হুযুর আকরাম  [ﷺ]-এঁর উর্দ্ধতন মূলধারার পূর্বপুরুষ নর-নারী সকলেই মু’মিন ছিলেন, এ বিষয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে।

প্রথম প্রমাণঃ কোরআন মজিদের সূরা শুয়ারা, আয়াত নং ২১৯-এ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ وَتَقَلُّبَكَ فِى السَّاجِدِيْنَ
অর্থঃ- “হে  রাসুল! সিজদাকারী মু’মিনগণের মধ্যে আপনার আবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি।" হযরত ইবনে আব্বাস (رضي  الله عنه) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে “আপনার পূর্ববর্তী সকল নর-নারী যাদের মাধ্যমে আপনি আবর্তিত হয়ে এসেছেন- তাঁরা সকলেই ছিলেন  সিজদাকারী মু’মিন।" (তাফসীরে ইবনে আব্বাস)।

দ্বিতীয়   প্রমাণঃ   নবী   করিম  [ﷺ]-এরশাদ করেছেনঃ
لَمْ يَزَل اللهُ يَنْقُلُنِي مِنَ الاَصْلاَبِ الطَّيِّبَةِ اِلَى الاَرْحَامِ الظَّاهِرَةِ مُصَفَّى مُّهَذَّبًا (عن أبن عباس-مواهب)
অর্থঃ- “আল্লাহ  তায়ালা পর্যায়ক্রমে আমাকে পবিত্র ঔরসে (মু’মিন পুরুষ) হতে পবিত্র গর্ভের (মু’মিন নারী) মাধ্যমে পাক-সাফ অবস্থায় স্থানান্তরিত করে পৃথিবীতে এনেছেন।"

হাদীসখানা এত পরিষ্কার এবং  এত শালীন ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে যে, যুগ-যুগান্তরের শিরক ও  কুফরীর অপবিত্রতা এবং চরিত্রগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে হুযুর [ﷺ]-এঁর পূর্ব পুরুষগণের মুক্ত থাকার পরিষ্কার  ইঙ্গিত  তাতে পরিষ্ফুট হয়ে উঠেছে। কোরআনের পরিভাষায় পবিত্র  নর-নারী  বলতে ঈমানদারকেই বুঝানো হয়েছে। (সুরা মু’মিনুন ১৮  পারা)

তৃতীয় প্রমাণঃ ইবনে মোহাম্মদ কলবীর বর্ণনা সূত্রে তাঁর পিতা মুহাম্মদ কলবী (رحمة الله عليه) বলেনঃ-
كَتَبْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَمْسَ مِائَةِ اُمَّهَاتِه فَلَمْ اَجِدْ فِيْهِنَّ سِفَاحًا وَلاَ شَيْئًا مِّنْ اَمْرِ الجَاهِلِيَّة
অর্থঃ- “আমি নবী করিম [ﷺ]-এঁর বংশধারার পূর্ববর্তী  পাঁচশত মায়ের তালিকা প্রস্তুত করেছি।  তাঁদের মধ্যে আমি চরিত্রহীনতা এবং  জাহেলিয়াতের কিছুই পাইনি।" (বেদায়া-নেহায়া)

জাহেলিয়াত অর্থ কুফরী ও শেরকী। চরিত্রহীনতা অর্থ যিনা। সুতরাং হুযুরের উর্দ্ধতন মহিলারা ছিলেন শিরক, কুফর ও চরিত্রহীনতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত- অর্থাৎ মু’মিনা ও সতী-সাধ্বী নারী ছিলেন। সুতরাং উপরোক্ত তিনটি অকাট্য দলীলের দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, নবী করিম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতা মু’মিন ছিলেন এবং মিল্লাতে ইব্রাহীমীর উপর তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের পর দশম হিজরীতে যখন নবী করিম [ﷺ] হজ্ব করতে মক্কা শরীফে আগমন করেন, তখন  হাজুন নামক  কবরস্থানে (বর্তমানে জান্নাতুল মুয়াল্লা) আল্লাহ পাক   তাঁর পিতা-মাতাকে এনে পুনর্জীবিত করে দ্বীনে মুহাম্মদী [ﷺ] গ্রহণ  করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ইমাম সোহায়লী  ও খতীবে বাগদাদী সূত্রে হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) কর্তৃক বর্ণিত এ সম্পর্কীয় হাদীসখানা বেদায়া-নেহায়া গ্রন্থে  ইবনে কাসির এবং মাওয়াহেব গ্রন্থে ইমাম কাস্‌তুলানী,  ফতোয়া শামীতে আল্লামা ইবনে আবেদীন প্রমুখ বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু বিদ’আতি আলেমগন বলে থাকেন যে,  এসব হাদীস নাকি জাল বা মওযু। একারণেই উপরে তিনটি নির্ভরযোগ্য সূত্র উল্লেখ করা হলো। ওহাবীদের মতে, হযরত আবদুল্লাহ ও বিবি আমেনা (رضي الله عنهما) নাকি  কুফরী  হালতে ইন্তিকাল   করেছেন (নাউযুবিল্লাহ!)। তারা যুক্তি হিসেবে বলে থাকে যে, হযরত  আবদুল্লাহ  (رضي  الله عنه) রাসুল [ﷺ]-এঁর জন্মের পূর্বে  এবং বিবি আমেনা (رضي الله عنها) হুযুরের ছয় বছর বয়সে  ইনতিকাল করেছেন। তাই তাঁরা ইসলাম গ্রহণের যুগ পাননি। তাদের এই কুটযুক্তি উপরের তিনটি দলীলের দ্বারা অসার প্রমাণিত হয়েছে। তারা আর একটি যুক্তি দেখায় যে, বিবি আমেনার (رضي  الله عنه) কবর যিয়ারত করতে চাইলে আল্লাহ  তায়ালা নবী করিম [ﷺ]-কে অনুমতি  দেন।  কিন্তু মাগফিরাতের দোয়ার  অনুমতি চাইলে প্রত্যাখ্যান করেন। সুতরাং তাদের মতে তিনি মু’মিনা ছিলেন না।
আল্লামা মানাভী এর জবাব এভাবে দিয়েছেন - কবর যিয়ারতের অনুমতি  প্রদানই প্রমাণ করে যে, বিবি আমেনা (رضي الله عنها) মু’মিনা ছিলেন। আর তিনি নেককার ছিলেন বলেই ঐ সময় মাগফিরাতের প্রাথনা নামঞ্জুর   করা  হয়।" তবে  নবী  করিম [ﷺ] উম্মতের শিক্ষার জন্য সবসময় মাতাপিতার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করতেন - যার বর্ণনা নিম্নে করা হবে।

বি:দ্র: এখানে সুন্নীদের পক্ষ হতেও এধরণের প্রশ্নের উদয় হতে পারে। মায়ের প্রার্থনা নামঞ্জুর করার কারণ হলো - তিনি ছিলেন নেককার। তাহলে পরবর্তী সময়ে দেখা যায়- নবী করিম [ﷺ] সবসময় নিজের জন্য এবং পিতামাতার জন্য মাগফিরাত কামনা করতেন। তাহলে কি নবীজী এবং তাঁর পিতামাতা  বদকার বা গুনাহগার ছিলেন? নাউযুবিল্লাহ!
এই বিষয়টির জবাব তাফসীরে রুহুল বয়ান ২৬ পারা সূরা আল-ফাতাহ ২য় আয়াতের ব্যাখ্যায় এভাবে বলা হয়েছে - "হে রাসুল,  আপনার উছিলায় আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গুনাহ্ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন"- আল্লাহর এই বাণীর বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কেননা তিনি তো ছিলেন বেগুনাহ। সুতরাং আয়াতে "আপনার গুনাহ্ "-এঁর অর্থ হবে "আপনার উম্মতের গুনাহ।"

আর "মাগফিরাত"-এর তিনটি অর্থ রয়েছে যথা: (১) অপরাধ ক্ষমা করা (২) অপরাধ থেকে হেফাযত করা (৩) অপরাধের খেয়াল থেকে নিরাপদ রাখা। প্রথম অর্থ হবে সাধারণ গুনাহ্গারদের বেলায়। দ্বিতীয় অর্থ হবে নেককার ও  আল্লাহর  অলী এবং নবীজীর পিতামাতা ও সাহাবীগণের বেলায়। তৃতীয় অর্থ হবে নবীগণের বেলায়।

উক্ত ব্যাখ্যার দ্বারা   বুঝা গেলো - নবী করিম [ﷺ] নিজের  জন্য যে মাগফিরাত কামনা করতেন  - তার অর্থ  হবে - "হে আল্লাহ, আমাকে সদাসর্বদা গুনাহ বা অপরাধের খেয়াল থেকে বাঁচিয়ে রেখো।" হুযুরের পিতা-মাতার জন্য মাগফিরাত কামনার অর্থ হবে – "হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতাকে গুনাহ থেকে হেফাযতে রেখো।" আর সাধারণ উম্মতের জন্য মাগফিরাত কামনার অর্থ – "হে আল্লাহ! তাদের গুনাহ  ক্ষমা করে দিও।" (রুহুল বয়ান, সূরা ফাতহ আয়াত-২)

এখন পরিষ্কার  হয়ে গেলো - হুযুরের পিতামাতা নেককার ছিলেন এবং  নবীজী তাদের গুনাহ হতে হেফাযতের জন্যই  দোয়া করতেন এবং গুনাহ ও যাবতীয় অপরাধের খেয়াল থেকে নিজেকে নিষ্পাপ রাখার জন্য তিনি সর্বদা আল্লাহর  কাছে  প্রার্থনা করতেন (তাফসীরে রুহুল বয়ান)। একই শব্দের  একাধিক অর্থ ও তার প্রয়োগ  সম্পর্কে না জানার কারণে রহমানপুরী নামে জনৈক মুফতী সাহেব আমার "নূরনবী"র এই অংশটি নিয়ে  অনেক লিফলেটিং করেছিলেন। কিন্তু তিনি কামিয়াব হতে  পারেননি। আলহামদুলিল্লাহ! সর্বোপরি জওয়াব হলো - উম্মতকে শিখানোর জন্যই হুযুর [ﷺ] ঐ ভাবে দোয়া করতেন।

নবী করিম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতার পুনর্জীবন লাভ ও নূতন করে ইসলাম গ্রহণ:

নবী  করিম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতা হুযুরের নবুয়তের যুগ পাননি।  কিন্তু তাঁরা ছিলেন মিল্লাতে  ইব্রাহীমীর উপর প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী হানিফ সম্প্রদায়ভূক্ত মু’মিন। তাঁদের মত আরবে আরও কিছু লোক  হানিফ সম্প্রদায়ভূক্ত ছিলেন। যেমন - আব্দুল মোত্তালেব, ওয়ারাকা ইবনে নওফেল, হযরত খাদিজা ও হযরত আবু বকর – প্রমূখ (رضي  الله عنهم)। যারা নবুয়ত যুগের পূর্বে ইনতিকাল করেছেন, তাদেরকে "আসহাবে ফাৎরাত" বলা হয়। তাঁরা ছিলেন তৌহিদবাদী    হানিফ।  নবী  করিম [ﷺ]-এঁর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ এবং মাতা বিবি আমেনাও ছিলেন  অনুরূপ তৌহিদপন্থী মু’মিন।

যখন নবী করিম [ﷺ] জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ১০ম হিজরীতে একলাখ চৌদ্দ হাজার  সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মক্কা শরীফে হজ্ব করতে আসেন, তখন একদিন বিবি আয়েশা (رضي الله عنها) কে সাথে  নিয়ে জান্নাতুল মুয়াল্লাতে বিবি খাদিজা (رضي الله عنه)-এঁর মাযার যিয়ারত করতে গেলেন। (তখন নাম ছিল হাজুন)। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) গাধার লাগাম ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। নবী করিম [ﷺ] যিয়ারতকালে প্রথমে খুব কাঁদলেন - পরে হাসলেন। হযরত আয়েশা (رضي الله  عنها) কারণ জানতে  চাইলে হুযুর আকরাম [ﷺ]  বললেন  - "আমার  পিতা-মাতাকে আল্লাহ্ পাক পুনর্জীবিত করে আমার সামনে হাযির করেছেন।  তাঁরা নতুন করে ইসলাম গ্রহণ   করে পুনরায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি পিতা-মাতাকে দেখে খুশী হয়ে হেসেছি।" (বেদায়া ও নেহায়া দ্রষ্টব্য)। ইমাম সোহায়লীর বরাত দিয়ে ইবনে কাছির এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ফতোয়ায়ে শামীতে হাফেয নাসিরুদ্দীন বাগদাদীর বরাতে হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) থেকে একখানা হাদীস উদ্ধৃত করে আল্লামা শামী লিখেছেন-

عن عائشة رضي الله عنها قالت ان الله احي ابويه اكراما له صلي الله عليه وسلم فاسلما ثم مانا كما كانا كما احي  الموتي بعيسي  عليه السلام -(ردالمحتار مطلب اسلام ابوي البي)

অর্থঃ- হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) বলেন- আল্লাহ তায়ালা নবী করিম [ﷺ]-এঁর সম্মানে তাঁর পিতা-মাতাকে পুনর্জীবিত করেন। তাঁরা উভয়ে নূতন করে  ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপরে তাঁরা পুনরায় পূর্বের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আল্লাহ্ পাক হযরত ঈসা (عليه السلام)-এঁর মাধ্যমে মৃতকে জীবিত  করতেন, তদ্রুপ নবীজীর খাতিরেও  করেছেন।" (শামী)

সুতরাং আমরা এখন থেকে মুক্তকন্ঠে বলবো - হযরত আব্দুল্লাহ ও হযরত  আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। কেননা, তারা সাহাবী হিসাবে গণ্য।

বি:দ্র: হযরত ইবরাহীম  (عليه السلام) ও হযরত ইসমাইল (عليه  السلام) আল্লাহর কাছে দোয়া  করেছিলেন - যেন তাঁদের বংশধরদের (আরব) মধ্যে প্রত্যেক যুগেই কিছু মুসলিম বিদ্যমান থাকে। (সূরা বাক্বারাহ ১২৮ আয়াত)।

-رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ

অর্থঃ- "হে প্রভু! আমাদের উভয়কে  তুমি তোমার অনুগত মুসলিম হিসেবে কবুল করো এবং আমাদের পরবর্তী বংশধরদের  মধ্যেও (আরব দেশে) কিছু সংখ্যক লোককে অনুগত মুসলিম বানিয়ে রেখো।" এই দোয়ার বরকতে পরবর্তী প্রত্যেক যুগেই আরবে কিছু সংখ্যক সত্যপন্থী হানিফ সম্প্রদায় বিদ্যমান ছিলেন। নবী করিম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতা ও তাঁদের পূর্ব পুরুষগণ এই হানিফ সম্প্রদায়ভূক্ত ছিলেন। তাঁদেরকে কাফের মনে করা বেদ্বীনি কাজ। ইতিহাসেও হানিফ সম্প্রদায়ের উল্লেখ  রয়েছে। বাতিলপন্থীরা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে বে-খবর।

 
Top