আশুরার দিন খাবার প্রস্তুত করার মর্মে হাদীসঃ—
✍️ RAFFEHAAN




নবীজী ﷺ এঁর কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হুসাইন عليه السلام এর পবিত্র শাহাদাতের দিন হল ১০ই মুহাররাম। এদিন মুসলমানগণ ইমাম পাকের এবং উনার সাথী শহিদদের ফাতেহা এবং ইসালে সওয়াবের দ্বারা বরকত অর্জনের উদ্দেশ্যে ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করে থাকেন।আমরা এখন দেখবো শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি আছে কিনা।


➤হাদীস নং ১ঃ

'কানযুল উম্মাল' গ্রন্থে ইমাম হিন্দী রহ. উল্লেখ করেন,হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ হতে বর্ণিত তিনি বলেন,নবীজী ﷺ বলেছেন,

من وسع على عياله يوم عاشوراء لم يزل في سعة سائر سنة(٢٤٢٤٩)

—যে ব্যক্তি আশুরাতে পরিবারের জন্য ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করবে,তার পুরো বছর স্বাচ্ছন্দ্যে কাটবে।

হাদীসটি আরো বর্ণিত হয়েছে:
[◑ইমাম তাবারানী,আল-কাবির,১০/৯৪
◑ইমাম নুরুদ্দীন হায়সামী,মাজমাউয যাওয়াইদ,৩/১৮৯
◑ইমাম ইবনে আদী,আল-কামিল ফিদ্ব-দ্বু'আফা,৫/১৮৫৪
◑ইমাম ইবনে হিব্বান,আল-মাজরুহীন,৩/৯৮
◑ইমাম বায়হাক্বী,শু'আবুল ঈমান,৩/৩৬৫,হাদীস নং ৩৭৯২]

ইমাম হায়সামী 'মাজমাউয যাওয়াইদ' গ্রন্থে রাবী 'হায়সাম বিন আশ-শাদাখ' কে খুবই দূর্বল বলেছেন।আবার ইমাম ইবনে আদী বলেন,

وهذا الحديث منكر بهذا الاسناد

— অর্থাৎ এই সনদে (আলী ইবনে আবী তালিব আল বাযযার যখন হায়সাম হতে বর্ণনা করবে) হাদীসটি মুনকার।

তাহলে দেখতে হবে অন্য কোনো সনদে বা অন্যকোনোভাবে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে কিনা।



➤হাদীস নং ২ঃ

'শুআবুল ঈমান' এ ইমাম বায়হাক্বী ঐ একই পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন,হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ নবীপাক ﷺ হতে বর্ণনা করেন যে, নবীজী বলেন,

من وسع على اهله يوم عاشوراء وسع الله على اهله طول سنتة

—যে ব্যক্তি আশুরাতে নিজের পরিবারের জন্য ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করবে, আল্লাহ তাকে সারা বছর স্বাছন্দ্যে রাখবেন।

ইমাম বায়হাক্বী রহঃ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,
هذا اسناد ضعيف
—এই সনদটি দূর্বল।

➤হাদীস নং ৩ঃ

ইমাম হিন্দী রহ. 'কানযুল উম্মাল' গ্রন্থে উল্লেখ করেন,হযরত জাবের রাঃ নবীজী ﷺ হতে বর্ণনা করেন, নবিজী ﷺ বলেন—

من وسع على نفسه وأهله يوم عاشوراء وسع الله تعالى عليه سائر سنته. (ابن عبد البر في الاستذكار عن جابر)(٢٤٢٥٨)

—যে ব্যক্তি আশুরাতে নিজের এবং নিজের পরিবারের জন্য ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করবে, আল্লাহ ﷻ তাকে সারা বছর জুড়েই স্বচ্ছল রাখবেন।(ইমাম ইবনে আব্দিল বার 'আল ইস্তিযকার' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)

বর্ণনাকারী সম্পর্কে চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম ইউসুফ বিন ইসমাঈল নাবাহানী প্যালেস্টাইনি আল-আযহারী রহ. স্বীয় 'শাওয়াহেদুল হক্ব ফিল ইস্তিগাসায়ে সাইয়্যিদিল খাল্ক' এর ১৪৫পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন—

وذكر العراقي أسانيده إلى جابر قال ورواه بإسناده ابن عبد البر في الاستذكار، ورجاله رجال الصحيح

—❝মুহাদ্দিসে কাবীর ফিল মাদীনাহ ইমাম যাইনুদ্দিন ইরাক্বী রহ. স্বীয় গ্রন্থে ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহ. এর 'আল-ইস্তিযকার' এর সনদে বর্ণনা করেছেন।বর্ণনাকারীরা সবাই বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাকারী।❞


এভাবে ইমাম বায়হাক্বী রহ. স্বীয় 'শোআবুল ঈমান' গ্রন্থে পরবর্তীতে ৩৭৯২,৩৭৯৩,৩৭৯৪ নং হাদীসে যথাক্রমে প্রথম দুটি হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাঃ হতে এবং শেষোক্তটি হযরত আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণনা করেছেন।

সব বর্ণনাগুলো সহিহ হবার লক্ষে অল্প-বিস্তর ত্রুটিযুক্ত হলে এরা একত্রে মিলেঝুলে একে অন্যকে শক্তিশালী করে দেয়।

হাদীসগুলোর ব্যাপারে ইমামগণের মন্তব্যঃ

যেমন ইমাম সাখাভী রহ. স্বীয় 'মাক্বাসিদুল হাসানা' গ্রন্থে ৪৩১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:

الطبراني والبيهقي في الشعب وفضائل الأوقات وأبو الشيخ عن ابن مسعود والأولان فقط عن أبي سعيد ، والثاني فقط في الشعب عن جابر وأبي هريرة وقال إن أسانيده كلها ضعيفة و لكن إذا ضم بعضها إلى بعض أفاد قوة ، بل قال العراقي في أماليه : لحديث أبي هريرة طرق صحح بعضها ابن ناصر الحافظ ، وأورده ابن الجوزي في الموضوعات من طريق سليمان ابن أبي عبد الله عنه ، وقال : سليان مجهول وسليمان ذكره ابن حبان في الثقات فالحديث حسن على رأيه قال وله طريق عن جابر على شرط مسلم أخرجها ابن عبد البر في الاستذكار من رواية أبي الزبير عنه وهي وهى أصح طرقه ورواه هو والدارقطني في الأفراد بسند جيد عن عمر موقوفاً عليه ، والبيهقى فى الشعب من جهة محمد بن المنتشر

—"ইমাম তাবারানি (আল-কাবিরে),ইমাম বায়হাক্বী 'শোয়াবুল ইমান' এবং 'ফাদ্বাইলুল আওক্বাত' গ্রন্থে এবং ইমাম আবু শায়খ ইস্পাহানী প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এবং হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।দ্বিতীয়ত হযরত আবু হুরায়রা রাঃ এবং হযরত জাবির রাঃ হতেও দ্বিতীয় আরেকটি পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বায়হাকী সবগুলো সনদকে দূর্বল বলেছেন।কিন্তু হাদীসগুলো একে অন্যকে শক্তিশালী করে।আবার ইমাম যাইনুদ্দীন ইরাকী রহ স্বীয় 'আমালি' গ্রন্থে বলেন,হযরত আবু হুরায়রা রাঃ এর হাদীসকে অনেকে সহিহ বলেছেন,যেমন ইমাম হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে নাসির।তবে ইমাম ইবনুল জওযী রহ. হাদীসটিকে সুলায়মান ইবনে আবু আবদুল্লাহর সূত্রে তার 'আল-মওযূআতে' অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন,সুলাইমান অজ্ঞাত বর্ণনাকারী।অবশ্য ইমাম ইবনে হিব্বান সুলাইমানকে তাঁর 'আস-সিকাত' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে হাদীসটি হাসান। তিনি বলেন,এর অন্য আরেকটি সূত্র রয়েছে,হযরত জাবির রাঃ থেকে;যা ইমাম মুসলিম-এর শর্তের অনুসরণ করেছে। ইবনে আবুয যুবায়রের বর্ণনাসূত্রে হাদীসটি ইমাম ইবনে আবদুল বার রহ. তার 'আল-ইস্তিযকার' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।হাদীসটির এ সূত্রটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ। ইমাম দারাকুতনীও তার 'আল-ইফরাদ' গ্রন্থে এটি হযরত ওমর রাঃ হতে মওকুফ এবং অতি উত্তম সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আল-বায়হাকী কে তাঁর শুআবুল ঈমানে হাদীসটি হযরত মুহাম্মদ ইবনুল মুনতাশিরের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।"

এবক্তব্যটি শায়খ আব্দুল হক্ব আল-বুখারী মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ স্বীয় 'মা সাবাতা মিনাস সুন্নাহ ফি আইয়্যামিস সুন্নাহ' গ্রন্থের ৪০-৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।উনি একই জায়গায় উল্লেখ করেন,হাফেয ইরাকীর হাদীসটির ব্যাপারে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাঃ বলেন—

إنه لا يصح أي لذاته، فلا ينفي كونه حسنا لغيره، والحسن لغيره يحتج به كما بين في علم الحديث

—"হাদীসটি সহিহ-লিযাতিহী নয়"! তবে এতে করে তা 'হাসান লি গায়রিহী' হতে বাধাপ্রাপ্ত নয়।আর হাসান লিগায়রিহী হল দলিলের উপযুক্ত। এমনটাই উলুমুল হাদীস বা হাদীসশাস্ত্রের মূলনীতি।

শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ এই অংশটি ইমামুল হারাম ইমাম ইবনু হাজার হায়তামি মাক্কী শাফেয়ী রহ. এর বিশ্বনন্দির 'আস-সাওয়ায়েকুল মুহরিকা' হতে সংকলন করেন।(২য় খন্ড ৫৩৬পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইলমিয়াহ হতে প্রকাশিত)।

'লাতায়েফুল মাআরেফ' গ্রন্থে ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি রহ. ومن فضائل يوم عاشوراء পরিচ্ছদের ঠিক আগে আশুরার উপরোক্ত হাদীস নিয়ে আলোচনা করেন।এগুলোর কোনোটিকে তিনি মওযু বলেননি,বরং ইমাম আহমদকে উপরোক্ত একটি হাদীস শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে উনি সম্মতিসূচক জবাব দিলেন।এরপর ইমাম সুফিয়ান বিন উয়ায়না সমেত মুহাম্মদ বিন মুন্তাশির এর সনদে হাদীসটি উল্লেখ করেন।

'শাওয়াহেদুল হক্ব' গ্রন্থের ১৪৪-১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন—

ذلك ومن هنا نورد الأحاديث الواردة في استحباب التوسيع يوم عاشوراء، وقد ورد عن النبي ﷺ من طريق جماعة من الصحابة منهم جابر بن عبد الله وعبد الله بن مسعود وأبو هريرة وأبو سعيد الخدري وعبد الله بن عمر بن الخطاب

আমি এখন উল্লেখ করছি সে সকল হাদীস যেগুলোর দ্বারা আশুরার দিন ভালো খাবার দাবার আয়োজন করা মুস্তাহাব সাব্যস্ত হয়।সে হাদীসগুলো হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ,হযরত আবু হুরায়রা রাঃ, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাঃ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ সহ একজামাত সাহাবী হতে বর্ণিত হয়েছে।

'আল মাদখাল' গ্রন্থের ১ম খন্ডের ২০৮ পৃষ্ঠায়(দারুল কুতুব ইলমিয়াহ) আল্লামা ইবনুল হাজ্জ আল মালেকী (৭৩৭ হি.) উল্লেখ করেন—

فَالتَّوْسِعَةُ فِيهِ عَلَى الْأَهْلِ، وَالْأَقَارِبِ، وَالْيَتَامَى، وَالْمَسَاكِينِ وَزِيَادَةُ النَّفَقَةِ، وَالصَّدَقَةِ مَنْدُوبٌ

— আশুরার দিনে ভালো খাবারের আয়োজন করে নিজের পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাওয়া, পাড়া-প্রতিবেশীদের দেয়া,ইয়াতীম, মিসকিন দেয়া এবং বেশি বেশি সাদকাহ করা 'মানদুব' এর অন্তর্ভুক্ত।

[ সালাফীদের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ ওয়েবসাইট islamqa.com এর মধ্যে 'মানদুব' সম্পর্কে বলা আছে—«মানদুব'-কে মুস্তাহাব, সুন্নত, মাসনূন, নফল ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল পালনকারী সওয়াব পাবেন; তবে বর্জনকারী শাস্তি পাবে না।»
https://www.google.com/amp/s/islamqa.info/amp/bn/answers/180341 ]

'হাশিয়াতুল জামাল আলা শরহে মিনহাজ' গ্রন্থের ৩য় খন্ডের ৪৬৫ পৃষ্ঠায় শায়খ মানসুর আল আ'জিইলী আশ-শাফেয়ী আল-আযহারী (১২০৪হি.) উল্লেখ করেন—

وَيُسْتَحَبُّ فِيهِ التَّوْسِعَةُ عَلَى الْعِيَالِ وَالْأَقَارِبِ، وَالتَّصَدُّقُ عَلَى الْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ مِنْ غَيْرِ تَكَلُّفٍ

আশুরা উপলক্ষে ভালো খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে তা পরিবার পরিজন এবং আশপাশের লোকেদের সাথে মিলে খাওয়া,বিনা অসুবিধায় ফকির মিসকিনদের সাদাকা করা,এসব মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত।

জনাব আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী সাহেব 'ইসলাহুর রুসুম' নামক গ্রন্থের ১৩০ পৃষ্ঠা (বঙ্গানুবাদ)

খিচুড়ী ইত্যাদি (মানে উত্তম খাবার) রান্না করে আত্মীয়-বান্ধব ও গরীব মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তার সওয়াব ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে বখশে দেওয়া।–‘এ দিনে যে ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনের জন্য মুক্ত হস্তে খরচ করবে, আল্লাহ তাআলা সারা বৎসর তার আয়-রোজগারে বরকত দেবেন'—এই মর্মে বর্ণিত হাদীসের উপর ভিত্তি করে বলা যায় আশুরা উপলক্ষে খিচুড়ী বা অন্যান্য খাদ্য-বস্তু প্রস্তুত ও বিতরণে কোন দোষ নেই।❞




অতএব বুঝা গেলো এদিন ভালো খাবারের আয়োজন করা মুস্তাহাবের কাজ।
 
Top