নবী (نبى) শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে নাবাউন (نباء)। নবী (نبى) শব্দটি আরবী ব্যাকরণ মতে সিফাতে মুশাববাহ। নবী শব্দের অর্থ হলো গায়েবের সংবাদদাতা। কারীমুন, রাহীমুন- শব্দগুলোও সিফাতে মুশাববাহ। নবী, কারীম, রাহীম- এগুলো সিফাতে মুশাববাহ হয়ে ইছমে ফায়েল (اسم  فاعل)    এর    অর্থ  বহনকারী।  অর্থাৎ  নবী   অর্থ-  গায়েবের সংবাদদাতা।

দুনিয়ার           সংবাদদাতা           বা            হালাল            হারামের   সংবাদদাতাকে     নবী    বলা   হয়   না।   কেননা,   এগুলো জাগতিক    বিষয়।   জাগতিক   বিষয়ের     সংবাদদাতাকে আলেম,   পন্ডিত, মুজাদ্দিদ  ও মুজতাহিদ ইত্যাদি  বলা হয়-   কিন্তু    নবী     বলা   হয়   না।   নবী   বলা      হয়   এমন সংবাদদাতা          ও           সংবাদ           বহনকারীকে-          যিনি দুনিয়াবাসীকে   আরশের   সংবাদ  ও   গায়েবের   সংবাদ শুনান।  যেখানে খবরাখবর  আদান প্রদানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি     ও      বিজ্ঞানীদের     চিন্তা     চেতনা     অকেজো-  সেখানকার  সংবাদদাতাকেই  নবী বলা   হয়। আমাদের প্রিয়   রাসূল   সাল্লাল্লাহু   আলাইহি   ওয়া   সাল্লাম   হচ্ছেন  সেই  অদৃশ্যজগতের  বড়  সংবাদদাতা নবী। যারা তাঁর ইলমে  গায়েবকে  (আতায়ীকে)  অস্বীকার  করে  মূলতঃ  তারা   নবুয়্যতকেই  অস্বীকার   করে। নবী  শব্দের অর্থই গায়েবী সংবাদ পরিবেশন করা। কেননা, ইলমে গায়েব নবুয়তের     অবিচ্ছেদ্য   অংশ    (সীরাতুন্নবী,     ৩য়   খন্ড, ১৬-১৭ পৃষ্ঠা)। তারা নবী শব্দ ব্যবহার করে সত্য কিন্তু তার অর্থ কোন সময়েই বলে না।

আমাদের    প্রিয়   নবী  সাল্লাল্লাহু  আলাইহি  ওয়া   সাল্লাম কোথাকার  সংবাদদাতা-  নিম্নে তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলোঃ

(১)   নবী   করিম      সাল্লাল্লাহু   আলাইহি   ওয়া   সাল্লামের দরবারে  হযরত   জাবির  ইবনে  আবদুল্লাহ  রাদিয়াল্লাহু   আনহু   বিষন্ন মনে বসা  ছিলেন। নবী  করিম   সাল্লাল্লাহু  আলাইহি   ওয়া  সাল্লাম  জিজ্ঞেস  করলেন-  হে   জাবির। কেন      এত     বিষন্নমনঃ    হযরত    জাবির     (রাঃ)    আরয করলেন-  আমার পিতা। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)  উহুদ যুদ্ধে  শহীদ  হয়েছেন। তিনি আমার   ছয়  বোন   ও  কিছু ঋণ   রেখে   গেছেন।   এসব   চিন্তাই     আমার    বিষন্নতার কারণ। হুয়ুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কথা শুনে বললেন- আমি কি তোমাকে এমন কিছু জানাবো- যদ্বারা তোমার বিষন্নতা দূর হয়ে যাবে?  হযরত জাবির (রাঃ) আরয   করলেন- অবশ্যই।  নবী করিম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি  ওয়া   সাল্লাম  বললেন,  অদ্যাবদি   কোন  মৃত  ব্যক্তির    সাথে   আল্লাহ্   পাক   কথা   বলেননি।    তোমার শহীদ পিতাই প্রথম ব্যক্তি- যার সাথে  আল্লাহ  সরাসরি কথা    বলেছেন।    আল্লাহ     তোমার    পিতাকে     জিজ্ঞেস করলেন-   ”হে  আবদুল্লাহ!  তুমি   শাহাদতের     বিনিময়ে আমার  কাছে    কী   চাও?  তোমার  পিতা    বললেন-   হে পরওয়ারদিগার!     আমি     শাহাদতের    মধ্যে     যে     স্বাদ পেয়েছি- দুনিয়াতে  গিয়ে  পূনঃ  সেই  স্বাদ  পেতে  চাই। আমাকে     পূনঃ     দুনিয়ায়      পাঠাও।      এই     শাহাদতের নেয়ামত  ও  স্বাদ   পুনঃ  পেতে  চাই।    আল্লাহ    তোমার  পিতাকে    বললেন-     “একবার    পরীক্ষায়   পাশ   করিয়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নেওয়া- নিয়ম বিরুদ্ধ”। (বুখারী)।

(২) এক    মহিলা সাহাবী  প্রিয়   নবীর  দরবারে উপস্থিত হয়ে    আরয   করলেন,   ইয়া    রাসুলাল্লাহ!   আমার   এক  যুবক   পুত্র   আপনার   সাথে    বদর   যুদ্ধে   জেহাদ   করে   শাহাদাত   বরণ   করেছে।  তার নাম হাবেজ। সে এখন   কী অবস্থায়  আছে- আমি  তা  দেখতে  চাই।  যদি তাকে জান্নাতবাসী দেখি- তাহলে সবর করবো। আর যদি সে দোযখবাসী হয়ে থাকে- তাহলে এমন কান্না  করবো যা পৃথিবীতে     স্মরণীয়      হয়ে     থাকবে।     হুযুর      সাল্লাল্লাহু আলাইহি   ওয়া   সাল্লাম   তাঁকে    শান্তনা   দিয়ে  বললেন, ”আমি দেখছি-  তোমার   শহীদ ছেলে সর্বোচ্চ  জান্নাত-   জান্নাতুল ফিরদাউসে রয়েছে”। সোবহানাল্লাহ!

(৩) জনৈক  সাহাবীকে (মায়েয    আসলামী)  প্রিয় নবীর জীবদ্দশায় শান্তিমূলক অপরাধের কারণে পাথর নিক্ষেপ করে  ছংগেছার  করা  হয়েছিল।  অন্য    একজন   সাহাবী উক্ত সাহাবীর অপরাধকে মন্দ হিসাবে উল্লেখ করলেন। প্রিয়নবী    সাল্লাল্লাহু  আলাইহি   ওয়া   সাল্লাম  তার   উক্তি শুনে বললেন- ”ওকে তুমি মন্দ বলছে- অথচ সে এখন বেহেস্তের ঝর্ণাধারার তৃপ্তিতে অবগাহন করছে”।

প্রিয়  পাঠক!  উপরের তিনটি  ঘটনাই  গায়েবী   জগতের বিষয়।   আমাদের    প্রিয়নবী   সাল্লাল্লাহু   আলাইহি   ওয়া  সাল্লাম মদিনায় অবস্থান করে  গায়েবী জগতের সংবাদ দিচ্ছেন। এটাকেই ইসলামী  পরিভাষায় ”ইলমে গায়েব আতায়ী” বলা হয়। এটা অস্বীকার করার  উপায়   নেই।  অস্বীকার করলে ঈমানই থাকবে না।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়- হযরত জাবিরের পিতার অবস্থা,  মহিলার   যুবক  পুত্রের   জান্নাতে  অবস্থান  এবং   সাজাপ্রাপ্ত      সাহাবীর     জান্নাতে     বিচরণ    -এই    তিনটি  গায়েবী   সংবাদ  নবীজী   সাথে  সাথে    দিলেন-  কিসের  ভিত্তিতে?   জিব্রাঈলের   অহীর    মাধ্যমে?   তাহলে    তো অবশ্যই  তার     উল্লেখ  থাকতো।   প্রশ্ন  করা   মাত্র   চিন্তা ভাবনা  ছাড়া    এবং   জিব্রাঈলের  আগমন   ব্যতিরেকেই  তিনি   ঐ   গাযেৰী   সংবাদ    দিয়েছিলেন।   এই    গায়েবী সংবাদ  প্রদান  হচ্ছে নবুয়তের  সহজাত  ইলম।  আল্লাহ পাক   নবীগণকে   এই   গায়েবী   এলেমের   জ্ঞান   প্রদান  করেই   পাঠিয়েছেন।   তাঁদের   এই    জ্ঞানকে    বলা    হয়  ইলমে  হুযুরী  (علم حضوري)  বা  ঐশীলব্ধ  জ্ঞান।  আর  আমাদের     জ্ঞানকে      বলা     হয়     ইলমে       হুছুলী     (علم حصولي) বা অর্জিত জ্ঞান।

স্মরণ       রাখা      একান্ত     দরকার     -     নবীগণের      তিনটি অপরিহার্য  বৈশিষ্ট রয়েছে-  যা অন্য কারুর মধ্যে নেই। যথা  (১)     ইলমে   গায়েব  বা   গায়েব   সম্পর্কে  অবহিত থাকা।      (২)    ফিরিস্তা  দর্শন  ও  (৩)  ইলমে    বদিহী  বা হুযুরী। (দেখুন দেওবন্দের আলেম সোলায়মান নদভীর লিখিত     সীরাতুন্নবী,      ৩য়     খন্ড      ১৬/১৭      পৃষ্ঠা     উর্দু সংস্করণ)।

আমাদের প্রিয়নবী  সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামকে  আল্লাহ পাক   কীভাবে  ইলমে   গায়েব শিক্ষা দিয়েছেন-  তা  দেখুন-    কোরআন  মজিদ  সূরা  নিসা, আয়াত নম্বর ১১৩। আল্লাহ পাক এরশাদ করেনঃ

وعلّمك  مالم   تكن   تعلم  –   অর্থাৎ-   ”হে  প্রিয়     হাবীব!  আপনার     প্রতিপালক    (অতীতে)      আপনাকে    অজানা বিষয়  নিজে শিক্ষা দিয়েছেন”। এই আয়াতের  ব্যাখ্যায় জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহঃ) বলেছেন,
أى من الأحكام والغيب অর্থাৎ- ”শরীয়তের বিধি-বিধান ও ইলমে গায়েব আপনাকে  অতীতে শিক্ষা দিয়েছেন”। (তাফসীরে জালালাঈন- সূরা নিসা, ১১৩। আয়াত)।

বুঝা গেলে- নবীজির ইলমে  গায়েব খোদা প্রদত্ত। যারা তাফসীর  দেখেনা তারাই  বলে  নবীজির ইলমে  গায়েব আতায়ী      ছিলনা।     অথচ       কোরআন     মজিদের      অত্র আয়াতেই    স্পষ্ট    করে     বলা    হয়েছে    যে,     আল্লাহ-ই   নবীজিকে     অতীতে   ইলমে   গায়েব   শিক্ষা   দিয়েছেন।  খোদার  কথা  অস্বীকার করা  কুফরীর নামান্তর নয় কি?

সুক্ষ্ম তত্ত্বঃ
=====
কোরআন   মজিদে  ইলমে গায়েবকে  আল্লাহর অধিকার ভূক্ত বলা হয়েছে এবং নিজে নিজে অন্য কেউ জানেনা  বলে    ঘোষণা   করা     হয়েছে।   এরূপ    ঘোষণাই   প্রমাণ করছে- আল্লাহ যাকে জানিয়েছেন- তিনি জানেন। নিজে নিজে  কেউ  গায়েব  জানেনা-  তার  প্রমাণ  হলো  فل  لاً  یعلم من فی ا لشموت والأرض الغيب الآ الله “বলুন হে প্রিয়    রাসূল!    আসমান    জমীনের    কেউ    নিজে    নিজে  গায়েব জানেনা- নিজে নিজে জানেন একমাত্র আল্লাহ”। (২০ পারা প্রথম রুকূ)। নিজে নিজে জানার নাম ইলমে গায়েব  যাতী।  এটা  আল্লাহর  জন্য  খাস।  আর  আল্লাহ  যাকে জানান বা  দান করেন-  তিনি  প্রদত্ত ক্ষমতা  বলে জানেন।    একে   বলা হয় ইলমে গায়েব   আতায়ী। এটা রাসূলে    পাকের   জন্য   খাস।  যার   জন্য  যা   খাস-    তা অন্যের বেলায়   মানা   কুফারী।   আল্লাহর ইলমে গায়েব যাতী  অন্যের জন্য  স্বীকার করা  যেমন   কুফৱী-  তদ্রূপ নবীজির   ইলমে গায়েব আতায়ী আল্লাহর   জন্য স্বীকার  করাও    কুফরী।  কেননা,  আল্লাহর   ইলাম   আতায়ী  নয় -বরং    যাতী।     কুরআন    মজিদের     ৫টি    আয়াত    দ্বারা নবীজীর   ইলমে  গায়েব    আতায়ী    প্রমাণিত।  যথাস্থানে দেখে নিন।

আলেমদের বুঝার জন্য আর একটি তথ্য হলো –
عَلِمَ يَعلَمُ
অর্থ  হলো  নিজে  নিজে  জানা।  এটা  লাযেম-এর  ছিগা  এবং
عَلَّمَ - يُعَلِّمُ‏‎
হলো-মুতাআদ্দি   -এর   ছিগা।   এর   অর্থ   হলো-অন্যের  মাধ্যমে   জানা।     আল্লাহর   কালামে     লাযেম   বা   নিজে নিজে  ইলমে    গায়েব  জানার    বিষয়টি   অন্যের  বেলায় نَفْي    বা  অস্বীকার  করা  হয়েছে  সত্য-  কিন্তু   নবীজীকে জানিয়ে দেওয়া  ও শিক্ষা দেওয়ার  বিষয়টিরও  স্বীকৃতি اثبات  রয়েছে।  ইলমে  গায়েব  শিক্ষা  দেওয়ার  স্বীকৃতি  রয়েছে   নবীজির   জন্য   এবং    নিজে   নিজে   না    জানার বিষয়টি  হচ্ছে  আমভাবে  অন্যের  ক্ষেত্রে।  নিজে  নিজে  ইলমে  গায়েব  জানাকে  বলে  ইলমে  গায়েব  যাতী-  যা  আল্লাহর     জন্য      খাস     এবং      ইলমে      গায়েব       শিক্ষা  দেওয়াকে বলে ইলমে গায়েব আতায়ী- যা নবীর   জন্য খাস। নবীজীর ইলমে গায়েব আতায়ীর স্বীকৃতি রয়েছে সূরা নিসার    ১১৩ নম্বরসহ  ৫টি   আয়াতের মধ্যে।  এই পার্থক্য   না   জানার  কারণেই  কিছু   বিপথগামী  আলেম সমাজের      মধ্যে      বিভ্রান্তি      ছড়াচ্ছে।      তাই      হক্বপন্থী  আলেমগণ ২০ পারার  উক্ত আয়াত   এবং   সূরা   নিসার ১১৩  আয়াত  সহ    ৫টি  আয়াতের  তাফসীর  ভালভাবে দেখে নিবেন।

 
Top