কিতাবঃ 
আকায়েদে আহলে সুন্নাহ (১ম খন্ড)
(ফিতনা ফাসাদের মোকাবেলায় আমাদের সঠিক আক্বিদা)
গ্রন্থনা ও সংকলনে:
মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর
প্রকাশক, সাকলাইন প্রকাশক, বাংলাদেশ।
সম্পাদনায়:
মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ আলাউদ্দিন জিহাদী।

প্রকাশনীঃ 
সাকলাইন প্রকাশন, বাংলাদেশ।
টেক্সট রেডীঃ 
মাসুম বিল্লাহ সানি, সিরাজুম মুনির তানভির।

উৎসর্গ:
আমার শ্রদ্ধেয় দাদা মুহাম্মদ আব্দুল মাজিদ (رحمة الله)‘র মাগফিরাত কামনায়।

গ্রন্থস্বত্ব: লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত।

নাম করণে: সৈয়দা হাবিবুন্নেছা দুলন।

প্রথম প্রকাশ:
২০ নভেম্বর, ২০১৫ ইং
দ্বিতীয় প্রকাশ:
৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং

প্রকাশনায়: সাকলাইন প্রকাশন, বাংলাদেশ।

শুভেচ্ছা হাদিয়া ৫০/= টাকা মাত্র


যোগাযোগঃ দেশ-বিদেশের যে কোন স্থানে বিভিন্ন সার্ভিসের মাধ্যমে কিতাবটি সংগ্রহ করতে মোবাইল: ০১৮৪২- ৯৩৩৩৯৬
                                                   
সূচিপত্র

লেখকের ভূমিকা/৫
প্রথম অধ্যায়ঃ 
আক্বিদার পরিচিতি-
আক্বিদা বলতে কী বুঝায়/৬
সর্বপ্রথম ঈমানের জ্ঞান শিক্ষা করা ফরয/৬
আক্বিদা দুরস্ত করা কেন প্রয়োজন?/৭
এক মাত্র আক্বিাদা শুদ্ধ ঈমানদাররাই জান্নাতে প্রবেশ করবে/৮
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ 
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জা‘মাআতই একমাত্র নাযাত প্রাপ্ত দল/৯
পবিত্র কুরআনে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত/৯
হাদিসের আলোকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের প্রমাণ/১২
প্রথম এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসদের অভিমত/১২
দ্বিতীয় হাদিসের বিষয়ে বিজ্ঞ উলামাদের ব্যাখ্যা/১৩
পঞ্চম হাদিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ উলামাদের ব্যাখ্যা/ ১৫
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শ/১৭
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকায়েদের ইমাম কে?/১৮
মাযহাব অস্বীকারকারীরা কি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী?/২০
তৃতীয় অধ্যায়ঃ 
আল্লাহ সম্পর্কে কিছু গূরুত্বপূর্ণ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা/২১
আল্লাহ তা‘য়ালার কী সৃষ্টির মত আকৃতি রয়েছে ?/২১
আল্লাহর আকৃতিতে আদম (عليه السلام) কে বানানো প্রসঙ্গ/২৪
আল্লাহকে স্বশরীরে সর্বত্র বিরাজমান আক্বিদা রাখা প্রসঙ্গ/২৫
আল্লাহকে আরশে সমাসীন বলা প্রসঙ্গ/২৯
আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন ধারণা রাখা প্রসঙ্গ/২৯
মহান আল্লাহর কাছে কোন কিছু গোপন নেই/৩২
স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা প্রসঙ্গ/৩২
চতুর্থ অধ্যায়ঃ 
নবিদের সম্পর্কে আক্বিদা/৩৩
এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আক্বিদা/৩৩-৩৪
সমস্ত নবীগণ নিষ্পাপ ছিলেন/৩৪
এক নজরে তাদের সম্পর্কে আরও কিছু আক্বিদা/৩৪-৩৬
সমস্ত নবীরা তাদের কবরে জীবিত/৩৬-৩৭
পঞ্চম অধ্যায়ঃ 
রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বিদা/৩৭
১.মহান আল্লাহ রাসূল (ﷺ) কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন/৩৭
এ বিষয়ে ইমামে আহলে সুন্নাতের অভিমত/৩৯
২. রাসূল (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام)‘র বহু আগেই সৃষ্টি, যদিও প্রেরিত হয়েছেন সকল নবির শেষে/৩৯
তিনি সৃষ্টির শুরুতে নবী ছিলেন/৪০
৩. তিনিই সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু; তাঁর উসিলায় জগত সৃষ্টি/৪০
৪. রাসূল (ﷺ)‘র সৃষ্টি অন্যান্য সৃষ্টির মতো নয়/৪১
সমস্ত মানুষ মাটির তৈরী নয়/৪২
৫. রাসূল (ﷺ)‘র পিতামাতা মু‘মিন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন/৪২
৬. অন্যান্য নবিদের থেকে আল্লাহ আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুস্তাফা (ﷺ) কে বেশী ইলমে গায়ব দান করেছেন/৪৪
৭. রাসূল (ﷺ) নিরক্ষর ছিলেন না/৪৬
৮. স্বয়ং আল­াহ তা‘আলাই নিজেই রাসূল (ﷺ)কে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন/৪৭
৯. চাঁদ ও সূর্যের আলোতে রাসূল (ﷺ)‘র ছায়া জমিনে পড়তো না/৪৮
১০. রাসূল (ﷺ) এর মি‘রাজ জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল/৪৯
১১. মি’রাজের সময়ের বিষয়ে সঠিক আক্বিদা/৫১
১২. রাসূল (ﷺ) সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহ তা‘য়ালা কে স্ব চক্ষে অবলোকন করেছেন/৫১-৫৩
১৩. রাসূল হায়াতুন্নবী (ﷺ) হিসেবে এখনও রওজা শরিফে আছেন/৫৩-৫৪
১৪. রাসূল (ﷺ) ওফাতের পরেও তেমন; যেমন হায়াতে ছিলেন/৫৪
১৫. রাসূল (ﷺ) যেখানে ইচ্ছা সেখানে পরিভ্রমণ করতে পারেন/৫৫
১৬. রাসূল (ﷺ) এর দৃষ্টিতে সব কিছু হাযির ও নাযির/৫৬
১৭. রাসূল (ﷺ) এর রওজা জিয়ারত একটি বরকতময় আমল/৫৬
১৮. রাসূল (ﷺ) এর শাফায়াত সত্য/৫৭
২০. রাসূল (ﷺ)‘র আগমনের দিনে ঈদ উদ্যাপন করা বৈধ/৫৭-৫৮
৬ষ্ঠ অধ্যায়ঃ 
খোলাফায়ে রাশেদীনের বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা-৫৮
হযরত আবু বকর ও উমর (رضي الله عنه)‘র ব্যাপারে আহলে জামাআতের আক্বীদা/৫৮
হযরত উসমান (رضي الله عنه)‘র ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের আক্বীদা/৫৯
হযরত আলী (رضي الله عنه)‘র ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের আক্বীদা/৫৯
সমস্ত সাহাবিরা সত্যের মাপকাঠি বা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন/৬০
সপ্তম অধ্যায়ঃ 
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আক্বিদার বিবরণ-
কবিরাহ গুনাহ এর দরুন কেই কাফের হবে না/৬০
আউলিয়ায়ে কেরামের প্রতি বিশ্বাস/৬১
সমস্ত বেলায়াত প্রাপ্ত ওলীরা তাদের স্বীয় কবরে জীবিত রয়েছেন/৬১
চার মাযহাবের ইমামদের প্রতি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা/৬২
ইয়াযিদ সম্পর্কে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অভিমত/৬৩-৬৪

ভূমিকা

আল্লাহ তা’য়ালার মহান দরবারে অসংখ্য কৃতজ্ঞতাসহ সিজদা আদায়ের পর, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম উপঢৌকন মহানবী হযরত মুহাম্মদ  এর পুণ্যময় চরণে লক্ষ কোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আমার এই পুস্তকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আক্বিদার বিষয়ের উপর আলোকপাত করছি, যে বিষয়গুলি যুগযুগ ধরে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্য বলে বিশ্বাস স্থাপিত হয়ে এসেছে, যা কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে সত্য আক্বিদার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণাদী থাকায় সূর্যের আলোর ন্যায় পরিষ্কার ছিলো আম জনতার নিকট এ সব বিষয় যেমন, আল্লাহ তা‘য়ালা আকার-আকৃতি থেকে মুক্ত, নবিজির ইলম গায়ব ও নূরের সৃষ্টি হওয়া, তিনি হাযির-নাযির, হায়াতুন্নবী (ﷺ), আমাদের সব কিছু দেখেন, ওলীগণ জীবিত, তাঁদের কারামাত সত্য ইত্যাদি বিশ্বাস পোষণ। আধুনিক সভ্যতার এই যুগে এসে কিছু কথিত জ্ঞানপাপী এ সব দীপ্তমান আক্বিদার বিষয়গুলির প্রতি নানা অভিযোগ উত্থাপন করে সরলমনা মুসলিম জাতিকে বিভ্রান্ত করছে প্রতিনিয়ত। সেসব বিভ্রান্তি থেকে সহজ সরল মুসলমানদের সতর্কতার লক্ষ্যে আমার এই ক্ষুদ্র্র প্রয়াস। আমার শ্রদ্ধেয়া বড় বোন সৈয়দা হাবিবুন্নেছা দুলন এ পুস্তকের নামকরণ করেছে ‘‘আকায়েদে আহলে সুন্নাহ (ফিতনা ফাসাদের মোকাবেলায় আমাদের সঠিক আক্বিদা)’’। গ্রন্থাকারে রূপদেয়ার পর বইজুড়ে অনুপম নজর দিয়ে আমাকে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে রেখেছেন, জামানার মুফতিয়ে আযম, আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুফতি আবদুল ওয়াজেদ আল-কাদেরী ও আল্লামা মুফতি আলী আকবার (মা.জি.আ)। বইয়ের বাংলা বানান সংশোধনীতে কৃতার্থ করেছে, মাওলানা আবদুল আজিজ রজভী ও মুহাম্মদ মাহবুব আলম মজুমদার- এ দুই ভাই।
প্রিয় পাঠক! আশা করি, নাতিদীর্ঘ এই পুস্তকটি পরোপুরি পড়ে বিবেকের আদালতে মুখোমুখি হবেন। এতে আপনার অন্তর চক্ষু খোলে যাবে, ইনশাআল্লাহ! সফলতার মুখ দেখবে আমার পরিশ্রম।
                               
অধম রচয়িতা মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর
তারিখ.১৫.১০.১৫ইং

প্রথম অধ্যায়ঃ 
আক্বিদা বলতে কী বুঝায়?

আক্বিদা عقد শব্দ থেকে আগত। যার বাংলা শাব্দিক অর্থ: বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। 
ভাষাবিদ ইবনে ফারিস (رحمة الله) এই শব্দের অর্থ বর্ণনা করে বলেন, “শব্দটির মূল অর্থই একটিই- দৃঢ় করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহিত। (মু‘জামু মাকায়িসিল লুগাহ, ৪/৮৬পৃ.) তাই বুঝা যায় মানুষ কতিপয় বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণকেই আক্বিদা বলে। এবার আমরা আক্বিদার পারিভাষিক সংজ্ঞা আলোকপাত করবো। আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ আল-ফাউমী বলেন-
الْعَقِيْدَةُ مَا يَدِيْنُ الإِنْسَانُ بِهِ وَلَهُ عَقِيْدَةُ حَسَنَةً مِنَ الشَّكِ
-‘‘মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করে তাকে ‘আক্বিদা’ বলা হয়। যেমন-বলা হয়, তার ভাল আক্বিদা আছে অর্থাৎ তার সন্দেহ মুক্ত দৃঢ় বিশ্বাস আছে।’’ (আল-মিসবাহুল মুনীর, ২/৪২১পৃ.)
ড. ইবরাহিম আনীস বলেন-
(العَقِيْدَةُ) الحُكْمَ الَّذِي لَا يَقْبَلُ الشَّكَ فِيهِ لَدَىْ مُعْتَقِدِهِ وَ (فِي الدّين) مَا يُقْصَدُ بِهِ الِاعْتِقَاد دون الْعَمَل كعقيدة وجود الله وَبَعثه الرُّسُل (ج) عَقَائِدْ
-‘‘আক্বিদা অর্থ এমন বিধান বা নির্দেশ যা বিশ্বাসীর বিশ্বাস অনুসারে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ রাখে না....ধর্মীয় বিশ্বাস যা কর্ম থেকে পৃথক। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালার অস্তিত্ব, রাসূলদের প্রেরণ। এটির বহুবচন আকায়েদ।’’ (আল-মুজাম আল-ওয়াসীত, ২/৬১৪পৃ.)

সর্বপ্রথম ঈমানের জ্ঞান শিক্ষা করা ফরয

সর্বপ্রথম ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন। অতঃপর দ্বীনের অন্যান্য জরুরী জ্ঞান শিক্ষা কার ফরয। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
لَمَّا بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ إِلَى نَحْوِ أَهْلِ اليَمَنِ قَالَ لَهُ: ্রإِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ مِنْ أَهْلِ الكِتَابِ، فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَى أَنْ يُوَحِّدُوا اللَّهَ تَعَالَى، فَإِذَا عَرَفُوا ذَلِكَ، فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي يَوْمِهِمْ وَلَيْلَتِهِمْ، فَإِذَا صَلَّوْا،
-‘‘রাসূল (ﷺ) যখন মুয়াজ বিন জাবাল (رضي الله عنه) কে ইয়ামান দেশে পাঠান তখন তাঁকে বলেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ যারা কিতাবধারী। সুতরাং তুমি তাদের নিকট পৌঁছে (সর্বপ্রথম ঈমানের) আহবান করবে, তারা যেন সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তোমার (ঈমানের) কথা মেনে নেয় (ঈমান গ্রহণ করে) তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও প্রত্যহ দিন-রাত আল্লাহ তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন......।’’  ➤ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৯/১১৪পৃষ্ঠা, হা/৭৩৭২, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, হা/১৩২।

এ হাদিসে রাসূল (ﷺ) মুয়ায ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) কে সর্বপ্রথম আহলে কিতাবদেরকে ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন এবং ইরশাদ করেছেন যদি আহলে কিতাব তাঁর ঈমানের দাওয়াত কবুল করে, তবে তাদেরকে ইবাদাতের দাওয়াত দিবে। নতুবা নয়। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ঈমানের গুরূত্ব এতই দিতেন যে, তাঁরা ঈমানের হালকা (মজলিস) কায়েম করতেন, পরস্পরে বসে ঈমান শিখতেন এবং অপর জনকে শিখাতেন। যেমন হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) আসওয়াদ ইবনে হেলাল (رضي الله عنه) কে লক্ষ্য করে বলেন-
اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنْ سَاعَةً
-‘‘আমাদের সাথে বসুন, কিছুক্ষণ ঈমান আনি তথা ঈমান শিখি।’’ ➤ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১/১০পৃষ্ঠা।

আক্বিদা বিশারদ আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য হানাফী (رحمة الله) বলেন-
وَلِهَذَا كَانَ الصَّحِيْحُ أَنَّ أَوَّلَ وَاجِبٍ يَجِبُ عَلَى المُكَلَّفِ شَهَادَةُ أَن لا أله الا الله....بَلْ أَئِمَّةُ السَّلَفِ كُلُّهُمْ مُتَّفِقُوْنَ عَلَى أَنَّ أَوَّلَ مَا يُؤْمَنُ بِهِ العَبْدُ الشَّهَادَتَانِ
-‘‘বিশুদ্ধমতে প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর সর্বপ্রথম ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা করা ফরয....এবং সকল আলেমগণ এ কথায় একমত যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে সর্বপ্রথম ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা করার আদেশ দেওয়া হবে...।’’ (শরহু আক্বিদাতুত তাহাভী, )

আক্বিদা দুরস্ত করা কেন প্রয়োজন?

আক্বিদা শুদ্ধ না হলে তার কোন ইবাদতই আল্লাহ কবুল করবেন না। হাশরে ময়দানে অসংখ্য ব্যক্তি এমন হবে যে তারা অনেক আমল করেছেন; কিন্তু আক্বিদা শুদ্ধ না থাকার কারণে তাদের আমল আল্লাহ বাতিল বলে ঘোষণা করবেন। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন-
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا
-‘‘(আর) আমি (যখন) তাদের সে সব আমল (ইবাদতের) দিকে মনোনিবেশ করব, যা তারা (দুনিয়াতে) করে এসেছে, তখন আমি তা (তাদের সকল ইবাদত) উড়ন্ত ধুলিকণার মতই (ঈমান শূন্য হওয়ার কারণে) নিষ্ফল করে দিব।’’ (সূরা ফুরকান, আয়াত, ২৩) 
তাই ঈমান-আক্বিদা যদি শুদ্ধ না থাকেন বান্দার আমল হাশরের ময়দানে ধুলার মতই উড়ে যাবে। তাই এক মাত্র সঠিক দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী না হলে কোন ব্যক্তির আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। হযরত হুযায়ফা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-
لَا يَقْبَلُ اللَّهُ لِصَاحِبِ بِدْعَةٍ صَوْمًا، وَلَا صَلَاةً، وَلَا صَدَقَةً، وَلَا حَجًّا، وَلَا عُمْرَةً، وَلَا جِهَادًا، وَلَا صَرْفًا، وَلَا عَدْلًا، يَخْرُجُ مِنَ الْإِسْلَامِ كَمَا تَخْرُجُ الشَّعَرَةُ مِنَ الْعَجِينِ
-‘‘আল্লাহ কোন বিদ‘আতীর (তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিপরীত কুফুরী-শিরকী আক্বিদা বিশ্বাসে নতুন বিশ্বাসী ব্যক্তির) কোনো রোযা, নামায, সদকা (যাকাত), হজ্জ, ওমরা, জিহাদ, ফরয ইবাদত, নফল ইবাদত কবুল করবেন না। সে (কুফুরী-শিরকী আক্বিদা পোষণের কারণে) ইসলাম থেকে বাহির হয়ে যাবে, যে ভাবে চুল (সহজে) আটার খমীরা থেকে বাহির হয়ে যায়।’’(সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/১৯পৃ. হা/৪৯, হাদিসটি ‘হাসান’।)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-
أَبَى اللَّهُ أَنْ يَقْبَلَ عَمَلَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ حَتَّى يَدَعَ بِدْعَتَهُ
-‘‘আল্লাহ বিদ‘আতির (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিপরীত দলের অনুসারীর) কোনো ইবাদত কবুল করবেন না, যতক্ষ না সে তার বিদ‘আত পরিত্যাগ করে।’’ (সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/১৯পৃ. হা/৫০, হাদিসটি ‘হাসান’ পর্যায়ের।)

একমাত্র আক্বিদা শুদ্ধ ঈমানদাররাই জান্নাতে প্রবেশ করবে

হাশরের ময়দানে যাদের ঈমান সঠিক বলে বিবেচিত হবে তারাই কেবল জান্নাতে যাবে। তাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য সকলের পূর্বে আক্বিদা শুদ্ধ করা জরুরী। যেমন মহান আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেন-
وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا
-‘‘যদি কোন পুরুষ বা মহিলা সৎকর্ম (ইবাদত) করে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন (অর্থাৎ ঈমানদার অবস্থায় ইবাদত করে)তাহলে সে (এবং তার মত ঈমানদার লোকেরাই শুধু মাত্র) জান্নাতে প্রবেশ করবে। (ইবাদতের পুরষ্কার দেওয়ার সময়) তাদের উপর বিন্দুমাত্র জুলুম, অবিচার করা হবে না।’’ (সূরা নিসা, ১২৪)

হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-
يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، اذْهَبْ فَنَادِ فِي النَّاسِ، أَنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا الْمُؤْمِنُونَ، قَالَ: فَخَرَجْتُ فَنَادَيْتُ: أَلَا إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا الْمُؤْمِنُونَ
-‘‘হে খাত্তাবের পুত্র! যাও লোকদের মাঝে ঘোষণা করে দাও যে, একমাত্র ঈমানদাররাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন, অতঃপর আমি বের হলাম এবং ঘোষণা করলাম: শুণ রাখো, ঈমানদার ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ মুসলিম, ১/১০৭, হা/১১৪)

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ 
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জা‘মাআতই একমাত্র নাজাত প্রাপ্ত দল

প্রায় দেড় হাজার বছর গত হয়ে গেল ইসলাম ধর্ম এ পৃথিবীতে এসেছে। এর মধ্যে অনেক বিপদাপদের মোকাবেলা করতে হয়েছে এ পবিত্র ধর্মকে। রাসূল (ﷺ)‘র সুশোভিত এ উদ্যানের উপর দিয়ে অনেক প্রলয়ঙ্করী ঝড়-তুফান বয়ে গেছে। কিন্তু খোদার লাখো শুকরিয়া যে, এ বাগান পূর্ববৎ সজীব ও প্রাণবন্ত রয়েছে। এ ধর্ম কখনো কুখ্যাত ইয়াযিদের শাসনামলে মেঘাচ্ছন্ন হয়েছে, কখনও হাজ্জাজের আমলের নির্যাতনে ধূলিধূসরিত হয়েছে, কখনো খলিফা মামুনের আমলে বাতিল পন্থীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে, আবার কখনও তাতারীরা বীর-বিক্রমে এর উপর প্রচন্ড আঘাত হেনেছে, আবার কখনও খারেজিদের সাথেও মোকাবেলা করতে হয়েছে। রাফেজিরাও একে সমূলে ধ্বংসের নীল নকশা তৈরী করেছিল। বর্তমান শতাব্দীতে আহলে হাদিস ও দেওবন্দী ফিতনাও ইসলামকে বিনাশ সাধনের জন্য ইসলামকে কেচি দ্বারা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের মত ছোট করতে শুরু করেছে। কিন্তু ইসলাম এমন এক স্থির পাহাড়, যার সম্মুখে কোন শক্তিই টিকে থাকতে পারেনি। এটা যেমন ছিল তেমনই মজবুত রয়েছে। আর যতগুলো বাতিল দলই উদ্ভাবিত হোক না কেন সকল বাতিল মতবাদের মুখোশ উন্মোচনে তার থেকে একটি হকপন্থি সত্যান্বেষী দল কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে, যারা রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবিগণ এবং সলফে সালেহিনের আক্বিদা, আমল, মত এবং  পথের উপর প্রতিষ্ঠিত। সে দলের নাম হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।

পবিত্র কুরআনে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত

আল্লাহ তা‘য়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আলে-ইমরানের  ১০৬ নং আয়াতে বলেছেন-
يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ
-‘‘সেদিন (কিয়ামতের দিন) কোন কোন মুখ উজ্জ্বল হবে, আর কোন কোন মুখ হবে কালো। বস্তুত যাদের মুখ কালো হবে, তাদরেকে বলা হবে তোমরা কি ঈমান আনার পর কাফির হয়ে গিয়েছিলে? এবার সে কুফুুরির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ আস্বাদন করো।’’
এখন আমরা দেখবো হাশরের ময়দানে কাদের মুখ কালো হবে আর কাদের মুখ হবে উজ্জ্বল।
১. সকল দেওবন্দী ও আহলে হাদিসদের মান্যবড় আল্লামা ইবনে কাসির (رحمة الله) পবিত্র কোরআনের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)‘র উক্তি বর্ণনা করেছেন-
وَتَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ
-‘‘কিয়ামতের দিন যাদের মুখ উজ্জল হবে তারা হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী।’’ 
➤ইবনে কাসির, তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২/৭৯পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৯হিজরি। 

বুঝা গেল সাহাবিদের যুগ থেকেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলোচনা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এবং যে দলের সফলতার ইঙ্গিত বহন করে মহান আল্লাহর বাণী পবিত্র কোরআন। 
২. ইমাম ইবনে আবি হাতেম  (ওফাত.৩২৭হি.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সনদ সহ একটি হাদিস সংকলন করেন এভাবে-
عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ فِي قَوْلِهِ: يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ قَالَ: تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ.
-‘‘হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (رضي الله عنه) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন...কিয়ামতের দিন যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।’’  
➤ইমাম আবি হাতেম, আত্-তাফসীর, ৩/৭২৯পৃষ্ঠা, হাদিস, ৩৯৫০, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাফসীরে আদ্-দুররুল মানসূর, ২/২৯১পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

৩. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী  (ওফাত.৯১১হি.) বলেন-
وَأخرج ابْن أبي حَاتِم وَأَبُو نصر فِي الْإِبَانَة والخطيب فِي تَارِيخه واللالكائي فِي السّنة عَن ابْن عَبَّاس فِي هَذِه الْآيَة قَالَ {تبيض وُجُوه وَتسود وُجُوه} قَالَ تبيض وُجُوه أهل السّنة وَالْجَمَاعَة وَتسود وُجُوه أهل الْبدع والضلالة
-‘‘ইমাম আবু হাতেম  তার তাফসীরে, আবু নছর  তার ইবানাত গ্রন্থে, খতিবে বাগদাদী  তাঁর তারিখে বাগদাদে, ইমাম লালকায়ী তাঁর সুন্নাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কিয়ামতের দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুখ উজ্জ্বল হবে এবং আহলে বিদআতি বা দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ কালো হবে।’’  
➤ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাফসীরে আদ্-দুররুল মানসূর, ২/২৯১পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

৪. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী  (ওফাত.৯১১হি.) আরও বর্ণনা করেন-
وَأخرج الْخَطِيب فِي رُوَاة مَالك والديلمي عَن ابْن عمر عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فِي قَوْله تَعَالَى {يَوْم تبيض وُجُوه وَتسود وُجُوه} قَالَ: تبيض وُجُوه أهل السّنة وَتسود وُجُوه أهل الْبدع
-‘‘ইমাম খতিবে বাগদাদি  তাঁর তারিখে বাগদাদে, ইমাম মালেক, ইমাম দায়লামী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে এ আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারাই হলো আহলে সুন্নাহ (জামাত)। আর আহলে বিদআতী বা দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ কালো হবে।’’  
➤ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাফসীরে দুররুল মানসূর, ২/২৯১পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, তাহের পাটনী, তাযকিরাতুল মাওদ্বুআত, ১/৮৪পৃষ্ঠা।

৫. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (ওফাত.৯১১হি.) আরও বর্ণনা করেন-
وَأخرج أَبُو نصر السجْزِي فِي الْإِبَانَة عَن أبي سعيد الْخُدْرِيّ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَرَأَ {يَوْم تبيض وُجُوه وَتسود وُجُوه} قَالَ: تبيض وُجُوه أهل الْجَمَاعَات وَالسّنة وَتسود وُجُوه أهل الْبدع والأهواء
-‘‘ ইমাম আবু নছর আল-সায্যি  তার আল-ইবানাত গ্রন্থে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে এ আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরূপ বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন যাদের মুখ উজ্জল হবে তারাই হলো আহলে জামাত অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত, আর আহলে বিদআতী বা ও দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এবং যাদের মধ্যে প্রবৃত্তিপূজা থাকবে তাদের মুখ কালো হবে।’’ 
➤ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাফসীরে দুররুল মানসূর, ২/২৯১পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, ইমাম আবি হাতেম, আত্-তাফসীর, ৩/৭২৯পৃষ্ঠা।

৬. আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
وَأَخْرَجَ ابْنُ أَبِي حَاتِمٍ، وَالْخَطِيبُ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ فِي قَوْلِهِ: يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ قَالَ: تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ الْبِدَعِ وَالضَّلَالَةِ.
-‘‘ কিয়ামতের দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুখ উজ্জ্বল হবে এবং বিদআতী ও দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ কালো হবে (যাদেরকে আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকা বলা হয়)।’’  
➤শাওকানী, ফতহুল ক্বদীর,  ১/৪২৫পৃষ্ঠা, দারু ইবনে কাসির, দামেস্ক, বয়রুত, প্রকাশ-১৪১৪হিজরি।

৭. ইমাম দায়লামী (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন-
{يَوْم تبيض وُجُوه وَتسود وُجُوه} تبيض وُجُوه أهل السّنة وَتسود وُجُوه أهل الْبدع
-‘‘এ আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরূপ বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন যাঁদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারাই হলো আহলে সুন্নাহ (জামাত)। আর আহলে বিদআতি বা দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ কালো হবে।’’  
➤ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৫/৫২৯পৃষ্ঠা, হাদিস, ৮৯৮৬

৮. আহলে হাদিসদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন-
قال ابن عباس رضي الله عنهما: تبيض وجوه أهل السنة والجماعة وتسود وجوه أهل البدعة والفرقة.
-‘‘হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কিয়ামতের দিন যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারাই হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং বিদআতী ও দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ কালো হবে (তাদেরকে আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকা বলা হয়)।’’ 
➤ইবনে তাইমিয়া, মুস্তাদরাক আ‘লা মাজমাউল ফাত্ওয়া, ২/২৫২পৃষ্ঠা, (শামিলা)


হাদিসের আলোকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের প্রমাণ

প্রথম হাদিসঃ 
হযরত ইবনে আমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-‘‘আমার উম্মতের মধ্যে সে সমস্ত জিনিসের আবির্ভাব ঘটবে, যা বনী ইসরালের মধ্যে ছিল। দু‘টি জুতার একটি অপরটির সাথে যেমন মিল থাকে। এমনকি বনী ইসরাঈলের কেউ যদি প্রকাশ্যে মায়ের সাথে যিনা করে, তবে আমার উম্মতের মধ্যেও এমন লোকের আবির্ভাব হবে, যে তা করবে। নিশ্চয় বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে এবং আমার উম্মত তিয়াত্তার দলে বিভক্ত হবে। তাদের সকলেই জাহান্নামে যাবে তবে একটি দল ব্যতীত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তারা কারা? রাসূল (ﷺ) উত্তর দিলেন, قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وأصحابي -‘‘আমি এবং আমার সাহাবার আদর্শের ওপর যারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’’  
➤খতিব তিবরিযি, মিশকাতুল মাসাবিহ, ১/৬১পৃষ্ঠা, কিতাবুল ই‘তিসাম বিস্-সুন্নাহ, হাদিস নং ১৬১, তিরমিযি, আস্-সুনান, ৫/২৬পৃষ্ঠা, হাদিস, ২৬৪১, আহলে হাদিস আলবানী সুনানে তিরমিযির তাহক্বীকে হাদিসটি ‘হাসান’ বলেছেন, তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ১৩/৩০পৃষ্ঠা, হাদিস, ৬২, ১৪/৫২পৃষ্ঠা, হাদিস, ১৪৬৪৬, মাকতুবাতু ইবনে তাইমিয়া, কাহেরা, মিশর, প্রকাশ-১৪১৫হিজরি। বায়হাকি, ই‘তিক্বাদ, ১/২৩৩পৃষ্ঠা, বাগভী, শরহে সুন্নাহ, ১/২১৩পৃষ্ঠা, হাদিস, ১০৪


প্রথম এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসদের অভিমতঃ

আমরা এখন দেখবো যে উপরের হাদিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকিহগণ কোন দলের কথা বলেছেন। 
১.এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) বলেন-
فَلَا شَكَّ وَلَا رَيْبَ أَنَّهُمْ هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ
-‘‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নাজাতপ্রাপ্ত দলটিই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত।’’   
➤মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ১/ ২৫৯পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ- ১৪২২হিজরি।।

২. আল্লামা ইমাম ইরাকী (رحمة الله) বলেন-
أهل السّنة وَالْجَمَاعَة -‘‘এটাই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জা‘আমাত।’’  
➤ইমাম ইরাকী, তাখরীজে ইহইয়াঊল ঊলূম, ১/ ১১৩৩পৃষ্ঠা, দারুল ইবনে হাযম, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ- ১৪২২হিজরি।।

৩. বিখ্যাত তাফসিরকারক আল্লামা ইসমাঈল হাক্কি (رحمة الله) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন- وفرقة ناجية وهم اهل السنة والجماعة -‘‘নাজাতপ্রাপ্ত দলই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত।’’  
➤ ইসমাঈল হাক্কী, তাফসীরে রূহুল বায়ান, ১/১৩পৃষ্ঠা, সুরা ফাতেহার ব্যাখ্যা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

৪. আহলে হাদিসদের মুহাদ্দিস মোবারকপুরী এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-
ولا شك أنهم أهل السنة والجماعة. -‘‘এতে কোন সন্দেহ নেই নাজাত প্রাপ্ত দলটিই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত।’’  
➤মোবারকপুরী, মের‘আতুল মাফাতিহ, ১/ ২৭৫পৃষ্ঠা।

দ্বিতীয় হাদিসঃ 
এ বিষয়ে উপরের হাদিসের ন্যায় সাহাবি হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (رحمة الله) হতে আরেকটি সূত্র বর্ণিত এভাবে আছে যে, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন ‘‘তোমাদের পূর্বে আহলে কিতাব (ইহুদি ও খ্রিষ্টান) বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। আর আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে।
كُلُّهَا فِي النَّارِ إِلَّا وَاحِدَةً، وَهِيَ الْجَمَاعَةُ
‘বাহাত্তর দল জাহান্নামে যাবে এবং একটি দল জান্নাতে যাবে। আর তারা হল জামাত অথার্ৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।’ আর আমার উম্মতের মাঝে এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যাদের মধ্যে প্রবৃত্তিপূজা এমনভাবে প্রবেশ করবে, যেমন জলাতঙ্ক রোগ, এ রোগ আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় প্রবেশ করে।’’ ➤ খতিব তিবরিযি, মিশকাতুল মাসাবিহ, ১/৬১পৃষ্ঠা, কিতাবুল ই‘তিসাম বিস্-সুন্নাহ, হাদিস নং ১৬২, মুসনাদে আহমদ,আবু দাউদ, আস্-সুনান, ৪/১৯৮পৃষ্ঠা, কিতাবুস্-সুন্নাহ, হাদিস, ৪৫৯৭, আহলে হাদিস আলবানী  সুনানে আবি দাউদের তাহক্বীকে হাদিসটি ‘হাসান’ বলেছে কিন্তু পাগলের মত আবার মিশকাতে সহিহ বলেছে।

এই দ্বিতীয় হাদিসের বিষয়ে বিজ্ঞ উলামাদের ব্যাখ্যাঃ
১.আল্লামা শায়খ মাতুলী শা‘রাভী  {ওফাত.১৪১৮হি.}এ হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেন-
والجماعة: هم أهل السنة والجماعة
-‘‘এখানে জামাত বলতে রাসূল (ﷺ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে বুঝিয়েছেন।’’  
➤শায়খ শারাভী, তাফসীরে শারাভী, ৭/৪০০২পৃষ্ঠা,।  

২-৩. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম আব্দুর রউফ মানাভী (رحمة الله) বলেন-
والجماعة أي أهل السنة والجماعة-
‘‘এখানে জামাত বলতে রাসূল (ﷺ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে বুঝিয়েছেন।’’ 
➤ মানাভী, ফয়যুল কাদীর, ২/২০পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ১২২৩, মাকতুবাতুল তাযারিয়াতুল কোবরা, মিশর, প্রকাশ- ১৩৫৬হিজরি।।   

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেন-
الفرقة الناجية هي أهل السنة والجماعة 
-‘‘নাজাত প্রাপ্ত দলই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত।’’  
➤ মানাভী, ফয়যুল কাদীর, ২/২০পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ১২২৩, মাকতুবাতুল তাযারিয়াতুল কোবরা, মিশর, প্রকাশ-১৩৫৬হিজরি।।  

৪. আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের আলেম আযিমাবাদী (ওফাত.১৩২৯হি.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-
 هُمْ أهل السنة والجماعة وهي الفرقة الناجية 
-‘‘এটা দ্বারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে, যা একমাত্র নাজাত প্রাপ্ত দল।’’  
➤ আযিমাবাদী, শরহে সুনানে আবি দাউদ, ১২/২২৩পৃষ্ঠা,দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৫ হিজরি।।

৫. আহলে হাদিস মোবারকপুরী (ওফাত.১৩৫৩হি.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-
هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ وَهِيَ الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ -‘‘এটা দ্বারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে, যা একমাত্র নাজাত প্রাপ্ত দল।’’  
➤ মোবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযি, ৭/৩৩২পৃষ্ঠা, ও মের‘আতুল মাফাতিহ, ১/২৭১পৃষ্ঠা, ও ১/২৭৮পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

তৃতীয় হাদিসঃ 
এ ছাড়া এ বিষয়ে উপরের হাদিসের অনুরূপ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে  আরেকটি সূত্র পাওয়া যায়। 
➤ ইমাম  আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, হুলিয়াতুল আউলিয়া, ৯/১৩৮পৃষ্ঠা, দারু ইহইয়াউত্-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।  

চতুর্থ হাদিসঃ 
ইমাম আবু লাইস সমরকন্দী {ওফাত.৩৭৩হি.} এ হাদিসটি কিছুটা মতন পরিবর্তন করে সংকলন করেন এভাবে-
قالوا: يا رسول الله ما هذه الواحدة؟ قال: أهْلَ السُّنَّةِ وَالجَمَاعَةِ الَّذِي أنا عَلَيْهِ، وأصْحَابِي
-‘‘সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! নাজাতপ্রাপ্ত একমাত্র দল কোনটি? তিনি বললেন, তারা হলো আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জা’মাত যারা আমার এবং সাহাবিদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।’’ 
➤ ইমাম  আবু লাইস সমরকন্দী, তাফসীরে বাহারুল উলূম, ১/৪৫৬পৃষ্ঠা, দারু ইহইয়াউত্-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।

উপরের হাদিসে প্রমাণিত হলো যে রাসূল (ﷺ)‘র মুখেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের নাম উচ্চারিত হয়েছে বা প্রচলন ছিল। তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় সাহাবিদের যুগেই এ সঠিক দলের নামের প্রচলন ছিল। যেমন আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন-
سُئِلَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ عَنْ عَلَامَاتِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ؟ فَقَالَ: أَنْ تُحِبَّ الشَّيْخَيْنِ، وَلَا تَطْعَنَ الْخَتَنَيْنِ، وَتَمْسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ.
-‘‘হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) কে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন- শায়খাইন অর্থাৎ হযরত আবু বকর ও উমর (رضي الله عنه) কে মুহাব্বত করা। এবং হযরত আলী য ও হযরত উসমান (رضي الله عنه)‘র সমালোচনা না করা এবং চামড়ার মৌজাদ্বয়ের উপরে মাসেহ করা। (মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত, ২/৪৭২পৃ.) এ রকম বর্ণনা হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর পাওয়া যায় (তথ্য সূত্রঃ মোল্লা জিওন, তাফসীরে আহমদিয়্যাহ তে সুরা আনআমের ১৫৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়।) এ ছাড়া আমরা সুরা আলে ইমরানের ১০৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বিস্তারিত আলোকপাত করেছি।
এ সমস্ত হাদিসে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত দলের পরিচয় দেওয়া হয়েছে, যারা রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবিদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত একমাত্র দল হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। এ বিষয়ে আরও অনেক হাদিসে পাক জানতে আপনারা আমার লিখিত ‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’ দ্বিতীয় খন্ড দেখুন। 
এ ছাড়া যত সম্প্রদায় তথা রাফেযী, খারেজী, মুরজিয়া, ক্বাদারীয়া, জাহমিয়া, হারুরিয়া, শিয়া, আহলে হাদিস, কওমী-দেওবন্দী সকলেই ভ্রান্ত এবং পথভ্রষ্ট। 

পঞ্চম হাদিসঃ 
হযরত মুয়াবিয়া বিন কুররাতা (رضي الله عنه) তিনি তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-
لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي مَنْصُورِينَ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ
-‘‘আমার উম্মতের মাঝে একদল কিয়ামত পর্যন্ত (শত্রু পক্ষের উপর) সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত থাকবে। যে তাদেরকে লাঞ্ছিত করতে চায়, সে তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’’  
➤ ইমাম ইবনে মাযাহ, আস্-সুনান, ১/৪পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৬, আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, হুলিয়াতুল আউলিয়া, ৯/৩০৭পৃষ্ঠা, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিসঃ ৬৮৩৫, মুসনাদে আহমদ, হাদিসঃ ৮২৭৪

পঞ্চম হাদিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ উলামাদের ব্যাখ্যা
১.এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম কাযি আয়াজ মালেকী (رحمة الله) এবং ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন-
قَالَ الْقَاضِي عِيَاضٌ إِنَّمَا أَرَادَ أَحْمَدُ أَهْلَ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ وَمَنْ يَعْتَقِدُ مَذْهَبَ أَهْلِ الْحَدِيثِ
-‘‘ইমাম কাযি আয়ায (رحمة الله) বলেন, নিশ্চয় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এ হাদিস থেকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতকে উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা পোষণ করেছেন যারা হাদিস বিশারদগণের আক্বিদার উপর রয়েছেন।’’  ➤ ইমাম নাওয়াবী, শরহে মুসলিম, ১৩/৬৭পৃষ্ঠা, দারু ইহ্ইয়াউত-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৩৯২হিজরি।

২. আল্লামা ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (رحمة الله) এর ব্যাখ্যায় লিখেন-
وَقَالَ الإِمَام أَحْمد: إِن لم يَكُونُوا أهل الحَدِيث فَلَا أَدْرِي من هم. وَقَالَ القَاضِي عِيَاض: إِنَّمَا أَرَادَ الإِمَام أَحْمد أهل السّنة وَالْجَمَاعَة.
-‘‘ইমাম আহমদ (رحمة الله) বলেন, যদি (সে দলের লোকেরা ) তারা হাদিস বিশারদগণ না হয় তাহলে তাদের সম্পর্কে আমি জানি না। ইমাম কাযি আয়ায (رحمة الله) বলেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) (এ হাদিসে পাকের ব্যাখ্যায়) (এখানে তায়েফা বা একটি দল বলতে) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতকেই উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা পোষণ করেছেন।’’
➤ ইমাম বদরুদ্দীন আইনী, শরহে বুখারী, ২/৫২পৃষ্ঠা, এবং ১৬/১৬৪পৃষ্ঠা, দারু ইহ্ইয়াউত - তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।

৩. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী  (ওফাত.৯১১হি.) বলেন-
قَالَ أَحْمد بن حَنْبَل فِي هَذِه الطَّائِفَة إِن لم يَكُونُوا هم أهل الحَدِيث فَلَا أَدْرِي من هم أخرجه الْحَاكِم فِي عُلُوم الحَدِيث قَالَ القَاضِي عِيَاض وَإِنَّمَا أَرَادَ أهل السّنة وَالْجَمَاعَة وَمن يعْتَقد مَذْهَب أهل الحَدِيث 
-‘‘ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ঐ দল সম্পর্কে বলেন যদি তারা হাদিস বিশারদগণ না হন তাহলে আমি তাদেরকে চিনি না। ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله) তাঁর ‘উলূমুল হাদিস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম কাযি আয়ায (رحمة الله) বলেছেন, (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল) যারা হাদিস বিশারদগণের আক্বিদার উপরে তিনি তাদেরকেই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলে বুঝিয়েছেন।’’  
➤ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, শরহে সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/২পৃষ্ঠা, (শামিলা)

৪. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন- فَالْمُرَادُ بِهِمْ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ.- 
-‘‘এখানে তায়েফা বা একদল দ্বারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।’’  
➤ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ৯/৪০৫২পৃষ্ঠা, হাদিস নং ৬২৯২, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ-১৪০৫ হিজরি।

৫. আহলে হাদিস আযিমাবাদী (ওফাত.১৩২৯হি.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-
وقال أحمد بن حنبل إن لم يكونوا أهل الحديث فلا أدري من هم -قال القاضي عياض إنما أراد أحمد أهل السنة والجماعة ومن يعتقد مذهب أهل الحديث
-‘‘ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ঐ দল সম্পর্কে বলেন যদি তারা হাদিস বিশারদগণ না হন তাহলে আমি তাদেরকে চিনি না। ইমাম কাযি আয়ায (رحمة الله) বলেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) এখানে যারা হাদিস বিশারদগণের আক্বিদার উপরে রয়েছেন তথা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতকেই ইচ্ছা পোষণ বা উদ্দেশ্য করেছেন।’’  
➤আযিমাবাদী, শরহে সুনানে আবি দাউদ, ৭/১১৭পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৫ হিজরি।

৬. আহলে হাদিস মোবারকপুরী (ওফাত.১৩৫৩হি.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-
وَقَالَ الْحَافِظُ فِي الْفَتْحِ وأخرج الحاكم فِي عُلُومِ الْحَدِيثِ بِسَنَدٍ صَحِيحٍ عَنْ أَحْمَدَ إِنْ لَمْ يَكُونُوا أَهْلَ الْحَدِيثِ فَلَا أَدْرِي مَنْ هُمْ وَمِنْ طَرِيقِ يَزِيدَ بْنِ هَارُونَ مِثْلُهُ انْتَهَى قَالَ الْقَاضِي عِيَاضٌ إِنَّمَا أَرَادَ أَحْمَدُ أَهْلَ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ وَمَنْ يَعْتَقِدُ مَذْهَبَ أَهْلِ الْحَدِيثِ
-‘‘ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তাঁর ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে এবং ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله) তার ‘উলূমুল হাদিস’ গ্রন্থে সহিহ সনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন ঐ দল সম্পর্কে বলেন যদি তারা হাদিস বিশারদগণ না হন তাহলে আমি তাদেরকে চিনি না। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইয়াযিদ ইবনে হারুন (رحمة الله) ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম কাযি আয়ায (رحمة الله) বলেছেন, (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল) যারা হাদিস বিশারদগণের আক্বিদার উপরে রয়েছেন তিনি তাদেরকেই তথা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলে উদ্ধেশ্য বা ইচ্ছা পোষণ করেছেন।’’ 
➤ মোবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযি, ৬/৩৬০পৃষ্ঠা,দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

আল্লামা ইবনে কাসির দামেস্কী (رحمة الله) ও এ মত পেশ করেছেন যে, তায়েফা বা সে দলটি হলো আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত। 
➤ ইবনে কাসির, বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৬/৭৩পৃষ্ঠা,দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪০৭হিজরি।।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শঃ

আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাতের পরিচয় সম্পর্কে আল্লামা মায়দানী (رحمة الله) লিখেছেন-
أَهْلِ السُّنَّةِ السيرة والطريقة المحمدية و أَهْلِ الْجَمَاعَةِ من الصحابة والتابعين ومن بعدهم من المتبعين للنبي صلى الله عليه وسلم
-‘‘আহলুস সুন্নাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রাসূল (ﷺ)‘র সীরাত এবং তাঁর তরিকার ওপর যারা প্রতিষ্ঠিত এবং আহলুল জামা‘আত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যারা রাসূল (ﷺ)‘র অনুসারী সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং তাবে-তাবেয়ীগণের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’’(শরহে আক্বিদাতুত তাহাবী, পৃ.৪৪)
সদরুশ শরিয়া আল্লামা উবায়দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) লিখেন-
أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ هُمُ الذين والطريقهم طريقة الرسول وَأَصْحَابِهِ دون أَهْلِ الْبِدَعِ
-‘‘যাঁদের তরিকা হলো, রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবাবিদের তরিকা, তারাই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত এবং তারা কোন বিদআতী সম্প্রদায় নয়।  
➤ আল্লামা উবায়দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আত-তাওযীহ, ৩/৩৮পৃষ্ঠা

আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাতের পরিচয় সম্পর্কে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন-
أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَهُمُ الَّذِينَ طَرِيقَتُهُمْ كَطَرِيقَةِ رَسُولِ اللَّهِ  صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ–وَأَصْحَابِهِ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ -، دُونَ أَهْلِ الْبِدَعِ
-‘‘ যাদের তরিকা হলো, রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবাবিগণের তরিকা, তারাই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত এবং তারা কোন বিদআতী সম্প্রদায় নয়।’’ 
➤ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ৯/৪০৪৪পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ- ১৪২২হি।

আহলে হাদিসদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন-
والبدعة مقرونة بالْجَمَاعَةِ فيقال: أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ كما يقال اهل البدعة والفرقة
-‘‘বিদআত শব্দটি ফিরকা’ (বিচ্ছিন্নতাবাদ)‘র সাথে সম্পর্কিত এবং সুন্নাত শব্দটি জামাত (বৃহত্তম) দলের সাথে সম্পর্কিত। যেমন বলা হয়ে থাকে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত এবং বলা হয়, আহলুল বিদআত ওয়াল ফিরকা।’’ (আল-ইস্তিমাতু, ১/৪২পৃ.) 
ইমাম তিরমিযি (رحمة الله) এক সঠিক মতটিকে উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন-
وَهَكَذَا قَوْلُ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالجَمَاعَةِ
-‘‘আর এটিই আহলে ইলম তথা আহলু সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বিদা।’’ 
➤ তিরমিযি, আস্-সুনান, ৩/৪১পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৬৬২।

ইমাম জুরকানী (رحمة الله) একটি বিষয়কে হক প্রমাণে এবং বাতিলদের খন্ডনে বলতে গিয়ে লিখেন-
 قَالَ أَهْلُ الْعِلْمِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ -
‘‘আর এটিই আহলে ইলম ( যারা ইলমে হাদিস ও ফিকহের অধিকারী) তথা আহলু সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বিদা।’’  
➤জুরকানী, শরহে মুয়াত্তা, ৪/৬৬৩পৃষ্ঠা, আযিমাবাদী, শরহে সুনানে আবি দাউদ, ১৩/১৩পৃষ্ঠা,দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ-১৪১৫ হিজরি।। 

আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী এক পর্যায়ে  আহলু সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে হক এভাবে লিখেন-
لِأَنَّ الْمَسْحَ ثَبَتَ بِالتَّوَاتُرِ وَاتَّفَقَ عَلَيْهِ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ
-‘‘নিশ্চয় (জুতার উপর মোজা) মাসেহ করা মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।’’  
➤ শাওকানী, নায়লুল আউতার, ১/২৩১পৃষ্ঠা, দারুল হাদিস, মিশর, প্রকাশ-১৪১৩হিজরি। 

আহলে হাদিস মোবারকপুরী (ওফাত.১৩৫৩হি.) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত সম্পর্কে তার কিতাবের এক স্থানে লিখেন-
الشيخ الجيلاني في الغنية: وأما الفرقة الناجية فهي أهل السنة والجماعة.
-‘‘বড় পীর হযরত শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (رحمة الله) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুনিয়াতুত-ত্বালেবীন’ এ লিখেন, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতই হলো একমাত্র নাযাতপ্রাপ্ত দল।’’  
➤ মোবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযি, ৭/৩৩২পৃষ্ঠা,ও মের‘আতুল মাফাতিহ, ১/২৭১পৃষ্ঠা,দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

ইমাম খতিবে বাগদাদী (رحمة الله) একজন রাবির গ্রহণযোগ্যতা ও সে সঠিক আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিল বলতে গিয়ে লিখেন-
وكان شيخا صالحا صدوقا من أهل السنة، معروفا بالخير،
-‘‘তিনি হাদিসের শায়খ ছিলেন, সৎ, সত্যবাদী, আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন, পরিচিত ভালো ব্যক্তি ছিলেন।’’ 
➤ খতিবে বাগদাদ, তারীখে বাগদাদ, ৪/২২পৃষ্ঠা, ক্রমিক:১২৩৩, দারুল গুরুবুল ইসলামি, বয়রুত, লেবানন।


আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকায়েদের ইমাম কে?

ইজতিহাদী ফিকহী শরিয়তের মাসআলার ক্ষেত্রে চার মাযহাবের যে কোনো ইমামের মতামতকে অনুসরণ করা অপরিহার্য। কিন্তু আক্বিদাগত ক্ষেত্রে সেটা ভিন্নতর। ১.ফাত্ওয়ায়ে শামীর মুকাদ্দামায় উল্লেখ আছে,
(عَنْ مُعْتَقَدِنَا) اَىْ عَمَّا نَعْتَقِدْهُ مِنْ غَيْرِ الْمَسَائِلِ الْفَرْعِيَّةِ مِمَّا يَجِبُ اِعْتَقَادْهُ عَلَه كُلِّ مُكَلَّفٍ بِلَا تَقْلِيْدٍ لِاَحْدٍ وَّهُوَ مَا عَلَيْهِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ وَهُمْ اْلاَشَاعِرَةُ وَالمَاتُرِيْدَّيَّةُ.
-‘‘শারয়ী  আনুষঙ্গিক মাসাইল ব্যতীত যে সব বিষয়ে আমরা বিশ্বাস রাখি এবং কারো অনুসরণ ছাড়াই যে সমস্ত বিষয়ে বিশ্বাস রাখাটা প্রত্যেক মুকাল্লাফ (বালিগ ও বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি) এর জন্য ওয়াজিব, সেগুলো হলো, ‘আকায়িদের সহিত সম্পৃক্ত বিষয়, যার ধারক ও বাহক হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। তারা হলেন ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) এবং ইমাম মাতুরীদি (رحمة الله)।’’  
➤ইবনে আবেদীন শামীঃ রুদ্দুল মুখতারঃ বহসে তাকলীদঃ ১/৩৬ পৃষ্ঠা।

২. এ বিষয়ে আরও কিছু ইমামদের মতামত নিম্নে দেয়া হলো- আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (رحمة الله) বলেন-
كَمَا حَكَاهُ أَبُو الْحسن الْأَشْعَرِيّ وَغَيره من أهل السّنة وَالْجَمَاعَة
-‘‘যেমন আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) বলেন এবং তার সাথে অন্যান্যগণ।’’  
➤ মোবারকপুরী, মের‘আতুল মাফাতিহ, ১/২৭৫পৃষ্ঠা, 

৩. ইমাম তকী উদ্দিন সুবকী (رحمة الله) {ওফাত.৭৭১হি.} বলেন-
إِمَام أهل السّنة وَالْجَمَاعَة أبي الْحسن الْأَشْعَرِيّ - رَضِي الله عَنهُ
-‘‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জা‘আমাতের আকায়েদের ইমাম হলো ইমাম আবুল হাসান আশআরী (رحمة الله)।’’  
➤ তকি উদ্দিন সুবকি, রফেউল হিজাব, ১/২৬৮পৃষ্ঠা, দারুল আলামুল কিতাব, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৯৯৯খৃ।

৪. ইমাম তাহতাবী (رحمة الله) বলেন-
والمراد بالعلماء هم أهل السنة والجماعة وهم أتباع أبي الحسن الأشعري وأبي منصور الماتريدي رضي الله عنهما
-‘‘ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) এবং তাঁর সহযোগী হযরত আবুল মনসুর (رحمة الله) এর আক্বিদার উপর যারা রয়েছেন।’’  
➤ তাহতাবী, মারাকিল ফালাহ ১/৯পৃষ্ঠা, দারুল আলামুল কিতাব, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ-১৪১৮হিজরি। 

৫. খাতেমাতুল মুহাক্কিকীন , ইমাম  ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) বলেন-
أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ وَهُمْ الْأَشَاعِرَةُ وَالْمَاتُرِيدِيَّةِ
-‘‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলতে আশ‘আরী এবং মাতুরীদী (মতবাদের অনুসরণ) কে বুঝায়।’’  
➤ ইবনে আবেদীন শামী, রুদ্দুল মুখতার, ১/৪৯পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

৬. এ ব্যাপারে আল্লামা যুবাইদি (رحمة الله) বলেন-
اذا اطلق السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ فالمراد به الأشاعرة والماتريديه
-‘‘যখন সাধারণভাবে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলা হয়, তখন আশআরী এবং মাতুরীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়।’’  
➤ আল্লামা যুবাইদি, ইত্তিহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, ২/৬পৃষ্ঠা,

৭. ইমাম ইবনে হাজার মক্কী হাইতমী (رحمة الله) বলেন-
إِمَام أهل السّنة وَالْجَمَاعَة الشَّيْخ أَبُو الْحسن الْأَشْعَرِيّ
-‘‘হযরত আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) হলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমাম।’’  
➤ইবনে হাজার মক্কী, ফাতওয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ, ১/৫২পৃষ্ঠা।

৮. ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (رحمة الله) বলেন-
إِمَامُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ الشَّيْخُ أَبُو الْحَسَنِ الْأَشْعَرِيُّ
-‘‘হযরত আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) হলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জাম‘আতের ইমাম।’’  
➤ ইমাম সুয়ূতী, আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ২/২৪১পৃষ্ঠা,

৯. তাফসিরে মাতুরীদির ভূমিকায় রয়েছে-
 الأشاعرة هم أهل السنة والجماعة 
-‘‘ইমাম আশআরী (رحمة الله)-এর আক্বিদা বা মতবাদে বিশ্বাসীরাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী।’’ ➤তাফসীরে মাতুরিদী, (ভূমিকা) ১/১৫৭পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ- ১৪২৬ হিজরি।।

মাযহাব অস্বীকারকারীরা কি আহলে সুন্নাহ 
ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী?

বর্তমানে নয় যুগযুগ ধরে অনেক বাতিল পন্থীরাও নিজেদেরকে আহলে সুন্নাহ বা হক পন্থী বলে দাবি করে আসছে। কিন্তু দেখতে হবে যে আহলে সুন্নাহের মূল নীতি অনুসারে সে আছে কিনা। এ কয়েক শতাব্দী ধরে একটি ফিতনা খুব প্রবল বেগে গজিয়ে উঠছে তাদের নাম আহলে হাদিস। তারাও সুযোগ বুঝে নিজেদেরকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী বলে দাবি করে। কিন্তু আক্বিদা ও মূল নীতির ক্ষেত্রে তারা আহলে সুন্নাহ এর ধারেকাছেও নেই। তারা চার মাযহাব মানাকে অস্বীকার করে, অথচ অতীতের অসংখ্য উলামায়ে কেরামগণ একমত পোষণ করেছেন যে, চার মাযহাবকে অস্বীকারকারী আহলে সুন্নাহ থেকে খারিজ বা বাতিল পথভ্রষ্ট। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (رحمة الله) বলেন-
هُوَ مَذْهَب الْأَئِمَّة الْأَرْبَعَة وَغَيرهم من أهل السّنة وَالْجَمَاعَة
-‘‘চার মাযহাবের মুজতাহিদ ইমামগণ এবং অন্য মুজতাহিদ ফকিহ ইমামদের মাযহাব হলো আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত।’’  
➤আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ২/২৩৮পৃষ্ঠা।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন-
 وَمَذْهَبِ الْحَنَفِيَّةِ مِنْ جُمْلَةِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ،  
-‘‘হানাফী মাযহাব হলো আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অর্ন্তভুক্ত।’’  
➤মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাতুল মাফাতিহ, ৮/৩৩৭৪৮পৃষ্ঠা, হা/৫৩৭৬ এর আলোচনা।

তাই বুঝা গেল যারা মাযহাব অস্বীকার করে তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী নয়; বরং সে পথভ্রষ্ট। এ প্রসঙ্গে ইমাম সাভী সূরা কাহাফ আয়াত ২৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
وَلَا يَجُوْزُ تَقْلِيْدُ مَا عَدَا الْمَذَهِبِ الْاَرْبَعَةِ وَلَوْ وَافَقَ قَوْلَ الصَحَّابَةِ وَالْحَدِيْثِ الصَّحِيْحِ وَالْاَيَةِ فَالْخَارِجُ عَنِ الْمَذَاهِبِ الْاَرْبَعَةِ ضَالٌّ مُضِلٌّ وَرُبَمَا اَدَّاهُ ذَالِكَ اِلَي الْكُفْرِ لِاَنَّ الْاَخْذَ بِظَوَاهِرِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنْ اُصُوْلِ الْكُفْرِ 
-‘‘চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাকলীদ বা অনুসরন জায়েয নয়। যদিও  সে মাযহাব সাহাবিদের উক্তি, সহীহ হাদীস ও কুরআনের আয়াতের সহিত সাঙ্গতি পূর্ণ হয়। যে এ চার মাযহাবের কোন একটির অনুসারী নয়, সে পথভ্রষ্ট এবং পথ ভ্রষ্টকারী। কেননা হাদিস ও কুরআনের কেবল বাহ্যিক অর্থ গ্রহণই হলো কুফরীর মূল।’’  
➤ইমাম সাভী : তাফসীরে সাভী : ৪/১৫পৃষ্ঠা,

তাই মাযহাবের প্রত্যেক ইমামকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বিদা। আজ পর্যন্ত কোন মুজতাহিদই বলেননি যে তারা ভুল করেছেন। তবে ডা. জাকির নায়েক বলে,‘‘আমি জানি সব মানুষই ভুল করতে পারেন। ইমাম আবু হানিফা ভুল করেছেন, ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) ভুল করেছেন, ইমাম মালেক ও ইমাম হাম্বলী (র)-ও ভুল করেছেন।’’  
➤ জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ৫/৯২পৃষ্ঠা, পিস পাবলিকেন্স, কম্পিউটার মার্কেট, বাংলাবাজার, ঢাকা।

ইমাম তাহাবী (رحمة الله) {৩২১হি.}আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা বর্ণনা করেন-
وَعُلَمَاءُ السَّلَفِ مِنَ السَّابِقِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ التَّابِعِينَ أَهْلِ الْخَيْرِ وَالْأَثَرِ وَأَهْلِ الْفِقْهِ وَالنَّظَرِ لَا يُذْكَرُونَ إِلَّا بِالْجَمِيلِ وَمَنْ ذَكَرَهُمْ بِسُوءٍ فهو على غير السبيل
-‘‘পূর্ববর্তী যুগের ‘সালাফে সালিহীন’ (নেককার পূর্ববর্তীগণ) ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তীকালের কল্যাণময় আলেমগণ, মুহাদ্দিস ও হাদিস অনুসারীগণ এবং ফকীহ-মুজতাহিদ ও ফিকহ-অনুসারীগণ, তাদের সকলকেই যথাযোগ্য সম্মান ও প্রশংসার সাথে স্মরণ ও উল্লেখ করতে হবে। আর যে ব্যক্তি তাঁদের সম্পর্কে কূটুক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করে সে ভ্রান্ত পথের অনুসারী।’’
➤ইমাম তাহাবী, আকিদাতুত তাহাবী, (শুধু মতন), ১/৮২পৃষ্ঠা, ক্রমিক:৯৭।

তাই ডা. জাকির নায়েকও সেই ভ্রান্ত পথের অনুসারী হয়েছেন চার মাযহাবের ইমামসহ অন্যান্য বুযর্গদের সমালোচনা করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তৃতীয় অধ্যায়ঃ
আল্লাহ সম্পর্কে কিছু গূরুত্বপূর্ণ আহলে সুন্নাহ 
ওয়াল জামাতের আক্বিদা

আল্লাহ তা‘য়ালার কী সৃষ্টির মত আকৃতি রয়েছে ?

আল্লাহ আকার আকৃতি হতে মুক্ত-এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা, কেননা আকার আকৃতি থাকলে কেমন তার অবকাশ রাখে। মানুষ বা সৃষ্টি শুনতে কান, দেখতে চোখের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু স্রষ্টার জন্য মানুষের বা সৃষ্টির মত কোন কিছুই প্রয়োজন পড়ে না। স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা দেয়া কুফুরী। ইমাম তাহাভী (رحمة الله) বলেন-
وَمَنْ وَصَفَ اللَّهَ بِمَعْنًى مِنْ مَعَانِي الْبَشَرِ فَقَدْ كُفر
-‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘য়ালাকে মানবীয় গুণাবলী হতে কোন গুণের দ্বারা গুণান্বিত করবে সে কাফির।’’  
➤ তাহাবী, আকিদাতুত তাহাভী, ৪১ পৃষ্ঠা, আক্বিদা নং ৩৪, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৪হিজরি।

ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) বলেন- 
لَا يشبه شَيْئا من الْأَشْيَاء من خلقه وَلَا يُشبههُ شَيْء مِنْ خلقه-
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর সৃষ্টির কোন বস্তুর মত নন, এমনকি তিনি কোনো সৃষ্টির মত নন।’’  
➤ ইমাম আবু হানিফা, আল-ফিকহুল আকবার, ১৪ পৃষ্ঠা।

ইমাম কুরতুবী (رحمة الله) বলেন- 
لَا يُشْبِهُ شَيْئًا مِنْ مَخْلُوقَاتِهِ وَلَا يُشْبَّهُ بِهِ
-‘‘সৃষ্টির কিছুই আল্লাহর সাথে সাদৃশ্য নেই, এবং তিনিও কারও সদৃশ নন।’’  
➤ ইমাম কুরতুবী, তাফসীরে কুরতুবী, ১৬/৮পৃষ্ঠা, মাকতুবাতুল মিসরিয়্যাহ, কাহেরা, মিশর, প্রকাশ- ১৩৮৪হিজরি।

মি‘রাজে আল্লাহ্কে নবিজি দেখেছেন-তা সত্য; কিন্তু তিনি কোন আকৃতির কথা বর্ণনা করেননি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে আকরাম (رحمة الله) ইরশাদ করেন-
رَأَيْت رَبِّي عَزَّوَجَلَّ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ 
-‘‘আমি আমার রব আল্লাহ তা‘য়ালাকে দেখেছি, তবে তার সাথে (সৃষ্টির) কোন সদৃশ্য বা তুলনা নেই।’’  
➤ দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ২/২৫৪পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৩১৮৩।

মহান রব তা‘য়ালা ইরশাদ করেন-
 لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ-
‘‘তাঁর কোন দৃষ্টান্ত তথা উপমা নেই।’’ 
➤ সুরা আশ-শুরা, আয়াত ১১

ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) বলেন-
فَإِنَّ الَّذِي يَجِبُ عَلَيْنَا وَعَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ أَنْ يَعْلَمَهُ: أَنَّ رَبَّنَا لَيْسَ بِذِي صُورَةٍ وَلَا هَيْئَةٍ، فَإِنَّ الصُّورَةَ تَقْتَضِي الْكَيْفِيَّةَ وَهِيَ عَنِ اللَّهِ وَعَنْ صِفَاتِهِ مَنْفِيَّةٌ
-‘‘নিশ্চয় আমাদের ও সকল মুসলমানের জানা অত্যাবশ্যক যে, আমাদের প্রভু আকৃতি ও অবয়ব বিশিষ্ট নহেন। কেননা, আকৃতি (الْكَيْفِيَّةَ) তথা ‘কেমন’ এর চাহিদা রাখে। অথচ কেমন প্রশ্নটি আল্লাহ ও তাঁর গুণবলীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’’  
➤ ইমাম বায়হাকী, কিতাবুল আসমা ওয়াল সিফাত, ২/৬৬পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৬৪১, মাকতুবাতুল সৌদিয়া, জেদ্দা, প্রথম প্রকাশ- ১৪১৩হিজরি।

ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) আরও বলেন-
وَلَا يَجُوزُ أَنْ يَكُونَ الْبَارِي تَعَالَى مُصَوَّرًا وَلَا أَنْ يَكُونَ لَهُ صُورَةٌ، لِأَنَّ الصُّورَةَ مُخْتَلِفَةٌ
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালার জন্য আকৃতি আছে ধারণা করা বৈধ নয়, কেননা তার কোন আকৃতি নেই। আর তাঁর আকৃতি হলো স্বতন্ত্র।’’  
➤ ইমাম বায়হাকী, কিতাবুল আসমা ওয়াল সিফাত, ২/৬০পৃষ্ঠা, মাকতুবাতুল সৌদিয়া, জেদ্দা, প্রথম প্রকাশ- ১৪১৩হিজরি।

ইমাম কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম (رحمة الله) বলেন-
فَلَيْسَ سبحانه بذى لون و لارائحة ولاصورة ولاشكل
-‘‘মহান আল্লাহ রং, গন্ধ, আকৃতি এবং অবয়ব বিশিষ্ট নন।’’  
➤ ইমাম কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম, আল-মুসাইরাত, ২১৮পৃষ্ঠা।

ইমাম আবুল মানসুর মাতুরীদি (رحمة الله) বলেন-
وليس بجسم، ولا شبه، ولا جثة، ولا صورة، ولا لحم، ولا دم، ولا شخص ولا جوهر ولا عرض،.....
-‘‘মহান আল্লাহ দেহ, কোনো সৃষ্টির সাদৃশ্য, দেহ বা শরীর, আকৃতি, মাংসবহুল, রং, বড় দেহ বিশিষ্ট, বস্তু/পদার্থ, প্রার্শ্ব, এমনকি নেই কোন সাদৃশ, আকৃতি গোস্ত, .....এগুলো থেকে পবিত্র।’’  
➤ইমাম মাতুরীদি, তাফসীরে মাতুরীদি, ১/১৩৫পৃষ্ঠা,

ইমাম মাতুরীদি (رحمة الله) আরও বলেন-
لا تشبه صفاته صفات المخلوقين، ولا اشتبهت صفات الخلق صفاته
-‘‘মহান আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীর মধ্যে তাঁর কোন সৃষ্টির গুণাবলীর সাদৃশ্য নেই।’’ 
➤ইমাম মাতুরীদি, তাফসীরে মাতুরীদি, ৮/২৬৭পৃষ্ঠা,

তাই বুঝা গেল আল্লাহকে কোন আকৃতি দ্বারা ব্যাখ্যা করলে, প্রশ্নের অবকাশ রাখে যে তাহলে তার আকৃতি কীসের মত তাই বলা যাবে না। এ বিষয়ে ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম নুয়াইম বিন হাম্মাদ (رحمة الله) বলেন-
قَالَ الْأَئِمَّةُ -مِنْهُمْ نُعَيْم بْنُ حَمَّادٍ الْخُزَاعِيُّ شَيْخُ الْبُخَارِيِّ -: مَنْ شَبَّهَ اللَّهَ بِخَلْقِهِ فَقَدْ كَفَرَ
-‘‘তিনি বলেন, যে মহান আল্লাহকে তার সৃষ্টির সাথে তুলনা/সাদৃশ্য করবে সে কাফির।’’  
➤ইবনে কাসির, তাফসীরে ইবনে কাসির, ৩/৪২৭।

পবিত্র কুরআনে কোন কোন স্থানে মহান রব তার যে অঙ্গ উল্লেখ করেছেন তা মূলত তার গুণবলীকে বুঝানো হয়েছে; তাই তার সরাসরি অর্থ এখানে গ্রহণ করা হবে না। এ প্রসঙ্গে হাদিসের এবং আক্বায়েদের অন্যতম ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বলেন-
أَنْ تَكُونَ الصُّورَةُ بِمَعْنَى الصِّفَةِ-‘‘কোনো ক্ষেত্রে যদি আকৃতি প্রকাশের কথা আসে তা হবে তাঁর সিফাত বা গুণবলী।’’ ➤ ইমাম বায়হাকী, কিতাবুল আসমা ওয়াল সিফাত, ২/৬৬পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৬৪১, মাকতুবাতুল সৌদিয়া, জেদ্দা, প্রথম প্রকাশ- ১৪১৩হিজরি।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
أَنَّ الْمُرَادَ بِالصُّورَةِ الصِّفَةُ وَإِلَيْهِ مَيْلُ الْبَيْهَقِيّ
-‘‘(অনেকের মতে-উপর্যুক্ত হাদিসে) ‘আকার’ দ্বারা ‘সিফাত’ (গুণ)ই উদ্দেশ্য। এ মতের দিকেই ইমাম আবু বকর আল-বাইহাকী (رحمة الله)-এর ঝোঁক রয়েছে।’’  
➤ ইমাম ইবনে হাজার, ফতহুল বারী, ১৩/৪২৭পৃষ্ঠা,

তিনি আরও উল্লেখ করেন-
قَالَ الْقُرْطُبِيُّ الْمُرَادُ بِالصُّورَةِ الصِّفَةُ
-‘‘ইমাম কুরতবী (رحمة الله) বলেন, এখানে আল্লাহর আকৃতি বলতে গুণই বুঝানো হবে।’’  
➤ ইমাম ইবনে হাজার, ফতহুল বারী, ১১/৪১৩পৃষ্ঠা,

ইমাম নববী (رحمة الله) ইমাম কাযি আয়্যায (رحمة الله) এর বরাতে উল্লেখ করেন-
لَا يَجُوزُ عَلَيْهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى التَّجَسُّمُ
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালার জন্য দেহাবয়ব আছে ধারণা করা বৈধ নয়।’’ 
➤ ইমাম নববী, শরহে সহীহ মুসলিম, ১৫/২৫পৃষ্ঠা,

আল্লাহর আকৃতিতে আদম (عليه السلام) কে বানানো প্রসঙ্গ

আমাদের সমাজের কিছু বাউল ও সাধারণ মুসলমানের ধারণা এরূপ। প্রকৃতপক্ষে এরূপ ধারণা রাখা বৈধ নয়; বরং এটি বাতিল পন্থীদের আক্বিদা। ইমাম ত্বাহাভী (رحمة الله) তার আক্বিদাতুত ত্বাহাভীর ভূমিকায় বলেন-
المرجئة يقولون ان الله خلق ادم على صورته والعرش مكان لله-
-‘‘ফিরকায়ে মুর্জিয়া সম্প্রদায় বলে, নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে তার আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। আরশ হল আল্লাহর স্থান।’’ আমাদের সমাজে এখন বহু লোক এ হাদিসটি অনেক সময় বলে থাকেন যে,  خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ عَلَى صُورَتِهِ‘আল্লাহ আদম (عليه السلام) কে তাঁর স্বীয় ছুরতে (আকৃতিতে) সৃষ্টি করেছেন।’  
➤মিশকাতুল মাসাবীহ, কিতাবুল আদাব, বুখারি ও মুসলিম শরিফের সূত্রে। 

এই হাদিসের প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা মূলত গোমরাহী ছাড়া আর কিছু নয়। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (رحمة الله) বলেন-
وَقد يُقَال: هُوَ عَائِد إِلَى الله تَعَالَى، لَكِن الصُّورَة هِيَ الْهَيْئَة وَذَلِكَ لَا يَصح إلاَّ على الْأَجْسَام، فَمَعْنَى الصُّورَة الصّفة كَمَا يُقَال: عرفني صُورَة هَذَا الْأَمر أَي: صفته، يَعْنِي: خلق آدم على صفته أَي حَيا عَالما سميعاً بَصيرًا متكلماً
-‘‘এ ব্যাখ্যাও করা যায় যে, عَلَى صُورَتِهِ এর ه সর্বনামটি الله এর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী কিন্তু ছুরত অর্থ আকৃতি। আর এমন অর্থ জিসিম বা শরীর ব্যতীত প্রয়োগ হয় না। তাই এখানে الصُّورَة  শব্দটি الصّفة বা গুণ অর্থে ব্যবহৃত। যেমন আরবীতে বলা হয়- عرفني صُورَة هَذَا الْأَمر (এ বিষয়ে ছুরত আমাকে অবগত করুন) বক্তব্যটিতেالصُّورَة শব্দটি গুণ অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ আদমকে আল্লাহর গুণে সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ আদমকে আল্লাহর গুণ জীবিত, জ্ঞানী, শ্রবণকারী, দৃষ্টিসম্পন্ন এবং বক্তা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’  
➤আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ২২/২২৯পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৬২২৭

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-
)خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ عَلَى صُورَتِهِ ) أَيْ: عَلَى صُورَتِهِ الَّتِي اسْتَمَرَّ عَلَيْهَا إِلَى أَنْ أُهْبِطَ، وَإِلَى أَنْ مَاتَ دَفْعًا لِتَوَهُّمِ أَنَّ صُورَتَهُ كَانَتْ فِي الْجَنَّةِ عَلَى صِفَةٍ أُخْرَى-
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা আদম (عليه السلام) কে ঐ আকৃতিতেই সৃষ্টি করেছেন যে আকৃতির উপর তাকে জান্নাত হতে জমিনে অবতরণ করা হয় এবং ইন্তিকাল পর্যন্ত ছিলেন। জান্নাতে তাঁর আকৃতি অন্য রকম ছিল, এমন সন্দেহকে দূর করার জন্য এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।’’  
➤মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাতুল মাফাতীহ, ৭/২৯৩৫পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৪৬২৮, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।

কিন্তু বিজ্ঞ আকায়েদবিদগণের মতে-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা দিক, কাল, গতি, স্থিতি, আকার-আকৃতির এবং যাবতীয় অঘটন থেকে পবিত্র। (মুসামের, ৩১পৃ. মাসায়েরা, ৩৯৩পৃ. বাহারে শরীয়ত, প্রথম খন্ড) 

আল্লাহকে স্বশরীরে সর্বত্র বিরাজমান আক্বিদা রাখা প্রসঙ্গ

আল্লাহকে সর্বত্র হাযির বলা যাবে না এবং আহলে হাদিসদের মতো আল্লাহ আরশে আযীমে সমাসীনও বলা যাবে না। কেননা আল্লাহ স্থান কাল থেকে মুক্ত। মহান আল্লাহ সমস্ত জগত বেষ্টন করে রয়েছে। অনেকে রাসূল (ﷺ) কে হাযির নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন হাযির-নাযির আল্লাহর গুণ। কিন্তু আহলে হাদিসদেরই মাযহাব আল্লাহ সব জায়গায় হাযির-নাযির নন; বরং আরশে সমাসীন; কিন্তু রাসূল (ﷺ)‘র হাযির-নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে তাদের নিজস্ব মতবাদ ভুলে যান। আর দেওবন্দীরা তাদের বিভিন্ন আক্বায়েদের কিতাবে লিখে থাকেন যে, আল্লাহ স্থান, কাল, আকার, আকৃতি থেকে মুক্ত। কিন্তু রাসূল (ﷺ)‘র হাযির-নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে তারা আবার বেঁকে বসে এবং মুতাযিলা ও ক্বাদারিয়া ফিরকার আক্বিদা পোষণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তারও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী বলে দাবী করে। ইমাম জুরজানী (رحمة الله) বলেন-  أََنَّهُ تَعَالَى لَيْسَ فِي جِهَة، وَلَا فِي مَكَان. 
-‘‘মহান আল্লাহ কোনো দিকে বা স্থানে নন।’’  
➤ইমাম জুরজানী, শরহুল মাওয়াকিফ, ২/৫১-৫২পৃষ্ঠা, সাফর বিন আবদুর রাহমান আল-হাওলী, মিনহাজুল আশাইরাহ, ৭৯পৃষ্ঠা, (শামিলা)

ইমামে আহলে সুন্নাহ আবূ মানসূর মাতুরিদী {ওফাত.৩৩৩হি.} বলেন- 
وَقَالَت القَدَرِية وَ الْمُعْتَزِلَة اَنَّ اللهَ تَعَالى فِى كُل مَكَان
-‘‘‘মুতাযিলা ও কাদারিয়াগণ বলেন, আল্লাহ সব স্থানে উপস্থিত।’’  
➤ইমাম মাতুরিদী, শরহুল ফিকহুল আকবার, ১৯পৃষ্ঠা,

ইমাম ইবনে জারীর আত্-তবারী (رحمة الله) বলেন-
لَا يَتَمكن فِي كُلّ مَكَان.
-‘‘তিনি কোনো (নির্দিষ্ট) স্থানে নন।’’  
➤ইমাম তবারী, তাফসীরে তবারী, ৬/২১০পৃষ্ঠা,

ইমাম কুরতুবী আন্দুলুসী (رحمة الله) বলেন-
وَأَنَّهُ فِي كُل مَكَان بِعِلْمِهِ
-‘‘নিশ্চই মহান রবের জ্ঞান সকল স্থানে উপস্থিত।’’ 
➤ইমাম কুরতুবী, হিদায়া ইলা বুলুগুল নিহায়া, ১/১২পৃষ্ঠা,

শায়খ আহমাদ বিন উমর মাসআদ হাযামী তার  شَرْحِ كِتَابُ الْتَوْحِيْد কিতাবের ৫৩/৮পৃষ্ঠায় (শামিলা) উল্লেখ করেন- 
اِعْتَقَد أَنَّ اللهَ تَعَالى فِي كُل مَكَان هَذَا كُفْرٌ أَكْبَرْ
-‘‘কেউ যদি আক্বিদা রাখে আল্লাহ সবখানে (হাযির-নাযির) এই ধারণা কুফুরে আকবার।’’ ইমামে আহলে সুন্নাহ আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) {ওফাত. ৩২৪হি.} তার الإبانة عن أصول الديانة গ্রন্থের ১০৯ পৃষ্ঠায় (যা দারুল আনসার, কায়রু মিশর হতে ১৩৯৭ হিজরীতে প্রকাশিত) লিখেন-
وزعمت المعتزلة والحرورية والجهمية أن الله تعالى في كل مكان
-‘‘মুতাযিলা, হারুরিয়াহ এবং জাহমিয়্যাহ বাতিল ফিরকার লোকেরা বিশ্বাস করে আল্লাহ সকল স্থানে (হাযির-নাযির) আছেন।’’ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله)-এর ছেলে ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ হাম্বল (ওফাত. ২৪১হি.) তিনি তার  الرد على الجهمية والزنادقة কিতাবের ১১৪পৃষ্ঠায় এ আক্বিদা পোষণ কারীদের খন্ডনে একটি শিরোনাম করেন এ নাম দিয়ে-
الرد على الجهمية في زعمهم أن الله في كل مكان
-‘‘আল্লাহ সকল স্থানে (হাযির-নাযির) আছেন জাহমিয়্যাহ ফিরকার বাতিল আক্বিদার খন্ডন।’’ জাহমিয়্যাহ ফিরকার মতে, ইবাদত করা হয় এমন কোন ইলাহ আসমানে নেই। আল্লাহ তা‘য়ালা সত্তাগতভাবে জগতের সর্বত্র বিদ্যমান রয়েছেন। 
➤ ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাহ, ৩/১৯৪পৃষ্ঠা, ইবনু কুদামাহ, ইছবাতু সিফাতিল ‘উলুয়ি, ১১৮পৃষ্ঠা,

একদা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উস্তায ইমাম সা‘ঈদ ইবনু ‘আমির আদ-দুবাঈ (ওফাত.২০৮হি.)-এর নিকট একবার জাহমিয়্যাদের কথা উঠলো। তখন তিনি বললেন-
الْجَهْمِيَّةُ أَشَرُّ قَوْلًا مِنَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى
-‘‘তারা তো ইয়াহুদী-খৃস্টানদের চাইতেও নিকৃষ্ট কথা বলে।’’ 
➤ ইমাম বুখারী, খালকু আফ‘আলিল ইবাদ, ৩০পৃ, যাহাবী, আল-‘উলুয়ু, ১৫৮পৃষ্ঠা,

ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার এক কিতাবে লিখেন-
مَنْ قَالَ بَأَنَّ اَلله بِذَاتِه فِي كُلِّ مَكَان فَهُوَ مُخَالِف لِلْكِتَاب ِوَالسُّنَّة وَإِجْمَاع سَلْف اَلأِمَّة
-‘‘যে ব্যক্তি বলবে মহান রব সত্ত্বাগতভাবে সর্বত্র তাহলে তা হবে কিতাবুল্লাহ, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী উম্মতের আক্বিদার বিপরীত।’’  
➤ যাহাবী, কিতাবুল আরশ, ১৮২পৃষ্ঠা,

তিনি তার আরেক গ্রন্থে লিখেন-
وأما قول العامة وكثير من الخاصة الله موجود فى كل مكان أو فى كل الوجود ويعنون بذاته فهو ضلال بل هو مأخوذ من القول بوحدة الوجود الذى يقول به غلاة الصوفية الذين لا يفرقون بين الخالق والمخلوق
-‘‘ ‘আল্লাহ সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিদ্যমান’- সর্বসাধারণ ও বহু বিশিষ্টজনের এরূপ কথা ভ্রান্ত। বস্তুতপক্ষে তা চরমপন্থী অদ্বৈতবাদী সূফীদের ‘ওয়াহদাতুল ওয়াজূদ’- এর বক্তব্য থেকেই গৃহীত।’’ 
➤ যাহাবী, আল-‘উলুউ, পৃষ্ঠা, ১৭৪

হাকিমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমাদ ইয়ার খঁান নাঈমী (رحمة الله) লিখেন-
خدا كو هر جگہ ماننا بے دينى هے
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালাকে প্রত্যেক যায়গায় আছে মনে করা অধার্মিকতারই নামান্তর।’’ 
➤মুফতি আহমদ ইয়ার খঁান, জ্বা‘আল হক, ১/১৫৩পৃষ্ঠা, (উর্দু)

অনেকে বলতে পারেন মহান আল্লাহ তা‘য়ালা তো বলেছেন যে-
وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ
-‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সাথেই আছেন।’’ (সূরা হাদীদ, ৪) প্রকৃতপক্ষে এখানে মহান রব তার জ্ঞান সকলের সাথে আছে তাই বুঝিয়েছেন। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
وَأخرج الْبَيْهَقِيّ فِي الْأَسْمَاء وَالصِّفَات عَن سُفْيَان الثَّوْريّ رَضِي الله عَنهُ أَنه سُئِلَ عَن قَوْله: {وَهُوَ مَعكُمْ} قَالَ: علمه
-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) তাঁর ‘আসমাউ ওয়াল সিফাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম সুফিয়ান সাওড়ী (رحمة الله) কে এই আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আল্লাহর জ্ঞান তোমাদের সাথে আছে তা মহান রব বুঝিয়েছেন।’’  
➤ ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৯পৃষ্ঠা, আলূসী, তাফসিরে রুহুল মা‘আনী, ২০/৩০৫পৃষ্ঠা, ইমাম বায়হাকী, আসমাউ ওয়াল সিফাত, ২/৪৪৮পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৮৭০

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) বলেন- وقدرته وعلمه في كل مكان -‘‘আল্লাহর কুদরত (ক্ষমতা) এবং জ্ঞান সর্বত্র উপস্থিত।’’  
➤ইমাম লালকায়ী, ই‘তিক্বাদে আহলে সুন্নাহ, ৩/৪০১পৃষ্ঠা,

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
أخرج ابْن أبي حَاتِم عَن ابْن عَبَّاس فِي قَوْله: {وَهُوَ مَعكُمْ أَيْن مَا كُنْتُم} قَالَ: عَالم بكم أَيْنَمَا كُنْتُم
-‘‘ইমাম আবু হাতেম (رحمة الله) সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত।’’  
➤ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৯পৃষ্ঠা, আলূসী, তাফসিরে রুহুল মা‘আনী, ২০/৩০৫পৃষ্ঠা,

বিশিষ্ট মুফাসসির মুকাতিল ইবনু হাইয়ান (১৫০হি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
يَعْنِي قدرته وسلطانه وَعلمه مَعكُمْ إينما كُنْتُم
-‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তোমরা তাঁর (আল্লাহর) কুদরাত, প্রতিপত্তি ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির মধ্যেই রয়েছো।’’  ➤ ইমাম বায়হাকী, আসমাউ ওয়াল সিফাত, ২/৪৪৬পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৮৬৮, আবু হাইয়্যান, আল-বাহরুল মুহীত, ৮/২১৭পৃষ্ঠা, ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৪৮পৃষ্ঠা,

আবার অনেকে বলতে পারেন মহান রব পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন-
مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوى ثَلاثَةٍ إِلاَّ هُوَ رابِعُهُمْ
-‘‘তোমার কোন স্থানে যদি তিনজন থাক চতুর্থজন হিসেবে তিনি (মহান আল্লাহ) থাকেন।’’(সূরা মুজাদালাহ, ৭) 
তাই অনেকে বলে থাকেন মহান রব সকলের সাথেই আছেন। ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী (رحمة الله) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
بِمَعْنَى أَنَّهُ مُشَاهِدُهُمْ بِعِلْمِهِ
-‘‘তাঁর (আল্লাহর) ইলমের মাধ্যমে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করেন।’’ 
➤ ইমাম তাবারী, জামি‘উল বায়ান ফী তা‘ভীলিল কুর‘আন, ২২/৪৬৮পৃষ্ঠা,

ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) তাবেয়ী যাহ্হাক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন- وَعلمه مَعَهم -‘‘তাঁর জ্ঞান তোমাদের (চতুর্থজন হিসেবে) সকলের সাথে আছে।’’  
➤ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মানছুর, ৮/৭৯পৃষ্ঠা,

ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন-
وَفِيمَا كَتَبْنَا مِنَ الْآيَاتِ دَلَالَةٌ عَلَى إِبْطَالِ قَوْلِ مَنْ زَعَمَ مِنَ الْجَهْمِيَّةِ أَنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى بِذَاتِهِ فِي كُلِّ مَكَانٍ، وَقَوْلُهُ عَزَّ وَجَلَّ {وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا  كُنْتُمْ} [الحديد: ৪] ، إِنَّمَا أَرَادَ بِهِ بِعِلْمِهِ لَا بِذَاتِهِ
-‘‘আমরা যে সব আয়াত লিপিবদ্ধ করেছি তা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, জাহমিয়্যাদের মধ্যে যারা মনে করে যে, আল্লাহ তা‘য়ালা সত্তাগতভাবে প্রত্যেক স্থানে বিদ্যমান রয়েছেন-তা অমূলক। ‘তিনি তোমাদের সাথেই থাকেন, তোমরা তোমরা যেখানেই থাকনা কেন’ (সূরা হাদিদ, ৪)- আল্লাহ তা‘য়ালার এ কথাটিতে তাঁর জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে; তাঁর সত্তাকে নয়।’’  
➤ইমাম বায়হাকী, আল-ই‘তিকাদ, ১১৪ পৃষ্ঠা,

বিশিষ্ট মুফাসসির আবূ হাইয়ান আল-আন্দালুসী  (ওফাত.৭৪৫হি.) এবং আল্লামা মাহমুদ আলূসী (رحمة الله) এই আয়াতের তাফসিরে লিখেন-
وَهَذِهِ آيَةٌ أَجْمَعَتِ الْأُمَّةُ عَلَى هَذَا التَّأْوِيلِ فِيهَا، وَأَنَّهَا لَا تُحْمَلُ عَلَى ظَاهِرِهَا مِنَ الْمَعِيَّةِ بِالذَّاتِ
-‘‘এ আয়াতের উক্ত ব্যাখ্যায় ব্যাপারে উম্মাতের সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ (অর্থাৎ প্রত্যেক কিছুর সাথে সত্তাগতভাবে আল্লাহর বিদ্যমান থাকা) উদ্দেশ্য নয়।’’ 
➤ইমাম আবূ হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহীত, ১০/১০১পৃষ্ঠা, আলূসী, রুহুল মা‘আনী, ১৪/১৬৮পৃষ্ঠা,

এজন্যই বড়পীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) তার কিতাবে বলেন-
وَلَا يُجَوزُ وَصفة بأنه فى كُل مكان
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা সর্বজায়গায় বিদ্যমান-এরূপ কথা বলা জায়েয নয়।’’ (আল-গুনিয়াতু লি তালিবী তারীক্বিল হাক্ব, পৃ. ৫৪-৫৭, ইমাম যাহাবী, কিতাবুল আরশ, ১৫৪পৃ.)

আল্লাহকে আরশে সমাসীন বলা প্রসঙ্গ

যারা আল্লাহকে আরশে সমাসীন বলেন তারাও পথভ্রষ্ট। তার কারণ আল্লাহর কোন সৃষ্টি তাকে ধারণ করতে সক্ষম নয়। মহান রব তা‘য়ালা ইরশাদ করেন-
إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطٌ
-নিশ্চয়ই মহান রব সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।’’ (সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত ৫৪)
ইমাম ত্বাহাবী (رحمة الله) বলেন-
مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ وَقَدْ أَعْجَزَ عَنِ الإحاطة خلقه
-‘‘প্রত্যেক বস্তুই তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আর সৃষ্টিকুল তাঁকে পরিবেষ্টনে অক্ষম।’’  ➤ইমাম তাহাভী, আক্বিদাতুল তাহাভী, ৫৬পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৫১, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৪হিজরি।

আরশ আল্লাহর সৃষ্টি তাই তাকে পরিবেষ্টনে সে অক্ষম। 
আর এজন্যই আল্লাহ তায়ালার একটি নামই হল মুহিত বা পরিবেষ্টনকারী। ইমাম ত্বাহাভী (رحمة الله) তাঁর এ কিতাবের অন্যত্র বলেন-
لَيْسَ فِي مَعْنَاهُ أَحَدٌ من البرية وَتَعَالَى عَنِ الْحُدُودِ وَالْغَايَاتِ وَالْأَرْكَانِ وَالْأَعْضَاءِ وَالْأَدَوَاتِ لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات  
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালার গুণে সৃষ্টি জগতের কেহ নেই। তিনি সীমা, পরিধি, অঙ্গপ্রতঙ্গ এবং উপাদান উপকরণের ঊর্ধ্বে। সৃষ্টি জগতের ন্যায় ছয় দিকের কোন দিক তাকে বেষ্টন করতে পারে না।’’ 
➤ইমাম তাহাভী, আক্বিদাতুত তাহাভী, ৪৪পৃষ্ঠা, ক্রমিক: ৩৮, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ- ১৪১৪হিজরি।

বর্তমান লা-মাযহাবি তথা আহলে হাদিসরা যারা মাজার জিয়ারত, মিলাদুন্নবীসহ পালন এ ইত্যাদি সুন্নত আমলকে শিরক বলে বেড়ায় অথচ তারা মহান আল্লাহর ব্যাপারে শিরকী আক্বিদা পোষণ করে যে রব তা‘য়ালা আরশে সমাসীন আর সেখান থেকে তিনি সব কিছু দেখেন শুনেন।

আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন ধারণা রাখা প্রসঙ্গ

মহান আল্লাহর প্রত্যেক কিছুই সুন্দর ও কামালিয়াতের প্রাণকেন্দ্র। তিনি দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত অর্থাৎ তাঁর মধ্যে দোষ ত্রুটি পাওয়া যাওয়াটা অসম্ভব। এমনি ‘পরিপূর্ণও নয়, ত্রুটিপূর্ণও নয়’-এ রকমের হওয়াটা অসম্ভব। যেমন মিথ্যা, ধোঁকাবাজী, ওয়াদাভঙ্গ, অত্যাচার, অজ্ঞতা, নির্লজ্জতা ইত্যাদি দোষ তাঁর থেকে প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব। দেওবন্দীদের মত ‘আল্লাহ মিথ্যা বলার ক্ষমতা রাখে’- এ রকম বলা মানে কুদরতের দুর্বলতা মানে বাতুলতা মাত্র। আর এ ধরনের কেউ বিশ্বাস পোষণ করলে সে কাফির হয়ে যাবে। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (رحمة الله) বলেন- 
 مِنْ صِفَاتِ كَلِمَةِ اللَّهِ كَوْنُهَا صِدْقًا وَالدَّلِيلُ عَلَيْهِ أَنَّ الْكَذِبَ نَقْصٌ وَالنَّقْصُ عَلَى اللَّهِ مُحَالٌ وَلَا يَجُوزُ إِثْبَاتُ أَنَّ الْكَذِبَ عَلَى اللَّهِ مُحَالٌ -
-‘‘সত্য বলা আল্লাহ তা‘য়ালার অন্যতম গুণ। এর পক্ষে দলীল হচ্ছে- মিথ্যা বলা দোষ। আর আল্লাহ তায়ালার মধ্যে কোন দোষ-ত্রুটি থাকা অসম্ভব।’’  
➤ ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী : তাফসীরে কাবীর : ১৩/১২৫পৃষ্ঠা, দারু ইহইয়াউত্-তুরাসিল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ-১৪২০হিজরি।

ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (رحمة الله) তো সুস্পষ্ট ভাষায় ফতোয়া আরোপ করেছেন-
  لِأَنَّ الْمُؤْمِنَ لَا يَجُوزُ أَنْ يَظُنَّ باللَّه الْكَذِبَ، بَلْ يَخْرُجُ بِذَلِكَ عَنِ الْإِيمَانِ فَكَيْفَ يَجُوزُ مِثْلُهُ عَلَى الرُّسُلِ -  
-‘‘কোন মুসলমানের জন্য এটা জায়েয নয় যে, সে আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষে মিথ্যা বলার ধারণা করবে; বরং এ ধরনের ধারণার কারণে সে ঈমান হতে বের হযে যাবে (অর্থাৎ-সে কাফির হয়ে যাবে)।’’ 
➤ ইমাম রাজী, তাফসীরে কাবির : ১৮/৫২১পৃষ্ঠা, দারু ইহইয়াউত্-তুরাসিল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ-১৪২০হিজরি।

আল্লামা নাসিরুদ্দিন বায়যাভী (رحمة الله) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন-
وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثاً إنكار أن يكون أحد أكثر صدقاً منه، فإنه لا يتطرق الكذب إلى خبره بوجه لأنه نقص وهو على الله محال.
-‘‘আল্লাহ অপেক্ষা কার কথা বেশি সত্য?  
➤ সূরা নিসা, আয়াত/৮৭

-‘‘এ মহান বাণী এ কথার প্রমাণ যে, তাঁর চেয়ে বেশি সত্যবাদী কেউ নেই। কেননা, তাঁর খবর প্রদানে মিথ্যা কোনভাবেই প্রবেশ করতে পারে না। কারণ, সেটা (মিথ্যা) হচ্ছে একটি জঘন্য দোষ, এটা আল্লাহর জন্য সম্পূর্ণ অসম্ভব।’’ 
➤ ইমাম বায়যাভী, তাফসীরে বায়যাভী, ২/৮৮পৃষ্ঠা,

আল্লামা শরবীনী (رحمة الله) বলেন-
قَوْلُه تعالى فلن يخلف الله عهده فيه دليل على ان الخلف فى خبر الله محال
-‘‘আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘অতঃপর আল্লাহ কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না’-এর মধ্যে এ কথার পক্ষে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষে মিথ্যা খবর দেওয়া অসম্ভব।’’  
➤ আল্লামা শরবীনী, তাফসীরে সিরাজুম মুনীর: পৃষ্ঠা, ৭০  

ইমাম আলী ইবনে মোহাম্মদ আল-খাযিন (رحمة الله) বলেছেন,
لا أحد أصدق من الله فإنه لا يخلف الميعاد ولا يجوز عليه الكذب
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালার চেয়ে বড় সত্যবাদী কেউ নেই। তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না এবং তাঁর পক্ষে মিথ্যা বলা সম্ভবই নয়।’’ 
➤ ইমাম খাযিন : তাফসীরে লুবাবুত তা’ভীল: ১/৪২১পৃষ্ঠা,

ইমাম আবুস সাউদ (رحمة الله) বলেন-
والكذِبُ مُحالٌ عليه سبحانه دون غيرِه
-‘‘মিথ্যা বলা আল্লাহ তাআলার পক্ষে অসম্ভব।’’  
➤ ইমাম আবুস সাউদ: তাফসীরে আবিস সাউদ: ২/২১২পৃষ্ঠা,

আল্লামা মুঈনুদ্দিন কাশেফী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, 
ومن اصدق من الله حديثا  از خدا ۓ تعالى يعنى نيست از وے راست گوۓ تراز جہت قولى ووعده يعنى كذب رادر سخن ووعده حق راه نيست زيرا كہ آں نقص ست وخداۓ از نقص مبراست- 
-‘‘আল্লাহ তাআলার চেয়ে অধিক সত্যবাদী আর কে আছে? অর্থাৎ তাঁর চেয়ে বেশি সত্যবাদী আর কেউ নেই। অর্থাৎ আল্লাহর কথা ও প্রতিশ্রুতিতে মিথ্যার কোন অবকাশ নেই। কেননা, সেটা (মিথ্যা) একটা জঘন্য দোষ। আর আল্লাহ তাআলা দোষ-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।’’  ➤ মোল্লা মুঈন উদ্দিন কাশেফী : তাফসীরে হুসাইনী: ১/পৃষ্ঠা,১২৭ 

ইমাম নাসাফী (رحمة الله) বলেন-
لا أحد أصدق منه في إخباره ووعده ووعيده لاستحالة الكذب عليه لقبحه
-‘‘খবর প্রদান, প্রতিশ্রুতি পূরণ ও শাস্তি প্রদানের হুমকি (যদি ক্ষমা না করেন) পূরণে তাঁর চেয়ে বেশি সত্যবাদী আর কেউ নেই। কারণ, মিথ্যা তাঁর জন্য অসম্ভব- যেহেতু সেটা জঘন্য দোষ।’’  
➤ইমাম নাসাফী : তাফসীরে মাদারিক: সূরা নিসা, আয়াত ৮৭ 

গায়রে মুকাল্লিদদের ইমাম নাওয়াব সিদ্দিক হাসান ভূপালভীও মিথ্যা এবং ওয়াদা খেলাফকে দোষগুলোর মধ্যে গণ্য করেছেন। সুতরাং তিনি লিখেছেন, 
وعده كى سچا‌‏ئى صفات حميدة ميں سے ہے جيسے خلف وعد اوصاف ذميمہ ميں سے ہے –
-‘‘প্রতিশ্রুতিতে সত্যবাদিতা প্রশংসিত গুণাবলীর অন্যতম, যেমনিভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করা মন্দ গুণাবলীর মধ্যে গণ্য।’’  ➤ তরজুমানে কুরআন: পৃষ্ঠা, ৩৫৯, পারা - ১৬ , সূরা মরিয়াম

৪. হায়াত, কুদরত, শোনা, দেখা . বাকশক্তি, ইলম ও ইচ্ছা হচ্ছে তাঁর নিজস্ব সিফাত বা গুণবলী। কিন্তু কান, চোখ ও মুখ দিয়ে শোনা, দেখা ও কথা বলা নয়। কেননা এগুলো হচ্ছে সাকার। কিন্তু আল্লাহ সাকার থেকে পবিত্র। অথচ তিনি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর আওয়াজ শোনেন এবং ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বস্তু, যা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারাও দেখা যায় না, তিনি তা দেখেন। তাঁর দেখার জন্য ওসব কিছুর প্রয়োজন হয়না। তিনি প্রত্যেক কিছু দেখেন ও শোনেন। (শরহে আকায়েদে নাসাফী, ৩৮পৃ.)
৫.তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোন বস্তু নেই। অর্থাৎ আংশিক-সামগ্রিক, বর্তমান-অবর্তমান , সম্ভব-অসম্ভব সবকিছু অনাদিকাল থেকে জানেন এবং অনন্তকাল পর্যন্ত জানবেন। প্রতিটি জিনিস পরিবর্তন হয় কিন্তু তাঁর জ্ঞান পরিবর্তন হয় না। তিনি মনের ধ্যান-ধারণা সম্পর্কেও জ্ঞাত । তাঁর জ্ঞানের কোন শেষ নেই। (মুসামেরা, ৬২পৃ. শরহে আকায়েদ, ৪২পৃ. ,মাওয়াকেফ, ৮পৃ.)

মহান আল্লাহর কাছে কোন কিছু গোপন নেইঃ

৬. মহান আল্লাহ তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছু সম্পর্কে অবগত। তার কাছে কোন কিছু গায়ব বা গোপন নেই। মহান আল্লাহ তা‘য়ালা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ
-‘‘নিশ্চয় মহান আল্লাহর কাছে আসমান যমীনে কোন কিছুই গোপন (গায়ব) নেই।’’ (সূরা আলে ইমরান, ৫) সত্তাগত জ্ঞানের অধিকারী হওয়াটা একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট্য। যেই ব্যক্তি সত্তাগত  অদৃশ্য বা দৃশ্য জ্ঞান খোদা ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রমাণ করে, সে কাফির। 
➤ সুরা আনআম,আয়াত-৫০, সুরা নামল-৬৫, শরহে আকায়েদে নাসাফী, শরহে ফিকহুল আকবার।

স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা প্রসঙ্গ

৭. পার্থিব জীবনে আল্লাহর দিদার লাভ একমাত্র নবী (ﷺ) এর জন্য খাস। এই বিষয়ে সামনে আলোকপাত করা হবে। (আল-মুনতাকিদ, ৬১পৃ.) ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
اخرجه الْبَيْهَقِيّ فِي كتاب الرُّؤْيَة بِلَفْظ ان الله اصْطفى إِبْرَاهِيم بالخلة وَاصْطفى مُوسَى بالْكلَام وَاصْطفى مُحَمَّدًا بِالرُّؤْيَةِ 
-“ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) ‘কিতাবুল রুয়া’ত’ এ বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘য়ালা ইবরাহীম (رحمة الله) কে বন্ধুত্ব, মূসা (رحمة الله) কে আলাপ এবং হযরত মুহাম্মদ (رحمة الله) কে তাঁর দীদার দ্বারা একক মর্যাদা দান করেছেন।’’  
➤ ইমাম কাজী আয়াজ : শিফা শরীফ : ২/২৭০ পৃষ্ঠা, ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ১/১৬১,পৃষ্ঠা, ইমাম যুরকানী : শরহে মাওয়াহেব : ৫/১১৭ পৃষ্ঠা, মোল্লা আলী ক্বারী : শরহে শিফা : ১/৪৭০ : পৃ:

পরকালে প্রত্যেক সুন্নি মুসলমানদের জন্য সম্ভব বরং অবশ্যম্ভাবী। 
➤ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুর রিকাক, হা/৬২০৪ এবং হা/৬৯৯৯

রূহানী বা স্বপ্নযোগে সাক্ষাৎ অন্যান্য আম্বিয়ায়ে ও আওলিয়ায়ে কিরামের জন্যও সম্ভব। আমাদের ইমাম হযরত আবু হানিফা (رحمة الله) স্বপ্নে একশ‘বার আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করেছেন। (আল-মুনতাকিদ, ৬১-৬২পৃ., ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/১১৮পৃ.)
অসংখ্য ওলীরা মহান আল্লাহকে স্বপ্নযোগে দেখেছেন; তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। ইমাম নববী (رحمة الله) উল্লেখ করেন-
قَالَ الْقَاضِي وَاتَّفَقَ الْعُلَمَاءُ عَلَى جَوَازِ رُؤْيَةِ اللَّهِ تَعَالَى فِي الْمَنَامِ وَلَا اخْتِلَافُ 
-‘‘ইমাম কাযি আয়্যায (رحمة الله) বলেন, সমস্ত উলামাগণ একমত পোষণ করেছেন যে, স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা বিশ্বাস বৈধ। এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কারো কোনো মতভেদ নেই।’’  
➤ ইমাম নববী, শরহে মুসলিম, ১৫/২৫পৃষ্ঠা, ইবনে হাজার আসকালানী, ফতহুল বারী, ১২/৩৮৭পৃষ্ঠা,

বিখ্যাত আকায়েদবিদ সা‘দ তাফতাযানী (ওফাত. ৭৯৩হি.) এ প্রসঙ্গে লিখেন-
وَلَا خَفَاءَ أَنَّهَا نَوْعُ مُشَاهَدَةٍ تَكُوْنُ بِالْقَلْبِ دُوْنَ الْعَيْنِ
-‘‘এটা স্পষ্টত একপ্রকারের দর্শন, যা অন্তরের মাধ্যমে হয়ে থাকে; চাক্ষুষ দেখা নয়।’’  
➤ শারহুল মাওয়াকিফ, 

ইমাম বাগভী (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে লিখেন-
قَالَ الإِمَامُ: رُؤْيَةُ اللَّهِ فِي الْمَنَامِ جَائِزَةٌ،......وَتَكُونُ رُؤْيَتُهُ جَلَّتْ قُدْرَتُهُ ظُهُورَ الْعَدْلِ، وَالْفَرَجِ، وَالْخِصْبِ، وَالْخَيْرِ لأَهْلِ ذَلِكَ الْمَوْضِعِ، فَإِنْ رَآهُ فَوَعَدَ لَهُ جَنَّةً، أَوْ مَغْفِرَةً، أَوْ نَجَاةً مِنَ النَّارِ، فَقَوْلُهُ حَقٌّ، وَوَعْدُهُ صِدْقٌ، وَإِنْ رَآهُ يَنْظُرُ إِلَيْهِ، فَهُوَ رَحْمَتُهُ، وَإِنْ رَآهُ مُعْرِضًا عَنْهُ، فَهُوَ تَحْذِيرٌ مِنَ الذُّنُوبِ
-‘‘ইমাম বলেন, স্বপ্নে আল্লাহ কে দেখা বৈধ।......স্বপ্নে আল্লাহকে দেখা সম্ভবপর। যদি কেউ তাঁকে জান্নাত কিংবা মাগফিরাত বা নাজাতের কথা বলতে দেখে, তা হলে তাঁর কথা হক্ক ও তাঁর ওয়াদা সত্য। যদি সে তাঁকে তার প্রতি দৃষ্টি দান করতে দেখে, তবে তা তার প্রতি দয়ার লক্ষণ আর যদি তাঁকে অবজ্ঞা করতে দেখে, তবে তা হবে পাপ থেকে সতর্ক করার লক্ষণ।’’ 
➤ বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ, ১২/২২৭পৃষ্ঠা, হা/৩২৮৮

চতুর্থ অধ্যায়ঃ 
নবিদের সম্পর্কে আক্বিদা

১.‘নবী’ শব্দের অর্থই হলো, অদৃশ্যের সংবাদ দাতা। আর যদি বাতিল পন্থীদের মতো নবি অর্থ যদি শুধু ‘সংবাদদাতা’ হয় তাহলে তো টেলিভিশনের সংবাদ প্রদানকারীও নবি হবেন! ইমাম শিহাবুদ্দীন কাস্তাল্লানী (رحمة الله) বলেন-
 النبوة ماخوذة من النباء بمعنى الخبر ان اطلعه الله على الغيب- 
-‘‘ نبوة শব্দটি نباء শব্দ থেকে নির্গত; যার অর্থ হচ্ছে খবর বা জ্ঞান। অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁকে অদৃশ্য বিষয়াদি অবহিত করেছেন (সে খবর)।’’  
➤ ইমাম কুস্তালানী : মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া : ২/১৯২পৃষ্ঠা,।

‘নবী’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে আরবী অভিধানের কিতাব مصباح اللغات এর ৮৪৭ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে النبى : الله تعالى كے الهام سے غيب كى باتيں بتا نيوالا -  
-‘‘নবী’ শব্দের অর্থ হল আল্লাহ তা‘য়ালা কতর্ৃক ইলহামের মাধ্যমে গায়বের সংবাদ প্রদানকারী।’’ 
আরবী অভিধানের অন্যতম কিতাব المنجد (আল মুনজিদ) এর ৭৮৪ নং পৃষ্ঠায় নবুয়ত শব্দের অর্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে- 
النبوة : الاخبار عن الغيب او المستقبل بالهام من الله
-‘‘নবুয়ত হলো আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে ইলহামের মাধ্যমে গায়ব বা ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদান করা।’’
২. নবি ওই ধরনের সম্মানিত মানবকে বলা হয়, যার কাছে হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তা‘য়ালা ওহী পাঠিয়েছেন। (আল-আরবাঈন, ৩৩পৃ. শরহে আকাঈদ, ৯৪পৃ.)
৩. নবিগণ সবাই পুরুষ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোন মহিলা বা জ্বীন ছিল না। (সূরা জ্বীন, শরহে আকায়েদ, ২৯পৃ.) তাই ডা. জাকির নায়েকের মত কেউ এ কথাও ধারনা করা গোমরাহী হবে যে চারজন মহিলা নবি এসেছিলেন।’’
➤ জাকির নায়েকের লেকচার সমগ্র, ভলিয়ম নং ১ পৃষ্ঠা, নং ৩৫৫, পিস পাবলিকেন্স, ঢাকা।

আরবী অভিধানের অন্যতম কিতাব المنجد (আল মুনজিদ) এর ৭৮৪ নং পৃষ্ঠায় নবুয়ত শব্দের অর্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে- 
النبوة : الاخبار عن الغيب او المستقبل بالهام من الله
-‘‘নবুয়ত হলো আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে ইলহামের মাধ্যমে গায়ব বা ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদান করা।’’
২. নবি ওই ধরনের সম্মানিত মানবকে বলা হয়, যার কাছে হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তা‘য়ালা ওহী পাঠিয়েছেন। (আল-আরবাঈন, ৩৩পৃ. শরহে আকাঈদ, ৯৪পৃ.)
৩. নবিগণ সবাই পুরুষ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোন মহিলা বা জ্বীন ছিল না। (সূরা জ্বীন, শরহে আকায়েদ, ২৯পৃ.) তাই ডা. জাকির নায়েকের মত কেউ এ কথাও ধারনা করা গোমরাহী হবে যে চারজন মহিলা নবি এসেছিলেন।’’
➤ ইবনে কাসির, তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪/৩৬২পৃষ্ঠা, প্রাগুক্ত।

ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) বলেন-  أَنَّهُ لَيْسَ فِي النِّسَاءِ نَبِيَّةٌ-‘‘কোনো মহিলা নবি ছিলেন না।’’ ১০৮
৪. নবি প্রেরণ করাটা আল্লাহর বাধ্যগত ব্যাপার নয়। তিনি স্বীয় মেহের বানীতে মানুষের হেদায়েতের জন্য নবিগণকে পাঠিয়েছেন। (উসূলে বাযদভী, ১২৬পৃ.)
৫. নবি হওয়ার জন্য ওহীর প্রয়োজন, প্রত্যক্ষ হোক বা ফিরেশতার মাধ্যমে হোক। (তামহিদ, ১২৬পৃ.)
৬. যে ব্যক্তি নবি থেকে নবুয়ত বিলুপ্ত হতে পারে বলে মনে করে সে, কাফির। 
➤ আরবাঈন, ৩২৯পৃষ্ঠা,

 
Top