সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গের ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম(রহ) এক চির উজ্জ্বল নক্ষত্র। যখন দক্ষিণ বঙ্গের অলিতে গলিতে চলছিলো হিন্দু ও খৃস্টান মিশনারীদের অপদৌরাত্ম, যখন ইসলামের বিরুদ্ধে তারা অপপ্রচারের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছিলো তখনই এই মহান সূফী ইসলামের বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেন।

মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীমের(রহ.) পূর্বপুরুষ ছিলেন-হযরত শাহসূফী সুলতান আহমদ। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সময় যশোর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। জানা যায়, সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহের পদাতিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি যশোর আগমন করেন এবং যশোর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে যশোর থেকে যান। সে সময়ে যশোরের চাঁচড়ার রাজা ছিলেন শূকদেব সিংহ রায়।

রাজা শূক দেব সিংহ রায় রাজা মানসিংহকে এবং সম্রাট আকবরকে খুশী করার উদ্দেশ্যে শাহ সূফী সুলতান আহমদকে বসবাসের জন্য রাজবাড়ীর খিড়কীর দিকে বেশ কিছু লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করেন। খিড়কী এলাকা পরে খড়কী এলাকায় পরিণত হয়। বর্তমানে খড়কী যশোর এলাকার একটি অংশ। যশোর সরকারী এম.এম. কলেজ এই খড়কীতে অবস্থিত।

মুগল আমল থেকে বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত মওলানা শাহ আবদুল করীম সাহেবের বংশের লোকেরা যশোর অঞ্চলে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে আসছেন।

যশোর শহরতলীস্থ খড়কী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে হযরত মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম ১৮৫২ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ মুহাম্মদ সালীম উদ্দীন চিশতী একজন কামিল পীর ছিলেন।

শাহ আবদুল করীম বাল্যকালেই পিতৃহারা হন এবং দাদা শাহ কালিম উদ্দীন চিশতী(রহ)এর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন।

দাদা শাহ কালিম উদ্দীন চিশতী দীনি ইলমের প্রাথমিক সবক দিয়ে তাঁর হাতেখড়ি দেন। পরে স্থানীয় বিদ্যালয় হতে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এই সময়ে তিনি দাদাকে হারান। দাদাকে হারিয়েও শাহ আবদুল করীম তাঁর শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন নি। তিনি পরবর্তীতে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে জামা’আতে উলা পাস করেন।

শিক্ষা জীবন শেষে এই মহান মণীষী যশোর জেলা স্কুলে হেড মৌলবী হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন।

শিক্ষকতা করা অবস্থায় তাঁর ভেতর ‘ইলমে তাসাওউফ’ সম্বন্ধে জানার কৌতুহল জাগে এবং সে সম্বন্ধে জানার জন্য তিনি বেরিয়ে পড়েন। তিনি ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের হুসিয়ারপুর জেলার  খালিক(রহ.) এর নিকট মুরীদ হন। এখানে দীর্ঘ বার বছর তিনি তাসাওউফ চর্চায় নিজেকে নিমগ্ন রাখেন এবং ইলমে তাসাওউফের উচ্চ স্তরে উত্তীর্ণ হন। তাঁর পীর তাঁকে নকশ বন্দীয়া মুজাদ্দীদিয়া, কাদিরিয়া, চিশতিয়া এবং সুহরাওয়ার্দিয়া তরিকার খিলাফত প্রদান করে স্বদেশ ইসলাম প্রচারের নির্দেশ হন।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর তিনি ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং সমাজে কুসংস্কার দূর করার প্রচেষ্টা চালান। এ সময় অনেক বিধর্মীই তাঁর সংস্পর্শে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে শাহ আবদুল করীম অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে চলাফেরা করতেন। পিতার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েও তিনি আড়ম্বরহীন, বিনয়ী ও নম্র জীবন যাপন করেছিলেন।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক সময় যশোর জেলা স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তিনি এই সময় শাহ আবদুল করীমের একান্ত সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর লেখা আধ্যত্ম পুণ্যময় লকখী ছাড়া গল্পটি পীর আবদুল করীম সাহেবকে লক্ষ্য করে (রমনার পীর সাহেব) লেখা। গল্পের নায়ক রমজানকে ডক্টর শহীদুল্লাহ সাহেবের সমকালীন প্রতিনিধি বলা যেতে পারে।

শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম একজন উচ্চস্তরের সাহিত্যিকও ছিলেন। ইলমে তাসাওউফের ওপর তিনি এরশাদে খালেকিয়া বা খোদা প্রাপ্তিতত্ত্ব নামক প্রায় তিন’শ পৃষ্ঠা একখানি পান্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ও সাহিত্যিক জনাব মুহম্মদ আবূ তালিব লিখেছেন, “বইখানি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায়, এ যাবত বাংলা ভাষায় সূফী বা তাসাউফ তত্ত্বমূলক যত বই লেখা হয়েছে, তন্মধ্যে এ খানি শ্রেষ্ঠ। আবদুল করীম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে একজন নিষ্ঠাবান সূফী, তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জ্ঞানে এই রঙিন বইখানি সাধারণ পাঠকের জন্য এক অনাস্বাদিত জগতের সন্ধান এনে দিয়েছে।

সুবিস্তৃত দশটি অধ্যায়ে তিনি তাসাওউফের দার্শনিক তত্ত্ব, বিবিধ সূফী-খান্দানের ইতিকথা, শাজরানামা(পীর-পরম্পরা) ইত্যাদির সুন্দর পরিচয় দিয়েছেন। শেষ বা দশম অধ্যায়ে তিনি তাসাউফ তত্ত্বের মর্মকথা, অমুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি, যথা-বেদ উপনিষদ পুরানাদির সঙ্গে ইসলামী সূফীতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা করে বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন।”

শাহ আবদুল করীম সাহেব গ্রন্থটি রচনা করেছেন তাঁর পীর হযরত খাজা আবু সা‘আদ মোহাম্মদ আবুদল খালেক সাহেব এর অনুপ্রেরণায়।

এ সম্বন্ধে শাহ আবদুল করীম সাহেব উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “পীর সাহেব বলেছেন, তুমি নিজ ভাষায় স্পষ্টভাবে যেমত আমার শিক্ষা পাইয়াছ সেইরূপ একখন্ড কিতাব লিখ। যাহা বুঝিতে লোকের কষ্ট না হয় এবং সন্দেহ ভঞ্জন হয়। কারণ তাসাউফের বিদ্যা ক্রমশ লোপ পাইয়া যাইতেছে; কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞেস করিলে স্পষ্টভাবে তাহার উত্তর পাওয়া সুকঠিন হইয়াছে; সুতরাং লোকের মূল উদ্দেশ্য পরম সৃষ্টিকর্তা খোদাতালাকে চেনার পথ একেবারে সংকীর্ণ হইয়া যাইতেছে। অতএব তুমি সত্ত্বর কিতাব লিখিতে প্রবৃত্ত হও।”

পীরের নির্দেশ মোতাবিক লেখক তাঁর কিতাবখানি সর্বসাধারণ বোধ্য ভাষায় লিখেছেন। বলাবাহুল্য, ইসলামী চিন্তাধারার এক মৌলিক উৎসের সন্ধান দিয়েছে কিতাবখানি।

গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক জনাব শাহাদাত আলী আনসারী বলেন, ‘মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম সাহেব নকশবন্দীয়া তরীকার একজন কামেল সূফী ছিলেন। সূফী তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তাঁর গ্রন্থখানিতে প্রথম হতে চতূর্থ অধ্যায় পর্যন্ত তিনি তাসাওফের দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন; পঞ্চম হতে নবম অধ্যায়ে সূফী সাধনায় কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া এবং চিশতীয়া তরিকার বিশ্লেষণ করেছেন এবং দশম হতে শেষ অধ্যায়ে বেদ, পুরান প্রভৃতিতে প্রচলিত বিষয়বস্তুর তত্ত্ব তিনি উদঘাটন করেছেন এবং সূফী মতবাদের সাথে তার তুলনামূলক সমালোচনা করেছেন। তাসাওফ সম্পর্কে বাংলাভাষায় লিখিত এইরূপ দ্বিতীয় কোন বই পাওয়া যায় না।”

শাহ আবদুল করীম(রহ.) এর জীবদ্দশায় গ্রন্থটির দু’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় শাহ সাহেবের মৃত্যুর পর। প্রকাশক ছিলেন মুনশী শেখ জমির উদ্দীন। গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে শাহ সাহেবের পুত্রদ্বয়(শাহ মুহাম্মদ আবু নাঈম এবং শাহ মুহাম্মদ আবুল খায়ের) লিখেছেন, “পিতৃবন্ধু প্রসিদ্ধ ইসলাম প্রচারক রেভারেন্ড মওলানা শাহ সূফী মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ সাহেবকে অত্র সংস্করণ দান করিলাম। টাইটেল পেজে কেবলমাত্র প্রকাশকের স্থানে তাঁহার নাম থাকিবে।”

গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ ৪০ বছর পর প্রখ্যাত সমাজসেবক ও সাহিত্যিক মরহুম মৌলভী ওয়াহেদ আলী আনসারী ১৩৫৬ সালে এর চতূর্থ সংস্করণ প্রকাশ করেন। এতে ভূমিকা লেখেন শাহ সাহেবের পুত্র জনাব শাহ মুহাম্মদ আবুল খায়ের। পরবর্তীতে ১৩৮১ সালে তাঁর পৌত্র শাহ মোহাম্মদ আবদুল মতিন বইটির পঞ্চম সংস্করণ বের করেন। এর ৬ষ্ঠ সংস্করণ বের হয়েছে ৩০ শে মার্চ ১৯৮৬। এ সংস্করণের প্রকাশক শাহ মোহাম্মদ আবুদল মতিন। তিনি বর্তমানে খড়কীর গদ্দীনশীন পীর।

এরশাদে খালেকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব নামক তাসাওউফের উপর এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত বিস্তারিত ও তত্ত্ব এবং তথ্যবহুল গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত নামক গ্রন্থে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান এই গ্রন্থখানি সম্পর্কে বলেছেন “মোহাম্মদ আবুদল করীরেম খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব সম্পর্কে বাংলায় তাসাওউফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয় দেখা যায় না।” বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, “প্রকৃতপক্ষে এ পুস্তকখানা সাধনার পথিকদের জন্য একখানি মূল্যবান গ্রন্থ। শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম(রহ.) আমাদের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি এদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয়।”

শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম (রহ.) ১৩২২ বাংলা সনের ৩০ অগ্রহায়ণ খড়কীস্থ নিজ খানকা শরীফে ইন্তিকাল করেন। এখানেই তাঁর মাযার রয়েছে। প্রতিদিন বহু যিয়ারতকারী আসেন। তাঁর নামে যশোর শহরে ‘শাহ আবদুল করীম সড়ক’ রয়েছে। তাঁর বংশধররা আজও ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। খড়কীর বর্তমান পীর হযরত মাওলানা শাহ আবদুল মতিন শাহ আবদুল করীমের পৌত্র।

 
Top