بسم الله الرحمن الرحيم
সুপ্রিয় পাঠক ভাই ও বোন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। দেখতে দেখতে মাহে রামাযান আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমরা এসে পৌঁছেছি শেষ দশকে। কিন্তু কল্যাণের বারি বর্ষণ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বন্ধ হয়ে যায়নি তাওবার দরজা বরং আরও বেশি সুযোগ নিয়ে মাহে রামাযানের শেষ দশক আমাদের মাঝে সমাগত।
* রামাযানের শেষ দশকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী-পরিবার সহ সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন: উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রামাযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন, নিজে সারা রাত জাগতেন এবং পরিবারকেও জাগাতেন।” (কোমর বাঁধার অর্থ হল: পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত হওয়া।)
* উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগীতে) যে পরিমাণ পরিশ্রম করতেন অন্য কোন সময় করতেন না।”
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমযানের শেষ দশ রাতে শবে ক্বদর সন্ধান কর। (বুখারী ও মুসলিম)
পবিত্র লাইলাতুল ক্বদর:

#############

‘লাইলাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ হলো মহিমা, মহাত্ম বা সম্মান, এই মহাত্ম ও সম্মানের কারণে একে লাইলাতুল ক্বদর, তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। যা হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষা উত্তম। এ রাতটি আমাদের এ উপমহাদেশে ‘শবে ক্বদর’ হিসেবে মশহূর।
ক্বদরের রাত্রের ফযিলত ও মহাত্ম সম্পর্কে কুরআনুল করিমে সূরাতুল ক্বদর নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়েছে। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন ইরশাদ ফরমান: (১) নিশ্চয়ই আমি একে (পবিত্র কুরআনকে) নাযিল করেছি শবে ক্বদরে। (২) শবে ক্বদর সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? (৩) শবে ক্বদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (৪) এই রাত্রিতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। (৫) এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পযর্ন্ত অব্যাহত থাকে। (সুরা ক্বদর)
শবে ক্বদরের ফযিলত ও মহাত্ম সম্পর্কে কুরআন পাকের এই বর্ণনাই যথেষ্ট।
কদরের অর্থ: নির্ধারণ করা, সময় নির্দিষ্ট করা ও সিদ্ধান্ত করা। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন। তার সময় নির্দিষ্ট করেন এবং হুকুম নাযিল করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন। মহান আল্লাহ আরও বলেন “ঐ রাতে সকল বিষয়ের সুষ্ঠু ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় আমার নির্দেশক্রমে”-(সূরা দুখান)
* প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে ক্বদরের রাতে ইবাদত করে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
* প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও এরশাদ করেন: যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহমত ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাঁড়িয়ে- বসে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: লোক সকল! তোমাদের মধ্যে এমন এক রাত এসেছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত রইলো সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল এবং এ রাত থেকে সে-ই বঞ্চিত থাকে যে প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত।–(ইবনে মাজাহ)
লাইলাতুল কদর নির্ধারণ: উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা শবে ক্বদর তালাশ কর। রমযানের শেষ দশকের বে-জোড় রাত্রিতে। (বুখারী)

সাহাবীদের মধ্যে অনেককেই স্বপ্ন দেখান হল, শবে ক্বদর (রমযানের) শেষ সাত রাতের মধ্যে।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: “আমি দেখছি, তোমাদের সবার স্বপ্ন একি রকম- শেষ ৭ রাতেই সীমাবদ্ধ। তাই যে তা অনুসন্ধান করে, সে যেন শেষ ৭ রাতে তা খোঁজ করে দেখে। (বুখারী ও মুসলীম)

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: “তোমরা তালাশ করবে তাকে রমযানের শেষ দশে- মাসের নয় দিন বাকি থাকতে, সাতদিন বাকি থাকতে, পাঁচ দিন বাকি থাকতে। (বুখারী)
উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, রমযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাত গুলোর মধ্যে কোনো একটি অর্থাৎ ২১শে, ২৩শে, ২৫শে, ২৭শে, অথবা ২৯শে রাত।
ইমামে আ’যম আবূ হানীফা (র) সহ অসংখ্য ইমামদের মত হলো: অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে রমযান মাসের সাতাশ তারিখ। তবে সুন্নত হলো পবিত্র রমাদ্বান শরীফ-এর শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতেই শবে ক্বদর তালাশ করা। আলাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
মহিমান্বিত রজনীর নিদর্শনসমূহ:

#################

১. কদরের রাত্রি তিমিরাচ্ছন্ন হবে না।

২. নাতিশীতোষ্ণ হবে। (না গরম না শীত এমন)

৩. মৃদু বায়ু প্রবাহিত হবে।

৪. উক্ত রাতে মু’মিনগণ ইবাদত করে অন্যান্য রাত অপেক্ষা অধিক তৃপ্তি বোধ করবে।

৫. হয়তো বা আল্লাহ তা’আলা কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে তা স্বপ্নে দেখাবেন। (দেখুন : ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান, মুসনাদে আহমদ)

৬. ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে। (বুখারী)

৭. সকালে হালকা আলোক রশ্নিসহ সূর্যোদয় হবে, পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায়। (মুসলিম) অবশ্য এ আলামতটি কদরের রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর সকাল বেলায় জানা যাবে। এর হেকমত হল লায়লাতুল কদর অনুসন্ধানে বান্দাদেরকে অধিক পরিশ্রমী করে তোলা, এবং যারা এ রাতের ফযীলত পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছে তাদেরকে আনন্দিত করা।
কদরের রাতের দুআ:

##########
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি ক্বদরের রাত খুঁজে পাই, তাহলে আমি ওই রাতে কী বলবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, তুমি বলবে- “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী” অর্থ: হে আল্লাহ তুমি অবশ্যই ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পছন্দ করো, তাই আমাকে ক্ষমা করো। (তিরমিযী)
শবে ক্বদর দুআ কবুলের অন্যতম রাত্রি। এই রাত্রিতে বান্দা আল্লাহর কাছে যা আরজি করে আল্লাহ পাক তাকে তাই দিয়ে থাকেন প্রয়োজন অনুসারে। বান্দার সকল দ’ুআই এ রাত্রিতে আল্লাহ পাক কবুল করে থাকেন। কেননা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: “তোমরা আমার নিকট দ’ুআ করো আমি তোমাদের দ’ুআ কবুল করবো।”(পবিত্র কুরআন)
তাই প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে, রমাদ্বান শরীফ-এর শেষ দশ দিনের প্রতি বিজোড় রাত্রিতে জাগ্রত থেকে লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর তালাশ করা। রাত্রিতে জাগ্রত থেকে বেশি বেশি তওবা ইস্তিগফার করে, ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানো এবং সকল মুসলমানের জন্য দু’আ করা। যার মনে যতো আরজি রয়েছে তা আল্লাহর দরবারে পেশ করা। কেননা হাদীছ শরীফ-এ রয়েছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট চায় না বা দু’আ করেনা আল্লাহ পাক তার উপর অসন্তুষ্ট হন।”
কাজেই সকলের উচিত আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টির জন্য, ইসলামের উপর, ঈমানের উপর ইস্তিক্বামত তথা অটল থাকার জন্য, দুনিয়া এবং আখিরাতের সবর্প্রকার কল্যাণের জন্য অন্তর থেকে দু’আ করা। অবশ্যই আল্লাহ পাক তাকে এই মহিমান্বিত রাত্রির সম্মানার্থে তা দান করবেনই করবেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা।
লাইলাতুল ক্বদর-এর নামায: লাইলাতুল ক্বদর-এ সুনির্দিষ্ট কোন নামায নেই, লাইলাতুল ক্বদর-এ সুন্নত-নফল অনেক নামায ও আমলই করা যায়। তবে বিশেষভাবে কয়েকটি আমল করা উচিত। তা হলো: লাইলাতুল ক্বদর-এর নিয়তে ৪/৬/৮/১২ রাকাআত নামায পড়া। দুরূদ শরীফ পাঠ করা। ছলাতুত তাসবীহ’র নামায আদায় করা। যিকির-আযকার করা। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা। তাহাজ্জুদের নামায পড়া। বেশি বেশি তওবা ইস্তিগফার এবং মুনাজাত করা। আল্লাহ পাকর কাছে কান্নাকাটি করা। মীলাদ শরীফ পাঠ করত: দু’আ-মুনাজাত করা, ইত্যাদি।
আসুন, আমরা আল্লাহর দেয়া উপহার গুলো দুহাত ভরে কুড়িয়ে রামাযানকে আরও অর্থ বহ করে তুলি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

 
Top