কোন  কোন লোক ইছালে ছাওয়াব সম্পর্কে বলে- নিজের আমল ব্যতিত মৃতব্যক্তি অন্যের  দানকৃত ছদ্কা- খয়রাত দ্বারা উপকৃত   হবে না। সুতরাং মৃতব্যক্তির  জন্য দোয়া করা, সদ্কা করা, যিয়ারত করা নিষ্ফল। এর স্বপক্ষে তারা কোরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যামূলক  কিছু দলীল পেশ করে। তাদের মনগড়া দলীলসমূহ  নিম্নে পেশ করে সংখ্যা গরিষ্ঠ আলেম উলামাগণ তা খন্ডন করে যে  সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন- তা উল্লেখ করা হলোঃ

আপত্তিঃ
====
(১) ইছালে ছাওয়াব বিরোধীদের প্রথম দলীলঃ
وان لیس الانسان الاما سعی
“মানুষ ঐ আমলের ফল পাবে- যা সে নিজে করেছে”। (ছূরা নাজ্ম ৩৮  আয়াত)। নিজে আমল করার ফল দুটি। একটি হলো মৃত্যুর সাথে সাথে যা বন্ধ হয়ে যায়। যেমন নামায, রোযা ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি হলো মৃত্যুর পরও সে কিছু আমলের ফলাফল পাবে- যা পরকালের জন্য নিজে  করে গেছে। যেমন- সদকায়ে জারিয়া। কিন্ত অন্যেরা কোন আমল করে  মৃত ব্যক্তিকে দান করলে তার সওয়াব মোটেই পাবেনা। (নাউযুবিল্লাহ)

(২) তাদের দ্বিতীয় দলিলঃ
وَلَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
অর্থাৎ: “তোমাদেরকে পরকালে তারই  প্রতিদান দেওয়া হবে- যা  তোমরা নিজে দুনিয়াতে আমল করেছিলে। ” (ছুরা ইয়াছিন ৫৪ আয়াত)

তারা  বলে- উক্ত আয়াতে জোর দিয়ে আল্লাহ্পাক বলেছেন- “মানুষ দুনিয়ায় থাকাকালীন  যে আমল করেছে, শুধু তারই ফলাফল পাবে- এর বাইরে কিছূ পাবেনা। ” (নাউযুবিল্লাহ্)

(৩) তাদের তৃতীয় দলিলঃ
لھا ماکسبت وعلیھا ما اکتسیت
অর্থাৎঃ “মানুষের উপকারে আসবে তার নিজের ঐসব নেক আমল- যা সে নিজে সহজে অর্জন করেছে। আর বোঝা বহন করতে হবে ঐ সব বদ কাজের- যা  সে কষ্টকর পথে অর্জন করেছে”। (ছূরা  বাক্বারা শেষ আয়াত)

তাদের মতে উক্ত  আয়াতে নিজের নেক আমলকে সহজে অর্জিত আমল বলা হয়েছে এবং বদ আমলকে কষ্টার্জিত আমল বলা হয়েছে। কেননা,  নেককাজ করতে আল্লাহর সহায়তা পাওয়া যায়। কিন্ত বদকাজ করতে গেলে সহজে করা যায় না-বরং বহু কষ্ট করতে হয় এবং অনেক অন্যায় কাজ সাথে যোগ করতে হয়। তারা বলে- আয়াতের সারমর্ম হলো - “সহজে হোক বা কষ্টের মাধ্যমে হোক-  নিজের ভালমন্দ আমলের ফলাফলই  সে পরকালে ভোগ করবে। এতেও বুঝা যায়- সে অন্যের আমল দ্বারা উপকৃত হবেনা।   (নাউযুবিল্লাহ)

(৪) তাদের চতুর্থ দলিলঃ হাদীস
اذا مات الانسان انقطع عنہ عملۃا لامن ثلاث صدقۃ جاریۃ او علم ینتفع بہ الناس۔ او ولد صالح یدعولہ ۔ رواہ مسلم۔
অর্থাৎঃ “মানুষ মরে যাওয়ার সাথে সাথে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। যেমন- নামায ও রোযা। কিন্ত তিনটি আমলের ফলাফল বন্ধ হয় না- বরং চালু থাকে। যথাঃ (১) ছদ্কায়ে জারিয়া, (২) রেখে যাওয়া ইলেম ও (৩) সুসন্তান- যে তার জন্য দোয়া করবে”।

ছদ্কায়ে জারিয়ার অর্থ হলো- যে দানের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। যেমন- রাস্তাঘাট,  হাসপাতাল, মসজিদ ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ইলেম রেখে যাওয়ার অর্থ হলো- নিজে ইলেম শিক্ষা দেয়া বা শিক্ষা দেওয়ার  জন্য মাদ্রাসা তৈরি করে যাওয়া। সুসন্তান রেখে যাওয়ার অর্থ হলো- এমন সন্তান রেখে যাওয়া, যে সন্তান পিতামাতার জন্য দোয়া  করবে  এবং সৎজীবন যাপন করবে।  এই তিনটিই তার নিজের কর্ম। অন্যে সদ্কা করলে সে সাওয়াব পাবেনা।

ইছালে ছাওয়াব বিরোধীদের এই ৪টি শক্তিশালী  দলীল তাদের একমাত্র পুঁজি। তারা জানেনা যে, মনের অজান্তেই তারা এগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করেছে।

১। জওয়াবঃ (প্রথম দলীলের)
======
“ইছালে ছাওয়াব বিরোধীরা বলে- “মানুষ তা-ই পাবে- যা সে নিজে অর্জন করেছে”। সুতরাং অন্যের আমলের দ্বারা সে উপকৃত হবেনা”।

খণ্ডনঃ  আল্লাহ্ তায়ালা ছুরা নাজম  -এর ৩৯ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন-
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَى
উহার মধ্যে لِلْإِنسَانِ শব্দের মধ্যে لَّا مَ-এর ব্যবহারিক অর্থ এখানে تملیک হবে- অর্থাৎ “মানুষ যেসব নেক আমল করে, তার ছাওয়াবের মালিক সে নিজে”-অন্যে ইহার মালিক নয়। ইহাই আয়াতের  মূল আলোচ্য বিষয়। কারো অর্জিত নেক আমল অন্যকে দান করার কোন নিষেধাজ্ঞা অত্র আয়াত দ্বারা বুঝা যায়না। কারো নিজস্ব আমলের ছাওয়াব মৃত ব্যক্তিকে দান  করার অনুমতি অন্য আয়াতে এবং হাদীসে রয়েছে। সুতরাং উক্ত আয়াত দ্বারা ইছালে ছাওয়াবকে  নিষিদ্ধ বলার কোনই অবকাশ নেই।

ইছালে ছাওয়াবের কোরআনিক প্রমান হলো ছুরা “তূর” ২১ আয়াত। উক্ত আয়াতে আল্লাহ্পাক বলেন-
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ   أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ
অর্থাৎ- “মোমেন পিতামাতার ঈমানের  অনুগামী সন্তানগণকে আমি পরকালে তাদের পিতামাতার সাথে মিলন ঘটাবো”।

বুঝা গেল- সন্তানগণ   পিতামাতার  ঈমানের উত্তরাধিকারী এবং তা দ্বারা সে উপকৃত হবে। তদ্রুপ অন্যের আমলের দ্বারাও সে উপকৃত হবে। সুতরাং অত্র আয়াতের দ্বারা ইছালে ছাওয়াবও প্রমাণিত হলো।

হাদীস শরীফে ইছালে ছাওয়াবের প্রমান হলো মা’ক্বাল ইবনে ইয়াছার বর্ণিত হাদীস-
اقرؤا وعلی موتا کم سورۃ یسن۔
“তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের জন্য ছুরা ইয়াছিন পাঠ করো-তাহলে তার মৃত্যু সহজ হবে এবং কবরের আযাব বন্ধ হবে”। বুঝা গেল- পরের আমলের দ্বারা সে উপকৃত হবে।

২। জওয়াবঃ (২নং দলীলের)

ইছালে ছাওয়াব বিরোধীরা وَلَا  تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ আয়াত দ্বারা বুঝাতে চেয়েছে-  “লোকেরা পরকালে  শুধূ তাহাই পাবে- যা সে  নিজে অর্জন করেছিল। এর বাইরে অন্য কোন  সুত্রে উপকৃত হবেনা।

খণ্ডনঃ তাদের এই  যুক্তি সঠিক নয়। কেননা, অত্র আয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো- “পরকালে নিজের অর্জিত আমলপ্রাপ্তির গ্যারান্টি। নিজের আমল কোন মতেই বরবাদ করা হবেনা”। এখানে অন্যসুত্রে  প্রাপ্ত নেক আমল প্রাপ্তির  নিষেধাজ্ঞামূলক কোন ইশারা নেই। অতএব অত্র আয়াতের যুক্তিও তাদের সঠিক নয়।

৩। জওয়াবঃ (৩নং দলীলের)

ইছালে  ছাওয়াব বিরোধীরা বলে- “আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন-
لھا ما کسبت وعلیھا مااکتسبت
অর্থাৎ “সহজপথে নিজের অর্জিত নেক আমল দ্বারা নিজে উপকৃত হবে এবং কষ্টের পথে অর্জিত গুনাহর বোঝাও সে নিজেই বহন করবে- অন্যে নয়”।

এতে বুঝা গেলো- মরে গেলে নিজের আমলের দ্বারাই উপকৃত অথবা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অন্যের ছাওয়াব দ্বারা কোন উপকার হবেনা।

খণ্ডনঃ তাদের উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যা সঠিক হয়নি। কেননা, অত্র আয়াতে শুধু নিজের নেক আমল বা বদ আমলের বিনিময় প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। অন্যের নেক আমল বা  ইছালে ছাওয়াবের নিষেধাজ্ঞামূলক কোন ইঙ্গিত অত্র আয়াতে নেই। সুতরাং অত্র আয়াত দ্বারা ইছালে ছাওয়াব বিরোধী ফতোয়া দেয়া শুদ্ধ নয়। ইছালে ছাওয়াবের  পৃথক আয়াত ও হাদীস ২৬তম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে  সপ্তম অধ্যায়ে। বিরোধীরা এগুলো খন্ডন করতে পারবে না- ইন্শাআল্লাহ্!

(৪) জওয়াবঃ (৪নং দলীলের):

ইছালে ছাওয়াব বিরোধীরা বলে- “মানুষ মারা গেলে তার  স্বাভাবিক আমল বন্ধ হলেও দুনিয়ার নিজস্ব আমলের ধারাবাহিক ফলাফল অব্যাহত থাকবে এবং এর দ্বারাই সে উপকৃত হবে- অন্যের আমলের দ্বারা নয়। ”

খণ্ডনঃ বিরোধীদের বর্ণিত হাদীসেই উল্লেখ  আছে- “নেক সন্তানেরা দোয়া করলে পিতামাতা ও পূর্বপুরুষরা উপকৃত হবে”। বুঝা গেল- দুনিয়ার সন্তানেরা দোয়া করলে বা  নেক আমল করলে কবরবাসীরা সেই সাওয়াব পায়। ইহাই তো ইছালে ছাওয়াবের মূল কথা ও মূল বিষয়। অতএব প্রমানিত হলো-   ইছালে ছাওয়াব, ফাতিহা, কবর যিয়ারত, সদ্কা-খয়রাত ও তিলাওয়াত- ইত্যাদি করা জায়েয ও বৈধ এবং ইহার সাওয়াব মুর্দারেরা পায়। তাদের মনগড়া ব্যাখ্যা সঠিক নয়।

ইছালে ছাওয়াবের আরো প্রমাণঃ
======
(১) ফাতেহা বিরোধীদের মান্যবর  ইমাম  শাহ ওয়ালিউল্লাহ  সাহেব নিজেই  প্রচলিত ফাতেহা অনুষ্ঠানকে জায়েয বলেছেন। যেমন, তিনি তাঁর “আল্ ইন্তিবাহ্ ফী ছালাছিলিল আউলিয়া ” গ্রন্থে উল্লেখ  করেছেন-
”پس دہ مردہ درود خوانند ختم تمام کنند وبرقدرے شیرنی فاتحۃ ینام خواجگاں چشت عموما بخواند وحاجت از خدا سوال نما نیند”
অর্থাৎ “দশ মর্তবা ﷺ পড়ে খতম পূর্ন করবে এবং সামান্য শিরনী সামনে  রেখে সমস্ত  খাজেগানে  চিস্ত- এর নামে  ফাতেহা দিবে এবং আল্লাহর  দরবারে দোয়া করবে”। (আল-ইন্তিবাহ্)। বুঝাগেল- অন্যের  প্রদত্ত সওয়াব মুর্দারগণ পেয়ে থাকেন।

(২) শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ তাঁর “যোবদাতুন  নাছায়েহ্” গ্রন্থে আরও পরিষ্কার করে ফাতেহা পাঠের  উল্লেখ করে বলেছেনঃ
وشیر یرنج بنا بر فاتحۃ بزرگے بقصد ایصال ثواب۔ بروح ایشاں پرند وبخورند مضائقۃ نیست۔
واگر فاتحۃ بنام بزرگ دادہ شود اغنیارا ھم خوردن جائز است۔
অর্থঃ “দুধ-চাউল মিশিয়ে কোন বুযর্গ ব্যক্তির ফাতেহা দেয়ার উদ্দেশ্যে শিরনী তৈরী করে তাঁর রূহে ছাওয়াব পৌছানো  এবং উক্ত তাবাররুক নিজে খাওয়া ও ধনীদেরকে খাওয়ানো- সবই জায়েয। এতে দোষের কিছুই নেই” (যোব্দাতুন নাছায়েহ্)।

ছাব্বিশতম অধ্যায়ে এতগুলো (১২টি) দলীল-আদিল্লা পেশ করার উদ্দেশ্য হলো- তিনদিন, সাত দিন, চল্লিশ দিন, ছয়মাস ও বার্ষিকী পালনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান করা এবং ফাতেহা পাঠ  করা, মিলাদ পড়া, সামনে নেয়ায  রেখে  প্রথমে দোয়া   করা ও পরে খাওয়া-ধনীগরীব সবার জন্য জায়েয। এতে দোষনীয় কিছুই নেই। সপ্তম অধ্যায়েও ইছালে ছাওয়াবের দলীল পেশকরা  হয়েছে। সুন্নী মুসলমানরা হাদীস এবং বুযর্গদের আমলের উপরই অনুসরণ   করে এবং তিনদিন ও চল্লিশা পালন করে। যাদের ভাগ্যে এসব নেয়ায নেই, তারাই মূলতঃ সর্বহারা ও ঈমান হারা।

-----

 
Top