প্রসঙ্গঃ মহামিলন দিবসের ঘটনা প্রবাহঃ ইনতিকাল লক্ষণ শুরু
১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। হযরত  আয়শা সিদ্দিকা (رضي الله  عنها)-এর  গৃহে নবী করীম [ﷺ]  অবস্থানরত। বেলা যতই বাড়তে    লাগলো,  নবী   করীম [ﷺ]-এঁর  জ্বর ততই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কন্যা হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) এবং বিবিগণ (رضي الله عنهم اجمعين) এসে উপস্থিত। নবী করীম [ﷺ]-এঁর অবস্থার পরিবর্তন দেখে হযরত ফাতিমা (رضي  الله عنها) কাঁদতে লাগলেন। নবী করীম [ﷺ] তাঁকে শান্তণা দিয়ে বললেন, “মা! কেঁদোনা! আজকের পর তোমার আব্বার আর কোন কষ্ট থাকবে না।"

একথা শুনে হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) ঢুকরে কেঁদে  উঠলেন। স্নেহময়  পিতা এবার হযরত ফাতেমাকে টেনে নিজের কাছে  নিলেন এবং কানে কানে কিছু কথা বললেন, হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) একটু করুণ হাসি হাসলেন। হাসির  কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে পরবর্তীতে  তিনি বললেন, নবী করীম [ﷺ] তাঁকে  শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি আমার পরিবারবর্গের মধ্যে প্রথম যে অচিরেই আমার সাথে মিলিত হবে। তুমি বেহেশতের নারীদের  সর্দার  হবে।"  নবী  করীম  [ﷺ]-এঁর আগাম এ সংবাদটি ছিল মৃত্যু সম্পর্কীয় ইলমে গায়েব। ঠিক ছয় মাসের মাথায় নবী-পরিবারের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইনতেকাল  করেন। এই ছয় মাসের মধ্যে কেউ তাঁকে কোনদিন হাসতে দেখেন নি।

সকাল বেলা নবী করীম [ﷺ]-এঁর অসুখ  বৃদ্ধির কথা দাবানলের মত মদীনায় ছড়িয়ে পড়ে। সাহাবায়ে কেরাম  মসজিদে সমবেত হন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه)  হুযরা মোবারকে  প্রবেশ  করে  নবী  করীম  [ﷺ]-কে ছালাম দিয়ে পবিত্র শরীরে হাত রেখে বলে   উঠেলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ  [ﷺ]! জ্বরের তাপে আপনার পবিত্র শরীরে হাত রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।“ এমন কঠিন অবস্থায়ও নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করলেন- “আমরা  নবীগণের পুরষ্কার যেমন দ্বিগুণ, তদ্রূপ পরীক্ষাও দ্বিগুণ। নবীগণ সুখের সময়  যেমন আনন্দিত, তদ্রূপ পরীক্ষাকালেও আনন্দিত।"

নবী করীম  [ﷺ]-এর পালিত পুত্র জায়েদ বিন হারেসা (رضي الله عنه) ৮ম হিজরীতে মুতার যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র হযরত উসামা (رضي الله عنه)-কে নবী করীম [ﷺ] অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি বললেন -  আমি যুদ্ধের সেনাপতি হয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর নির্দেশে সিরিয়ার পথে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। হুযুর [ﷺ]-এঁর অবস্থার পরিবর্তণের কথা শুনে রাস্তা হতে ফিরে আসলাম এবং নবীজীর খেদমতে হাজির হলাম। নবী করীম [ﷺ] কথা বলতে  পারছিলেন না। তিনি শুধু হাত মোবারক আসমানের দিকে উত্তলোন করে পূণরায় মুখে মালিশ করলেন। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আমার জন্য নীরবে দোয়া করছেন। (আহমদ ইবনে হাম্বল)।

হযরত আয়শা (رضي  الله  عنها) নবী করীম [ﷺ]-কে বুকে নিয়ে ঠেস  দিয়ে বসেছিলেন। নবী করীম [ﷺ] ক্ষণে ক্ষণে নিকটে সংরক্ষিত পাত্র  থেকে পানি  নিয়ে চোখে-মুখে  মালিশ করছিলেন আর বলছিলেন - “মৃত্যুর যন্ত্রণা সত্যিই কষ্টদায়ক।" এই কঠিন সময়ের মধ্যেও উম্মতকে লক্ষ্য করে তিনি কতিপয় ওসিয়ত বা শেষ উপদেশ দিয়ে যান। তিনি  এরশাদ করেনঃ “তোমরা নামাযের পাবন্দি করবে এবং দাস-দাসীদের প্রতি সদয় হবে।"

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত ছিলো দাস-দাসি। শেষ সময়েও নবী করীম [ﷺ]-এর দৃষ্টি সেই অবহেলিত  মানুষের দুর্দশার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি ছিলেন মানবতার মুক্তির দূত। আল্লাহর হক্ব নামায এবং বান্দার হক্ব সেবা - এই ‍দুটি নীতির প্রতি তিনি সর্বশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আমরা আজ উভয়টিকে ভুলতে বসেছি।

পিতা-মাতার সর্বশেষ অসিয়ত  সন্তানগণ প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে কিন্তু আমরা  উম্মত হয়ে নবীজীর শেষ ওসিয়ত ভঙ্গ করছি।  সে কারণেই  আজ আমরা অধঃপতিত। নামায আমাদের জন্য ভারী বোঝা স্বরূপ আর দুর্বলদের শোষণ করা আমাদের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত  হয়েছে। ঈমাম মালেক (رضي الله عنه) মোয়াত্তায় লিখেনঃ-

“নবী করীম  [ﷺ]-এঁর আখেরী উপদেশের মধ্যে এটিও ছিলো যে, পূর্ববর্তী ইহুদী ও নাসারাগণ  তাদের নবীও বুজুর্গানের  মাজারকে সেজদার স্থানে পরিণত করেছিল। তারা  মাজারকে সেজদা করতো। তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। তারা যা করতো তোমরা তা করোনা। (মাজারে সিজদাহ করা হারাম,  শুধু চুম্বন করা বৈধ)। আরব উপদ্বীপে দুটি ধর্ম একসাথে অবস্থান করবেনা। ইয়াহুদ নাছারাদেরকে জাযিরাতুল আরব থেকে বের  করে দাও।" (মোয়াত্তা ইমাম মালেক)

দুঃখের সাথে বলতে হয় - নবীজীর আদেশে হযরত ওমর (رضي الله عنه) যে আরব দেশকে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানমুক্ত করেছিলেন- সেই আরবে নজদী বাদশাহ ফাহাদ ১৯৯০ সালে কুয়েত   রক্ষার নামে এবং ইরাককে শায়েস্তা করার লক্ষ্যে পাঁচলক্ষ ইহুদী-খৃষ্টান সৈন্য আমদানী করে নবীজীর পাক ভূমিকে অপমান করেছে। নবীজীর নির্দেশ ছিলো - আখরিজিল ইয়াহুদ ওয়ান নাছারা’ অর্থাৎ ইয়াহুদী ও নাছারাকে বহিস্কার কর। আর সৌদি সরকারের নীতি হলো- আদখিলুল ইয়াহুদ ওয়ান নাছারা’ অর্থাৎ ইয়াহুদী ও নাছারাকে প্রবেশ করাও।  মূলতঃ এরা খৃষ্টান ও আমেরিকার সামরিক সাহায্য নিয়েই ১৯১৪-১৯১৮ ইং সাল পর্যন্ত ওসমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পুরষ্কার স্বরূপ ১৯২৪ সালে ওহাবী রাষ্ট্র কায়েম করে। তাই তারা বর্তমানেও আমেরিকা ও বৃটেনের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। আমেরিকা গণতন্ত্রী হয়েও সৌদি রাজতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদেশকে গণতন্ত্রের জন্য চাপ দিলেও সৌদি আরব সম্পর্কে একেবারে চূপ। বিষয়টি খুবই রহস্যময়। ১৯১৪-১৯১৮ সালের প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানরা ছিল  তুরষ্কের পক্ষে। ওহাবী ওলামা হিন্দ ছিল নজদীর পক্ষে।

ইনতেকালের মূহুর্তঃ
সোমবার দিন  বেলা যতই বাড়তে লাগলো, হুযুর আকরাম [ﷺ]-এর অস্থিরতাও ততই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এ অবস্থা  দর্শণ করে হযরত ফাতিমা (رضي  الله عنها)  কেঁদে উঠলেন এবং বললেন, “ওয়া কুরাবু  আবাতাহ্।" অর্থাৎ- “হায়! আমার আব্বার কত কষ্ট ও যন্ত্রণা!" পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ফাতিমার অস্থিরতা লক্ষ্য করে নবী করীম [ﷺ]  তাঁকে শান্তনা দিয়ে বললেন- “আজকের পর তোমার আব্বার আর কোন যন্ত্রণা থাকবেনা।" হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) আবার  কেঁদে  উঠলেন।  নবী  করীম  [ﷺ] হযরত ফাতিমার কান মুখের কাছে টেনে এনে চুপে চুপে বললেন- “তুমি  কি এ কথায় সন্তুষ্টু  নও যে, তুমি আমার পরিবারের মধ্যে সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে"? নিজের মৃত্যুর আগাম  সংবাদ পেয়ে এবং নবীজীর সাথে মিলিত হওয়ার সু-সংবাদ পেয়ে হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) করুণ হাসি হাসলেন। এখনও হযরত ফাতিমার মৃত্যু সময়ের গায়েবী সংবাদের (ইলমে গায়েব) প্রমাণ পাওয়া যায়। নবীজি  আল্লাহ প্রদত্ত পঞ্চ গায়েবের ইলমে গায়েব সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন।  আলা হযরতের আদ-দৌলাতুল মাক্কিয়া দেখুন।

 
Top