উম্মুল মু‘মিনীন অর্থ হচ্ছে মু‘মিনদের মাতা, আর উম্মুহাতুল মু’মিনীন অর্থ হচ্ছে মু’মিনদের মাতাগণ। হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে :   إن الجنة تحت أقدام أمهاتكم (অর্থাৎ নিশ্চয়ই জান্নাত হচ্ছে তোমাদের মায়ের ক্বদমের নীচে)

এই হাদীছ শরীফ থেকেই বুঝা যায় মাতার সম্মান কিরূপ।  মু’মিনদের মাতা বলতে  আজওয়াজে মুত্বাহহারাত অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পবিত্র আহলিয়াগণ উনাদেরকে বুঝায়।

উম্মুহাতুল মু’মিনীনগণ উনারা সংখ্যায়  ১৩ জন ছিলেন । তম্মধ্যে ৮ জন ছিলেন কুরাইশ গোত্রের :

হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম
হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম
হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম
হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম
হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ আলাইহাস সালাম
হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম
হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম
হযরত মায়মুনা আলাইহাস সালাম
দুই জন ছিলেন অন্যান্য আরব গোত্রের :

হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মা আলাইহাস সালাম, বনু হিলাল গোত্রের
হযরত জুওয়ায়রিয়া আলাইহাস সালাম, বনু মুছতালিক গোত্রের।
দুইজন ছিলেন ইয়াহুদী সম্প্রদায় থেকে :

হযরত ছাফিয়া আলাইহাস সালাম
হযরত রায়হানা আলাইহাস সালাম।
আর একজন ছিলেন ঈসায়ী সম্প্রদায় থেকে:

হযরত মারিয়া কিবতিয়া আলাইহাস সালাম ।



হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তো ছিলেন বেমেছাল, আল্লাহ পাক উনার পরেই উনার শান। সাধারণ উম্মতের জন্য মহান আল্লাহ পাক নির্দ্ধারণ করে দিয়েছেন শর্ত ও ক্ষমতা অনুসারে উর্দ্ধে ৪ জন আহলিয়া রাখা যাবে।

খালিক্ব, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব-উনাকে তিনি এই নির্দ্ধারিত সীমার উর্দ্ধে আহলিয়া গ্রহণ করার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন, যা কালাম পাকে উল্লেখ রয়েছে। সাধারণ অন্যান্য নবী-রসুলদেরও অনেক খাছ বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষ থেকে ভিন্ন । যেমন পূর্ববর্তি নবীদের মধ্যে দেখা যায় হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম উনার ১০০ জন আহলিয়া ছিলেন। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম উনার ৭০০ আহলিয়া এবং ৩০০ বাঁদী ছিলেন এবং উনার সর্বশেষ আহলিয়া ছিলেন হযরত বিলকিস আলাইহাস সালাম। এই সংখ্যাধিক্যতা নবীদের মু’জিযার অন্তর্ভূক্ত । খালিক্ব, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদের এত অধিক সংখ্যক আহলিয়া রাখার জন্য ইখতিয়ার দিয়েছিলেন এবং এর শক্তি-সামর্থও দিয়েছিলেন।  সকল নবীগণই মা’ছুম, উনারা সর্বাবস্থায় নফসানী খাহেশাতের উর্দ্ধে। উনারা ওহী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি ও মর্জির খেলাফ কোন কাজ করেন না । হযরত শাহ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার লিখিত মাদারিজুন নবুওওত কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জান্নাতী ৪০ জন পুরুষের শক্তি দেয়া হয়েছিল ।

তিনি বলেন:  এ সম্পর্কে আরো সুস্পষ্ট বর্ণনা এ রকম এসেছে যে, জান্নাতী একজন পুরুষ দুনিয়ার একশত পুরুষের সমান শক্তির অধিকারী হবে । অপর এক বর্ণনায় এসেছে, হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেছেন : একবার হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম খাবার ভর্তি একটি ডেগ আমার নিকট নিয়ে আসলেন । আমি তা থেকে কিছু খাবার গ্রহণ করলাম । তাতে আমার ভিতরে ৪০জন পুরুষের সমান পুরুষত্বশক্তি এসে গেল (মাদারিজুন নবুওওত)।


এখন উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, সাধারণ মানুষ যুবক বয়সে  একজন যুবতী স্ত্রী পছন্দ করে থাকে । কিন্তু আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তদ্রুপ করেন নি। উনার যখন প্রথম নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয় তখন উনার বয়স মুবারক ছিল ২৫ বছর, আর উনার প্রথমা আহলিয়া উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার বয়স মুবারক ছিল ৪০ বছরের উর্দ্ধে। উনার জীবিত অবস্থায় তিনি অন্য কোন আহলিয়া গ্রহণ করেন নি । উনার বিছাল শরীফের পরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বয়স মুবারক যখন ৫০ বছরের উর্দ্ধে তখন ৫২ বছর বয়স্কা উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছাওদা আলাইহাস সালাম উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়।  এ সময় উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম-উনার সঙ্গেও খালিক্ব, মালিক, মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশক্রমে উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্দেশ সম্পর্কে উনার সংক্ষিপ্ত জীবনী মুবারক আলোচনায় আমরা পরে আলোচনা করব। সে সময় উনার বয়স মুবারক ছিল মাত্র ৬ বছর। মক্কা শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ২৮ বছর বৈবাহিক হায়াত মুবারকের মধ্যে যদিও এই তিনটি নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়, এ সময় শুধু একজন আহলিয়া উনার সঙ্গে ছিলেন অর্থাৎ হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার বিছাল শরীফের পরে হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম।  হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে আরো ৩ বছর পর মদীনা শরীফে উম্মুল মু’মিনীন হিসাবে আজওয়াজে মুত্বাহহারাত উনাদের অন্তর্ভূক্ত হন ।

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে উনার ১০ বছর হায়াত মুবারকের শেষের দিকে, উনার বয়স মুবারক যখন ৫৮ থেকে ৬০ বছর, তখন বাকী দশটি নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয় । এই দশ জন উম্মুহাতুল মু’মিনীন উনাদের মধ্যে একমাত্র হযরত মারিয়া কিবতিয়া আলাইহাস সালাম ব্যতীত সকলই ছিলেন বিধবা। হযরত মারিয়া কিবতিয়া আলাইহাস সালাম, যিনি ছিলেন ঈসায়ী স¤প্রদায়ের, উনাকে মিসরের শাসনকর্তা মুকাওকিস হাদিয়া হিসাবে পাঠিয়েছিলেন।  এই নিকাহ মুবারক সমূহ করা হয়েছিল বিশেষ বিশেষ কারণ ও উদ্দেশ্যে এবং খালিক, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে, এতে দুনিয়াবী কোন লোভ লালসা ছিল না।


নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হায়াত মুবারকের শেষ  সময়টি ছিল সামাজিকভাবে অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ, ঘন ঘন সারিয়া জিহাদের কারণে অনেক মুসলমান রমণী স্বামী হারা, পিতৃ হারা ইয়াতীম হয়ে পড়েন । পক্ষান্তরে বিজয় অভিযানের কারণে বহু বিধর্মী মহিলা বন্দীনী গণীমত হিসাবে মুসলমানদের হস্তগত হয় । তৎকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় আরবে বহু-বিবাহের প্রচলন ছিল। ইসলামের প্রারম্ভে অনেকের ৮/১০ জন স্ত্রী ছিল । তম্মধ্যে ইসলামী আইন অনুযায়ী ৪ জন রেখে বাকী স্ত্রীদের তালাক দিতে হয়েছে।  সাধারণত: বিধবা বিবাহ করা  একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার, উনারা বয়স্কা হয়ে থাকেন এবং উনাদের সন্তান সন্ততি থেকে থাকেন, উনাদের ভরণ পোষণের ব্যাপার রয়েছে । এমতাবস্থায় সর্ব-প্রথম আল্লাহ পাক উনার হাবীব বিধবাদের আশ্রয় দিয়ে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রতি উৎসাহ দেখিয়েছেন, নতুবা তখনকার পরিস্থিতিতে এক বিরাট সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিত ।

কুরআন শরীফে খালিক, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক একাধিক বিবাহ সংক্রান্ত যে নির্দেশ মুবারক দিয়েছেন, তাতে বুঝা যায় সাধারণত: এক বিবাহ হচ্ছে আদর্শ, আর একাধিক বিবাহ হচ্ছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এবং শর্ত সাপেক্ষে।  ফিকির করলে বুঝা যায়, হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ছিলেন মানব জাতির সর্ব বিষয়ে আদর্শ। মক্কা শরীফে উনার ৫৩ বছর হায়াত মুবারকে ২৮ বছর বৈবাহিক হায়াত মুবারক ছিল এক বিবাহের আদর্শ এবং মদীনা শরীফে উনার হায়াত মুবারকের শেষ ১০ বছর ছিল বহু বিবাহের আদর্শ। কারণ একাধিক আহলিয়ার সঙ্গে কি ভাবে জীবন যাপন করতে হয়, তারও আদর্শ তিনি রেখেছেন। এ ছাড়াও এর মধ্যে আমাদের ধারণার উর্দ্ধে আরো অনেক হিকমত রয়েছে, যা খালিক্ব, মালিক, রব্ব মহান আল্লাহ পাক তিনি ভাল জানেন।



ফাযায়েল-ফযীলত

এখন আমরা উনাদের ফাযায়েল ফযীলত সম্পর্কে  আলোচনা করব ।  কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত শরীফ থেকে সমস্ত উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম-উনাদের অতুলনীয় ফাযায়েল ফযীলত বুঝা যায় :-

সুরা আহযাবের ৬ নং আয়াত শরীফে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদেরকে উম্মুহাতুল মু’মিনীন বলে উল্লেখ করেছেন, যেমন :-

ألنَّبِيُّ أوْلَى  بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ أنْفُسِهِمْ وَ أزْوَاجُهُ أمُّهَاتُهُمْ

(নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঈমানদারগণের নিকট উনাদের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় । আর উনার আহলিয়া আলাইহিন্নাস সালাম উনারা মু’মিনগণের মাতা). এই আয়াত শরীফের প্রেক্ষিতে উনাদের একটি লক্বব মুবারক  أمهات
المؤمنين

(মু’মিনগণের মাতা). এই হিসাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মু’মিন লোক ছিলেন, এখন আছেন এবং ভবিষ্যতে থাকবেন উনাদের সকলেরই মাতা হচ্ছেন হযরত উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম।  মনে হয়, এই একটি মাত্র লক্বব মুবারকই উনাদের ফাযায়েল ফযীলত প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ। সুবহানাল্লাহ !

খালিক, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদেরকে বেমেছাল পুত:পবিত্রা ও সুমহান চরিত্র মুবারকের অধিকারিণী করে সৃষ্টি করেছেন সেজন্য উনাদের আরেকটি লক্বব মুবারক হচ্ছে  أزواج
مطهرات

(আজওয়াজে মুত্বাহহারাত অর্থাৎ পুত:পবিত্রা আহলিয়াগণ)  অর্থাৎ উনাদের চরিত্র সকল প্রকার কলুষ-মুক্ত। সুবহানাল্লাহ!

আবার আজওয়াজে মুত্বাহহারাত সকলই আহলে বায়ত শরীফ উনাদের অন্তর্ভূক্ত। খালিক্ব, মালিক, রব্ব মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন :-

إنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أهْلَ الْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرًا -

(হে আহলে বায়ত অর্থাৎ নবী পরিবার ! আল্লাহ পাক অবশ্যই চান আপনাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং আপনাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করতে অর্থাৎ আপনাদেরকে পবিত্র করেই সৃষ্টি করেছেন।)  এই আয়াত শরীফ নবী পরিবার উনাদের সকলেরই বিশেষ মর্যাদা, পবিত্রতা ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে । (সুরা আহযাব/৩৩)

সুরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে :-

وَلَا أنْ تَنْكِحُوْا
أزْوَاجَهُ مِنْ بَعْدِهِ أبَدًا

(নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের পর উনার আহলিয়া আলাইহিন্নাস সালাম উনাদেরকে তোমরা বিবাহ করতে পারবে না) . এই একই সুরার ৩২ নং আয়াত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে :-

َا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ

(অর্থ: হে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার আহলিয়াগণ অর্থাৎ উম্মুল মুমিনীনগণ ! আপনারা অন্যান্য নারীদের মত নন) । আল্লাহ পাক উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন অন্য কোন পুরুষ বা সাধারণ মানুষের মত নন, উনারাও অন্য কোন সাধারণ নারীর মত নন। এই সব আয়াত শরীফ থেকে বুঝা যায়, খালিক্ব, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদের মর্যাদাকে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল স্ত্রী জাতীর উপরে স্থান দিয়ে উনাদেরকে পৃথক করে সম্মান দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!

সুরা আহযাব উনার আয়াত শরীফ ২৮ :-

يَا أيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِّأزْوّاجِكَ إنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَ زِيْنَتَهَا فَتَعَالَيْنَ اُمَتِّعْكُنَّ وَ اُسَرِّحْكُنَّ

سَرَاحًا جَمِيْلًا -

(অর্থ : হে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আপনি আপনার আহলিয়াগণ উনাদেরকে বলুন, আপনারা যদি  পার্থিব জীবন ও উহার সৌন্দর্য কামনা করেন, তবে আসুন, আমি আপনাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেই এবং সৌজন্যের সাথে বিদায় দেই ।)


খায়বরের জিহাদের পরে মুসলমানদের প্রচূর গণীমত হাসিলের কারণে রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালে প্রাচূর্য আসলে হযরত উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা উনাদের খোর-পোষের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধির আর্জি পেশ করলে উক্ত আয়াত শরীফ নাযিল হয়। এর অর্থ এই নয় যে, উনারা পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করেছিলেন। হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম-উনার সময় যখন ইসলামী খিলাফতের আয়ের উৎস অনেক বেড়ে গেল এবং সর্বত্র প্রাচূর্যে ভরপূর হয়ে গেল, তখন উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম-উনাদের বার্ষিক ভাতা ১০ হাজার দিরহাম নির্দ্ধারণ করা হয়।  (ইছাবা). এতদ্ব্যতীত উম্মুহাতুল মু’মিনীন হিসাবে হাদিয়া তোহফাও উনাদের নিকট যখেষ্ট আসত। কিন্তু হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা সকলই এতই দানশীল ছিলেন যে, নিজের প্রয়োজন পরিমান সম্পদও জমা রাখতেন না। সম্পদ হাতে  আসার সঙ্গে সঙ্গেই উনারা গরীবদেরকে দান করে দিতেন। একবার উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার নিকট এক লক্ষ দিরহাম হাদিয়া আসে । এই অর্থ হাতে আসার পর সারাদিন তিনি গরীবদেরকে দান করতে থাকেন এবং সন্ধ্যার পূর্বেই সমস্ত অর্থ বিতরণ করে শেষ করেন । ঘটনাক্রমে সেদিন তিনি রোযা রেখে ছিলেন । উনার দাসী উনাকে জানাল যে, ইফতার করার জন্য ঘরে কিছুই নেই। উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম বললেন : ইতোপূর্বে তুমি কেন আমাকে জানালে না ?  উক্ত হাদিয়ার অর্থ হতে আমাদের ইফতারের জন্য কিছু রাখতে পারতাম (সিয়ারু আলামিন নুবালা). সুবহানাল্লাহ !  উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের সকলের মধ্যেই দানশীলতার এই বিশেষ গুণটি বিদ্যমান ছিল । উনাদের পবিত্র জীবনে পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসের নাম-গন্ধও ছিল না । উনাদের বসবাসের হুযরা সমূহও ছিল মসজিদের সাথে সংযুক্ত, পরবর্তীতে সবগুলিই মসজিদে রূপান্তরিত হয় । হুযরা সমূহ দৈর্ঘ দশ হাত ও প্রস্থ সাত বা আট হাত ছিল, উচ্চতা হাত উঠালে ছাদ স্পর্শ করা যেতো ।


১।  উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম

পরিচিতি উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি মক্কা শরীফের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও ঐশ্বর্যশালী মহিলা, জাহিলী যুগে  উনার লক্বব মুবারক ছিল ‘ত্বাহিরা’ (পবিত্রা), কুবরাও উনার অপর একটি লক্বব মুবারক এবং এই মুবারক লক্ববেই   তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রথমা আহলিয়া। তিনি কুরাঈশ গোত্রের সন্মানিত শাখা-গোত্র বনু আছাদে বিলাদত শরীফ লাভ করেন ।

বিলাদত শরীফ হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি আমুল ফীল (আবরাহার হস্তী বাহিণীর বছর)-এর ১৫ বছর পূর্বে বিলাদত শরীফ লাভ করেন।

প্রাথমিক জীবন প্রথম জীবনে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার পর পর দু’টি নিকাহ মুবারক   হয়েছিল । প্রথম স্বামীর নাম ছিল আবু হালা। তিনি জাহেলী যুগেই মারা যান। এই সংসারে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার  দু’টি পুত্র সন্তান ছিলেন – হযরত হিন্দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত হালা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। উভয়ই ছিলেন বিশিষ্ট ছাহাবী।  হযরত হিন্দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  উনার হুলিয়া মুবারক  (দৈহিক অবয়ব মুবারক) উনার অতি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন, যা ইতিহাস ও সীরত গ্রন্থ সমূহে অত্যন্ত মসহুর ।

হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার দ্বিতীয় স্বামীর নাম ছিল আত্বীক বিন ‘আবিদ। আবু হালার ইনতিকালের পর উনার সাথে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  এই সংসারে হযরত হিন্দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা নামে উনার এক কন্যা সন্তান ছিলেন।

ব্যবসা-বানিজ্য কুরাঈশদের মত হযরত  কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার আয়ের উৎস ছিল ব্যবসা বানিজ্য । উনার ব্যবসার মালের চালান সিরিয়ায় যেত এবং উনার একার জিনিষপত্র সমগ্র কুরাঈশদের  জিনিষপত্রের সমান   হতো।  উল্লেখযোগ্য যে মক্কা শরীফে চাষোপযোগী কৃষি জমি নেই, এজন্য এখানকার অধিবাসীগণ বিশেষ করে কুরাইশগণ ব্যবসা করেই জীবন ধারণ করতেন। যেহেতু সমস্ত কুরাইশ গোত্রের সকলের ব্যবসার সমান ছিল উনার ব্যবসার পুঁজি ও মালামাল, উনার ব্যবসায়ের এ বিশালতা থেকে উনার স¤পদের প্রাচূর্য স¤পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়।

নিকাহ মুবারক নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ,  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে যখন বিবাহ মুবারক হয় তখন উনার বয়স মুবারক ৪০ বছরের উর্দ্ধে । আর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বয়স মুবারক ছিল ২৫ বছর । সুবহানাল্লাহ !

ইসলাম গ্রহণ সকল মুসলমান এ ব্যাপারে একমত যে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি সর্বপ্রথম রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার উপর ঈমান আনয়ন করেন । (সিয়ারু আলামিন নুবালা)

ইসলামের জন্য সমুদয় ধন-স¤পদ ওয়াক্ফ ইসলাম গ্রহণের পর উম্মুল মু’মিনী হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার সমুদয় ধন-স¤পদ ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন । সুবহানাল্লাহ !  নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ব্যবসা বানিজ্য ছেড়ে আল্লাহ পাক-উনার ইবাদতে ও ইসলাম প্রচারে নিমগ্ন হলেন । এতে আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়াতে সঞ্চিত অর্থ দ্বারাই জীবন যাপন করতেন।

উনার রেহেম শরীফে রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সন্তান সন্ততি মশহুর মত অনুযায়ী উনার রেহেম শরীফে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার তিন জন পুত্র সন্তান ও চার জন কন্যা সন্তান বিলাদত শরীফ লাভ করেন ।  তিন জন পুত্র সন্তান  হচ্ছেন : (১) হযরত কাসিম আলাইহিস  সালাম,   (২) হযরত ত্বইয়্যিব আলাইহিস সালাম এবং (৩) হযরত ত্বাহির আলাইহিস সালাম । আর চার জন কন্যা সন্তান হচ্ছেন (১) হযরত  যায়নব  আলাইহাস সালাম,   (২) হযরত রুকাইয়া আলাইহাস সালাম,  (৩) হযরত উ¤েম কুলছুম আলাইহাস সালাম এবং (৪) সাইয়্যিদাতু নিসাঈ আহলিল জান্নাহ হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম ।   পুত্র সন্তানগণ-উনারা সকলই অপ্রাপ্ত বয়সে বিছাল শরীফ লাভ করেছেন। কন্যা সন্তানগণ-উনাদের মধ্যে হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম-উনার বিবাহ মুবারক হয়েছিল হযরত আবুল ‘আছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার সাথে । হযরত রুকাইয়া আলাইহাস সালাম ও হযরত উ¤েম কুলছুম আলাইহাস সালাম-উনাদের নিকাহ মুবারক হয়েছিল হযরত উছমান যুন্নুরাইন আলাইহিস সালাম -উনার সাথে, একজনের বিছাল শরীফের পর অন্যজনের । আর সাইয়্যিদাতুন নিসাই আহলিল জান্নাহ হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম-উনার বিবাহ মুবারক হয়েছিল হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ওয়া আলাইহিস সালাম উনার সঙ্গে ।

কাফিরদের  দ্বারা নির্যাতন-ভোগ মক্কা শরীফের সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালীনী, অগাধ ধন-সম্পদের অধিকারিনী, পুত:পবিত্র চরিত্রের অধিকারিনী ত্বাহিরা, হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার ৬৫ বছর হায়াত মুবারকের মধ্যে নবুয়ত প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৫৫ বছর দুনিয়াবী সুখ শান্তিতে স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করছিলেন। অত:পর উনার শেষ জীবনে নবুয়ত প্রকাশের পর থেকে কাফিরদের বিরোধিতা শুরু হলো এবং ক্রমেই তা বৃদ্ধি পেতে লাগল । তিনি ধৈর্য সহকারে সমস্ত পরিস্থিতির মুকাবিলা করেন। কাফিরদের বিরোধিতা ও নির্যাতনের জন্য রসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মনে যে আঘাত পেতেন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত  কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার সান্ত¦না বাক্য দ্বারা তা দূরীভূত হতো। সুবহানাল্লাহ !

শি‘য়াবে আবু তালিবে অবরূদ্ধ জীবন নির্যাতনের সবচেয়ে কঠিনতম দিনগুলি ছিল শিয়াবে আবু তালিবের তিন বছরের অবরুদ্ধ জীবন। নবুয়ত প্রকাশের ৭ম বছর মুহররম মাসে কুরাঈশগণ এইরূপ একটি অঙ্গীকার নামা তৈরী যে, বনু হাশিম যতক্ষণ পর্যন্ত নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে হত্যার জন্য তাদের নিকট সোপর্দ্দ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে কেউ আত্মীয়তার স¤পর্ক স্থাপন করবে না, ক্রয় বিক্রয় করবে না, তাদের সাথে মেলামেশা ও কথাবার্তা স¤পূর্ণরূপে বন্ধ রাখবে এবং তাদের নিকট কোন খাদ্য সামগ্রী পৌঁছতে দিবে না । উপায়ান্তর না দেখে বনু হাশিম আবু কুবায়েশ পর্বতের “শি‘য়াবে আবী তালিব” নামক গিরিপথে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ইহা ছিল হাশিম গোত্রের মিরাছী সুত্রে প্রাপ্ত গিরিপথ । আবু তালিব এবং উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে ছিলেন । দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত উনারা এই গিরিপথে অবস্থান করেন ।  এখানে এত কষ্টে উনাদের জীবন যাপন করতে হয়েছে যে, খাদ্যের অভাবে গাছের পাতা পর্যন্ত খেতে হয়েছে ।

পঞ্চাশের অধিক বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি অতি দু:খ কষ্টের মধ্য দিয়ে সেই পার্বত্য গিরিপথে জীবন যাপন করতে থাকেন। অবশেষে দুশমনের মধ্যেই দয়ার সঞ্চার হলো । তাদের পক্ষ হতেই লিখিত অঙ্গীকার ভঙ্গ করার  উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো।  নবুয়ত প্রকাশের ১০ম বছরে  তারা উনাদেরকে বের করে নিয়ে আসলেন। সুবহানাল্লাহ !

বিছাল শরীফ আবু তালিব গিরিপথ (শি‘য়াবে আবু তালিব) থেকে বের হওয়ার পরপরই আবু তালিব ও উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল। অবশেষে একই বছরে উভয়ই বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন । সুবহানাল্লাহ !

শি‘য়াবে আবু তালিব থেকে বের হওয়ার পরে নামায ফরয হওয়ার পূর্বে  (নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ,  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার স্ব-শরীরে মিরাজ শরীফ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে) নবুয়ত প্রকাশের ১০ম বছরে ১৭ই মাহে রমাদ্বান শরীফে ৬৫ বছর বয়স মুবারকে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন।  মক্কা শরীফের জান্নাতুল মা’লা নামক কবরস্তানে উনার দাফন মুবারক সম্পন্ন হয় । জান্নাতুল মা‘লায় উনার মাযার শরীফ-এর স্থান এখনও চিহ্ণিত রয়েছে  (উসুদুল গাবা, ইছাবা) ।

হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার বিছাল শরীফের পর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন: এইদিন উ¤মতের উপর এমন দু’টি মুছিবত আপতিত হয় যে, আমি বুঝে উঠতে পারছি না যে, আমি কোন্টির উপর বেশী দু:খ করব । এ দু’টি মুছিবত হচ্ছে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম ও আবু তালিব-উনাদের ওফাত শরীফ। এই দু:খ ও চিন্তার কারণেই উক্ত বছরের নাম রাখা হয় عام
الحزن

(‘আমুল হুযন অর্থাৎ দু:খের বছর)।  সুবহানাল্লাহ !

ফযীলত ও মর্যাদা উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি ছিলেন সেই পবিত্রা নারী যিনি নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেও মূর্তিপূজা করতেন না ।

উনার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য-সমূহের মধ্যে একটি এই ছিল যে,  তিনি প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পবিত্র ছোহবত মুবারকে কাটান এবং একমাত্র হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তিনি ব্যতীত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সকল সন্তান উনারই রেহেম শরীফে বিলাদত শরীফ লাভ করেন  (ইবনে সা’দ). এতদ্ব্যতীত এই সৌভাগ্যও তিনি লাভ করেন যে, তিনি জীবিত থাকতে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আর দ্বিতীয় আহলিয়া গ্রহণ করেন নি। সুবহানাল্লাহ !

উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার আভিজাত্য, স¤মান ও মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তিনি আল্লাহ পাক-উনার পক্ষ হতে উনার জন্য সালাম নিয়ে আসতেন । এক হাদীছ শরীফের বর্ণনায় জানা যায়, একবার নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনাকে বললেন : হে হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম !  স্বয়ং আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-উনার মাধ্যমে  আপনাকে সালাম দিয়েছেন । উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি উক্ত সালামের জওয়াব দিলেন এভাবে :-

و السلام عليك، و على جبرائيل عليه السلام، وإن الله هو السلام -

(অর্থ : ইয়া রসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আপনার প্রতি এবং হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-উনার প্রতিও আমার সালাম । আর আল্লাহ পাক তিনি তো নিজেই সালাম (শান্তি দাতা) অর্থাৎ  তিনি অন্য কোন সালামের মুখাপেক্ষী নন । (  সুবহানাল্লাহ ! এই জওয়াব থেকে উনার তীক্ষœ বুদ্ধিমত্তা ও  গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় ।  নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সারা জীবন উনার কথা স্মরণ করতেন । সুবহানাল্লাহ! [সূত্র-সমূহ : উসুদুল গাবা, ইছাবা,  তাবাকাত, তফসীরে মাজহারী, অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী]

২. উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম

পরিচিতি পিতা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম, মাতার নাম হযরত উম্মে রুমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। কুরাইশ বংশের বনু তায়ম শাখায় বিলাদত শরীফ । নবুয়ত প্রকাশের ৪র্থ বছরে তিনি বিলাদত শরীফ লাভ করেন।

নিকাহ মুবারক হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম-উনার বিছাল শরীফের পরে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে স্বপ্নে হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার প্রতিকৃতি দেখিয়েছিলেন। নবীদের স্বপ্নও ওহী হয়ে থাকে, যেমন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে আদীষ্ট হয়ে উনার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই স্বপ্ন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার নিকট বর্ণনা করেন। হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন : আমাকে পর পর দুই বার আপনাকে (স্বপ্নে) দেখানো হয়েছে । আমি দেখলাম এক ব্যক্তি আপনাকে রেশমী বস্ত্র পরিয়ে আমাকে বলছেন: ইনি আপনার আহলিয়া। আমি বস্ত্র একটুখানি সরিয়ে আপনাকে দেখছিলাম এবং মনে মনে বলছিলাম: এই স্বপ্ন আল্লাহ পাক উনার তরফ হতে হয়ে থাকলে আল্লাহ পাক তিনি অবশ্যই বাস্তবায়িত করবেন। অন্য বর্ণনায় আছে, হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম উনার বিছাল শরীফে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অত্যধিক মর্মপীড়া অনুভব করেন । হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনাকে দোলনায় নিয়ে হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আগমন করেন এবং বলেন, এই শিশুটি আপনার মনের দু:খ বেদনা এবং মর্মপীড়া দূর করে দিবেন। তিনি হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার স্থলাভিষিক্ত হবেন । সুবহানাল্লাহ ! এ দু’টি বর্ণনা হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খাছায়েছুল কুবরা কিতাবে উল্লেখ করেছেন । এতদ্ব্যতীত বুখারী শরীফ উনার একটি হাদীছ শরীফেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে । এসব বর্ণনা থেকে বুঝা যায় হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার শিশু অবস্থায় (মাত্র ৬ বছর বয়স মুবারকে) নিক্বাহ মুবারক হওয়াটা ছিল খালিক্ব, মালিক, রব্ব, মহান আল্লাহ পাক উনারই মর্জি অনুযায়ী এবং উনারই নির্দেশে ।


নবুয়ত প্রকাশের ১০ম সনে, হিজরতের তিন বছর পূর্বে, যখন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার বয়স মুবারক ৬ বছর, মক্কা শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু আরো তিন বছর পরে মদীনা শরীফে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন । তখন উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ৯ বছর। (উসুদুল গাবা, ইছাবা). সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাদানী জিন্দেগী মুবারকের সম্পূর্ণ ১০ বছর সময় উনার সর্বাপেক্ষা প্রিয় আহলিয়া হিসাবে উনার পবিত্র ছোহবতে তিনি অবস্থান করেছেন। হিজরী ৫৮ সনে ১৭ই মাহে রমদ্বান শরীফে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার খিলাফতের শেষের দিকে ৬৭ বছর বয়স মুবারকে তিনি বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন ।

উনার আবাসিক পবিত্র হুযরা শরীফ ছিল বর্তমানে মসজিদে নববী শরীফে যেখানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ সেখানে।

উনার সম্পূর্ণ জীবনী মুবারকে অনেক ঘটনাবলী ঘটেছে, যার বর্ণনা অনেক দীর্ঘ। আমরা এখন উনার ফযীলত সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় আলোচনা করব ।

ফযীলত ও মর্যাদা নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন :-

فضل عائشة على النساء كفضل الثريد على سائر الطعام

(অর্থ: অন্যান্য মহিলাদের উপর হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার মর্যাদা অন্যান্য সকল খাদ্যের উপর “আছ-ছারীদ” (এক প্রকার উত্তম খাদ্য)-এর ন্যায় ।) সুবহানাল্লাহ ! এই হাদীছ শরীফ উনার বিশিষ্ট মর্যাদার পরিচায়ক ।

উনার উছীলায় তায়াম্মুমের হুকুম জারি হয়, যদ্ধারা সমস্ত উম্মত উপকৃত হয়। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-উনারা সহ একটি সফরে ছিলেন । সফরে উম্মুল মু‘মিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনিও ছিলেন । পথে আবওয়া নামক স্থানে উনার একটি হার হারিয়ে গেলে উহা অনুসন্ধানের জন্য সেখানে রাত্রি যাপন করেন । এ স্থানটিতে পানি ছিল না বিধায় অযুর পানির ব্যবস্থা করা গেল না। তখন আল্লাহ পাক এই আয়াত শরীফ নাযিল করেন : فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا – (পাক মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করুন) সুরা নিসা-৪২ . সুবহানাল্লাহ !

একবার হযরত মু‘য়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এক লক্ষ দিরহাম উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার নিকট হাদিয়া পাঠান । এই অর্থ হাতে আসার পর সারাদিন তিনি গরীবদেরকে দান করতে থাকেন এবং সন্ধ্যার পূর্বেই সমস্ত অর্থ বিতরণ করে শেষ করেন । ঘটনাক্রমে সেদিন তিনি রোযা রেখে ছিলেন । উনার দাসী উনাকে জানাল যে, ইফতার করার জন্য ঘরে কিছুই নেই। উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম বললেন : ইতোপূর্বে তুমি কেন আমাকে জানালে না ? উক্ত হাদিয়ার অর্থ হতে আমাদের ইফতারের জন্য কিছু রাখতে পারতাম (সিয়ারু আলামিন নুবালা). সুবহানাল্লাহ ! উনার বোনের পুত্র হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়র রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ছিদ্দিক্বা আলাইহাস সালাম উনার দানশীলতা ও যোহদ সম্পর্কে বলেন : আমি স্বচক্ষে উনাকে দেখেছি ৭০ হাজার দিরহাম মানুষের মধ্যে দান করতে অথচ উনার পোষাকে ছিল তালী লাগানো । এতদসত্বেও তিনি নতুন কাপড় খরিদ করতেন না ।

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের পরে তিনি ৪৮ বছর দুনিয়াবী হায়াত মুবারকে ছিলেন । এই সুদীর্ঘ সময়ে নারী জাতীর শিক্ষা দীক্ষায় উনার ব্যাপক ভূমিকা ছিল । জ্ঞান গরীমা-শিক্ষা দীক্ষায় উনার জুড়ি ছিল না । বড় বড় ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং তাবেয়ীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম-উনারা কঠিন কঠিন মাসয়ালা জিজ্ঞেস করার জন্য উনার নিকট আগমন করতেন ।

ইসলামী ফিকাহ বা আইন শাস্ত্রের এক চতুর্থাংশ উনার বর্ণিত হাদীছ শরীফ হতে গৃহীত । (ইছাবা). বর্ণিত আছে যে, ফিকাহ শাস্ত্রে হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালালাম উনার ফতোয়া এত বেশী আছে যে, তা দিয়ে কয়েক খন্ডে কয়েকটি কিতাব তৈরী হতে পারে (ই’লামুল মু’মিনীন : ইবনে ক্বাইয়েম)। ফারায়েজ শাস্ত্রেও উনার বিশেষ দক্ষতা ছিল । অনেক বড় বড় ছাহাবা ফারায়েজ বিষয়ে অনেক মীমাংসা ও মন্তব্য উনার নিকট থেকে জেনে নিতেন (তাবাকাত). সুবহানাল্লাহ !


হাদীছ শরীফ বর্ণনায় প্রথম স্থান হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার, দ্বিতীয় স্থান হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিযাল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার এবং তৃতীয় স্থান ছিল হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার । তিনি হাফিজে কুরআন ছিলেন । উনার মেধা ছিল অত্যন্ত তীক্ষœ ।

হাদীছ শরীফ ছাড়াও আরবী সাহিত্যে উনার পূর্ণ পান্ডিত্য ছিল । বহু কবির অনেক বড় বড় কবিতা উনার মুখস্ত ছিল। ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি আদাবুল মুফরাদ নামক কিতাবে লিখেছেন : কা’ব বিন মালিকের পুরা কাছীদা উনার মুখস্ত ছিল, সেই কছীদায় কম-বেশী ৪০টি কবিতা ছিল । সুবহানাল্লাহ ! কা’ব ছাড়াও অন্যান্য জাহেলী যুগের এবং ইসলামী যুগের অসংখ্য কবির অনেক কবিতা উনার মুখস্ত ছিল, যা তিনি উপযুক্ত স্থানে আবৃত্তি করতেন, হাদীছ শরীফের কিতাব সমূহেও সে সবের উল্লেখ রয়েছে।

আরব ইতিহাস বিষয়ে উনার সমকক্ষ আলেম কেউ ছিলেন না । জাহেলী যুগের আরব অবস্থা, তাদের বিভিন্ন প্রথা, তাদের বংশ বিদ্যা, তাদের সামাজিক জীবন বিষয়ে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা অন্যত্র দু®প্রাপ্য । ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কেও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উনার নিকট থেকে বর্ণিত রয়েছে।

কুরআন শরীফের তফসীরে উনার বিপুল অধিকার ছিল । মুসলিম শরীফের শেষাংশে উনার তফসীরের একটি বড় অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন । হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়র রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি ছিলেন উনার বোনের পুত্র এবং একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী, একবার উনাকে বলেন : আপনার ফিকাহের ইলেম, শে‘র আশ‘য়ার-এর ইলেম, যুদ্ধ বিগ্রহের ইলেম, বংশাবলীর ইলেম, ইত্যাদি দেখে আমি আশ্চর্য হই না, কিন্তু আপনার চিকিৎসা শাস্ত্রের ইলেম দেখে আমি আশ্চর্য হই, ইহা কিভাবে এবং কোথা থেকে আসল ? সুবহানাল্লাহ ! অর্থাৎ দেখা যায়, চিকিৎসা শাস্ত্রেও উনার যথেষ্ট দক্ষতা ছিল ।

ওয়াজ নছিহতে উনার বিশেষ খ্যাতি ছিল । বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইবনে সীরীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : আমি চার খলীফা এবং পরবর্তী খলীফাদের খুতবা শুনেছি, কিন্তু উনার মত এত সুন্দর, এত পরিপূর্ণ কালাম কোন মাখলুকের যবান থেকে শুনি নি । সুবহানাল্লাহ ! নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেমন জাওয়ামিউল কালিম ছিলেন অর্থাৎ আল্লাহ পাক উনাকে সকল ইলেম হাদিয়া করেছিলেন, বুঝা যায় এই জ্ঞান-ভান্ডারের একটি হিস্যা তিনি পেয়েছিলেন ।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি যে কেবল এইসব জ্ঞানে শিক্ষিতা ছিলেন তা নয়, তিনি অন্যদেরকেও এইসব শিক্ষায় দক্ষ করে তুলতেন । উনার হাতে যাঁরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় দুই শত হবে । তম্মধ্যে আত্মীয়তায় ঘনিষ্ঠ কয়েকজন পুরুষ তাবেয়ী এবং বিশিষ্ট কয়েকজন মহিলা তাবেয়ীর নাম এইরূপ :-

হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়র রহমতুল্লাহি আলাইহি (বোনের পুত্র), হযরত ইমাম কাশিম বিন মুহম্মদ বিন আবু বকর রহমতুল্লাহি আলাইহি (ভ্রাতুষ্পুত্র), হযরত আবু সালমা বিন আবদির রহমান বিন আবু বকর রহমতুল্লাহি আলাইহি (ভ্রাতুষ্পুত্র), হযরত মাসরুক রহমতুল্লাহি আলাইহি (উপনাম আবু আয়েশা–উনার পালক-পুত্র), হযরত উমরা রহমতুল্লাহি আলাইহা, হযরত ছুফিয়া বিনতে শায়বা রহমতুল্লাহি আলাইহা, হযরত আয়েশা বিনতে তাহলা রহমতুল্লাহি আলাইহা প্রমূখ ।


উনার বিছাল শরীফের সময় নিকটবর্তী হলে তিনি ওছীয়ত করেন যে, উনাকে যেন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে রওযা শরীফে দাফন করা না হয়, বরং জান্নাতুল বাকীতে অন্যান্য উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম-উনাদের সাথে উনাকে দাফন করা হয়। সুবহানাল্লাহ ! (মুস্তাদরাক হাকিম) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার ঘরেই বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং উনার ঘরেই উনার রওযা শরীফ। সুতরাং সেখানে উনারও মাযার শরীফ থাকা উনার অধিকার ছিল । কিন্তু এই অধিকার তিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন । (উসুদুল গাবা, ইছাবা)

তিনি হজ্জের কঠিন অনুগামী ছিলেন এবং প্রতি বছর হজ্জ করতেন, গোলামদের খুবই স্নেহ করতেন, তাদেরকে ক্রয় করে মুক্ত করে দিতেন । যেসব গোলাম তিনি মুক্ত করে দিয়েছিলেন তাদের সংখ্যা ৬৬. সুবহানাল্লাহ !

উনার ভাতিজা হযরত ইমাম কাশিম বিন মুহম্মদ বিন আবু বকর রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : যতবারই আমি উনার হুযরা শরীফের সামনে দিয়ে যেতাম উনাকে সালাম করতাম । একদিন যখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম দেখলাম তিনি নামাযে আছেন, আর পড়ছেন :-

فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَ وَقَانَا عَذَابَ السَّمُوْمِ -

(অর্থ : আল্লাহ পাক তিনি আমাদের উপর দয়া করেছেন এবং আমাদেরকে সামুম (গরম বাতাস — অর্থাৎ দোজখের শাস্তি) থেকে রক্ষা করেছেন ) (সুরা ত্বুর/২৭) . তিনি কাঁদছিলেন এবং বার বার এই আয়াত শরীফ পড়ছিলেন । এদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ধরে গেল । তাই বাজারে চলে গেলাম আমার কিছু কেনাকাটার জন্য । তারপর যখন আবার প্রত্যাবর্তন করলাম, দেখলাম তিনি তখনও দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন ও কাঁদছেন ।

উনার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য যা অন্যান্য উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের মধ্যে ও ছিল না, যেমন তিনি উম্মুল মু‘মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম-উনাদের মধ্যে সর্বাধিক হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন । হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম উনাকে সালাম জানাতেন । তিনি হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম-উনাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন । অন্য কোন উম্মুল মু‘মিনীন দেখেন নি ।-তিনি ছিলেন ছায়েমুদ্দাহর — সারা বছর রোযা রাখতেন । সুবহানাল্লাহ ! সূত্র-সমূহ : উসুদুল গাবা, ইছাবা, সিয়ারু আলামিন নুবালা, তাবাকাত, মাদারিজুননবুয়ত, অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী

পর্যালোচনা

দেখা যায়, উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি সুদীর্ঘ ২৫ বছর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মক্কা শরীফে অবস্থান কালীন সময়ে উনার ছোহবত মুবারকে ছিলেন । তম্মধ্যে ১৫ বছর নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে এবং ১০ বছর নবুয়ত প্রকাশের পরে । নবুয়ত প্রকাশের পর ১০টি বছর ছিল মক্কা শরীফের কাফির মুশরিকদের চরম জুলুম অত্যাচার ও অস্বীকৃতির সময় । এ সময়ে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম-উনাকে কি পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা শিয়াবে আবু তালিবের তিন বছরের বন্দী জীবন সম্পর্কে চিন্তা করলেনই অনুমান করা যায়। আর উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মদীনা শরীফে তশরীফ নেয়ার পর থেকে বিছাল শরীফ পর্যন্ত ১০ বছর উনার ছোহবত মুবারকে ছিলেন । মুনাফিকদের সার্বক্ষণিক আভ্যন্তরীন শত্রুতা এবং কাফিরদের সাথে অবিরত সারিয়া-জিহাদের কারণে এ সময়টিও ছিল প্রতিটি মুহূর্ত আশঙ্কাপূর্ণ। দেখা যায় নবুয়ত প্রকাশের পরে উনাদের উভয়ের প্রত্যেকের ১০ বছর ছোহবত মুবারক-এর সময় সমান এবং ১৭ই রমাদ্বান শরীফে একই তারিখে বিছাল শরীফ-এর মধ্যে এক অপরূপ সামঞ্জস্য রয়েছে । তাছাড়া উনাদের দু’জনের জন্যই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মহব্বত ছিল অপরিসীম ।



দ্বীন-ইসলাম নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ২৩ বছর আনুষ্ঠানিক নবুওয়ত প্রকাশের সময়ে ক্রমে ক্রমে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। প্রথম ১০ বছর অর্থাৎ ইহার প্রারম্ভে হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত, কষ্টভোগ এবং সম্পদের দ্বারা দ্বীন-ইসলাম-উনার ভিত্তিমূল মজবুত করেছেন। আর হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি নবুওয়ত প্রকাশের শেষের দশ বছরে হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র ছোহবতে থেকে অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারিনী হয়েছিলেন, যা তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের পরে প্রায় ৪৮ বছর পর্যন্ত (উনার বিছাল শরীফ হয় ৫৮ হিজরীতে) সমস্ত উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, বিশেষ করে সমস্ত স্ত্রী জাতীর শিক্ষা দীক্ষায় ব্যপৃত থাকেন । সুবহানাল্লাহ !

মহিলাদের জন্য সকল উম্মুহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম বিশেষ করে উম্মুল মু’মিনীন হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম এবং উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনারা অনুসরণযোগ্য অনুপম আদর্শ রেখে গিয়েছেন ।

০৩. উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদা বিনতে যাম‘য়া আলাইহাস সালাম

প্রাথমিক জীবন: উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদা বিনতে যাম‘য়া আলাইহাস সালাম তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু আমির শাখায় বিলাদত শরীফ, পূর্ব পুরুষ মদীনা শরীফের বনু নাজ্জার বংশীয় ছিলেন। উনার প্রথম নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয় বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত সাক্রান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার সঙ্গে ।

একবার হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম স্বপ্নে দেখলেন যে, হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মুখ দিক থেকে আসছেন এবং শেষ পর্যন্ত উনার ঘাড়ের উপর হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পা মুবারক রাখছেন । হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম উনার স্বামীর নিকট এ স্বপ্নটি ব্যক্ত করলে উনার স্বামী বললেন : এ স্বপ্ন সত্য হলে আমার মৃত্যুর পর হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আপনাকে বিবাহ করবেন। এর পর হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম আর এক রাত্রে স্বপ্নে দেখলেন : আসমান থেকে চাঁদ উনার নিকট নেমে এসেছে এবং তিনি শায়িত অবস্থায় আছেন। তিনি এ স্বপ্নটি স্বামীকে বললে স্বামী বললেন: ইহা সত্য স্বপ্ন হলে, আমি আর কয়েকদিন মাত্র জীবিত থেকে মারা যাব। আমার মৃত্যুর পর আপনার বিবাহ হবে। ঐদিনই হযরত সাকরান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রোগাক্রান্ত হন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন (খাছায়েছুল কুবরা)।

নিকাহ মুবারকঃ হযরত কুবরা আলাইহাস সালাম উনার বিছাল শরীফের পরে মক্কা শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম-উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ৫২ বছর ।

নবী পরিবারের তত্ত্বাবধায়কঃ উনার নিকাহ মুবারকের পর থেকে অর্থাৎ নবুয়ত প্রকাশের দশম বছর রমাদ্বান শরীফ থেকে শুরু করে একাদশ হিজরীর মাহে রবীউল আউয়াল শরীফ পর্যন্ত আনুমানিক সাড়ে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পবিত্র ছোহবত লাভ করেন।

বিছাল শরীফঃ হিজরী ২২ সনে হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনার খিলাফত আমলে ৭৭ বছর বয়স মুবারকে তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেছিলেন । (তাবাকাত) ।

ফযীলত ও মর্যাদাঃ তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের পরে তিনি কঠোর পর্দ্দা করতেন । এমনকি হজ্জ ও উমরার জন্যও ঘর হতে বের হতেন না । উ¤মুল মু’মিনীন, হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার ধর্ম-পরায়ণতার প্রশংসা করে বলতেন : আমার ইচ্ছা হয় আমার রুহ যদি উনার শরীরে প্রবেশ করত। সুবহানাল্লাহ !


দানশীলতা ছিল উনার উল্লেখযোগ্য গুণ । একবার হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার খিদমতে দিরহামপূর্ণ একটি থলি প্রেরণ করেন (সম্ভবত: উনার জন্য নির্দ্ধারিত ভাতা)। তিনি বাহককে জিজ্ঞাসা করেন, ইহাতে কি রয়েছে ? বাহক বললেন, দিরহাম । তিনি বলেন : খেজুরের মত থলিতে দিরহামও পাঠান হয় নাকি ? অত:পর তিনি উনার খাদিমাকে উক্ত দিরহামগুলি অভাবগ্রস্থ লোকদের মধ্যে তৎক্ষণাৎ বন্টনের নির্দেশ দেন (ইবনে সা‘দ). তিনি তায়েফের চামড়া দাবাগাত করে ব্যবহার উপযোগী করতেন এবং বিক্রয় করে প্রাপ্ত আয় উদারভাবে সৎকর্মে ব্যয় করতেন । সুবহানাল্লাহ !

০৪. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম

পরিচিতিঃ উনার নাম ছিল হিন্দ, উপনাম উম্মে সালামা (সালামা উনার পুত্রের নাম), কুরাইশ গোত্রের মাখযুম বংশে বিলাদত শরীফ।

প্রাথমিক জীবন ও ইসলাম গ্রহণঃ হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম-উনার প্রথম নিকাহ মুবারক হয় হযরত আবু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার সঙ্গে, যিনি “আছ-ছাবিকুন আল-আউয়ালুন” (প্রথম যুগের মুসলমান)-উনাদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন ।

হিজরতঃ তিনি উনার প্রথম স্বামী হযরত আবু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার সঙ্গে প্রথমে হাবশায় হিজরত করেছিলেন । কিছুকাল সেখানে থেকে আবার মক্কা শরীফে ফিরে আসেন । অত:পর কাফিরদের প্রতিরোধের কারণে হযরত আবু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একাকী মদীনা শরীফে হিজরত করেন । স্বামীর হিজরতের পরে হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালামও মদীনা শরীফে হিজরত করেন। ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী তিনিই প্রথম মহিলা ছাহাবী যিনি হিজরত করে মদীনা শরীফে আসেন ।

প্রথম স্বামীর বিছাল শরীফ ও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে নিকাহ মুবারকঃ উনার প্রথম স্বামী হযরত আবু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার বিছাল শরীফের পরে হিজরী ৪ সনে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয় ।

হিজরী ৬১ সনে সংঘটিত কারবালার মার্মান্তিক ঘটনা হযরত হুসাইন আলাহিস সালাম-উনার শাহাদত তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ্য করেন । এই ঘটনায় তিনি এতই চিন্তিত ও মর্মাহত হন যে, তিনি মর্চ্ছিতা হয়ে পড়েছিলেন। (মসনদে আহমদ) হিজরী ৬৩ সনে অনুষ্ঠিত হাররার হৃদয়-বিদারক ঘটনাও তিনি প্রত্যক্ষ করেন । এ সময় উমাইয়া শাসকগণের নির্দেশে মদীনা শরীফে অভিযান চালিয়ে অনেক আলেম উলামাকে নৃশংসভাবে শহীদ করা হয়েছিল। নাউজু বিল্লাহ !

বিছাল শরীফঃ উম্মুল মুমিনীনদের মধ্যে তিনি সর্বশেষে বিছাল শরীফ লাভ করেন এবং হযরত মায়মুনা আলাইহাস সালাম ব্যতীত অন্য সবার চেয়ে দীর্ঘায়ূ লাভ করেন। তিনি ৮৫ বছর বয়স মুবারকে ৬৩ হিজরী সনে (হাররার ঘটনার বছর) বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন । উমাইয়া শাসকদের প্রতি বিরক্ত হয়ে তিনি ওছীয়ত করে যান যেন তৎকালীন মদীনা শরীফের উমাইয়া শাসকগণের তরফ থেকে নিযুক্ত গভর্ণর ওলীদ বিন উতবা উনার জানাযার নামায না পড়ান । সেই অনুযায়ী ওলীদ অরণ্যের দিকে চলে যায় এবং নিজেই হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু উনাকে পাঠিয়ে দেয়। তদনুযায়ী তিনিই উনার জানাযার নামায পড়ান । সুবহানাল্লাহ !

ফযীলত ও মর্যাদাঃ তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী, অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারিণী ও দানশীলা ছিলেন । সমস্যা সমাধানে বিশেষ দক্ষ ছিলেন । উনার প্রদত্ত ফতোয়া সমূহ একত্র করলে একটি কিতাব হয়ে যাবে। তিনি ফকীহ ছাহাবিয়াদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন । ইমামুল হারামাইন বলতেন : সঠিক মতামতের ক্ষেত্রে নারী জাতীর পূর্ণ ইতিহাসে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উ¤েম সালামা আলাইহাস সালাম-উনার নজীর খুজে পাওয়া দুষ্কর। সুবহানাল্লাহ !


শিক্ষা দীক্ষায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার পরেই উনার স্থান ছিল । হাদীছ শরীফ মুখস্ত রাখা ও স্মরণ শক্তির ব্যাপারে তিনি প্রায় উ¤মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার অনুরূপ ছিলেন। অনেক ছাহাবী এবং শীর্ষ স্থানীয় তাবেয়ীগণ উনার নিকট থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন (তাবাকাত, ইছাবা). পূর্ণ কুরআন শরীফ উনার মুখস্ত ছিল (ফতহুল বারী). তিনি বিশুদ্ধভাবে সুস্পষ্ট কন্ঠে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন এবং উনার উচ্চারণ পদ্ধতি ঠিক নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার উচ্চারণ পদ্ধতির অনুরূপ সুস্পষ্ট হতো (মসনদে আহমদ ইবনে হাম্বাল). সুবহানাল্লাহ !

তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে অত্যন্ত মহব্বত করতেন । নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার কয়েকটি চূল মুবারক নিজের নিকট বরকত স্বরূপ সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন । সুবহানাল্লাহ !

উনার একটি রূপার পাত্র ছিল, তাতে তিনি চূল মুবারক সংরক্ষণ করেছিলেন। ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের কেউ কোন দু:খ-বেদনা পেলে এক পেয়ালা পানি এনে উনার সামনে রাখতেন, তিনি চূল মুবারকটি সেই পানিতে ডুবিয়ে দিতেন । সেই পানির বরকতে উনার সকল দু:খ কষ্ট দূর হয়ে যেত (আনসাবুল আশরাফ, ছাহাবিয়াত)।
সুত্র সমূহ : উসুদুল গাবা, ইছাবা, বুখারী শরীফ, ইবনে মাজা শরীফ, তাবাকাত, আনসাবুর আশরাফ, ছাহাবিয়াত,
অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী।

০৫. উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম

পরিচিতিঃ তিনি ছিলেন হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার কন্যা, উনার বংশ ছিল কুরাইশ গোত্রের বনু ‘আদী বিন কা‘ব শাখার অন্তর্ভূক্ত।

রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে নিকাহ মুবারকঃ হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম-উনার প্রথম স্বামীর বিছাল শরীফের পর উনার পিতা হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনার এই বিধবা মেয়ের বিবাহের ব্যাপারে খুব পেরেশান হয়ে পড়েন । অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে উনার বিবাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়।

বিছাল শরীফঃ হিজরী ৪৫ সনে শাবান মাসে তিনি বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন । তখন ছিল হযরত মু‘য়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার খিলাফত কাল । তখন উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ৬৩ বছর । (ইছাবা)



ফযীলত ও বুযূর্গীঃ উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম অধিক রোযা রাখতেন এবং অধিক নামায পড়তেন ও ইবাদত করতেন (ইবনে সা’দ). বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞানে উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম-উনার পরেই উনার স্থান ছিল। উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন । তিনি বলতেন : হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম সত্যিই উনার বাপের মেয়ে অর্থাৎ উনার বাপ হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম-উনার ন্যায় তিনি ছিলেন দৃঢ়মনা । সুবহানাল্লাহ ! কুরআনে পাক উনার সংরক্ষক হিসাবে হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম-উনার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে । কারণ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি কুরআন পাক উনার যে সংকলনটি প্রস্তুত করেছিলেন, তা হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যমে হযরত হাফছা আলাইহাস সালাম উনার নিকট পৌঁছে, যা তিনি হযরত উছমান যুন্নুরাইন আলাইহিস সালাম উনার নিকট অর্পন করেন, যা কুরআন পাক উনার ঝঃধহফধৎফ পড়ঢ়ু হিসাবে গৃহীত হয় ।

বিছাল শরীফের পূর্বে তিনি উনার ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনাকে নির্দ্দেশ দিয়ে যান, যেন উনার সমস্ত অর্থ স¤পদ গরীব-দু:খীদের মধ্যে দান করে দেয়া হয় । উনার নির্দেশ কার্যকর করা হয় । সুবহানাল্লাহ ! (ইবনে সা’দ, সিয়ারু আলামিন নুবালা, উসুদুল গাবা, ইছাবা, অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী)

০৬. উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ আলাইহাস সালাম

পরিচিতিঃ তিনি ছিলেন রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ফুফাতো বোন ।

হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার সঙ্গে নিকাহঃ এক সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে উনার নিকাহের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, কিন্ত রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন উনাকে নিকাহের আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। অত:পর রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নির্দ্দেশে উনার পালক পুত্র হযরত যায়েদ বিন হারেছা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার সঙ্গে উনার নিকাহ অনুষ্ঠিত হয় ।

নিকাহ-বিচ্ছেদঃ কুরাঈশ বংশের সম্ভ্রান্ত মহিলা হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম-উনার নিকাহ হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার সাথে সুখের হয় নি । শেষ পর্যন্ত উনাদের মনোমালিন্য এতটুকু পৌঁছে গেল যে, হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম-উনাকে তালাক দিতে বাধ্য হন এবং তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে এ বিষয়ে অবহিত করেন ।



রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে নিকাহ মুবারকঃ ইতোমধ্যে আল্লাহ পাক-উনার তরফ থেকে এই মর্মে আয়াত শরীফ নাযিল হয় — মহান আল্লাহ পাক-উনার ইচ্ছা আরবে যে কু-প্রথা প্রচলিত আছে, পালক পুত্রকে আপন পুত্রের সমান জ্ঞান করা হয়, এই কু-প্রথা রহিত করা । পালক পুত্র নিজের পুত্র নয়। অত:পর হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম উনার সঙ্গে আল্লাহ পাক-উনার নির্দ্দেশক্রমে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয়। সুবহানাল্লাহ !

বিছাল শরীফঃ তিনি হিজরী ২০ সালে ৫৩ বছর বয়স মুবারকে বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন । জীবিত থাকতেই তিনি উনার কাফন প্রস্তুত করে রেখেছিলেন । তিনি ওছীয়ত করে যান যে হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম যদি আর একটি কাফনের ব্যবস্থা করেন, তবে উনার কাফনটি যেন গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হয় । তিনি আরো ওছীয়ত করে যান যে, উনার লাশ মুবারক যেন রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার লাশ মুবারককে যে খাটিয়ায় বহন করে নেয়া হয়েছিল, সে খাটিয়ায় বহন করে নেয়া হয় । উনার ওছীয়ত মত তা-ই করা হয়। হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম উনার জানাযার নামায পড়ান। সুবহানাল্লাহ !

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম-উনাদেরকে বলেছিলেন : أسرعكن بى لحوقا اطولكن باعًا – (আপনাদের মধ্যে যার হাত সবচেয়ে লম্বা তিনি আমার সঙ্গে সর্ব-প্রথম সাক্ষাত করবেন). রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের পর উম্মাহাতুল মুমিনীনগণ উনাদের মধ্যে তিনিই সর্ব-প্রথম বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন । সুবহানাল্লাহ ! পরে সকলেই বুঝতে পারলেন যে হাত লম্বা দ্বারা অত্যধিক দানশীলা বুঝানো হয়েছে।

ফযীলত ও মর্যাদাঃ উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম অন্যান্য উম্মুহাতুল মুমিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের মধ্যে উল্লেখ করতেন: অন্যান্যদের নিকাহ মুবারক উনাদের পিতা-মাতা ব্যবস্থা করেছেন, আর উনার নিকাহ মুবারক স্বয়ং আল্লাহ পাক তিনি আসমানে ব্যবস্থা করেছেন (ইছাবা). সুবহানাল্লাহ!

হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম খুব বেশী দান খয়রাত করতেন। তিনি হাতের কাজ করতেন এবং উহা বিক্রয় করে দান খয়রাত করতেন । উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার সন্মন্ধে বলতেন, দ্বীন সংক্রান্ত ব্যাপারে হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম অপেক্ষা উত্তম কোন মহিলা আমি দেখি নি, যিনি ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু, অত্যন্ত সত্যবাদীনি, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীনি, শ্রেষ্ঠ আমানতদার ও দান-খয়রাত-কারীনি । তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাওদা আলাইহাস সালাম উনার ন্যায় কঠোর ভাবে পর্দ্দা পালন করতেন । হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফের পরে হজ্জ ও ওমরা করার জন্যও ঘর থেকে বের হন নি, যদিও এ বিষয়ে হুয়ূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুমতি ছিল ।

হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম সকল উম্মুহাতুল মুমিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের জন্য বার্ষিক ভাতা (১০ হাজার দিরহাম) নির্দ্ধারণ করেন, অত:পর প্রথম বার উনার বার্ষিক ভাতা উনার নিকট পাঠালেন। তিনি ইহা গ্রহণ করে তৎক্ষণাৎ আত্মীয়-স্বজন ও ইয়াতিমদের মধ্যে বন্টন করে দিলেন । অত:পর দোয়া করলেন : আয় আল্লাহ পাক ! হযরত উমর ইবনে খাত্তাব আলাইহিস সালাম-উনার ভাতা যেন এর পর আমার নিকট আর না পৌঁছে । অত:পর এক বছর শেষ না হতেই তিনি বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন । পরের বছর হযরত উমর ফারুক আলাইহিস সালাম-উনার প্রদত্ত ভাতা আর উনাকে গ্রহণ করতে হয় নি (ইছাবা). সুবহানাল্লাহ ! (সূত্র সমূহ : উসুদুল গাবা, ইছাবা, তাবাকাত)




০৭. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম

পরিচিতিঃ উনার পিতা হযরত আবু সুফিয়ান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু (ইসলাম গ্রহণের পূর্বে) কুরাঈশ কাফিরদের নেতা ছিলেন।

ইসলাম গ্রহণ ও হিজরতঃ উনার প্রথম বিবাহ হয়েছিল উবায়দুল্লাহ বিন জাহাসের সঙ্গে । অত:পর ইসলামের প্রাথমিক যুগে উভয়ে একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন । হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম উনার স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরত করেছিলেন । হাবশায় অবস্থানকালে উনার স্বামী উবায়দুল্লাহ ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্টান হয়ে যায় । হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম তাকে ত্যাগ করত: সেখানে পৃথকভাবে জীবন যাপন করতে থাকেন । স্বামীর বহু চাপ সৃষ্টি সত্বেও তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগে রাজী হন নি । ইসলাম ত্যাগ করে উবায়দুল্লাহ বিভিন্ন পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং শীঘ্রই মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয় । নাউজু বিল্লাহ !

রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে উনার নিকাহ মুবারকঃ ইতিমধ্যে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদিনা শরীফে চলে আসেন । তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাসের ইসলাম ত্যাগ এবং হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম-উনার ঈমানী দৃঢ়তা ও আশ্রয়হীনতার উপরোক্ত সংবাদ পান । অত:পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে নিকাহ মুবারকের প্রস্তাব দিলে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসী রহমতুল্লাহি আলাইহি রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মধ্যস্থতায় এই বিবাহ মুবারক অনুষ্ঠিত হয় । সুবহানাল্লাহ ! উনার পিতা হযরত আবু সুফিয়ান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি। উনার নিকাহ মুবারকের কথা শুনে বলেছিলেন : ইহা তো এমন সম্ভ্রান্ত কুফু, যা প্রত্যাখ্যান করা যায় না ।

বিছাল শরীফঃ হিজরী ৪৪ সনে ৭৩ বছর বয়স মুবারকে উনার সৎভাই হযরত মু‘য়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্হু-উনার খিলাফত আমলে তিনি বিছাল শরীফ প্রাপ্ত হন ।

ফযীলত ও মর্যাদাঃ হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম ইসলামের জন্য স্বীয় জন্ম ভুমি ত্যাগ করে সুদুর হাবশায় হিজরত করেন এবং সেখানে উনার স্বামী বিধর্মী হয়ে গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে পরিত্যাগ করেন । ফলত: তিনি সমুদয় বিপদ তুচ্ছ করে ঈমানের দৃঢ়তায় ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও চারিত্রিক মাহাত্মের পরিচয় দিয়েছিলেন । তিনি অমায়িক ও অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিলেন। তিনি সর্বদা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার আদর্শ অনুসরণ করে চলতেন এবং উনাকে অপরিসীম মহব্বত করতেন। একটি ঘটনা থেকে তা বুঝা যায় । একবার উনার পিতা কুরাইশ নেতা হযরত আবু সুফিয়ান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে হুদায়বিয়ার সন্ধির মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য মদীনা শরীফে আগমন করেন। এ উপলক্ষে তিনি উনার মেয়ে হযরত উম্মে হাবিবা আলাইহাস সালাম-উনার সাথে সাক্ষাত করতে উনার ঘরে আসেন । তিনি ঘরে প্রবেশ করে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছানা মুবারকে বসছিলেন, ঠিক এ সময় হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম উক্ত বিছানা উল্টিয়ে ফেলেন । উনার পিতা উনাকে জিজ্ঞেস করেন : তোমার এ বিছানা কি তোমার পিতা অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় ? হযরত উম্মে হাবিবাহ আলাইহাস সালাম উত্তর দিলেন : ইহা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পবিত্র বিছানা। আপনি যেহেতু কাফির, আপনি অপবিত্র । তাই এ বিছানায় আপনি বসতে পারেন না । সুবহানাল্লাহ ! তখন হযরত আবু সুফিয়ান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন : আমার পরে তোমার স্বভাব অনেক মন্দ হয়ে গিয়েছে । সুত্র সমূহ : উসুদুল গাবা,ইছাবা, অন্যান্য সীরত গ্রন্থাবলী







 
Top