পুরুষদের  জন্য জান্নাতে দু প্রকারের স্ত্রী থাকবে। দুনিয়ার নিজ স্ত্রী বা স্ত্রীগণ এবং বেহেস্তের হুর জাতীয় স্ত্রী। এ ছাড়াও থাকবে- কাফেরের কোন  স্ত্রী যদি মুসলমান হয়ে যায়- যেমন ফেরআউনের স্ত্রী আছিয়া। তিনি এবং হযরত মরিয়ম হবেন হুযুরের জান্নাতী স্ত্রী। পুরুষদের বয়স হবে ৩০/৩৩ বৎসরের মধ্যে। শক্তি হবে একশত পুরুষের। হুরগণের বয়স হবে পুরুষদের ইচ্ছানুযায়ী। জান্নাতে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে আনন্দমিলন হবে- কিন্তু সন্তানাদি হওয়ার ইচ্ছা তাঁরা করবে  না। তাঁদের মিলনে শরীর নাপাক হবে না। এ সম্পর্কে  বিভিন্ন রেওয়ায়াত এসেছে। দুনিয়ার স্ত্রী ছাড়াও হুর হবে কমপক্ষে ৭২ জন করে। তাঁদের গঠনপ্রকৃতি ও রূপসৌন্দর্য হবে বিস্ময়কর- যা কেউ কোন দিন শুনেনি, দেখেনি-এমন কি কল্পনাও করেনি। দুনিয়ার স্ত্রীগণ হবেন সর্দার।  দুনিয়ার স্ত্রী ও বেহেস্তী হুরদের মধ্যে রূপগুণ ও মর্যাদা  নিয়ে মাঝে মধ্যে কথা কাটাকাটি হবে। বেহেস্তী হুরেরা বলবে- আমরা রুপেগুণী অধিক সুন্দরী, পাকপবিত্র ও স্বামী সোহাগিণী। অপরদিকে দুনিয়ার স্ত্রী বলবে- আমি ছিলাম নামাযী, রোযাদার, সুখ-দূঃখের সঙ্গিনী ও  খেদমতগার। আমিই বেশী উত্তম।  এভাবে তাঁরা স্বামীকে নিয়ে বড়াই করবে। আল্লাহ্পাক নেক্কার বান্দাদের জন্য জান্নাতের অনন্ত সুখের ব্যবস্থা করবেন- দুনিয়ার সামান্য ইবাদতের  বিনিময়ে। এটাই হবে বড় সফলতা।

(১) বেহেস্তের হুর তিন জিনিস দ্বারা সৃষ্ট
ان  رسول اللّٰہ ﷺ سئل عن الحور العین من ای شئی خلقن؟ فقال :  من ثلاثۃ اشیاء اسفلھن من المسک واوسطھن من العنبر واعلا ھن من الکافور ۔ وشعورھن وحواجبھن سواد سوداء خط من نور ۔ رواہ الترمذی۔

অর্থঃ  রাসুলে মকবুল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে আরয করা হলো- বেহেস্তের হুর কিসের তৈরী? হুযুর (ﷺ) জবাব  দিলেন “তিন বস্তু দ্বারা হুর সৃষ্টি- (১) নিম্মাংশ মিশ্ক -এর তৈরী (২) মধ্যভাগ আম্বরের তৈরী (৩) উপরিভাগ কাপুর জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী। তাঁদের চুল ও ভ্রু হবে কালো এবং   নূরের রেখা সমৃদ্ধ” (তিরমিযি শরীফ)।

(২) জান্নাতী পুরুষ হবে একই বয়সের যুবক-  কিন্তু হুরের বয়স হবে পুরুষের ইচ্ছানুযায়ী
ذکر ابن الادمیات فی الجنۃ علی سن واحد واحد واما الحور العین۔  فاصناف مصفۃ صغار وکبار علی ما اشتھت النفس اھل الجنہ۔
অর্থঃ বর্ণিত আছে- জান্নাতে পুরুষগণ হবে সমবয়সী যুবক। কিন্তু ডাগর চোখের হুরগণ হবে বিভিন্ন বয়সের। ছোট, বড়- জান্নাতী পুরুষদের মনের ইচ্ছামত”। (আত্ তাযকিরাহ্ ৫৪৬ পৃষ্ঠা)।

(৩) হুরদের পাত্লা গড়ন হবে এবং হাঁড়ের ভিতরের মগজ দেখা যাবে
عن عبد اللّہ بن مسعود عن النبی ﷺ قال ان المرأۃ من اھل الجنۃ لیری بیاض ساقیھا من وراء سبعین حلۃ حتی  یری مخھا۔ وذلک بان اللّہ تعالی یقول کانھن الیاقون والمرجان۔ والیاقوت حجر لو ادخلت فیہ سلکا ثم  استصفیتہ لرأیتہ۔ رواہ الترمذی۔

অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে  বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “বেহেস্তীদের স্ত্রীগণের  দু’পায়ের গোড়ালীর হাঁড় সত্তরটি পোষাকের ভিতর দিয়ে দেখা যাবে। এমনকি- হাঁড়ের ভিতরের মগজও দেখা যাবে। এ জন্য  আল্লাহ্পাক ইরশাদ  করেছেন- “হুর বালাগণকে  মনে হবে- যেন ইয়াকুত ও মারজান পাথর”। ইয়াকুত এমন পাথর- যদি তুমি তার ভিতরে একটি শলাকা ঢুকিয়ে তাঁর  স্বচ্ছতা পরীক্ষা করতে চাও- তাহলে ঐ  শলাকা পরিষ্কার দেখতে পাবে”। (তদ্রূপ  হুরদের মগজের মধ্যেও শলাকা ঢুকিয়ে দেখতে পারো”)। (তিরমিযি)।

(৪)  হুরদের  এক চাহনীতে জান্নাত ও দুনিয়ার মধ্যবর্তীস্থান আলোকিত হয়ে যাবে
عن انس بن مالک  رضی  اللّہ عنہ عن النبی ﷺ لو ان امراۃ من اھل الجنۃ اطلعت الی  اھل الارض لا ضاء ت ما بینھما ولملاتہ ۔ ریھا۔ ولنصیفھا۔ علی رأسھا کیر من الدنیا وما فیھا۔ روی عن البخاری ۔ موقوفا۔

অর্থঃ হযরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা  করেছেন-    আল্লাহর প্রিয় রাসুল (ﷺ) এরশাদ করেছেন- “জান্নাতী লোকদের একজন স্ত্রী  যদি জান্নাত  থেকে  দুনিয়াবাসীদের দিকে একটু ঝুঁকে তাকায়- তাহলে  তাঁর সৌন্দর্যের ছটায়  জান্নাত হতে দুনিয়া পর্য্যন্ত মধ্যবর্তীস্থান আলোকিত হয়ে যাবে এবং তাতে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়বে। একজন হুরের মাথার ওড়না দুনিয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু হতে উত্তম হবে”। (ইমাম বুখারী হতে মওকুফ হাদীস হিসাবে বর্ণিত)।

(৫) জান্নাতী হুরগণ হবেন নতুন কুমারী

আল্লাহ্পাক ইরশাদ করেন-
فِيهِنَّ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَانٌّ
অর্থঃ  “জান্নাতের রমণীগণ হবে আনত-নয়না হুর। তাঁদেরকে এর পূর্বে কোন ইনসান বা  জ্বীন স্পর্শ করেনি”। (আর রহমান- ৫৬)

(৬) হুরগণ হবেন সতী-সাধ্বী নারী ও অনিন্দ্য সুন্দরী

আল্লাহ্পাক বলেন-
فِيهِنَّ خَيْرَاتٌ حِسَانٌ
অর্থাৎঃ “তথায় থাকবে সতী-সাধ্বী ও অনিন্দ্য সুন্দরী হুর রমনী”। (সূরা আর রহমান ৭০ আয়াত)।

(৭) হুরগণ থাকবেন তাঁবুতে অবস্থানকারিনী

আল্লাহ্ বলেন-
حُورٌ مَّقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ
অর্থাৎঃ “হুরগণ  থাকবেন তাঁবুতে অবস্থানকারিণী” (সুরা আর রহমান- ৭২ আয়াত)।

(৮) হুরগণ চির কুমারী, কামিনী ও সমবয়স্কা হবে
إِنَّا أَنشَأْنَاهُنَّ إِنشَاءً - فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا - عُرُبًا أَتْرَابًا
অর্থঃ “আমি তাঁদেরকে উত্তমরূপে এবং বিশেষরূপে সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করেছি। তাঁদেরকে বানিয়েছি চিরকুমারী। তাঁরা হবে সমবয়সী ভরাযৌবনা”। (সুরা ওয়াকিয়াহ্ ৩৫-৩৭ আয়াত)

টিকাঃ

(ক) হুরগণ বিশেষ প্রক্রিয়ায়  সৃষ্টি হয়েছে। দুনিয়ার মহিলাগণ ষোড়শী ও যুবতী এবং সুশ্রী, সুন্দরী ও  লাবন্যময়ী হবে। হযরত আনাছ (রাঃ) উক্ত রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন- মা আয়েশা সিদ্দিকার মাধ্যমে।

(খ) باکرۃ অর্থ- চিরকুমারী। জান্নাতী স্ত্রীগণ শতকোটি মিলনের পরেও চিরকুমারীর মতই থাকবে।

(গ) عربا অর্থ-স্বামী সোহাগিণী ও কামিনী নারী।

(ঘ) اترابا অর্থ- সমবয়সী ভরাযৌবনা। স্বামীরা হবেন পূর্ণ যুবক ৩০/৩৩ বৎসর বয়ষ্ক। (হাদীস)

(৯) দুনিয়ার স্ত্রী  ও জান্নাতী হুরদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানঃ হুরদের অহঙ্কার।
عن  علی رضی اللّٰہ عنہ قال قال  رسول اللّٰہ ﷺ فی الجنۃ لمجتمعا للحور العین۔ یرتفعن باصوات لم تسع الخلائن بمثلا، قال یقلن نحن الخالات فلا نبیذ ونحن الناعمات فلا  نبأس ۔ ونحن الراضیات فلا نسخط۔ طوبی لمن کان لنا وکنا لہ ۔

অর্থঃ হযরত আলী (রাঃ) বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “জান্নাতের মধ্যে ডাগর চোখ বিশিষ্ট হুরদের মিলনমেলা বসবে। তাঁরা এত উচ্চ আওয়াজ করবে- যা  সৃষ্টির কেউ শুনেনি। হুযুর (ﷺ) বলেন- “তাঁরা উচ্চ আওয়াজে বলতে থাকবে-  “আমরা জান্নাতে এমন চিরস্থায়ী যে- নষ্ট হবো না। আমরা এমন নেয়ামত প্রাপ্তা যে- তা কখনও পুরাতন এবং নষ্ট  হবেনা। আমরা স্বামীদের  প্রতি এমন  রাযী যে- কোনদিন গোস্বা হবোনা। আমরা যাদের জন্য এবং যারা  আমাদের জন্য- সবারই ভাগ্য সুপ্রসন্নœ” (তিরমিযি শরীফ)।

(১০) দুনিয়ার স্ত্রীদের জবাব
قالت عائشۃ رضی اللّٰہ عھا ان الحور العین اذا قلن ھذہ المقالۃ ۔ اجابھن ۔ المؤمنات من اھل الدنیا ۔ نحن المصلیات وما صلیتن  ۔ ونحن الصائمات ۔ وما صمتن ،ونحن المتوضات وما توضائن ونحن المتصدقات وما تصدقتن ۔ قالت عائشۃ فلغبنھن۔

অর্থঃ হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন- “জান্নাতী হুরেরা যখন ঐসব বড়াই করবে- তার জবাবে দুনিয়ার মুমিন স্ত্রীগণ বলবে-“আমরা ছিলাম নামাযী- তোমরা নামাযী নও। আমরা ছিলাম রোযাদার- তোমরা তো রোযা  রাখনি। আমরা ছিলাম ওযু সম্পাদনকারিনী- তোমরা তো  তা  ছিলেনা। আমরা ছিলাম  সাদ্কাকারিনী- তোমরা তো  তা ছিলেনা”। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন- দুনিয়ার মহিলারাই এই বিতর্কে জিতে যাবে”। (আত্ ত্াযকিরাহ্)।

ব্যাখ্যাঃ বুঝা গেলো- হুরেরা  হলো ভোগের, আর দুনিয়ার স্ত্রীরা হলো ত্যাগের। হুরেরা আমল শুন্য- আর মোমেন  নারীরা হবে আমলে পূন্য। শুন্যের উপর পূন্যের প্রাধান্য সর্বজন স্বীকৃত। কাজেই দুনিয়ার স্ত্রীর সম্মান হবে বেশী। ইহাই হাদীসের মূল কথা। আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে জান্নাতে দুনিয়ার পূন্যবতী স্ত্রী নসীব করেন। আমীন!

বিঃ দ্রঃ ঐসব  মা বোনদের জন্য সুসংবাদ- যারা দুনিয়াতে নামায রোযা, অযু গোসল, পাক পবিত্রতা ও সাদ্কা খয়রাতে ত্রুটি করেন না। তাঁরাই হবেন সেরা ও মর্যাদার অধিকারিনী। তাঁদের মূল্য জান্নাতী হুরের চেয়েও অধিক।

(১১) হুরের মিষ্টি থুথু
قال ابن عباس ان فی لجنۃ حوراء یقال لھا لعب ۔ لو بزقت فی البحر لعذب ماء البحر کلہ۔ مکتوب علی نحرھا من احب ال یکون لہ مثل فلیعمل  بطاعۃ ربی عزوجل ۔

অর্থঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- “বেহেস্তের মধ্যে এক প্রকার হুর  আছে-  তাঁদের বলা হয় “লোয়াব”। তাঁরা যদি দুনিয়ার সাগরে মুখের থুথু বা লোয়াব নিক্ষেপ  করতো- তাহলে  সাগরের সব জলরাশি মিষ্টি হয়ে যেতো। তাঁদের বুকে লিখা থাকবে- “যারা আমার মত হুর পেতে পছন্দ করে, তাঁরা যেন আমার প্রভূর আনুগত্যের আমল করেন”।  (আত্ তাযকিরাহ্ পৃষ্ঠা ৫১৮-৫১৯)।

(১২) শবে মি’রাজে দেখা হুরের বর্ণনা
روی عن النبی ﷺ انہ وصف حوراء لیلۃ الاسراء فقال : ولقد رایت جبینھا کا الھلال ۔ فی طول البدر منھا الف وثلاثون ذکرعا۔ فی رأسھا ماءۃ صفیرۃ  ما بین الصفیرۃ والصفیرۃ سبعون سبعون الف ذؤابۃ اضؤا من البدر مکلل بالدر وصفوف الجواھر  ۔ علی جبینھا سطران مکتوبان بالدر والجوھر۔ فی السطر الاول بسم اللّٰہ الرحمٰن الرحیم۔ وفی السطر الثانی ۔ من اراد مثلی فلیعمل یطاعۃ ربی فقال جبرئیل ۔ یا محمد ھذہ وامثالھا لا متک فابشر یامحمد وبشر امتک و امرھم بالاجتھاد۔

অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে- তিনি শবে মি’রাজে দেখা হুরদের বর্ণনা দিতে  গিয়ে ইরশাদ করেছেন- “আমি ঐ হুরদের মুখমন্ডলে পূনির্মার চাঁদে একহাজার  ত্রিশগজ দৈর্ঘ নূতন চাঁদের মত বাঁকা ও লম্বা মুখমন্ডল দেখতে  পেলাম। তাঁদের মাথায় রয়েছে চুলের একশত গুচ্ছ। এক গুচ্ছ হতে অন্য গুচ্ছ পর্য্যন্ত এক  হাজার খোঁপা রয়েছে। আর ঐ খোঁপাগুলো পূর্নিমার চাঁদের চেয়েও বেশী উজ্জ্বল। মনিমুক্তার সুতা দিয়ে ঐগুলি মোড়ানো। সিঁথি হবে মুক্তার। তাঁদের  কপালে মনিমুক্তার দুটি লাইন লিখিত আছে। এক  লাইনে  লিখা আছে- “বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। ” দ্বিতীয় লাইনে লেখা আছে- “যারা আমার মত হুর পেতে চায়, তাঁরা যেন আমার প্রতিপালকের ইবাদত করে”।  অতঃপর  জিবরাঈল আমাকে বল্লেন- হে প্রিয় মুহাম্মদ! এই রমণী ও অনুরূপ আরো রমনী আপনার উম্মতের জন্য প্রস্তুত। হে প্রিয় মুহাম্মদ!  আপনি নিজে এই সুসংবাদ গ্রহন করুন  এবং আপনার উম্মতকে সুসংবাদ দিন- যেন তাঁরা তা পাওয়ার  জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করে”। (আত্ তাযকিরাহ্ ৫১৯)।

ব্যাখ্যাঃ   হুর লাভ করা মর্যাদার ব্যাপার। মর্যাদা পাওয়ার বিনিময় হলো ইবাদত ও আমল।  কিন্তু জান্নাতে প্রবেশের শর্ত হলো ঈমান।  সুতরাং ঈমান হলো- প্রবেশপত্র এবং আমল হলো মর্যদার পূর্বশর্ত।

(১৩) হুরগণ যদিও সুন্দরী, কিন্তু দুনিয়ার স্ত্রীগণ হবে আমলের কারণে শ্রেষ্ঠ
قال عبد اللّٰہ بن المبارک عن  عبد اللّٰہ بن مسعود رضی اللّٰہ عنہ انہ قال: ان المراۃ  من الحور العین لیری مخ ساقیھا  من وراء اللحم والعظم ومن تحت سبعین حلۃ کما یری الشراب  الاحمر فی الزجاجہ البیضاء وقال عن حبان بن ابی حبلۃ قال ؛ ان نسأ الدنیا من دخل منھن الجنۃ فضلن علی العین بما عمل فی الدنیا۔ وروی مرفوعا ان الامھیات افضل من الحور العین بسبعین الف ضغت (التذکرۃ صفح ۵۱۹)

অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রঃ) (হানাফী মোহাদ্দেস)  হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) -এর সনদে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন- “জান্নাতী ডাগরচোখ বিশিষ্ট হুরগণের পায়ের গোঁড়ালীর মগজ, তাঁদের মাংস ও হাড্ডি এবং সত্তরটি পোষাকের ভিতর দিয়েও দেখা যাবে- যেমন দেখা যায় সাদা কাঁচপাত্রের ভিতরের লাল শরাব”। আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (রহঃ) হিব্বান ইবনে আবু জাবালা সূত্রে আর একটি হাদীস বর্ণনা  করেছেন। হিব্বান বলেন- “দুনিয়ার যেসব মহিলা জান্নাতবাসিনী হবেন- তাঁরা নেক আমলের কারণে হুরদের চেয়ে বেশী মর্যাদাবতী হবেন”। অন্য একটি   মারফু হাদীসে এসেছে- “দুনিয়ার নারীগণ হুরদের চেয়ে সত্তর হাজার গুন বেশী  উত্তম হবে”। (আত্  তাযকিরাহ্ ৫১৯ পৃষ্ঠা)।

(১৪) দুনিয়ার অতি সামান্য সদ্কা হবে হুরদের  মোহর
عن ابی ھریرۃ  رضی اللّٰہ  عنہ ان رسول اللّٰہ ﷺ قال مھور العین قبضات  التمر وفلق الخبز ۔ ذکرہ الثعلبی ۔ وقال ابو ھریرۃ ۔ رضی اللّٰہ عنہ یتزوج  احدکم فلانۃ بنت فلان بالمال الکثیر ویدع الحور العین ۔ باللقمۃ والتمر والکسوۃ ۔

অর্থঃ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “ডাগরচোখ বিশিষ্ট হুরদের মোহরানা হলো দুনিয়াতে কয়েকটি খুরমা ও কয়েক টুকরা রুটি সদ্কা করা”। (ছা’লাবীর বর্ণনা)।

হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) নিজ ভাষ্যে (মাওকুফ) বলেছেন- “তোমাদের যেকোন লোক অনেক অর্থ খরচ করে অমুকের মেয়ে অমুককে বিবাহ  করো। কিন্তু কয়েকটি লোকমা, কিছু খুরমা ও সাধারন পরিধানবস্ত্র দান  করে তোমরা ডাগর  চোখের অধিকারীনী হুরদেরকে বিবাহ করছো না”। (আত্ তাযকিরাহ্ ৫২০ পৃষ্ঠা)।

ব্যাখ্যাঃ জান্নাতী হুরদের সাথে পুরুষদের বিবাহ হবে জান্নাতে। কিন্তু  মোহরানা আদায় করে যেতে হবে দুনিয়াতে। ফকির মিসকিনকে কয়েক টুক্রা রুটি  ও কয়েকটি খুরমা দান করলে হুরদের মোহরানা আদায় হয়ে যায়। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন- তোমরা অনেক টাকা পয়সা খরচ করে দুনিয়ার মহিলাদেরকে বিবাহ করছো- কিন্তু সামান্য কিছু দান  সদ্কা করে এবং ফকির মিসকিনকে কয়েক লোকমা ভাত, রুটি, খুরমা বা সাধারণ পরিধান বস্ত্র দান করে জান্নাতী হুর লাভ করছো না- এটা বড়ই আফসোসের কথা। বুঝা গেল- দুনিয়াতে যারা সামান্য দান সদ্কা করে- তাঁরা জান্নাতী  হুর বিবাহ করতে  পারবে এবং তাঁদের মোহরানা অগ্রীম আদায় হয়ে যাবে।

এই হাদীসখানা নীতিমালা স্বরূপ। পূর্ব অধ্যায়ে ৭২ জন হুরবালা পাওয়ার যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং দুনিয়ার আমলের বিনিময়ে তা পাওয়া  যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে- তাঁর  অর্থ এখন পূর্ণভাবে বুঝা গেল। নামায রোযার সাথে ফকির মিসকিন,  অনাথ গরীব, ও দুস্থ মানবসেবা হলো মূল মোহরানা  বা বিনিময়। আরো বুঝা গেল- যারা আল্লাহর হক্বের সাথে বান্দার হক্ব আদায় করবে- তাঁরাই হুর  পাবে। খুশী মনে জান্নাতী স্ত্রী লাভের আশায় দান সদ্কা করতে হবে। ইহাই হাদীসের মুখ্য বিষয়।

(১৫) জান্নাতে কেউ সন্তান নিবেনা
عن النبی ﷺ  اذا اشتھی المؤمن الولد فی الجنۃ کان فی ساعۃ کما یشتھی ولکن لا یشتھی ھذا ابدا۔ وفی حدیث الترمذی عن  ابی سعید الخدری رضی اللّٰہ عنہ قال  رسول  اللّٰہ ﷺ المومن اذا اشتھی الولد فی الجنۃ کان حملہ ووضعہ ۔ وسنہ فی ساعۃ کما یشتھی ۔ (التذکرۃ صفح ۵۲۵)

অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “কোন জান্নাতী মোমেন পুরুষ যদি চায়- তাহলে চাওয়া মাত্র এক মুহুর্তেই সন্তান পয়দা হবে। কিন্তু  সে কখনও তা চাইবেনা। ” তিরমিযি শরীফে হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে নবী  করীম (ﷺ)   এরশাদ করেছেন-“মোমেন পুরুষ যখনই জান্নাতে সন্তান কামনা করবে, তখনই  এক মূহুর্তে গর্ভধারণ,  ভূমিষ্ট ও পূর্ণবয়স্ক সন্তান পেয়ে যাবে”। (যদি ইচ্ছা করে) আত্ তাযকিরাহ্ ৫২৫ পৃষ্ঠা।

ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্পাক বলেছেন- “জান্নাতে যা চাইবে- তাই পাবে”। হাদীসেও তাই বলা হয়েছে। কিন্তু নবীজী জানেন যে, কোন জান্নাতী পুরুষই তা কামনা করবে না।  এই গায়েবী সংবাদ নবীজীই প্রচার করেছেন। গায়েবী বিষয়সমূহ ব্যাপকহারে আল্লাহ্পাক নবীজীকে দান করেছেন  বলে কোরআন মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে- وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُن تَعْلَمُ আয়াতের মাধ্যমে। তাফসীরে জালালাঈন উক্ত   আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন-“আল্লাহ্পাক  নবীজীকে গায়েবী এলেম ব্যাপকহারে শিক্ষা  দিয়েছেন” (من الاحکام  والغیب)

তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে-
صار علمہ علیہ السلام محیطا  لجمیع المغیبات الملکوتیۃ۔
অর্থাৎঃ “উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয় নবীজীর ইলেমের আওতাভুক্ত রয়েছে”। (ছুরা নাজম) নবীজীর খোদাপ্রদত্ত ইলমে গায়েব অমান্যকারী ষ্পষ্ট গোম্রাহ্ ও পথভ্রষ্ট-  এতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁরা হিংসুক ও পরশ্রীকাতর। লওহে মাহফুযে সংরক্ষিত ইলম নবীজীর ইল্মের তুলনায় অতি সামান্য। কাসিদা বুরদা শরীফে আছে-
ومن علومه علم اللوح والقلم
অর্থাৎ- লওহ- কলমের ইলেম নবীজীর  এলেমের সামান্য অংশ মাত্র।

লওহে মাহ্ফুজ, জান্নাত, জাহান্নাম সম্পর্কে হুযুরের ইল্মের নামই ইল্মে  গায়ব, এটা শতসিদ্ধ  কথা। ওহাবীরা বড়ই হতভাগা।  ওহাবী নেতা ইসমাঈল দেহলভী তার ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ পুস্তকে লিখেছে- “যার   নাম মোহাম্মদ (ﷺ)- সে দেওয়ালের অপরদিকের খবরও জানেনা”। এজন্যই সে কাফের বলে ঘোষিত হয়েছে ১৩২৩ হিজরীতে। (হোস্সামুল হারামাঈন)।

(১৬) জান্নাতে দুনিয়ার  স্ত্রীদের সাথে মিলন হবে কিনা?
عن عبد اللّٰہ بن عباس رضی اللّٰہ عنھما قال قلنا یار سول اللّٰہ ﷺ انفضی الی نسائنا فی الجنۃ کما نفضی الیھن فی  الدنیا؟ قال : ای والذی نفسی بیدہ ان الرجل لیفضی فی  الغداۃ الواحدۃ  الی مأۃ عذراء۔ ذکرہ المخرمی کذا فی التذکرۃ ۔ صفح ۵۲۴

অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু  আনহুমা বলেন- আমরা আরয  করলাম-  ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমরা দুনিয়াতে যেভাবে স্ত্রীমিলন করি ও বীর্য নিক্ষেপ করি- অনুরূপভাবে কি জান্নাতে তাঁদের সাথে- বীর্যপাত  ঘটাতে   পারবো? হুযুর  (ﷺ) ইরশাদ করলেন- হাঁ, যে সত্বার হাতে আমার প্রাণ- তাঁর শপথ করে বলছি- একজন ব্যক্তি একই দিনে  একশত কুমারীর সাথে মিলন ঘটাতে পারবে”। (মুখরামী সূত্রে আত্ তাযকিরাহ্ ৫২৪ পৃষ্ঠা)।

(১৭) জান্নাতীদের ভুরিভোজ এক নিমিষে হজম হয়ে যাবে
عن زید بن ارقم رضی اللّٰہ عنہ قال : قال رسول اللّٰہ ﷺ ان الرجل من اھل الجنۃ لیعطی قوۃ ماءۃ رجل فی الاکل والشراب والجماع والشھوۃ ۔ فقال رجل من الیھود ۔ ان الذی یاکل ویشرب یکون منہ الحاجۃ ۔ قال ثم یفیض من  جدلہ عرق۔ فاذا بنطہ قد ضمر ۔ رواہ الدارمی فی سندہ ۔

অর্থঃ হযরত  যায়েদ ইবনে আরকাম  কোরায়শী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া  সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “জান্নাতী  পুরুষলোককে  পানাহার ও যৌনশক্তির ক্ষেত্রে একশত পুরুষের শক্তি দান করা হবে। একজন ইয়াহুদী প্রশ্ন করলো- যেব্যক্তি খাওয়া দাওয়া ও পানাহার করে- তার তো প্রস্রাব পায়খানার প্রয়োজন হয়? নবী  করীম (ﷺ) ইরশাদ করলেন- পানাহারের পর সাথে সাথে তার চামড়ার লোমকুপ দিয়ে এক প্রকার ঘাম বের হবে। তখন সব হজম হয়ে যাবে”  (দারামী শরীফ)। (এই জানার নামই ইলমে গায়েব) এটা জিবরাইলের মাধ্যমে নয়।

(১৮) কোন মহিলার একাধিক স্বামী থাকলে জান্নাতে কার সাথী হবে?
ذکر ابو بکر العربی فی احکام القرآن لہ
فان کانت المراۃ ذات ازواج فقیل ان من مات عنھا من الازواج اخراھن لہ قال حذیفۃ لامرتہ ان سرک ان تکون ام الدرداء فأبت وقالت وقالت : سمعت ابا الدرداء یحدث رسول اللّٰہ ﷺ انہ قال المراۃ لاخر ازواجھا فی الجنۃ ۔ وقال لی ان اردت ان تکونی زوجتی فی الجنۃ فلا تزوجی من بعدی۔

অর্থঃ  আবু বকর ইবনে আরাবী তাঁর “আহ্কামুল কোরআন” তাফসীরে উল্লেখ করেছেন- যে মহিলার কয়েক  বিবাহ হয়, সে শেষ স্বামীর সাথে জান্নাতে যাবে- যদি তাঁরা উভয়ে জান্নাতী হয়। হযরত হোযায়ফা ইবনুল ইয়ামন  (রাঃ) তাঁর  স্ত্রীকে  লক্ষ্য করে বলেছিলেন-  “যদি তোমার মনে চায় যে, জান্নাতে আমার স্ত্রী হবে- যদি আল্লাহ্ আমাদের উভয়কে জান্নাত দান করেন- তাহলে  আমার পরে অন্য স্বামী গ্রহণ করোনা। কেননা, দুনিয়ার  শেষ স্বামীর সাথেই স্ত্রী জান্নাতে যাবে”।

হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হযরত উম্মে দারদাহ্ (রাঃ) কে বিবাহের প্রস্তাব দিলে উম্মে দারদাহ্ (রাঃ) অস্বীকৃতি জানিয়ে বল্লেন- “আমি আমার শহীদ স্বামী হযরত আবু দারদাহ্ (রাঃ) -এর  মুখে রাসুলুল্লাহ্র একটি হাদীস শুনেছি যে, নারীরা  শেষ স্বামীর সাথেই জান্নাতে থাকবে। আমার স্বামী আমাকে ওসিয়ত করে বলেছেন- যদি তুমি  পছন্দ কর  যে, জান্নাতে আমার সাথে থাকবে, তাহলে আমার পরে কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না”। (আত্ তাযকিরাহ্ ৫২৫ পৃষ্ঠা)।

নোটঃ হযরত হোযায়ফা (রাঃ) এবং আবু দারদা ছিলেন জান্নাতী। তাই ওই অসিয়ত করেছিলেন। এতে বুঝা গেল-  জোর করে বিধবাকে বিবাহ দিবে না। কিন্তু সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল  দেহ্লভী জোর করে সীমান্ত প্রদেশের বিধবাদেরকে  বিবাহ দিতেন এবং এটাকে বলেছেন “সংস্কার” বা মুজাদ্দেদ -এর কাজ। (নাউযুবিল্লাহ)! এটাই ছিল তাদের পতনের মূল কারণ।

(১৯) কোন মহিলার  দুই স্বামী জান্নাতী হলে উত্তম স্বভাবের স্বামীর সাথে থাকবে
عن انس بن مالک رضی اللّٰہ عنہ ان ام حبیبۃ زوج النبی ﷺ قالت ؛ یا رسول اللّٰہ المراۃ یکون لھا زوجان فی الدنیا ثم یموتون یجتمعون فی الجنۃ  لا یھما تکون  الاول او الاخر؟ ۔ قال لاحسنھما خلقا کان معھا یا ام حبیبۃ ۔

অর্থঃ হযরত  আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন- নবীপত্নী হযরত  উম্মে হাবিবা (রাঃ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার খেদমতে আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ্! কোন মহিলা যদি দুনিয়াতে দুই স্বামীর ঘর সংসার করে থাকে এবং উভয় স্বামী জান্নাতী হলে স্ত্রী কোন্ স্বামীর  সহগামিনী হবে- প্রথম জনের- নাকি দ্বিতীয় জনের? হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন- “যে স্বামী তাঁর সাথে বেশী  সৎ ব্যবহার করতো- তাঁর সাথে থাকবে হে উম্মে হাবীবা”! (আত্ তাযকিরাহ্ ৫২৫ পৃষ্ঠা)।

আস্ সালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ্ (ﷺ)।

 
Top