◾আহলে বাইত কারা?


দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আমরা মুসলমান হয়েও আহলে বাইত তথা আউলাদে রাসূলকে চিনি না বা চেনার চেষ্টাও করি না। আবার কোন সময় চিনলেও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করি না। এটা কি আমাদের জন্য লজ্জার নয়? বস্তুত আহলে বাইত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় ও স্নেহের পাত্র। সেদিকে নির্দেশ করেই আল্লাহর রাব্বুল আলামীন পবিত্র ক্বোরআনুল করীম এরশাদ ফরমান-

قل لااسئلكم عليه اجرا الا المودة فى القربى

অর্থাৎ : (হে হাবীব) আপনি বলে দিন যে, আমি (রাসূল) তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চাই না, আমার বংশধরগণ ও নিকটাত্মীয়দের ভালোবাসা ব্যতীত। [সূরা শুরা-২৩]


এই আয়াতে কারীমা নাযিল হওয়ার পর, সাহাবায়ে কেরাম রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নিকট স্বীয় আত্মীয় সম্পর্কে বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকটাত্মীয় কারা? যাঁদের প্রতি (আমাদের) আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব।

[তাফসীর ইবনে কছীর- ২য় খণ্ড, ২১১ পৃষ্ঠা]


সরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- তাঁরা (আহলে বাইত) হলেন হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এবং তাদের উভয়ের আওলাদ।

[যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব, সাওয়াইক্বে মুহরিক্বা, খুৎবাতে মুহররম- পৃষ্ঠা ২৫৬, মুফতি জালালুদ্দীন আমজাদী রহ.]


বস্তুত আহলে বাইত ছিলেন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খুবই আপনজন। পবিত্র ক্বোরআনে তাদের পবিত্রতা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ্ পাকের ইরশাদ- ‘‘হে আহলে বাইত! নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। [সূরা আহযাব: ৩৩]


আয়াতটি নাযিল হলে হযরত আবু সাঈদ খুদরী, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা ও উম্মে সালমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, এটি ‘‘আহলে বাইত’’ তথা মা ফাতেমা, হযরত আলী, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। আহলে বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচয়ে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং তাবেঈ হযরত মুজাহিদ, হযরত ক্বাতাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা সহ অন্যান্য মুফাস্সিরের মতে আহলে বাইত বলতে ‘‘আহলে আবা’’ অর্থাৎ চাদরাবৃতদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো কারা এই চাদরাবৃত? এই প্রসঙ্গে একটি হাদীস শরীফে এসেছে- হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যুষে বের হলেন, তখন তাঁর শরীর মুবারক কালো নকশা বিশিষ্ট চাদর দ্বারা আবৃত ছিল। অতঃপর ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আসলে নবীজী তাঁকে চাদরের মধ্যে শামিল করে নিলেন, এরপর ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এলে তাঁকেও নবীজী চাদর মুবারকে জড়িয়ে নিলেন। অতঃপর আসলেন হযরত মা ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা আল্লাহর রসূল তাঁকেও চাদরের অভ্যন্তরে নিয়ে নিলেন। সর্বশেষ এলেন শেরে খোদা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তাঁকেও তাঁর নূরানী চাদর মুবারকে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতঃপর তিলাওয়াত করলেন- হে আহলে বাইত! নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। [সূরা আহযাব-৩৩]


অতঃপর রব্বুল আলামীনের দরবারে এই দোয়া করলেন- আল্লাহুম্মা হা-উলায়ে আহলু বাইতি ওয়াখাচ্ছাতি ফাআজহিব আনহুমুর রিজসা ওয়াতাতহিরহুম তাতহীরান।

অর্থাৎ হে আল্লাহ্। এরাই আমার আহলে বাইত এবং বংশীয় ও ঘনিষ্ঠজন। আপনি এদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভূত করুন আর এদেরকে পরিপূর্ণভাবে পবিত্র করুন। [মুসলিম শরীফের বরাতে মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫৬৮]


অপর এক হাদীসে পাকে এসেছে হযরত উসামা ইবনে যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, ‘‘আমি নবীজীর খিদমতে উপস্থিত হয়ে দেখলাম নবীজী এমনভাবে কম্বল জড়িয়ে আছেন যে, মনে হলো তার ভিতরে কিছু লুকিয়ে রেখেছেন। আমি আবেদন করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম, কম্বলের ভিতরে কী যেন লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছে? সাথে সাথে নবীজী কম্বলখানা খুলে দিলেন। তখন দেখা গেল নবীজীর নূরানী কোলে বসে আছেন ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা। অতঃপর নবীজী ইরশাদ করলেন- আল্লাহুম্মা ইন্নি উহিব্বুহুমা ফাআহিব্বাহুমা ওয়া আহিব্বা মান আহাব্বাহুমা। অর্থাৎ হে আল্লাহ্! আমি এই দু’জনকে ভালোবাসি সুতরাং তুমিও এদেরকে ভালোবাস এবং ভালোবাস তাদেরকে যারা এদেরকে ভালোবাসবে। [তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫৭০]


অতএব, প্রতীয়মান হলো যে, আহলে বায়ত হলো শেরে খোদা আলী, হযরত মা ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান, হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও তাঁদের সন্তানগণ।


◾আহলে বাইতের মর্যাদাঃ

যবেহ ইসমাঈল যে যিবহে আযীম দ্বারা পরিবর্তন হয়, তা হুযূর নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের পর পূর্ণতা লাভ করে। প্রসঙ্গে ড.আল্লামা ইকবাল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,

‘‘সিরের ইবরাহীম ইসমাঈল বুয়দ

ইয়া’নি ইসমাঈল রা তাফসীলে বুয়দ।’’

অর্থাৎ ইবরাহীম আলায়হিস্ সালাম এবং হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর সেই কোরবানির ঘটনা ছিল এক গূঢ় রহস্য, আর তার প্রাকটিক্যাল নমুনা হলো কারবালার যমীনে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত। 


হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পর শেরে খোদা হযরত আলী ও নবী দুলালী মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর বংশ অব্যাহত থাকে। সেই শাহাদাত সংঘটিত হওয়ার সময় যাকে যবেহ ইসমাঈল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ কারবালার ময়দানের ঘটনা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আর আহলে বাইত তথা আউলাদে রাসূলগণকে আল্লাহ্ তা‘আলা যে মর্যাদা দান করেছেন তা সাধারণ মুমিন মুসলমানদের দেয়া হয়নি। কারণ তাঁরা আল্লাহর রাসূলের বংশধর। ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে আল্লাহর রাসূল নিজের পুত্রের মত ভালোবাসতেন। হাদীসে পাকে এসেছে- হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি দেখেছি, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের হাত ধরে বলেছেন- এরা আমার সন্তান।

[দায়লামী আল্ ফিরদাউস বিমা’ সূরিল খিতাব-৪/৩৩৬ হাদীস ৫৯৭৩]


ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার সাদৃশ্য হাদীসে পাকে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তাঁরা সবচেয়ে বেশী সদৃশ ছিলেন।

[আসকালানী, আল্ ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা ২/৭৭ হাদীস ১৭২৬]


তাবরানী শরীফের এক হাদীসে পাকে রয়েছে- হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বক্ষ থেকে মাথা মুবারক পর্যন্ত, আর ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন বক্ষ থেকে পা মুবারক পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পুরোপুরি সদৃশ। [আল্ মুজামুল কবির, ৩/২৯ হাদীস ২৫৭]


◾আহলে বাইত সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত বংশের অধিকারীঃ

নবী-বংশ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। এ প্রসঙ্গে হাদীস পাকে এসেছে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালাম-এর আউলাদগণের মধ্যে কেনান গোত্রকে নির্বাচন করেছেন। তার মধ্য থেকে কোরাইশ বংশকে আর কোরাইশ বংশ হতে বনী হাশেমকে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বনী হাশেম হতে আমাকে মনোনীত করেছেন।

[বরকাতে আলে রাসূল: পৃষ্ঠা ৯১, খুৎবাতে মুহররম পৃষ্ঠা ২৪৩]


উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- একদিন জিবরাঈল আমীন এসে আমাকে বললেন- আমি জমিনের পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত সবখানে তালাশ করলাম, কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে উত্তম মর্যাদাবান সম্মানিত কাউকে খুঁজে পাইনি।

তাবরানী শরীফে ও দারু কুতনীর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে- রাসূলে পাক ইরশাদ করেছেন- কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সর্ব প্রথম ‘আহলে বায়ত’ এর জন্য আমার শাফা‘আত হবে; অতঃপর অন্যান্যের জন্য। আল্লাহর নবী ইরশাদ করেন, ‘‘আমি যাদের জন্য/যার জন্য সর্বপ্রথম সুপারিশ করব। তারাই সর্বাধিক মর্যাদাবান হবে।’’ [আশরাফুল মুয়াববাদ: পৃষ্ঠা ৩৯]


এ সব হাদীসে পাক থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আহলে বাইত অতি মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন।


◾আহলে বায়তের প্রতি মুহাব্বতঃ


আহলে বাইতের প্রতি মুহাব্বতের বহু রেওয়ায়ত বিদ্যমান। তৎমধ্যে তিরমিযী শরীফে উল্লেখ রয়েছে- হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিদায় হজের সময় আরাফাত দিবসে রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘ক্বাসওয়া’ নামক উটের উপর আরোহনরত অবস্থায় বলতে শুনেছি ও দেখেছি- নবীজী ইরশাদ করলেন- হে মানব সম্প্রদায়! আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর তাহলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো কিতাবুল্লাহ্ ও আমার বংশধর- আমার আহলে বাইত।

[মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫৬]


তাবরানী শরীফে এসেছে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন বান্দা মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাকে নিজের জীবন থেকে, আমার বংশধরকে তার বংশধর থেকে, আমার পরিবার-পরিজনকে তার পরিবার-পরিজন থেকে এবং আমার সত্তাকে তার সত্তার চাইতে বেশি ভালোবাসবে না।

আউলাদে রাসূলকে যে যত বেশি ভালোবাসবে ও সম্মান করবে সে তত বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে। হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হাসান-হোসাইন আলায়হিমাস্ সালামকে ভালোবেসেছে, সে যেন বাস্তবে আমি রাসূলকে ভালোবেসেছে।

[ইবনে মাজাহ আস্ সুনান, ইমাম আহমদ- আল্ মুসনাদ, নাসায়ী- আস্ সুনানুল কুবরা ও ফাযায়িলুস্সাহাবা। যথক্রমে হাদীস ১৪৩,৭৮৬৩,৮১৬৮ ও ৬৪]


আর যাকে আল্লাহর রাসূল ভালোবেসেছেন, আল্লাহ্ও তাঁকে ভালোবাসবেন। সুতরাং আল্লাহ্ যাকে ভালোবাসবেন নিঃসন্দেহে তিনি তাঁকে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। হাদীস পাকে এসেছে- হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হযরত রাসূল করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি তাঁদেরকে ভালোবাসবে তাকে আমি ভালোবাসবো, আর যাকে আমি (নবী) ভালোবাসবো, তাকে আল্লাহ্পাক ভালোবাসবেন, আর আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন যাকে ভালোবাসেন তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যা নেয়ামত দ্বারা পরিপূর্ণ।

[তাবরানী: আল্ মু’জামুল কবীর ৩/৫০ হাদীস ২৬৫৫ হায়সমী: মাজমাঊয যাওয়ায়েদ ৯/১৮১]


এমনকি দুনিয়ার শেষ পরীক্ষা অর্থাৎ মৃত্যুর পরীক্ষায় ও আউলাদে রাসূলের নেগাহে করমে ও দোয়ার বরকতে সফলতা লাভ করা যাবে, যা আল্লাহ রাসূলের একাধিক হাদীসে পাক দ্বারা সুস্পষ্ট। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নবী বংশের ভালোবাসায় ইন্তেকাল করলো, সে যেন ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় ইন্তেকাল করল এবং আর যে ব্যক্তি নবী বংশের ভালোবাসা নিয়ে ইন্তেকাল করলো সে যেন তাওবাকারী রূপে ইন্তেকাল করল। এবং যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধরদের ভালোবাসার উপর ইন্তেকাল করলো, সে যেন মু’মিন হিসেবে ইন্তেকাল করলো। [খোতবাতে মুহাররম: ১৪১]


আহলে বাইতের মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে হযরত আবূ বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, (যার হাতে আমার প্রাণ এ সত্তা, তাঁর কসম) আমার নিকট আমার আত্মীয়গণ অপেক্ষা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আত্মীয় ও বংশধরের ভালোবাসা অধিক প্রিয়। [বুখারী শরীফ ও আশশারফুল মুআব্বদ : পৃষ্ঠা ৮৭]

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আলে রাসূলকে মহব্বত করা একশ বৎসর ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। [আশশারফুল মুআব্বাদ: পৃষ্ঠা ৮৭]


ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমি আহলে বাইতে রাসূলকে এতবেশি ভালোবাসতাম যে, লোকেরা আমাকে রাফেযী বলা শুরু করল। আমি তাদের জবাবে বললাম, আলে রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নাম যদি রাফেযী হয়, তাহলে হে জ্বিন জাতি ও মানবজাতি ও বিশ্ববাসী সাক্ষী হয়ে থাক, এই অর্থে আমি রাফেযী। এরপর আহলে বাইতের মহব্বতে তিনি আরো বলেন, হে নবীজীর বংশধরগণ, আপনাদের মহব্বত করা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয। আর এই হুকুম মহান আল্লাহর পবিত্র ক্বোরআনে নাযিল করেছেন। তদ্রুপ তাঁদের সাথে যারা শত্র“তা পোষণ করবে তারা মূলত আল্লাহ্ ও রাসূলের সাথে শত্র“তা পোষণ করে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-

اشتد غضب الله على من اذانى فى عترتى

অর্থাৎ আল্লাহর ক্রোধ অতীব কঠোর ও কঠিন হবে যারা আমার বংশধরকে কষ্ট দিয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন যে আমার বংশধরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, সে আমার সাথেই বিদ্বেষভাব পোষণ করল। নবীজী আরো বলেন,

حسين منى وانا من حسين احب الله من احب حسينا

অর্থাৎ হোসাইন আমার থেকে আমি হোসাইন থেকে, যে হোসাইনকে ভালোবাসে তাকে মহান আল্লাহ্ ভালোবাসেন। [তিরমিযি শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮২]


নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযরত ছিলেন। ইমাম হোসাইন নিজ ঘর হতে বের হয়ে মসজিদে নববীতে গেলেন এবং দেখতে পেলেন নানাজান রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে নামাযরত। শিশু ইমাম হোসাইন কালবিলম্ব না করে আল্লাহর রাসূলের কাঁধ মুবারকে ওঠে গেলেন। হুযূর-ই আকরাম সাজদাকে দীর্ঘ করে দিলেন। রাসূলুল্লাহরও ইচ্ছা ইমাম হোসাইন যতক্ষণ নিজের ইচ্ছায় নামবে না ততক্ষণ অবস্থান করুক।

এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অবতরণ করলে সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও মাথা মুবারক সাজদা হতে উত্তোলন করলেন। নামায শেষে সাহাবীরা সাজদা দীর্ঘ করার কারণ জানতে চাইলেন এবং বললেন আজ থেকে কি সাজদা দীর্ঘ করার কোন হুকুম এসেছে? হে আল্লাহর রাসূল! হুযূর-ই আকরাম উত্তরে বললেন, ‘না, সাজদা দীর্ঘ করার কারণ- আমার হোসাইন আমার কাঁধে উঠে গিয়েছিল। আর সে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাওয়ার আশঙ্কায় আমি সাজদা দীর্ঘ করি। [মুস্তাদরাক: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠ ১৬৬]


ইমাম হোসাইনের এতটুকু কষ্টও নবীজী সহ্য করতে পারলেন না, তাও আবার নামাযরত অবস্থায়। তাহেল ৬১ হিজরি সনে করবালার প্রান্তরে কুখ্যাত ইয়াযীদের নরপশুরা সেই ইমামের নূরানী দেহ মুবারকে কত ধরনের নির্যাতন চালিয়ে পরিশেষে দেহ মুবারক হতে মাথা মুবারককে বিচ্ছিন্ন করে উল্লাস করল! (নাঊযুবিল্লাহ্)। এতে নবীজী কত কষ্ট পেয়েছেন তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।


পরিশেষে, বর্তমানে এক শ্রেণীর লোক আশুরার নামে যে মাতম করে ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ছুরিও ব্লেড দিয়ে শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তা মোটেও ইসলাম ও শরিয়ত সমর্থিত নয়। তাই সকল প্রকার কুপ্রথা মর্সিয়া, মাতম বর্জন করে শাহাদাতে কারবালার প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করতে হবে। তাইতো বলা হয় ‘‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ।’’ আমাদের সকলের অন্তরে যেন আহলে বাইতে রাসূলের প্রতি মহব্বত ও সম্মান বিরাজমান রাখতে পারি আল্লাহ সেই তাওফীক্ব দান করুন।

 
Top