সাহাবায়ে কেরামের স্বপ্নঃ রসুলেপাক (ﷺ) যার তাবীর করেছেন


সাহাবা  কেরামের বহু  স্বপ্নের তাবীর  করেছেন রসুলেপাক (ﷺ)  স্বয়ং। এমনি একটি স্বপ্ন দেখেছেন হজরত যারারাহ ইবনে ওমর নাখয়ী (رضي الله عنه)। তিনি নাখা গোত্রের প্রতিনিধি  হয়ে নবী করীম (ﷺ) এর নিকট এসেছিলেন। তিনি বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনার দরবারে আসার সময় পথিমধ্যে  একটি স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, বাড়ীতে যে গাধাটিকে রেখে এসেছিলাম, সে একটি বকরীর বাচ্চা প্রসব করেছে, যার গায়ের রঙ শাদা এবং কালো।


রসুলেপাক (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঘরে কি কোনো বাঁদী আছে? সে কি গর্ভবতী? তিনি বললেন, হাঁ ইয়া রসুলালা­ হ। মনে হয় সে গর্ভবতী। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, নিশ্চয়ই সে ওই বাচ্চাটি প্রসব করবে, যে হবে তোমার সন্তান। হজরত যাররাহ (رضي الله عنه) বললেন, শাদা কালো রঙ দেখার তাৎপর্য কী? রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, কাছে এসো। হজরত যাররাহ বলেন, অতঃপর আমি রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকটবর্তী হলাম। তিনি  বললেন, তোমার শরীরের এক স্থানে শ্বেতী দাগ আছে, যা তুমি মানুষের কাছে কখনও প্রকাশ করোনি। তিনি বললেন, হাঁ, কসম ওই সত্তার, যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমার শ্বেতী দাগ সম্পর্কে আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।


রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তোমার শ্বেতী রোগের চিহ্নটি তোমার বাচ্চার দেহেও রয়েছে।  তারপর হজরত যাররাহ (رضي الله عنه) বললেন, আমি স্বপ্নে নোমান ইবনে মুনযিরকে দেখেছি। নোমান ইবনে মুনযির কেসরার শাসনামলে আরবের একজন বাদশাহ্ ছিলেন। যারারাহ (رضي الله عنه) বললেন, আমি নোমান ইবনে মুনযিরকে দেখলাম, তার কানে দুটি বালি ঝুলছে, আর হাতে রয়েছে বাজুবন্দ এবং চুড়ি, অথচ এগুলো মেয়েদের অলংকার।


রসুলেপাক  (ﷺ) বললেন,  এই আরবদেশে পূর্বের  মতো আবার সাজসজ্জার বাহার ফিরে আসবে। হজরত যারারাহ (رضي الله عنه) বললেন, আমি আরেকটি স্বপ্ন দেখেছি। একটি বৃদ্ধলোককে দেখলাম, তার মাথার চুল শাদা-কালো মিশ্রিত, সে যমীনের ভিতর  থেকে বের হয়ে আসছে। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, এটি হচ্ছে দুনিয়ার অবস্থা। এরপর তিনি আরেকটি স্বপ্ন পেশ করলেন। বললেন, আমি যমীন থেকে একটি অগ্নি নির্গত হতে দেখেছি। অগ্নিটি আমার এবং আমার পুত্র ওমরের মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে গেলো। আমি দেখলাম, আগুন বলছে, লাজা লাজা। আরও বলছে, আমি   অন্ধ ও চক্ষুস্মান সকলকেই খেয়ে ফেলি। আমি তোমাকে, তোমার সাথে সম্পর্ক রাখে এমন সকলকে এবং তোমার মালকেও খেয়ে ফেলবো।


রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, ওই আগুন হচ্ছে ফেতনা, যা আখেরী জামানায় প্রকাশ পাবে। হজরত যাররাহ (رضي الله عنه) বললেন, ফেতনাটি কী? আর সে ফেতনাকারীরাই বা কারা?  রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, ফেতনাটি হচ্ছে, মুসলমানেরা আপন ইমামকে অকস্মাৎ ধ্বংস করে দিবে। তার পর নানা রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের মধ্যে নিপতিত হবে। মাথার হাড়সমূহ যেরকম পরস্পরে সম্মিলিত থাকে, তেমনি তখন একটার  পর একটা ফেতনা আসতে থাকবে। রসুলেপাক (ﷺ) আপন হাতের আঙুলসমূহ একত্রিত করে দেখালেন, ফেতনা এভাবে, সম্মিলিতভাবে আসতে

থাকবে।  আর ফেতনাবাজরা  মনে করবে, তারা  নেক কাজ করছে। তখন  এক মুসলমানের রক্ত অপর মুসলমানের নিকট মিষ্টি পানীয়ের চেয়েও সুস্বাদু মনে হবে।

বোখারী ও মুসলিম শরীফে হজরত কায়েস ইবনে উব্বাদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি একদা মদীনা শরীফে মসজিদে নববীতে এক বৈঠকে উপবিষ্ট  ছিলাম, যে বৈঠকে হজরত সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه)ও উপস্থিত ছিলেন। তখন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (رضي الله عنه) ওই স্থান দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।

 

অন্য এক বর্ণনায় আছে, বৈঠকে একজন উপস্থিত হলেন, যার চেহারার মধ্যে বিনয়ের নমুনা পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। বৈঠকের লোকেরা বললো, লোকটি জান্নাতী লোকদের অন্যতম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম দু’ রাকাত নামাজ আদায় করে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি তাঁর পিছনে পিছনে গিয়ে বললাম,  আপনি যখন মসজিদে প্রবেশ করেছিলেন, তখন সেখানকার লোকেরা বলছিলো, লোকটি বেহেশতী। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (رضي الله عنه) বললেন, যে ব্যাপারে জানা নেই, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলা কারও জন্য উচিত নয়। তিনি একথা বলেছিলেন বিনয়ের কারণে অথবা কোনোরূপ অহংকার তাকে যেনো স্পর্শ করতে না পারে সেজন্যই।


একথা  বুঝতে আমার  অসুবিধা হচ্ছিলো  না। সেখানকার উপবিষ্ট  লোকজন কেমন করে বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি  জান্নাতী - তা আমার জানা নেই। তবে যে জিনিসটির  ব্যাপারে আমার ধারণা জন্মালো তা হলো এই - আমি  রসুলে মকবুল (ﷺ) এর জীবদ্দশায় একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম।


একটি প্রকাণ্ড ময়দানে একটি লোহার খুঁটি, যার নীচের অংশ যমীনের সঙ্গে সংযুক্ত। আর   উপরের দিক আকাশে গিয়ে মিশেছে। আর সেই খুঁটিটির উপরে একটি মজবুত রশি রয়েছে। আমাকে  বলা হলো, উপরে উঠে এসো। আমি বললাম, উপরে ওঠার মতো শক্তি আমার নেই। তারপর একজন খেদমতগার এসে আমাকে উপরে উঠতে সাহায্য করলো। সে আমার কাপড় ধরে টেনে টেনে খুঁটির উপরের অংশে তুলে নিলো, আর আমি সেই রশিটি ধরে ফেললাম। আমাকে বলা হলো যেনো রশিটি আমি খুব ভালোভাবে ধরে রাখি। এতটুকু দেখার পর আমার ঘুম ভেঙে গেলো। চেয়ে দেখি, বাস্তবেই আমার হাতে একটি রশি রয়েছে। এরপর আমি আমার স্বপ্নটি রসুলে করীম (ﷺ) এর নিকট পেশ করলাম।


তিনি (ﷺ) তাবীর করে বললেন, প্রকাণ্ড ময়দানটি হচ্ছে ইসলাম। খুঁটিটি হচ্ছে ইসলামের রুকনসমূহ। আর সেই রশিটি হচ্ছে উরওয়ায়ে উছকা অর্থাৎ ইসলামের উপর সুদৃঢ়ভাবে টিকে থাকা। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তুমি উরওয়ায়ে উছকাকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করা অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে।


রসুলেপাক (ﷺ) এর বাণী আল্লাহ্তায়ালার এই আয়াতের মর্মার্থই যেনো প্রকাশ করেছে ‘যে তাগুতকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহর উপর ইমান এনেছে, সে যেনো উরওয়ায়ে  উছকা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে, হজরত কায়েস ইবনে উব্বাদ (رضي الله عنه) বলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম একজন লোক আমার নিকট এসে বললো, ওঠো আমার হাত ধরো। আমি তার সঙ্গে চললাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি বাম দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে। আমি ওই রাস্তার দিকে যেতে চাইলাম। লোকটি বললো, ওপথে যেয়ো না। ওই পথ আসহাবে শেমালদের। তুমি তো সে দলের  লোক নও। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকটি রাস্তা দেখলাম, ডান দিকে চলে গিয়েছে। লোকটি বললো, এই রাস্তাটি ধরো।


এরপর আমার সামনে পড়লো এক পাহাড়। লোকটি বললো, এই পাহাড়ের উপর  ওঠে যাও। আমি উঠতে চাইলাম। কিন্তু অবস্থা হলো এই, আমি যখনই উঠতে চাই, তখনই পড়ে যাই। ফলে উপরে ওঠা হচ্ছিলো না। এ স্বপ্ন রসুলেপাক

(ﷺ) এর কাছে পেশ করলে তিনি বললেন, সেটা হচ্ছে হাশরের ময়দানের অবস্থা। আর ওই পাহাড়টি শাহাদতের মাকাম। তুমি সে মাকাম লাভ করতে পারবে না। উলামা কেরাম বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) উক্ত সাহাবীকে যে সুসংবাদ দিলেন তা তাঁর নবুওয়াত এবং গায়েবী সংবাদ প্রদানের আলামত।


মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক স্বপ্নের তাবীর সংক্রান্ত যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে, এসমস্ত তার একটি নমুনা মাত্র। অন্যথায় তিনি যে সকল সূক্ষ্ম তাবীর করেছেন, তার সবগুলো একত্রিত করলে কয়েক খণ্ড পুস্তক রচিত হবে। বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, তাঁর উম্মতের মধ্যে  এ ধরনের বহুলোক রয়েছেন, যারা ওই ধরনের কারামত পেয়ে ধন্য হয়েছেন। সবই রসুলেপাক (ﷺ) এর মোজেজার প্রতিবিম্ব, তাঁর প্রতি মান্যতার বরকত, হেদায়েত প্রাপ্তির ফল।


মোহাম্মদ ইবনে শিরীনের স্বপ্নের তাবীর সংক্রান্ত যে সূক্ষ্মদর্শিতা এবং দক্ষতা ছিলো,  কেবল তাঁর কথা চিন্তা করলেও ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাঁর সূক্ষ্ম তাবীরগুলোকে একত্রিত করলে সহজেই অনুমান করা যাবে, তিনি যাঁর অনুসরণের ফলে এরূপ জ্ঞানী হতে পেরেছিলেন, তাঁর স্থান কোথায়। অনুসরণীয় ব্যক্তি অর্থাৎ মহান রসুল (ﷺ) কে প্রদত্ত এলেম ও মারেফতের বর্ণনা ভাষার গণ্ডিতে আসে না। ইবনে শিরীন নবী করীম (ﷺ) এর একজন উম্মত মাত্র। স্বপ্নের তাবীর বিষয়ে তাঁর সূক্ষ্মজ্ঞান যদি এরকম বিস্ময়কর হয়, তবে রসুলেপাক (ﷺ) এর মাকাম কতো উচ্চ ছিলো তা অনুমান করাও কঠিন।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 





© | সেনানী এপ্স |

 
Top