প্রশ্নঃ কবরের যিন্দেগীর পরে হাশরের যিন্দেগী কখন থেকে শুরু  হবে? অর্থাৎ- কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? কিয়ামতের পূর্বে কি কি আলামত দেখা দিবে? রাসুল করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি  ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন ও তারিখ সম্বন্ধে জানেন কিনা?

জওয়াবঃ মানুষের জীবনের পাঁচটি স্তর রয়েছে। যথা- (ক) রূহানী জগত  (খ) জীবজগত বা বস্তুজগত (গ) বরযখী বা কবর জগত (ঘ) হাশর জগত (ঙ) নশর বা জান্নাত-জাহান্নাম জগত।

রূহানী জগতে কতদিন ছিলাম- তা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় রাসুলই ভাল  জানেন।  জীবজগত অল্পদিনের। বরযখীজগত  আরও দীর্ঘ। কতদিন কবরে থাকতে হবে- তা আল্লাহ্  এবং তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। হাশর জগত আরও দীর্ঘ- পঞ্চাশ হাজার বছর। নশর জগত বা জান্নাতী  ও জাহান্নামী জীবন চিরদিন ও আবাদুল আবাদ পর্যন্ত থাকবে। সেখানে মৃত্যুরও মৃত্যু হবে। মৃত্যুকে ছাগলের আকৃতিতে  যবেহ্ করবেন হযরত ইয়াহ্ইয়া আলাইহিস সালাম।

কিয়ামত কখন হবে- হাদীসে স্পষ্ট করে এ সম্পর্কে সবকিছু বলা হয়নি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা জানতেন- ইলমে গায়েবের মাধ্যমে। কিন্ত এসব তথ্য গোপন রাখার নির্দেশ ছিল- তাই তিনি খোলাসা করে সবকিছু  বলেননি। তবে কিয়ামতের দিন, তারিখ,মাস ও সময় বলে দিয়েছেন- কিন্ত সনের কথা  স্পষ্ট করে কিছু বলেননি- গোপন রেখেছেন। উম্মতের জন্য এগুলোর প্রয়োজনও নেই। শুধূ প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বারবার উল্লেখ করেছেন।  কিয়ামতের পূর্বে কি কি ঘটবে- শুধু তার ভবিষ্যৎবাণী তিনি করেছেন।

হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম চেষ্টা করেছিলেন- নবীজীর মুখে কিয়ামতের সন তারিখ শুনতে- কিন্ত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন তারিখের বিষয়টি  এড়িয়ে যান এবং  বলেন- “প্রশ্নকারীর (জিব্রাঈলের) চেয়ে  প্রশ্নকৃত ব্যক্তি (নবী) অধিক জানেন না”। প্রশ্নকারী ছিলেন জিবরাঈল এবং প্রশ্নকৃত ছিলেন নবী করিম (ﷺ)। জিব্রাঈলের বিশ্বাস ছিল- নবী করিম  (ﷺ)  কিয়ামতের সন তারিখ জানেন। তা না হলে তিনি প্রশ্ন করতেন না। তাই রাসুল করিম (ﷺ) ঐ সময়ে না বলে পরবর্তী সময়ে মাস, তারিখ, দিন ও সময় নির্দিষ্ট করে বলেছেন- কিন্তু সনের কথা গোপন রেখেছেন। তিনি এরশাদ করেছেন- “কিয়ামত হবে মহররম মাসের দশ তারিখ  আশুরার দিন শুক্রবারে এবং তা হবে মাগরিবের সময়ে”। যিনি সেকেণ্ড  ও মিনিট বলতে পারেন- তিনি ঘন্টাও বলতে পারবেন- এটাই  স্বাভাবিক। তদুপরি- সনের হিসাব এক এক দেশে এক এক রকম। তাই তিনি এটি উল্লেখ করেন নি। সর্বোপরি-  তখন সনই গণনা করা হতোনা। হিজরতের ১৭ বৎসর পর হিজরী সন গণনা শুরু হয়। হুযুর (ﷺ) কে  প্রদত্ত তিন প্রকার এলেমের মধ্যে এক প্রকার এলেম  গোপন রাখার নির্দেশ  ছিল। কিয়ামতের সন  তার অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে সাভী, ছুরা নিছা ১১৩ আয়াত)।

কিয়ামতের আলামতঃ
======
এখন আমরা কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিতব্য আলামতের কথা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করবো।

(১) হাদীসে  জিবরাঈলঃ যখন জিবরাঈল (আঃ) কিয়ামতের আলামত জান্তে চাইলেন- তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন- “যখন অবৈধ সন্তানের আধিক্য হবে, বাঁদীর সন্তানেরা রাজ্য শাসন করবে, নীচুস্তরের  লোকেরা বিরাট বিরাট অট্টালিকার মালিক হয়ে অহঙ্কার বশতঃ ধরাকে শরা জ্ঞান করবে- তখন যেন কিয়ামতের প্রতীক্ষা করা হয়। জিবরাঈল (আঃ) নবীজির মুখে এই কথা শুনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বুঝা গেল- নবীজি ভবিষ্যৎবক্তা এবং ভবিষ্যৎ খবরও তিনি রাখেন।

বিঃ দ্রঃ কিয়ামত, হায়াত-মউত, রিযিক-দৌলত, বৃষ্টি, পেটের সন্তান- এই ৫টি হলো আল্লাহর মূল ইলমে  গায়েব। এগুলোর গায়েবী এলেমও  আল্লাহ্পাক নবীজীকে দান করেছেন। (আদ্ দৌলাতুল মাককীয়া)

(২) হযরত আনাছ রাদিয়াল্লাহু   আনহু থেকে কেয়ামতের লক্ষণ এভাবে বর্ণিত হয়েছে,
وعن انس قال سمعت رسول اللّٰہ ﷺ یقول  : ان من اشراط الساعۃ ا۔ ان یرفع  العلم ویکثر الجمل ویکثر الزنا ویکثر شرب الخمر ویقل الرجال وبکثر النساء حتی یکون لخمیس امراۃ القیم الواحد ۔ متفق علیہ ۔

অর্থঃ “হযরত আনাছ (রাঃ) বলেন- আমি রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা  বলতে শুনেছি যে,  কিয়ামতের ছোট আলামতের  মধ্যে অন্যতম আলামত হলো- ইলেম উঠে যাবে (উলামাদের মৃত্যুতে), মূর্খতা   বেড়ে যাবে, যিনা বেড়ে যাবে, শরাবখুরী বেড়ে যাবে, পুরুষের  সংখ্যা কমে যাবে, নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে- (জন্মগত কারণে অথবা যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে)।   এমনকি- পঞ্চাশজন নারীর পরিচালক হবে একজন   পুরুষ”।  (বুখারী ও মুসলীম)।

নোটঃ জন্মগত কারণে তখন প্রোজম বেশি হবে নারীর, যার ফলে মেয়ে জন্ম গ্রহণ করবে বেশি- ছেলের জন্ম হবে কম।

(৩) হযরত আনাছ (রাঃ) হতে বর্ণিত-
عن انس قال : قال رسول اللّٰہ ﷺ : لا یقوم الساعۃ حتی یتقارب الزمان ۔ فتکون السنۃ کاالشھر والشھر کاالجمعۃ وتکون الجمعۃ کا الیوم ۔ ویکون الیوم کاالساعۃ والساعۃ الضرمۃ بالنار ۔ رواہ الترمذی۔

অর্থঃ “হযরত আনাছ (রাঃ) বলেন- রাসূল  মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- কিয়ামত হবে না- যতক্ষণ না সময় সঙ্কুচিত হবে। তখন বৎসর হবে মাসের ন্যায়, মাস হবে সপ্তাহের  ন্যায়, সপ্তাহ হবে দিনের ন্যায়, দিন হবে এক ঘন্টার ন্যায়। আর এক ঘণ্টা হবে আগুন জ্বালানোর সময়ের ন্যায় স্বল্প”। (মিশকাত)

ব্যাখ্যাঃ বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন ও ঘণ্টা মূলতঃ ছোট হবে না-  বরং ফিতনা ফাসাদ ও দুনিয়াবী ধান্ধার কারণে মানুষ এমন মশগুল হয়ে পড়বে যে,  বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন  ও ঘণ্টা কিভাবে চলে যাবে, তা টেরই পাবে না। যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ফিতনা ফাসাদের কারণ হলো কিয়ামতের ছোট আলামত।

আলামতে ছোগরাঃ
======
(৪) হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত-
وعن  ابی ھریرۃؓ قال :  قال رسو  ل  اللّٰہ ﷺ اذا اتخذ القئی دولا ۔ والامانۃ مغنما ۔ والزکوۃ مغرما۔ وتعلم لغیر الدین ۔ واطاع الرسول امراء تہ۔ وعق امہ وادنی صدیقہ۔ واقصی  ابہ ۔ وظھرت الاصوات فی المساجد۔ وساد القبیلۃ فاسقھم کان زعیم القوم ارذلھم ۔ واکرم الرجل مخالفۃ ۔ شرہ ۔ وظھرتالقنیات والمعازف وشربت الخمور۔ ولعن آخر ھذہ الامۃ اولھا فارتقبوا عند ذلک ریحا حمراء او زلزلۃ وخسفا ومسخا وقذفا وآیات تتابع لنظام قطع سلکہ فتتابع ۔ رواہ الترمذی۔

অর্থঃ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা  করেছেন- ”রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- (১) যখন গণিমতের  সরকারী মালকে নিজের স¤পত্তি মনে করা হবে,  (২) আমানতের মালকে গনিমতের মাল মনে করা হবে (৩) যাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে (৪) ইলেম শিক্ষা করা হবে সম্মান ও সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে (৫) স্বামী নিজ স্ত্রীর অনুগত হবে (৬) মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করবে, (৭) বন্ধু বান্ধবকে নিকটে টেনে আনবে, (৮) বাবাকে দূরে ঠেলে দিবে (৯) মসজিদে উচ্চস্বরে দুনিয়াবী কথাবার্তা হবে (১০) জাতীয় নেতারা হবে ফাছেক লোক, (১১) জাতির  নিকৃষ্ট লোকেরা হবে সর্দার, (১২) কাউকে সম্মান করা হবে তার অনিষ্টের ভয়ে, (১৩) গায়িকা ছুক্রীদের আবির্ভাব  হবে ও খেল তামাশার যন্ত্র বৃদ্ধি পাবে, (১৪) শরাবখুরী করা হবে (১৫) এই উম্মতের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী বুযুর্গদের অভিসম্পাত  করবে।

তখন তোমরা প্রতীক্ষা করবে কয়েকটি বিপদের জন্য- যথা  (১) লাল বায়ু বা অগ্নিবায়ু (২) ভূমিকম্প (৩) ভূমিধ্বস (৪) আকৃতির  পরিবর্তন (৫) আকাশ হতে শিলা বর্ষণ (৬) অন্যান্য ভয়ঙ্কর আলামত একটির পর একটি আসতে থাকবে- যেভাবে মালার সুতা  ছিঁড়ে গেলে একটির পর একটি দানা ছিঁড়ে পড়তে থাকে”। (তিরমিযি)

নোটঃ এগুলোকে আলামতে ছোগরা  বা ছোট ছোট লক্ষণ বলা হয়। প্রায় সবগুলোই  কিছু কিছু ফলে গেছে।

কিয়ামতের আলামতে কুবরাঃ
=====
(৫) হযরত হোযায়ফা ইবনে ওসায়েদ গিফারী (রঃ) বর্ণনা করেন-
عن حذیفۃ بن  اسید الغفاری قال : اطلع النبی ﷺ علینا ونحن نتذاکر ۔ فقال ما تذکرون؟ قالوا نذکر  الساعۃ ۔ قال : انما لن تقوم حتی تروا قبلھا عشر آیات۔ فذکر الدخان والدخان والدابۃ ، وطلوع الشمس من مغربھا، ونزول عیسی بن مریم، ویأجوج ومأجوج، وثلٰثۃ خسوف، خسف بالمشرق وخسف بالمگرب وخسف بجزیرہ العبر ۔ وآخر ذلک نار مخرج من الیمن تطرد الناس الی محشر ھم ۔ رواہ مسلم ۔

অর্থঃ “হযরত হোযায়ফা ইবনে ওসায়েদ গিফারী (রঃ) বর্ণনা করেন- আমরা আলোচনারত ছিলাম, এমন সময় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে এসে উদয় হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন-  তোমরা কি সম্পর্কে আলোচনা করছিলে? সবাই আরয করলাম- আমরা কিয়ামতের আলোচনা করছিলাম। হুযুর (ﷺ)  এরশাদ  করলেন - ”কেয়ামত হবে না-  যতক্ষণ না তোমরা তার পূর্বে দশটি আলামত দেখতে পাবে”। তিনি দশটি আলামত এভাবে বললেন- (১) ধূয়া বের হবে (২) দাজজালের আগমন হবে, (৩) দাববাতুল র্আদ  বের হবে, (৪) পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য পুনরায় উদিত হবে (৫) ইছা ইবনে মরিয়ম (আঃ)  -এর পূনঃ আগমন হবে (৬) ইয়া’জুজ মা’জুজ প্রাচীর ভেঙ্গে সমতলে ছড়িয়ে পড়বে (৭) পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলে ভূমিধ্বস হবে, (৮) পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিধ্বস হবে (৯) জাযিরাতুল আরবে ভূমিধ্বস হবে (১০) সর্বশেষ ইয়ামান দেশ থেকে আগুন বের হয়ে লোকদেরকে হাশরের দিকে  হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে”। (মুসলিম শরীফ)

বিঃ দ্রঃ উপরোক্ত দশটি আলামতের বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত  হয়েছে। জেনে রাখা দরকার- প্রথমে ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর আগমন হবে। অতঃপর আবির্ভাব হবে দাজজালের। এর পর আগমন হবে  ইছা আলাইহিস সালামের। হযরত  ইছা আলাইহিস সালাম  ইমাম মাহ্দির পিছনে নামায পড়বেন  হানাফী মাযহাব মতে। তিনি চল্লিশ বৎসর জীবিত থাকবেন, দাজজালকে হত্যা করবেন, বাদ্যযন্ত্র ও হলিক্রস ভেঙ্গে ফেলবেন এবং শুকর হত্যা করবেন। ইয়া’জুজ মা’জুজ তাঁর নিঃশ্বাসে লবণের মত  গলে যাবে। সুতরাং কেউ ইমাম মাহ্দি দাবী করলে হযরত ইছা (আঃ) এবং দাজজালকে দেখাতে হবে- নতুবা সে ভন্ড ও মিথ্যাবাদী।

(৬) ইমাম মাহ্দী সম্পর্কে হাদীসঃ
عن   ام سلمۃ  قالت سمعت   رسول اللّٰہ ﷺ یقول : المھدی من عترتی من اولاد فاطمۃ ۔ رواہ ابو داؤد۔
অর্থঃ “উম্মুল মোমেনীন হযরত উম্মে ছালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত-  তিনি  বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- “ইমাম মাহ্দী হবে  আমার বংশের লোক  এবং  ফাতেমার আওলাদগণের মধ্য হতে”। (আবু দাউদ ও মিশকাত- কিয়ামতের আলামত অধ্যায়)

(৭) ইমাম মাহ্দী হবে হযরত হাসানের খান্দানেঃ
وعن ابی اسحاق قال : قال علی ونظر الی ابنہ الحسن ۔ قال  ان ابنی ھذا  سید کما مسماہ رسول اللّٰہ ﷺ وسیخرج من صلبہ رجل یسمی باسم نبیکم یشبھہ فی الخلق ولا یشبھہ فی الخلق ۔ ثم ذکر قصۃ یملاء الارض عدلا ۔ رواہ ابو داؤد ولم بذکر القصۃ ۔

অর্থঃ “তাবেয়ী আবু ইছহাক (রহঃ) (মৃত্যু ১৩৯ হিঃ) থেকে বর্র্ণিত আছে- তিনি  বলেন, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজ্হাহু আপন  পুত্র হযরত ইমাম হাসানের দিকে নযর করে বললেন- আমার এই পুত্র সাইয়েদ। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁকে ”সাইয়েদ” বলে উল্লেখ করেছেন। আমার এই সন্তানের বংশে ভবিষ্যতে এক  ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটবে-  যার নাম  হবে তোমাদের নবীর নামে “মুহাম্মদ”। তাঁর স্বভাব হবে  নবীজীর মত- কিন্ত আকৃতিতে নয়। এরপর  হযরত আলী (রাঃ) ইমাম মাহ্দীর রাজত্বকালে-আদল ও ইনসাফের বর্ণনা দিয়ে বললেন- ঐসময় ইনসাফে দুনিয়া ভরে যাবে”। আবু দাউদও অত্র হাদীসটি বর্ণনা করেছেন- কিন্ত  ইমাম মাহ্দীর ঘটনাটি বর্ণনা করেন নি।

বিঃ দ্রঃ বর্তমানে পশ্চিমবাংলার একটি দরবার থেকে বলা হচ্ছে- ইমাম মাহ্দীর জন্ম  হবে হযরত ইমাম হোসাইনের বংশে।  আমি তাদের কাছে অত্র  হাদীসখানা  উপস্থাপন করেছি। তারা কোন মন্তব্য করেন নি।

নোটঃ ইমাম মাহ্দী, দাজজাল, হযরত ইছা আলাইহিস সালাম এবং ইয়াজুজ মাজুজ এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

(১) ইমাম মাহ্দী আলাইহিস সালামঃ
=======
নবী  করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইল্মে গায়েবের মাধ্যমে ইমাম মাহ্দীর  জন্ম ও রাজত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। কিয়ামতের  আলামতে ছোগরা যখন ব্যাপক আকারে দেখা দিবে- যা একটু পূর্বে আলামতে ছোগরায় বর্ণনা করা হয়েছে। তখন মুসলমানদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়বে এবং ইসলামের কেন্দ্রীয় কোন শক্তি থাকবেনা। সর্বত্র কাফিরদের প্রভাব ঘটবে। খৃষ্টানরা তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করতে থাকবে। শাম, তুরস্ক  মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।  এমন সময়  মুসলমানগণ প্রতিশ্র“ত  ইমাম মাহ্দীর অভাব  অনুভব করতে থাকবে। ঐ সময় ইমাম মাহ্দী মদিনা শরীফে অবস্থান করবেন। তিনি ইমাম হাসান (রাঃ) এর বংশধর এবং শেষ যমানার গাউসুল আযম  হিসাবে খ্যাতি লাভ করবেন। তাঁর ভক্ত অনুরক্ত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। খৃষ্টানশক্তির কাছে যখন মুসলমানরা একে একে মার খেতে থাকবে- তখনই লোকেরা ইমাম মাহ্দীর অভাব অনুভব করতে থাকবে। তাঁর নাম হবে মুহাম্মদ, পিতার নাম হবে আবদুল্লাহ, মাতার নাম হবে আমেনা। শাসন ক্ষমতা  লাভ করার পর তাঁর লকব হবে ইমাম মাহ্দী।  শাম, তুরস্ক মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার পর মুসলমানরা বেদিশা হয়ে ইমাম মাহ্দীর আগমনের প্রতিক্ষা করতে থাকবে। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আবির্ভাব ও সুশাসন সম্পর্কে অনেক  ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। ইমাম মাহ্দী যখন অনুভব করবেন যে, লোকেরা হয়তো এই ঘোর বিপদ থেকে মুক্তির জন্য তাঁকে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ  করার জন্য বাধ্য করতে চায়, এই ভয়ে তিনি মদিনা শরীফ হতে মক্কা শরীফে গোপনে  চলে আসবেন এবং আত্মগোপন  করে চলবেন। ইত্যবসরে অনেক ভণ্ড লোকেরা ইমাম মাহ্দী দাবী করে ফায়দা লুটবে।

শেষ পর্য্যন্ত সত্য ইমাম মাহ্দীর সন্ধান মিলবে। যখন তিনি খানায়ে কাবায় তাওয়াফরত অবস্থায় হজ্রে  আসওয়াদ ও মাকামে  ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছবেন, তখন কিছু  সংখ্যক ওলী আবদাল তাঁকে চিনে ফেলবেন  এবং একপ্রকার জোর করে তাঁকে খলিফাতুল  মুসলিমীন ঘোষনা করে তাঁর  হাতে খেলাফতের বায়আত  করবেন। এ সময়ে আসমানী গায়েবী আওয়াজ শুনা যাবে- “ইনিই আল্লাহর খলিফা ইমাম  মাহ্দী”। নেতৃত্ব গ্রহণের পর ইমাম মাহ্দী সুশাসন কায়েম করবেন। মদিনা ও চতুর্দিক  থেকে বিচ্ছিন্ন মুসলিম সৈন্যবাহিনী এসে ইমাম মাহ্দীর সাথে যোগ দেবেন।

কিন্তু তিনি  নিচ্ছিদ্র আয়াসে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন না। তাঁর সামনে এগিয়ে আসবে কণ্টকাকীর্ণ পিচ্ছিল রাস্তা। একের পর এক বিপদ এগিয়ে আসতে থাকবে। তিনি দৃঢ়তার সাথে সবগুলোর মোকাবেলা করবেন। একদিকে নয়লক্ষ ষাট হাজার খৃষ্টান বাহিনী তুরস্ক ও সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসবে- অপর দিকে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে দাজজালের খোদায়ী দাবী  ও অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চলতে থাকবে। ইমাম মাহ্দী মক্কা শরীফ হতে সৈন্য বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার দিকে রওনা দিবেন।  প্রথমে মদিনা শরীফ গমন করে রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারে রওযা মোবারক যিয়ারত  করবেন। তারপর শামদেশের  দিকে রওনা দিবেন। দামেস্কে খৃষ্টান বাহিনীর সাথে মাহ্দী বাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হবে। মাহ্দী বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ ভয়ে পলায়ন করবে, এক অংশ শহীদ হয়ে যাবে- বাকী এক অংশ চারদিন ব্যাপী   ঘোরতর যুদ্ধ করে বিজয়ী হবে। এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খৃষ্টান বাহিনী আর রাজত্ব  করতে পারবেনা। ইমাম মাহ্দী সামনে অগ্রসর হয়ে সিরিয়া ও তুরস্ক জয় করে নেবেন। এভাবে ইমাম মাহ্দীর রাজত্ব সুদৃঢ় করতে  বাইআতের সময় হতে সাত বৎসর অতিবাহিত হয়ে  যাবে। সারা পৃথিবীতে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।

(২) দাজজালের ফিতনা এবং ইছা (আঃ)  -এর  আগমনঃ
=======
ইমাম মাহ্দী (আঃ) যখন বিজিত রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনে ব্যস্ত- এমন সময় একটি মিথ্যা খবর প্রচারিত হবে যে, শাম দেশে দাজজাল আবির্ভূত হয়েছে। এ খবর পেয়ে ইমাম মাহ্দী আপন  সৈন্যবাহিনী নিয়ে শামদেশের দিকে রওনা দিবেন। পথিমধ্যে জানতে পারবেন- খবরটি ছিল ভূয়া।  তাই তিনি পথিমধ্যে বিজিত রাজ্যসমূহে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়ে ধীরে ধীরে  শামদেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকবেন।

শামদেশে পৌঁছার পর কিছুদিনের মধ্যে দাজজালের আবির্ভাব হবে। প্রথমে সে নবী দাবী করে ইস্পাহানের দিকে অগ্রসর হবে। সেখানে ৭০ হাজার ইহুদী তাকে নবী বলে স্বীকার করবে। পরে সে  খোদায়ী দাবী করবে। দাজজাল একের পর এক দেশ জয় করতে করতে দক্ষিণ দিকে  অগ্রসর হয়ে ইয়ামেন দেশের সীমানায় গিয়ে উপস্থিত হবে। তার তিলিসমাতি দেখে প্রত্যেক দেশ হতেই বহু সংখ্যক লোক ধর্মত্যাগী হয়ে তাকে খোদা বলে  স্বীকার করে নেবে। তারপর সে মক্কা-মদীনা  দখল করার জন্য অগ্রসর হবে। কিন্তু আল্লাহর ফিরিস্তারা তাকে বাধা দিবে। মদিনা শরীফে ঐ সময় তিনবার ভূমিকম্প হবে। এতে ভীত হয়ে কিছু লোক মদিনা হতে বের হয়ে গিয়ে   দাজজালের বাহিনীতে যোগ দেবে। দাজজাল মানুষকে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করে  দেখাবে। যে  তাকে খোদা মানবেনা তাকে তার দোযখে নিক্ষেপ করবে। মূলতঃ উহাই আসল বেহেস্ত। যারা মানবে- তাদেরকে তার জান্নাতে প্রবেশ করাবে- মূলতঃ উহাই আসল দোযখ। মদিনার জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি দাজজালকে চ্যালেঞ্জ করে প্রথমে  নিহত হবেন।  পরে জীবিত হয়ে তিনি দাজজালকে দৃঢ়ভাবে যখন প্রত্যাখ্যান করবেন- তখন দাজজালের তিলিসমাতি  কোন কাজে আসবেনা। এভাবে সে বহু লোককে কাফেরে পরিণত করবে।

দাজজাল মদিনায় প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে শামদেশের দিকে ইমাম মাহ্দীকে মোকাবেলা করতে রওনা দিবে। যখন সে দামেস্কে পোঁছবে, তখন ইমাম মাহ্দী (আঃ) আপন সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত  হবেন। এমন সময়েই হযরত ইসা আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে দুজন ফিরিস্তার কাঁধে ভর দিয়ে দামেস্কের জামে মসজিদের পূর্ব প্রান্তের মিনারায় এসে দাঁড়াবেন এবং সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসবেন। তখন মসজিদে সবেমাত্র আছরের  আযান হয়েছে। ইমাম মাহ্দী ইমামতি করতে  প্রস্তুত হবেন। এমন সময় হযরত ইছা আলাইহিস সালামকে দেখে  নামাযে ইমামতি করার অনুরোধ করবেন এবং রাজ্য শাসন ও যুদ্ধের দায়িত্ব বহন- ইত্যাদি তাঁর উপর ন্যাস্ত করতে চাইবেন। কিন্তু ইছা আলাইহিস সালাম বলবেন- রাজ্য পরিচালনা ও  নামায পরিচালনার দায়িত্ব আপনিই পালন  করুন। আমি শুধু দাজজাল ও  ইয়াজুজ মাজুজকে বধ করে যমীনকে পাক করতেই আদিষ্ট হয়ে এসেছি। পরদিন দাজজালের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ হবে। মুসলিম সৈন্যবাহিনী  ইমাম মাহ্দীর নেতৃত্বে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।  হযরত ইছা (আঃ) তাঁর নেতৃত্বে একটি ঘোড়ায় চড়ে বল্লম হাতে নিয়ে রওনা দিবেন। আল্লাহপাক হযরত ইছা (আঃ) -এর নিঃশ্বাসে এমন এক বিষাক্ত মোজেযা দান করবেন যে, যতদূর দৃষ্টি যায়- ততদূর পর্য্যন্ত নিশ্বাস পৌঁছবে। যেসব দাজজাল বাহিনীর গায়ে ঐ শ্বাস লাগবে- সে তৎক্ষনাৎ ধ্বংস হয়ে  মৃত্যু বরণ করবে। দাজজাল অনেক দূর হতে হযরত ইছা (আঃ) কে দেখে পলায়ন করতে চাইবে- কিন্তু হযরত ইছা (আঃ) বিদ্যুৎবেগে অগ্রসর হয়ে “বাবে লোদ” নামক স্থানে  গিয়ে দাজজালকে খতম করে দেবেন।

হযরত ইছা (আঃ) ইমাম মাহ্দীর সাহায্যকারী হয়ে আগমন করবেন  এবং তাঁর পিছনে হানাফী মাযহাব মতে  মোক্তাদী হয়ে নামায আদায় করবেন। তিনি দাজজাল উপদ্রুত এলাকাসমুহে ভ্রমণ করে সবাইকে ইসলামে পূনঃদীক্ষিত করবেন। ঐ সময় যমীনে কোন কাফের থাকবেনা। ইমাম মাহ্দী ও হযরত ইছা (আঃ) -এর যৌথ প্রচেষ্টায় দুনিয়ায় অনাবিল  শান্তি নেমে আসবে। খৃষ্টানদের যাবতীয় মনগড়া প্রথা তিনি বিলুপ্ত করবেন। এর কিছুদিন পর  ইমাম মাহ্দী ইন্তিকাল করবেন এবং হযরত ইছা আলাইহিস সালামের রাজত্ব আরম্ভ হবে। তিনি চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ বৎসর রাজত্ব করে বিবাহ শাদী  করে সন্তানাদি রেখে ইন্তিকাল করবেন। তখন তাঁর বয়স হবে পূর্বের ৩৩ বৎসর সহ মোট ৭৩ বা ৭৮ বৎসর। তাঁর ওফাত হবে কোহেতুর পাহাড়ে- কিন্তু রওযা হবে মদিনাতে রাসুলে পাকের সাথে। হাশরের দিনে  চারজন একসাথে হাশরে যাবেন।

(৩) ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনাঃ
=======
দাজজালের পর আসবে ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনা। তারা হযরত নূহ্ আলাইহিস সালামের এক  পুত্র ইয়াফিস -এর বংশধর।  এদের বাসস্থান দুনিয়ার উত্তরাঞ্চলের শেষ সীমান্তে হাফ্ত এক্লীমের বাইরে। ওয়াল দ্বারা  অন্যান্য  মানবগোষ্ঠি থেকে তারা পরিবেষ্টিত আছে। কিয়ামতের পূর্বে আলামতে কোব্রা হিসাবে তাদের অভ্যূদয় হবে। তারা এখন ওয়াল চেঁটে চেঁটে ছিদ্র করে বেরিয়ে আসতে  চায়। কিন্তু রাত্রে ওয়াল তথৈবচ হয়ে যায়। কিয়ামতের পূর্বে দাজজালের পরে হযরত ইছা আলাইহিস সালামের রাজত্বকালে তাদের প্রাদুর্ভাব হবে। হযরত ইছা (আঃ)   -এর নিঃশ্বাসে তারা ধবংসপ্রাপ্ত হবে। তারপর   তিনি কুহেতুরে  চলে যাবেন  এবং সেখানেই ইন্তিকাল করবেন। তাঁর লাশ মোবারক মদিনায় আনা হবে এবং রাসলে পাক (ﷺ)  -এর রওযার ভিতরে তাঁর জন্য সংরক্ষিত স্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।  শেষ সিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার পর  রাসুলেপাক (ﷺ) তাঁর হাত ধরে হাশর ময়দানে যাবেন এবং তাঁদের দুপাশে থাকবেন হযরত আবু  বকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)। হযরত ইছা (আঃ) -এর পর ইয়ামেনের কাহ্তান বংশীয় জাহ্জাহ্ নামক জনৈক ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং তাঁর বংশের আরো কিছু লোক  শাসন কার্য পরিচালনা করবেন। তাদের সময়েও ন্যায়শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে। পুনরায় দুনিয়া কুফরীর দিকে যাবে এবং তারপরই কিয়ামত ঘনিয়ে আসবে।


------

 
Top