ফি*লি*স্তিন (বিশেষত বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-আকসা মসজিদ) সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে, যেগুলো ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ও ফজিলতবিষয়ক। নিচে কিছু হাদিস ও ইসলামি ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো:
🕌 ১. ফি*লি*স্তিনের আল-আকসা মসজিদের ফজিলত
“তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো মসজিদে সফর করা বৈধ নয়: মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববী) এবং মসজিদুল আকসা।”
📚 (বুখারি: ১১৮৯, মুসলিম: ১৩৯৭)
“ মন্তব্য: মসজিদুল আকসা ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। নবী (ﷺ) মিরাজে যাওয়ার সময় এই মসজিদেই ইমামতি করেছেন। এটি মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। মুসলিমদের কাছে এ স্থান বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ও সম্মানিত।
হাদিস (বুখারী: ১১৮৯): হাদিস: আল-আকসা মসজিদের ফজিলত
"لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ..."
❏ ১. শরহ: ইমাম ইবনু হাজার (فتح الباري)
“এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর শুধুমাত্র এই তিনটি মসজিদের জন্য অনুমোদিত।
এর মানে হল আল-আকসা মসজিদের একটি বিশেষ মর্যাদা আছে, এবং তা মুসলমানদের ঐতিহ্য ও আখেরি যুগের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবেও গণ্য।”
📘 রেফারেন্স: ফাতহুল বারী, খণ্ড ৩, হাদিস ১১৮৯
❏ ২. আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান (رحمة الله) এর ব্যাখ্যা:
❏ গ্রন্থ: “আল-‘আমন ওল উলা লি নাঈতিল মুস্তাফা”
এ গ্রন্থে তিনি ফি*লি*স্তিন বা আল-আকসার ফজিলত এবং মিরাজের রাতের ব্যাখ্যায় বলেন:
"الْمَسْجِدُ الأَقْصَى هُوَ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ، وَهُوَ ثَالِثُ الْمَسَاجِدِ، وَالسَّفَرُ إِلَيْهِ لِلطَّاعَةِ سُنَّةٌ."
🔸 অনুবাদ: “আল-আকসা মসজিদ বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত। এটি তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ। এর উদ্দেশ্যে ইবাদতের নিয়তে সফর করা সুন্নত।”
📚 রেফারেন্স: ফাতাওয়া রিজভিয়া, খণ্ড ২৯, পৃষ্ঠা ৪৪৫ (নূরী মুদ্রণ)
⟶ মন্তব্য: তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, আল-আকসা সফর করা শুধু বৈধ নয়, বরং সুন্নত। এটি মুসলমানদের আকীদাগত ভালোবাসার প্রতীক।
❏ গ্রন্থ: হাদিয়া শাহজাহানপুর (تسکین الخواطر)
এই কিতাবে তিনি উল্লেখ করেন—
“শেষ যুগে যখন দাজ্জাল আসবে, তখন ঈসা (عليه السلام) শাম বা ফি*লি*স্তিন অঞ্চলে অবতরণ করবেন। সুতরাং শাম তথা ফি*লি*স্তিন ভূমি বরকতময় ও ফিতনা-মুক্ত এক ঘাঁটি হবে।”
📚 হাদিয়া শাহজাহানপুর, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭
❏ ৩. হাকিমুল উম্মাহ মুফতি ইয়ার খান নঈমী (رحمة الله) এর ব্যাখ্যা:
❏ গ্রন্থ: নূরুল ইরফান (তাফসির)
🔖 সূরা ইসরা (আয়াত ১) -
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ... إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى
🔹 তাফসির (মুফতি ইয়ার খান):
“আল-আকসা মসজিদ ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা এবং বরকতপূর্ণ ভূমি। এর ফজিলত এতই বেশি যে নবী (ﷺ)-কে মিরাজের সফরে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। কিয়ামতের আগ মুহূর্তে এটি আবার মুসলমানদের তাওহিদের কেন্দ্রে পরিণত হবে।”
📚 নূরুল ইরফান, সূরা ইসরা ব্যাখ্যা অংশ
❏ হাদিস শরাহ: মিরআত শরহে মিশকাত
(মুফতি ইয়ার খান নঈমী এই বিশাল হাদিস শরাহগ্রন্থে দাজ্জাল, ঈসা (عليه السلام) ও শেষ যুগের যুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।)
হাদিস: “يقاتلكم اليهود...”
🔹 ব্যাখ্যা:
“এই যুদ্ধ হবে বিশেষভাবে ফি*লি*স্তিন বা শাম এলাকায়। দাজ্জালের পতন হবে এখানেই। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের হাতে ইহুদি শক্তিকে পরাজিত করবেন।”
📚 মিরআত, হাদিস ৫৩৫২ ব্যাখ্যা
২. শেষ যুগে ফি*লি*স্তিনে যুদ্ধ ও বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী
হাদিস:
“তোমরা অবশ্যই ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ করবে, এমনকি তোমরা তাদের হত্যা করবে। এমনকি কোনো ইহুদি যদি পাথর বা গাছের আড়ালে লুকায়, তখন সেই পাথর বা গাছ বলবে: ‘হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দা! আমার পেছনে একজন ইহুদি লুকিয়ে আছে, তাকে হত্যা কর।’ তবে গারকাদ গাছ এ কথা বলবে না, কারণ এটি ইহুদিদের গাছ।”
📚 (সহীহ মুসলিম: ২৯২২)
মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যকার যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী:
“কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত আসবে না যতক্ষণ না মুসলমানরা ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ করবে এবং মুসলমানরা তাদের হত্যা করবে...”
“...এমনকি পাথর ও গাছ বলবে: ‘হে মুসলমান! হে আল্লাহর বান্দা! আমার পেছনে একটি ইহুদি আছে—তাকে হত্যা কর।’ তবে গারকাদ গাছ তা বলবে না, কারণ তা ইহুদিদের গাছ।”
📚 সহীহ মুসলিম: ২৯২২, বুখারী: ২৯২৪
❏ ইহুদি-মুসলিম যুদ্ধ ও গারকাদ গাছ
মূল হাদিস (সহীহ মুসলিম: ২৯২২):
"لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقَاتِلَ الْمُسْلِمُونَ الْيَهُودَ، فَيَقْتُلُهُمُ الْمُسْلِمُونَ..."
“কিয়ামত আসবে না, যতক্ষণ না মুসলমানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে...”
❏ শরহ: ইমাম নববী (شرح مسلم)
ব্যাখ্যা:
“এটি কিয়ামতের একটি নিদর্শন। হাদিসটি স্পষ্টভাবে বোঝায় যে ভবিষ্যতে মুসলমানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে।
এখানে গারকাদ গাছের উল্লেখ একটি বাস্তব নিদর্শন—এটি ইহুদিদের বিশেষ রোপিত গাছ যা মুসলমানদের ধোঁকা দিতে গোপনীয়তা রক্ষা করবে।”
📘 রেফারেন্স: ইমাম নববী, “শরহ সহীহ মুসলিম”, খণ্ড ১৮, পৃষ্ঠা ৬৮
🔹 ব্যাখ্যা: এই হাদিসে এক ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে যেখানে মুসলমানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে, এবং এটা ফি*লি*স্তিনকে কেন্দ্র করেই হবে বলে বহু আলেম মনে করেন।
৩. শাম তথা ফি*লি*স্তিন ও সিরিয়া অঞ্চল হবে মুসলমানদের শক্ত ঘাঁটি
হাদিস:
“তুমি যদি শোনো যে শাম বা সিরিয়া অঞ্চলে যুদ্ধ হচ্ছে, তাহলে সেখানে থাকো। কারণ শাম হবে কিয়ামতের সময় মুসলমানদের সবচেয়ে নিরাপদ ও বরকতময় ঘাঁটি।”
📚 (আবু দাউদ: ২৪৮৩, তিরমিজি: ২১৯২)
“তোমরা শাম (সিরিয়া-ফি*লি*স্তিন অঞ্চল) বসবাস করো, কারণ তা আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় এলাকা।”
📚 তিরমিজি: ৩৯৩۰, হাকিম: সহীহ
৪. হাদিস: শাম ও ফি*লি*স্তিন অঞ্চলের বরকত
হাদিস (তিরমিজি: ৩৯৩০):
"عليك بالشام فإنها صفوة بلاد الله يسكنها خيرته من خلقه..."
শরহ: ইবনে হাজার হায়তামী, ইবনু কাসীর
❏ ইবনে কাসীর (তাফসির):
“শাম অঞ্চলে বরকত রয়েছে, আল্লাহ তা’আলা ঐ এলাকাকে বার বার নবী ও রাসূলদের আবাস করেছেন। দাজ্জালের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধও এখানেই হবে।”
📘 তাফসির ইবনে কাসীর, সূরা ইসরা, আয়াত ১
🔸 মন্তব্য: ‘শাম’ অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ফি*লি*স্তিনকে বোঝায়। নবী (ﷺ) শামকে বরকতময় বলেছেন। শেষ যুগে ইসলামি শক্তির কেন্দ্র হবে এই অঞ্চল।
৫. ঈসা (عليه السلام) এর আগমন ও দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
হাদিস:
“ঈসা (عليه السلام) দামেশকের পূর্ব দিকে একটি সাদা মিনারে নামবেন, দুই হাত দুই ফেরেশতার ডান ও বাম পাশে থাকবে...”
এরপর মুসলমানদের ইমাম মাহদির নেতৃত্বে ঈসা (عليه السلام) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।
📚 সহীহ মুসলিম: ২৯৩৭
দাজ্জালের পতন ও ঈসা (عليه السلام)-এর আগমন — লুদ নামক স্থানে
হাদিস (মুসলিম: ২৯৩৭):
“...فيقتل عيسى بن مريم الدجال بباب لُدّ الشرقي...”
❏ শরহ: ইমাম নববী (শরহ মুসলিম):
“লুদের গেট বলতে ফি*লি*স্তিনের এক শহর বোঝানো হয়েছে, যা আজকের ইসরায়েলে অবস্থিত। ঈসা (عليه السلام) দাজ্জালকে হত্যা করবেন এই শহরের উপকণ্ঠে।
এই হাদিস ভবিষ্যতের স্পষ্ট ঘটনাবলী নির্দেশ করে যা ফি*লি*স্তিন কেন্দ্রিক।”
📘 শরহ মুসলিম, খণ্ড ১৮, পৃষ্ঠা ৭১
🔸 মন্তব্য: অনেক হাদিসে দাজ্জালের অবস্থান ও মৃত্যু ফি*লি*স্তিনের “লুদ” নামক স্থানে হবে বলে উল্লেখ আছে (আজকের ইসরায়েলের মধ্যে)। এ অঞ্চল তখন মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধের ময়দান হবে।