প্রশ্ন: বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ট্রেন্ড চলছে—যেখানে মানুষ এআই (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ছবি তৈরি করছে এবং সেগুলো ইসলামী শায়খ, পীর বা সম্মানিত আলেমদের সঙ্গে পোস্ট করছে। কখনো কাঁধে মাথা রেখে বা ভিন্ন ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে এমন ছবি বানাচ্ছে। এমনকি অনেকে নিজেদের পুতুলসদৃশ ভার্সনও তৈরি করছে এবং তা প্রচার করছে। দু:খজনকভাবে, দাড়ি-টুপি পরা অনেক ইসলামী ভাইও অজ্ঞতার কারণে এতে অংশ নিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো— এভাবে এআই ব্যবহার করার শরয়ি হুকুম কী?


উত্তর: এআই (AI) দিয়ে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ডিজিটাল ছবি তৈরি করা মূলত নিজে থেকে নিষিদ্ধ নয়, কারণ এগুলো ডিজিটাল ইমেজ, যা অনেক আলেমের মতে আয়নায় দেখা প্রতিবিম্বের মতো— অর্থাৎ, এর উপর প্রচলিত ছবি (ফটোগ্রাফ) এর হুকুম প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া এতে সাধারণত প্রতারণার উপাদান থাকে না, কেননা এমন ছবিতে মুখমণ্ডলের কিছু পরিবর্তন থাকে এবং নিচে এআই (AI) এর লোগো থাকে— যা দেখেই বুঝা যায় এটি বাস্তব নয়, বরং এআই দ্বারা প্রস্তুতকৃত একটি ডিজিটাল ছবি।


তবে যদি কেউ এমনভাবে এআই ছবি তৈরি করে যাতে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়— যেমন, কাঁধে বা কোলে মাথা রেখে পোজ দেওয়া ইত্যাদি— অথবা এমন ছবি বানিয়ে সরল মানুষদের ধোঁকা দেয়, তাহলে এই ধরনের ব্যবহার শরিয়তে অনুমোদিত নয়; বরং নিষিদ্ধ (حرام)।


সহীহ বুখারী-তে হযরত আসমা (حسبي الله عنها ) হতে বর্ণিত আছে—

একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার এক সতীন আছে; যদি আমি এমন কিছু দেখাই বা দাবি করি যা আমার স্বামী আসলে আমাকে দেয়নি— তাহলে কি তাতে গুনাহ হবে?”


রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “যে ব্যক্তি এমন কিছু দেখায় যা তার নেই, সে এমন—যেন সে দুটি মিথ্যার পোশাক পরেছে।” -(সহীহ বুখারী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৫, দার তাওক আল-নাজাহ)


অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে এমন গুণ বা অবস্থা প্রদর্শন করে যা আসলে তার নেই, সে মূলত একজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারক।


আল্লামা আব্দুর রউফ মুনাভী رحمه الله এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন—

“যেমন কেউ একটি জামা পরে তার হাতায় আরও দুটি হাতা জুড়ে দেয়, যেন মানুষ মনে করে সে দুটি জামা পরেছে—আসলে সে মিথ্যাবাদী ও প্রতারণাকারী।” -(ফয়যুল ক্বাদীর, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৭৫, আল-মাকতাবাতুত তিজারিয়্যাহ আল-কুবরা, মিশর)


ইমাম আহমদ রাযা খান رحمه الله কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— পুরুষের জন্য দাড়ি, গোঁফ বা মাথার চুল কালো রঙে রাঙানোর হুকুম কী?


তিনি উত্তরে বলেন— 'কালো খিযাব হারাম। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

‘যে ব্যক্তি এমন কিছু দেখায় যা তাকে দেয়া হয়নি, সে এমন যেন দুটি মিথ্যার কাপড় পরেছে।' -(ফাতাওয়া রযবিয়্যাহ, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা ৪৯৩, রাযা ফাউন্ডেশন, লাহোর)


মাকতাবাতুল মদীনা প্রকাশিত “টি.ভি ও মুভি” নামক রিসালায় দারুল ইফতা আহলে সুন্নতের একটি বিশদ ফতোয়ায় বলা হয়েছে—


টেলিভিশন ও ভিডিওর বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ এটিকে সাধারণ ছবির (তসবি’র) মতো গণ্য করে হারাম বলেছেন, আবার কেউ বলেছে— এটি আয়নায় প্রতিবিম্বের মতো, তাই অনুমোদিত।


যদি এটি সত্যিই “ছবি” প্রমাণিত হয়, তবে হারাম হবে। কিন্তু যদি এটি শুধুমাত্র আলোকরশ্মির (Rays) প্রতিফলন প্রমাণিত হয়, তাহলে বৈধ বিষয়ে ব্যবহৃত ভিডিও বা ছবি অনুমোদিত হবে। ইমাম আহমদ রাযা খান ও সদরুশ শরীয়াহ মুফতি আমজদ আলী আজমী رحمهم الله এর বক্তব্য থেকেও এটাই প্রতীয়মান হয় যে আলো দ্বারা তৈরি প্রতিচ্ছবি প্রচলিত ছবির অন্তর্ভুক্ত নয়। -('টি.ভি ও মুভি', পৃষ্ঠা ১৬, মাকতাবাতুল মদীনা)


ইমাম আহমদ রাযা খান رحمه الله আরও বলেন—

“প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা—এমনকি কোনো কাফেরের সাথেও— সম্পূর্ণরূপে হারাম।” -(ফাতাওয়া রাযবিয়্যাহ, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা ৩৪৮, রাযা ফাউন্ডেশন, লাহোর)


والله أعلم عزوجل و رسولُه أعلم ﷺ


ফতোয়া লিখক: 

আল মুতাখাসসিস ফিল ফিকহ আল ইসলামী,

আবু কাসিম মুহাম্মদ আজম মাদানী

০৫ জিলহজ্জাহ ১৪৪৬ হিজরি / ০২ জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Next
This is the most recent post.
Previous
Older Post
Top