তার কথা যতই শুনেছি অবাক হয়েছি,

তার লেখা যতই পড়েছি মুগ্ধ হয়েছি,
তার নাতের ছন্দে সম্মোহনে ডুবেছি,
রাত জেগে কন্ঠহীন মুখে গুণ গুন করেছি।

আলা হজরত। একটা অনুপ্রেরণার নাম। একটা আদর্শের নাম। পুরো নাম ইমাম আহমদ রেজা খান বেরেলভী। ভারতের বেরেলি প্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন। একজন জীবন্ত ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের লাইব্রেরি। আজকের সমাজ আলা হজরতকে চিনে না। যারা চিনে তারাও কেবল একজন আলেম হিসেবেই চিনে। তাদের মনে আলা হযরতের ছবি এরকম যেন তিনি শুধু মানুষকে ফতোয়াই দেয়।


বাস্তবে আলা হজরত এমন না। আলা হজরত ছিলেন একজন মানব সেবী। মানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন সর্বস্ব। ইমামের যখন মৃত্যু হয় তখন জানাজার সময় একদল মানুষ এসে উপস্থিত। তারা বেরেলির নয়। সবাই শারীরিক ভাবে অসুস্থ কিংবা প্রতিবন্ধী। কেউ এদের চিনে না। জানতে চায় কারা এরা। তারা বলে, আমরা সবাই নিতান্তই অসহায় মানুষ। ইমাম আহমদ রেজা আমাদের বছরের পর বছর আমাদের ভরন পোষন করেছেন। কঠিন মানা করেছিলেন কাউকে না বলতে। তার কাছে আসতেও মানা করেছেন। আজ ইমাম চলে যাচ্ছেন। আমাদের মাথা থেকে শেষ সম্বল টুকু আজ হারিয়ে গেছে। তাই ইমামকে একটি বার দেখতে আমরা ছুটে এসেছি এখানে।

আলা হজরত অসম্ভব রকমের নবী প্রেমিক ছিলেন। ইমাম একবার দাওয়াতে গেলেন। খাবারের আগে শসা খেতে দেওয়া হলো। ইমাম একটু খেয়ে আবদার করলেন আপনাদের অনুমতি থাকলে আমি এইসব শসা খেয়ে ফেলতে চাই। উপস্থিত মানুষরা ইমামের এই আচরণ দেখে অবাক। খাওয়া শেষে বের হয়ে এলে ইমাম বলেন শসা আমার নবীর প্রিয় খাবার ছিল। আজ যে শসা টি দিয়েছিল সেটা খেয়ে তেঁতু ছিল। আপনারা খেয়ে যদি ফেলে দেন তাহলে আমার নবীর অপমান হতে পারে। সেই ভয়ে আমি আহমদ রেজা সব খেয়ে ফেলেছি।

আহমদ রেজা ছিলেন কৌশলী। নিজের মহত্ব দিয়ে মানুষকে সত্যের পথে আনতেন। একবার কোনো বিত্তশালী ইমামের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তার পরনে ছিল একটা অলংকার। ইমাম সেটা হাদিয়া হিসেবে সেই লোকটির কাছথেকে চেয়ে নিলেন। আশ্চর্য হয়ে অলংকার দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। দুদিন পর সেই লোকের মেয়ের কাছে একটা চিঠি আসল। সঙ্গে ওই অলংকারটি। ইমাম চিঠিতে লিখলেন পুরুষের জন্য অলঙ্কার হারাম, তাই আপনার বাবার এই সম্বল আপনাকে ফেরত দিলাম।

ইমাম একটা ছোট বাচ্চার সাথেই ভালো আচরণ করতেন। কোনো ভুল হলে তাদের কাছেও ক্ষমা চাইতেন। ইমাম ফতোয়া লিখতে চাননি। বাধ্য হয়েছিলেন ওই যুগের ফিৎনা থেকে বাঁচতে। সেই সময়ে যদি ইমাম ফতোয়া না লিখতেন তাহলে হয়তো আজও মুসলিম সমাজ অনেক গুমরাহির মধ্যে আচ্ছন্ন থাকতো। ইমাম কাউকে কাফের বলতে শতবার ভাবতেন। এক ব্যক্তি কুফরী করেছে। ইমাম তাকে কাফের না বলে বললেন সে কুফরী করেছে। কারণ ইমাম শুনেছিলেন সেই লোকটি মৃত্যুর আগে তওবা করেছেন, কিন্তু তথ্যপ্রমান এতটা ভরসার ছিল না। তাই ইমাম বলেছেন ওই ব্যক্তি কুফরী করেছে।

ইমাম কোনো সাধারণ আলেম ছিলেন না। তিনি জগৎ বিখ্যাত জ্ঞানী ছিলেন। ভাবতে পারেন আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে ভারতের কোনো মাওলানা সংখ্যা-বিজ্ঞান, জাফর, ভগ্নাংশ, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, পাটিগণিত, লগারিদমস, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিবিদ্যা, যুক্তি, দর্শন এর মতো বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ৭০টিরও বেশি বই লিখেছেন। এমনকি অঙ্ক শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে এক কালের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় আলীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর-কেও হার মানিয়েছেন। ইদারা তাহকীকাতে ইমাম আহমদ রেজা নামে একটি প্রকাশনী আছে করাচিতে। সেখানে ডক্টর মুহাম্মদ মালিকের লেখা একটি বই ছাপানো হয়েছে ইংরেজিতে। নাম- সায়েন্টিফিক ওয়ার্ক অভ ইমাম আহমদ রেজা। ইমাম আহমদ রেজার বৈজ্ঞানিক কর্ম।

ইমামের লেখার দক্ষতা ও দ্রুততার ধারণা দিতে একটা ঘটনা বলছি।
ইমাম দু'বার হজ্ব করেছেন। এটি দ্বিতীয় হজ্বের ঘটনা। স্বার্থান্বেষী এক মহল চিঠি দিল মক্কার গভর্নরের কাছে। চিঠিতে মদিনা মুনিব (দ:) এর ইলমে গায়েব (অদৃশ্য জ্ঞান) নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য উত্তর জানা ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ইমামকে অপমান করা। যাই হোক। মক্কার গভর্নর ছিলেন শরীফ গালিব। তিনি ইমামকে প্রশ্ন গুলো দিয়ে উত্তর জানতে চাইলেন। ইমাম হজ্বে এসেছেন। বইপত্র কিছুই আনেননি। এই সমস্ত বিষয়ে রেফারেন্স খুবই জরুরী। আর রেফারেন্স এর জন্য দরকার বই। কী আর করা! উত্তর লেখা শুরু করলেন ইমাম। সময় নিলেন মাত্র ৮ ঘন্টা। উত্তর লিখলেন ১৫০ পৃষ্ঠার। একটা প্রশ্নের উত্তরেই হয়ে গেল বই। নাম- আদদৌলাতুল মাক্কীয়্যা বিল মাদ্দাতিল গায়বিয়্যা। বাংলা অর্থ- অদৃশ্য জ্ঞানে মক্কার সম্পদ।

গভর্নর স্তম্ভিত। মক্কার সাবেক মুফতি শেখ সালেহ কামালকে সকলের সামনে বইটি পড়তে বললেন। একের পর এক সহীহ দলিল শুনে সকলেই অবাক। পরে গভর্নরের লাইব্রেরীতে দলিলগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। হুবহু মিলে যায়। আর বইয়ের ভাষা ছিল উচ্চমানের আরবি যা একজন ভারতীয় মানুষের জন্য লেখা অসম্ভব। এব্যাপারেও বিস্মিত সবাই।

আলা হযরতের ১৫০০ এর বেশি কিতাব রয়েছে। মানুষটা কেবল ২ঘন্টা ঘুমাতেন। দিন রাত শুধু লেখালেখি করতেন। ১০০ বছর আগে যখন ব্যাংক ছিল না তখনও তিনি ইসলামিক ব্যাংকের গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন। আফসোস! আমরা আলা হজরতকে সঠিক ভাবে প্রচার করতে পারিনি। অথচ অনেক বিধর্মীও আলা হজরতকে নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছে।

আর বলার কি আছে! ইমামকে একবার প্রশ্ন করা হলো- হজরত! আপনি এতো লিখেন কিভাবে? ইমাম হেসেছিলেন। সুন্নতি মুচকি হাসি। বলেছিলেন- লেখা হয় কলম দিয়ে। তাই বলে কি সেই লেখা কলমের? তিনি লিখেন যিনি ধরে আছেন কলমটি। আমি আব্দুল মোস্তফা (মোস্তফা স. গোলাম) হচ্ছি একটি কলম মাত্র। আর আমাকে ধরে লিখেন আমার গাউসে পাক শেখ সৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল কাদের জিলানি আল হাসানী ওয়াল হুসাইনি রাদিয়াল্লাহু আনহু।

এই পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলা হজরত ইমাম আহমদ রেজা খান বেরেলভী কে নিয়ে ২৩টি পিএইচডি ডিগ্রি করা হয়েছে।

ইমাম আহমদ রেজা সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে এবং সব ধরনের রেফারেন্স পেতে বাংলায় মাহদী গালিব নামে একজন লেখকের বই আছে। নাম "পথিকৃৎ"।

লেখক: গোলাম শাফিউল আলম মাহিন
শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা।

 
Top