে পাক (ﷺ), তাঁর ঘরের শ্রেষ্ঠজনেরা এবং তাঁরই সাথীবৃন্দ।” অনুরূপ বর্ণনা করেন মক্কী: “এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর দু’জন সাহাবী হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) এবং হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-কে ইঙ্গিত করে।”


”তাঁদেরই পথে, যাঁদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন”– খোদায়ী এ কালামটি সম্পর্কে আবুল আলীয়্যা হতে আবূল লায়েস্ সামারকান্দী প্রায় অনুরূপ আরেকটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। হযরত হাসান বসরী (رحمة الله) এটা শোনার পর বলেন, “আল্লাহর নামে শপথ! এ কথা সত্য এবং এটা সৎ উপদেশ।” “তাঁদেরই পথে যাঁদের প্রতি অনুগ্রহকরেছেন” – এ আয়াতটির তাফসীরে আবদুর রাহমান ইবনে যায়দ হতে আল-মাওয়ার্দী এটা বর্ণনা করেন।


আবূ আব্দির রাহমান আস্ সুলামী বর্ণনা করেন যে জনৈক তাফসীরবিদ “সে এমন এক মজবুত গ্রন্থি ধারণকরেছে” (সূরা বাকারা, ২৫৬ আয়াত) – খোদায়ী এ কালামের মধ্যে ‘মজবুত গ্রন্থি’ – বাক্যটিকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ দ্বীন ইসলাম। আরো বলা হয়েছে যে এতে তাওহীদের সাক্ষ্য (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই) বিদ্যমান।


সাহল্ আত্ তুসতরী বলেন যে “যদি আল্লাহরঅনুগ্রহসমূহ গণনা করো, তবে সংখ্যা নির্ণয় করতেপারবে না” (আল-কুরআন, ১৪:৩৪) – আল্লাহতা’লার এ বাণীর উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর অনুগ্রহ।


আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “এবং তিনি–ই, যিনি এসত্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন এবং ওই সব মানুষ, যাঁরাতাঁকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাঁরাইআল্লাহভীতিসম্পন্ন।” (সূরা যুমার, ৩৩ আয়াত)। অধিকাংশ তাফসীরবিদ বলেন, “তিনি-ই একে সত্যায়ন করেছেন।” কখনো কখনো এ শব্দটিকে ‘সাদাকা’ (সত্য ভাষণ) পড়া হয়; আবার কখনো কখনো ‘সাদ্দাকা’ (সত্যায়ন) পাঠ করা হয়, যার দরুন মো’মেন (বিশ্বাসী)-দের উদ্দেশ্য করা হয়। এ কথা বলা হয়েছে যে এতে হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)-কে বোঝানো হয়েছে। আরো অনেক কথা এ বিষয়ে বলা হয়েছে।


মোজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন, “আল্লাহর স্মরণেই অন্তরেরপ্রশান্তি নিহিত” (সূরা রা’দ, ২৮ আয়াত) – খোদায়ী এ কালামের উদ্দেশ্য হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তার আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه)।


পরিচ্ছেদ – ২/ মহানবী (ﷺ)-কে শাহেদ (সাক্ষী) হিসেবে আল্লাহর দেয়া বর্ণনা এবং এর সাথে সম্পৃক্তপ্রশংসা ও মর্যাদা


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “হে অদৃশ্যের সংবাদদানকারী (নবী)! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছিশাহেদ তথা উপস্থিত পর্যবেক্ষণকারী (হাযের–নাযের) করে, শুভ সংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীস্বরূপ” [সূরা আহযাব, ৪৫ আয়াত]। এ আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা তাঁর হাবীব (ﷺ)-কে শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ সকল পদমর্যাদা ও প্রশংসনীয় প্রতিটি গুণ দ্বারা বিভূষিত করেছেন। তিনি তাঁকে উম্মতের জন্যে একজন সাক্ষী বানিয়েছেন এ বাস্তবতার আলোকে যে তিনি তাদের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁকে মান্যকারী মানুষের জন্যে তিনি হলেন শুভ সংবাদ দানকারী, আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী লোকদের জন্যে তিনি হলেন সতর্ককারী। তিনি আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁরই এবাদত-বন্দেগীর প্রতি আহ্বানকারী এবং তিনি হলেন একটি প্রোজ্জ্বল প্রদীপ, যা দ্বারা মানুষজন সত্যের দিকনির্দেশনা পায়।


আতা ইবনে ইয়াসার বলেন, “আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস্-এর সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: আমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে বিবরণ দিন। তিনি জবাব দিলেন: নিশ্চয়ই! শপথ আল্লাহর নামে, কুরআন মজীদে বর্ণিত হুযূর পূর ‍নূর (ﷺ)-এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য তৌরাতেও পাওয়া যায়। তৌরাত ঘোষণা করে: ‘হে নবী (ﷺ)! আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, শুভ সংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী এবং নিরক্ষরদের জন্যে আশ্রয় হিসেবে। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনাকে মানুষের আস্থার পাত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছি। আপনি এমনই একজন যিনি অমার্জিত কিংবা অশিষ্ট নন, যিনি বাজার এলাকায় হৈচৈ করেন না এবং যিনি মন্দের প্রতিদানে মন্দ কিছু করেন না, বরং ক্ষমা করেন। আল্লাহ তাঁকে ততোক্ষণ নিজের কাছে ফেরত নেবেন না, যতোক্ষণ না বদমায়েশ সমাজ তাঁর দ্বারা সিধা হয় এবং ঘোষণা করে – ”আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বূদ নেই।” নবী (ﷺ)-এর মাধ্যমেই অন্ধ চক্ষু, বধির কান ও কলুষিত অন্তর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠবে’।” আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও কা’আব আল-আহবার হতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা এসেছে।


ইবনে এসহাক থেকে একটি বর্ণনায় এরশাদ হয়: “যিনি বাজার এলাকায় হৈচৈ করেন না এবং অশালীন ভাষা প্রয়োগ কিম্বা গালিগালাজ করেন না। আমি তাঁকে সমস্ত মহৎ গুণাবলী ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত করেছি। আমি শান্তিকে তাঁর ভূষণ, উৎসর্গিত হওয়াকে তাঁর নীতি, খোদাভীরুতাকে তাঁর বিবেক, জ্ঞানকে তাঁর উপলব্ধি, সত্যবাদিতা ও আনুগত্যকে তাঁর স্বভাব, ক্ষমা ও সঠিক আচরণকে তাঁর চরিত্র, ন্যায়বিচারকে তাঁর আচরণ, সত্যকে তাঁর শরীয়ত, হেদায়াতকে তাঁর দিক-নির্দেশক, ইসলামকে তাঁর ধর্ম এবং আহমদকে তাঁর নাম হিসেবে পছন্দ করে সৃষ্টি করেছি। আমি পথভ্রষ্টতার পরে তাঁর হেদায়াতকে এবং অজ্ঞতার পরে তাঁর জ্ঞানকে প্রকাশ করবো। বিস্মৃতির পরে আমি তাঁকে বুলন্দ্ তথা সমুন্নত করবো। অস্বীকৃতির পরে আমি তাঁর নাম মোবারককে সর্বত্র জ্ঞাত করবো। অভাবের পরে আমি তাঁকে অধিক (পরিমাণে) দান করবো। গরিবীর পরে আমি তাঁকে সমৃদ্ধ করবো। বিচ্ছেদের পরে আমি তাঁকে মিলিত করবো। তাঁর মাধ্যমেই আমি বিচ্ছিন্ন অন্তরগুলো ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রেরণাকে এবং বিচ্ছিন্ন সমাজগুলোকে একত্রিত করবো। আমি তাঁর সমাজ (উম্মত)-কে মানবের কল্যাণকারী সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ হিসেবে আবির্ভূত করবো।”


আরেকটি হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তৌরাতে তাঁর সম্পর্কে যা যা বর্ণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে বিবৃত করেন: “আমার বান্দা আহমদ, পছন্দকৃত জন যিনি মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করবেন; তিনি মদীনা নগরীতে হিজরত করবেন, কেননা তিনি তৈয়্যবাত (কলেমা) পড়েছিলেন; তাঁর উম্মত হবেন তাঁরাই, যাঁরা সকল অবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করবেন।” [কা’আব হতে আদ্ দারিমী বর্ণিত; ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে তাবরানী ও আবূ নুয়াইম বর্ণিত]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “ওই সব মানুষ, যারাগোলামী করবে এ পড়াবিহীন অদৃশ্যের সংবাদ দানকারীরাসূলের, যাঁকে লিপিবদ্ধ পাবে নিজেদের নিকটতাওরীত ও ইনজীলের মধ্যে; তিনি তাদেরকে সৎকর্মেরনির্দেশ দেবেন এবং অসৎ কাজে বাধা দেবেন, আরপবিত্র বস্তুগুলো তাদের জন্যে হালাল করবেন এবংঅপবিত্র বস্তুসমূহ তাদের প্রতি হারাম করবেন; আরতাদের ওপর থেকে ওই কঠিন কষ্টের বোঝা ও গলারশৃঙ্খল যা তাদের ওপর ছিল, নামিয়ে অপসারিতকরবেন। সুতরাং ওইসব মানুষ যারা তাঁর প্রতি ঈমানআনে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং ওইনূরের অনুসরণ করে, যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তারাই সফলকাম হয়েছে।” [সূরা আ’রাফ, ১৫৭ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]


আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “আল্লাহর তরফ থেকে এএক দয়া ছিল যে আপনি, হে হাবীব (ﷺ), তাদের জন্যেকোমল–হৃদয় হয়েছেন। আর যদি আপনি রূঢ় ওকঠোর চিত্ত হতেন, তবে তারা নিশ্চয় আপনার আশপাশথেকে পেরেশান হয়ে যেতো। সুতরাং আপনি তাদেরকেক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্যে সুপারিশ করুন। আর(বিভিন্ন) কার্যাদিতে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। এবংযখন কোনো কাজের ইচ্ছা পাকাপোক্ত করবেন, তখনআল্লাহর ওপর নির্ভর করুন। নিঃসন্দেহে (এরকম) নির্ভরকারীরা আল্লাহর প্রিয়ভাজন।” [সূরা আলে ইমরান, ১৫৯ আয়াত; ইমাম আহমদ রেযা খান কৃত ‘কানযুল ঈমান’ বাংলা সংস্করণ]


আস্ সামারকান্দী বলেন, “আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ) মো’মেন মুসলমানদের প্রতি ক্ষমাশীল, করুণাশীল ও কোমল। তিনি যদি ভাষণে কঠোর ও রূঢ় হতেন, তাহলে তারা তাঁকে ছেড়ে যেতো। তবে আল্লাহ তাঁকে বিশাল অন্তরের অধিকারী, দয়ালু, নম্র, হাসি-খুশি ও সহজ-সরল বানিয়েছেন।” আদ্ দাহহাক-ও অনুরূপ এক বর্ণনা দিয়েছেন।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং কথা হলো এরকমই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠকরেছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্যে সাক্ষী হও।আর এ রাসূল (ﷺ) তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন” [সূরা বাকারা, ১৪৩ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। আবূল হাসান আল-কাবিসী বলেন, “এ আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা আমাদের মহানবী (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব পরিস্ফুট করেছেন।”


আরেকটি আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:“যাতে রাসূল (ﷺ) তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন এবংতোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও” [সূরাহ্জ্জ্ব, ৭৮ আয়াত; কানযুল ঈমান]। তিনি আরোএরশাদ ফরমান: “তবে কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেকউম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো, এবং হেহাবীব, আপনাকে তাদের সবার জন্যে সাক্ষী ওপর্যবেক্ষণকারী হিসেবে উপস্থিত করবো?” [সূরা নিসা, ৪১ আয়াত]


আল্লাহতা’লা যখন একটি ‘মধ্যমপন্থী সমাজ’ সম্পর্কে বলেন, তখন তিনি বোঝান ভারসাম্যপূর্ণ ও ভালো। আয়াতটির অর্থ হলো, আমি (আল্লাহ) যেমন তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছি, তেমনি আমি তোমাদের পছন্দ করে নিয়েছি এ মর্মে যে তোমাদেরকে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বানিয়ে দিয়েছি এবং পয়গম্বরবৃন্দের পক্ষ হয়ে তাঁদের উম্মতদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে তোমাদেরকে অনুমতিও দিয়েছি। আর মহানবী (ﷺ)-ও সততার সাথে তোমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।


এ কথা বলা হয়েছে, যখন আল্লাহতা’লা পয়গম্বরবৃন্দকে জিজ্ঞেস করবেন – “আপনারা কি (ঐশী বাণী) পৌঁছেদিয়েছেন?” তখন তাঁরা উত্তর দেবেন – “হ্যাঁ, আমরাপৌঁছে দিয়েছি।” অতঃপর তাঁদের উম্মতবর্গ বলবে, “আমাদের কাছে কোনো সুসংবাদ দানকারী (নবী) ওসতর্ককারী আসেননি” [সূরা মায়েদা, ১৯ আয়াত]। এমতাবস্থায় উম্মতে মোহাম্মদী (পূর্ববর্তী) পয়গম্বরবৃন্দের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন এবং রাসূলে খোদা (ﷺ) তাঁর উম্মতের পক্ষে সাক্ষী হবেন (আল-বোখারী ও অন্যান্যদের বর্ণিত)। এ কথাও বলা হয়েছে যে এই আয়াতে করীমার অর্থ হচ্ছে: (শেষ বিচারে) তোমরা (উম্মতে মোহাম্মদী) তোমাদের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে এক (জোরালো) যুক্তি এবং মহানবী (ﷺ) হলেন তোমাদের পক্ষে এক (জোরালো) যুক্তি।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “ঈমানদার (মুসলমান)-দের সুসংবাদ দিন যে তাদের জন্যে তাদেরপ্রতিপালকের কাছে সত্যের মর্যাদা রয়েছে” [সূরা ইউনুস, ২ আয়াত]। সর্ব-হযরত কাতাদা (رضي الله عنه), হাসান বসরী (رحمة الله) এবং যায়দ ইবনে আসলাম বলেন, “এই ‘সত্যের মর্যাদা’ হলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যিনি তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন।” হাসান আল-বসরী (رحمة الله) আরো বলেন, “এটা তাদের প্রতি তাদেরই মহানবী (ﷺ)-এর মঞ্জুর হওয়াকে বোঝায়।” আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, “এটা হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফায়াত। আল্লাহতা’লার দরবারে তিনি-ই হলেন তাদের পক্ষে নিশ্চিত সুপারিশকারী।” সাহল্ আত্ তুসতরী (رحمة الله) বলেন, “এটা আল্লাহতা’লা কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাঝে স্থাপিত পুর্বনির্ধারিত রহমত (করুণা)।”


মোহাম্মদ ইবনে আলী আত্ তিরমিযী (رحمة الله) বলেন, “তিনি-ই হলেন সত্যবাদীদের ও সত্যের ইমাম, গৃহীত সুপারিশকারী, সাড়াপ্রাপ্ত (খোদার) আহ্বানকারী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।” এটা বর্ণনা করেছেন আস্ সুলামী।


পরিচ্ছেদ – ৩/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহতা’লারদয়া ও নম্র মনোভাব


এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে খোদায়ী কালাম – “আল্লাহআপনাকে ক্ষমা করুন; আপনি তাদেরকে কেন অনুমতিদিলেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনার কাছে স্পষ্ট হয়নিসত্যবাদীরা এবং প্রকাশ পায়নি মিথ্যেবাদীরাও” [সূরা তওবা, ৪৩ আয়াত]। আওন ইবনে আবদিল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-কে তাঁর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু বলার আগেই তাঁকে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন।”


আস্ সামারকান্দী বর্ণনা করেন এ মর্মে যে জনৈক আলেম এর অর্থ করেছেন, “হে হৃদ-স্পন্দনের ধ্বনি, আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন। তাহলে আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন?” যদি প্রথমেই এ কথা বলা হতো – “আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন?” – তাহলে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর চিত্ত ভয়ে দুরু দুরু করতো। কিন্তু আল্লাহ পাক প্রথমেই ক্ষমা করার কথা বলে তাঁর অন্তরকে শান্ত রেখেছেন এবং তারপর জিজ্ঞেস করেছেন – “আপনার কাছে কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যেবাদী তা স্পষ্ট হবার আগে কেন আপনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন?”


এতে আল্লাহর সাথে মহানবী (ﷺ)-এর উচ্চ মকাম পরিস্ফুট হয়, যা ন্যূনতম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছেও গোপন থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (দ;)-কে পাক পরওয়াদেগারে আলম কী পরিমাণ সম্মান করেন এবং তাঁর প্রতি কী রকম দয়াবান তা এতে পরিস্ফুট হয়, যা সম্পূর্ণ জ্ঞাত হলে অন্তর বিগলিত হতো (সবার)।


নিফতাওয়াইহ্ বলেন, “কিছু লোক মনে করে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে এ আয়াতে তিরস্কার করা হয়েছে। বিষয়টি তা থেকে যোজন যোজন দূরে! বস্তুতঃ তাঁকে এর দরুন পছন্দ করা হয়েছে। যখন তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন, তখন আল্লাহ জ্ঞাত করলেন যে তিনি (রাসূল) যদি তাদেরকে অনুমতি না দিতেন, তাহলে তারা এমনিতেই তাদের মোনাফেকীর মধ্যে বসে থাকতো; অতএব, তাঁর অনুমতি দেয়ার প্রতি কোনো আপত্তি উত্থাপন-ই  করা যায় না।”


যে মুসলমান-ব্যক্তি নিজের নফসের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন এবং নিজ আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রে শরীয়তকে আঁকড়ে ধরেছেন, তিনি তাঁর কথাবার্তায়, কাজ-কর্মে, উদ্দেশ্য সাধনে ও আলাপচারিতায় কুরআন মজীদের আদব-কায়দা (শিষ্টাচার)-কে ধারণ করতে বাধ্য। এটাই দ্বীন ও দুনিয়ায় প্রকৃত জ্ঞান ও সঠিক আচরণের মূলভিত্তি। সকল মনিবের মহাপ্রভু, যিনি সবাইকে আশীর্বাদ দেন, যাঁর কিছুরই প্রয়োজন নেই, তাঁর কাছে চাওয়া-পাওয়ার বেলায় এই অনন্য সাধারণ নম্রতা ও দয়াকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। আয়াতে ধারণকৃত ফায়দাগুলোকে অন্তরে গ্রহণ করে নিতে হবে এ বাস্তবতার আলোকে যে, আল্লাহতা’লা জিজ্ঞেস করার আগে সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং ক্ষমা করতে আনন্দ অনুভব করেছেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, যদিও এর মধ্যে ত্রুটিজনিত জবাবদিহিতার কিছু আছে কি না সন্দেহ।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “যদি আমি আপনাকেঅবিচলিত না রাখতাম, তবে এ কথা নিশ্চিত ছিল যেআপনি তাদের প্রতি সামান্য কিছু ঝুঁকে পড়তেন” [সূরা বনী ইসরাঈল, ৭৪ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। জনৈক মোতাকাল্লেমূন (কালাম-শাস্ত্র) পণ্ডিত বলেন, “অন্যান্য নবী (عليه السلام)-বৃন্দের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আল্লাহতা’লা (গঠনমূলক) দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ)-এর কোনো কর্মের আগেই (গঠনমূলক) দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যাতে তা ভালোবাসার কার্যকর ও সর্বোত্তম নিদর্শন হয়। এতে তাঁর ভালাইয়ের প্রতি খোদাতা’লার সর্বান্তকরণের আভাস পাওয়া যায়।


লক্ষ্য করুন কীভাবে আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-এর অবিচলিত ভাব সম্পর্কে উল্লেখ করে তারপর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে সজাগ যে মহানবী (ﷺ) হয়তো এ বক্তব্যে ভীত হতে পারেন। তাই তাঁর এ বক্তব্যে তিনি মহানবী (ﷺ)-এর নিষ্কলুষ মর্যাদা বজায় রেখেছেন। এ বক্তব্য কোনোক্রমেই তাঁর (খোদাপ্রদত্ত) মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে না।


একই কথা প্রযোজ্য আরেকটি আয়াতে করীমার ক্ষেত্রে, যা’তে আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “আমি জানি, আপনাকে (রাসূলকে) কষ্ট দিচ্ছে ওই কথা যা তারাবলছে। অতঃপর তারা তো আপনাকে অস্বীকার করছেনা; বরং যালেমরাই আল্লাহর আয়াতগুলোর অস্বীকারকরছে।” [সূরা আনআম, ৩৩ আয়াত]


হযরত আলী (ক:) বর্ণনা করেন যে আবূ জাহেল হযরত রাসূলে করীম (ﷺ)-কে বলেছিল, “আমরা তোমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দেই না। আমরা বলি, তুমি যা নিয়ে এসেছো, তা একটা ডাহা মিথ্যে।” এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতে করীমাটি আল্লাহতা’লা নাযেল করেন।


এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (ﷺ) অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন যখন তাঁর জাতি (মক্কার কুফফার) তাঁর প্রতি মিথ্যের অপবাদ দিয়েছিল। এমতাবস্থায় জিবরীল (عليه السلام) তাঁর কাছে এসে বলেন, “আপনি কেন এতো পেরেশান?” তিনি জবাব দেন, “আমার জাতি আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দিয়েছে।” জিবরীল (عليه السلام) বলেন, “তারা ভালো করেই জানে আপনি সত্য কথা বলেছেন।” অতঃপর আল্লাহ এ আয়াতখানা নাযেল করেন।


হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে নরম সুরে সান্ত্বনা দেয়া এবং তাঁর সাথে স্নেহভরে কথা বলাই হচ্ছে আয়াতটির লক্ষ্য, যা তাঁর জাতির মাঝে বিবেচিত তাঁরই সত্যবাদী ব্যক্তিত্বকে ও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের অস্বীকার না করার কথাকে সমর্থন দেয়। তারা স্বীকার করে যে তিনি কথা ও বিশ্বাসে সত্যবাদী। তিনি নবী হওয়ার আগে তারা তাঁকে ‘আল-আমিন’ (বিশ্বাসভাজন) বলে ডাকতো। তাঁকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলে ডাকাতে তাঁর অনুভূত দুঃখকষ্ট (আয়াতোক্ত) এই সমর্থন দ্বারা দূর হয়েছিল।


অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর জাতিকে সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তারা অস্বীকারকারী ও মন্দ-কর্ম সংঘটনকারী। তিনি এরশাদ ফরমান: “বরংযালেমরাই আল্লাহর আয়াত (নিদর্শন)-গুলো অস্বীকারকরছে।”


আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর ওপর থেকে সমস্ত অসম্মানের মিথ্যে অপবাদ অপসারণ করেছেন এবং এর পরে তাঁর নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করার দোষে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর জাতিকে একগুঁয়ে বলে চিহ্নিত করেছেন। অস্বীকৃতি সে ব্যক্তির কাছ থেকেই আসতে পারে, যে কিছুটুকু জানে এবং তারপর অস্বীকার করে। যেমন আল্লাহ বলেন: “এবং সেগুলোকে অস্বীকার করলো, অথচতাদের অন্তরগুলোতে সেগুলোর (সত্যতার) নিশ্চিতবিশ্বাস ছিল, যুলুম ও অহঙ্কারবশতঃ (তারা তা অস্বীকারকরলো)” [সূরা নামল, ১৪ আয়াত]


অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (ﷺ)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং তাঁকে খুশি করেছেন তাঁর পূর্ববর্তীদের কথা বলে, আর তিনি আপন সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছেন এ কথা ঘোষণা করে – “এবং আপনার আগেও বহুরাসূলকে অস্বীকার করা হয়েছে। তখন তাঁরা ধৈর্য ধারণকরেছিলেন এ অস্বীকার ও দুঃখকষ্টের ব্যাপারে, যেপর্যন্ত না তাঁদের কাছে আমার সাহায্য এসেছে” [সূরা আনআম, ৩৪ আয়াত; প্রাগুক্ত কানযুল ঈমান]


রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহর দয়া ও মহানবী (ﷺ)-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি এই যে, আল্লাহতা’লা সকল পয়গম্বরকে তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন; যেমন – ‘হে আদম’ [২:২৩], ‘হে নূহ’ [১১:৪৮], ’হে ইবরাহীম’[৩৭:১০৪-৫], ‘হে মূসা’ [২০:১৪], ‘হে দাউদ’ [৩৮:২৬], ‘হে ঈসা’ [৩:৫৫], ‘হে যাকারিয়্যা’ [১৯:৭], ‘হেইয়াহইয়া’ [১৯:১২]। কিন্তু তিনি মহানবী (দ;)-কে সম্বোধন করেছেন – ‘হে রাসূল’ [৫:৬৭], ‘হে নবী’[৩৩:৪৫], ‘হে বস্ত্রাবৃত’ [৭৩:০১], ‘হে চাদর আবৃত’[৭৪:০১]।


পরিচ্ছেদ – ৪/ তাঁর মহান সত্তার নামে আল্লাহর কৃতকসম–সম্পর্কিত


আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “হে মাহবুব! আপনারপ্রাণের শপথ, নিশ্চয় তারা আপন নেশায়উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করছে” [সূরা হিজর, ৭২ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। তাফসীরবিদ উলামাবৃন্দ ঐকমত্য পোষণ করেন যে আল্লাহতা’লা এতে মহানবী (ﷺ)-এর (যাহেরী) জীবনের ওপর শপথ করেছেন। এর অর্থ, ‘হে রাসূল (ﷺ), আপনার (জীবনের) ধারাবাহিকতার শপথ!’ এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ, ‘আপনার জীবনের শপথ।’ আরো বলা হয়েছে, ‘আপনার বেঁচে থাকার শপথ।’ এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান ও সর্বাধিক মর্যাদার ইঙ্গিতবহ।


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়তম রাসূল (ﷺ)-রে চেয়ে অধিক মর্যাদাবান আর কোনো রূহ (আত্মা)-কে সৃষ্টি করেননি। আল্লাহকে অন্য কারো প্রাণের নামে শপথ করতে আমি শুনিনি।” আবূল জাওযা’ বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর নবী (ﷺ) ব্যতিরেকে আর কারো প্রাণের নামে শপথ করেননি, কেননা তাঁর দৃষ্টিতে রাসূলে করীম (ﷺ) হলেন সৃষ্টির সেরা।”


আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “এয়া–সীন। হেকমত(ঐশী প্রজ্ঞা)-ময় কুরআনের শপথ” [সূরা ইয়াসীন, ১-২ আয়াত]। তাফসীরকারবৃন্দ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে ‘ইয়া-সীন’-এর অর্থ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আবূ মোহাম্মদ মক্কী বর্ণনা করেন যে হুযূর পূর নূর (ﷺ) বলেছেন: “আমার প্রভু (খোদাতা’লা)-এর কাছে আমার দশটি নাম রয়েছে।” তিনি ‘তোয়াহা’ ও ‘ইয়া-সীন’ নাম দুটোকে ওই দশটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেন। আবূ আবদির রহমান আস্ সুলামী উদ্ধৃত করেন হযরত জা’ফর সাদেক (رحمة الله)-এর কথা, যিনি বলেন যে ‘ইয়া-সীন’-এর অর্থ হচ্ছে ‘হে সাইয়্যেদ’ (সরদার), যা দ্বারা মহানবী (ﷺ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে ‘ইয়া-সীন’ মানে ‘ওহে ইনসান (-এ-কামেল)’; অর্থাৎ, হে রাসূলে খোদা (ﷺ)। তিনি আরো বলেন যে এটা একটা শপথ এবং আল্লাহরই একটা নাম। আয্ যাজ্জাজ বলেন যে এর অর্থ, ‘হে মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ, ‘হে ইনসান (-এ-কামেল)’।


ইবনুল হানাফিয়্যা বলেছেন যে ‘ইয়া-সীন’ অর্থ, ‘হে রাসূল (ﷺ)!’ কা’আব বলেন যে ’ইয়া-সীন’ হচ্ছে একটি শপথ যা দ্বারা আল্লাহতা’লা আসমান-জমিন সৃষ্টির আগে শপথ করেছিলেন এই বলে – “হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), আপনি আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মাঝে অন্যতম!”


অতঃপর আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “হেকমতময় কুরআনের শপথ, নিশ্চয় আপনি প্রেরিত (রাসূল)” [আল-কুরআন, ৩৬:০২]। যদি ‘ইয়া-সীন’ মহানবী (ﷺ)-এর একটি নাম মোবারক হিসেবে সমর্থিত হয় এবং এটা একটা বহাল শপথ বলেও সমর্থিত হয়, তবে এতে সম্পৃক্ত রয়েছে মহাসম্মান এবং প্রথম শপথটিকে আরো মজবুত করা হয়েছে দ্বিতীয় শপথটির সাথে সেটিকে যুক্ত করে। যদিও এটা সম্বোধনসূচক বিষয়, তবুও আল্লাহতা’লা এরপর আরেকটি শপথ দ্বারা মহানবী (ﷺ)-এর নবুওয়্যতের সত্যতাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁর হেদায়াতের সত্যায়নও করেছেন। আল্লাহ পাক তাঁর মহানবী (ﷺ) ও তাঁর মহান কেতাবের নামে শপথ করেছেন এই মর্মে যে হুযূর পূর নূর (ﷺ) তাঁরই অন্যতম নবী, যিনি ঐশী বাণী বহন করে এনেছেন তাঁরই বান্দাদের কাছে এবং নিজ বিশ্বাসে নবী করীম (ﷺ) সঠিক পথের ওপর আছেন; অর্থাৎ, সত্য থেকে বিচ্যুত কিংবা বক্র নয় এমন পথের ওপর তিনি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত।


আন্ নাক্কাশ বলেন, “আল্লাহতা’লা নিজ ঐশীগ্রন্থে কোনো নবী (عليه السلام)-এর নামে শপথ করেননি এ মর্মে যে তাঁরা পয়গম্বর ছিলেন; কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন মহানবী (ﷺ)।”


যে আলেমবৃন্দ এর অর্থ ‘হে সাইয়্যেদ’ বলে উল্লেখ করেন, ‘ইয়া-সীন’ শব্দের ব্যবহার দ্বারা তাতে বিশ্বনবী (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহর সুউচ্চ শ্রদ্ধাবোধ পরিস্ফুট হয়। সত্য বটে, মহানবী (ﷺ) স্বয়ং এরশাদ করেন: “আমি হলাম আদম–সন্তানদের সাইয়্যেদ (সরদার), আর এটা কোনোঅহঙ্কার নয়” [হযরত আবূ হোরায়রা হতে মুসলিম ও তিরমিযী]।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আমায় এ শহরের শপথ, যেহেতু হে মাহবুব, আপনি এ শহরে তাশরীফরেখেছেন” [সূরা বালাদ, ১-২ আয়াত]। মক্কী বলেন যে এর সঠিক পঠন হলো, “আমি কসম (শপথ) করি না এর ওপর, যখন আপনি আর এতে থাকবেন না আপনার প্রস্থানের পরে” [আরবী ‘মা’ শব্দটি পাঠ করে ক্রিয়াপদটি না-বাচক করা হয়েছে এবং একে সহজ ‘না’ করা হয়নি]। এ কথাও বলা হয়েছে যে ‘না’ শব্দটি অতিরিক্ত, অর্থাৎ, ‘আমি এ শহরের নামে শপথ করছি, কেননা হে রাসূল (ﷺ), আপনি তাতে অবস্থান (হালাল) করছেন, কিংবা আপনি যা করেন তা-ই বৈধ (হিল্)। এ অভিমতটি দুটো তাফসীরের। সেগুলো বলে যে ‘বালাদ’ তথা ‘দেশ’ (ভূমি) শব্দটি মক্কা মোয়াযযমাকে বুঝিয়েছে।


আল-ওয়াসিতী বলেন, “আল্লাহ বোঝাচ্ছেন: আমি এ দেশের নামে আপনার কাছে শপথ করছি, যে দেশকে আমি সম্মানিত করেছি এ ঘটনা দ্বারা যে আপনি তাতে বসবাস করেছেন এবং আপনার বেসালের পরে তা আপনারই রওযা মোবারকের আশীর্বাদ দ্বারা ধন্য হবে [অর্থাৎ, মদীনা মোনাওয়ারার বরকতপ্রাপ্ত হবে]।”


প্রথম ব্যাখ্যাটি বেশি নির্ভরযোগ্য। কেননা সূরাটি একটি মক্কী সূরা। পরবর্তী পর্যায়ে যা বলা হয়েছে, তা একে সমর্থন দিয়েছে যখন আল্লাহ এরশাদ করেছেন: “এখানে তাশরীফ রেখেছেন’ বা ‘অবস্থান করেছেন’। “ওই নিরাপদ শহরের(দ্বারা)” [সূরা ত্বীন, ০৩ আয়াত] – এই আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইবনে আতা’ তাঁর তাফসীরে অনুরূপ কিছু বলেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহতা’লা শহরটিকে নিরাপদ করে দিয়েছিলেন, কেননা রাসূলে আকরাম (ﷺ) সেখানে তাশরীফ রেখেছিলেন। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁর অস্তিত্ব-ই নিরাপত্তা বিধান করে।”


এরপর আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “এবং আপনার পিতা (পূর্বপুরুষ) ইবরাহীম (عليه السلام)-এর শপথ ও তাঁর বংশধরের তথা আপনার শপথ” [সূরা বালাদ, ০৩ আয়াত]। কেউ কেউ বলেন যে এখানে আদম (عليه السلام)-কে বোঝানো হয়েছে এবং তাই এটা একটা সার্বিক মন্তব্য। আর কেউ কেউ বলেন যে এতে ইবরাহীম (عليه السلام)-কে বোঝানো হয়েছে এবং তাঁর বংশধর, অর্থাৎ, হযরত রাসূলে করীম (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যার দরুন সূরাটি দু’বার মহানবী (ﷺ)-এর নামে শপথ করেছে।


আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “আলিফ–লাম–মীম।সেই মহান কেতাব যা’তে কোনো সন্দেহের অবকাশনেই” [সূরা বাকারা, ২ নং আয়াত]। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে প্রথমোক্ত শব্দগুলো দ্বারা আল্লাহ শপথ করেছেন। তিনি এবং অন্যান্য বুযূর্গানে দ্বীন এ শব্দগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলেছেন।


সাহল্ আত্ তুসতরী বলেন, “আলিফ হলেন আল্লাহ, লাম হলেন জিবরীল (عليه السلام) এবং মীম হলেন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। আস্ সামারকান্দীও এ কথা বলেছেন, কিন্তু তা সাহলের প্রতি আরোপ করেননি। তিনি বলেন যে এতে বোঝায়, আল্লাহতা’লা জিবরীল আমীন (عليه السلام)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এ কেতাব নাযেল করেছেন যার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম বাক্যটি অনুযায়ী শপথের গুরুত্ব হলো এই যে, এ কেতাবটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য এবং এতে জড়িত রয়েছে দুটো নামের সম্পর্ক, যে বিষয়টির শ্রেষ্ঠত্ব ইতিপূর্বে বিবৃত হয়েছে।


ইবনে আতা’ বলেন যে “কা–ফ, সম্মানিত কুরআনেরশপথ” [সূরা কা-ফ, ১-২ আয়াত] – এ আয়াতে আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর অন্তরের শক্তি (কুওয়া) দ্বারা শপথ করেছেন; কেননা তাঁর মোবারক অন্তরই আল্লাহর ভাষণ ও সাক্ষ্য বহন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর উচ্চমর্যাদার কারণে তা তাঁকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। একথাও বলা হয়েছে যে কা-ফ হলো কুরআনের নামগুলোর মধ্যে একটি নাম। এ-ও বলা হয়েছে যে এটা আল্লাহরই একটা নাম। আরো বলা হয়েছে যে এটা একটা পাহাড়।


জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ বলেন যে “ওই প্রিয় উজ্জ্বলনক্ষত্রের (মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের) শপথ, যিনি (মে’রাজ থেকে) অবতরণকরেন” [সূরা নজম, আয়াত নং ০১] – এ আয়াতটি রাসূলে খোদা (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করে। তিনি বলেন, “নক্ষত্রটি হলো রাসূলুল্লাহ (দ;)-এর অন্তর মোবারক। যখন তা অবতরণ করে, তখন তা নূর দ্বারা বিস্তৃত হয়।” তিনি আরো বলেন, “নবী (ﷺ) আল্লাহ ভিন্ন অন্য সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হন।”


ইবনে আতা’ বলেন যে “ভোরের শপথ এবং দশটিরাতেরও” [আল-কুরআন ৮:১] – খোদায়ী এ কালামের মধ্যে ভোর হচ্ছেন হযরত মোহাম্মদ সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁকে নিজের পাশে জায়গা দেয়ারব্যাপারে আল্লাহর কৃত শপথ


আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “চাশত্ (সূর্যোদয়ের পরেরসময়)-এর শপথ; এবং রাতেরও, যখন (তা) পর্দাবৃতকরে; আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগকরেননি এবং অপছন্দও করেননি। এবং নিশ্চয় পরবর্তীজীবন আপনার জন্যে পূর্ববর্তী জীবনের চেয়ে ভালো।এবং নিশ্চয় অচিরে আপনার প্রতিপালক আপনাকে এপরিমাণ দেবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। তিনি কিআপনাকে এতিম পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন।এবং আপনাকে তাঁরই প্রেমে আত্মহারা পেয়েছেন এবংতাঁর দিকে পথ দেখিয়েছেন। এবং আপনাকে অভাবগ্রস্তপেয়েছেন, অতঃপর ধনী করে দিয়েছেন। সুতরাংএতিমের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন না; এবং ভিক্ষুককেধমকাবেন না। এবং আপনার প্রতিপালকের নেয়ামত(আশীর্বাদ)-এর ঘোষণা দিতে থাকুন” [সূরা দোহা, ১-১১ আয়াত, তাফসীরে কানযুল ঈমান]। এ সূরাটির অবতীর্ণ হওয়ার কারণ নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে এটা এমনই এক সময় নাযেল হয় যখন মহানবী (ﷺ) কোনো একটা বিষয় নিয়ে পীড়িত হওয়ার দরুন রাত জেগে এবাদত করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং একজন নির্দিষ্ট স্ত্রীলোক এ ব্যাপারে নানান কথা বলছিল [জুনদুব হতে বর্ণনা করেন ইমাম মুসলিম ও আল-বোখারী। আল-হাকীম নিশাপুরী বলেন যে স্ত্রীলোকটি আবূ লাহাবের পত্নী ছিল]। এ কথাও বলা হয়েছে যে আয়াত নাযেলে কিছুদিন বিরতির কারণে মক্কার মূর্তি পূজারীরা সমালোচনা করার ফলে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় [মুসলিম ও তিরমিযী শরীফে এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে]।


সে যা-ই হোক না কেন, এই বিষয়টি সুস্পষ্ট যে আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-কে কী রকম মর্যাদা দেন, তাঁর প্রশংসা করেন এবং তাঁকে মহাসম্মান করেন, এ সূরাটি তারই একটি নির্ভর-পত্র এবং ছয়টি পন্থায় এটা তা পরিস্ফুট করে।


প্রথমতঃ তাঁর অবস্থা ইঙ্গিত করার জন্যে কোনো কিছুর নামে শপথ করতে আল্লাহ বলেন, “চাশতের শপথ; এবং রাতেরও, যখন তা পর্দাবৃত করে”, অর্থাৎ, পূর্বাহ্নের (সূর্যোদয়ের পরের সময়) মালিকের শপথ। এটা তাঁকে সম্মানিত করার সর্বোচ্চ পর্যায়।


দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর সাথে তাঁর উচ্চ মকাম (মর্যাদা) ও তাঁর প্রতি বর্ষিত নেয়ামত পরিস্ফুট করতে আল্লাহ বলেন, “আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং অপছন্দও করেননি।” অর্থাৎ, তিনি আপনাকে ছেড়ে চলে যাননি এবং আপনাকে ঘৃণাও করেননি। এ কথা বলা হয়েছে যে এর মানে ‘আপনাকে পছন্দ করে নেয়ার পর তিনি আপনার প্রতি অবহেলা করেন না এবং আপনাকে ঘৃণাও করেন না।’


তৃতীয়তঃ “নিশ্চয় পরবর্তী জীবন আপনার জন্যে পূর্ববর্তী জীবনের চেয়ে ভালো” – খোদায়ী এ কালামের ব্যবহার সম্পর্কে ইবনে এসহাক বলেন, “এর অর্থ হলো আপনার বেসাল (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্তি এ জগতে আপনাকে তাঁর (খোদার) দেয়া সম্মান হতে অনেক উত্তম।” সাহল্ আত্ তুসতরী বলেন যে এর মানে হলো এ জগতে মহানবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত আল্লাহতা’লার আশীর্বাদ অপেক্ষা তাঁর জন্যে (পরকালে) মওজুদ ‘শাফায়াতে কুবরা’ (সুপারিশের সর্বময় ক্ষমতা) ও ‘মাকামে মাহমূদ’ (সর্বোচ্চ মর্যাদা) অনেক বেশি ভালো।


চতুর্থতঃ আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আপনার প্রতিপালক আপনাকে এ পরিমাণ দেবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হবেন” (সূরা দোহা)। এই আয়াতে সম্মানের সাথে (ইহ ও পরকাল) উভয় জগতের সুখ-শান্তির সমন্বয় ঘটেছে। ইবনে এসহাক বলেন, “খোদাতা’লা রাসূলে করীম (ﷺ)-কে এ জগতে স্বস্তি দ্বারা এবং পরবর্তী জগতে পুরস্কার দ্বারা সন্তুষ্ট করবেন।” এ কথা বলা হয়েছে যে তাঁকে খোদাতা’লা হাউযে কাউসার ও শাফায়াত দান করবেন। বর্ণিত আছে যে মহানবী (ﷺ)-এর পরিবারভুক্ত জনৈক আত্মীয় বলেন, “আল-কুরআনে এর চেয়ে আশাব্যঞ্জক আর কোনো আয়াতে করীমা নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সন্তুষ্ট হবেন না, যদি তাঁর উম্মতের কেউ জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করে” (আবূ নুয়াইম বর্ণিত ‘মওকুফ’ ও আদ্ দায়লামী কৃত ‘মুসনাদ আল-ফেরদৌস’ গ্রন্থে বর্ণিত ‘মরফু’ পর্যায়ের রেওয়ায়াত)।


পঞ্চমতঃ সূরাটির বাকি অংশে আল্লাহতা’লা তাঁকে যে নেয়ামত তথা আশীর্বাদ দান করেছেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হেদায়াত তথা তাঁর দ্বারা মানুষকে সত্য-সঠিক পথপ্রদর্শন; তাফসীরের ওপর নির্ভর করে (প্রতিভাত হয়) মহানবী (ﷺ)-এর কোনো সম্পত্তি ছিল না, আল্লাহ তাঁকে সমৃদ্ধ করেছেন, কিংবা তাঁর অন্তরকে সন্তুষ্টি ও সমৃদ্ধি দ্বারা ধন্য করেছেন; তিনি এতিম ছিলেন এবং তাঁর চাচা তাঁকে দেখাশোনা করেছেন ও যত্ন নিয়েছেন এবং তাঁর কাছে মহানবী (ﷺ) আশ্রয় পেয়েছেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে তিনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় পেয়েছেন এবং তাঁর এতিম হওয়ার অর্থ হলো এই যে, তাঁর মতো আর কেউই নেই, তাই তাঁকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে এ সকল আয়াতের অর্থ, “আমি কি আপনাকে পছন্দ করে নেই নি এবং পথহারাদেরকে আপনার দ্বারা হেদায়াত দেই নি, গরিবদেরকে আপনার দ্বারা সমৃদ্ধ করি নি, এবং এতিমদেরকে আপনার দ্বারা আশ্রয় দেই নি?” আল্লাহতা’লা তাঁকে এ সকল নেয়ামত সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এটা ভলোভাবে জ্ঞাত যে মহানবী (ﷺ) যখন অল্প বয়স্ক ও এতিম ছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে অবহেলা করেননি। তিনি তাঁকে পরিত্যাগ করেননি, ঘৃণাও করেননি। এমতাবস্থায় নবুওয়্যত (প্রকাশ্যভাবে) দান করার পরে আল্লাহ কীভাবে তাঁকে অবহেলা বা ঘৃণা করতে পারেন?


ষষ্ঠতঃ মহানবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত আল্লাহর নেয়ামত-প্রাপ্তিতে শোকর-গুজার (কৃতজ্ঞ) হওয়া এবং তা প্রকাশ করার জন্যে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “আপনার প্রতিপালকের নেয়ামত তথা আশীর্বাদের ঘোষণা দিতে থাকুন” [সূরা দোহা]। এটা করতে তাঁকে খাস তথা নির্দিষ্টভাবে এবং তাঁর উম্মতকে সার্বিকভাবে আদেশ করা হয়েছে।


আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “ওই প্রিয় উজ্জ্বল নক্ষত্রমোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এরশপথ, যখন তিনি মে’রাজ থেকে অবতরণ করেন; তোমাদের সাহিব (হুযূর পাক) না পথভ্রষ্ট হয়েছেন, নাবিপথে চলেছেন। এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তিথেকে বলেন না, কেবল ওহী ব্যতিরেকে, যা তাঁর প্রতিনাযেল করা হয়েছে। তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন প্রবলশক্তিসমূহের অধিকারী, শক্তিমান। অতঃপর ওই জ্যোতিইচ্ছা করলেন; আর তিনি উচ্চাকাশের সর্বোচ্চ দিগন্তেছিলেন। অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হলো; আর খুব(কাছে) নেমে এলো। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এইমাহবুবের মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইলো; বরংতদপেক্ষাও কম দূরত্ব রইলো। এমতাবস্থায় ঐশীপ্রত্যাদেশ দিলেন আপন বান্দা (হাবীব সাল্লাল্লাহুআলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি যা ওহী দেয়ার ছিল।তাঁর অন্তর মিথ্যে বলেনি যা দেখেছে। তবে কি তোমরাতাঁর সাথে তিনি যা দেখেছেন তা নিয়ে বিতর্ক করছো? এবং তিনি তো ওই জ্যোতি দু’বার দেখেছেন; সিদরাতুলমোনতাহার কাছে। সেটার কাছে রয়েছে ‘জান্নাতুলমাওয়া’। যখন সিদরার ওপর আচ্ছন্ন করছিল যাআচ্ছন্ন করার ছিল; চক্ষু না কোনো দিকে ফিরেছে, নাসীমাতিক্রম করেছে। নিশ্চয় আপন প্রতিপালকের বহুবড় নিদর্শন তিনি দেখেছেন।” [সূরা নাজম, ১-১৮ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]


তাফসীরবিদ উলামাবৃন্দ আয়াতোক্ত ‘নক্ষত্র’ শব্দটি নিয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। কেউ কেউ বলেন, শব্দটির স্বাভাবিক উপলব্ধি অনুযায়ী এটা একটা নক্ষত্র। কেউ কেউ বলেন, এটা আল-কুরআন। জা’ফর ইবনে মোহাম্মদ বলেন যে এতে মহানবী (দ;)-কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে এবং এটা তাঁরই অন্তর মোবারক। বুযূর্গানে দ্বীন একইভাবে বলেন, “শপথ আসমানের এবং রাতে আগমনকারীর; এবংআপনি কি কিছু জেনেছেন, সে–ই রাতে আগমনকারীকী? (তা হচ্ছে) অত্যন্ত উজ্জ্বল তারকা” [সূরা তারিক, ১-৩ আয়াত] – এ আয়াতে করীমায় উল্লেখিত নক্ষত্র হলেন হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।


এসব আয়াতে করীমা মহানবী (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ব্যাপকভাবে পরিস্ফুট করে। মহানবী (ﷺ)-এর হেদায়াত (পথপ্রদর্শন), তাঁর খামখেয়ালিশূন্যতা ও তাঁরই তেলাওয়াতকৃত বিষয়ের প্রতি তাঁর সত্যবাদিতা সম্পর্কে আল্লাহতা’লা শপথ দ্বারা সমর্থন যুগিয়েছেন। এটা এমনই এক ঐশী বাণী যা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে হযরত জিবরীল (عليه السلام)-এর মাধ্যমে, যিনি শক্তিশালী। অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁর (রাসূলের) শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সমর্থন করেছেন তাঁরই মে’রাজ রাতের ভ্রমণের ঘটনা বর্ণনা করে, যা’তে তিনি সিদরাতুল মোনতাহায় পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি দ্বারা দর্শন করেছিলেন এমনই এক বিষয় যা ছিল তাঁর প্রভুর সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে এ ঘটনা সম্পর্কে সূরা বনী ইসরাঈলের প্রারম্ভে আরো বিশদ জানিয়েছেন।


আল্লাহতা’লা তাঁর অদৃশ্য জগত (জাবারূত) সম্পর্কে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কাছে যা প্রকাশ করেছেন এবং ফেরেশতাদের জগত (মালাকুত)-এর অত্যাশ্চর্য যা তিনি দেখেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং তা মানব মস্তিষ্কের পক্ষে যৎসামান্য উপলব্ধি করাও অসম্ভব। আল্লাহ এটা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন, যার দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি তাঁর সুউচ্চ শ্রদ্ধাবোধ প্রতিভাত হয়। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “ঐশী প্রত্যাদেশ দিলেনআপন হাবীবের (ﷺ) প্রতি, যা ওহী দেয়ার ছিল” [আল-কুরআন, ৫৩:১০]। অলঙ্কারবিদ্যা ও তর্কশাস্ত্রের (মানতেক) উলামাদের মতানুযায়ী এ ধরনের সম্বোধনকে সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ ইঙ্গিত বলা হয়। তাঁদের ভাষ্যানুযায়ী এটা হলো সবচেয়ে প্রাঞ্জল প্রকাশভঙ্গি।


আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আপন প্রতিপালকের বহু বড়নিদর্শন তিনি দেখেছেন” [আল-কুরআন, ৫৩:১৮]। যা প্রকাশিত হয়েছিল তা বিস্তারিত অনুধাবন করতে সাধারণ মস্তিষ্ক ব্যর্থ এবং সেই বড় নিদর্শনটি যে কী ছিল, তা বোঝার চেষ্টা করলে তাতে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হতে হবে।


এই আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা রাত্রি-ভ্রমণের (মে’রাজের) সময় মহানবী (ﷺ)-এর পরিপূর্ণ নির্মলতার এবং ক্ষতি থেকে তাঁর হেফাযতের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর অন্তর, জিহ্বা ও চোখ মোবারকের পবিত্রতাকে সমর্থন দিয়েছেন এ কথাগুলো বলে: “(তাঁর) অন্তর মিথ্যে বলেনি যা দেখেছেন”; “তিনি নিজ হতেকিছুই বলেন না”; “(তাঁর) চক্ষু না কোনো দিকেফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে।” [আল-কুরআন, ৫৩: ১১, ৩, ১৭ যথাক্রমে]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “সুতরাং তারই শপথ যাপ্রত্যাবর্তন করে, সোজা চলে, স্থিত থাকে, এবং রাতের(শপথ) যা পৃষ্ঠ প্রদান করে, আর প্রভাতের (শপথ), যখন শ্বাস গ্রহণ করে; নিশ্চয় এটা সম্মানিত প্রেরিতেরবাণী, যিনি শক্তিশালী, আরশ–অধিপতির দরবারেসম্মানিত; সেখানে তার আদেশ পালন করা হয় যিনিআমানতদার (জিবরীল)। তোমাদের সাহিব (রাসূলেপাক) যিনি তোমাদের সাথে আছেন, তিনি পাগল নন, এবং নিশ্চয় তিনি তাঁকে আলোকিত প্রান্তে দেখলেন; এবং এ নবী (ﷺ) অদৃশ্য বিষয় বর্ণনা করার ব্যাপারেকৃপণ নন; এবং আল–কুরআন বিতাড়িত শয়তানেরবাণী নয়” [সূরা তাকভীর, ১৫-২৫ আয়াত]।


উদ্ধৃত আয়াতে করীমার অর্থ হচ্ছে: আমি শপথ করছি যে এটা একজন মহান পয়গম্বরের বাণী – মহান তাঁর কাছে যিনি তাঁকে প্রেরণ করেছেন – তাঁর প্রতি অর্পিত ঐশী প্রত্যাদেশ প্রকাশ করার ক্ষমতাসম্পন্ন এক পয়গম্বর যিনি তাঁর প্রভুর কাছে নিজ মকাম ও মর্যাদাসহ নিরাপদ এবং দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত; যাঁকে আসমানে মান্য করা হয় এবং খোদায়ী কালামের ব্যাপারে বিশ্বাস করা হয়।


আলী ইবনে ঈসা রূমানী বলেন যে মহান পয়গম্বর হলেন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এবং তাই এসব গুণ তাঁরই। অন্যান্যরা বলেন যে জিবরীল (عليه السلام)-কে এ আয়াতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, আর তাই এসব গুণ তাঁরই। “তিনি তাঁকে আলোকিত প্রান্তে দেখলেন” – এ আয়াতের অর্থ জিবরীল (عليه السلام) রাসূলে খোদা (ﷺ)-কে দেখতে পেয়েছিলেন। এ কথা বলা হয়েছে যে এর অর্থ মহানবী (ﷺ) তাঁর প্রভু আল্লাহতা’লাকে দেখেছিলেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে মহানবী (ﷺ) জিবরীল (عليه السلام)-কে তাঁর আসল চেহারায় দেখেছিলেন। একটি ভিন্ন বর্ণনা বিবৃত করে যে “কার্পণ্য” শব্দটির ব্যবহার দ্বারা বোঝায় মহানবী (ﷺ) গায়ব তথা অদৃশ্যকে সন্দেহ করেন না; অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে হুযূর পূল নূর (ﷺ) আল্লাহতা’লার এবাদত-বন্দেগীতে কার্পণ্য করেন না এবং তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করার ক্ষেত্রেও কার্পণ্য করেন না। তবে সর্বসম্মতি হলো এ উদ্ধৃতিটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে।


আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “নূ–ন। কলম ও তাদেরলেখার শপথ। আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহেউন্মাদ নন; এবং আপনার জন্যে অশেষ পুরস্কাররয়েছে; এবং নিশ্চয় মহা মর্যাদাপূর্ণ হলো আপনারইচরিত্র।” [সূরা কালাম, ১-৪ আয়াত]


এই মহা শপথ-বাক্য দ্বারা আল্লাহতা’লা নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে তাঁরই পছন্দকৃত পয়গম্বর (ﷺ)-এর প্রতি কাফেররা যা কিছু হিংসা-বিদ্বেষবশতঃ আরোপ করছে তা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-কে প্রফুল্ল চিত্ত করেছেন এবং তাঁর আশা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন নম্রভাবে ঘোষণা করে এ কথা – “আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে উন্মাদ নন।” এতে সর্বাধিক সম্মান প্রতিভাত হয় এবং কথাবার্তায় আদবের সর্বাধিক মাত্রার দৃষ্টান্ত-ও বটে।


অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁকে জানিয়েছেন যে তাঁর কাছ থেকে মহানবী (ﷺ) অনন্ত নেয়ামত ও গণনার অতীত এক পুরস্কার পাবেন, যা তাঁকে কোনোভাবেই দেনাগ্রস্ত করবে না। এরশাদ হয়েছে – “আপনি নিশ্চয় পাবেন অশেষ পুরস্কার।” এরপর খোদাতা’লা তাঁকে প্রদত্ত উপহারগুলোর জন্যে তাঁর প্রশংসা করেছেন। তিনি মহানবী (ﷺ)-কে তাঁর দিকে পথপ্রদর্শন করেছেন এবং রাসূল (দ;)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলীকে সমর্থন দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় মহা মর্যাদাসম্পন্ন হলো আপনার চরিত্র।” এ কথা বলা হয়েছে যে এই বাণী কুরআন-সম্পর্কিত (হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা’কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে; তিনি বলেন: “তাঁর চরিত্র হলো আল-কুরআন”)। এ কথা বলা হয়েছে যে এর অর্থ দ্বীন ইসলাম (হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত)। আর এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ হলো মহান স্বভাব। আরো কথিত আছে যে এর অর্থ হলো মহানবী (ﷺ)-এর আল্লাহ ছাড়া আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।


আল-ওয়াসিতী বলেন, “আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-কে যে নেয়ামত তথা আশীর্বাদ দ্বারা ধন্য করেছেন, তার সম্পূর্ণ স্বীকৃতির কারণে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাই তাঁকে সেই চরিত্রের ওপর গঠন করে আল্লাহ পাক তাঁকে সবার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন।”


সেই সূক্ষ্ম, মহানুভব, প্রশংসিত সত্তার প্রতি প্রশংসা জানাই, যিনি ভালো কাজ করাকে সহজ করে দিয়েছেন এবং যিনি মানুষজনকে সেদিকে হেদায়াত দিয়েছেন; আর যারা ভালো কাজ করে তাদের তিনি প্রশংসা করেন এবং পুরস্কৃত করেন। তাঁরই মহান শান! তাঁর আশীর্বাদ কতোই না অগণিত! তাঁর অনুগ্রহ-ও কতোই না বিস্তৃত!


অতঃপর আল্লাহতা’লা সূরাটিতে তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ দানকারীদের ব্যাপারে এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে তারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তিনি তাদেরকে হুমকি দিয়েছেন এ বলে, “সুতরাং অবিলম্বেআপনিও দেখতে পাবেন এবং তারাও দেখবে যেতোমাদের মধ্যে কে উন্মাদ ছিল। নিশ্চয় আপনারপ্রতিপালক ভালোভাবে জানেন কে তাঁর পথ থেকেবিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালোভাবে জানেনতাদেরকেও যারা সত্য পথে রয়েছে।” [সূরা কলম, ৫-৭ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]


মহানবী (ﷺ)-এর প্রশংসার পরে আল্লাহতা’লা তাঁর শত্রুদের সমালোচনা করেছেন, তাদের মন্দ চরিত্র উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং তাদের দোষত্রুটিগুলো গণনা করেছেন। এর বিপরীতে তিনি মহানবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত নেয়ামত ও সাহায্যের কথা দ্বারা সমর্থন দিয়েছেন। তিনি দশটি সমালোচিত দোষের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁরই কালামে পাকে –  “আপনি অস্বীকারকারীদের কথামান্য করবেন না; তারা তো এ কামনায় রয়েছে যেকোনো মতে আপনি নমনীয় হোন, অতঃপর তারাওনমনীয় হবে। এবং কারো কথা মান্য করবেন না, যে বড়বড় শপথকারী, লাঞ্ছিত; খুব নিন্দুক, এদিকের কথাওদিকে লাগিয়ে বিচরণকারী; সৎ কাজে বড় বাধাপ্রদানকারী; সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ; বদ মেজাজী; এসব কিছু ওপরে অতিরিক্ত এই যে, তার মূলে ত্রুটিরয়েছে। তদুপরি, কিছু সম্পদ ও সন্তানের অধিকারী।যখন তার কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, “এ তো পূর্ববর্তীদের কল্পকাহিনী।” [সূরা কলম, ৮-১৫ আয়াত]


আল্লাহতা’লা এসব কথার পরিসমাপ্তি টেনেছেন এই প্রকৃত হুমকি দ্বারা যে, তাদের শাস্তি সম্পূর্ণ হবে এবং তাদের ধ্বংস সামগ্রিক হবে; তিনি এরশাদ ফরমান: “অতি সত্বর আমিতার শুঁড়রূপী থুতনীর ওপর দাগ দেবো” [সূরা কলম, ১৬ আয়াত]। হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর নিজেকে নিজের সাহায্য করা থেকে আল্লাহ তাঁকে যে সাহায্য করেছেন, তা আরো বেশি কার্যকর। হুযূর সৈয়্যদে আলম (ﷺ) যেভাবে শত্রুদেরকে হতবুদ্ধি করেছেন, তার চেয়েও বেশি কার্যকর হলো আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাদেরকে হতবুদ্ধি করার ব্যাপারটি।


পরিচ্ছেদ – ৬/ মহানবী (ﷺ)-কে সম্বোধন করার ক্ষেত্রেআল্লাহতা’লার দয়া ও মহানুভবতা


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “তোয়াহা। হে মাহবুব(দ;)! আমি আপনার ওপর এই কুরআন এ জন্যেঅবতীর্ণ করিনি যে আপনি ক্লেশে পড়বেন।” [সূরা তোয়াহা, ১-২ আয়াত]


কথিত আছে যে ‘তোয়াহা’ মহানবী (ﷺ)-এরই একটি নাম মোবারক। আরো কথিত আছে যে এটা আল্লাহ পাকেরও একটি পবিত্র নাম। বলা হয়ে থাকে এর অর্থ, “ওহে মানুষ!” আরো বলা হয়ে থাকে, এটা বিভিন্ন অর্থবোধক পৃথক পৃথক শব্দকে ইঙ্গিত করে। আল-ওয়াসিতী বলেন যে এর অর্থ, “ওহে পুতঃপবিত্র” (তাহের), “ওহে পথপ্রদর্শক” (হাদী)।


এ কথা বলা হয়েছে যে ক্রিয়াটির (ফে’ল) দ্বারা পায়ে হাঁটা আবশ্যক হয়েছে এবং আরবী ‘হা’ শব্দটি দ্বারা পৃথিবীকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে; অর্থাৎ, পৃথিবীর বুকে দু’পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে এবং এক পায়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, “আমি আপনার ওপর এই কুরআন এ জন্যে অবতীর্ণ করিনি যে আপনি ক্লেশে পড়বেন।” তিনি এ আয়াত এমনই এক সময় নাযেল করেন যখন মহানবী (ﷺ) সারা রাত জেগে দাঁড়িয়ে এবাদত-বন্দেগী করতেন এবং ক্লান্ত হয়ে যেতেন। আর্ রাবীউ ইবনে আনাস্ (رضي الله عنه) বলেন যে হুযূর পূর নূর (ﷺ) এবাদতরত অবস্থায় এক পায়ের ওপর দাঁড়াতেন এবং তারপর অপরটির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। তাই আল্লাহ পাক তাঁকে বলেন, “তোয়াহা”, অর্থাৎ, “হে মাহবুব! পৃথিবীর বুকে দু’পায়ের ওপর দণ্ডায়মান হোন। আমি আপনার ওপর এই কুরআন এ জন্যে নাযেল করিনি যে আপনি ক্লেশে পড়বেন।” সে যা-ই হোক, এটা পরিষ্কার যে এসব-ই (আল্লাহর তরফ থেকে) মহাসম্মান ও উত্তম ব্যবহার পরিস্ফুট করে।


“তোয়াহা” শব্দটি মহানবী (ﷺ)-এর একটি নাম হোক বা কোনো শপথ-ই হোক, এতে মহান প্রভুর দয়া ও সম্মান প্রদর্শন প্রতিভাত হয়।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “হয়তো আপনি আক্ষেপেআত্মবিনাশী হয়ে পড়বেন তাদের জন্যে, যদি তারা এবাণীর প্রতি ঈমান না আনে” [সূরা কাহাফ, ৬ আয়াত]। অর্থাৎ, দুঃখ, ক্ষোভ বা আক্ষেপে আত্মহননের পথ বেছে নেবেন। এর সাথে নিম্নের ঐশী বাণীর মিল রয়েছে: “হয়তোআপনি আপন প্রাণবিনাশী হয়ে যাবেন এ দুঃখে যে তারাঈমান আনেনি” [সূরা শুয়ারা, ৩ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। এর পরবর্তী আয়াতে ঘোষিত হয়েছে, “যদি আমি ইচ্ছা করি, তাহলে আসমান থেকে তাদেরওপর কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ করবো, যাতে তাদের উঁচুউঁচু গ্রীবাগুলো সেটার সামনে বিনত থেকে যায়।” [সূরা শুয়ারা, ৪ আয়াত]


একই ধারায় আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “অতএব, প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা দিন যা আপনার প্রতি আদেশ করাহয়েছে এবং মূর্তি পূজারীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েনিন। নিশ্চয় সেই বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমি–ইযথেষ্ট; যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য স্থির করে; সুতরাং শিগগিরই তারা জেনে যাবে। এবং নিশ্চয় আমারজানা আছে যে তাদের কথায় আপনার অন্তর সংকুচিত(ভারাক্রান্ত) হয়” [সূরা হিজর, ৯৪-৯৭ আয়াত]। আরো এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় আপনার পূর্ববর্তী রাসূল(عليه السلام)-বৃন্দের সাথেও ঠাট্টা–বিদ্রূপ করা হয়েছিল।অতঃপর আমি কাফেরদেরকে কিছুদিনের জন্যেঅবকাশ দিয়েছিলাম। এরপর তাদেরকে পাকড়াওকরেছি; আর আমার (প্রদত্ত) শাস্তি কেমন ছিল?” [সূরা রা’দ, ৩২ আয়াত]


মক্কী বলেন, “আল্লাহ পাক এ কথা দ্বারা রাসূলে করীম (ﷺ)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং মূর্তি পূজারীদের প্রদত্ত দুঃখকষ্ট হতে তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি মহানবী (ﷺ)-কে জানিয়েছিলেন যে যারা এ ধরনের আচরণ অব্যাহত রাখতে চাইবে, তারা পূর্ববর্তী অনুরূপ আচরণকারীদের পরিণতি ভোগ করবে।


একই সান্ত্বনা বিধৃত হয়েছে নিম্নের কালামে পাকে – “আরযদি এরা আপনাকে অস্বীকার করে, তবে নিশ্চয়আপনার পূর্ববর্তী কতো রাসূলকেই তো অস্বীকার করাহয়েছে” [সূরা ফাতির, ৪ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে: “এমনিভাবেই যখনতাদের পূর্ববর্তীদের কাছে কোনো রাসূল তাশরীফএনেছেন, তখন তারা বলেছিল, ‘যাদুকর’ অথবা‘উন্মাদ’।” [সূরা যা-রিয়াত, ৫২ আয়াত]।


আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-কে পূর্ববর্তী কওম (জাতি)-গুলো সম্পর্কে, তারা তাদের আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দকে কী বলেছিল সে সম্পর্কে এবং পূর্ববর্তী পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলী তাদের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে জানিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি বিশ্বনবী (ﷺ)-কে এ তথ্য জানিয়ে আশ্বস্ত করেছেন যে মক্কার অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে তিনি যে আঘাত পেয়েছেন, তা তাঁর পূর্ববর্তী আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মতোই একটি ঘটনামাত্র। এ ধরনের বৈরী আচরণের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি-ই প্রথম নন।


অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁকে মানসিক শান্তি দিয়েছেন এ কথা বলে – “অতএব, হে মাহবুব! আপনি তাদের দিকথেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। এতে আপনার কোনো দোষহবে না” [সূরা যা-রিয়াত, ৫৪ আয়াত]। অর্থাৎ, তাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিন; এতে আপনি তাদের কাছে যে (ঐশী) বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, তা তারা মান্য না করার কারণে আপনাকে দায়ী করা হবে না এবং আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তা পৌঁছানোর জন্যেও আপনাকে দায়ী করা হবে না।


অনুরূপভাবে, আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “হে মাহবুব! আপনি আপন প্রতিপালকের আদেশের ওপর স্থিরথাকুন! কেননা, নিশ্চয় আপনি আমার রক্ষণাবেক্ষণেরয়েছেন” [সূরা তুর, ৪৮ আয়াত]। এর মানে কাফেররা আপনার যে ক্ষতিসাধন করতে চায়, তা মোকাবেলায় আপনি অটল, অবিচল থাকুন। আপনি সব সময়েই আমার (মানে আল্লাহর) করম নজর (পবিত্র দৃষ্টি তথা হেফাযত)-এর আওতায় আছেন; সর্বদা আমার হেফাযতেই আছেন। অনুরূপ আরো বহু আয়াতে করীমায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহানবী (ﷺ)-কে এভাবে সান্ত্বনা দিয়েছেন।


পরিচ্ছেদ – ৭/ রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে আল্লাহরপ্রশংসাস্তুতি এবং তাঁর অগণিত মহৎ গুণাবলী


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “(এবং স্মরণ করুন) যখন আল্লাহ আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের কাছ থেকেঅঙ্গীকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাবও হেকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেনতোমাদের কাছে রাসূল (ﷺ) যিনি তোমাদেরকিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরাঅবশ্যঅবশ্য তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকেসাহায্য করবে।’ এরশাদ করলেন, ‘তোমরা কি স্বীকারকরলে এবং এ সম্পর্কে আমার দেয়া গুরুদায়িত্ব গ্রহণকরলে?’ সবাই আরয করলো, ‘আমরা স্বীকারকরলাম।’ এরশাদ করলেন, ‘তবে (তোমরা) একেঅপরের সাক্ষী হও এবং আমি নিজেই তোমাদের সাথেসাক্ষীদের মধ্যে রইলাম’।” [সূরা আলে ইমরান, ৮১ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]


আবূল হাসান আল-কাবিসী এ সম্পর্কে বলেন, “আল্লাহ পাক তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর কোনো শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে তাঁকে আলাদা করে নিয়েছেন। এ আয়াতে সে কথাই তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন।”


তাফসীরবিদ উলামাবৃন্দ বলেন যে আল্লাহতা’লা এই অঙ্গীকার আদায় করেছিলেন ওহীর (ঐশী প্রত্যাদেশের) মাধ্যমে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা উল্লেখ না করে এবং তাঁর বর্ণনা না দিয়ে কোনো নবী বা রাসূল (عليه السلام)-কে পাঠাননি। অঙ্গীকারের শর্ত এই ছিল যে যদি সেই নবী বা রাসূল (عليه السلام) মহানবী (ﷺ)-এর দেখা পান, তবে তাঁকে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনতে হবে। এ কথা বলা হয়েছে যে অঙ্গীকারের মধ্যে এমন শর্ত দেয়া হয়েছিল যাতে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দ তাঁদের নিজ নিজ উম্মত বা জাতির কাছে মহানবী (ﷺ) সম্পর্কে বলেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দেন। “অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের কাছে রাসূল (ﷺ)” – খোদায়ী এ কালাম বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়কার কিতাবসম্পন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে বর্ণিত হয়েছে।


হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:) বলেন, “হযরত আদম (عليه السلام)-এর যুগ থেকে আরম্ভ করে আল্লাহতা’লা এমন কোনো নবী বা রাসূল (عليه السلام) পাঠাননি, যাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে তিনি প্রতিশ্রুতি আদায় করেননি। ওই নবী বা রাসূল (عليه السلام) বেঁচে থাকা অবস্থায় মহানবী (ﷺ)-কে পাঠানো হলে তাঁকে অবশ্যই হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনতে হতো এবং সর্বাত্মক সাহায্য করতে হতো। তাঁকে তাঁর জাতির স্বার্থ না দেখেই এই অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হতো।” মহানবী (ﷺ)-এর একাধিক বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য প্রকাশ করে এমন আরো অনেক আয়াতে করীমা সম্পর্কে আস্ সুদ্দী ও কাতাদা অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং হে মাহবূব! স্মরণকরুন, যখন আমি আম্বিয়াবৃন্দের কাছ থেকে অঙ্গীকারগ্রহণ করেছি এবং আপনার কাছ থেকে আর নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম–তনয় ঈসার কাছ থেকে।”[আল-কুরআন, ৩৩:৭; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]


আবার অন্যত্র তিনি ফরমান: “নিঃসন্দেহে, হে মাহবূব, আমি আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি, যেমন ওহী নূহও তার পরবর্তী আম্বিয়াবৃন্দের প্রতি প্রেরণ করেছি; এবংআমি ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়া’কুব ও তাঁরপুত্রবৃন্দ; আর ঈসা, আইয়ূব, ইয়ূনুস, হারূন এবংসুলাইমানের প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি; এবং আমিদাউদকে যাবূর দান করেছি। এবং ওই রাসূলবৃন্দকে(প্রেরণ করেছি) যাদের উল্লেখ আমি আপনার কাছেআগে করেছি আর ওই সব রাসূলকে যাদের উল্লেখআপনার কাছে করিনি। আর আল্লাহ মূসার সাথে প্রকৃতঅর্থে কথা বলেছেন। রাসূলবৃন্দকে (প্রেরণ করেছি) সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী করে, যাতে রাসূলবৃন্দেরপরে আল্লাহর কাছে মানুষের কোনো অভিযোগেরঅবকাশ না থাকে; এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিন্তু, হে মাহবূব, আল্লাহ সেটারই সাক্ষী, যাতিনি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন।” [আল-কুরআন, ৪:১৬৩-৬]


বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বেসাল তথা পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্তির পর হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) আহাজারি করে বলছিলেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। (ঐশী বাণীতে) অবতীর্ণ হয়েছে যে আল্লাহর কাছে আপনার শ্রেষ্ঠত্বের একটি অংশ হলো তিনি আপনাকে সবশেষ নবী হিসেবে প্রেরণ করলেও তাঁদের সবার আগে আপনার নাম উল্লেখ করেছেন: ‘এবং হে মাহবূব! স্মরণকরুন, যখন আমি আম্বিয়াবৃন্দের কাছ থেকে অঙ্গীকারগ্রহণ করেছি এবং আপনার কাছ থেকে আর নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম–তনয় ঈসার কাছ থেকে[আল–কুরআন, ৩৩:৭]।’ হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। (ঐশী বাণীতে) অবতীর্ণ হয়েছে যে আল্লাহর কাছে আপনার শ্রেষ্ঠত্বের একটি অংশ হলো জাহান্নামে সাজাপ্রাপ্ত লোকেরা তাদের সাজা পাওয়ার সময় আক্ষেপ করবে এ কথা বলে যে তারা যদি আপনাকে মান্য করতো। তারা বলবে: ‘হায়, কোনোমতে যদি আমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করতামএবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশও মান্য করতাম’[আল-কুরআন, ৩৩:৬৬]।”


কাতাদা বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “আমাকেই আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মধ্যে সর্বপ্রথমে সৃষ্টি করা হয়, আর তাঁদের সবার শেষে প্রেরণ করা হয়।” এ কারণেই তাঁকে হযরত নূহ (عليه السلام) ও অন্যান্যদের আগে উল্লেখ করা হয়েছে।


আস্ সামারকান্দী বলেন, “আমাদের রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সব আম্বিয়া (عليه السلام)-এর শেষে প্রেরণ করা হলেও তাঁদের আগে তাঁর নাম মোবারক উল্লেখ করে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। এর মানে হলো, আল্লাহতা’লা যখন তাঁদেরকে হযরত আদম (عليه السلام)-এর পিঠ থেকে ছোট্ট ছোট্ট পিঁপড়ার মতো বের করে আনেন, তখন তিনি তাঁদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন।”


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এঁরা রাসূল, আমিতাঁদের মধ্যে এককে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠ করেছি।তাঁদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবংকেউ এমনও আছেন, যাঁকে সবার ওপর মর্যাদাসমূহেউন্নীত করেছেন।” [আল-কুরআন, ২:২৫৩]


তাফসীরবিদ উলামাবৃন্দ বলেন যে ‘কেউ এমনও আছেন, যাঁকে (আল্লাহ) সবার ওপর মর্যাদাসমূহে উন্নীতকরেছেন’ – আল্লাহর এ কালাম শরীফ মহানবী (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করেছে, কেননা তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্যে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহতা’লা তাঁর জন্যে গনীমতকেও হালাল করেছেন এবং তাঁকে বিশেষ বিশেষ মো’জেযা মঞ্জুর করেছেন। তিনি অন্যান্য নবী-রাসূল (عليه السلام)-কে মঞ্জুর করেননি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য বা মর্যাদাকর গুণ যা তিনি মহানবী (ﷺ)-কে মঞ্জুর করেননি। একজন তাফসীরবিদ বলেন যে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের একটি অংশ হলো এই যে, আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কিতাবে অন্যান্য নবী-রাসূল (عليه السلام)-কে তাঁদের নাম ধরে ডেকেছেন, কিন্তু মহানবী (ﷺ)-কে সম্বোধন করেছেন ‘হে নবী’ বা ‘হে রাসূল’ বলে।


আস-সামারকান্দী বর্ণনা করেন যে “এবং নিশ্চয় ইব্রাহীম(عليه السلام) তাঁরই দলের অন্তর্ভুক্ত” [আল-কুরআন, ৩৭:৮৩] – খোদায়ী এ কালাম সম্পর্কে আল-কালবী বলেছেন (আয়াতোক্ত) আরবী ‘হু’ (তাঁরই) সর্বনামটি মহানবী (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করেছে; যার মানে হলো ইব্রাহীম (عليه السلام) মহানবী (ﷺ)-এর দলেরই অন্তর্ভুক্ত, তাঁরই দ্বীন ও পথের অনুসারী। আল-ফাররা’ এই ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করেছেন এবং মক্কী তাঁর কাছ থেকে এটা বর্ণনা করেছেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে এতে নূহ (عليه السلام)-কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। [নোট: শেষোক্ত মতটি অধিকাংশ তাফসীরবিদ উলামার]


পরিচ্ছেদ – ৮/ রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি সালাওয়াতপাঠের জন্যে সৃষ্টিকুলের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এবংতাঁকে আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ ও তাঁরই অসীলায় শাস্তিমওকুফ করা


আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “এবং আল্লাহর কাজ এ নয়যে তাদেরকে শাস্তি দেবেন যতোক্ষণ পর্যন্ত হে মাহবূব, আপনি তাদের মাঝে উপস্থিত থাকবেন” [আল-কুরআন, ৮:৩৩; তাফসীরে নূরুল এরফান]। অর্থাৎ, তিনি যতোদিন মক্কা মোয়াযযমায় থাকবেন, ততোদিন পর্যন্ত আল্লাহ শাস্তি দেবেন না। মহানবী (ﷺ) মক্কা শরীফ (হিজরতকালে) ত্যাগ করলে কতিপয় ঈমানদার তখনো ওখানে থেকে যান; এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা আয়াতে করীমা নাযেল করেন, “এবং আল্লাহ তাদেরকেশাস্তিদাতা নন, যতোক্ষণ তারা ক্ষমা প্রার্থনারত থাকছে”[আল-কুরআন, ৮:৩৩]। ওপরের বাণীটি তাঁরই নিম্নোক্ত বাণীর মতো শোনায়: “যদি তারা পৃথক হয়ে যেতো, তবেঅবশ্যই আমি তাদের মধ্য থেকে কাফিরদেরকেবেদনাদায়ক শাস্তি দিতাম” [আল-কুরআন, ৪৮:৩৫]। এর আগে একই আয়াতে তিনি বলেন, “এবং যদি এমন নাহতো যে কিছু সংখ্যক মুসলমান পুরুষ ও কিছু সংখ্যকমুসলমান নারী যাদের সম্পর্কে তোমরা অবগত নও”[৪৮:৩৫]।


ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ হিজরত করার পর আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হয় এ মর্মে, “আর তাদের (কাফেরদের) কী–ইবা আছে যে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না?”[আল-কুরআন, ৮:৩৪]। এসব আয়াতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুউচ্চ মর্যাদার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে। খোদায়ী শাস্তি মওকুফ হয় প্রথমতঃ তাঁর মক্কায় উপস্থিতির কারণে; অতঃপর তাঁরই সাহাবী (رضي الله عنه)-দের উপস্থিতির কারণে দ্বিতীয় দফায় তা মওকুফ হয়। যখন আর কেউই মক্কায় অবশিষ্ট রইলেন না, তখন আল্লাহ মক্কার কাফেরদেরকে শাস্তি দেন ঈমানদারবৃন্দকে তাদের চেয়ে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এবং তাদের ওপর বিজয় দান করে। তিনি মুসলমানদের তরবারিকে কাফেরদের ওপর শাসন করার ক্ষমতা দান করেন; আর মুসলমানবৃন্দ তাদের জমি-জিরাত, বাড়িঘর ও সম্পদ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন [মানে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সবাই মুসলমান হয়ে যান – অনুবাদক]।


আবূ মূসা এই আয়াতটি আরেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; তিনি মহানবী (ﷺ)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: আল্লাহতা’লা আমার উম্মতের বেলায় আমাকে দুটো নিশ্চয়তা (গ্যারান্টী) দান করেছেন; প্রথমটি এই আয়াতে করীমা – ““এবং আল্লাহর কাজ এ নয় যে তাদেরকেশাস্তি দেবেন যতোক্ষণ পর্যন্ত হে মাহবূব, আপনি তাদেরমাঝে উপস্থিত থাকবেন” [আল-কুরআন, ৮:৩৩; তাফসীরে নূরুল এরফান]। আর দ্বিতীয়টি অপর আয়াতে করীমা – “এবং আল্লাহ তাদেরকে শাস্তিদাতা নন, যতোক্ষণ তারা ক্ষমা প্রার্থনারত থাকছে” [আল-কুরআন, ৮:৩৩]। [এটা একমাত্র ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন (গরীব)]। এই রেওয়ায়াতটি আমাদেরকে আল্লাহতা’লার পাক কালামে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান: “এবং আমি আপনাকে (হেরাসূল) সমগ্র জগতের জন্যে রহমত করে প্রেরণকরেছি” [আল-কুরআন, ২১:১০৭]।


মহানবী (ﷺ) বলেছিলেন “আমি আমার সাহাবাবৃন্দের বেলায় নিশ্চয়তা পেয়েছি” [আবূ মূসা হতে ইমাম মুসলিম]। কেউ কেউ বলেন এর মানে বেদআত তথা নতুন প্রবর্তিত প্রথা হতে রক্ষাপ্রাপ্ত হবার নিশ্চয়তা; আর কেউ কেউ বলেন এর মানে মতপার্থক্য ও বিশৃঙ্খলা হতে রক্ষাপ্রাপ্ত হবার নিশ্চয়তা। উলামা-এ-হক্কানীদের মধ্যে একজন বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা ছিলেন এবং তাঁর সুন্নাহ যতোদিন উপস্থিত (হাজির) আছে, ততোদিন পর্যন্ত তিনিও (শাস্তি মওকুফকারী হিসেবে) উপস্থিত আছেন। তাঁর সুন্নাহ বিস্মৃত হলে পরেই ক্লেশ ও বিশৃঙ্খলা আশঙ্কা করো।”


আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁরফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্যবক্তা(নবী)’র প্রতি। ওহে ঈমানদার সকল! তোমরাও তাঁরপ্রতি দরূদ ও খুব সালাম প্রেরণ করো।” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৬]


আল্লাহ পাক তাঁর নবী (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রথমেই স্পষ্ট করেছেন স্বয়ং তাঁর প্রতি দরূদ-সালাম প্রেরণ করে; এরপর ফেরেশতাদের দ্বারা সালাওয়াত পাঠ করিয়ে; এবং তারপর বান্দাদেরকেও তাঁর প্রতি সালাত-সালাম পাঠ করতে আদেশ দিয়ে।


আবূ বকর ইবনে ফারূক বর্ণনা করেন যে “আমার চোখের স্বস্তি-শান্তি সালাতের মাঝে নিহিত”, মহানবী (ﷺ)-এর এই বাণীকে উলামা-এ-কেরামের মধ্যে কেউ একজন ব্যাখ্যা করেছেন এ অর্থে যে, এটা আল্লাহর (আয়াতোক্ত) আদেশের প্রেক্ষিতে আল্লাহ পাকের, তাঁর ফেরেশতাকুলের ও উম্মতে মুহাম্মদীর সালাত-সালাম প্রেরণ, যা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত জারি থাকবে। ফেরেশতাকুল ও মনুষ্যজাতির সালাত-সালাম হচ্ছে রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি অনুনয়, আর আল্লাহতা’লার জন্যে তা হচ্ছে মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি করুণা বর্ষণ।


এ কথা বলা হয়েছে যে “তারা (ফেরেশতাকুল) সালাত প্রেরণ করেন”, আয়াতোক্ত এ বাক্যটির মানে তাঁরা ‘বারাকা’ তথা আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। তবে মহানবী (ﷺ) যখন মানুষদেরকে তাঁর প্রতি দরূদ-সালাম প্রেরণ শিক্ষা দেন, তখন তিনি ‘সালাত’ (প্রার্থনা) ও ‘বারাকা’(আশীর্বাদ) শব্দগুলোর মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমরা পরে তাঁর প্রতি সালাতের অর্থ ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পাবো।

তাফসীরবিদদের কেউ একজন বলেন যে আল-কুরআনের সূরা মরিয়মে বর্ণিত “কাফ–হা–ইয়া–আঈন–সোয়াদ” (১৯:১) আয়াতটির ব্যাখ্যা হলো, ‘কাফ’ বলতে রাসূল (ﷺ)-এর জন্যে আল্লাহ-ই যথেষ্ট (কেফায়া) হওয়াকে বুঝিয়েছে, যেমনটি আল্লাহ এরশাদ করেছেন: “আল্লাহ কিআপন বান্দাদের জন্যে যথেষ্ট নন?” [আল-কুরআন, ৩৯:৩৬]; ‘হা’ বলতে বোঝানো হয়েছে  সঠিক রাস্তা প্রদর্শন (হেদায়াত ), যেমনটি আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আর (আল্লাহ) আপনাকে সোজা পথ দেখিয়ে দেন”[আল-কুরআন, ৪৮:২]; ‘ইয়া’ বলতে আল্লাহ’র শক্তি (তাইয়্যিদ) দ্বারা সমর্থন দানকে বুঝিয়েছে, যেমনটি তিনি তাঁর পাক কালামে ঘোষণা করেছেন: “(আল্লাহ) নিজসাহায্য দ্বারা শক্তিদান করেছেন” [আল-কুরআন, ৮:২৬]; ‘আঈন’ বলতে আল্লাহর সুরক্ষা (’ইসমা)বুঝিয়েছে, যেমনটি তিনি এরশাদ করেন: “আর আল্লাহআপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে” [আল-কুরআন, ৫:৬৭]; আর ‘সোয়াদ’ বলতে মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহর প্রেরিত আশীর্বাদ (সালাত) বুঝিয়েছে, যেমনটি তিনি কিতাবুল্লাহ শরীফে ঘোষণা করেছেন: ““নিশ্চয়আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন ওইঅদৃশ্যবক্তা (নবী)’র প্রতি” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৬]। আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন, “এবং যদি তাঁর (নবীর) ব্যাপারে তোমরা জোট বাঁধো (মানে একে অপরকেসাহায্য করো), তবে নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাহায্যকারী(মাওলা) এবং জিব্রাঈল ও সৎকর্মপরায়ণ মু’মিনবৃন্দ–ও” [আল-কুরআন, ৬৬:৪]। এখানে ‘মাওলা’ শব্দটির অর্থ রক্ষাকারী (বা সাহায্যকারী)। এ কথা বলা হয়েছে যে সৎকর্মশীল ঈমানদারবৃন্দ রাসূল (ﷺ)-এর সাহায্যকারী। আরো বলা হয়েছে যে এ আয়াতকে আক্ষরিক অর্থে নিতে হবে, যার মানে সকল ঈমানদারকে এতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। [অনুবাদকের জ্ঞাতব্য: মুফতী আহমদ এয়ার খানসাহেব প্রণীত “তাফসীরে নূরুল এরফান” গ্রন্থে এআয়াতের টীকায় লেখা হয়েছে: “স্মরণ রাখা দরকার যে, নবী (ﷺ) মুসলমানদের এমন–ই সাহায্যকারী, যেমনবাদশাহ প্রজাদের সাহায্যকারী। আর মু’মিনবৃন্দ হুযূর(ﷺ)-এর এমন সাহায্যকারী, যেমন সেবক ও সিপাহীবর্গবাদশাহর। সুতরাং এ আয়াতের ভিত্তিতে একথা বলা যেতেপারে না যে রাসূল (ﷺ)মুসলমানদের মুখাপেক্ষী।]


পরিচ্ছেদ – ৯/ সূরা ফাতহ-এ মহানবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত মর্যাদাপূর্ণ চিহ্নগুলো সম্পর্কে


আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আমি আপনার জন্যে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি; যাতে আল্লাহ আপনার কারণে ক্ষমা করে দেন আপনার পূর্ববর্তীদের ও আপনার পরবর্তীদের গুনাহ্ এবং আপন নি’মাতগুলো (আপনার) প্রতি পরিপূর্ণ করে দেন, আর আপনাকে সোজা পথ দেখান; এবং আল্লাহ আপনাকে বড় ধরনের সাহায্য করেন। তিনি-ই, যিনি ঈমানদারদের অন্তরসমূহে প্রশান্তি দান করেন, যাতে তাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়; এবং আল্লাহরই মালিকানাধীন সমস্ত বাহিনী আসমানসমূহ ও জমিনের; এবং আল্লাহ জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়; যাতে ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে বাগানসমূহে নিয়ে যান, যেগুলোর নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান; তারা সেগুলোর মধ্যে স্থায়ীভাবে থাকবে; এবং তাদের পাপরাশি তাদের থেকে মোচন করে দেন। আর এটা আল্লাহর কাছে মহা সাফল্য। এবং শাস্তি দেন মুনাফিক্ক পুরুষ ও মুনাফিক্ক নারীদেরকে এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদেরকে, যারা আল্লাহ সম্বন্ধে ধারণা পোষণ করে – মন্দ ধারণা। তাদের ওপর রয়েছে মন্দচক্র এবং আল্লাহ তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাদের প্রতি অভিসম্পাত করছেন, আর তাদের জন্যে জাহান্নাম তৈরি করেছেন; এবং তা কতোই মন্দ পরিণাম! এবং আল্লাহরই মালিকানাধীন আসমানসমূহ ও জমিনের সমস্ত বাহিনী এবং আল্লাহ সম্মান ও প্রজ্ঞাময়। নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাযের-নাযের (উপস্থিত প্রত্যক্ষকারী) এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে; যাতে হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনো এবং রাসূল (ﷺ)-এর মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো। আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো। ওই সব লোক, যারা আপনার কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে তারা তো আল্লাহরই কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে। তাদের হাতগুলোর ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে। সুতরাং যে কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, সে নিজেরই অনিষ্টার্থে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে; আর যে কেউ পূরণ করেছে ওই অঙ্গীকার, যা সে আল্লাহর সাথে করেছিল, তবে অতি সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।”[আল-কুরআন, ৪৮: ১-১০ আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান]


আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি দানকৃত নেয়ামত-আশীর্বাদ ও তাঁরই কৃত মহানবী (ﷺ)-এর প্রশংসা এবং আল্লাহর কাছে হুযূর পাক (দ;)-এর মাকামের মহত্ব ও আশীর্বাদ ওপরে বর্ণিত আয়াতগুলোতে বিধৃত হয়েছে, যা ভাষায় যথাযথভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আল্লাহতা’লা শুরু করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শত্রুদের ওপর তাঁরই সুস্পষ্ট বিজয়ের কথা বিবৃত করে; আর কীভাবে আল্লাহর বাণী ও শরীয়ত আধিপত্য লাভ করবে, তা-ও বর্ণনা করে; আর মহানবী (ﷺ)-কে তিনি যে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো কাজের জন্যে তাঁকে যে দোষী সাব্যস্ত করবেন না, তা-ও ব্যক্ত করে। উলামা-এ-হক্কানীদের একজন বলেন যে, যা কিছু ঘটেছে এবং যা ঘটেনি, আল্লাহ পাক উভয়কেই এখানে উদ্দেশ্য করেছেন। মক্কী (رحمة الله) বলেন, “আল্লাহতা’লা তাঁর ঐশী দানকে ক্ষমার অসীলা বানিয়েছেন। সব কিছুই তাঁর কাছ থেকে এসে থাকে। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। (খোদায়ী) আশীর্বাদের ওপর (খোদায়ী) আশীর্বাদ, (ঐশী) দানের ওপর (ঐশী) দান।”


অতঃপর আল্লাহ পাক বলেন: “….আপন নি’মাতগুলো (আপনার) প্রতি পরিপূর্ণ করে দেন…।” এ কথা বলা হয়েছে যে মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি যারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে, তাদের দর্পচূর্ণ করেই এটা করা হয়; আরো বলা হয়েছে যে এতে মক্কা ও তায়েফ নগরীগুলোর বিজয়কে বোঝানো হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহতা’লা এই আয়াতে ব্যক্ত করেছেন – “এই পৃথিবীতে আপনার খ্যাতি বৃদ্ধি করে, আপনাকে সাহায্য ও ক্ষমা করে (এটা করেছি)।” আল্লাহ তাঁকে বলছেন যে, তাঁর প্রতি আপন নেয়ামতগুলো আল্লাহ পূর্ণ করেছেন তাঁরই দাম্ভিক শত্রুদের দম্ভকে ধূলিসাৎ করে; সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় নগরীগুলোর একটিকে উন্মুক্ত করে; তাঁর মহত্ব উন্নীত করে এবং তাঁকে বেহেশ্ত ও সুখ-শান্তির দিকে অগ্রসরমান সোজা পথ প্রদর্শন করে; খোদাতা’লার বিজয় শক্তিশালী এক বিজয়-ই বটে। আল্লাহতা’লা  ঈমানদার মুসলমানদের প্রতি আপন নেয়ামত বর্ষণ করেন তাদেরই কলব্ তথা অন্তরে স্থাপিত তাসল্লি (শান্তি) ও ‘সাকিনা’ (অন্তরের প্রশান্তি)-পূর্ণ পুরস্কার দ্বারা; তাদের নিরঙ্কুশ বিজয় ও খোদায়ী ক্ষমা প্রদর্শনের সুসংবাদ দ্বারাও; তাঁদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করার দ্বারাও; আর তাঁর শত্রুদের খোদায়ী অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরই দয়া হতে বঞ্চিত অবস্থায় দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পরিণতি বরণের কথা ব্যক্ত করার দ্বারাও।


অতঃপর আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাযের-নাযের (উপস্থিত প্রত্যক্ষকারী) এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে” [আল-কুরআন, ৪৮: ১-১০]। এখানে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর কয়েকটি উত্তম গুণ ও বৈশিষ্ট্য এক এক করে উল্লেখ করেছেন। তিনি যে তাঁর উম্মতের কাছে সত্যিসত্যি ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, তার সাক্ষী তিনি নিজেই। এ কথা বলা হয়েছে এর মানে এ-ও যে তিনি তাদের পক্ষে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য বহন করবেন। তিনি তাঁর উম্মতের কাছে পুরস্কারের বা গুনাহ মাফের খোশ-খবরী (সুসংবাদ) প্রদান করে থাকেন। তিনি তাঁর শত্রুদেরকে তাদের শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করেন এবং তাদের গোমরাহীর (পথভ্রষ্টতার) ব্যাপারেও এমন উপায়ে তা করেন, যার দরুন আল্লাহতা’লা যাঁদের তাকদীরে ভালাই রেখেছেন, তাঁরা আল্লাহতা’লা ও তাঁর (রাসূল)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন।


এরপর তাঁরা (ঈমানদারবৃন্দ) “রাসূল (ﷺ)-এর মহত্ব বর্ণনা (সাহায্য) ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন” করবেন। এ কথাও বলা হয়েছে যে তাঁরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কঠিন সাধনা করবেন। এর সম্পর্কে সবচেয়ে সার্বিক ও স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এটা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-কে উদ্দেশ্য করেছে।


অতঃপর আল্লাহ ফরমান: “আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো।” এর উদ্দেশ্য আল্লাহ-ই।


ইবনে আতা’ বলেন, “এই সূরাটি মহানবী (ﷺ)-এর জন্যে বিভিন্ন আশীর্বাদের সুসংবাদ বহন করে, যার মধ্যে রয়েছে “সুস্পষ্ট বিজয়”, যেটা দোয়া কবূল হওয়ার ইঙ্গিত; “ক্ষমা”, যা মহব্বতের ইঙ্গিতবহ; সম্পূর্ণ আশীর্বাদ, যেটা নির্বাচিত/পছন্দকৃত হওয়ার চিহ্ন; আর হেদায়াত তথা পথপ্রদর্শন, যেটা উইলায়াত (বন্ধুত্ব)-এর একটি চিহ্ন। ক্ষমায় নিহিত রয়েছে দোষত্রুটি থেকে মুক্তি। আর আশীর্বাদের পূর্ণতাপ্রাপ্তি হলো নিখুঁত পর্যায়ে উন্নীত হওয়া। সাক্ষ্যদানের হুকুমনামা/আদেশপত্র হলো হেদায়াত।”


জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ বলেন, “আল্লাহর পূর্ণকৃত নেয়ামতের অংশ হলো, তিনি তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে নিজের মাহবূব (প্রিয়ভাজন) বানিয়েছেন, হুযূর (ﷺ)-এর (পবিত্র) জীবনের নামে কসম করেছেন, তাঁর দ্বারা অন্যান্য (পয়গম্বরের) শরীয়তগুলোকে রহিত করিয়েছেন, মাকামে মাহমূদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ মাকামে তাঁকে উন্নীত করেছেন, মে’রাজ শরীফে তাঁকে রক্ষা করেছেন – যার দরুন তাঁর দু’চোখ ’না কোনো দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে’, অধিকন্তু, সমগ্র মানবজাতির জন্যে তাঁকে পয়গম্বর করে পাঠিয়েছেন, আর তাঁর উম্মতের জন্যে গনীমতকে হালাল করেছেন। আল্লাহতা’লা তাঁকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন, আর আদম (عليه السلام)-সন্তানদের সরদার বানিয়েছেন। তিনি মহানবী (ﷺ)-এর নাম মোবারককে তাঁরই পবিত্র নামের সাথে, রাসূলুল্লাহ (দ;)-এর আনন্দ-খুশিকে তাঁরই আনন্দ-খুশির সাথে জড়িত করেছেন। আল্লাহতা’লা তাওহীদের দুটো স্তম্ভের একটি মহানবী (ﷺ)-কে বানিয়েছেন।”


আল্লাহতা’লা এরপর এরশাদ করেন, “যারা আপনার কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে তারা তো আল্লাহরই কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে”, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বায়’আত আর-রিদওয়ান [হোদায়বিয়ায়]। তারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করলেই আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথকারী হবে।


এই শপথে “তাদের হাতগুলোর ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে।” এটা আল্লাহর ক্ষমতাকে, তাঁর পুরস্কারকে, তাঁর নেয়ামত/আশীর্বাদকে কিংবা তাঁর প্রতিশ্রুতিকে রূপকার্থে ব্যক্ত করেছে, আর মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি তাঁদের বায়’আত গ্রহণকে শক্তিশালী করেছে এবং যাঁর প্রতি তাঁরা এই আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর মাকামকেও উন্নীত করেছে।


আল্লাহর এই বাণী তাঁরই নিম্নবর্ণিত কালামের মতো: “অতঃপর তাদেরকে তোমরা হত্যা করো নি, বরং আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করেছেন (বদর যুদ্ধে), এবং হে মাহবূব! ওই মাটি, যা আপনি নিক্ষেপ করেছেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ-ই নিক্ষেপ করেছেন।” [আল-কুরআন, ৮: ১৭]


তবে পূর্ববর্তী আয়াতটি রূপক হলেও পরবর্তী আয়াতটি আক্ষরিকভাবে সত্য, কেননা পরবর্তীটির ক্ষেত্রে বাস্তবে হত্যা করেছেন এবং মাটি ছুঁড়েছেন আল্লাহ পাক-ই। তিনি-ই মহানবী (ﷺ)-এর কাজের স্রষ্টা; তাঁর (মাটি) ছুঁড়ে মারা, এ কাজ করতে তাঁর (প্রতি মঞ্জুরিকৃত) ক্ষমতা, এবং এটা করতে তাঁর নেয়া সিদ্ধান্তের সবই ছিল আল্লাহতা’লার সৃষ্ট (অলৌকিক) কর্ম। শত্রুপক্ষের সবার চোখ ধুলোয় পূর্ণ করার শক্তি নিয়ে মাটি নিক্ষেপ করার মতো সামর্থ্য কারোরই নেই। ফেরেশতাদের দ্বারা (শত্রুপক্ষের সৈন্যদের) হত্যা করার ঘটনাও ছিল বাস্তব।


এ কথাও বিবৃত হয়েছে যে এই পরবর্তী আয়াতটি আরবীতে এক বিশেষ ধরনের রূপক, যার অর্থ – আপনি যখন তাদের চোখে-মুখে ধুলো ও পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন, তখন তো আপনি নিক্ষেপ করেননি এবং আপনি তাদেরকে হত্যা করেননি। বরঞ্চ অাল্লাহতা’লাই তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন। এর মানে হলো, ওই কাজের ফায়দা আল্লাহতা’লার কাজ হতেই সৃষ্ট হয়েছে। অন্তর্নিহিত অর্থে আল্লাহতা’লাই হলেন তাদের হত্যাকারী ও ধুলো নিক্ষেপকারী, আর (বাহ্যিকভাবে) আপনার নাম তাতে রয়েছে।


পরিচ্ছেদ – ১০/ আল্লাহর মহান কেতাবে বিশ্বনবী (ﷺ)-কে প্রদত্ত মহা সম্মান এবং তাঁরই পাশে রাসূল (ﷺ)-এর মাকাম (পদমর্যাদা) ও রাসূল (ﷺ)-কে তাঁরই প্রদত্ত অন্যান্য বস্তু সম্পর্কে ব্যাখ্যা


এখানে উদ্ধৃত কিছু অংশ বর্ণিত হয়েছে মে’রাজ রাতের ঊর্ধ্বগমন সংক্রান্ত আল্লাহতা’লার পাক কালামে [আল-কুরআন, ১৭:১ – “পবিত্রতা তাঁরই জন্যে, যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গিয়েছেন মসজিদ-ই হারাম হতে মসজিদ-ই আক্কসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনগুলো দেখাই; নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন।”তাফসীরে নূরুল এরফান]; আর সূরা নজমেও তা বর্ণিত হয়েছে [“এবং তিনি ওই জ্যোতি দু’বার দেখেছেন; সিদরাতুল মুন্তাহার কাছে। সেটার কাছে রয়েছে ‘জান্নাতুল মাওয়া’। যখন সিদরার ওপর আচ্ছন্ন করছিল যা আচ্ছন্ন করছিল; চক্ষু না কোনো দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে। নিশ্চয় আপন রবের বহু বড় নিদর্শনাদি দেখেছেন” আল-কুরআন, ৫৩:১৩-১৮]। এতে সরাসরি বিবৃত হয়েছে মহানবী (ﷺ)-এর অতুলনীয় মাকাম (উচ্চ মর্যাদা) ও আল্লাহর নৈকট্য এবং তাঁরই প্রত্যক্ষকৃত অলৌকিক বিষয়াদি।


আরো একটি বাস্তব উদাহরণ হলো এই যে, তিনি মানুষের (ক্ষতি) থেকে সুরক্ষিত। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষের (ক্ষতি) থেকে” [আল-কুরআন, ৫:৬৭]। অন্যত্র ফরমান: “যখন কাফেরবর্গ আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল যে আপনাকে বন্দী করে রাখবে কিংবা শহীদ করবে অথবা নির্বাসিত করবে এবং তারা নিজেদের মতো ষড়যন্ত্র করছিল; আর আল্লাহ নিজের গোপন কৌশল (প্রয়োগ) করছিলেন; এবং আল্লাহর গোপন কৌশল-ই সর্বাপেক্ষা উত্তম” [আল-কুরআন, ৮:৩০]। আল্লাহ আরো এরশাদ করেন: “যদি তোমরা ‘মাহবূব’কে সাহায্য না করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করেছেন” [আল-কুরআন, ৯:৪০]।


আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-কে শত্রুদের ক্ষতি থেকে সে সময় রক্ষা করেন, যখন তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল এবং তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল। তিনি তাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আল্লাহতা’লা তাদের দৃষ্টিভ্রম ঘটিয়েছিলেন এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খোঁজে গুহায় যেতে দেননি। এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট নিদর্শনগুলো এবং হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর প্রতি অবতীর্ণ সাকিনা(প্রশান্তি), আর সুরাক্কা ইবনে মালেকের ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে মুহাদ্দেসীন ও সীরাহ-লেখকবৃন্দ কর্তৃক লিখিত মহানবী (ﷺ)-এর গুহায় অবস্থান ও মদীনায় হিজরতের ইতিহাসে।


আল্লাহতা’লা আরো ঘোষণা করেন: “হে মাহবূব! নিশ্চয় আমি আপনাকে ’কাউসার’ (অসংখ্য গুণাবলী) দান করেছি; সুতরাং আপনি আপনার রবের জন্যে নামায পড়ুন এবং ক্কোরবানী করুন। নিশ্চয় যে আপনার শত্রু, সে-ই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত (নির্বংশ হবে)” [আল-কুরআন, ১০৮:১-৩]।

আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-কে যা যা দিয়েছেন, তার সবই তাঁকে জানিয়েছেন। বলা হয় যে ‘কাউসার’ বলতে তাঁর হাউয (জলাধার)-কে বোঝানো হয়েছে। এ কথাও বলা হয়েছে যে এটা বেহেশতে অবস্থিত একটা নদী; অফুরন্ত আশীর্বাদ; শাফায়াত তথা সুপারিশ; তাঁর অগণিত মো’জেযা তথা অলৌকিকত্ব; তাঁর নবুওয়্যত; কিংবা এলমে গায়ব বা অদৃশ্য জ্ঞান। অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর শত্রুদেরকে জবাব দিয়েছেন এবং খণ্ডন করেছেন এই বলে, “নিশ্চয় যে আপনার শত্রু, সে-ই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত (নির্বংশ হবে)।” এতে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি হচ্ছে আপনারই শত্রু এবং আপনাকে যে ব্যক্তি ঘৃণা করে। “বঞ্চিত” (নির্বংশ) মানে গরিব ও অপমানিত, কিংবা একাকী অবস্থায় প্রত্যাখ্যাত, অথবা তার মধ্যে কোনো রকম ভালাই না থাকা। [মুফতী আহমদ এয়ার খান (رحمة الله) তাঁর ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, “ফলে, তার ভাগ্যে না ঈমান জুটবে, না উত্তম চর্চা, না বরকত, না কোনো মঙ্গল, না পরকালে সে ক্ষমা পাবে। সুতরাং ‘আস্ ইবনে ওয়াইলের যদিও সন্তান-সন্ততি ছিলো, তবুও মহান রব তার সন্তানদেরকে ঈমানের ক্ষমতা দান করে প্রকারান্তরে তাকে নিঃসন্তান করে দিয়েছেন।”]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং নিশ্চয় আমি আপনাকে সপ্ত-আয়াত (সাবআ’ন্ মিনাল মাসা’নী) প্রদান করেছি, যেগুলো পুনঃপুনঃ আবৃত্ত হয় আর শ্রেষ্ঠত্বসম্পন্ন কুরআন” [আল-কুরআন, ১৫:৮৭; তাফসীরে নূরুল এরফান]।


এটা বলা হয় যে সপ্ত-আয়াত (সাবআ’ন্ মিনাল মাসা’নী) হচ্ছে প্রথম দীর্ঘ সূরাগুলো; আর ‘কুরআনুল আযীম’(শ্রেষ্ঠত্বসম্পন্ন কুরআন) বলতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে উম্মূল কুরআন তথা সূরা ফাতিহাকে। এ কথাও বলা হয়েছে যে সপ্ত-আয়াত বলতে স্বয়ং উম্মূল কুরআন তথা সূরা ফাতেহাকে বুঝিয়েছে এবং শ্রেষ্ঠত্বসম্পন্ন কুরআন বলতে বোঝানো হয়েছে কুরআন মজীদের বাকি অংশকে। আরো বলা হয়েছে যে সপ্ত-আয়াত বলতে আল-কুরআনে নিহিত (খোদায়ী) আদেশ ও নিষেধ, খোশ-খবরী (সুসংবাদ) ও সতর্কবার্তা, আশীর্বাদের রূপক ও ক্রমিক বর্ণনাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এর অর্থ আরেক কথায়, “আমি আপনাকে শ্রেষ্ঠত্বসম্পন্ন কুরআনের খোশ-খবরী দিয়েছি।” এই কথা বলা হয়েছে যে উম্মূল কুরআন (সূরা ফাতেহা)-কে “মাসা’নী” অভিহিত করা হয় এ কারণে যে, প্রতি ওয়াক্ত নামাযে এটা অন্ততঃ দু’বার পাঠ করা হয়। এ-ও বলা হয়েছে যে আল্লাহতা’লা এটাকে অন্যান্য আম্বিয়া (عليه السلام)-এর পরিবর্তে হযরতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জন্যেই সুনির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। আল্লাহতা’লা আল-কুরআনকে “মাসা’নী” অভিহিত করেছেন, কেননা এতে কাহিনীগুলো পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা হয়েছে। এ কথা বলা হয়েছে যে “সপ্ত-আয়াত” মানে “আমি আপনাকে মহা-মর্যাদার সাতটি চিহ্ন দ্বারা সম্মানিত করেছি: হেদায়াত (সঠিক পথপ্রদর্শন), নবুওয়্যত, করুণা, শাফায়াত (সুপারিশ), বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা ও প্রশান্তি।”


আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন: “এবং হে মাহবূব! আমি আপনার প্রতি এ স্মৃতি (যিকর তথা আল-কুরআন)) অবতীর্ণ করেছি যেন আপনি মানুষের কাছে তা (খোলাসাভাবে) বর্ণনা করেন” [আল-কুরআন, ১৬:৪৪; তাফসীরে নূরুল এরফান]। এবং অন্যত্র এরশাদ করেন:“এবং হে মাহবূব! আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি, এমন রেসালাত সহকারেই যা সমগ্র মানবজাতিকে পরিব্যাপ্ত করে নেয় সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপে” [আল-কুরআন, ৩৪:২৮; প্রাগুক্ত নূরুল এরফান]। এবং আরো এরশাদ ফরমান: “হে রাসূল, আপনি বলুন, ওহে মানবকুল! আমি তোমাদের সবার প্রতি (প্রেরিত) আল্লাহর ওই রাসূল” [আল-কুরআন, ৭:১৫৮]।


মহানবী (দ;)-এর প্রতি আল্লাহর মঞ্জুরিকৃত বিশেষ নেয়ামত (আশীর্বাদ)-গুলোর এটা একটা। আল্লাহ ঘোষণা করেন: “এবং আমি প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি যেন তিনি তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলে দেন” [আল-কুরআন, ১৪:৪]। আল্লাহতা’লা (পূর্ববর্তী) পয়গম্বরবৃন্দের জন্যে নিজ নিজ জাতিকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন, যেমনটি হুযূর পূর নূর (ﷺ) স্বয়ং এরশাদ ফরমান: আমি সমগ্র মানবকুলের জন্যে (রাসূল হিসেবে) প্রেরিত হয়েছি।”


আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “এই নবী (ﷺ), মুসলমানদের আপন আপন প্রাণ অপেক্ষাও সন্নিকটে (মানে তাদের প্রাণের ওপর তাঁর মালিকানা বেশি), এবং তাঁর স্ত্রীবৃন্দ হলেন তাদের মা” [আল-কুরআন, ৩৩:৬]।


কুরআন তাফসীরবিদমণ্ডলী বলেন যে “মুসলমানদের আপন আপন প্রাণ অপেক্ষাও সন্নিকটে”, এ আয়াতটির অর্থ মহানবী (ﷺ) মুসলমানদেরকে যা নির্দেশ দেন, তা-ই তাদেরকে পালন করতে হবে, যেমনিভাবে কোনো গোলাম তার মনিবের নির্দেশ পালন করে থাকে। এ কথা বলা হয়েছে যে কারো নিজস্ব মতামত মেনে চলার চেয়ে রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই উত্তম। “তাঁর স্ত্রীবৃন্দ হলেন তাদের মা”, এ আয়াতটির অর্থ তাঁরা আমাদের মায়ের মর্যাদা ভোগ করে থাকেন। মহানবী (ﷺ)-এর বেসালপ্রাপ্তির পরে তাঁদের আর কারো সাথে বিয়ে হতে পারবে না। এটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রদত্ত এক মহা সম্মান ও বিশেষ নেয়ামত। এটা এ কারণে যে তাঁরা বেহেশতেও তাঁরই স্ত্রী। কুরআন মজীদের একটি (বিরল) সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত আছে: “মহানবী (ﷺ) মো’মেনবর্গের পিতা।” কিন্তু এটা আর এখন তেলাওয়াত করা হয় না, কেননা এটা হযরত উসমান (رضي الله عنه)-এর আল-কুরআনের প্রমিত সংস্করণের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ।

আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “এবং আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব (ঐশীগ্রন্থ) ও হেকমত (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) অবতীর্ণ করেছেন” [আল-কুরআন, ৪:১১৩] এবং “আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে” [৪:১১৩]। এ কথা বলা হয় যে ওই “মহা অনুগ্রহ” বলতে নবুওয়্যতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, কিংবা সেসব খোদায়ী দানকে যা মহানবী (ﷺ) ইতোমধ্যেই প্রাক-অনন্তকালে পেয়ে গিয়েছেন। আল-ওয়াসিতী বলেন যে এটা হুযূর পাক (ﷺ) কর্তৃক (খোদাতা’লাকে মে’রাজ রাতে) দেখার ক্ষমতা, যা হযরত মূসা (عليه السلام) ধারণ করতে পারেননি।


দ্বিতীয় অধ্যায়: মহানবী (ﷺ)-এর সুমহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গঠনকে আল্লাহর পূর্ণতাদান এবং দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় সুন্দর নৈতিকতা দ্বারা তাঁকে সমৃদ্ধকরণ


অবতরণিকা


মহান রাসূল (ﷺ)-কে যে ব্যক্তি ভালোবাসেন এবং তাঁর পবিত্র সত্তার অমূল্য রত্নভাণ্ডারের সম্পূর্ণ বিবরণ যিনি খুঁজছেন, তাঁর এটা জানা আবশ্যক যে কোনো ব্যক্তিত্বের সুন্দর ও নিখুঁত বৈশিষ্ট্যগুলোকে দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়:


১/ সেসব বৈশিষ্ট্য যেগুলো জন্মগত এবং এই পৃথিবীতে জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। যেমন – প্রাকৃতিক আকার-আকৃতি ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি।


২/ সেসব বৈশিষ্ট্য যেগুলো দ্বীন তথা ধর্মের অংশ হিসেবে অর্জিত। এগুলো এমন বিষয় যার জন্যে কাউকে প্রশংসা করা হয় এবং যেটা কাউকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে আসে।


এসব গুণকে আরো দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়:


১/ এমন গুণাবলী যা একেবারেই সহজাত/জন্মগত, নয়তো অর্জিত।


২/ এমন গুণাবলী যা সহজাত/জন্মগত ও অর্জিত উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত।


সহজাত বা জন্মগত গুণাবলী অর্জনে মানুষের কোনো পছন্দ-অপছন্দ কিংবা সামর্থ্য নেই। এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে শারীরিক গঠনের উৎকর্ষ, শারীরিক সৌন্দর্য, ধীশক্তি, উপলব্ধির তীক্ষ্ণতা, বাগ্মিতা, তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয় চেতনা, হাত ও পায়ের শক্তি, ভারসাম্য, বুনিয়াদি খান্দান, কারো জাতীয় সংহতি ও বল, দেশীয় গৌরব ও সম্মান।


এটার সাথে আরো জড়িত রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন – খাদ্য, ঘুম, বস্ত্র, বাসস্থান, বিয়ে-শাদী, জমি-সম্পত্তি ও পদমর্যাদা। তবে এগুলোকে পরবর্তী জগতের সাথে কেবল তখন-ই যুক্ত করা যাবে, যখন এগুলোর নিয়্যত তথা উদ্দেশ্য আল্লাহকে ভয় (তাকওয়া) করার সাথে এবং আল্লাহর রাস্তা অনুসরণে শরীরকে শিক্ষাদানের সাথে যুক্ত করা হবে, যদিও বাস্তবতা হলো এগুলোর সবগুলোকেই প্রয়োজনীয় বিষয়/বস্তু হিসেবে ব্যাখ্যা ও শরীয়তের আইন-কানুন দ্বারা পরিচালিত করা হয়েছে।


আর পরকালের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্জিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে, সেগুলোতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে শরীয়তের সমস্ত উন্নত গুণাবলী/নৈতিকতা ও আদব-কায়দা। যেমন – দ্বীনীচর্চা, জ্ঞানার্জন, আত্মসংযম, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, ন্যায়পরায়ণতা, অল্পে তুষ্টি/ত্যাগী হওয়া, বিনয়, ক্ষমার মনোভাব, সচ্চরিত্র/সতিত্ব, দানশীলতা, সৎসাহসী, নিরহঙ্কার, পৌরুষ, নিরবতা, সুবিচার-সুবিবেচনা, গুরুগাম্ভীর্য, করুণাশীলতা, উত্তম আচার-ব্যবহার, বন্ধুত্ব/সতীর্থদের প্রতি সহমর্মিতা এবং অন্যান্য অনুরূপ গুণ। এগুলোকে এক কথায় ‘সচ্চরিত্র’ বলা যায়।


এসব বৈশিষ্ট্যের কিছু কিছু হতে পারে কারো কারো মাঝে সহজপ্রকৃতি ও (জন্মগত) স্বভাব। অন্যান্যদের মাঝে এগুলো নেই এবং তাদেরকে এগুলো অর্জন করতে হয়। তবে এগুলোর কিছু মৌলিক অংশ কোনো মানুষের মাঝে অবশ্যই বিরাজ করতে হবে, যা ইনশা’আল্লাহ আমরা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবো (পরে)।

এসব দুনিয়াবী/পার্থিব গুণাবলী দ্বারা যদিও (পরকালে) আল্লাহতা’লার ‘চেহারা মোবারক’ (দর্শন) ও পরকালকে উদ্দেশ্য করা হয়নি, তবুও তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি (অর্থাৎ, বুযূর্গানে দ্বীন)-বৃন্দের সর্বসম্মতি অনুযায়ী এগুলোকে সচ্চরিত্র ও সৎ গুণ হিসেবে এখনো বিবেচনা করা যায়। তবে মানুষের এসব গুণ থাকার কারণের ব্যাপারে (উলামা-এ-হক্কানীদের মধ্যে) মতপার্থক্য বিরাজমান।


পরিচ্ছেদ – ১/ মুখবন্ধ


পূর্ণতা ও মহত্ত্বের এসব গুণের মধ্যে এমন কি একটি বা দুটি দ্বারাও যদি কেউ আশীর্বাদধন্য হন, চাই তা হোক বংশ, সৌন্দর্য, ক্ষমতা, জ্ঞান, ধৈর্য, সাহস বা উদারতা, তবে তাঁকে গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং মানুষেরা তাঁকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেবে। মানুষের অন্তরে এসব গুণের প্রতি লালিত ভক্তি-শ্রদ্ধা এগুলোর অধিকারীদেরকে সমাধিস্থ হওয়ার দীর্ঘকাল পরও স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখে।


এমতাবস্থায় ওই অপরিমেয় যোগ্যতাসম্পন্ন মহান সত্তা সম্পর্কে কী বলা যায়, যিনি এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সবগুলোরই এমন প্রাচুর্যের অধিকারী যে সেগুলো গণনা করে শেষ করা যায় না এবং ভাষায় প্রকাশ করা যায় না? তাঁর পক্ষে এগুলো অসাধু উপায়ে বা ধূর্তামি করে অর্জন করা অসম্ভব। এ ধরনের বিষয় কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার দান বা পুরস্কার দ্বারাই পাওয়া সম্ভব। এসব বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নবুওয়্যত, ওহী (ঐশীবাণী) বহন (মানে তা পৌঁছে দেয়া), আল্লাহ পাকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, আল্লাহর মহব্বতপ্রাপ্তি, (আল্লাহ কর্তৃক) মনোনীত হওয়া, মে’রাজ রাতের ঊর্ধ্বভ্রমণ, আল্লাহকে দেখা, মহান প্রভুর নৈকট্য, সামীপ্য, ওহী প্রকাশ, শাফায়াত তথা (আল্লাহর দরবারে) সুপারিশ, ধ্যান-সাধনা, সকল উন্নত গুণ ও নৈতিকতা, সুউচ্চ মর্যাদা, মাকামে মাহমূদ (প্রশংসিত স্থান), বোরাক্ক (আসমানে ঊর্ধ্বগমনের বাহন), মে’রাজ (ঊর্ধ্বগমন), সমগ্র মানবজাতির প্রতি (রাসূল হিসেবে) প্রেরিত হওয়া, নামাযে সমস্ত আম্বিয়া (عليه السلام)-এর হয়ে ইমামতি করা, পয়গম্বরমণ্ডলী ও তাঁদের নিজ নিজ জাতির ব্যাপারে সাক্ষী হওয়া, বনী আদমের ওপর কর্তৃত্ব, প্রশংসার পতাকা/ঝাণ্ডাধারী হওয়া, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হওয়া, আরশের অধিপতির কাছে তাঁর স্থান, আনুগত্য, আস্থাভাজন, হেদায়াতপ্রাপ্ত, বিশ্বজগতের জন্যে খোদায়ী করুণা (রহমত), তাঁর প্রতি আল্লাহর এমন রেযামন্দি যে তিনি ফরিয়াদ করার অনুমতিপ্রাপ্ত, কাউসার, তাঁর আর্জি শ্রুত হওয়া, তাঁর প্রতি বর্ষিত আশীর্বাদের পূর্ণতা, অতীত ও ভবিষ্যতের যাবতীয় কাজে আল্লাহ পাকের ক্ষমা, বক্ষ (অন্তর) প্রশস্তকরণ, তাঁর পবিত্র কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে দেয়া, তাঁর স্মরণকে সমুন্নতকরণ, মহান বিজয় লাভ, সাকিনা (প্রশান্তি) তাঁর প্রতি অবতীর্ণ করা, ফেরেশতাদের সমর্থন, তাঁর কিতাবুল্লাহ ও হেকমত (জ্ঞান-প্রজ্ঞা) এবং সপ্ত-আয়াত ও মহান কুরআন নিয়ে আসা, তাঁর উম্মতের পরিশুদ্ধি লাভ, তাঁর দ্বারা আল্লাহকে ডাকা, তাঁর প্রতি আল্লাহতা’লা ও ফেরেশতাদের সালাত-সালাম পেশ, আল্লাহ তাঁকে যা দেখিয়েছেন তা দ্বারা মানুষের মধ্যে তাঁর বিচার করা, তাঁর দ্বারা তাদের শেকল ও বোঝা অপসারণ, আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁর নাম মোবারক উচ্চারণ করে শপথ করা, তাঁর দোয়া কবূল তথা গৃহীত হওয়া, জড় বস্তুর ও জন্তু-জানোয়ারের তাঁর সাথে কথা বলা, তাঁরই খাতিরে মৃতদেরকে জীবিত করা, বধিরের শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়া, তাঁর আঙ্গুল মোবারক থেকে পানির নহর প্রবাহিত হওয়া, তাঁর দ্বারা অল্পকে আধিক্যে পরিণত করা, চাঁদ দ্বি-খণ্ডিতকরণ, সূর্যকে ফেরত পাঠানো, বিভিন্ন বস্তুর মৌলিক পরিবর্তন সাধন [যেমন – ‘উকাশার লাঠি তাঁর হাতে তরবারিতে পরিবর্তিত হয়], (খোদায়ী) ভয়ভীতি দ্বারা তাঁকে সমর্থনদান (মানে তাঁর কথা না মানায় গযব/আযাব অবতীর্ণ হওয়া), এলমে গায়ব তথা (খোদায়ী) অদৃশ্য জ্ঞান তাঁর জানা, মেঘমালা তাঁকে ছায়া দেয়া, তাঁর হাতের মুঠোয় কঙ্কর কর্তৃক প্রশংসাস্তুতি পাঠ, তাঁর দ্বারা ব্যথা উপশম, লোকদের ক্ষতি থেকে তাঁকে (আল্লাহর) রক্ষা করা ইত্যাদি। আর তাঁকে আল্লাহতা’লা যা দান করেছেন, এগুলো তার কয়েকটি মাত্র। আরো অনেক আছে। তাঁর (অনন্য) বৈশিষ্ট্যগুলোর জ্ঞান শুধু তিনি-ই ধারণ করতে পারেন, যাঁকে সে সামর্থ্য দান করা হয়েছে, আর একমাত্র আল্লাহতা’লা-ই তা দান করতে সক্ষম। আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ (উপাস্য) নেই।

এসবের সাথে যোগ করুন সুউচ্চ মর্যাদা (মাকাম), পবিত্রতার মাত্রা, সুখ-শান্তি, মাহাত্ম্য ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির স্তরসমূহ-ও, যা আল্লাহ পাক তাঁর জন্যে আখেরাত তথা পরকালে প্রস্তুত করে রেখেছেন, যা গণনারও অতীত, যা মস্তিষ্ক-ও উপলব্ধি করতে অক্ষম, আর যা কল্পনাকেও হতভম্ব করে।


পরিচ্ছেদ – ২/ মহানবী (ﷺ)-এর শারীরিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডলী


মহানবী (ﷺ) যে সমগ্র মানবজাতির মাঝে যোগ্যতম সত্তা, মর্যাদার দিক দিয়ে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সৎ গুণাবলী ও নৈতিকতায় সবচেয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও নিখুঁত, এ বাস্তবতা গোপন করার কোনো উপায়-ই নেই। তাঁর নিখুঁত গুণাবলীর বিস্তারিত বিবরণ আমার সাধ্যমতো প্রদান করতে আমি এক্ষণে সচেষ্ট হবো; তবে এ পর্যায়ে তাঁর কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে (সবার) মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠেছে।


আল্লাহতা’লা যেন আমার ও আপনার অন্তরকে আলোকিত করেন এবং এই মহান রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি আমার ও আপনার মহব্বত বৃদ্ধি করে দেন (আমীন)। জেনে রাখুন, আপনি যদি ওই সমস্ত অনুপম বৈশিষ্ট্য ও গুণের সবগুলোর দিকে লক্ষ্য করেন, যা অর্জন করা অসম্ভব এবং যা কারো মৌলিক সত্তার অংশবিশেষ, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন মহানবী (ﷺ) এগুলোর সবই ধারণ করেছিলেন; অর্থাৎ, সমস্ত সৎ গুণেরই তিনি অধিকারী; আর এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণনাকারীদের কোনো মতপার্থক্যই নেই।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শারীরিক সৌন্দর্য ও নিখুঁত হাত-পায়ের সামঞ্জস্য অসংখ্য নির্ভরযোগ্য আহাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোর বর্ণনাকারী হচ্ছেন সর্ব-হযরত আলী (ক:), আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه), আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه), আল-বারা’আ ইবনে আযিব (رضي الله عنه), মা আয়েশা (رضي الله عنه), ইবনে আবি হালা (رضي الله عنه), আবূ জুহায়ফা (رضي الله عنه), জাবের ইবনে সামুরা (رضي الله عنه), উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه), ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه), মু’আররিদ ইবনে মু’আয়কিব (رضي الله عنه), আবূত্ তোফায়ল (رضي الله عنه), আল-ঈদা’ ইবনে খালিদ (رضي الله عنه), খুরায়ম ইবনে ফাতেক (رضي الله عنه), হাকীম ইবনে হিযাম (رضي الله عنه) এবং অন্যান্য মোহাদ্দেসীন।


হুযূরে আকরাম (ﷺ)-এর গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল বর্ণের, গভীর কালো চোখযুগল বড় বড় ও রক্তিমাভ, আর চোখের ভ্রুগুলো লম্বা লম্বা; তাঁর গাত্রবর্ণ বিশেষ করে চেহারা ছিল উজ্জ্বল, টিকলো বা খাড়া নাকবিশিষ্ট; আর সামনের সারির দাঁতগুলোর মধ্যে ছিল ফাঁক। তাঁর মুখমণ্ডল ছিল গোল, ললাট প্রশ্বস্ত, আর ঘন শ্মশ্রুমণ্ডিত, যা বুক পর্যন্ত ছিল দীর্ঘ। তাঁর বুক ও পেট একই সমান (আকৃতির) ছিল; বক্ষ ও কাঁধ ছিল প্রশ্বস্ত। তাঁর হাড় ছিল দীর্ঘ, হাতও দীর্ঘ, হাত ও পায়ের পাতা ছিল ঘন, হাতের আঙ্গুল লম্বা, ফর্সা চামড়া, আর বুক থেকে নাভি পর্যন্ত লোম ছিল। তিনি দীর্ঘকায় বা খাটো কোনোটাই ছিলেন না, বরঞ্চ দু’য়ের মাঝখানে ছিলেন। এতদসত্ত্বেও তাঁর সাথে হাঁটায় রত কোনো লম্বা ব্যক্তিকেই তাঁর চেয়ে লম্বা মনে হতো না। তাঁর চুল কোঁকড়াও ছিল না, আবার সোজাও ছিল না। হাসলে তাঁর দাঁত দেখা যেতো, যাকে মনে হতো বিদ্যুতের চমকের মতো, কিংবা শিলাবৃষ্টিতে শিলার মতো সাদা। তিনি কথা বল্লে তাঁর দাঁত মোবারক থেকে যেন আলো বের হতো। তাঁর পবিত্র ঘাড় ছিল ভালোভাবে গঠিত, যা প্রশ্বস্ত বা মোটা নয়। তাঁর জিসম (শরীর) মোবারক ছিল ঘনভাবে বিন্যস্ত যা আবার মাংসল ছিল না।


আল-বারা’আ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি লাল জুব্বার ওপর এলানো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চুল মোবারকের চেয়ে সুন্দর আর কারো চুল (জীবনে) দেখিনি।”


হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি মহানবী (ﷺ)-এর চেয়ে সুন্দর আর কাউকেই দেখিনি। তাঁর চেহারা মোবারকে যেন সূর্য কিরণ ছড়াতো। তিনি হাসলে দেয়ালে তা প্রতিফলিত হতো।”


হযরত জাবের ইবনে সামুরা (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করা হয়: “রাসূল (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক কি তরবারির মতো ছিল দেখতে?” তিনি উত্তর দেন, “না, তা ছিল চাঁদ ও সূর্যসদৃশ; গোলাকৃতির” [আল-বোখারী ও মুসলিম এবং অন্যান্য মুহাদ্দেসীন]।


হযরত উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه) তাঁর বর্ণনায় বলেন, “দূর থেকে দেখতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, আর কাছ থেকে অনিন্দ্য সুন্দর” [আল-বায়হাকী]।


ইবনে আবি হালা (رضي الله عنه) বলেন, “তাঁর মুখমণ্ডল চাঁদের মতোই কিরণ ছড়াতো।”


হযরত আলী (ক:) নিজ বর্ণনার শেষে বলেন, “কেউ তাঁকে হঠাৎ দেখলে শ্রদ্ধাপ্লুত হতেন। তাঁর সান্নিধ্য লাভকারী ব্যক্তিবৃন্দ তাঁকে মহব্বত করতেন।”


মহানবী (ﷺ)-এর বর্ণনাকারী সবাই এ কথা বলেছেন যে তাঁরা ইতিপূর্বে বা পরবর্তী সময়ে এমন কাউকেই দেখেননি।


বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বর্ণনাসম্বলিত অনেক প্রসিদ্ধ হাদীস বিদ্যমান। আমরা এখানে সবগুলো বিবৃত করার সময় নেবো না। তাঁর এসব বর্ণনার কয়েকটি দিক নিয়েই আমরা নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রেখেছি এবং এগুলোর একটি সংক্ষিপ্তসার পেশ করেছি, যা আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে যথেষ্ট।

ইনশা’আল্লাহ আমরা এই পরিচ্ছেদগুলোর শেষে (অপর) একখানা হাদীস বর্ণনা করবো, যা’তে এসব বিষয়ের পুরোটুকুই সংযুক্ত থাকবে।


পরিচ্ছেদ – ৩/ তাঁর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা


মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র শরীরের পরিপূর্ণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, তাঁর শরীর ও ঘাম হতে নির্গত মিষ্টি সুগন্ধ, আর অপরিচ্ছন্নতা ও শারীরিক ত্রুটি হতে তাঁর মুক্ত থাকা আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁকে দানকৃত এক বিশেষ গুণেরই অন্তর্ভুক্ত যা অন্য কারো নেই; আর এগুলো অধিকতর পূর্ণতা পেয়েছে সেই পরিচ্ছন্নতা দ্বারা, যা শরীয়ত ও ‘ফিতরা’ তথা স্বাভাবিক আচরণের দশটি অনুশীলনীয় প্রথা অনুযায়ী অবশ্য পালনীয়। [হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বর্ণিত ও মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ এক হাদীস অনুসারে এগুলো হচ্ছে মোচ ছেঁটে ফেলা বা ছোট করা, দাড়ি বড় করা, খিলাল ব্যবহার করা, নাকের ভেতরে পানি দেয়া, নখ কাটা, হাতের কব্জি ধোয়া, বগলের লোম কাটা, তলপেটের লোম কাটা, (স্নানাগারে) নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। রেওয়ায়াতকারিনী (মা আয়েশা) দশমটি ভুলে গিয়েছিলেন, তবে ভেবেছিলেন এটা মুখে কুলি হতে পারে। অপর এক বর্ণনায় দাড়ি বৃদ্ধির পরিবর্তে খতনা এসেছে]


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “দ্বীন তথা ধর্ম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর ভিত্তিশীল।” [হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে ইবনে হিব্বান; যয়ীফ তথা দু্র্বল]


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ)-এর সুগন্ধের চেয়ে অধিক সুগন্ধময় মেশকে আম্বর বা অন্য কোনো কিছুর ঘ্রাণ আমি গ্রহণ করিনি।” [মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরীফ] 


হযরত জাবের ইবনে সামুরা (رضي الله عنه) বলেন যে হুযূর পূর নূর (ﷺ) তাঁর গাল স্পর্শ করেন। তিনি আরো বলেন, “আমি এক শীতল পরশ অনুভব করি এবং তাঁর হাত মোবারক এমন-ই সুগন্ধিময় ছিল যেন তিনি তাঁর পবিত্র হাত কোনো সুগন্ধিভর্তি থলে থেকে বের করেছিলেন।” [মুসলিম]


অন্য কেউ একজন বলেন, “তাঁর পবিত্র হাতে সুগন্ধি ব্যবহার করুন বা না-ই করুন, তিনি কারো সাথে মুসাফাহা (করমর্দন) করলে ওই ব্যক্তির হাতে সুগন্ধ সারা দিন বিরাজ করতো। কোনো শিশুর মাথায় তিনি হাত মোবারক রাখলে ওই শিশুকে সুগন্ধের কারণে অন্যান্য শিশুদের মাঝে আলাদাভাবে চেনা যেতো।”


একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর বাড়িতে ফরাশের ওপর ঘুমিয়েছিলেন এবং তিনি (গরমে) ঘামছিলেন। হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর মা সাহেবা একটি লম্বা মুখবিশিষ্ট বোতল আনেন যাতে তাঁর ঘাম সংরক্ষণ করা যায়। মহানবী (ﷺ) তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন, “আমরা এগুলো আমাদের সুগন্ধিতে মেশাই, যার দরুন তা সেরা সুগন্ধিতে পরিণত হয়।” [মুসলিম ও বোখারী শরীফ]


ইমাম বোখারী (رحمة الله) তাঁর ‘মহা ইতিহাস’ গ্রন্থে হযরত জাবের (رضي الله عنه)-কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনো রাস্তা ধরে গেলে তাঁকে অনুসরণকারী যে কেউ বুঝতে পারতেন তিনি এ রাস্তা ধরে গিয়েছেন।”


এসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (رضي الله عنه) উল্লেখ করেন যে মহানবী (ﷺ)-এর এই সুগন্ধ কোনো সুগন্ধির ব্যবহার ছাড়াই হতো।


আল-মুযানী ও আল-হারবী বর্ণনা করেন হযরত জাবের (رضي الله عنه)-এর কথা, যিনি বলেন: “হুযূর পূর নূর (ﷺ) একবার আমাকে সওয়ারে তাঁর পেছনে বসতে দেন। এমতাবস্থায় আমি তাঁর পিঠে অবস্থিত মোহরে নবুওয়্যতে হাত রাখি, আর মেশকে আম্বরের সুগন্ধি আমার মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।”


মহানবী (ﷺ) ও তাঁর বৈশিষ্ট্যসম্পর্কিত হাদীসশাস্ত্রের এক জ্ঞান বিশারদ (মুহাদ্দীস) বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (ﷺ) যখন মল-মূত্র ত্যাগ করতে চাইতেন, তখন মাটি দু’ভাগ হয়ে যেতো এবং তা অভ্যন্তরে গ্রহণ করতো; আর তা থেকে সুগন্ধ বের হতো।


আল-ওয়াকিদীর কাতেব/লেখক মুহাম্মদ ইবনে সা’আদ বর্ণনা করেন যে হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি আরয করেন, “হে আল্লাহর নবী (ﷺ), আপনি মল-মূত্র ত্যাগ করে ফিরলে আমরা কোনো অনিষ্টকর কিছু আপনার কাছ থেকে দেখি না।” হুযূর করীম (ﷺ) উত্তর দেন, “আয়েশা, তুমি কি জানো না আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মল-মূত্র মাটি খেয়ে ফেলে, যাতে ওগুলোর কিছুই দেখা না যায়।” [আদ-দারাকুতনী বর্ণিত এই হাদীসটির যদিও এসনাদ সুদৃঢ়, তবুও এটা প্রসিদ্ধ তথা বহুল পরিচিত নয়]  

এই হাদীসটি প্রসিদ্ধ না হলেও (হক্কানী) আলেম-উলামাবৃন্দ হুযূর পাক (ﷺ)-এর মল-মূত্রের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করে থাকেন। ইমাম শাফেঈ (رحمة الله)-এর জনৈক সহচর এটা বলেছেন এবং ইমাম আবূ নাসর সাব্বাগ এটা তাঁর সংকলনে বর্ণনা করেছেন। ‘উলামা-এ-কেরাম’ ওপরের দুটো বক্তব্য-ই বর্ণনা করেছেন। আবূ বকর ইবনে সাবিক আল-মক্কী তাঁর কৃত মালেকী মযহাবের ফেকাহ’র শাখাবিষয়ক ‘আল-বাদী’ বই, যা’তে মালেকী মযহাবের অংশ নয় বরং শাফেঈ উলামাদের অমুখ্য সিদ্ধান্ত হতে নিঃসৃত বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে এসব বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, মহানবী (ﷺ)-এর কাছ থেকে আপত্তিকর বা অপ্রীতিকর কোনো কিছুই আগমন করেনি।


এই বিষয়ের সাথে সংযুক্ত আরেকটি রেওয়ায়াত (বর্ণনা) আমরা দেখতে পাই, যা হযরত আলী (ক:) হতে এসেছে; তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে (বেসালের পরে) গোসল দেই, আর আমি তা-ই খুঁজতে থাকি, যা কোনো মরদেহে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু আমি কোনো কিছুই খুঁজে পাইনি। (অতঃপর) আমি বলি, ‘আপনি (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে ছিলেন খাঁটি ও নির্মল, আর বেসালেও তা-ই’।” হযরত আলী (ক:) আরো যোগ করেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছ থেকে (ওই সময়) এক মিষ্টি সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল, যার অভিজ্ঞতা আমি আগে কখনোই লাভ করিনি।” [ইবনে মাজাহ, আবূ দাউদ, আল-হাকীম ও আল-বায়হাকী]


হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বেসালের পরে বুসা দিলে তিনিও অনুরূপ এক অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। [হযরত উমর (رضي الله عنه) হতে সহীহ সনদে আল-বাযযার বর্ণিত]


আরেকবার হযরত মালেক ইবনে সিনান (رضي الله عنه) উহুদের জ্বেহাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রক্ত মোবারক পান করেন এবং তা চেটে খান। মহানবী (ﷺ) তাঁকে তা করতে দেন এবং এরপর বলেন, “দোযখের আগুন তোমাকে স্পর্শ করবে না।”


[হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رحمة الله) হতে আত্ তাবারানী এবং হযরত উমর ইবনে আস্ সা’ইব (رضي الله عنه) হতে আল-বায়হাকী বর্ণিত]


হুযূর পাক (ﷺ)-এর শিঙ্গা অস্ত্রোপচারের সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (رضي الله عنه) তাঁর রক্ত পান করলে একই রকম ঘটনা ঘটে। মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “মানুষের কাছ থেকে তোমার প্রতি দুঃখ, আর তোমার কাছ থেকেও মানুষের প্রতি দুঃখ।” কিন্তু তিনি ওই সাহাবী যা করেছেন, তাতে আপত্তি করেননি। [সহীহ সনদে এটা বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আল-হাকাম, আল-বাযযার, আদ্ দারাকুতনী, আল-বায়হাকী, আল-বাগাবী ও আত্ তাবারানী]


এ রকম আরেকটি বর্ণনা এসেছে এক মহিলা সম্পর্কে, যিনি নবী করীম (ﷺ)-এর প্রস্রাব মোবারক পান করেছিলেন। তিনি ওই মহিলাকে বলেন, “তুমি আর কখনোই পেটের ব্যথায় (পীড়ায়) ভুগবে না।” [আল-হাকীম বর্ণিত এবং আয-যাহাবী ও আদ্ দারাকুতনী কর্তৃক সমর্থিত]


মহানবী (ﷺ) এসব সাহাবী (رضي الله عنه)-এর কাউকেই মুখ ধুয়ে ফেলতে বলেননি, অথবা একাজ আর করতে নিষেধও করেননি।


প্রস্রাব পানকারিনী মহিলার হাদীসটি সহীহ। আদ্ দারাকুতনী সর্ব-ইমাম বোখারী ও মুসলিমের অনুসরণ করে সহীহ’তে বর্ণনা করেন। এই মহিলার নাম বারাকা, তবে তাঁরা (মুহাদ্দেসীন) তাঁর বংশের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন এ মহিলা উম্মে আয়মান (رضي الله عنه), যিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমত করতেন। তিনি (উম্মে আয়মান) বলেন যে মহানবী (ﷺ)-এর একটি কাঠের পাত্র ছিল, যেটা তাঁর খাটের নিচে থাকতো এবং রাতে যেটাতে তিনি প্রস্রাব করতেন। এক রাতে তিনি তাতে প্রস্রাব করেন এবং সকালে পরীক্ষা করে তা শূন্য দেখতে  পান। তিনি বারাকাকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে তৃষ্ণার্ত ছিলাম। তাই না জেনেই তা পান করেছি।” এই হাদীস ইবনে জুরায়জ ও অন্যান্য হাদীসবেত্তা বর্ণনা করেন।


মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) খতনা অবস্থায় হয় এবং তাঁর নাড়িও কাটা ছিল। বর্ণিত আছে যে তাঁর মা আমিনা (আল্লাহ তাঁকে পরকালীন শান্তি দিন) বলেন, “রাসূল (ﷺ)-এর বেলাদত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অবস্থায় হয়েছিল। তাঁর শরীরে কোনো অপবিত্রতা বা অপরিচ্ছন্নতা ছিল না।”


হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি কখনোই মহানবী (ﷺ)-এর গোপন অঙ্গ দেখিনি।” [আল-বাযযার ও আল-বায়হাকী]


হযরত আলী (ক:) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেন যেন আমি ছাড়া আর কেউই তাঁর বেসালের পরে তাঁকে গোসল না দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কেউই আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে অন্ধ না হয়ে যায়নি’।” [প্রাগুক্ত আল-বাযযার ও আল-বায়হাকী]


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে হযরত একরেমা ইবনে আবদিল্লাহ (رضي الله عنه) বর্ণিত একটি হাদীস অনুযায়ী মহানবী (ﷺ) একবার এমন নিদ্রাগত ছিলেন যে তাঁর গভীর নিঃশ্বাস নেয়ার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। অতঃপর তিনি ঘুম থেকে জেগে বিনা ওযূতে নামায আদায় করেন [আল-বোখারী ও মুসলিম]। হযরত একরেমা (رضي الله عنه) বলেন, “এটা এ কারণে যে তিনি রক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন।”


পরিচ্ছেদ – ৪/ তাঁর মেধা, বাগ্মিতা ও ধীশক্তির তীক্ষ্ণতা


মহানবী (ﷺ)-এর মেধা, বুদ্ধিমত্তা, ইন্দ্রিয়শক্তির তীক্ষ্ণতা, বাগ্মিতা, চাল-চলনে পরিমার্জিত আচরণ ও সহজাত (মানসিক) গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে সকল মানুষের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ এক সত্তা।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি এবং সর্বসাধারণের ও (সমাজের) গণ্যমান্য ব্যক্তিদের রাজনীতি যেভাবে সামাল দিতেন সে সম্পর্কে এবং তাঁর বিস্ময়কর গুণাবলী ও বিস্ময়ে ভরা (যাহেরী) জীবন সম্পর্কে, আর তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছুরিত জ্ঞানের জ্যোতি ও পূর্ব-নির্দেশনা, পূর্ব-অভিজ্ঞতা, বা বইপত্র পাঠ ব্যতিরেকেই তাঁর দ্বারা শরীয়তের বিধান জারি করার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো সম্পর্কে কেউ গভীরভাবে চিন্তা করলে তার মনে মহানবী (ﷺ)-এর মেধার শ্রেষ্ঠত্ব এবং উপলব্ধির গভীরতা ও দৃঢ়তা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ-ই থাকবে না। এগুলোর কোনোটিরই সমর্থনসূচক প্রামাণ্য দলিলের দরকার নেই, কেননা এ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই পর্যাপ্তভাবে যাচাই করা হয়েছে।


ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ্ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি একাত্তরটি বই পড়েছি, আর সেগুলোর সবের মাঝে আমি দেখতে পেয়েছি যে মহানবী (ﷺ)-এরই সর্বশ্রেষ্ঠ ধীশক্তি ও সেরা মতামত (দৃষ্টিভঙ্গি) বিদ্যমান।” অন্য এক বর্ণনায় ভাষ্যটি নিম্নরূপ: “আমি এসব পুস্তকে দেখেছি যে আল্লাহতা’লা দুনিয়ার সূচনালগ্ন হতে শেষ অবধি মানবজাতিকে যে মেধা/ধীশক্তি দান করেছেন, তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মেধার তুলনায় এক শস্যদানার মতোই।”


মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন, “হুযূর পাক (ﷺ) যখন নামাযে (ইমামতি করতে) দাঁড়াতেন, তখন তিনি পেছনে দাঁড়ানো সবাইকেই (স্পষ্ট) দেখতে পেতেন, ঠিক যেমনটি তিনি সামনে দেখতে পেতেন” [ইবনে মুনযির ও আল-বায়হাকী বর্ণিত (মুরসাল)]। এটা আল্লাহতা’লার কালামের ওপর কৃত একটি তাফসীরকে সমর্থন দেয়, যা’তে ঘোষিত হয়েছে: “যিনি (আল্লাহ) দেখেন নামাযীদের মধ্যে আপনার পরিদর্শনার্থে ভ্রমণকেও” (আল-কুরঅান, সূরা শুয়ারা, ২১৯ আয়াত)।


’মুওয়াত্তা’ হাদীসগ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে, যিনি বলেন: “পেছনেও আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই।” বুখারী ও মুসলিম দুটো সহীহ হাদীসগ্রন্থেও অনুরূপ বক্তব্য হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) একই বর্ণনা উদ্ধৃত করার পর নিজ হতে আরো যোগ করেন, “এটা অতিরিক্ত এমন কিছু যা আল্লাহতা’লা তাঁকে সমর্থনসূচক প্রমাণ হিসেবে দান করেছিলেন।” অপর এক হাদীসে এসেছে এভাবে, “আমি পেছনদিকে ঠিক সেভাবেই দেখতে পাই, যেভাবে সামনে দেখে থাকি।” আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “আমার ঘাড়ের পেছনে অবস্থানরত ব্যক্তিকে ঠিক সেভাবেই দেখতে পাই, যেভাবে সামনে অবস্থানরত জনকে দেখতে পাই।”

বাক্কী ইবনে মুখাল্লাদ (رضي الله عنه) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “মহানবী (ﷺ) অন্ধকারেও তেমনটি দেখতে পেতেন, যেমনটি তিনি দেখতে সক্ষম ছিলেন আলোতে।” [ইবনে আদ ও আল-বায়হাকী কর্তৃক দুর্বল সনদে বর্ণিত]   


অনেক সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক ফেরেশতাবৃন্দকে দেখার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে [আল-বোখারী ও অন্যান্যদের ভাষ্য নিম্নরূপ: “মহানবী (ﷺ) আসমান ও জমিনের মাঝখানে ছয়’শ ডানাসহ হযরত জিবরাঈল আমীন (عليه السلام)-কে একটি সিংহাসনের ওপর উপবিষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, আর তিনি (জিবরাঈল) দিগন্তকে আড়াল করে রেখেছিলেন”]। তিনি শয়তানদেরকেও দেখেছিলেন বলে রেওয়ায়াত করা হয়েছে[আল-বোখারী বর্ণিত হাদীস: “এক ইফরিত (বদমাইশ দেও-দানব) গত সন্ধ্যার মাগরেব নামাযের সময় আমার কাছে একটি (কাঠনির্মিত) আগুনের মশাল নিয়ে এসেছিল আমারই মুখ পোড়াবার (অসৎ) উদ্দেশ্যে। আল্লাহতা’লা আমাকে তার ওপর ক্ষমতাবান করে দেন”]। আবিসিনীয় বাদশাহ নাজ্জাশীর জন্যে যাতে তিনি দোয়া করতে পারেন সেজন্যে ওই বাদশাহকে (আবিসিনিয়ায়) দেখার সামর্থ্য (দিব্যদৃষ্টি) তিনি লাভ করেন [মুসলিম ও আল-বোখারী বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের ভাই নাজ্জাশী বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন; অতএব, ওঠো এবং তাঁর জন্যে প্রার্থনা করো”]। একইভাবে তিনি (মে’রাজ রাতের ভ্রমণে) জেরুসালেম নগরী দেখতে পেয়েছিলেন এবং তা কুরাইশদের কাছে বর্ণনাও করেছিলেন [মুসলিম ও আল-বোখারী]। মদীনা মোনাওয়ারায় মসজিদ (-এ-নববী) নির্মাণ করার সময় তিনি মক্কায় অবস্থিত কা’বা শরীফ-ও দেখতে পেয়েছিলেন।


ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ও অন্যান্য জ্ঞান বিশারদ বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) ’আল-তুরাইয়া’ নামের তারকাগুচ্ছের এগারোটি তারকা (খালি চোখে) দেখতে সক্ষম ছিলেন। এটা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ও অন্যান্যদের মতে খালি চোখে দেখা সম্ভব সর্বোচ্চ সংখ্যক তারকা। এঁদের মধ্যে একজন (ইমাম নববী) বিশ্বাস করেন যে এটা হুযূর পাক (ﷺ)-এর এতদসংক্রান্ত জ্ঞান (ওয়াকেফহাল অবস্থা) সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। তবে এর স্পষ্ট অর্থ ওই মতের সাথে সাংঘর্ষিক, আর মহানবী (ﷺ)-এর এটা করতে না পারার কোনো অসম্ভাব্যতা-ই নেই। কেননা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি আম্বিয়া তথা পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের একটি বিশেষ গুণ এবং তা তাঁদের অনন্য বৈশিষ্ট্যেরই অন্তর্ভুক্ত।


হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) উদ্ধৃত করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা যখন হযরত মূসা (عليه السلام)-এর কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, তখন তিনি রাতের অন্ধকারে (প্রায়) ত্রিশ মাইল দূরে পাথরের ওপরে অবস্থিত কোনো পিঁপড়াকেও দেখতে সক্ষম ছিলেন” [ইমাম তাবারানী কৃত ‘আস্ সাগীর’]।


অতএব, নবী করীম (ﷺ)-এর মে’রাজে গমন ও তাঁর রব্বের অন্যতম সেরা নিদর্শন দেখার আশীর্বাদ লাভের পর আমরা এ অধ্যায়ে যা বর্ণনা করেছি, তা তাঁর দ্বারা করা অসম্ভব কোনো ব্যাপারই নয়।


বিভিন্ন হাদীসে জানা যায় যে তিনি তাঁর সময়কার সবচেয়ে বেশি শারীরিক শক্তির অধিকারী আবূ রুকানা নামের ব্যক্তিকে (কুস্তি লড়াইয়ে) আছাড় দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন এবং তার প্রতি ইসলামের দাওয়াত-ও পৌঁছে দিয়েছিলেন। জাহেলীয়্যা যুগের অতি শক্তিধর হিসেবে খ্যাত এই কুস্তিগীরকে তিনি এভাবে তিনবার পরাস্ত করেন।


হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মতো আর কাউকেই এতো দ্রুত হাঁটতে দেখিনি। এ যেন দুনিয়া তাঁর জন্যে বিছানো থাকতো। আমরা হয়রান হলেও তিনি একদম ক্লান্ত হতেন না।” [তিরমিযী ও বায়হাকী]


মহানবী (ﷺ)-এর আরেকটি গুণ ছিল তিনি স্মিতহাস্য করতেন। কারো মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় সরাসরি মুখ করে দাঁড়াতেন। আর হাঁটতে থাকলে মনে হতো যেন তিনি কোনো ঢাল হতে নেমে আসছেন।


পরিচ্ছেদ – ৫/ তাঁর সুন্দর বাচনভঙ্গি ও স্পষ্ট আরবী ভাষা


প্রাঞ্জল ভাষণ দেয়ার ক্ষেত্রে মহানবী (ﷺ)-এর সর্বশ্রেষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। তিনি ছিলেন বচনে সাবলীল, বিতর্কে দক্ষতাসম্পন্ন, অল্প কথায় ব্যাপক অর্থ জ্ঞাপনে সক্ষম, স্পষ্ট প্রকাশভঙ্গিসম্পন্ন, সহজে বোধগম্য ও উত্তম শব্দ ব্যবহারকারী এবং মেকি আচরণ থেকে মুক্ত।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আরবী ভাষার (সকল শব্দের) ওপর (সর্বোৎকৃষ্ট) পাণ্ডিত্য প্রদান করা হয়েছিল, যার অনন্য বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটতো তাঁরই চমৎকার সব প্রবচন দ্বারা। তিনি আরবদের বিভিন্ন আঞ্চলিক/গোত্রীয় ভাষা শিক্ষা করেছিলেন এবং তাদের প্রতিটি গোত্রের সাথেই নিজ নিজ ভাষায় ও নিজস্ব বাগরীতিতে কথা বলতেন। তিনি তাদের আপন আপন রীতি ব্যবহার করে তাদের যুক্তির উত্তর এমনভাবে দিতেন, যার ফলে তাঁর বেশ বড় সংখ্যক সাহাবা (رضي الله عنه) একাধিকবার তাঁকে তিনি (ওই গোত্রগুলোকে) কী বলেছিলেন তা বুঝিয়ে বলার জন্যে অনুরোধ করতেন। হুযূর পাক (ﷺ)-এর হাদীস (বাণী) ও জীবনী যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন, তাঁরা এটা জানেন এবং এর সত্যতা নিশ্চিত করে থাকেন। কুরাইশ, আনসার এবং হেজায ও নজদের মানুষের সাথে তিনি যেভাবে কথা বলেছেন, তা কিন্তু যুল-মিশ’আর আল-হামদানী, তিহফা আল-হান্দী, কাতান ইবনে হারিসা আল-উলায়মী, আল-আশ’আত ইবনে কায়স, ওয়া’ইল ইবনে হুজর আল-কিন্দী এবং হাদরামাউত অঞ্চলের গোত্রপ্রধান ও ইয়েমেনের রাজন্যবর্গের সাথে ব্যবহৃত বাগরীতি নয়। [এই দৃষ্টান্তগুলোর প্রতিপাদ্য হলো, এগুলো বিভিন্ন আরবীয় বাগরীতির প্রতিনিধিত্ব করে, যা কুরাইশ বংশীয়দের মাঝে প্রচলিত আরবী ভাষা হতে বেশ আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল]


হামদান গোত্রের প্রতি মহানবী (ﷺ)-এর লিখিত পত্রের দিকে লক্ষ্য করুন: “তোমাদের অধিকারে রয়েছে উঁচু ও নিচুভূমি এবং বনভূমি-ও। তোমরা তা হতে (উৎপন্ন) ফসল খাও এবং (গবাদি পশু) চারণ করো। ফল-ফসল তোমরা যা পাও এবং গবাদি পশু যা সমর্পণ করে (ঐশী) চুক্তি ও আস্থাবলে, তা তোমাদেরই (অধিকারে)। যাকাতেরআওতাভুক্ত হচ্ছে তিন বছর বয়সী উট, বয়স্ক মাদী উট, মাই ছাড়ানো উট, বাড়িতে রাখা এবং মাই না ছাড়ানো অল্পবয়সী মদ্দা উট। আর গবাদি পশুর ক্ষেত্রে ছয় বছর বয়সী ও পাঁচ বছর বয়সীগুলোর ওপর যাকাত দিতে হবে।” [এই পত্রের ভাষা হেজায অঞ্চলে প্রচলিত আরবী ভাষা থেকে বেশ আলাদা]


নজদী গোত্রের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন: “হে আল্লাহ, তাদেরকে (গবাদি পশুর) দুধ, মাখন ও দধিতে বরকত দিন। তাদের মেষপালকদেরকে ধনবান করুন এবং অভাব দূর করে দিন। সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততিতে তাদেরকে আশীর্বাদ দিন। যে কেউ নামায পড়লে সে মুসলমান (বলে গণ্য হবে)। যে কেউ যাকাত দিলে, সে মুহসিন (পুণ্যবান)। যে কেউ আল্লাহ ভিন্ন কোনো উপাস্য নেই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করলে সে মুখলিস (একনিষ্ঠ)।


“বনূ নজদ, তোমাদের প্রতি বহাল রয়েছে (ঐশী) অঙ্গীকার (পূরণ) ও সম্পদ জমা (দেয়া)। বেঁচে থাকতে যাকাতআটকে রেখো না, বা তা হতে বিচ্যুত-ও হয়ো না। নামাযকে বোঝা মনে করো না এবং ফলশ্রুতিতে তা পরিত্যাগ করো না।”

মহানবী (ﷺ) নজদীদেরকে আরো লিখেন: “তোমরা ন্যূনতম যাকাত দাও। তোমাদের রয়েছে অসুস্থ উট, সদ্য সন্তান প্রসবকারিনী উটনী, সওয়ারের জন্যে পোষ মানানো উট ও পোষ না মানানো অশ্বশাবক। তোমাদের গবাদি পশু আটক করা হবে না, খেজুর/তাল (জাতীয়) গাছের ফুল-ও কাটা হবে না। আর তোমাদের দুগ্ধবতী গাভীও কেড়ে নেয়া হবে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত তোমরা (অন্তরে) কপটতা লুকিয়ে না রাখো, কিংবা চুক্তি ভঙ্গ না করো। কেউ কোনো কিছুতে চুক্তিবদ্ধ হলে এবং যিম্মা তথা সুরক্ষা সংক্রান্ত অঙ্গীকারে আবদ্ধ থাকলে তাকে অবশ্যই তা পূরণ করতে হবে। কেউ তা অস্বীকার করলে এর দায়-ই কেবল বৃদ্ধি পাবে (শাস্তিস্বরূপ)” [এসব উদ্ধৃতিতে বিভিন্ন আরবী বাগরীতির ওপর রাসূল (ﷺ)-এর পাণ্ডিত্যেরই নিদর্শন মেলে]। [অনুবাদকের জরুরি নোট: পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন, নজদী গোত্রের প্রতি মহানবী (ﷺ) যে নির্দেশ জারি করেছিলেন, তাতে তাদের ভবিষ্যত বিচ্যুতির আভাস মেলে। পরবর্তীকালে তারা ঠিকই বিদ্রোহ করেছিল]  


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক ওয়া’ইল ইবনে হুজরকে প্রেরিত পত্রের কিয়দংশ এরকম: “প্রতি কায়লস্, ইয়েমেনের রাজা-বাদশাহবৃন্দ, সুন্দর চেহারার অধিকারী, বয়োবৃদ্ধমণ্ডলী।” তিনি ওই পত্রে আরো লেখেন, “ন্যূনতম চল্লিশটি ভেড়ার মধ্য হতে একটি (যাকাতস্বরূপ), যা মোটা নয়, আবার শুকনো-ও নয়। দান করুন যা মধ্যম (আকৃতির)। ধনভাণ্ডারের এক-পঞ্চমাংশ (যাকাতস্বরূপ বিধিবদ্ধ)। অবিবাহিত কেউ অবৈধ যৌনাচার করলে তাকে (শাস্তিস্বরূপ) এক’শ বেত্রাঘাত দিন এবং এক বছরের জন্যে নির্বাসনে পাঠান। বিবাহিত কেউ তা করলে এক দল মানুষ দ্বারা তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করুন। দ্বীন (ধর্ম)-এর ব্যাপারে শিথিল হবেন না, আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন হতেও টলবেন না। সকল ধরনের মাদক নিষিদ্ধ। ওয়া’ইল ইবনে হুজরকে কায়লস্-এর ওপর নিয়োগ করা হলো।”


হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর কাছে প্রেরিত যাকাত সংক্রান্ত বিখ্যাত পত্রের সাথে ওপরের পত্রটি তুলনা করুন! মহানবী (ﷺ) এসব নির্দিষ্ট মানুষের নিজস্ব শব্দভাণ্ডারের পাশাপাশি তাঁদেরই রূপক-শৈলী ও সাধারণ ভাষাগত প্রকাশভঙ্গি বা অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ ঐশী বিধান তাঁদের কাছে স্পষ্ট ও বোধগম্য ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।


’আতিয়া আস্ সাদীর কাছে ব্যক্ত এক হাদীসের সাথে ওপরের হাদীসটি মেলে যায়, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “ওপরের হাত দাতার, আর নিচের হাত গ্রহীতার।” এই হাদীসেও তিনি তাঁদের প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করেন। [আল-হাকীম, আল-বায়হাকী সমর্থিত]


আল-আমিরী প্রার্থিত কোনো একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে হুযূর পাক (ﷺ) যে হাদীসটি বলেন, তাতে বনূ আমির গোত্রের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল।


মহানবী (ﷺ) প্রাত্যহিক যে ভাষণ দিতেন, তাঁর প্রসিদ্ধ বাগ্মিতা ও বোধগম্য ভাষায় প্রদত্ত বক্তব্য ও বাণী, এসব সম্পর্কে জ্ঞান বিশারদবৃন্দ অসংখ্য বইপত্র লিখেছেন এবং তাতে এসবের বাণী ও অর্থ বিধৃত হয়েছে। তাঁর ভাষণ ছিল অসমকক্ষ বাগ্মিতা ও অতুলনীয় প্রাঞ্জলতাপূর্ণ। এর উদাহরণ নিম্নরূপ:


”মুসলমানদের রক্ত একই। তাদের সবচেয়ে কম সংখ্যক তাদের সুরক্ষা দিতে পারে। অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে তারা একটা-ই হাত (-স্বরূপ)।” [আবূ দাউদ ও নাসাঈ]


”মানুষ হচ্ছে চিরুনির দাঁতের মতো।” [ইবনে লাল]


”যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে, সে তার সঙ্গে থাকে।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


”ওই সঙ্গ কল্যাণকর নয়, যা তোমাকে প্রদর্শন করে না সেসব জিনিস, যেগুলো তুমি তাকে প্রদর্শন করো।” [ইবনে ’আদী কর্তৃক দুর্বল এসনাদে বর্ণিত]


”মানুষ হচ্ছে স্বর্ণ ও রৌপ্যের খনিসদৃশ। জাহেলীয়া যুগে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে ব্যক্তি, যাকে দ্বীন ইসলামে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়, যদি তাদের উপলব্ধি থাকে।” [মুসলিম ও আল-বোখারী]


”যে ব্যক্তি নিজের মূল্য বোঝে, সে বিনাশপ্রাপ্ত হয় না।” [ইবনে আস্ সাম’আনী]


”যে ব্যক্তির কাছে উপদেশ চাওয়া হয়, তিনি আস্থাভাজন পর্যায়ভুক্ত; আর তিনি মুখ না খোলা পর্যন্ত কী বলবেন তা পছন্দ করতেও সক্ষম।” [পূর্বোক্ত চার হাদীসবেত্তা এবং আল-হাকীম ও তিরমিযী বর্ণিত]


”আল্লাহতা’লা তাঁর ওই বান্দার প্রতি করুণা প্রদর্শন করেন, যিনি ভালো কথা বলেন ও অর্জন করেন, অথবা যিনি নিরবতা পালন করেন ও নিরাপদ থাকেন।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


”তোমরা মুসলমান হও এবং নিরাপদ থাকো। মুসলমান হও এবং আল্লাহ পাক তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কৃত করবেন।” [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


”তোমাদের মধ্যে আমি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি এবং যারা পুনরুত্থান দিবসে আমার সবচেয়ে কাছে বসবে, তারা হলো সচ্চরিত্রবান – যারা (মানুষকে) আশ্রয় দেয়, সুরক্ষা দেয় এবং একতাবদ্ধ করে তথা মিলমিশ করিয়ে দেয়।” [আত্ তিরমিযী]


”হয়তো সে ব্যক্তি এমন বিষয়ে কথা বলতো যা তার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এবং যা তাকে সমৃদ্ধ করেনি সে সম্পর্কে কৃপণতা অবলম্বন করেছে।” [আল-বায়হাকী]

”দু’মুখো ব্যক্তির কোনো মূল্যই আল্লাহতা’লার কাছে নেই।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


মহানবী (ﷺ) নিষেধ করেন, “গল্প-গুজব করা (আজে-বাজে কথা বলা), বেশি বেশি প্রশ্ন করা, ধনসম্পদ ও সম্পত্তি অপচয় করা, উপহারসামগ্রী নিষেধ করা, মায়ের প্রতি অবাধ্যতা এবং মেয়েদেরকে জীবিত কবর দেয়া।”


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহকে ভয় করো। কোনো মন্দ কাজকে উত্তম কাজ দ্বারা মুছে ফেলো। আল্লাহতা’লা মানুষকে উত্তম চরিত্রে (বৈশিষ্ট্যে) সৃষ্টি করেছেন।” [হযরত আবূ যর (رضي الله عنه) হতে সর্ব-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله), তিরমিযী (رحمة الله), আল-হাকীম (رحمة الله) এবং আল-বায়হাকী (رحمة الله)] 


”সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে মধ্যম পন্থা।” [ইবনে আস্ সাম’আনী]


”তুমি যাকে মহব্বত করো, তার সাথে নম্র আচরণ করবে, নচেৎ একদিন সে-ই হয়তো তোমার ঘৃণাকারী হতে পারে।” [হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে আত্ তিরমিযী (رحمة الله) ও আল-বায়হাকী (رحمة الله)]


”পুনরুত্থান দিবসে অন্যায় অন্ধকার হিসেবে দৃশ্যমান হবে।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


নবী করীম (ﷺ) তাঁর এক দোয়ায় আরয করেন, “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছ থেকে আপনারই অনুগ্রহ প্রার্থনা করি যা দ্বারা আমার অন্তর হেদায়াত পাবে, আমার এলোমেলো বিষয়গুলো সংযুক্ত হবে আর সেগুলো সহজ-সরলও হয়ে যাবে, (উপরন্তু) আমার অদৃশ্য অংশ-ও সঠিক হবে এবং আমার দৃশ্যমান অংশ-ও সমুন্নত হবে, আর আমার কর্ম পরিশুদ্ধ হবে, যা দ্বারা আমি হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিকে উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত হবো, আর (আপনার সাথে) আমার ঘনিষ্ঠতা-ও ফিরিয়ে দেয়া হবে, যা দ্বারা আমি প্রতিটি মন্দ হতে সুরক্ষিত থাকবো। হে আল্লাহ, ঐশী বিধান, শহীদানের খোরাক, আশীর্বাদপ্রাপ্তের জীবন এবং আমার শত্রুদের ওপর বিজয় লাভে উত্তম ফলাফলের ব্যাপারে আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি।” [হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্যরা। এসব ভাষ্য কেবল অর্থের কারণেই নয়, বরং আরবী ভাষাগত সৌন্দর্যের দিক থেকেও অসামান্য ]


এগুলো ছাড়াও মহানবী (ﷺ)-এর এমন অনেক বাণী, কথপোকথন/আলাপ, ভাষণ, দোয়া, মন্তব্য ও ওয়াদা/প্রতিশ্রুতি রয়েছে যা সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বর্ণনা করেছেন। তিনি যে এসব ক্ষেত্রে অতুলনীয় এক আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সে বাস্তবতার ব্যাপারে কোনো রকম মতপার্থক্যই কারো ছিল না। এক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যবিচার করাও অসম্ভব একটি বিষয়।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনন্য বাণী যা ইতিপূর্বে কোনো মুখেই উচ্চারিত হয়নি, তা-ও সংকলিত হয়েছে। কেউই কখনো সেগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে বা ফুটিয়ে তুলতে পারবে না।


যেমনটি তিনি (ﷺ) বলেন, ”তুমুল যুদ্ধ বেধেছে।”


”সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।”


“ঈমানদার একই পাথর দ্বারা দু’বার আঘাতপ্রাপ্ত (ক্ষতিগ্রস্ত) হয় না।”


”যে ব্যক্তি কারো সতর্কবাণী গ্রহণ করে, সে-ই সুখি হয়।”


এ ধরনের আরো বাণী আছে। কেউ এগুলো যাচাই করলে এতে নিহিত বিষয়াদি দেখে তিনি সতত চমৎকৃত হতে থাকবেন এবং এতে ধারণকৃত জ্ঞান-ও সুবিবেচনায় নেবেন।


মহানবী (ﷺ)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) তাঁকে একবার বলেন, “আমরা আপনার চেয়ে বেশি বাগ্মী বা প্রাঞ্জল-ভাষী কাউকেই তো আর খুঁজে পাচ্ছি না।” তিনি উত্তর দেন, “এর ব্যতিক্রম কীভাবে হবে? আল-কুরআন তো আমার জিহ্বাতেই প্রকাশিত হয়েছে, যা স্পষ্ট আরবী-ভাষী এক জিহ্বা!” [আল-বায়হাকী]


আরেকবার তিনি এরশাদ ফরমান, “আরবদের মধ্যে আমি-ই সবচেয়ে প্রাঞ্জল-ভাষী, কেননা আমি কুরাইশ বংশ হতে আবির্ভূত এবং বনূ সা’আদ গোত্রে লালিত-পালিত।” এই ব্যাপারটি তাঁকে নগরের অভিব্যক্তির সাবলীলতা ও সৌন্দর্য ধারণের পাশাপাশি মরু অঞ্চলের শক্তি ও নির্মলতা-ও দিয়েছিল। এগুলোর সাথে সমন্বিত হয়েছিল খোদায়ী সমর্থন, যা ঐশীবাণীর সাথী হয়েছিল, আর যা কোনো (মরণশীল) মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা একেবারেই অসম্ভব।

উম্মে মা’আবাদ (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “(তিনি ভাষণে ছিলেন) সুমধুর, স্পষ্ট; অতি অল্প বা অতি বেশি কথা তিনি বলতেন না। আর তাঁর ভাষণ ছিল যেন সুতোয় গাঁথা মুক্তোর মালা। তাঁর কণ্ঠস্বর-ও ছিল সুউচ্চ ও সুরেলা।”


পরিচ্ছেদ – ৬/ তাঁর বংশগত আভিজাত্য; তাঁর জন্মস্থানের ও বেড়ে ওঠার স্থানের সম্মান ও মর্যাদা


মহানবী (ﷺ)-এর উচ্চবংশ ও জন্মস্থানের সম্মান এবং তাঁরই বেড়ে ওঠার স্থানের মর্যাদা সম্পর্কে কোনো প্রমাণ বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। এটা গোপন কোনো বিষয় নয়।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনূ হাশেম গোত্রের শ্রেষ্ঠদের মধ্য হতে আবির্ভূত হন, আর কুরাইশ গোত্রেরও মূল হতে তিনি আগমন করেন। বাবা ও মায়ের উভয় বংশীয় দিক থেকেই তিনি আরবদের মধ্যে মহত্তম ও সর্বাধিক শক্তিশালী গোত্রভুক্ত। মক্কার মানুষের মধ্য হতেই তাঁর আবির্ভাব, যা আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের কাছে সবচেয়ে মহান এক দেশ/রাজ্য।


হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “আমি বনী আদমের এক শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হতে আরেক শ্রেষ্ঠ প্রজন্মে (মানে ঔরসে) প্রেরিত হতে থাকি, যতোক্ষণ না আমি যে প্রজন্মে প্রেরিত হয়েছি, তাতে পৌঁছেছি।” [আল-বুখারী]


হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন মহানবী (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলকে পয়দা করেন এবং আমাকে তাদের শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের শ্রেষ্ঠজনদের মাঝে প্রেরণ করেন। অতঃপর তিনি বিভিন্ন গোত্র বেছে নেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ গোত্রে প্রেরণ করেন। এরপর তিনি পরিবারগুলো বাছাই করেন এবং তাদের মধ্যে সেরা এক পরিবারে আমাকে প্রেরণ করেন। আমি ব্যক্তি হিসেবে তাদের মধ্যে সেরা এবং পরিবারের বেলায়ও তাদের মাঝে সেরা।” [আল-বায়হাকী ও আত্ তিরমিযী]


হযরত ওয়া’ইলা ইবনে আসকা’ (رضي الله عنه) বলেন যে হুযূর পাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, “আল্লাহতা’লা পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সন্তানদের মধ্য হতে পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام)-কে পছন্দ করে নেন, আর তিনি ইসমাঈল (عليه السلام)-এর সন্তানদের মধ্য হতে বনূ কেনানা-কে বেছে নেন। অতঃপর তিনি বনূ কেনানা’র মধ্য হতে কুরাইশ গোত্রকে বেছে নেন; আর কুরাইশ গোত্রের মধ্য হতে বনূ হাশেমকে পছন্দ করেন। তিনি বনূ হাশেম হতে আমাকে পছন্দ করেন।” [আত্ তিরমিযী বলেন এই হাদীসটি সহীহ; মুসলিমেও এটা বর্ণিত হয়েছে]


হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে আত্ তাবারানী (رحمة الله) বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, “মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্য হতে বনূ আদমকে পছন্দ করেন। এরপর তাদের মধ্য হতে আরবদেরকে পছন্দ করে নেন। অতঃপর আরবদের মধ্য হতে তিনি কুরাইশদেরকে বেছে নেন। এরপর কুরাইশদের মধ্য হতে বনূ হাশেমকে পছন্দ করেন। অতঃপর বনূ হাশেমের মধ্য হতে আমাকে পছন্দ করেন। আমি-ই সেরাদের সেরা। যে কেউ আরবদেরকে ভালোবাসলে আমার প্রতি ভালোবাসার সূত্রেই তাদেরকে ভালোবাসে। যে কেউ আরবদেরকে ঘৃণা করলে আমার প্রতি ঘৃণার কারণেই তাদেরকে ঘৃণা করে।”


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে মহানবী (ﷺ)-এর রূহ মোবারক নূর তথা জ্যোতির আকৃতিতে আল্লাহর কাছে অবস্থান করছিলেন পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টির ২০০০ বছরেরও আগে। ওই নূর আল্লাহর প্রশংসারত ছিলেন, আর ফেরেশতাকুল তাঁরই (ওই নূরেরই) প্রশংসার অনুসরণে (আল্লাহর) প্রশংসায় মুখর ছিলেন। আল্লাহতা’লা যখন পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি ওই নূরকে আদম (عليه السلام)-এর কোমরে (ঔরসে) স্থাপন করেন।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, “আল্লাহতা’লা আমাকে এই দুনিয়াতে পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর ঔরসে প্রেরণ করেন, এরপর পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)-এর ঔরস হয়ে পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর ঔরসে প্রেরণ করেন। আল্লাহতা’লা পবিত্র ঔরস হতে পবিত্র গর্ভে আমাকে স্থানান্তর করতে থাকেন, যতোক্ষণ না আমি আমার পবিত্র পিতামাতার ঘরে বেলাদতপ্রাপ্ত হই। তাঁদের (পূর্বপুরুষদের) কেউই কখনো অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হননি।”


 


মহানবী (ﷺ)-এর প্রশংসায় হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-এর রচিত বিখ্যাত কবিতা (ওপরের) এই হাদীসের নির্ভরযোগ্যতার সাক্ষ্য বহন করে।


পরিচ্ছেদ – ৭/ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কর্মের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থা


দৈনন্দিন জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তিন ধরনের হতে পারে:


১/ এ শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে সেসব বিষয় যেগুলো স্বল্প পরিমাণে হলে চমৎকার;


২/ এ শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে সেসব বিষয় যেগুলো অধিক পরিমাণে হলে উত্তম;


৩/ এ শ্রেণিভুক্ত বিষয় পরিস্থিতি অনুযায়ী তারতম্য হয়।


শরীয়ত ও প্রথা উভয় অনুযায়ী যে ধরনের বিষয় যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বল্প পরিমাণে উত্তম ও প্রশংসনীয় বলে সর্বসম্মতভাবে বিবেচিত, তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পানাহারের মতো ব্যাপার। আরবীয় জনগণ ও জ্ঞানী-গুণীজন সবাই এগুলোর স্বল্প পরিমাণ ব্যবহারের প্রশংসা ও অধিক ব্যবহারের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছেন; কেননা অধিক পানাহার লোভ, লালসা, লোলুপতা ও খাদ্য-লিপ্সা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ইঙ্গিতবহ। সেটা ইহ ও পরকালীন জগতে ক্ষতিকর ফলাফল বয়ে আনে। শারীরিক অসুখ-বিসুখ, আত্মিক নিকৃষ্টতা ও মেধাশূন্যতা-ও নিয়ে আসে। এর স্বল্প পরিমাণ ব্যবহার তুষ্টি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিফলন করে। বস্তুতঃ খিদের নিয়ন্ত্রণ দ্বারা স্বাস্থ্য, স্পষ্ট বা পরিষ্কার চিন্তা ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তি অর্জিত হয়।


একই কথা প্রযোজ্য বেশি মাত্রায় ঘুমের বেলায়ও। এটা (শারীরিক ও মানসিক) দুর্বলতা ও মেধাহীনতা এবং অবিচক্ষণতার ইঙ্গিতবহ। এর ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় অলসতা, ব্যর্থতার অভ্যেস, উপকারী নয় এমন সব বিষয়ে জীবন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বরবাদ করা, হৃদয়ের কাঠিন্য, আর অন্তরের প্রতি অবহেলা ও সেটার অপমৃত্যু-ও। এর প্রমাণ সর্বজনবিদিত, (সবারই) প্রত্যক্ষকৃত এবং পূর্ববর্তী জাতি-গোষ্ঠী (কওম) ও অতীতকালের জ্ঞানী-গুণীজন কর্তৃক তা বর্ণিত, বিশেষ করে আরবীয়দের কাব্যে ও তাঁদেরই নানা কাহিনীতে। এগুলো আরো পাওয়া যায় সহীহ হাদীস ও সালাফ-বৃন্দের রেওয়ায়াত তথা বর্ণনায়, আর তাঁদের পরে আগত (খালাফ)-দের বিবরণেও, যেগুলো সম্পর্কে উদ্ধৃতি দেয়া নিষ্প্রয়োজন। আমরা এখানে সেগুলোর পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করবো না, বরং শুধু সারাংশ-ই পেশ করবো; কেননা তাতে নিহিত জ্ঞান সর্বজনজ্ঞাত।


ওপরোক্ত দুটো বিষয়ে (অতিভোজন ও অধিক ঘুমের ব্যাপারে) মহানবী (ﷺ)-ই সবার চেয়ে সংযমী; এই বাস্তবতা তাঁরই প্রসিদ্ধ জীবনী হতে জানা যায়। তিনি মানুষজনকে আদেশ দিতেন ও উৎসাহিত করতেন যাতে তাঁরা সেগুলোর স্বল্প পরিমাণ ব্যবহার করেন; আর এই দুটো বিষয়কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সংযুক্ত-ও করে দিয়েছিলেন।


আল-মিকদাম আল-মা’দিকারিব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “বনী আদম (আদম-সন্তান) তার পেটের চেয়ে মন্দ আর কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। আদম-পুত্রের মেরুদণ্ড সোজা রাখার (মানে জীবন ধারণের) জন্যে কয়েক গ্রাস খাবার-ই যথেষ্ট। যদি (বেশি) হতেই হয়, তবে তার খাবারের জন্যে এক-তৃতীয়াংশ, পানীয়ের জন্যে এক-তৃতীয়াংশ এবং নিঃশ্বাসের জন্যে এক-তৃতীয়াংশ (বরাদ্দ)” [আত্ তিরমিযী, আন্ নাসাঈ ও ইবনে হিব্বান]। কেননা, অতিরিক্ত খাবার অতিরিক্ত ঘুমের কারণ হয়।


হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله) বলেন, “স্বল্প আহারে কেউ রাত জাগতে সক্ষম।”


জনৈক সালাফ বলেন, “এতো বেশি খেয়ো না যার দরুন তোমাদের বেশি পান করতে হয়, আর বেশি নিদ্রাও যাপন করতে হয়, আর অনেক বেশি পরিমাণে হারাতেও হয়।”


বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমি ওই ধরনের খাবার পছন্দ করি যা’তে রয়েছে অনেক হাত” (মানে বেশি মানুষ ওই খাবার গ্রহণ করে, আর তারা অল্প খাওয়ার দরুন তাতে বরকত লাভ হয়)। [সর্ব-হযরত আনাস (رضي الله عنه) ও জাবের (رضي الله عنه) হতে সকল হাদীসবেত্তা]


হযরত মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলে পাক (ﷺ) কখনোই পেট ভরে খেতেন না। পরিবারের সাথে থাকাকালে তিনি তাদের কাছে খাবার চাইতেন না। তাঁরা তাঁকে খাওয়ালে তিনি খেতেন। তাঁরা যা খাদ্য পরিবেশন করতেন, তা-ই খেতেন, আর যা পানীয় হিসেবে দিতেন, তা-ই পান করতেন।”


এটা বারিরা (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, যেখানে মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি কি গোশতের একটি পাত্র দেখিনি?” [মুসলিম ও আল-বোখারী। বারিরা (رضي الله عنه) যে মাংস রান্না করছিলেন, তার বৈধতা প্রমাণের উদ্দেশ্যেই এ কথা বলা হয়েছিল]  

এটা সম্ভব যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এই ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করার কারণ হতে পারে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের মনের কথা এই মর্মে যে ওই গোস্ত তাঁর জন্যে বৈধ নয়; এমতাবস্থায় তিনি সুন্নাতকে স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে তাঁরা কোনো মাংস পরিবেশন না করতে দেখে, যদিও তাঁরা নিজেদেরকে তাঁর চেয়ে এর প্রতি বেশি হক্কদার বিবেচনা করেননি, তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে তাঁর ভাবনা সত্য/সঠিক কি না, আর তিনি তাঁদের কাছেও ব্যাপারটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন এই বলে, “এটা তার (বারিরা’র) জন্যে সাদাকাহ এবং আমাদের জন্যে পুরস্কার।”


লোকমান (عليه السلام)-এর পুত্রের প্রতি তাঁর জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ ছিল এরকম – “হে পুত্র, উদরপূর্তি হলে চিন্তাশক্তি লোপ পায়, জ্ঞান স্থবির হয়ে যায়, আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবাদত-বন্দেগীতে ব্যর্থ হয়।”


সাহনূন বলেন, “যে ব্যক্তি উদরপূর্তি করে খায়, তার জন্যে জ্ঞান যথাবিহিত নয়।”


একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমার ক্ষেত্রে আমি স্থিরভাবে বসা অবস্থায় (তথা এলিয়ে পড়া/ হেলান দেয়া অবস্থায়) খাবার গ্রহণ করি না।” [আল-বুখারী]


স্থিরভাবে উপবেশন হচ্ছে খাবার গ্রহণের জন্যে শক্তভাবে বসা বা গা এলানো, যার উদাহরণ পা আড়াআড়ি পেতে বা অন্য কোনো আরামদায়ক পন্থায় রেখে বসা। এভাবে যে ব্যক্তি বসে, সে খাবার চায় এবং প্রচুর পরিমাণেই তা চায়। মহানবী (ﷺ) খেতে বসলে পায়ের ওপর এমনভাবেই বসতেন যেন ওঠে যেতে তিনি সদাপ্রস্তুত। [মুসলিম]


হুযূর পূর নূর (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমি একজন বান্দা। কোনো বান্দা যেমনভাবে খায় এবং যেভাবে বসে, আমিও তেমনিভাবে খাই ও বসি।” [হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে দুর্বল সনদে আল-বাযযার বর্ণিত হাদীস]


এই হাদীসের অর্থ স্রেফ কারো শরীর একপাশে এলানো নয়, যেমনটি কিছু মানুষ বলে থাকে।


নবী করীম (ﷺ)-এর ঘুমের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য ছিল। তিনি অল্প ঘুমোতেন। সহীহ আহাদীস এর পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে। উপরন্তু, মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার নয়নযুগল ঘুমোয়, কিন্তু আমার কলব্ (অন্তর) ঘুমোয় না।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


মহানবী (ﷺ) তাঁর শরীর মোবারকের ডানপাশে কাত হয়ে ঘুমোতেন, যাতে কম ঘুমোতে পারেন; কেননা বামপাশে কাত হয়ে ঘুমোনো হৃদযন্ত্র ও শরীরের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্যে সহজতর, যেহেতু এগুলো বামদিকেই অবস্থান করে। তাই বামপাশে কাত হয়ে ঘুমোলে গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন হতে হয়। কিন্তু কেউ ডানদিকে কাত হয়ে ঘুমোলে তার হৃদযন্ত্র ঝুলে থাকে এবং আলোড়িত হয়; ফলে তিনি তাড়াতাড়ি জেগে ওঠেন এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হন না।


পরিচ্ছেদ – ৮/ বিয়ে ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াদি


দৈনন্দিন জীবনে দ্বিতীয় কিসিমের যে বিষয়গুলো অধিক পরিমাণে হলে প্রশংসা ও গর্বের কারণ হয়, তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিয়ে-শাদী ও উচ্চ-পদমর্যাদা।


বিয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শরীয়ত ও (সামাজিক) প্রথায় পুরো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। এটা পূর্ণতা ও স্বাস্থ্যপূর্ণ পৌরুষের স্পষ্ট প্রমাণবহ। এর প্রচুর গর্ব ও প্রশংসা করা সবসময়-ই প্রথাসিদ্ধ ছিল, আর শরীয়তের বিধানে এটা সুন্নাহ হিসেবেই বর্ণিত হয়েছে।


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হুযূর পাক (ﷺ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “এই উম্মতের সেরা হলেন তিনি, যাঁর সর্বাধিক স্ত্রী।” [আল-বুখারী]


মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান,  “বিয়ে-শাদী করে বংশবৃদ্ধি করো। আমি তোমাদের মাধ্যমে এই উম্মতের বিস্তার দেখতে চাই।” [হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে ইবনে মারদাওয়াইহ্ কর্তৃক নিজ তাফসীরগ্রন্থে উদ্ধৃত দুর্বল এসনাদে মারফু’ হাদীস; আত্ তাবারানী-ও তাঁর কৃত ‘আল-আওসাত’ পুস্তকে অনুরূপ বর্ণনা নকল করেছেন] 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কৌমার্য-ব্রত নিষেধ করেছিলেন। এটা এ কারণে যে, বিয়ে তার সাথে বয়ে আনে ক্ষুধা দমন, আর দৃষ্টি নতকরণ, যেমনটি মহানবী (ﷺ) বলেছিলেন। তিনি এরশাদ ফরমান, “সামর্থ্যবান যে কারো বিয়ে করা উচিত। এটা দৃষ্টিকে নত করে এবং (শরীরের) গোপন অঙ্গকে রক্ষা করে থাকে।” [আত্ তাবারানী, মুসলিম ও আল-বুখারী]


এই কারণে উলামা-বৃন্দ কৃচ্ছ্বতা সাধনের গুণ হতে বিচ্যুতিকর কোনো কিছু হিসেবে এটাকে (মানে বিয়ে-শাদীকে) বিবেচনা করেন না। সাহল আত্ তুসতারী (رحمة الله) বলেন, “আম্বিয়াকুল-শিরোরত্ন (মানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নারী জাতিকে পছন্দ করতেন। আমরা কীভাবে তাদেরকে পরিহার করতে পারি?” হযরত উবায়না (رحمة الله)-ও অনুরূপ কিছু বলেছিলেন।


আসহাব-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর মধ্যে সবচেয়ে কৃচ্ছ্বব্রতী সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দেরও অনেক স্ত্রী ও দাসী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একাধিক জন ইন্তেকালের পরে অবিবাহিত অবস্থায় আল্লাহর কাছে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টিকে অপছন্দ করতেন।


এ প্রশ্ন করা হতে পারে – “বিয়ে-শাদী কীভাবে এতো গুণসম্পন্ন হতে পারে, যেখানে আল্লাহতা’লা পয়গম্বর যাকারিয্যা (عليه السلام)-এর পুত্র পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام)-এর কুমার (সৎ) থাকাকে প্রশংসা করেছেন? যে বিষয়কে গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা না করার কারণে কীভাবে আল্লাহতা’লা ওই পয়গম্বর (عليه السلام)-এর ভূয়সী প্রশংসা করতে পারলেন? অধিকন্তু, পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-ও কুমার থেকে যান। আপনি যা দাবি করছেন তা-ই যদি (সত্য) হতো, তাহলে কি তিনি বিয়ে করতেন না?”


এর উত্তর হলো, কৌমার্য-ব্রতের কারণে পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام)-এর প্রশংসা আল্লাহ পাক করেছেন, এ কথা ঠিক। তবে এটা এ কারণে নয় যে তিনি লাজুক বা পৌরুষহীন ছিলেন, যেমনটি কেউ একজন অভিযোগ করেছেন। জ্ঞানী বিশ্লেষকবৃন্দ ও সূক্ষ্মতাত্ত্বিক আলেম-উলেমা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এ কথা বলে যে, এতে (ওই পয়গম্বরের প্রতি) একটি ত্রুটি আরোপ করা হয়, আর কোনো পয়গম্বরের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘাটতি যথাবিহিত নয়। প্রকৃতপক্ষে এর মানে হচ্ছে তিনি সব রকম ভ্রান্ত কাজ হতে রক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন; অর্থাৎ, (খোদায়ী) হেফাযত-প্রাপ্ত ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি সমস্ত শারীরিক চাহিদা থেকে হেফাযত-প্রাপ্ত ছিলেন। আর কেউ কেউ বলেন, তিনি নারী-আসক্তি থেকে মুক্ত ছিলেন।


এ থেকে স্পষ্ট হয় যে বিয়ে করার সামর্থ্য না থাকাটা এক ধরনের বৈশিষ্ট্যগত ঘাটতি। অপরদিকে বিয়ে করতে পারা একটি গুণ। অতএব, এর অনুপস্থিতি আরেকটি পাল্টা গুণের অস্তিত্বের দ্বারাই (মোকাবেলা করা) সম্ভব, যেমনটি হচ্ছে পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর সাধনা, কিংবা আল্লাহ হতে প্রাপ্ত পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام)-এর কৌমার্য-ব্রতের বৈশিষ্ট্য। কেননা, বিয়ে-শাদী ঘনঘন আল্লাহ হতে (মানুষের) চিত্তবিক্ষেপ ঘটিয়ে দুনিয়াতে নামিয়ে আনে।


কেউ বিয়ে করতে সামর্থ্যবান হলে এবং নিজ খোদাতা’লা হতে বিক্ষিপ্তচিত্ত না হয়ে বিয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হলে তিনি অবশ্যই মহামর্যাদাবান কেউ হবেন। এটাই হলো আমাদের মহানবী (ﷺ)-এর উচ্চমর্যাদা। তাঁর এতোজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহতা’লার এবাদত-বন্দেগী থেকে বিক্ষিপ্তচিত্ত হননি। বস্তুতঃ এতে বরং তাঁর এবাদত-বন্দেগী আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, যার দরুন তিনি তাঁর স্ত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন, তাঁদের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন, আর তাঁদের জন্যে উপার্জন করেছেন এবং তাঁদেরকে হেদায়াত তথা সঠিক পথপ্রদর্শন করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছেন যে এসব বিষয় তাঁর দুনিয়াবী/পার্থিব জীবনের অংশ নয়, যদিও তা অন্যান্যদের দুনিয়াবী জীবনের অংশবিশেষ।

মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ পাক তোমাদের এই পৃথিবীর নারী ও সুগন্ধকে এবং এবাদত-বন্দেগীতে আমার নয়নের প্রশান্তি (মানে উৎফুল্লচিত্ত)-কে ভালোবাসতে দিয়েছেন” [আল-হাকীম ও নাসাঈ]। অতঃপর তিনি ইঙ্গিত করেন যে নারী ও সুগন্ধের প্রতি তাঁর ভালোবাসা হচ্ছে অন্যান্যদের কাছে পার্থিব বস্তু-(তুল্য), অথচ এ দুইয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তাঁরই পার্থিব জীবনের খাতিরে নয়, বরঞ্চ পরবর্তী জগতেরই খাতিরে; কেননা এগুলো ইতোমধ্যে উল্লেখিত বিয়ের পরকালীন জগতের ভালাইয়ের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়; আর তিনি সুগন্ধের প্রতি আগ্রহ রেখেছিলেন যাতে ফেরেশতাদের সাথে দেখা করার সময় তিনি তা ধারণ করতে পারেন। অধিকন্তু, সুগন্ধ যৌনমিলনকে উৎসাহিত ও সহায়তা করে এবং জাগিয়েও তোলে। তিনি এই দুটো গুণকে অন্যদের খাতিরে পছন্দ করতেন, আর নিজের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণের খাতিরেও পছন্দ করতেন। তাঁর জন্যে খাস্ (সুনির্দিষ্ট) তাঁরই প্রকৃত ভালোবাসা অবশ্য নিহিত ছিল আপন প্রভুর (খোদাতা’লার) “জাবারুত” দর্শনে এবং তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ কথপোকথনে। এ কারণেই তিনি এই দুটো ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য ব্যক্ত করেন এবং দুটো অবস্থাকে আলাদা করে দেন এ কথা বলে, “এবাদত-বন্দেগীতে আমার নয়নের প্রশান্তি।”


পয়গম্বর এয়াহইয়া (عليه السلام) ও ঈসা (عليه السلام) নারীবিষয়ক পরীক্ষার ব্যাপারে (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) একই পর্যায়ভুক্ত ছিলেন (এই অর্থে যে তাঁরা নারীর কারণে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী হতে বিক্ষিপ্তচিত্ত হননি, ঠিক যেমনিভাবে মহানবী-ও হননি)। তবে নারীদের প্রয়োজন পূরণের মাঝে অতিরিক্ত একটি গুণ নিহিত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই যোগ্যতা বা সামর্থ্য দান করা হয়েছিল, আর তাঁকে এর অতিপ্রাচুর্য-ই দেয়া হয়েছিল। এ কারণেই অন্য যে কারো চেয়ে তাঁকে অনেক বেশি সংখ্যক স্ত্রীর অনুমতি দেয়া হয়।


হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, “মহানবী (ﷺ) দিন বা রাতের একটি ঘণ্টায় তাঁর স্ত্রী (رضي الله عنه)-বৃন্দের সান্নিধ্যে যেতেন, আর তাঁরা ছিলেন এগারোজন।” [আল-বুখারী ও নাসাঈ]


হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) আরো বলেন, “আমরা বলাবলি করতাম যে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে ত্রিশজন পুরুষের শক্তি প্রদান করা হয়েছে” [এটা নাসাঈ বর্ণনা করেন; আল-বুখারীতেও বিদ্যমান]। আবূ রাফী’ হতেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে। তাউস্ বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে স্ত্রী সহবাসে চল্লিশজন পুরুষের সামর্থ্য মঞ্জুর করা হয়েছিল।” সাফওয়ান ইবনে সুলাইম হতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা এসেছে।


নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত দাসী সুলামা (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ) তাঁর নয়জন বিবি সাহেবা (رضي الله عنه)-এর কাছে রাতে যেতেন; তিনি তাঁদের প্রতিজনের কাছ থেকে পবিত্র হয়ে পরবর্তীজনের কাছে যেতেন। মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘এটা শ্রেয়তর ও সবচেয়ে বেশি নির্মল’।” [আবূ দাউদ বর্ণিত সহীহ হাদীস]


পয়গম্বর সুলায়মান (عليه السلام) বলেছিলেন, “আমি রাতে এক’শ বা ৯৯ জন নারীর সহবাস করতাম” [প্রাগুক্ত আবূ দাউদ শরীফ]। অতএব, তাঁরও একই সামর্থ্য ছিল (বলে এতে নিশ্চিত হওয়া যায়)। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “পয়গম্বর সুলাইমান (عليه السلام)-এর এক’শ জন পুরুষের শারীরিক সামর্থ্য ছিল, আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন ৩০০ জন এবং দাসী ছিলেন (আরো) ৩০০ জন।” আন্ নাক্কাশ ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৭০০ এবং দাসীর সংখ্যা ৩০০।


পয়গম্বর দাউদ (عليه السلام) কৃচ্ছ্বব্রত পালন ও নিজ হাতে কাজ করে খাওয়ার পাশাপাশি ৯৯ জন স্ত্রীকে ভরণপোষণ করতেন, আর তিনি উরিয়া’কে বিয়ে করে ১০০ সংখ্যাটি পূরণ করেন। আল্লাহতা’লা এ কথা উল্লেখ করেন তাঁর পাক কালামে – “নিশ্চয় এ আমার ভাই; তার কাছে নিরানব্বইটা মাদী দুম্বা আছে” [আল-কুরআন, ৩৮:২৩]।

হযরত আনাস্ (رضي الله عنه)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমাকে চারটি বিষয়ের ক্ষেত্রে মানুষের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে: উদারতা, সাহসিকতা, অধিক সহবাসের ক্ষমতা এবং বিশাল (আধ্যাত্মিক) ক্ষমতা।” [আত্ তাবরানী]


পদমর্যাদার বিষয়ে বুদ্ধিমান মানুষেরা সাধারণত এর প্রশংসা করে থাকেন। মর্যাদানুযায়ী অতি উচ্চ শ্রদ্ধাবোধ অন্তরে লালিত হয়। তবে কিছু মানুষের বেলায় পরকালীন জগতের প্রেক্ষিতে এটা অনেক দুর্ভাগ্য ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে মানুষেরা এটার সমালোচনা করেছেন এবং এর বিপরীতটার প্রশংসা করেছেন। শরীয়ত-ও অখ্যাত হওয়াকে প্রশংসা করে এই জগতের উচ্চ মর্যাদার সমালোচনা করেছে।


মহানবী (ﷺ) বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী ছিলেন, আর তাঁর নবুওয়্যতের আগে জাহেলীয়্যা যুগে এবং পরে (ইসলামী যুগে) মানুষের অন্তরে উচ্চমর্যাদার আসনে ছিলেন অধিষ্ঠিত। অতঃপর (কিছু) মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে, তাঁকে এবং তাঁর সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দকে আঘাত দেয়, আর গোপনে তাঁর ক্ষতি করতে অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু যখনই তিনি তাদেরকে সামনাসামনি মোকাবেলা করেছেন, তারা তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে এবং তাঁর যা প্রয়োজন তা-ই দিয়েছে। এতদসংক্রান্ত হাদীসগুলো সর্বজনবিদিত যার মধ্য হতে আমরা কিছু পেশ করবো।


মহানবী (ﷺ)-কে যে কেউ আগে দেখে না থাকলে দেখামাত্র-ই হতবুদ্ধি ও ভীত হয়ে যেতো। এটা ক্কায়লা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সম্পর্কে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখে ভয়ে কম্পমান হন। এমতাবস্থায় হুযূর (ﷺ) বলেন, “বেচারি মেয়ে, তোমাকে শান্ত হতে হবে।” [ইমাম তিরমিযী কৃত ‘শামায়েল’ ও আবূ দাউদ (رحمة الله) প্রণীত ‘সুনান’। ইবনে সা’আদ (رضي الله عنه) এটা বর্ণনা করেন]


হযরত আবূ মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদীসে জানা যায়, এক ব্যক্তি নবী পাক (ﷺ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। তিনি তাকে বলেন, “নিরুদ্বিগ্ন হও, আমি কোনো রাজা-বাদশাহ নই।” [কায়স (رضي الله عنه) হতে মুরসাল হাদীস এবং আল-বায়হাকীতে উদ্ধৃত; আল-হাকীমও রেওয়ায়াত করেছেন এবং এটাকে সহীহ বলেছেন]


 



হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর পয়গম্বর হওয়ার দরুন তাঁর যে অ-পরিমাপযোগ্য শ্রেষ্ঠত্ব, উচ্চমর্যাদা, আল্লাহতা’লা কর্তৃক পছন্দকৃত হওয়ার মহাসম্মান এবং এই পৃথিবীতে প্রাপ্ত শ্রদ্ধা, সে ব্যাপারে তাঁর মাহাত্ম্যের কোনো সীমা-পরিসীমা-ই নেই। আর পরবর্তী জগতে তিনি হবেন আদম-সন্তানদের (মানে মনুষ্যজাতির) ইমাম [আল-বুখারী বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী]। বইয়ের এই অনুচ্ছেদে নিহিতার্থ এ পুরো অধ্যায়েরই ভিত্তি রচনা করেছে।


পরিচ্ছেদ – ৯/ অর্থসম্পদ সংক্রান্ত বিষয়াদি


পরিস্থিতিভেদে প্রশংসাযোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠতাসম্পন্ন তৃতীয় ধরনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অজস্র ধনসম্পদের মালিকানা।


সাধারণতঃ কারো প্রচুর ধনসম্পদ থাকলে মানুষেরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। কেননা তাঁরা বিশ্বাস করেন ওই ব্যক্তি তা দিয়ে নিজ চাহিদানুযায়ী সব কিছুই পেতে সক্ষম এবং তাঁর পক্ষে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করাও সম্ভব। তবে এই সম্পদ নিজ হতে কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। কেউ এর মালিক হলে তাঁর নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে এবং তাঁর কাছে আগমনকারী মানুষের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে তিনি তা যথাযথভাবে খরচ করলে ওই ধনসম্পদ তাঁর জন্যে বয়ে আনে মহত্ত্ব, প্রশংসা, শ্রেষ্ঠতা এবং মানুষের অন্তরে উচ্চাসন। এমতাবস্থায় পৃথিবীবাসীর চোখে ওই ধনসম্পদ তাঁরই একটি গুণ হয়ে দাঁড়ায়।


সম্পদের মালিক যদি ধর্ম ও পুণ্যের উদ্দেশ্যে, আল্লাহতা’লা ও আখেরাতের নিয়্যতে তা দান-সদকাহ’তে ব্যয় করেন, তাহলে প্রত্যেকের দৃষ্টিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা এক গুণ হিসেবে দেখা হয়।


আর যদি সম্পদের মালিক কৃপণ হয় এবং এর যথাযথ ব্যবহার না করে, আর যদি সে সম্পদের পাহাড় গড়তে তৎপর হয়, তাহলে ওই সম্পদ প্রচুর পরিমাণে হলেও মনে হবে যেন সেটার কোনো অস্তিত্ব-ই নেই। সেটা তখন তার মালিকের জন্যে একটি খুঁত হয়ে দেখা দেয়। এতে সম্পদের মালিক নিরাপদ স্থানে যেতে পারে না, বরঞ্চ কৃপণতা ও নীচতাপূর্ণ ত্রুটির গহ্বরে পতিত হয়।


ধনসম্পদ গুণ হিসেবে বিবেচিত হলে সে সম্পদ ও তার গুণের প্রশংসা খোদ সম্পদের কারণে হয় না। কারো সাথে এর সংশ্লিষ্টতা ও যথাযথ ব্যবহারের কারণেই এটার মর্যাদা উন্নীত হয়। সম্পদ মওজূদকারী যদি যথাযথভাবে তার সদ্ব্যবহার না করে, তাহলে সে প্রকৃতপ্রস্তাবে সম্পদশালী নয়, আর ধনাঢ্য শব্দটির খাঁটি অর্থেও সে তা নয়। জ্ঞানী-গুণীজনের কেউই তাকে প্রশংসা করেন না। সে সবসময়-ই গরিব থাকে এবং সে তার লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয়। কেননা, সে তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্ষম হওয়ার মতো সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ওই সম্পদের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে অনেকটা অন্য কারো সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতোই, যার নিজস্ব কোনো সম্পত্তি-ই নেই। সে যেন কোনো কিছুর মালিক-ই নয়।

যে সম্পদের মালিক (যথাযথ পন্থায়) তা ব্যয় করেন, তিনি প্রকৃত-ই ধনী ও সম্পদশালী। তিনি অর্থকড়ির বিভিন্ন সুফল অর্জন করতে পেরেছেন, যদিও ওই সম্পদের কোনো কিছু তাঁর মালিকানায় আর অবশিষ্ট না থাকে।


ধনসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের মহানবী (ﷺ)-এর জীবনী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করুন। আপনারা দেখতে পাবেন তাঁকে বিশ্বজগতের ধনভাণ্ডার ও রাজ্যসমূহের চাবি দেয়া হয়েছিল। গনীমতের মাল যা তাঁর পূর্ববর্তী কোনো নবী-রাসূল (عليه السلام)-এর জন্যে হালাল তথা বৈধ ছিল না, তা তাঁর জন্যে জায়েয তথা অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাঁর যাহেরী তথা প্রকাশ্য জীবদ্দশায় তিনি হেজায (মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারা), ইয়েমেন ও সমগ্র জাযিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ এবং এর পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্তসংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন। গনীমতের মালামালের এক-পঞ্চমাংশ ছাড়াও তাঁর খেদমতে পেশ করা হয় জিযিয়া কর ও যাকাত, যার যৎসামান্য অংশ-ই কেবল তাঁর পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাহবর্গ পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন বিদেশী শাসক তাঁর খেদমতে উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। তিনি এসবের কিছুই নিজের জন্যে রাখেন নি, কোনো দিরহাম-ও জমা করেননি। যথাযথ পন্থায় তিনি এগুলো ব্যয় করেছেন, অন্যান্যদেরকে এসব দ্বারা ধনাঢ্য করেছেন, আর মুসলমানদেরকে এগুলোর সাহায্যে শক্তিশালী করেছেন।


মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “রাতে আমার কাছে কোনো সোনার দিনার অবশিষ্ট থাকলে আমি স্বস্তি পাই না, ব্যতিক্রম শুধু ওই দিনারটা, যেটা আমি ঋণ পরিশোধের জন্যে আলাদা করে রেখেছি।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


কখনো তাঁকে দিনারসমূহ দেয়া হলে তিনি তা ভাগ করে দিতেন; হয়তো ছয়টি দিনার অবশিষ্ট থেকে যেতো। এমতাবস্থায় তিনি সেগুলো তাঁর কয়েকজন স্ত্রীর মাঝে বণ্টন করতেন। তিনি ঘুমোতে যেতেন না, যতোক্ষণ না এই বিলি-বণ্টন শেষ হতো। অতঃপর তিনি বলতেন, “এখন আমি বিশ্রাম নিতে পারবো।” তাঁর বেসালপ্রাপ্তির সময় আপন পরিবারের খোরাকির জন্যে নিজের বর্মটি পর্যন্ত তিনি বন্ধক রেখেছিলেন।


তাঁর জীবনধারণ, জামাকাপড় ও বসতঘর বাবদ তিনি প্রয়োজন মোতাবেক খরচ করতে রাজি ছিলেন এবং এর বাইরে ব্যয় করা হতে নিবৃত্ত ছিলেন। তিনি তা-ই পরতেন যা কিছু তাঁর কাছে লভ্য ছিল। সাধারণতঃ তিনি একটি চাদর, একটি মোটা কাপড় কিংবা একখানি মোটা বহিরাবরণ-বস্ত্র (জুব্বা) পরিধান করতেন। এসব বুটিদার ও সোনা দিয়ে কারুকাজ করা জুব্বা তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত মানুষজনের মাঝে বণ্টন করতেন, অথবা অনুপস্থিতদের কাছে প্রেরণ করতেন। এটা এ কারণে যে আল্লাহ-ওয়ালাদের দৃষ্টিতে জামাকাপড় ও সাজসজ্জার অহঙ্কার মহত্ত্ব ও সম্মানজ্ঞাপক কোনো গুণ নয়। এটা মহিলাদের একটা বৈশিষ্ট্য।


যেসব জামাকাপড় সবচেয়ে প্রশংসিত, সেগুলো পরিষ্কার ও মধ্যম মানের হয়ে থাকে। এ ধরনের বস্ত্র পরিধান করলে পৌরুষ হতে চিত্তবিক্ষেপ হয় না, আর অন্যান্য মানুষের চোখেও (নিজেকে) বড় করে দেখানো হয় না। শরীয়ত এই বড় করে দেখানোকে নিষেধ করেছে। মানুষ প্রায়শঃ যা দ্বারা গর্ব করে থাকে, তা হচ্ছে অধিক কাপড়চোপড় ও ধনসম্পদ।

একই কথা প্রযোজ্য জাঁকালো বসতভিটা, প্রশস্ত বাড়ি কিংবা অনেক মালামাল, সেবক ও জন্তু-জানোয়ারের বেলায়ও। কারো জমি-জিরাত থাকলে এবং তা কর্ষণ করে কৃচ্ছ্বব্রত ও অনাসক্তির কারণে তার ফসল দান করলে তিনি ওই সম্পত্তির মালিকানাসম্পর্কিত গুণ অর্জন করেন এবং এই গুণ সম্পর্কে গর্ব করার অধিকারও সংরক্ষণ করেন – যদি এই গর্ব করাকে কখনো কোনো সময় গুণ বলে সম্বোধন করা যায়। ধনসম্পদ থেকে (এভাবে) মুখ ফিরিয়ে নেয়াটার উচ্চসিত প্রশংসা করা হয়েছে, আর এর অনুপস্থিতিতে অল্পে তুষ্ট থাকার এবং ধনসম্পদের যথাযথ ব্যবহারেরও (যেমন দান-সদকাহ করারও) ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।


পরিচ্ছেদ – ১০/ তাঁর প্রশংসনীয় গুণাবলী


এমন অনেকগুলো প্রশংসনীয় গুণ ও মহৎ আদব (শিষ্টাচার) আছে যেগুলো অর্জন করা হয়। জ্ঞানী-গুণীজন সবাই একমত, যে ব্যক্তি সেগুলো ধারণ করেন তিনি সৎ ও পুণ্যবান, আর যিনি সেসব গুণের একটিও ধারণ করতে সক্ষম হন তিনি মহাসম্মানিত ব্যক্তি। শরীয়ত সেগুলোর প্রশংসা করে, সেগুলো ধারণের জন্যে আদেশ করে এবং যাঁরা সেসব গুণ ধারণ করেন, তাঁদেরকে চির সুখ-শান্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব গুণের কিছু কিছুকে নবুওয়্যতের অংশ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এগুলোকে উত্তম স্বভাব-চরিত্র বলা হয়। উত্তম চরিত্রের সমষ্টি হচ্ছে ব্যক্তি-সত্তার বুদ্ধিবৃত্তি ও গুণাবলীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা, আর চরমপন্থার প্রতি না ঝুঁকে মধ্যম পন্থা অবলম্বন।


আমাদের রাসূল (ﷺ) এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে ছিলেন একদম নিখুঁত এবং পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ, যার দরুন আল্লাহ পাক তাঁর প্রশংসা করেছেন এ কথা বলে, “নিশ্চয় আপনার চরিত্র তো মহা মর্যাদারই।” [আল-কুরআন, ৬৮:৪]


হযরত মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “তাঁর চরিত্র ছিল (মূর্তমান/জীবন্ত) কুরঅান। এ মহাগ্রন্থ যেসব বিষয়ের প্রতি রাজি, তিনিও সেগুলোর প্রতি রাজি ছিলেন, আর যেসব বিষয়ের প্রতি এটা না-রাজি, তিনিও সেগুলোর প্রতি না-রাজি ছিলেন। [আল-বায়হাকী]


মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমি সচ্চরিত্রকে পূর্ণতা দিতে প্রেরিত হয়েছি।” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ও আল-বাযযার; কিছুটা ভিন্নতর বর্ণনায় ইমাম মালেক (رحمة الله)-এর ’মুওয়াত্তা’ গ্রন্থেও বিদ্যমান, যেমনটি রয়েছে আল-বাগাউয়ী’র পুস্তকেও]


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ) মনুষ্যকুলের মাঝে সেরা চরিত্রের অধিকারী ছিলেন” [মুসলিম ও আল-বুখারী]। হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:)-ও অনুরূপ কিছু বলেছিলেন।


উলামাদের মতানুযায়ী, মহানবী (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে এসব গুণ/বৈশিষ্ট্য তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁরই সৃষ্টিকাল হতে, অর্থাৎ, তাঁরই জাত মোবারক সৃষ্টির সূচনালগ্নে। তিনি এগুলো অর্জন করেননি কিংবা পড়ালেখার মাধ্যমেও এগুলো শেখেননি। তিনি এগুলো খোদায়ী দানের মাধ্যমে পেয়েছেন, আর এগুলো হলো আল্লাহতা’লার বিশেষ উপহার।


এই একই অবস্থা বিরাজমান অন্যান্য সকল পয়গম্বর (عليه السلام)-এর বেলায়ও। তাঁদের শিশুবেলা হতে নবুওয়্যতপ্রাপ্তি পর্যন্ত ইতিহাস অধ্যয়ন করলে যে কেউ এটা বুঝতে পারবেন, যেমনটি পরিদৃষ্ট হয়েছে সর্ব-হযরত ঈসা (عليه السلام), মূসা (عليه السلام), ইয়াহইয়া (عليه السلام), সুলাইমান (عليه السلام) ও অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের ক্ষেত্রে। তাঁরা এসব গুণ সত্তাগতভাবে ধারণ করেছিলেন এবং সৃষ্টিলগ্নেই তাঁদেরকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করা হয়েছিল।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “আমি তাকে (ইয়াহইয়া আলাইহিস্ সালামকে) শৈশবেই নুবুয়্যত প্রদান করেছি।” [আল-কুরআন, ১৯:১২]


তাফসীরকার উলামা বলেন যে আল্লাহ পাক পয়গম্বর হযরত ইয়াহইয়া (عليه السلام)-কে শিশু থাকতেই নবুওয়্যত দান করেছিলেন। মা’মার বলেন তিনি ওই সময় মাত্র ২-৩ বছর বয়সী ছিলেন [ইমাম আহমদ কৃত ‘যুহদ’, ইবনে আবি হাতেম প্রণীত তাফসীরগ্রন্থ, আদ্ দায়লামী ও হাকীম]। শিশুরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কেন আমাদের সাথে খেলেন না?” তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমাকে কি খেলাধুলোর জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে?”


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন ইয়াহইয়ার, যে আল্লাহর পক্ষের একটা কলেমার সত্যায়ন করবে।” [আল-কুরআন, ৩:৩৯; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]


পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام) তিন বছর বয়সেই পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর ব্যাপারে সত্যায়ন করেন। তিনি সাক্ষ্য দেন যে হযরত ঈসা (عليه السلام) আল্লাহতা’লার কলেমা-বাক্য (কুন্ তথা ‘হও’, আর তিনি হয়ে যান) এবং তাঁরই রূহ (রূহুল্লাহ)। কথিত আছে যে পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام) যখন তাঁর মায়ের গর্ভে ছিলেন, তখনই তিনি এই সত্যায়ন করেছিলেন। হযরত ইয়াহইয়া (عليه السلام)-এর মা হযরত মরিয়ম (عليه السلام)-কে বলেন, “আমি অনুভব করি আমার গর্ভে যে (ইয়াহইয়া আলাইহিস্ সালাম) আছে, সে আপনার গর্ভে অবস্থিত জনের (অর্থাৎ, ঈসা আলাইহিস্ সালামের) প্রতি নত হয়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছে।”


হযরত ঈসা (عليه السلام) জন্মের সময় তাঁর মাকে যা বলেছিলেন, তা আল্লাহ পাক উদ্ধৃত করেন এভাবে: “অতঃপর তাকে তার নিম্নদেশ থেকে আহ্বান করলো, ‘তুমি দুঃখ করো না’।” [আল-কুরআন, ১৯:২৪]


কোনো কোনো তাফসীরকার বলেন যিনি আওয়াজ দিয়েছিলেন, তিনি হযরত ঈসা (عليه السلام) স্বয়ং। দোলনায় অবস্থানকালে তাঁর কথাও কুরআন মজীদে উদ্ধৃত হয়েছে: “শিশুটি বল্লো, ‘আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) দিয়েছেন এবং নবী (তথা অদৃশ্যের সংবাদদাতা) করেছেন’।” [আল-কুরআন, ১৯:৩০]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আমি ওই বিষয়ে (পয়গম্বর) সুলাইমানকে বুঝিয়ে (মানে সমঝ) দিয়েছি এবং উভয়কে রাষ্ট্রীয় শাসনক্ষমতা ও জ্ঞান দান করেছি।” [আল-কুরআন, ২১:৭৯]


হযরত সুলাইমান (عليه السلام) যখন ছোট ছিলেন, তাঁর তখনকার বিচার ক্ষমতা সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে: পাথর নিক্ষেপের মুখোমুখি এক নারীর ঘটনা এবং একটি শিশুর ঘটনাও, যা’তে (সুলাইমান আলাইহিস্ সালামের পিতা) পয়গম্বর দাউদ (عليه السلام) তাঁরই রায় মেনে বিষয়টির মীমাংসা করেন। আত্ তাবারী বলেন, “তিনি (সুলাইমান আ:) রাজত্ব লাভ করেন ১২ বছর বয়সে।”


পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) কর্তৃক ছোট বয়সে ফেরাউনের দাড়ি ধরার ঘটনাটিও একই রকমের।


তাফসীরবিদ উলামা বলেন “নিশ্চয় আমি (পয়গম্বর) ইবরাহীমকে আগে থেকেই তার সৎপথ দান করেছি” [আল-কুরআন, ২১:৫১], খোদায়ী এই কালামের মানে হলো, “আমি তাকে ছোট বয়সেই হেদায়াত দিয়েছি।” মুজাহিদ (رضي الله عنه) ও অন্যান্যরা এ কথা বলেছেন। ইবনে আতা’ (رحمة الله) বলেন, “আল্লাহ পাক তাঁকে সৃষ্টি করার আগেই মনোনীত করেছিলেন।” অপর কেউ একজন বলেন, “পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর বেলাদত হলে পরে আল্লাহতা’লা নিজেকে আত্মিকভাবে চেনানোর জন্যে এবং জিহ্বা দ্বারা যিকির (স্মরণ) করানোর উদ্দেশ্যে ঐশী আজ্ঞাবহনকারী একজন ফেরেশতা পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাছে প্রেরণ করেন। তিনি উত্তর দেন, ‘আমি তা পালন করেছি।’ তিনি কখনো বলেননি, ‘আমি পালন করবো।’ এটাই তাঁর সঠিক পথপ্রাপ্তি।”

কথিত আছে যে পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করে পরীক্ষা করা হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। নক্ষত্র, চাঁদ ও সূর্যের মাঝে তাঁর প্রমাণ খোঁজার সময় তিনি ১৫ মাসের শিশু ছিলেন।


বর্ণিত আছে যে আল্লাহতা’লা পয়গম্বর ইউসূফ (عليه السلام)-এর কাছে শিশু বয়েসে ওহী নাযেল করেন, যে সময়ে তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে কুয়োর মধ্যে নিক্ষেপ করেন। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান, “এবং আমি তার (হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের) প্রতি ওহী প্রেরণ করলাম, ‘নিশ্চয় তাদেরকে (ভাইদেরকে) তুমি তাদের এ কাজের কথা জানিয়ে দেবে এমনি সময়ে যে তারা অনুধাবন করতে পারবে না’।” [আল-কুরআন, ১২:১৫] আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দ সম্পর্কে এরকম আরো অনেক বর্ণনা রয়েছে।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মা আমিনা বিনতে ওয়াহহাব বলেন, যখন মহানবী (ﷺ) ধরাধামে শুভাগমন করেন, তৎক্ষণাৎ তিনি মাটির ওপর নিজের পবিত্র হাত দুটো প্রসারিত করে পবিত্র শির মোবারক আসমানের দিকে উত্তোলন করেন। [আবূল হুসাইন হতে গ্রহণ করে ইমাম ইবনে জাওযী নিজ ‘ওয়াফা’ গ্রন্থে সংকলন করেন; বর্ণনাটি মুরসাল]


মহানবী (ﷺ) নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেন, “আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন-ই (জাহেলীয়া যুগের) প্রতিমা/মূর্তিকে আমার কাছে ঘৃণিত করে দেয়া হয়েছিল, ঠিক যেমনিভাবে করা হয়েছিল (জাহেলীয়া যুগের) কাব্যচর্চাকে। অন্ধকার যুগের কোনো রসম-রেওয়াজ (কুপ্রথা)-এর প্রলোভনে আমি পড়িনি, ব্যতিক্রম শুধু দুটো ক্ষেত্রে। আল্লাহতা’লা ওগুলো হতে আমাকে রক্ষা করেন এবং আমি আর ওগুলো পুনরায় পালন করিনি।” [আবূ নুয়াইম কৃত দালা’য়েল]


অতএব, পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলী এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তথা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁরা (অভীষ্ট) লক্ষ্যে না পৌঁছুনো পর্যন্ত একের পর এক আল্লাহতা’লার (রহমতের) সুবাতাস আলতোভাবে তাঁদেরকে উৎকর্ষে ভাসিয়েছিল, আর মা’রেফতের (আধ্যাত্মিকতার) আলো/জ্যোতি তাঁদের অন্তরগুলোকে আলোকিত করেছিল। তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন, কেননা আল্লাহ পাক তাঁদেরকে পয়গম্বর হিসেবে মনোনীত করেছিলেন এবং শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকেই মহৎ গুণ অর্জনের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “আর সে (মূসা আলাইহিস্ সালাম) যখন আপন যৌবনে উপনীত হলো এবং পূর্ণ শক্তিপ্রাপ্ত হলো, তখন আমি তাকে হুকুম ও জ্ঞানদান করলাম।” [আল-কুরআন, ২৮:১৪; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব নিজ ‘নূরুল এরফান’ গ্রন্থে এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন যে খোদাপ্রদত্ত এ হুকুম ও জ্ঞান নব্যুওয়ত নয়, বরং তারও আগে মঞ্জুরিকৃত এলমে লাদুন্নী তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞান – বঙ্গানুবাদক]


আমরা দেখতে পাই যে অন্যান্য মানুষের মাঝেও এসব গুণের কিছু কিছু বিদ্যমান, কিন্তু সবগুলো নয়। কোনো ব্যক্তি জন্মগতভাবে এগুলোর কিছু কিছু পেয়ে থাকেন, কিন্তু তিনি আল্লাহতা’লার আশীর্বাদধন্য হয়েই কেবল এগুলো সহজে পূর্ণ করার সুযোগ পান। আমরা এর বাস্তব চিত্রটি দেখতে পাই যে আল্লাহতা’লা কিছু শিশুকে উত্তম স্বভাব-চরিত্র ও আচরণ, বুদ্ধিমত্তা ও সততা, সত্যবাদিতা ও উদারতাসহ সৃষ্টি করেন, আর কিছু শিশুকে এর বিপরীতও সৃষ্টি করেন।


অতঃপর যা ঘাটতি থাকে, তা মানুষেরা অর্জনের মাধ্যমে মেটাতে পারেন। তাঁদের মধ্যে যে অভাব, তা তাঁরা নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সাধনার মাধ্যমে দূর করতে পারেন এবং নিজেদের ভারসাম্যহীনতারও সুসামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন। এই দুটো অবস্থা অনুযায়ী মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রত্যেকেই যে উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছে, তাতে সহজে অভ্যস্ত। এ কারণেই সালাফ (প্রাথমিক যুগের পুণ্যবান মুসলমান)-বৃন্দ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণ সহজাত না অর্জিত, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন। আত্ তাবারী (رحمة الله) জনৈক সালাফের বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “আল্লাহর প্রিয় বান্দার ক্ষেত্রে উত্তম চরিত্র জন্মগত এবং সহজাত প্রবৃত্তি।” তিনি এ কথা সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) ও আল-হাসান বসরী (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন। আর আমরা এটাকে সহীহ (বিশুদ্ধ/নির্ভরযোগ্য) হিসেবে পেয়েছি।


হযরত সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) মহানবী (ﷺ)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যে ছাড়া প্রকৃতিগতভাবে ঈমানদার মুসলমানের সব ধরনের চারিত্রিক অপূর্ণতা থাকতে পারে।” [ইবনে ‘আদী; ইমাম ইবনে হাম্বল বর্ণিত সহীহ হাদীস]


হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) বলেন, “সাহসিকতা ও কাপুরুষতা এমন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহ যেখানে ইচ্ছে সেখানে স্থাপন করে থাকেন।”

এই সব প্রশংসনীয় ও সুন্দর মহৎ গুণ অসংখ্য, তবে আমরা এগুলোর মৌলভিত্তি উল্লেখ ও ইঙ্গিত করবো। ইনশা’আল্লাহ তা’লা আমরা প্রতিপাদন ও প্রতিষ্ঠা করবো যে মহানবী (ﷺ)-এর মাঝে সমস্ত গুণেরই সমাহার ছিল।


পরিচ্ছেদ – ১১/ তাঁর বুদ্ধিমত্তা


বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে সকল জ্ঞানের শাখার শেকড়, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা প্রবাহিত হওয়ার মূলাধার ও উৎসমুখ। এর থেকেই নিঃসৃত হয় সুতীক্ষ্ণ উপলব্ধি, স্পষ্ট চিন্তা ও ধারণা, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ, সঠিক মতামত, নিজ সত্তার জন্যে কী ভালো তা জানা, ক্ষুধা ও কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বিচক্ষণ নীতি ও তার বাস্তবায়ন, আর সৎ গুণাবলী অর্জন ও দোষত্রুটি বর্জন।


আমরা ইতোমধ্যে এক্ষেত্রে মহানবী (ﷺ)-এর মাক্বাম বা মর্যাদার কথা ইঙ্গিত করেছি এবং মেধার ক্ষেত্রে তাঁর অর্জন-ও উল্লেখ করেছি; আর তাঁর সুগভীর জ্ঞান সম্পর্কেও বলেছি, যে জ্ঞানের পর্যায়ে অন্য কোনো নশ্বর সত্তা পৌঁছুতে পারেনি। তাঁর শাহী (রাজকীয়) মর্যাদা এ থেকেই নিঃসৃত এবং তা এরই এক বহিঃপ্রকাশ, যার সত্যাসত্য নির্ধারণ এমন যে কেউ করতে পারবেন, যিনি অধ্যয়ন করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আহওয়াল তথা (আধ্যাত্মিক) অবস্থার ক্রমবিকাশ, তাঁর জীবনের পথ-চলা, তাঁর হাদীস তথা বাণীর জ্ঞান-প্রজ্ঞা, তৌরাত, ইনজিল ও পূর্ববর্তী ঐশীগ্রন্থসমূহে নিহিত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান, পুণ্যাত্মাবৃন্দের অন্তর্দৃষ্টিমূলক জ্ঞান ও পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ইতিহাস ও যুদ্ধসম্পর্কিত জ্ঞান, রূপক দ্বারা কথা বলার ক্ষেত্রে তাঁর গুণ, মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, শরীয়তের আইন-কানুন প্রয়োগ, তাঁর অতুলনীয় আদব (শিষ্টাচার) ও প্রশংসাযোগ্য অভ্যেস ও আচার-আচরণের ভিত্তি স্থাপন।


এটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় জ্ঞানের প্রতিটি শাখায়, যেখানে মানুষেরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণীকে মডেল বা দৃষ্টান্ত এবং তাঁরই উদাহরণগুলোকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেন, যেমনটি করা হয় স্বপ্নের তা’বির করার সময়, চিকিৎসা ও ওষুধের বেলায়, উত্তরাধিকারের অংশীদারিত্বে, বংশপরম্পরায় এবং অনুরূপ অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেগুলো আমরা তাঁর মো’জেযা তথা অলৌকিক ঘটনাগুলোর আলোচনাকালে আলোকপাত করবো, ইনশা’আল্লাহ। এগুলোর সব কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা গ্রহণ বা পূর্ববর্তী শাস্ত্রলিপি পাঠ অথবা তাদের পণ্ডিতদের কাছ থেকে জানা ব্যতিরেকেই হয়েছিল। তিনি ছিলেন উম্মী নবী (عليه السلام), যিনি এগুলো সম্পর্কে জেনেছিলেন আল্লাহতা’লা কর্তৃক তাঁরই বক্ষ সম্প্রসারণ, বিষয়াবলীর দিকনির্দেশনা দান এবং কুরআন মজীদ তেলাওয়াতকরণ দ্বারা।


মহানবী (ﷺ) কী রকম ছিলেন সে সম্পর্কে অনুসন্ধান করে এবং তাঁর নবুওয়্যতের ফায়সালাকারী প্রমাণগুলো যাচাই করে সামান্যতম সন্দেহ ছাড়াই এ বিষয়টি নির্ধারণ করা যায়। আমরা প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে এটাকে দীর্ঘ করবো না, কেননা সেগুলোর সর্বমোট সংখ্যা নির্ণয় করা বা সেগুলো সম্পর্কে সামগ্রিক বর্ণনা দেয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার।


আল্লাহতা’লা হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে ভবিষ্যতে যা ঘটবে এবং অতীতে যা ঘটেছিল, মহান প্রভুর বিস্ময়কর ক্ষমতা ও তাঁরই মালাকুতের বিশালত্ব সম্পর্কে যা শিখিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন, তা স্বীকার করাটাই মহানবী (ﷺ)-এর মেধার জন্যে যথোপযুক্ত ছিল।


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “আর (হে মাহবূব) আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা কিছু আপনি জানতেন না এবং আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।” [আল-কুরআন, ৪:১১৩]

মহান প্রভুর এই মহা অনুগ্রহ নিরূপণ করতে গিয়ে বুদ্ধি হতভম্ব হওয়ার দশা হয়। আর বাকশক্তি-ও লোপ পায়, যা এর পূর্ণ বিবরণ দেয়া তো দূরে, কোনো রকম বর্ণনা দিতেও অপারগ।


পরিচ্ছেদ – ১২/ তাঁর ধৈর্য, দীর্ঘ দুঃখকষ্ট ও ক্ষমা প্রদর্শন


ধৈর্য, দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগ, শাস্তি বিধানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা প্রদর্শন, এসব বৈশিষ্ট্য আর ক্লেশ সহ্য করার ক্ষমতা একে অপর হতে পৃথক। ধৈর্য (হিলম্) হচ্ছে উস্কানির মুখেও সম্মান ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। দীর্ঘ কষ্টভোগ (এহতেমাল) হচ্ছে আঘাত ও জখম হওয়ার মুখেও আত্মসংযমী ও আত্মসমর্পিত থাকা। ধৈর্য (সবর ) সেটার অনুরূপ হলেও অর্থের দিক থেকে এটা কিছুটা ভিন্ন। আর ক্ষমা প্রদর্শন (’আফওয়া) মানে হলো অন্য কারো প্রতি কোনো রকম হিংসা-বিদ্বেষ (অন্তরে) লালন করতে অস্বীকৃতি।


এসব গুণ-ই সেই আদবের (শিষ্টাচারের) অংশ যা দ্বারা আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে বিভূষিত করেন। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “হে মাহবূব! ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করুন, সৎকর্মের নির্দেশ দিন এবং মূর্খদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন” [আল-কুরআন, ৭:১৯৯; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব (رحمة الله) কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]। এ কথা বর্ণিত আছে (তাফসীরে ইবনে জারির তাবারী, ইবনে আবি হাকীম ও অন্যান্য কেতাবে) যে, এই আয়াতটি যখন মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল, তখন তিনি হযরত জিবরীল আমিন (عليه السلام)-কে এটা ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। হযরত জিবরীল (عليه السلام) তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, “যিনি জানেন (মানে খোদাতা’লা) তাঁকে জিজ্ঞেস করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।” অতঃপর ফেরেশতা প্রস্থান করেন এবং ফিরে এসে হুযূর পাক (ﷺ)-কে বলেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আল্লাহ পাক আপনাকে আদেশ করেন যেন আপনি তাদের সাথে মিলেমিশে যান যারা আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল; আর তাদেরকে দান করুন যারা আপনাকে দিতে অস্বীকার করেছিল; আর তাদেরকে ক্ষমা করে দিন যারা আপনার প্রতি অন্যায় করেছিল।”


আল্লাহতা’লা মহানবী (ﷺ)-এর কাছে (হযরত লোক্বমান-সম্পর্কিত ঘটনা) বর্ণনা করেন: “এবং যে বিপদাপদ তোমার প্রতি আপতিত হয় সেটার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করো” [আল-ক্বুরআন, ৩১:১৭]। তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “সুতরাং আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমনিভাবে সাহসী রাসূল (عليه السلام)-বৃন্দ ধৈর্য ধারণ করেছেন” [আল-ক্বুরআন, ৪৬:৩৫]। তিনি আরো ফরমান: “এবং তাদের উচিত যেন ক্ষমা করে দেয় এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করে” [আল-ক্বুরআন, ২৪:২২]। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান: “এবং নিশ্চয় যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করেছে এবং ক্ষমা করেছে, তবে এটা অবশ্য সৎ সাহসের কাজ”[আল-ক্বুরআন, ৪২:৪৩; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله) প্রণীত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ধৈর্যধারণ ও দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগের ফলাফল সুস্পষ্ট। প্রতিটি মানুষেরই সময়ে সময়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটা একটা জানা ব্যাপার। কিন্তু মহানবী (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে আঘাতের মাত্রা যতো বড় হতো, ততোই তাঁর ধৈর্যধারণ আরো বৃদ্ধি পেতো; অতিষ্ঠকারী লোকদের বাড়াবাড়ির মুখেই শুধু তাঁর ধৈর্যধারণ আরো বেড়ে যেতো।

হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুটো বিষয়ের মাঝে পছন্দ করার ক্ষেত্রে সহজতর বিষয়টি বেছে নিতেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত তা ভুল হিসেবে বিবেচিত না হতো; ভুল কর্ম হলে তা হতে তিনি সবার চেয়ে বেশি দূরত্ব বজায় রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের খাতিরে প্রতিশোধ নিতেন না, যতোক্ষণ না কোনো কিছু আল্লাহতা’লার সম্মান (’হুরমা’) লঙ্ঘন করতো। অতঃপর তিনি আল্লাহর ওয়াস্তে প্রতিবিধানসূচক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।” [মুসলিম ও আল-বুখারী এবং আবূ দাউদ]


বর্ণিত আছে যে উহুদের জ্বিহাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যখন দাঁত মোবারক শহীদ হয় এবং পবিত্র মুখে আঘাত লাগে, তখন সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর জন্যে এ ঘটনা বাস্তবিক-ই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা বলেন, “আপনি যদি তাদের প্রতি শুধু লা’নত (অভিসম্পাত) দিতেন (তাহলেই তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো)!” মহানবী (ﷺ) উত্তর দেন, “আমাকে অভিসম্পাত দেয়ার জন্যে প্রেরণ করা হয়নি, বরঞ্চ (দ্বীনের প্রতি) আহ্বানকারী ও (খোদার) রহমত (তথা করুণা) হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত দিন (মানে সঠিক পথপ্রদর্শন করুন)। কেননা, তারা জানে না (সঠিক রাস্তা সম্পর্কে)।”


আরেকটি বর্ণনায় হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। পয়গম্বর নূহ (عليه السلام) তাঁর কওমের প্রতি অভিসম্পাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘হে আমার রব্ব! পৃথিবীপৃষ্ঠে কাফেরদের মধ্য হতে কোনো বসবাসকারীকে (অস্তিত্বশীল) রাখবেন না’ [আল-ক্বুরআন, ৭১:২৬]। আপনি যদি অনুরূপ কোনো লা’নত আমাদের প্রতি দিতেন, তাহলে আমাদের শেষ ব্যক্তিটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। আপনার মোবারক পিঠ পদদলন করা হয়েছে, আপনার পবিত্র মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করা হয়েছে, এবং দাঁত মোবারক-ও ভেঙ্গেছে, তথাপিও আপনি ভালো ছাড়া কোনো কিছু উচ্চারণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আপনি বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত দিন (মানে সঠিক পথপ্রদর্শন করুন)। কেননা, তারা জানে না (সঠিক রাস্তা সম্পর্কে)‘।”


কাজী আবূল ফযল (رحمة الله) বলেন: চোখ চেয়ে দেখুন, উদারতার কী পূর্ণতা, এহসান তথা সদগুণাবলীর কী মাত্রা, চমৎকার চারিত্রিক উৎকর্ষ, মহত্ত্ব ও সীমাহীন ধৈর্যের নিদর্শন মহানবী (ﷺ)-এর এই কথায় ফুটে ওঠেছে! তিনি তাদের ব্যাপারে কেবল নীরবতায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তাদের ক্ষমাও করে দিয়েছেন, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছেন, করুণাশীল-ও হয়েছেন, তাদের জন্যে দোয়া ও শাফায়াত তথা সুপারিশ-ও করেছেন। তিনি (দোয়ায়) বলেন, “ক্ষমা” বা “পথপ্রদর্শন করুন”, অতঃপর তাদের অজ্ঞতার জন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেন, “তারা জানে না।”

একবার এক ব্যক্তি [হুনাইনের যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীমতের মালামাল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক বণ্টনের সময় মোনাফেক ও পরে খারেজী হিসেবে নিহত যুল-খোয়াইসারা] হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে বলে, “ইনসাফ করুন। কেননা, এভাবে অংশের বণ্টন আল্লাহর পুরস্কারপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কৃত নয়।” এমতাবস্থায় তিনি শুধু ওই লোকের অজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে পরামর্শের আকারে বলেন, “ধিক তোমার প্রতি! আমি ইনসাফ না করলে কে ইনসাফকারী হবে? ইনসাফ না করলে আমি-ই তো ব্যর্থ ও পথভ্রষ্ট হবো” [হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে মুসলিম বর্ণিত; আল-বুখারী ও আল-বায়হাক্বীতেও উদ্ধৃত]। অধিকন্তু,  তিনি ওই লোককে হত্যা করতে উদ্যত তাঁর সাহাবী (رضي الله عنه)-দের বাধাও দেন।


গাওরাস্ ইবনে হারিস্ ও কিছু লোক যাতু’র রিক্বা অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করার সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মহানবী (ﷺ)-কে খুঁজে একটি গাছের নিচে বসা অবস্থায় পান। উন্মুক্ত তরবারি হাতে সামনে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত হুযূর পূর নূর (ﷺ) তাকে বাধা দেননি। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেন, “কে আপনাকে আমার কাছ থেকে রক্ষা করবেন এখন?” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাব দেন, “আল্লাহ।” (এ কথা শুনে ভয়ে কম্পমান হয়ে) গাওরাসের হাত থেকে তরবারি পড়ে যায় এবং মহানবী (ﷺ) তা উঠিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “কে তোমাকে আমার কাছ থেকে রক্ষা করবে এখন?” তিনি বলেন, “আমাকে সেরা পদ্ধতিতে শাস্তি দিন।” অতঃপর হুযূর পাক (ﷺ) তাঁকে ছেড়ে দেন এবং ক্ষমাও করেন। গাওরাস্ ইবনে হারিস্ তাঁর লোকদের কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, “আমি তোমাদের কাছে এসেছি মানবজাতির মাঝে সেরা জনের সান্নিধ্য হতে।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


মহানবী (ﷺ)-এর ক্ষমা করার শ্রেষ্ঠ নজির হচ্ছে এক ইহুদী রমনীর বেলায়, যিনি ভেড়ার গোস্তে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করার পর তা স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তিনি তাকে মাফ করে দেন। [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


লাবিদ ইবনে আ’যম বাণ-টোনা করার পর নবী করীম (ﷺ) তাকে ক্ষমা করে দেন, যদিও তিনি ওই ঘটনার আগেই এতদবিষয়ে ব্যাখ্যাসম্বলিত ওহী প্রাপ্ত হয়ে অবহিত ছিলেন। তিনি এমন কি তাকে তিরস্কারও করেননি, শাস্তি দেয়া তো দূরে। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ও অন্যান্য মোনাফেক্কদের দ্বারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ ও কুৎসা রটনার গুরুতর ঘটনা সত্ত্বেও তাদেরকে মাফ করে দেন। অপরদিকে, যে ব্যক্তি ইঙ্গিত করেছিলেন তাদের (মোনাফেক্বদের) কয়েকজনকে হত্যা করতে হবে, তাকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “এ কথা যেন বলা না হয় যে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দকে হত্যা করেন।” [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “আমি একবার রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। ওই সময় তিনি একটি কালো আলখাল্লা পরা অবস্থায় ছিলেন। এক বেদুঈন আরব লোক তাঁর আলখাল্লা ধরে এমন জোরে হেঁচকা টান দেন যে সেটার শক্ত গলার ধার তাঁর মোবারক গলায় দাগ বসিয়ে দেয়। অতঃপর ওই বেদুঈন বলেন, ‘ওহে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আপনার অধীনে থাকা আল্লাহর সম্পদ দ্বারা আমার এই দুটি উট বোঝাই করতে আমাকে সুযোগ দেয়া হোক। আপনি তো আর আপনার নিজস্ব সম্পদ বা আপনার পৈতৃক সম্পদ হতে আমাকে তা করতে দেবেন না।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুযূরে পূর নূর (ﷺ) তাকে বলেন, ‘এই সম্পদ তো আল্লাহতা’লার আর আমি হলাম তাঁরই বান্দা।’ এরপর তিনি আরো বলেন, ‘ওহে বেদুঈন, তুমি আমার সাথে যা করেছো,  সেজন্যে আমি কি এর কোনো প্রতিবিধান করবো?’ বেদুঈন উত্তর দেন, ‘না।’ মহানবী (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন নয়?’ বেদুঈন জবাব দেন, ‘কেননা, আপনি কোনো মন্দ কাজের প্রতিদান কোনো মন্দ কাজের মাধ্যমে দেন না।’ এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হেসে ফেলেন এবং এ মর্মে নির্দেশ দেন যেন একটি উট যব দ্বারা এবং অপরটি খেজুর দ্বারা বোঝাই করা হয় ।”[প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]  

হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি কখনো দেখিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর প্রতি কৃত কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছেন – যতোক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর এমন কোনো হুকুম হয়েছে যাকে সম্মান করতেই হতো। তিনি কাউকেই তাঁর হাত দিয়ে কোনো আঘাত করেননি, ব্যতিক্রম শুধু আল্লাহর রাস্তায় জ্বেহাদ করার সময় (মানে যুদ্ধক্ষেত্রে)। তিনি কখনোই কোনো সেবক বা নারীকেও আঘাত করেননি।” [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


এক ব্যক্তিকে মহানবী (ﷺ)-এর সামনে আনা হয় এবং তার সম্পর্কে তাঁকে বলা হয়, “এই লোক আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বলেন, “ভয় করো না! ভয় করো না! তুমি যদি আমাকে হত্যা করতেও চাইতে, তবুও আমাকে হত্যা করার সেই ক্ষমতা তোমায় দেয়া হতো না।” [ইবনে তাবারানী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, সহীহ এসনাদ-সহ]


মুসলমান হবার আগে যায়দ ইবনে সা’না (رضي الله عنه) হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কাছে এসে তাঁর কাছে দেয়া হাওলাতের পাওনা দাবি করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাঁধের জামা ধরে টানাটানি ও রূঢ় আচরণ করেন, আর তাঁকে বলেন, “বনূ আবদুল মোত্তালেব, তুমি (ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে) গড়িমসি করছো।” হযরত উমর (رضي الله عنه) তাকে হটিয়ে দেন এবং কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন। মহানবী (ﷺ) এই সময় শুধু স্মিত হাসেন। অতঃপর তিনি বলেন, “ওহে উমর, তোমার কাছ থেকে তার এবং আমার অন্য জিনিসের প্রয়োজন ছিল; (তা হলো) আমাকে সুষ্ঠুভাবে ঋণ পরিশোধ করতে বলা, আর তাকে ভালোভাবে (অর্থাৎ, সুন্দর আচরণের মাধ্যমে) তা আদায় করতে বলা।” তিনি আরো বলেন, “আমার দেনা এখনো তিনটি।” অতঃপর তিনি হযরত উমর (رضي الله عنه)-কে ওই ঋণ পরিশোধ করতে বলেন এবং তিনি তাতে আরো ২০ ‘সা’ বেশি যোগ করেন, যেহেতু হযরত উমর (رضي الله عنه) ওই ইহুদীকে তিরস্কারের মাধ্যমে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিলেন। যায়দ ইবনে সা’না (رضي الله عنه)-এর বক্তব্য অনুযায়ী এটাই ছিল তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণ। তিনি বলেন, “হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মধ্যে নবুওয়্যতের দুটি নিদর্শন আমার তখনো দেখা বাকি ছিল: অল্পতে রেগে যাওয়ার পরিবর্তে ধৈর্য ধারণ ও চরম মূর্খতার মুখোমুখি হয়ে ধৈর্য ধারণ মাত্রার আরো বৃদ্ধি প্রাপ্তি। আমি এ বিষয়গুলোতে তাঁকে পরীক্ষা করেছিলাম এবং তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, সে মোতাবেক-ই পেয়েছিলাম।” [আল-বায়হাক্বী, ইবনে হিব্বান, তাবারানী ও আবূ নু’য়াইম, সহীহ সনদে]


রাসূলে পাক (ﷺ)-এর ধৈর্য ধারণ ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেয়ার মাহাত্ম্যসম্পর্কিত হাদীসের সংখ্যা এতো বেশি যে সবগুলো এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। আমরা যেগুলো উদ্ধৃত করেছি, সেগুলোই যথেষ্ট হওয়া উচিত। এই হাদীসগুলো বিভিন্ন সহীহ হাদীসের সংকলনে এবং অনেক আলাদা আলাদা এসনাদ-সহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য বইপত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। কুরাইশ গোত্র কর্তৃক মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি যে রূঢ় আচরণ করা হয়েছিল এবং জাহেলীয়্যা যুগে তাদের হাতে তাঁকে যে আঘাত ও কঠিন দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল – যতোক্ষণ না আল্লাহতা’লা তাঁকে তাদের ওপর বিজয়ী করেছিলেন – এসব বর্ণনায় তা ফুটে ওঠেছে। (ফতেহ মক্কার পরে) কুরাইশ গোত্র সন্দেহ করেনি এ ব্যাপারে যে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা হবে এবং তাদের ধনাঢ্য লোকদেরকে হত্যা করা হবে, কিন্তু মহানবী (ﷺ) সবাইকে মাফ করে দিতেই থাকেন এবং তিনি কারোরই শাস্তি বিধান করেননি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “আমি তোমাদের সাথে যে আচরণ করবো, সে সম্পর্কে তোমরা কী বলো?” তারা উত্তর দেয়, “উত্তম (আচরণ), একজন উদার ভ্রাতা ও উদার ভাতিজা (হিসেবে)।” তিনি বলেন, “আমি ঠিক সেভাবেই বলছি, যেভাবে আমার ভাই ইউসূফ (عليه السلام) বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদেরকে কোনো রকম তিরস্কার করা হবে না’ [আল-ক্বুরআন, ১২:৯২]। অতএব, যাও, তোমরা মুক্ত।”


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “ফজরের নামাযের ওয়াক্তে আটজন লোক তা’নিম এলাকা  [মক্কার উত্তরে অবস্থিত, যেখান থেকে মক্কাবাসী মানুষ উমরাহ হজ্জ্বের জন্যে এহরাম বাঁধেন] হতে আগমন করে; এদের উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (ﷺ)-কে হত্যা করার। কিন্তু এরা ধরা পড়ে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের মুক্ত করে দেন। আল্লাহ পাক এ মর্মে আয়াতে করীমা নাযেল করেন, ‘এবং তিনি-ই, যিনি তাদের হাতকে তোমাদের থেকে প্রতিরুদ্ধ করেছেন’।” [আল-ক্বুরআন, ৪৮:২৪] {হাদীসটি বিদ্যমান মুসলিম, আবূ দাউদ ও নাসাঈ শরীফে}


অনুরূপভাবে, আবূ সুফিয়ান হুযূর পাক (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচারীদেরকে জোটবদ্ধ করা, তাঁর চাচা (আমীরে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহূ)-কে [আবূ সুফিয়ান ও তাঁর স্ত্রীর উস্কানিতে আবিসিনীয় গোলাম দ্বারা] হত্যা, অধিকন্তু অনেক সাহাবা (رضي الله عنه)-কে হত্যা এবং অন্য সাহাবা (رضي الله عنه)-দেরকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বিকলাঙ্গ করা সত্ত্বেও যখন মহানবী (ﷺ)-এর সামনে তাঁকে আনা হয়, তখন তিনি তাঁকে ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর সাথে নম্র আচরণ করেন। তিনি বলেন, “ওহে আবূ সুফিয়ান, আল্লাহতা’লা আপনার প্রতি সদয় হোন। এখনো কি সময় হয়নি আপনার এ কথা জানার যে আল্লাহতা’লা ছাড়া কোনো মা’বূদ (উপাস্য) নেই?” আবূ সুফিয়ান উত্তর দেন, “আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন! আপনি কতোই না ধৈর্যশীল ও উদার, আত্মিয়তার বন্ধন (এখনো) বজায় রেখেছেন!” [আত্ তাবারানী ও আল-বায়হাক্বী]


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন মানুষের মাঝে রাগ হতে সবচেয়ে দূরে এবং তাঁর রেযামন্দি তথা সন্তুষ্টি লাভের বেলায় সবচেয়ে সহজতর।


পরিচ্ছেদ – ১৩/ তাঁর দয়া ও উদারতা


উদারতা/মহত্ত্ব, হিতাকাঙ্ক্ষা, মহানুভবতা ও বদান্যতা, এসবেরও আলাদা আলাদা অর্থ বিদ্যমান। কিছু মানুষ এগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন শাখায় বিভক্ত করে থাকেন। তারা বলেন যে কারাম তথা উদারতা/মহত্ত্ব হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী কোনো কাজে খুশি মনে দান করা। তাঁরা এটাকে সাহস-ও বলেছেন, যা নিচুতার বিপরীত। বদান্যতা হচ্ছে অন্যদের কাছ থেকে কারো যা প্রাপ্য সেটার প্রতি ইচ্ছাকৃত নিস্পৃহতা। এটা মন্দ স্বভাবের বিপরীত। মহানুভবতা হচ্ছে সহজে ব্যয় করা এবং প্রশংসিত নয় এমন কিছু অর্জনকে এড়িয়ে চলা। এটা কৃপণতার বিপরীত।


এসব মহৎ গুণের ক্ষেত্রে মহানবী (ﷺ)-এর কোনো সমকক্ষ ছিল না এবং কেউই তাঁকে এতে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারেননি। তাঁকে যাঁরা চিনতেন, তাঁরা সবাই তাঁর সম্পর্কে এভাবেই বর্ণনা করেছেন।


ইবনে আল-মুনকাদির (رحمة الله) হযরত জাবের ইবনে আবদিল্লাহ (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছেন, “মহানবী (ﷺ)-কে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কখনোই উত্তরে ‘না’ বলতেন না” [আল-বুখারী]। সর্ব-হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) ও সাহল ইবনে সা’আদ (رضي الله عنه) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ) ছিলেন উপহারসামগ্রী দানের ক্ষেত্রে অন্যান্যদের মাঝে সবচেয়ে উদার এবং রমযান মাসেও তিনি ছিলেন সবার চেয়ে সহৃদয়বান। জিবরীল আমীন (عليه السلام)-এর সাথে যখন তাঁর সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি এমন কি প্রেরিত (বৃষ্টি বর্ষণকারী ও উপকারী) বায়ুর চেয়েও উদার ছিলেন।” [মুসলিম ও বুখারী শরীফ]


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে কিছু একটা চেয়েছিলেন, তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সমস্ত ভেড়া দান করেন। ওই ব্যক্তি স্বগোত্রীয় লোকদের কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, ‘ওহে মানুষেরা, তোমরা ইসলাম ধর্ম কবূল করো, কেননা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এমনভাবে উপহার সামগ্রী দান করেন যে তিনি দারিদ্র্যকে ভয়-ই পান না।’ “ [মুসলিম]  


 


মহানবী (ﷺ) একাধিক ব্যক্তিকে এক’শ উট দান করেন। সাফওয়ান‘কে তিনি এক’শটি উট, এরপর আরো এক’শটি, অতঃপর আরো এক’শটি উট দান করেন। ওহী নাযেল হওয়ার আগে থেকেই এটা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। ওয়ারাক্বা ইবনে নাওফাল একবার তাঁকে বলেন, “আপনি পরিশ্রমে ক্লান্তদের সমর্থন যোগান এবং দুঃস্থদের টিকিয়ে রাখেন।” [আল-বুখারী ও মুসলিম]


 


হাওয়াযিম গোত্রের ৬০০০ বন্দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের হাতে প্রত্যার্পণ করেন। তিনি হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-কে এতো সোনা দান করেছিলেন যে তিনি তা বহন করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। নব্বই হাজার দিরহাম তাঁর কাছে অানা হলে তিনি তা একটি (খড়ের তৈরি) ফরাশের ওপর স্থাপন করেন এবং এরপর উঠে দাঁড়িয়ে সেগুলো বণ্টন করেন। তিনি এর প্রার্থীদের কাউকেই ফিরিয়ে দেননি, যতোক্ষণ না সেগুলো ফুরিয়ে গিয়েছিল।


 


একবার এক ব্যক্তি এসে তাঁর কাছে কিছু একটা চান। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার কাছে কিছুই নেই, তবে তুমি যা চাও তা কিনতে পারো; পরে অর্থ জোগাড় হলে আমি তা তোমার হয়ে পরিশোধ করবো।” এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) তাঁকে বলেন, “আল্লাহ পাক আপনার সামর্থ্যের বাইরে কোনো বোঝা আপনাকে বহন করতে বাধ্য করেননি।” এ কথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চিন্তিত হন। অতঃপর এক আনসার সাহাবী (رضي الله عنه) বলেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! (অর্থ) ব্যয় করুন এবং আরশের অধিপতির (খোদাতা’লার) তরফ থেকে তা হ্রাস পাবার শঙ্কাবোধ না করুন।” এতে মহানবী (ﷺ) স্মিত হাসেন এবং তাঁর (অনুভূত) আনন্দ ও সুখ তাঁরই মোবারক চেহারায় ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, “আমি এই ব্যাপারেই আদিষ্ট হয়েছি।”[আত্ তিরমিযী (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত]  


 


বর্ণিত আছে যে মু’ওয়াব্বেয ইবনে ‘আফরা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি মহানবী (ﷺ)-এর খেদমতে কিছু খেজুর ও শশা পেশ করলে তিনি আমাকে এক হাত-ভর্তি রত্নখচিত অলঙ্কারাদি ও স্বর্ণ দান করেন।”


 


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পরের দিনের জন্যে কোনো কিছু মওজূদ করতেন না।”


 


হুযূরে পাক (ﷺ)-এর উদারতা/মহত্ত্ব ও বদান্যতা সম্পর্কে এমন আরো অনেক বর্ণনা বিদ্যমান।

হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে একবার এক লোক মহানবী (ﷺ)-এর দরবারে আসেন কোনো নির্দিষ্ট কিছু চাইতে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই লোকের কাছ থেকে (ইতিপূর্বে) অর্ধেক ওয়াসক্ব্ ধার করেছিলেন, আর লোকটি তা-ই ফেরত নিতে এসেছিলেন। হুযূর পূর নূর (ﷺ) তাকে এক ওয়াসক্ব্  (৬০ সা’ পরিমাণ, যা আনুমানিক ১৩৫ কেজি) দান করেন। তিনি বলেন, “এর অর্ধেক হচ্ছে কর্জ পরিশোধ, বাদবাকিটুকু উপহার।” [কে এটা বর্ণনা করেছেন, তা অজ্ঞাত]   


পরিচ্ছেদ – ১৪/ তাঁর সাহস ও পরাক্রম


 


সাহস হলো এমন একটি গুণ যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির আনুগত্যকারী ক্রোধ-শক্তি। আর পরাক্রম কোনো সত্তার শৌর্য-বীর্যকে বোঝায়, যে সত্তা মৃত্যুর মুখোমুখি হলে তার ভীতির পরিবর্তে পরাক্রম-ই প্রশংসাযোগ্য হয়।


 


মহানবী (ﷺ)-এর বেলায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটা তাঁর মোটেও অজানা ছিল না। তিনি একাধিকবার এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, যেখান থেকে সাহসী বীরেরাও পলায়ন করে থাকে। কিন্তু ছিলেন অটল, অবিচল এবং এসব পরিস্থিতিতে পিছু হটেননি। বরঞ্চ তিনি অগ্রসর হয়েছেন এবং দোদুল্যমান-ও হননি। এমন কোনো সাহসী ব্যক্তি-ই নেই যিনি কোনো না কোনো মুহূর্তে পিছু হটেননি, কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন মহানবী (ﷺ)।


 


আবূ এসহাক্ব আল-হামদানী বলেন যে এক ব্যক্তি আল-বারা’আ (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হুনায়নের যুদ্ধে ছেড়ে পিছু হটেননি?” তিনি জবাব দেন, “কিন্তু হুযূরে পাক (ﷺ) পিছু হটেননি।” এরপর তিনি আরো বলেন, “আমি তাঁকে তাঁর সাদা খচ্চরের পিঠে উপবিষ্ট দেখতে পাই। আবূ সুফিয়ান সেটার লাগাম ধরে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলছিলেন, ‘আমি (আল্লাহর) রাসূল, আর এটা কোনো মিথ্যে নয়।’ ” অন্য কেউ একজন যোগ করেন যে তিনি বলছিলেন, “আমি ইবনে আব্দিল মোত্তালিব।” বর্ণিত হয়েছে যে ওই দিন তাঁর মতো পরাক্রমশালী আর কেউই ছিলেন না। অপর একজন বলেন, “মহানবী (ﷺ) তাঁর খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে আসেন।” ইমাম মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর কথা, যিনি বলেন, “মুসলমান যোদ্ধারা যখন (মক্কার) কুফফারদের মুখোমুখি হন, তখন তাঁরা পিছু হটে আসেন; কিন্তু মহানবী (ﷺ) কুফফারদের দিকে তাঁর খচ্চর ছুটিয়ে যান; ওই সময় আমি লাগাম টেনে ধরে তাঁর খচ্চরটিকে সামনে যেতে দিতে চাইছিলাম না। আবূ সুফিয়ান ছিলেন হুযূর পাক (ﷺ)-এর জিনের পাশে অবস্থানরত। অতঃপর মহানবী (ﷺ) সবাইকে ডাক দেন এই বলে, “ওহে মুসলমান সকল!’”


 


কথিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাগ করলে তা একমাত্র আল্লাহর খাতিরেই করতেন এবং কোনো কিছুই তাঁর রাগের সামনে দাঁড়াতে পারতো না।


 


হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বলেন, “আমি আর কাউকেই মহানবী (ﷺ)-এর মতো এতো সাহসী, পরাক্রমশালী ও উদার দেখিনি, বা তাঁর সঙ্গের মতো সুখদায়ক কারো সঙ্গ-ও দেখিনি।” [আল-দারিমী] 

হযরত আলী (ক:) বলেন, “পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, ভয়-ভীতি চরমে এবং যুদ্ধ-ও তুঙ্গে, আমরা হুযূর পাক (ﷺ)-এর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলাম। তাঁর মতো শত্রুর এতো কাছে আর কেউই ছিলেন না। আমি বদর (যুদ্ধের) দিবসে তাঁকে দেখেছিলাম, যখন আমরা তাঁর আশপাশে অবস্থান করছিলাম; আর তিনি ছিলেন শত্রুদের সবচেয়ে কাছাকাছি। ওই দিন তিনি-ই ছিলেন সবচেয়ে সাহসী।” [আহমদ ইবনে হাম্বল, নাসাঈ, আত্ তাবারানী ও আল-বায়হাক্বী। মুসলিম এর আংশিক বর্ণনা করেছেন]


কথিত আছে যে (সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের মধ্যে) সাহসী তিনি-ই ছিলেন, শত্রুরা খুব কাছে এসে পড়লে যিনি মহানবী (ﷺ)-এর পাশে অবস্থান করছিলেন। এটা কেবল এই বাস্তবতার সুবাদে যে তিনি হুযূর পাক (ﷺ)-এর পাশে ছিলেন [যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম (বাহিনীর) সর্বাগ্রে অবস্থান করছিলেন]।


 


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ) মানুষের মাঝে সবচেয়ে মহৎ, উদার ও সাহসী সত্তা ছিলেন। এক রাতে মক্কাবাসী সর্বসাধারণ একটি আওয়াজ শুনে চমকে ওঠেন এবং তাঁদের কেউ কেউ ওই আওয়াজের উৎসস্থলের দিকে ছুটেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইতোমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং তিনি সেখান থেকে আবূ তালহার একটি রেকাব-বিহীন ঘোড়ার পিঠে চড়ে ফেরার পথে তাঁদের সাক্ষাৎ পান। ওই সময় তাঁর হাতে তরবারি ছিল এবং তিনি তাঁদেরকে বলেন, ‘আপনারা ভয় পাবেন না।’ ” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


 


এমরান বিন হুসাইন (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন কোনো (শত্রু) বাহিনীর মোকাবেলা করেননি, যেখানে তিনি সর্বপ্রথম আঘাত হানেননি।”


 


উবাই ইবনে খালাফ উহুদের যুদ্ধে মহানবী (ﷺ)-কে দেখতে পায়। এর আগে সে চিৎকার করে বলেছিল, “কোথায় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)? তিনি যদি বাঁচেন, তবে আমি যেন না বাঁচি!” ইতিপূর্বে বদরের জ্বেহাদে উবাই উৎসর্গ দিয়ে বলেছিল, “আমার একটি ঘোড়া আছে যাকে আমি প্রতিদিন এক ‘ফারাক্ব’ (১৯ rotls) পরিমাণ যব/গম খাওয়াই। আমি তাতে চড়া অবস্থাতেই আপনাকে (হুযূর পাককে) হত্যা করবো।” এর পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও তাকে বলেন, “আল্লাহর ইচ্ছা হলে আমি-ই তোমাকে হত্যা করবো।” অতঃপর উহুদের ময়দানে সে যখন তাঁকে দেখে, তৎক্ষণাৎ সেদিকে ঘোড়া ছুটায়। মুসলমান বাহিনীর কেউ কেউ তার পথরোধ করে দাঁড়ালে মহানবী (ﷺ) বলেন, “তাকে ছেড়ে দাও (মানে আসতে দাও)।” তিনি হারিস্ ইবনে সাম্মা হতে একটি বর্শা নিয়ে তা এমনভাবে নাড়া দেন যে তাঁর সামনে আর কেউই দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। এরপর হুযূর পূর নূর (ﷺ) উবাইয়ের মুখোমুখি হয়ে তার গলায় বর্শা দিয়ে আঘাত করেন, যার দরুন সে ঘোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়। মানুষেরা বলাবলি করতে থাকে, “তার পাঁজরের একখানি হাড় ভেঙ্গেছে মাত্র।” সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বলে, “মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমাকে হত্যা করেছেন।” তারা তাকে বলে, “তোমার তো (শারীরিক) কোনো ক্ষতি-ই হয়নি।” সে জবাবে বলে, “আমার যে আঘাত লেগেছে, তা অন্যদের লাগলে সবাই নিহত হতো। তিনি কি বলেন নি, ‘আমি তোমায় হত্যা করবো।’ আল্লাহর কসম! তিনি যদি আমাকে থুতু-ও মারতেন, তা-ও আমার প্রাণ কেড়ে নিতো।” (উহুদ যুদ্ধশেষে) শত্রু বাহিনী মক্কায় ফেরার পথে ’সারিফ’ (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী) এলাকায় উবাই ইবনে খালাফ মারা যায়। [ইবনে সা’আদ, আল-বায়হাক্বী ও আবদুর রাযযাক্ব বর্ণিত; আল-ওয়াক্বিদীও এটা বর্ণনা করেছেন]    


পরিচ্ছেদ – ১৫/ তাঁর হায়া-শরম ও দৃষ্টি অবনতকরণ


 


হায়া-শরম ও দৃষ্টি অবনতকরণ হচ্ছে এমন এক মহৎ গুণ, যা কোনো ব্যক্তিকে তার অপছন্দনীয় কোনো কিছু ঘটলে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিতে বা (ওই বিষয়টিকে) সেই অবস্থায় ছেড়ে দিতে প্রবৃত্ত করে। মানুষ স্বভাবতঃ যাকে বেমানান মনে করে তা হতে দৃষ্টিকে সংযত রাখাই দৃষ্টি অবনতকরণ।


 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন সকল মানবের মাঝে সবচেয়ে হায়া-শরমসম্পন্ন এবং তাদের গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত না করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক তৎপর। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় তাতে নবী (ﷺ)-এর কষ্ট হতো; অতঃপর তিনি তোমাদেরকে উঠিয়ে দিতে সংকোচবোধ করতেন।” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৩]


 


হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ) ছিলেন কোনো নিঃসঙ্গ কুমারীর চেয়েও লাজুক। তিনি কখনো কোনো কিছু অপছন্দ করলে আমরা তা তাঁর চেহারা মোবারক দেখে বুঝতে পারতাম।” [আবূ দাউদ]


 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চারিত্রিকভাবে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন। তাঁর হায়া-শরম ও উদারতার কারণে তিনি কখনোই কারো কাছে তার অপছন্দনীয় কোনো কথা বলতেন না। হযরত মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “হুযূর পূর নূর (ﷺ) যখন কারো সম্পর্কে এমন কথা শুনতেন যা তিনি অপছন্দ করতেন, তৎক্ষণাৎ তিনি এ কথা বলতেন না ‘অমুক এরকম কাজ করার বা এমনটি বলার ব্যাপারে তোমার কী মত?’ বরঞ্চ তিনি বলতেন, ‘এরকম কাজ করে বা এমনটি বলে যেসব লোক, তাদের সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?’ এতে তিনি কারো নাম উল্লেখ না করেই নিষেধাজ্ঞা দিতে পারতেন।” [সর্ব-ইমাম মুসলিম, বুখারী, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ]


 


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে একবার এক ব্যক্তি মহানবী (ﷺ)-এর কাছে জাফরানের চিহ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়। কারো অপছন্দনীয় কোনো কিছু সম্পর্কে জানাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেহেতু লজ্জা পেতেন, সেহেতু তিনি তাকে কিছুই বল্লেন না। ওই ব্যক্তি প্রস্থান করলে তিনি বলেন, “তাকে এটা ধুয়ে ফেলতে বলতে পারবে কি?” এ-ও বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছিলেন, “তাকে এটা অপসারণ করতে বলো।” [আবূ দাউদ]


 


হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) ‘সহীহ’ রওয়ায়াতে বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইতর (অশ্লীল) প্রকৃতির ছিলেন না, তিনি গালিগালাজ-ও করতেন না। বাজারে তিনি উচ্চস্বরে চিৎকার করতেন না, আর মন্দকে মন্দ দ্বারা ফিরিয়েও দিতেন না। তিনি ক্ষমা করতেন এবং দেখেও না দেখার মতো ছেড়ে দিতেন।” আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (رضي الله عنه) ও আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস্ (رضي الله عنه) হতে একটি বর্ণনায় তৌরাতেও এরকম একটি ঘটনার কথা উল্লেখিত হয়েছে।

মহানবী (ﷺ) নিজ লজ্জার কারণে কারো মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। উপরন্তু, কোনো অপছন্দনীয় কিছুকে নিষেধ করতে তাঁকে বাধ্য করা হলে তিনি রূপকের ব্যবহার করতেন। হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি কখনোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গোপন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখিনি।” [তিরমিযী]


পরিচ্ছেদ – ১৬/ তাঁর সৎ সঙ্গ, শিষ্ট আচার-ব্যবহার ও সৎ স্বভাব


 


সব ধরনের মানুষের সাথে মহানবী (ﷺ)-এর সৎ সঙ্গ, উত্তম আচার-ব্যবহার ও হাসি-খুশি আচরণ অনেকগুলো সহীহ হাদীসে বিবৃত হয়েছে। হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ) তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “তিনি ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে উদার, সত্যবাদী, দয়ালু এবং তাঁর সঙ্গীদের প্রতি সহৃদয়।” [ইমাম তিরমিযী বর্ণিত সহীহ হাদীস]


 


হযরত কায়স ইবনে সা’আদ (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একবার আমাদের বাসায় আসেন। তিনি যখন বিদায় নিতে চান, তখন আমার বাবা হযরত সা’আদ (رضي الله عنه) একটি গাধা নিয়ে আসেন যার ওপর একখানা কাপড়ের জিন ছিল। নবী করীম (ﷺ) তাতে উঠে বসেন। এমতাবস্থায় হযরত সা’আদ (رضي الله عنه) আমাকে বলেন, ‘কায়স, তুমি হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর সাথে যাও।’ মহানবী (ﷺ) আমাকেও তাঁর সাথে (গাধার পিঠে) চড়ে বসতে বলেন। আমি অম্বীকৃতি জানাই। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হয় তুমি আমার সাথে বসো, না হয় চলে যাও (মানে সাথে এসো না)।’ তাই আমি প্রস্থান করি।” আরেকটি বর্ণনায় এসেছে এভাবে, “আমার সামনে বসো, (কেননা গাধার) মালিকেরই সামনে বসার অধিকার বেশি।” [আবূ দাউদ ও নাসাঈ। বঙ্গানুবাদকের নোট: হযরত কায়স (رضي الله عنه) এই ঘটনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান প্রদর্শন করেছেন। একই জিনের ওপর তিনি বসেননি। হুযূরের আদেশের প্রতি এটা কোনোক্রমেই বেয়াদবি নয়]     


 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকল মানুষকে কাছে টানতেন, দূর করে দিতেন না। যে কোনো গোত্রের মর্যাদাবান নেতৃস্থানীয়দের তিনি শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁদেরকে গোত্রপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করতেন। তিনি মানুষের প্রতি হাসি-খুশি ভাব ও উত্তম আচরণপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ না করেই তাদের ব্যাপারে সাবধান ও যত্নবান ছিলেন। তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দের প্রতি তিনি যথাযথ মনোযোগ দিতেন এবং তাঁর সোহবত তথা সাহচর্য যাঁর যতোটুকু প্রাপ্য, তা-ই তিনি তাঁদেরকে দিতেন। ফলে তাঁর সান্নিধ্যে ধন্য প্রত্যেকেই মনে করতেন তাঁর চেয়ে বেশি সম্মান আর কেউই পাননি।


 


হুযূর পাক (ﷺ) তাঁর সান্নিধ্যে উপবেশনকারী বা কোনো কিছুর প্রত্যাশায় সাহচর্য লাভকারী যে কারো প্রতি অত্যন্ত দৈর্যশীল ছিলেন, যার দরুন ওই ব্যক্তি-ই সর্বপ্রথম বিদায় নিতেন। কেউ মহানবী (ﷺ)-এর কাছে কিছু চাইলে তিনি হয় তা তাকে দিতেন, না হয় দয়াপূর্ণ কিছু একটা বলতেন। তাঁর উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সবাইকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলতো (মনে হতো) যেন তিনি তাঁদের বাবার মতোই কোনো সত্তা। তিনি তাঁদের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করতেন, তাঁরাও সমান পর্যায়ের শ্রদ্ধা তাঁকে প্রদর্শন করতেন।

ইবনে আবি হালা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “তিনি ছিলেন সহজ, সরল মন-মেজাজসম্পন্ন সর্বদা হাসি-খুশি এক মহাত্মা। তিনি নম্র স্বভাবের ছিলেন; বদমেজাজি বা রূঢ় অথবা শোরগোলকারী কিংবা অশ্লীল বা ছিদ্রান্বেষণকারী অথবা তোষামোদকারী ছিলেন না। তিনি যে খাবার খেতে চাইতেন না, তা কোনো অভিযোগ ছাড়াই পরিত্যাগ করতেন।”[শামায়েলে তিরমিযী]


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “অতঃপর কেমন-ই আল্লাহর কিছু দয়া রয়েছে যে, হে মাহবূব! আপনি তাদের জন্যে কোমল-হৃদয় হয়েছেন। আর যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা নিশ্চয় আপনার আশপাশ থেকে পেরেশান হয়ে যেতো।” [আল-কুরআন, ৩:১৫৯; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله)-এর কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]


 


আল্লাহ (আরো) এরশাদ ফরমান: “মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করো! তখনই ওই ব্যক্তি, তোমার সাথে যার পারস্পরিক শত্রুতাভাব ছিল, সে এমন হয়ে যাবে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।” [আল-কুরআন, ৪১:৩৪; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’]


 


কেউ মহানবী (ﷺ)-কে দাওয়াত করলে তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং উপহার-ও নিতেন, এমন কি তা যদি খাবার হিসেবে ভেড়ার পা-ও হতো; আর তিনি সেটার প্রতিদানস্বরূপ উপযুক্ত পুরস্কার-ও দিতেন।


 


হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমত করেছি, কিন্তু তিনি কখনো আমার প্রতি ‘উফ!’ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। আমার কৃত কোনো কর্ম সম্পর্কে তিনি এমন কথা বলেননি যে ‘কেন তুমি এটা করেছো?’ অথবা, আমার না করা কোনো কিছু সম্পর্কে বলেননি, ‘কেন তুমি এটা করোনি?’ “ [মুসলিম ও বুখারী]  


 


হযরত মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “চরিত্র বৈশিষ্ট্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে উত্তম আর কেউই ছিলেন না। তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-মণ্ডলীর কেউ কিংবা তাঁর পরিবার-সদস্যদের কেউ তাঁকে ডাকলে তিনি উত্তর দিতেন, ‘(আমি) আপনার সেবায় হাজির!’ “ [আবূ নুয়াইম]


 


হযরত জাবের ইবনে আবদিল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি মুসলমান হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই আমার কাছ থেকে নিজেকে পৃথক করে রাখেননি; আর যখন-ই তিনি আমাকে দেখতে পেতেন, তৎক্ষণাৎ স্মিত হাসতেন।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


 


মহানবী (ﷺ) তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর সাথে মজাক (কৌতুক) করতেন এবং তাঁদের সাথে মিশতেন ও আলাপ করতেন; আর তাঁদের বাচ্চাদের সাথেও খেলতেন। তিনি তাঁদের সবাইকে নিজ কক্ষে বসাতেন এবং মুক্ত, স্বাধীন ব্যক্তির পাশাপাশি গোলাম ও দাসী এবং গরিব মানুষেরও ফরিয়াদ শুনতেন (তথা প্রতিবিধান দিতেন)। শহরের দূরবর্তী অংশে অবস্থিত অসুস্থদেরও তিনি দেখতে যেতেন এবং কেউ কোনো ওজর পেশ করলে তিনি তা গ্রহণ করতেন।

হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “কেউ হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কানে কানে কিছু বল্লে তিনি প্রথম নিজ শির মোবারক সরাতেন না, যতোক্ষণ না ওই ব্যক্তি আপন শির সরাতেন। যখন কেউ তাঁর হাত মোবারক ধরতেন, তখন তিনি তা ছাড়াতেন না, যতোক্ষণ না ওই ব্যক্তি আপন হাত ছাড়াতেন। তাঁর পাশে বসে থাকা কারো সামনে হাঁটু ছড়িয়ে বসতে তাঁকে কখনোই দেখা যায়নি।” [আবূ দাউদ, তিরমিযী ও আল-বায়হাক্বী; ইবনে আল-বাযযার এটা বর্ণনা করেছেন সর্ব-হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) ও ইবনে উমর (رضي الله عنه)-এর সূত্রে]  


মহানবী (ﷺ)-এর কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি-ই সর্বপ্রথম সালাম দিতেন। সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর সাথে করমর্দন-ও তিনি-ই প্রথম করতেন। তাঁদের মাঝে অবস্থানকালে তাঁদেরকে সীমাবদ্ধ করে এমনভাবে পা মেলে রাখতেন না তিনি। যে কেউ তাঁর সামনে হাজির হলে তিনি তাকে সম্মান করতেন। কখনো কখনো তিনি অন্যদের জন্যে তাঁর বস্ত্র মেলে ধরতেন যাতে তিনি যেখানে বসেছিলেন সেখানে অন্যরা আরামে বসতে পারেন, আর এতে তিনি নিজের চেয়ে অন্যদেরকে বেশি মূল্যায়ন করতেন। তারা না বসতে চাইলেও তিনি তাদের বসতে দেয়ার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা হতেন। তিনি তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কে কুনিয়া প্রদান করেন এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁদেরকে সবচেয়ে  সেরা সেরা নামে ডাকতেন। কারো সাথে আলাপকালে তিনি তা চালিয়ে যেতেন যতোক্ষণ না তা নিঃশেষ হতো; এরপর তিনি তা শেষ করতেন, নতুবা উঠে যেতেন। বর্ণিত আছে যে তিনি প্রার্থনা করার সময় কেউই তাঁর সোহবত (সান্নিধ্য) পেতেন না, তবে তাঁদের কার কী প্রয়োজন তা জানতে তিনি তাঁর প্রার্থনা সংক্ষিপ্ত করতেন। তাঁদের আরযি পেশ শেষ হওয়ামাত্র তিনি আবার প্রার্থনায় ফিরে যেতেন।


 


তিনি সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্মিত হাসতেন এবং উৎফুল্ল চিত্তের ছিলেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রম ঘটতো যখন আল-কুরআন অবতীর্ণ হতো, অথবা তিনি কাউকে সদুপদেশ বা কোনো ভাষণ দিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আল-হারিস্ (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ)-এর চেয়ে বেশি স্মিত হাস্যকারী আর কাউকে আমি (জীবনে) দেখিনি।” [ইবনে হাম্বল (رضي الله عنه) ও আল-তিরমিযী (رحمة الله)] 

হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভোরে (ফজরের) নামায পড়ার সময় মদীনার সেবকবৃন্দ পাত্রভর্তি পানি নিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে আসতেন। তাঁর সামনে যখনই (এরকম) পাত্র আনা হতো, তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর হাত মোবারক তাতে চুবাতেন; আর কখনো কখনো (শীতের) সকালগুলো ঠাণ্ডা হতো। তাঁরা এভাবে (তাঁর কাছ থেকে) তাবাররুক (বরকত/আশীর্বাদ) অন্বেষণ করতেন।”[মুসলিম]


পরিচ্ছেদ – ১৭/ তাঁর দয়া ও করুণাশীলতা


সৃষ্টিকুলের প্রতি মহানবী (ﷺ)-এর দয়া-মায়া ও করুণাশীলতা সম্পর্কে আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:“নিশ্চয় তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যাঁর কাছে তোমাদের দুঃখকষ্টে পড়াটা কষ্টদায়ক, (যিনি) তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, (আর যিনি) মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু” [আল-কুরআন, ৯:১২৮; তাফসীরে নূরুল এরফান]। আল্লাহ আরো ফরমান: “এবং আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্যে রহমত (করুণা)-রূপেই প্রেরণ করেছি” [আল-কুরআন, ২১:১০৭]।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠত্বের অংশবিশেষ এই ছিল যে, আল্লাহতা’লা তাঁকে নিজের দুটি মোবারক নাম দান করেছিলেন এ কথা বলে, “ঈমানদারদের প্রতি তিনি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু।”


ইবনে শিহাব (رحمة الله) বলেন, “মহানবী (ﷺ) এক সামরিক অভিযানে বের হন [আর বর্ণনাকারী ‘হুনায়নের’ যুদ্ধের কথাই উল্লেখ করেন]। তিনি সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াকে একশটি উট দান করেন, এরপর আরো একশটি, অতঃপর আরো একশটি উট দান করেন।” ইবনে শিহাব বলেন, “সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه) সাফওয়ান (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন, “আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে দান করেছিলেন যা তিনি দান করেছিলেন, যখন তিনি ছিলেন আমার কাছে সবার চেয়ে ঘৃণিত; আর তিনি দান করতে থাকেন যতোক্ষণ না তিনি আমার কাছে সবার চেয়ে পছন্দনীয় হন।”


বর্ণিত আছে যে এক বেদুঈন আরবীয় লোক হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কাছে এসে কিছু একটা চেয়েছিলেন। তিনি তাকে কিছু একটা দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আমি কি তোমার প্রতি এহসান (মানে অনুগ্রহ) করিনি?” ওই বেদুঈন বলেন, “না, অনুগ্রহ করেননি, আর আপনি ভালাই-ও করেননি।” সেখানে উপস্থিত সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) এতে রাগান্বিত হন এবং তার দিকে ছুটে যান। মহানবী (ﷺ) তাঁদের থামতে ইশারা করেন এবং উঠে গিয়ে নিজ গৃহে প্রবেশ করেন। অতঃপর তিনি ওই বেদুঈনকে তলব করেন এবং তাকে প্রদত্ত উপহারের সাথে আরো কিছু একটা (উপহার) যোগ করেন, আর তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “আমি কি তোমার ভালাই করিনি?” বেদুঈন আরব লোকটি এবার বলেন, “হ্যাঁ, আল্লাহতা’লা যেন আপনাকে সেরা পরিবার ও গোত্র দ্বারা পুরস্কৃত করেন।” এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “তুমি বলেছিলে যা তুমি বলেছিলে এবং তাতে আমার সাথীবৃন্দ অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তুমি যদি চাও, তবে আমার উপস্থিতিতে যা তুমি বল্লে তা ওদের সামনে গিয়েও বলতে পারো, যাতে ওদের অন্তরে তোমার প্রতি যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছে তা অপসারিত হয়।” লোকটি বলেন, “হ্যাঁ (অর্থাৎ, ঠিক আছে, তা-ই করবো)।” তিনি পরের দিন ফিরে এলে মহানবী (ﷺ) বলেন, “এই বেদুঈন আরব বলেছিল যা সে বলেছিল, অতঃপর আমরা তাকে আরো বেশি দিয়েছিলাম। সে দাবি করছে এখন সে পরিতৃপ্ত। তাই নয় কি?” বেদুঈন উত্তরে বলেন, “হ্যাঁ, আল্লাহ পাক যেন আপনাকে সেরা পরিবার ও গোত্র দ্বারা পুরস্কৃত করেন।” হুযূর পাক (ﷺ) বলেন, “আমার এবং এই লোকের উদাহরণ হলো সেই ব্যক্তির মতো, যাঁর মালিকানাধীন উটনী তাঁর কাছ থেকে পিছু সরে থাকে। মানুষজন সেটাকে তাড়া করে, আর তাতে ওই মাদী উট আরো দূরে সরে থাকে। মালিক তখন মানুষদের বলেন তারা যেন তাঁর এবং তাঁর উটনী হতে দূরত্ব রাখে; তিনি তাদের বলেন, ‘আমি এই প্রাণিটির প্রতি তোমাদের চেয়েও বেশি দয়ালু ও কল্যাণকামী।’ তিনি উটনীর সামনে যান এবং কিছু মাটির ঢেলা নিয়ে সেটাকে ফিরে আসতে বাধ্য করেন, যতোক্ষণ না সেটা হাঁটু ভেঙ্গে বসে আর তিনি তাতে জিন বসিয়ে চড়ে বসেন। এই ব্যক্তি যখন ওই কথা বলেছিল যা সে বলেছিল, তখন আমি যদি তোমাদেরকে ছেড়ে দিতাম তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করতে, আর সে জাহান্নামে প্রবেশ করতো।” [হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে আল-বাযযার]


বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “আমার সাহাবাদের মধ্যে কারো বিরুদ্ধে কোনো মন্দ কথা নিয়ে তোমরা আমার কাছে আসবে না, কেননা আমি তোমাদের কাছে প্রশান্ত অন্তর ছাড়া যেতে চাই না।” [হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে আবূ দাউদ ও আত্ তিরমিযী]


   


 


 


 


 


[অসম্পূর্ণ]

 
Top