কিতাবঃ সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
মূলঃ ইমাম আব্দুল্লাহ সিরাজুদ্দিন আল হুসাইনী (রহ.)
বঙ্গানুবাদঃ কাজী সাইফুদ্দিন হোসাইন
🕌ভূমিকা
ভূমিকা
الحمد لله رب العالمين، وأفضل الصلاة وأكمل التسليم، على سيدنا محمد، إمام الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وصحبه والتابعين أجمعين.
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্যে, যিনি জগতসমূহের প্রভু। সর্বোৎকৃষ্ট সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের সাইয়্যিদ মুহাম্মদ (ﷺ)-এর প্রতি, যিনি আম্বিয়া ও রাসূল (عليه السلام)-মণ্ডলীর ইমাম। অতঃপর তা বর্ষিত হোক তাঁর আ’ল তথা পরিবারসদস্যবৃন্দ, সাহাবায়ে কেরাম (সাথী) ও তাবেঈন (অনুসারী)-মণ্ডলীর প্রতিও।
আমি এই গ্রন্থে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শামায়িল (الشمائل المحمدية) তথা উন্নত বৈশিষ্ট্যের কিছু সংক্ষিপ্ত অধ্যায় সংকলন করেছি, যা তাঁরই উৎকৃষ্ট নীতি-নৈতিকতার বিভিন্ন দিক ও উচ্চমার্গের সীরাত মোবারক প্রতীয়মান করবে। হয়তো এগুলো দ্বারা বুদ্ধিমানদের কাছে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাবে; আর উদাসীনদের সতর্ক করানোও যাবে; উপরন্তু অজ্ঞদেরও শিক্ষা দেওয়া যাবে।
সকল বুদ্ধিমান ও দায়িত্ববান (মুসলমান) ব্যক্তির প্রতি অত্যাবশ্যক এ মর্মে যে তাঁরা এই মহানতম ও সর্বোচ্চ মর্যাদাবান রাসূল (ﷺ)-এর সিফাত তথা গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলীর সাথে পরিচিত হবেন, যাতে তাঁর (ﷺ) সীরাতের নূর তাঁরা অনুসরণ করতে পারেন এবং তাঁরই কামালাতপূর্ণ আখলাক বা পূর্ণতাপ্রাপ্ত চরিত্রবৈশিষ্ট্যকে তাঁরা অনুকরণীয়-অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।
যদি বুদ্ধিমানদের প্রকৃতি হয় দুনিয়াতে সেরা ও যোগ্য ব্যক্তিত্বদের (সম্পর্কে) জ্ঞান অন্বেষণ/আহরণ করা, তবে আরো যথাযথ হবে তাঁরা যেনো সাইয়্যিদবৃন্দের সাইয়্যিদ (ﷺ)-এর ব্যাপারে জানার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন, যিনি সকল সৃষ্টিকুলের গর্ব, যাঁকে আল্লাহতায়ালা সর্বোচ্চ দরজাত তথা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, এবং সকল মর্তবা ও মকামের ঊর্ধ্বে উন্নীত করেছেন।
কোনো ব্যক্তি, তাঁর মর্যাদা যতো উঁচুই হোক না কেন, অথবা জ্ঞান যতো বিশাল, কিংবা ধীশক্তি যতো পূর্ণই হোক না কেন, তিনি কখনোই (আমাদের) এই নবী করীম (ﷺ)-এর মহৎ গুণাবলীকে পরিবেষ্টন করতে সক্ষম হবেন না; যেমনটি ভেদ করতে সক্ষম হবেন না প্রিয়নবী (ﷺ)-এর পূর্ণতার বিভিন্ন দিক অথবা তাঁরই সৌন্দর্যের নানা রং; বরং আমরা সবাই এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশে একেবারে অক্ষম, যেমনটি ব্যক্ত হয় নিম্নের দুটি ছত্রে:
وإنَّ قميصاً خِيطَ من نسج تسعةٍ :: وعشرين حرفاً عن معانيه قاصرُ
উনত্রিশটি অক্ষর দ্বারা কামিসের বুনন,
ব্যর্থ তাঁরই (ﷺ) মহান চরিত্রবৈশিষ্ট্য করিতে বর্ণন। [ভাবানুবাদ]
🕌প্রিয়নবী (ﷺ)-কে জানার এবং তাঁর শামায়িল শরীফ ও মহত্তম স্বভাব-চরিত্র অধ্যয়নের আবশ্যকতা
আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন:
وَٱعْلَمُوۤاْ أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ ٱللَّهِ…
অর্থ: এবং জেনে রেখো, নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। [আল-কুর’আন, ৪৯/৭; নূরুল ইরফান]
তিনি আরো ঘোষণা করেন:
أَمْ لَمْ يَعْرِفُواْ رَسُولَهُمْ فَهُمْ لَهُ مُنكِرُونَ.
অর্থ: অথবা তারা কি তাদের রাসূলকে চিনে নি, অতঃপর তারা তাঁকে অপরিচিত মনে করছে? [আল-কুর’আন ২৩/৬৯; নূরুল ইরফান]
অতএব, সকল বুদ্ধিমান, দায়িত্ববান মানুষের প্রতি অত্যাবশ্যক হয়েছে যে তাঁরা এই রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর সাথে সুপরিচিত হবেন, আর তাঁর প্রশংসনীয় শামায়িল তথা চরিত্রবৈশিষ্ট্য ও মহৎ গুণাবলী সম্পর্কে জানবেন, যা নিম্নবর্ণিত বিভিন্ন কারণে (জানা প্রয়োজন):
প্রথমতঃ আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের আদেশ করেছেন এই রাসূলে করীম (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনতে; তিনি ঘোষণা করেছেন:
فَآمِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ وَٱلنّورِ ٱلَّذِيۤ أَنزَلْنَا وَٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ.
অর্থ: সুতরাং তোমরা ঈমান আনো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং ওই নূরের প্রতি যা আমি অবতীর্ণ করেছি। এবং আল্লাহ তোমাদের কার্যাদি সম্পর্কে অবহিত। [আল-কুর’আন ৬৪/৮; নূরুল ইরফান]
নবী করীম (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস আল্লাহর বান্দাদের কাছে এই দাবি রাখে যে তাঁরা তাঁর (ﷺ) ফযল তথা গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব/মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানবেন; (আরো জানবেন) অন্যান্যদের ওপরে তাঁর উচ্চমর্যাদাগত অবস্থান সম্পর্কে; আল্লাহতায়ালা কর্তৃক তাঁর প্রতি মঞ্জুরকৃত সত্তাগত পূর্ণতা সম্পর্কে; রব্ব সোবহানাহু ওয়া তায়ালার দ্বারা তাঁকে (ﷺ) প্রশিক্ষণদানকৃত উন্নত আদব-কায়দা ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে; উপরন্তু, তাঁকে আল্লাহর দানকৃত মহান চরিত্র ও অনন্য শারীরিক সৌন্দর্য সম্পর্কে; এবং তাঁর মাঝে আল্লাহর সৃষ্ট গুণগত উৎকর্ষ সম্পর্কে; আর আল্লাহতায়ালা কর্তৃক তাঁর মাঝে সমাহারকৃত যাবতীয় পূর্ণতা সম্পর্কেও; কেননা আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মহান প্রকৃতিকে সকল মানব ও জাতিগোষ্ঠীর চেয়েও উচ্চমর্যাদা ও উৎকর্ষ দান করেছেন, আর তাই তাঁর সাথে অন্য কারোরই তুলনা চলে না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে অন্য কারো তুলনা চলতে পারেই বা কীভাবে, যেখানে আল্লাহ তাঁকে কামালাত তথা পূর্ণতার ক্ষেত্রে আলাদা শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, এবং স্বকীয় গুণগত মাহাত্ম্য মঞ্জুর করেছেন, আর উন্নততম চরিত্রবৈশিষ্ট্য দ্বারা উচ্চাসনে বিভূষিত করেছেন, এবং সেরা শারীরিক অবয়বে অলংকৃত করেছেন, আর তাঁকে অসংখ্য স্বতন্ত্র গুণ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন? আল্লাহ পাক তাঁকে যত্ন সহকারে গড়ে তুলেছেন এবং তাঁর প্রতি (যথাযথ) সম্মানসহ লক্ষ্য রেখেছেন। আল্লাহ ঘোষণা করেন:
أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيماً فَآوَىٰ، وَوَجَدَكَ ضَآلاًّ فَهَدَىٰ، وَوَجَدَكَ عَآئِلاً فَأَغْنَىٰ.
অর্থ: তিনি কি আপনাকে এতিম পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন। এবং আপনাকে (তাঁর) স্বীয় প্রেমে আত্মহারা পেয়েছেন, তখন নিজের দিকে পথ দেখিয়েছেন। এবং আপনাকে অভাবগ্রস্ত পেয়েছেন, অতঃপর ধনী করে দিয়েছেন। [আল-কুর’আন ৯৩/৬-৮; নূরুল ইরফান]
আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কেননা তিনি (ﷺ) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বলেন:
ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ.
অর্থ: পড়ুন! আপনার রবের তথা প্রভুর নামে। [আল-কুর’আন ৯৬/১; নূরুল ইরফান]
أي: لا بدراستك ولا بثقافتك،
এর মানে, আপনার পাঠ ও অধ্যয়ন দ্বারা নয়, বরং আপনারই প্রভুর নামে পড়ুন!
আল্লাহ আরো বলেন:
سَنُقْرِئُكَ فَلاَ تَنسَىٰ.
অর্থ: এখন আমি আপনাকে পড়াবো, ফলে আপনি ভুলবেন না। [আল-কুর’আন ৮৭/৬; নূরুল ইরফান]
তিনি আরো ফরমান:
وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيماً.
অর্থ: আর (আল্লাহ) আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা কিছু আপনি জানতেন না এবং আপনার ওপর আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে। [আল-কুর’আন ৪/১১৩; নূরুল ইরফান]
নিশ্চয় - يُوحَىٰ إِلَيَّ - ‘আমার কাছে ওহী আসে’ মর্মে আল্লাহর বাণীর মকাম/মর্যাদা, যা’তে উল্লেখিত হয়েছে - قُلْ إِنَّمَآ أَنَاْ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ - “(হে রাসূল) আপনি বলুন, ‘প্রকাশ্য মানবীয় আকৃতিতে আমি তোমাদের মতো, আমার নিকট ওহী আসে” [আল-কুর’আন, ১৮/১১০; নূরুল ইরফান], তাতে গভীর চিন্তার অনুপ্রেরণা যোগানো হয়েছে এই মনোনীত রাসূল (ﷺ)-এর প্রকৃতি সম্পর্কে; আর তা এই মহান নবী করীম (ﷺ)-এর অনন্য খাসাইস/বৈশিষ্ট্যের দিকে ইশারা করেছে; যাঁকে আল্লাহতায়ালা দান করেছেন এবং প্রস্তুত করেছেন রূহ/আত্মাতে ও জিসম/শরীরে, আক্কল/বুদ্ধিতে ও উপলব্ধিতে, শ্রবণশক্তিতে ও দর্শন-ক্ষমতায়, এবং অন্যান্য সব ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে ও গুণগত বৈশিষ্ট্যে; আর যাঁকে রাব্বুল আলামীন আল্লাহতায়ালা দান করেছেন সকল প্রকারের ওহী/ঐশীবাণী গ্রহণ করার অনন্য সক্ষমতা বা সামর্থ্য।
এই কারণে বুখারী ও মুসলিম শরীফ হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে:
ومن ثَمَّ لما واصل صلى الله عليه وسلم الصيام، واصل بعض أصحابه معه، فنهاهم عن الوصال، فقالوا: (نراك تواصل يا رسول الله)؟ فقال: (إني لست مثلكم ـ وفي رواية: إني لست كهيئتكم ـ أبيت يطعمني ربي ويسقيني) كما جاء في الصحيحين.
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) সওমে বিসাল তথা বিরতিহীন রোযা পালনকালে কতিপয় সাহাবী (رضي الله عنه) তাঁর সাথে রোযা পালন করছিলেন; অতঃপর তিনি তাঁদের তা করা হতে নিষেধ করেন। তাঁরা আরজ করেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ), আমরা যে আপনাকে এই বিরতিহীন রোযা রাখতে দেখছি?’ তিনি উত্তর দেন, “আমি তোমাদের মতো নই (মানে তোমাদের উপমায় নই);” অপর এক বর্ণনায় এসেছে - “আমি তোমাদের মতো নই; আমার প্রভু আল্লাহতায়ালা আমাকে পানাহার করান।” [সহীহাইন]
فهو صلى الله عليه وسلم بشر لا كالبشر، كما أن الياقوت حجر لا كالحجر.
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রকাশ্য আকৃতিতে মানবীয়, কিন্তু নন তিনি সদৃশ কোনো মানবের,
যেমনটি নীলকান্তমণি একখানি পাথর, কিন্তু নয়কো তা সাযুজ্যপূর্ণ কোনো পাথরের। [ভাবানুবাদ]
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি আদেশ করেছেন প্রিয়নবী (ﷺ)-কে অনুকরণ-অনুসরণ করার জন্যে; তিনি ফরমান:
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ ٱللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَٱللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ.
অর্থ: হে মাহবূব! আপনি বলে দিন, হে মানবকুল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। [আল-কুর’আন, ৩/৩১; নূরুল ইরফান]
আল্লাহতায়ালা এ আয়াত দ্বারা তাঁর প্রতি আপন বান্দাদের প্রেমের (মানদণ্ডের) প্রকৃত প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন যে, বান্দাবৃন্দ (অবশ্যঅবশ্য) তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে অনুসরণ-অনুকরণ করবেন। রাব্বুল আলামীন আরো বলেন:
وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ.
অর্থ: এবং তাঁরই গোলামী/তাবেদারী করো, তোমরা (সঠিক) পথ পাবে। [আল-কুর’আন, ৭/১৫৮; নূরুল ইরফান]
أي: إلى ما فيه سعادتكم في الدنيا والآخرة.
এর মানে, তোমরা যাতে দুনিয়া ও আখেরাতে নিহিত তোমাদের সুখ-শান্তি ও কল্যাণপ্রাপ্তির দিকে পথপ্রদর্শিত হতে পারো।
وهذا يتطلَّب البحث عن أعماله صلى الله عله وسلم، وعن أقواله وأحواله، ويتطلَّب التعرّف إلى سجاياه الكريمة وأخلاقه العظيمة، ليُتأسىَّ به، وليُتَّبَعَ في ذلك اتباعاً كاملًا شاملًا، إلَّا فيما خصَّه الله تعالى به من الأحكام والأحوال.
অর্থ: এটা (মানে আল্লাহর ওপরোক্ত বাণী) রাসূলে করীম (ﷺ)-এর ’আমল/পুণ্যকর্ম, বাণী ও হালত-অবস্থার অধ্যয়ন/গবেষণা দাবি করে; আরো দাবি করে তাঁর মহৎ গুণাবলী ও মহান নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জনও; যাতে তাঁকে তাতে সামগ্রিকভাবে অনুসরণ-অনুকরণ করা যায়। এর ব্যতিক্রম শুধু সেসব খোদায়ী হুকুম-আহকাম ও আহওয়াল/হালত-অবস্থা, যেগুলো আল্লাহতায়ালা তাঁর জন্যে খাস্ তথা সুনির্দিষ্টভাবে জারি করেছেন।
ومن ثَمَّ كان أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم يحرصون كل الحرص على تتبُّع أفعاله وأقواله، وأحواله وآدابه وأخلاقه، ليتبعوه في ذلك، لأنَّ عادات السادات هي سادات العادات، فكيف بعادات سيد السادات عليه أفضل الصلوات والتسليمات؟!
অর্থ: এই কারণে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁর কর্ম, ভাষণ, হালত-অবস্থা ও আদব-আখলাক্ককে অনুকরণ-অনুসরণ করার মানসে সর্বাত্মক যত্ন সহকারে অধ্যয়ন/গবেষণা করেছেন। বরঞ্চ তাঁরা তাঁর নিয়মিত আদত/অভ্যেস ও আচার-আচরণ গবেষণায়ও সর্বাত্মক যত্নবান হয়েছেন। কেননা সেরা ব্যক্তিত্বদের আদত হচ্ছে সেরা আদত/অভ্যেস; তাহলে সেরাদের সাইয়্যিদ বা নেতৃত্বকারী পুণ্যাত্মার (আলাইহি আফদালুস্ সলাওয়াতি ওয়াত্ তাসলীমাত) আদত তথা অভ্যেস কেমন হতে পারে?
আল্লামা ইমাম সানূসী (রহিমাহুল্লাহ) নিজ ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থের শরাহ/ব্যাখ্যায় বলেন:
قال العلامة السنوسي رحمه الله تعالى في شرح مقدمته: وقد عُلم من دين الصحابة رضي الله عنهم أجمعين ضرورة اتباعه صلى الله عليه وسلم من غير توقُّفٍ ولا نظر في جميع أقواله، إلا ما قام عليه دليل اختصاصه به صلى الله عليه وسلم، فقد خلعوا نعالهم لما خلع صلى الله عليه وسلم نعله، ونزعوا خواتيمهم الذهبية لما نزع صلى الله عليه وسلم خاتم الذهب، وحسر أبو بكر وعمر في قصة جلوسهما على البئر كما فعل عليه السلام، وكاد يقتل بعضهم بعضاً من شدة الازدحام على الخلاق عندما رأوا النبي صلى الله عليه وسلم يحلق رأسه الشريف؛ وحَلًَ من عمرته في قضية الحديث ـ وكان الصحابة يبحثون البحث العظيم عن هيئات جلوسه صلى الله عليه وسلم ونومه، وكيفية أكله وشربه، وغير ذلك ليقتدوا به. اهــ.
অর্থ: এটা স্পষ্ট যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সকল কথা ও কাজকে দ্বিধাহীন চিত্তে অনুসরণ করার বিষয়টি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) ধর্মের জরুরি বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করতেন; ব্যতিক্রম শুধু সেসব বিষয় যেগুলো তাঁর জন্যে (খোদায়ী) খাস্ আদেশ ছিলো। তিনি তাঁর (পবিত্র) পায়ের জুতো মোবারক খুল্লে তাঁরাও নিজেদের পায়ের জুতো খুলে নিতেন; তিনি তাঁর হাতের আংটি খুল্লে তাঁরাও তাই করতেন। প্রিয়নবী (ﷺ) যে কুয়োর পাড়ে বসেছিলেন, তাতে বসার জন্যে সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ক ও উমর ফারূক্ক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁদের সর্বাত্মক করেছিলেন। যখন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) দেখতে পান যে মহানবী (ﷺ) হুদায়বিয়ায় উমরাহ সুসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে নিজ চুল মোবারক কাটছিলেন, তখন তাঁরাও নিজেদের মাথার চুল কাটার জন্যে মহা ত্বরা করতে যেয়ে নিজেদের জীবন প্রায় ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁকে অনুসরণের উদ্দেশ্যে তাঁর উপবেশন, নিদ্রা গমন, পানাহার ইত্যাদি অভ্যেস সঠিকভাবে জানার জন্যে তাঁরা সর্বাত্মক করতেন। [ইমাম সানূসী রহিমাহুল্লাহ]
প্রিয়নবী (ﷺ) যা কিছু খেতে পছন্দ করতেন অথবা খেতে অপছন্দ করতেন, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-ও একইভাবে এমন কী তা-ই পছন্দ কিংবা অপছন্দ করতেন। [নোট: যেমন ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে জনৈক দরজি/খলিফা একবার নিজের তৈরি খাবার গ্রহণের জন্যে রাসূল (ﷺ)-কে দাওয়াত করেন। হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর সাথে আমি খাবার গ্রহণ করতে যাই; মেজবান তাঁর (ﷺ) সামনে যবের রুটি ও লাউয়ের ঝোল তরকারি পরিবেশন করেন। আমি প্রিয়নবী (ﷺ)-কে লাউ খেতে দেখি। ওই দিন থেকে আমি কখনো লাউ খাওয়া অপছন্দ করিনি (كما روى الترمذي عن أنس رضي الله عنه أن خياطاً دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم لطعام صنعه، قال أنس: فذهبت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى ذلك الطعام، فقرب إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم خُبزاً من شعير ومَرَقاً فيه دباء ـ أي: قرع ـ فرأيت النبي صلى الله عليه وسلم يتتبع الدباء فلم أحبه من يومئذ)।
ঠিক যেমনটি ইমাম মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত আবূ আইয়ূব (رضي الله عنه)-এর সূত্রে এ মর্মে যে, তিনি প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সামনে এমন খাবার পরিবেশন করেন যার মধ্যে পেঁয়াজ ছিলো। তাঁকে বলা হয়, “মহানবী (ﷺ) এটা খাবেন না।” তিনি উত্তর দেন, “এটা কি নিষিদ্ধ?” অতঃপর নবী করীম (ﷺ) বলেন, “না, কিন্তু আমি তা অপছন্দ করি।” হযরত আবূ আইয়ূব (رضي الله عنه) তখন বলেন, “সে ক্ষেত্রে নিশ্চয় আমিও তা অপছন্দ করি যা আপনি অপছন্দ করেন” (كما ورد في صحيح مسلم عن أبي أيوب رضي الله عنه لما صنع طعاماً للنبي صلى الله عليه وسلم وفيه ثوم، فيقل لأبي أيوب: لم يأكل منه النبي صلى الله عليه وسلم، فقال: أحرم هو؟ فقال النبي صلى الله عليه وسلم: (لا، ولكني أكرهه) قال أبو أيوب: فإني أكره ما تكره... الحديث)।]
অতএব, আমাদের এ বইতে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আদব-কায়দা, আমল/পুণ্যকর্ম, বাণী, যিকর-তাযকিরাহ তথা স্মরণ ও ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে আলোচনা করেছি, যাতে এগুলো দ্বারা তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করা যায়।
তৃতীয়তঃ আল্লাহতায়ালা ঈমানদার মুসলমানদের জন্যে ওয়াজিব/অত্যাবশ্যক করেছেন এ মর্মে যেনো তাঁরা নবী পাক (ﷺ)-কে নিজেদের পিতা, সন্তান, সহধর্মিণী, পরিবার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মালামাল/সম্পদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন; আর তিনি এতে ব্যর্থ ব্যক্তিদের প্রতি কঠিন শাস্তির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ ঘোষণা করেন:
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ ٱقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَآ أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأْتِيَ ٱللَّهُ بِأَمْرِهِ وَٱللَّهُ لاَ يَهْدِي ٱلْقَوْمَ ٱلْفَاسِقِينَ.
অর্থ: (হে রাসূল) আপনি বলুন, ‘যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ওই ব্যবসা-বাণিজ্য, যার ক্ষতি হবার তোমরা আশঙ্কা করো এবং তোমাদের পছন্দের বাসস্থান - এসব বস্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে যুদ্ধ করা থেকেও তোমাদের নিকট প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর নির্দেশ আনা পর্যন্ত। এবং আল্লাহ ফাসিক্কদেরকে সৎপথ প্রদান করেন না। [আল-কুর’আন ৯/২৪; নূরুল ইরফান]
ولا ريب أن أسباب المحبة ترجع إلى أنواع الجمال والكمال والنوال، كما قرره الإمام الغزالي رضي الله عنه وغيره.
অর্থ: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মহব্বত/ভালোবাসার কারণসমূহ সৌন্দর্য, পূর্ণতা ও মঙ্গল/কল্যাণ হতে উৎসারিত হয়, যেমনটি (হুজ্জাতুল ইসলাম) ইমাম গাজ্বালী (রহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য ইমাম/আল্লামাবৃন্দ আলোকপাত করেছেন নিজেদের বক্তব্যে।
কোনো ব্যক্তি ভালোবাসার পাত্র হন তাঁর মহত্ত্বের জন্যে (لكرمه); অথবা তাঁর সাহসিকতার খাতিরে (لشجاعته); কিংবা ধৈর্যের কারণে (لحلمه); নতুবা তাঁর জ্ঞানের খাতিরে (لعلمه); অথবা তাঁর নম্রতার জন্যে (تواضعه); কিংবা তাঁর ধার্মিকতা ও খোদাভীরুতার কারণে (لتعَبُّدهِ وتقواه); নতুবা তাঁর কৃচ্ছ্র ও পরহেযগারীর খাতিরে (لزهده وورعه); অথবা তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনার পরিপক্কতার জন্যে (لكمال عقله); কিংবা তাঁর ত্বরিত উপলব্ধির খাতিরে (وفور فهمه); নতুবা তাঁর আদব/শিষ্টাচারের সৌন্দর্যের কারণে (جمال أدبه); অথবা তাঁর উন্নত/উত্তম চরিত্রবৈশিষ্ট্যের খাতিরে (حسن خلقه); কিংবা তাঁর বাগ্মিতার জন্যে (فصاحة لسانه); নতুবা তাঁর সৎ সঙ্গ (حسن معاشرته); অথবা তাঁর অত্যধিক পুণ্যময়তা ও কল্যাণের খাতিরে (كثرة برّه وخيره); কিংবা তাঁর অনুগ্রহ ও করুণার জন্যে (لشفقته ورحمته); বা অনুরূপ পূর্ণতাপ্রাপ্ত সিফাত তথা গুণাবলীর খাতিরে। তাহলে এটি কেমন হবে যদি কোনো ব্যক্তিত্বের মাঝে এ সকল অনবদ্য গুণের সমাবেশ ঘটে এবং তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয় আর সম্পূর্ণতা পায়? এ রকমই হলেন আমাদের সাইয়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ), যাঁর মাঝে সকল গুণগত এবং স্বভাবগত সৌন্দর্য ও পূর্ণতার সমাহার হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা প্রিয়নবী (ﷺ)-কে সৃষ্টি করেছেন তাঁর মহা মর্যাদাপূর্ণ সুরতে (صورته العظيمة); তাঁর শালীন শারীরিক আকৃতিতে (هيئته الكريم); আর তিনি তাঁকে অলংকৃত করেছেন সর্বপ্রকারের সৌন্দর্য ও দ্যুতি দ্বারা, যার দরুন কেউ তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গেলে বলতেন:
لم يُرَ قبله ولا بعده مثله.
অর্থ: “আমি তাঁর আগে অথবা তাঁর পরে তাঁরই মতো কাউকে আর দেখিনি।”
অতএব, (শরঈ) বিধানের বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ প্রত্যেকের জন্যে এই রাসূলে করীম (ﷺ)-এর সমস্ত জামাল/সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হওয়া অত্যাবশ্যক; তাঁর সুন্দরতম (অনুকরণীয়) চরিত্রবৈশিষ্ট্য, তাঁর আত্মা, অন্তর, মেধা ও মনন সম্পর্কে জানা অতীব জরুরি। কেবল তখনই তাঁর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা কেউ অর্জন করতে সক্ষম হবেন; কেননা জ্ঞান ভালোবাসার উৎস। প্রেমাস্পদের গুণগত সৌন্দর্যের জ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তাঁর প্রতি কারো ভালোবাসাও বৃদ্ধি পায়।
আমাদের সাইয়্যিদুনা ইমাম হাসান ইবনু আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন:
سألت خالي هند بن أبي هالة ـ وكان وصّافاً ـ عن حِلْية النبي صلى الله عليه وسلم وأنا أشتهي أن يصف لي منها شيئاً أتعلق به، فقال: (كان رسول الله صلى الله عليه وسلم فخماً مفخماً، يتلألأ وجهه تلألؤ القمر ليلة البدر...)
অর্থ: আমার মামা হিন্দ বিন আবী হা’লা (رضي الله عنه) যিনি বর্ণনা করার বেলায় (ঐশী) গুণে গুণান্বিত ছিলেন, তাঁকে আমি প্রিয়নবী (ﷺ)-এর অলংকৃত গুণাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি এই আশায় যে, তিনি আমার কাছে এমন কিছু বর্ণনা করবেন যা আমি আঁকড়ে ধরতে ও যত্নে আগলে রাখতে পারবো। অতঃপর তিনি উত্তর দেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহৎ ও মহিমান্বিত গুণাবলী ছিলো, আর অন্যরাও এর দরুন তাঁকে সম্মান করতেন। তাঁর চেহারা মোবারক রাতের পূর্ণ চন্দ্রের মতো উজ্জ্বল আভা ছড়াতো…।” যেমনটি এই বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ে হাদীস উল্লেখ করা হবে।
চতুর্থতঃ প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মহান গুণাবলী (أوصافه صلى الله عليه وسلم العظيمة) ও মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (وشمائله الكريم) অধ্যয়নে অন্তরে ও চিন্তাভাবনায় এমনই এক সুদৃঢ় এবং স্পষ্ট ছাপ পড়বে যেনো কেউ তাঁর মাহবূব তথা প্রেমাস্পদকে সত্যিসত্যি দেখেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর কাছে তাঁর পূর্বে আগত রাসূল (عليه السلام)-বৃন্দের সিফাতসমূহের বর্ণনা দিতেন; আর এসব বর্ণনাকে অধিকতর স্পষ্ট করতে সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন পূর্ববর্তী রাসূল (عليه السلام)-বৃন্দের মতো দেখতে, তাঁদেরকে উল্লেখ করতেন, যতোক্ষণ না তাঁরা এমন হালত-অবস্থায় উপনীত হতেন যেনো তাঁরা ওই পয়গাম্বর (عليه السلام)-বৃন্দকে স্বচক্ষে দেখেছেন। এটিই ছিলো তাঁদের প্রতি ঘনিষ্ঠ হওয়ার এবং তাঁদেরকে ভালোবাসার সবচেয়ে যথাযথ পন্থা (তরীকা)।
সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম সহীহাইন দুটি গ্রন্থে এবং অন্যান্যরা (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) বর্ণনা করেন যে হযরতে আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) বলেছেন:
قال النبي صلى الله عليه وسلم: (ليلة أسري بي لقيتُ موسىٰ ـ قال الراوي: فنعته النبي صلى الله عليه وسلم ـ أي: وَصَفَه ـ رَجِل الرأس، كأنه رجال شنوءة، قال: ولقيتُ عيسىٰ ـ فنعته صلى الله عليه وسلم فقال: ـ رَبْعَةً أحمرَ، كأنما خرج من دِيماس ـ يعني: الحمام ـ ورأيت إبراهيم وأنا أشبه ولده به...) الحديث.
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) ফরমান: “এসরা-মে’রাজ রজনীতে পয়গাম্বর মূসা আলাইহিস্ সালামের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বর্ণনা দেন, “তাঁর চুল ছিলো কুঞ্চিত, আর তাঁকে দেখতে লাগছিলো শানূ’য়া গোত্রের লোকদের মতো।” এরপর তিনি (আরো) বলেন, “আমি পয়গাম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর সাথেও সাক্ষাৎ করি।” আর তিনি তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দেন, “পয়গাম্বর ঈসা আলাইহিস্ সালাম মধ্যম গড়নের এবং লাল বর্ণের; আর তাঁকে দেখতে এতো সতেজ লাগছিলো যেনো তিনি এই মাত্র হাম্মাম তথা গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন; এবং আমি পয়গাম্বর ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম-কে দেখেছি; আর আমিই তাঁর বংশধরদের মধ্যে চেহারায় দেখতে তাঁর সবচেয়ে সদৃশ।” [আল-হাদীস]
পঞ্চমতঃ প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শামাঈল তথা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যখন উল্লেখিত হয় এবং তাঁর আওসাফ তথা গুণাবলী বর্ণনা করা হয়, তখন যাঁরা তাঁকে ভালোবাসেন তাঁদের অন্তরের জন্যে এটি জীবনের এক উৎস হয়ে দাঁড়ায়; আর তাঁদের আত্মা ও মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করার একটি মাধ্যমে পরিণত হয়; উপরন্তু তা তাঁর প্রতি তাঁদের ভালোবাসা বৃদ্ধি করে এবং তাঁর (নৈকট্যের) আকাঙ্ক্ষাও জাগ্রত করে।
আ’রিফুল কবীর (মহান খোদা-জ্ঞানী) শাইখ আবূ মাদইয়ান (رضي الله عنه) কাব্যাকারে বলেন:
ونحيا بذكراكم إذا لم نراكُمُ :: ألا إن تَذكار الأحبة ينعشنا
فلولا معانيكم تراها قلوبنا :: إذا نحن أيقاظ وفي النوم إن غبنا
لمتنا أسىً من بُعدكم وصبابةً :: ولكنّ في المعنى معانيكمُ معنا
يحرّكنا ذكر الأحاديث عنكم :: ولولا هواكم في الحشا ما تحرّكنا
আমরা বাঁচি আপনাকে করে স্মরণ, যবে আপনার না পাই দর্শন,
নিশ্চয় প্রেমাস্পদের স্মরণে হয় আমাদের পুনরুজ্জীবন,
আমাদের অন্তর যদি না করতো দর্শন আপনার সমস্ত কল্যাণ,
আমরা যখন থাকি জাগ্রত, আর থাকি গভীর নিদ্রাগত,
আপনার বিচ্ছেদে হতো মোদের মরণ, আপনারই দূরত্বে গভীর বেদন,
কিন্তু আপনার অনুগ্রহ ও কল্যাণ করেছে আমাদের পরিবেষ্টন,
আপনার বাণী করেছে মোদের আন্দোলিত, আরো সৃষ্টি করেছে আলোড়ন,
আমাদের অন্তরে যদি না হতো আপনার প্রেমের সিংহাসন,
আমরা থাকতাম জড়, অন্তরে সৃষ্টি হতো না কোনো সঞ্চালন। [ভাবানুবাদ]
আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করুন যিনি বলেছিলেন:
أخلايَ إن شطَّ الحبيب ورَبْعه :: وعزَّ تلاقيه وناءتْ منازلهْ
وفاتكم أن تنظروه بعينكم :: فما فاتكم بالسمع هذي شمائله
ওহে বন্ধু সকল! যদি প্রেমাস্পদ ও তাঁর জাতি রহেন বহু দূর,
তাঁর সাক্ষাৎ লাভ হয় আয়ত্তের বাহির, আর দূরে রয় তাঁর ঘর,
তোমার নয়নে তাঁর দর্শন লাভের সুযোগও যদি হয় দুষ্কর,
তবু তুমি হারাও নি সুযোগ তাঁর চারিত্রিক গুণের শ্রোতা হবার। [ভাবানুবাদ]
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
🕌প্রথম অধ্যায়: প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শারীরিক সৌন্দর্য
প্রথম অধ্যায়: প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শারীরিক সৌন্দর্য
[حول محاسن صورته الشريفة]
আল্লাহতায়ালা আমাদের এবং আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন - (অতঃপর) জেনে রাখুন যে, আল্লাহ আমাদের সাইয়্যিদুনা মুহাম্মদ (ﷺ)-কে সবচেয়ে চমৎকার ও সুন্দর শারীরিক অবয়বে (সুরতে বশরীয়াহ) সৃষ্টি করেছেন। তিনি হলেন সৃজিত সৌন্দর্যের এবং শারীরিক ও আচরণগত উৎকর্ষের প্রতীক। তাঁকে যাঁরা দেখেছেন এবং তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন, তাঁরা একমত হয়েছেন যে তাঁর মতো আর কাউকেই ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।
হযরত বারা’য়া বিন আ’যিব (رضي الله عنه) বলেছেন:
(كان النبي صلى الله عليه وسلم أحسن الناس وجهاً، وأحسنهم خُلُقاً، ليس بالطويل البائن ولا بالقصير) متفق عليه.
অর্থ: “প্রিয়নবী (ﷺ)-এর ছিলো মানুষের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর চেহারা মোবারক ও সর্বোত্তম চরিত্রবৈশিষ্ট্য। তিনি না ছিলেন (অতি) লম্বা, না খর্বাকৃতির।” [বুখারী ও মুসলিম সর্বসম্মত]
হযরত বারা’য়া বিন আ’যিব (رضي الله عنه) আরো বলেন:
(كان النبي صلى الله عليه وسلم مربوعاً، بعيد ما بين المنكبين، له شعر يبلغ شحمة أذنيه، رأيته في حُلةٍ حمراء، لم أرشيئاً قطُّ أحسنَ منه صلى الله عليه وسلم) رواه مسلم.
অর্থ: “মহানবী (ﷺ) ছিলেন মধ্যম উচ্চতার এবং তাঁর কাঁধগুলো ছিলো প্রশস্ত। তাঁর চুল কানের লতি পর্যন্ত ঝুলে থাকতো। আমি তাঁকে (একবার) একটি লাল রংয়ের শাল পরনে দেখেছিলাম; তাঁর চেয়ে সুন্দর কোনো কিছু (মানে কাউকে) আমি আর কখনোই দেখিনি।” [মুসলিম শরীফ]
আমীরুল মু’মেনীন হযরতে ইমামে আলী ইবনে আবী তালিব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) বলেন:
(كان رسول الله صلى الله عليه وسلم ليس بالقصير ولا بالطويل، ضخم الرأس، شثْن الكفين والقدمين، مُشْرَباً وجهه بحمرة، طويلَ المسربُة، إذا مشى تكفأ كأنما يقلع من صخر، لم أر قبله ولا بعده مثله) رواه الإمام أحمد.
অর্থ: “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না ছিলেন খাটো, না লম্বা। তাঁর শির মোবারক ছিলো বড়; হাত ও পা ছিলো মাংসবহুল; তাঁর চেহারা মোবারক ছিলো রক্তিম বর্ণের; তাঁর বুক থেকে নাভী পর্যন্ত লোমের একখানি পাতলা রেখা ছিলো। তিনি যখন হাঁটতেন, তখন মনে হতো যেনো তিনি কোনো উঁচু স্থান থেকে নেমে আসছেন। তাঁর মতো কাউকে আমি এর আগে অথবা পরে আর কখনোই দেখিনি।” [ইমাম আহমদ হাম্বল (رحمة الله) বর্ণিত]
হযরতে ইমামে আলী ইবনে আবী তালিব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে বর্ণিত যে, তিনি যখনই প্রিয়নবী (ﷺ) সম্পর্কে বর্ণনা করতেন, তখন তিনি বলতেন:
(لم يكن رسول الله صلى الله عليه وسلم باطويل الممغَّط، ولا بالقصير المتردّد، وكان ربْعة من القوم، ولم يكن بالجَعْد القَطَط، ولا بالسبْط، كان جعْداً رَجِلًا، ولم يكن بالمطهم ولا بالمُكَلْثم، وكان في وجهه تدوير، أبيضُ، مُشْرب بحمرة، أدعج العينين، أهدب الأشفار، جليلُ المشاش والكَتَد، أجرد، ذو مَسْربُةٍ، شثن الكفين والقدمين، إذا مشى تقلعَ كأنما ينحطُّ من صَبَبٍ، وإذا التفتَ التفتَ معاً، بين كتفيه خاتَم النبوَّة وهو خاتم النبيين، أجودُ الناس صدراً، وأصدقُ الناس لهجةً، وألينهم عريكةً، وأكرمهم عِشْرَةً، من رأه بديهةً هابه، ومن خالطه معرفةً أحبه، يقول ناعته: لم أرَ قبلَه ولا بعدَه مثلَه)
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) না ছিলেন অতিরিক্ত লম্বা, না খাটো; বরং তিনি ছিলেন মধ্যম গড়নের। তাঁর চুল মোবারক না ছিলো কোঁকড়া, না সোজা, বরং ছিলো ঢেউ খেলানো ও প্রবাহিত। তিনি ছিলেন মাংসল। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল পুরোপুরি গোল ছিলো না, বরং সামান্য গোলাকার। তাঁর গায়ের রং ছিলো ফর্সা, তবে কিছুটা লাল আভাযুক্ত [নোট: কিছু হাদীসে বর্ণিত তাঁর শরীরের রং কালো হওয়া প্রসঙ্গে হাফিয ইরাকী সেগুলোকে শায্ তথা অনিয়মিত/বিরল বলেছেন। তিনি বলেন, “এই কৃষ্ণকায় শব্দটি কেবল হামিদ বিন আনাস বর্ণনা করেছেন; আনাস হতে অন্যান্য বর্ণনাকারী ‘উজ্জ্বল বর্ণের’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দের পনেরো জন তাঁকে (ﷺ) ফর্সা বলে বর্ণনা করেছেন, যেমনটি এ ব্যাপারে গবেষণাকারী আলেম-উলামা উল্লেখ করেছেন”]। তাঁর নয়নযুগল ছিলো কালো; চোখের পাতার লোমগুলো ছিলো লম্বা। তাঁর গ্রন্থিগুলো বড় বড় ছিলো, আর দুই কাঁধ ছিলো প্রশস্ত। তাঁর গায়ের চামড়া ছিলো মসৃণ; লোমের একটি পাতলা রেখা বুক হতে নাভী পর্যন্ত নেমে গিয়েছিলো। তাঁর হাত ও পা ছিলো মাংসল। তিনি তেজোদ্দীপ্তভাবে হাঁটতেন, যেনো কোনো উঁচু স্থান হতে নেমে আসছিলেন। তিনি যখন কোনো কিছুর দিকে ফিরে তাকাতেন, তখন পুরো মোবারক শরীরই ঘুরিয়ে দাঁড়াতেন। তাঁর পবিত্র কাঁধের মাঝখানে ছিলো নবূয়্যতের সীলমোহর, আর তিনিই ছিলেন খাতামুন্ নাবীঈন (পয়গম্বরবৃন্দের সীলমোহর)। তাঁর অন্তর ছিলো সকল অন্তরের চেয়ে পবিত্র। তাঁর ভাষণ ছিলো সেরা সত্যভাষণ। তিনিই ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে নম্রতম; আর সঙ্গী হিসেবে তাঁদের মাঝে সবচেয়ে দয়ালু। তাঁকে যে কেউ অকস্মাৎ দেখলে সশ্রদ্ধ বিস্ময়াভিভূত হতেন। তাঁর সাথে কেউ পরিচিত হলে তাঁকে পছন্দ করতেন। যে কেউ তাঁর বর্ণনা দিতে গেলে বলতেন, “আমি তাঁর মতো কাউকে এর আগে অথবা পরে আর কখনোই দেখিনি।”
وروى البيهقي أن رسول الله ﷺ ليلة هاجر من مكة إلى المدينة هو وأبو بكر وعامر بن فُهَيْرة مولى أبي بكر، ودليلهم عبد الله بن أُريقط الليثي، فمرُّوا بخيمة أمِّ معبد عاتكة بنت خالد الخزاعية ـ وكانت أمُّ معبد امرأةً برزة جلدة ـ أى: قوية ـ تحتبي وتجلس بفناء الخيمة فتطعم وتسقي (مَن يمر بها) فسألوها هل عندها لحم أو لبن يشترونه منها؟ فلم يجدوا عندها شيئاً من ذلك، وقالت: والله لو كان عندنا شيء ما أعوزناكم القِرى ـ أي: ما أحوجناكم بل كنا نضيفكم ـ وإن القوم مُرمِلون مُسنتون.
অর্থ: ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) ও অন্যান্য মুহাদ্দীস ইমামবৃন্দ [নোট: হাকিম কর্তৃকও বর্ণিত; তিনি এটাকে সহীহ বলেছেন; আরো বর্ণনা করেছেন ‘আল-গিলা’নীয়্যাত’ গ্রন্থপ্রণেতা, ইবনে আবদুল বার্র, ইবনু শাহীন, ইবনুস্ সাকান, ইমাম তাবারী ও অন্যান্যরা] বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মক্কা মোয়াযযমা হতে মদীনা মোনাওয়ারায় সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه), আমির বিন ফুহায়রাহ (হযরত আবূ বকরের মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম) ও তাঁদের পথপ্রদর্শক আবদুল্লাহ বিন উরায়কিয আল-লাইসী (رضي الله عنه)-সহ হিজরত করেন, তখন তাঁরা উম্মে মা’বাদ আতিকা বিনতে খালিদ আল-খুযাইয়্যা নাম্নী এক বৃদ্ধার তাঁবুর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন; এই মহিলা তাঁবুর ধারে বসে (পথ অতিক্রমকারীদের) খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতেন। তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন তাঁর কাছে কেনার মতো কোনো মাংস বা দুধ আছে কি-না, কিন্তু তাঁরা দেখতে পান তাঁর কাছে তা নেই। ওই মহিলা তাঁদের জানান, “আল্লাহর শপথ, আমাদের কাছে কিছু থাকলে আমরা আপনাদের অভাবে রাখতাম না, কিন্তু আমাদের জাতি একটি নিষ্ফলা বছরের মুখ দেখেছে এবার।”
فنظر رسول الله ﷺ فإذا شاه في كِسر ـ أي: جانب ـ خيمتها فقال: (ما هذه الشاة يا أمَّ معبد؟). فقالت: شاة خلّفها الجهد عن الغنم. فقال ﷺ: (فهل فيها من لبن؟). فقالت: هي أجهد ـ أي: أضعف ـ من ذلك. فقال ﷺ: (أتأذنين لي أن أحلبها)؟ فقالت: إن كان بها حَلْب فاحلُبْها ـ وفي رواية: قالت: نعم، بأبي أنت وأمي إن رأيت بها حلْباً فاحلُبها ـ. فدعا رسول الله ﷺ بالشاة فمسحها، وذكر اسم الله ومسحَ ضرعها ـ وفي رواية: ظهرها ـ وذكر اسم الله، ودعا بإناءٍ لها يُريض الرهط ـ أي: يشبع الجماعة حتى يُريضوا ـ وتفاجّت، واجترّت ـ وفي رواية: ودرّت ـ فحلب فيه ثجاً حتى ملأه.
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) একটি মাদী ভেড়ার দিকে নজর দেন, যেটা ওই মহিলার তাঁবুর এক পাশে দৃশ্যমান হয়েছিলো; আর তিনি (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, “ওহে উম্মে মা’বাদ, এই ভেড়ীর বিষয়টি কী?” মহিলা উত্তর দেন, “এটা এমন এক ভেড়ী যার ক্লান্তি-অবসাদ এটাকে অন্যান্য ভেড়া হতে পেছনে ফেলে দিয়েছে।” নবী করীম (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, “এর কি কোনো দুধ আছে?” মহিলা উত্তর দেন, “এটা দুধ দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই দর্বল।” প্রিয়নবী (ﷺ) প্রশ্ন করেন, “আপনি কি আমাকে এর দুধ দোহনের অনুমতি দেবেন?” তিনি উত্তরে বলেন, “যদি দুধ দোহন সম্ভব হয়, তবে তা করুন।” অপর এক বর্ণনায় এভাবে এসেছে - “আমার বাবা ও মা আপনার জন্যে উৎসর্গিত হোন, আপনি যদি এর দুধ দোহন সম্ভব বলে মনে করেন, তবে তা করুন।” মহানবী (ﷺ) ভেড়ীকে নিয়ে আসতে বলেন এবং আপন হাত মোবারক দ্বারা সেটার বাঁট মোছেন; অপর এক বর্ণনায় এসেছে - ‘ওর পিঠ।’ আর তিনি আল্লাহর পবিত্র নাম উল্লেখ করেন; অতঃপর এমন একটা বালতি আনতে বলেন, যেটা সবার জন্যে পর্যাপ্ত হবে যতোক্ষণ না সবাই ঘুমোতে যাচ্ছেন। ভেড়ী তার নিজের দুটি পা ফাঁক করে দাঁড়ায় এবং প্রচুর দুধ ছাড়ে, যার দরুন বালতি পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের দুধ পান করতে দেন এবং তাঁরা তা নিজেদের সন্তুষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পান করেন। অতঃপর প্রিয়নবী (ﷺ) তা সবশেষে পান করেন এ কথা বলে -
(ساقي القوم آخرهم شرباً).
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি মানুষদেরকে পান করায়, তার সবশেষে পান করা উচিত।”
এরপর তিনি আবার বালতি/পাত্রটি দুধ দ্বারা পূর্ণ করেন এবং উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه)-এর কাছে হস্তান্তর করেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে তিনি তাঁকে বলেন -
(ارفعي هذا لأبي معبدٍ إذا جاءك).
অর্থাৎ, “এটি আবূ মা’বাদ (মানে মহিলার স্বামী)-কে দেবেন যখনই তিনি আপনার কাছে আসবেন।” এরপর তাঁরা স্থান ত্যাগ করেন।
সহসা মহিলার স্বামী আবূ মা’বাদ (رضي الله عنه) রুগ্ন ও ক্ষীণকায় মেষপাল নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি (পাত্রভর্তি) দুধ দেখতে পেয়ে আশ্চর্যান্বিত হন এবং স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন -
من أين هذا اللبن يا أم معبد ولا حلوب في البيت، والشاء عازب؟!.
অর্থ: “এই দুধ কোত্থেকে এলো, ওহে উম্মে মা’বাদ, যখন বাড়িতে এমন কোনো প্রাণিই নেই যে দুধ দেয়, আর ভেড়ীগুলোও চারণভূমি থেকে রয়েছে দূরে?”
উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه) উত্তরে বলেন -
لا والله إلَّا أنه مرَّ بنا رجل مبارك،
অর্থ: “এক পুণ্যবান মোবারক সত্তা আমাদের এলাকা অতিক্রম করেছেন (আজ)।” এরপর তিনি পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করেন।
আবূ মা’বাদ (رضي الله عنه) বলেন -
صفيه لي يا أمّ معبد.
অর্থ: “ওহে উম্মে মা’বাদ, আমার জন্যে তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দাও।”
অতঃপর উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه) বলেন -
فقالت: رأيت رجلًا ظاهر الوضاءة، حسن الخَلقِ، مليح الوجه، لم تَعِبْه ثَجْلة، ولم تُزْرِِ بِهِ صَعْلة، قسيم وسيم، في عينيه دَعَج، وفي أشفاره وَطَف، وفي صوته صَحَل، أحْور، أكحل، أزجُّ، أقرن، في عنقه سطع، وفي لحيته كثاثة، إذا صمت فعليه الوقار، وإذا تكلم سما وعلاه البهاو، حلو المنطق، كلامه فصل لا نزر ولا هذر، كأن منطقه خرزات نظم يتحدرن، أبهى الناس وأجمله من بعيد، وأحسنه من قريب، ربعة، لا تَشْنَؤه عين من طول، ولا تقتحمه عين من قصر، غصن بين غصنين، فهو أنضر الثلاثة منظراً، وأحسنهم قداً، له رفقاء يَحفون به، إن قال استمعوا لقوله، وإن أمر تبادروا لأمره، محفود محشود، لا عابس ولا مفنِّد.
অর্থ: “আমি এমন এক ব্যক্তিত্বকে দেখেছি যিনি ছিলেন দৃশ্যমান দীপ্তিময়, সদাচারী; সুন্দর উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট; তাঁর পাঁজর না ছিলো বাইরে প্রসারিত, না তাঁর শির মোবারক ছিলো ছোট আকৃতির; তিনি ছিলেন সুন্দর ও শুভ্র। তাঁর নয়নযুগল ছিলো ঘন কালো এবং তাঁর চোখের লোম ঘন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিলো কোমল ও মৃদু। তাঁর চোখের শুভ্রতা ছিলো উজ্জ্বল এবং চক্ষুতারা কালো। তাঁর ভ্রূ ছিলো কোণাগুলোতে সরু এবং (মধ্যখানে) সংযুক্ত [নোট: বইয়ের পরবর্তী পর্যায়ে হযরত হিন্দ্ বিন আবী হা’লা (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদীসের সাথে এ বর্ণনা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যা’তে বিবৃত হয়েছে যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর ভ্রূ ছিলো দীর্ঘ এবং সংযুক্ত ছিলো না; আর এটাই অধিকতর প্রাধান্যপ্রাপ্ত বর্ণনা। এই দৃশ্যতঃ অসামঞ্জস্য এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, তাঁর পবিত্র ভ্রূ ছিলো সরু বা মিহি কেশাবৃত যা ভ্রমণের ধুলো পড়ে দৃশ্যমান হয়েছিলো, কেননা উম্মে মা’বাদ (رضي الله عنه)-এর বর্ণনা এসেছে হজূরের (ﷺ) সফরের সময় - প্রাগুক্ত শরহুয্ যুরকানী আলাল মাওয়াহীব]। তাঁর মোবারক ঘাড় ছিলো দীর্ঘ এবং দাড়ি ছিলো পূর্ণ। তিনি যখন ছিলেন নীরব, তখন তাঁকে মহৎ ও মর্যাদাপূর্ণ দেখা গিয়েছে; আর কথা বল্লে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ও মহিমার মুকুট পরিহিত। তাঁর ভাষণ ছিলো মিষ্টি, কথা যথাযথ - কমও নয়, বেশিও নয়, যেনো নিচের দিকে প্রবাহমান মুক্তার মালা। দূর থেকে তাঁকে মানুষের মাঝে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুন্দর দেখা যেতো, আর কাছ থেকে দেখতে তাদের সবার চেয়ে সুন্দর। তিনি ছিলেন মধ্যম উচ্চতাবিশিষ্ট, অসম্মতভাবে লম্বা নন, অপছন্দনীয়ভাবে বেঁটেও নন - যেনো দুটি বৃক্ষশাখার মাঝে একটি বৃক্ষশাখা; এই তিনের মাঝে তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রভাময়, (দৈহিক) উচ্চতায় সবচেয়ে সুন্দর। তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন তাঁরই সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দ। তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁরা মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। তিনি যখন আদেশ দিচ্ছিলেন, তখন তাঁরা তা পালনে ত্বরা করছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দের কাছে সম্মানিত এবং তাঁদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। তিনি কখনো (তাঁদের প্রতি) ভ্রূকুটি করেননি, (তাঁদের) সমালোচনাও করেননি।”
অতঃপর আবূ মা’বাদ (رضي الله عنه) বলেন -
هذا والله صاحب قريش الذي تطلب، ولو صادفتُه لالتمست أن أصحبه وفي رواية: لو روأيته لاتبعته ـ ولأجهدنَّ إن وجدت إلى ذلك سبيلا ـ ثم هاجرت مع زوجها إلى النبي ﷺ وأسلما.
অর্থ: “আল্লাহর কসম, উনিই কুরাইশ গোত্রের সেই ব্যক্তিত্ব যাঁকে আমরা খুঁজছি; আর আমি যদি তাঁর সাক্ষাৎ পাই, তাহলে আমি তাঁর সাহচর্য অন্বেষণ করবো।” অপর এক বর্ণনায় আছে তিনি বলেন, “যদি আমি তাঁকে দেখতে পাই, তাহলে তাঁর আনুগত্য করবো এবং এই (আনুগত্যের) পথপ্রাপ্তিতে কঠোর সাধনা করবো।” অতঃপর তাঁরা দু জন (স্বামী ও স্ত্রী) প্রিয়নবী (ﷺ)-এর দরবারে হিজরত করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। [দেখুন - শরহুল মাওয়া’হিব এবং তারীখু ইবনে কাসীর]
وروى مسلم والترمذي عن الجُرَيري ـ بالتصغير ـ أنه قال لأبي الطفيل: رأيتَ رسول الله ﷺ؟ فقال: نعم. قلت: كيف رأيته؟ ـ وفي رواية الترمذي: فقلت: صفه لي ـ فقال: كان رسول الله ﷺ أبيضَ مليحَ الوجه ـ وفي رواية: أبيض مليحاً مقصَّداً.
অর্থ: সর্ব-ইমাম মুসলিম ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন আজ্-জুরাইরী (رحمة الله) সূত্রে এ মর্মে যে তিনি আবূ আত্ তোফায়েল (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখেছেন কি?” তিনি উত্তর দেন, “হ্যাঁ।” আজ্ জুরাইরী (رحمة الله) জিজ্ঞেস করেন, “তাঁকে আপনি কেমন দেখেছেন?” (ইমাম তিরমিযী (رحمة الله)-এর বর্ণনায় এসেছে - “অনুগ্রহ করে আমায় তাঁর বর্ণনা দিন)।” আবূ আত্ তোফায়েল (رضي الله عنه) উত্তরে বলেন, “প্রিয়নবী (ﷺ) ছিলেন শুভ্র বর্ণের সুদর্শন চেহারাবিশিষ্ট [নোট: অন্যান্য বর্ণনানুসারে কিছুটা রক্তিমাভ - লেখক]।” অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে তিনি বলেন, “শ্বেতবর্ণের, সুদর্শন চেহারার এবং মধ্যম।” [নোট: মধ্যম বলতে তাঁর গুণাবলীতে মধ্যম অবস্থানে; এবং মধ্যম হলো বিপরীত দুই প্রান্তিক বৈশিষ্ট্যাবলীর সেরা উপাদানগুলোর সমষ্টি - লেখক]
تلألؤ وجهه المنير وإشراق مُحياه
রাসূল (ﷺ)-এর চেহারার উজ্জ্বল প্রভা ও সত্তাগত দীপ্তি
সকল মানুষের মধ্যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক ছিলো সবচেয়ে সুন্দর, আর তাঁর পবিত্র সত্তা ছিলো তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যোতির্ময়। তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা প্রদানকারী সমস্ত সাহাবা (رضي الله عنه)-ই একমত হয়েছেন যে তাঁর চেহারা মোবারক ছিলো উজ্জ্বল ও দীপ্তিময়, আলোক বিচ্ছুরণকারী ও স্পষ্ট প্রভাময়। তাঁদের কেউ কেউ তাঁর জ্যোতির ঔজ্জ্বল্যকে সূর্যকিরণের সাথে তুলনা করেছেন; আর অন্যরা করেছেন চাঁদের সাথে তুলনা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তাঁর চেহারা মোবারকের প্রভাকে চাঁদের ছড়ানো দীপ্তির সাথে তুলনা করেছেন। এসবই আমাদের কাছে নিশ্চিত করেছে তাঁর চেহারা মোবারকের জ্যোতির্ময়তা এবং তাঁরই চমকপ্রদ ঔজ্জ্বল্য - সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
এতদুদ্দেশ্যে চলুন, আমরা বিবেচনা করি অকাট্য দলিলস্বরূপ একটি হাদীস যা বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে; তিনি বলেন -
(ما رأيت شيئاً أحسن من رسول الله ﷺ، كأنَّ الشمس تجري في وجهه)
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে সুন্দর কোনো কিছু আমি আর কখনোই দেখিনি; এ যেনো সূর্য তাঁরই চেহারা মোবারক হতে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণ করছিলো। [নোট: এটি আরো বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম আহমদ, বায়হাকী, ইবনে হিব্বান ও ইবনে সা’আদ (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)। রাসূল (ﷺ) তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দকে সাথে নিয়ে মদীনার মসজিদে নববীতে অবস্থানকালে হযরত আমর বিন সালিম আল-খুযাঈ (رضي الله عنه) একটি কবিতা পাঠ করেন; এটি তখনই যখন কুরাইশ গোত্র সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করেছিলো:
يا رب إني ناشد محمداً :: حلف أبينا وأبيه الأتلدا
قد كنتم ولداً وكنا والداً :: ثمت أسلمنا ولم ننزع يدا
فانصر هداك الله نصراً أبداً :: وادع عباد الله يأتوا مددا
فيهم رسول الله قد تجردا :: أبيض مثل البدر يسمو صعدا
হে মোর প্রভু! প্রিয়নবী (ﷺ)-এর প্রতি আমার এ আবেদন,
শপথ আমাদের পিতৃপৃরুষ ও তাঁরই পিতৃপুরুষ, পূর্বতন,
আপনি ছিলেন এক পুত্র, আমরা এক পিতা, (দায়িত্ববান)
অতঃপর আমি করলাম (নিজকে) সমর্পণ এবং করিনি হাত অপসারণ,
অতএব, আল্লাহর চির-হেদায়াত ও সাহায্য আপনার প্রতি হোক বর্ষণ,
আর সাহায্যের জন্যে আল্লাহর বান্দাদের করুন আপনি আহ্বান,
তাঁদের মাঝখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অবস্থান, অনন্য মহান,
যেমন উজ্জ্বল পূর্ণচন্দ্র রাতের আকাশে উদীয়মান। (ভাবানুবাদ) - লেখক]
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্বালী (رحمة الله) বলেন:
وكانوا يقولون: هو كما وصفه صاحبه أبو بكر رضي الله عنه
أمينٌ مصطفى للخير يدعو :: كضوء البدر زايله الظلام
সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দ বলতেন, প্রিয়নবী (ﷺ) তেমনই ঠিক যেমনটি হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) বর্ণনা করতেন -
বিশ্বাসভাজন, মনোনীত জন, যিনি কল্যাণের প্রতি করেন আহ্বান,
যেমন উদীয়মান পূর্ণচন্দ্রের কিরণ রাতের অন্ধকারকে করে বিতাড়ন। (ভাবানুবাদ)
হযরত আবূ উবায়দাহ বিন মুহাম্মদ বিন আম্মার বিন ইয়াসির (رحمة الله) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
قلت للرُّبيِّع بنت معوِّذ: صفي لنا رسول الله ﷺ. فقالت: (يا بنيَّ لو رأيتَه الشمس طالعة) رواه الترمذي. والبيهقي وغيرهما.
অর্থ: আমি হযরত রুবাইয়া বিনতে মু’য়াওউইয (رضي الله عنه)-কে বল্লাম, “আমাদের জন্যে প্রিয়নবী (ﷺ) সম্পর্কে বর্ণনা করুন।” তিনি উত্তরে বল্লেন, “ওহে আমার পুত্র, তুমি যদি তাঁর দেখা পেতে, তাহলে তুমি (যেনো) উদীয়মান সূর্যকে দেখতে পেতে।” [সর্ব-ইমাম তিরমিযী (رحمة الله), বায়হাকী (رحمة الله) প্রমুখ বর্ণিত]
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত হিন্দ বিন আবী হা’লা (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদীস, যা ইমাম হাসান বিন আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সূত্রে, যিনি বলেন:
سألت خالي هند بن أبي هالة ـ وكان وصافاً ـ عن حلية النبي ﷺ وأنا أشتهي أن يصف لي منها شيئاً أتعلق به. فقال: (كان رسول الله ﷺ فخماً مفخماً، يتلألؤ وجهه تلألؤ القمر ليلة البدر..) الحديث كما سيأتي.
অর্থ: আমার মামা হিন্দ্ বিন আবী হা’লা (رضي الله عنه) যিনি বর্ণনা করার বেলায় (ঐশী দানে) গুণান্বিত ছিলেন, তাঁকে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম এই আশায় যে তিনি আমার কাছে এমন কিছু বর্ণনা করবেন যা আমি অন্তরে আগলে রেখে লালন করতে পারবো; আর তিনি বল্লেন, “প্রিয়নবী (ﷺ)-এর ছিলো মহান গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী, এবং তাঁকে অন্যরা সেই মোতাবেক সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর চেহারা মোবারক পূর্ণ চন্দ্রের আলো বিচ্ছুরণ করতো..,” যেমনটি বর্ণিত হয়েছে একটি হাদীসে, যার পুরোটুকু পরে উল্লেখ করা হবে।
হযরত জাবির ইবনে সামূরাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
(رأيت رسول الله ﷺ في ليلة إضحِيان وعليه حُلة حمراء، فجعلتُ أنظر إليه وإلى القمر فلهوَ عندي أحسن من القمر) رواه الترمذي.
অর্থ: আমি এক চাঁদনী রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখি; একটি লাল রংয়ের চাদর তাঁর পরনে ছিলো। আমি তাঁকে দেখে চাঁদের দিকে তাকানো আরম্ভ করি এবং তাঁকে আমার কাছে চাঁদের চেয়েও সুন্দর মনে হয়। [ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণিত]
হযরত আবূ ইসহাক্ব আস্ সাবাঈ (رضي الله عنه) বলেন:
سأل رجل البراء بن عازب: أكان وجه رسول الله ﷺ مثل السيف (أي: أهو مثل السيف في اللمعان والإضاءة)؟ فقال: (لا، بل مثل القمر) رواه البخاري والترمذي.
অর্থ: জনৈক ব্যক্তি হযরত বারা’য়া ইবনে আযিব (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক কি তরবারির মতো ছিলো (মানে আলোর ঝলক ছড়ানোর বেলায়)?” তিনি উত্তর দেন, “না, বরঞ্চ চন্দ্রের মতো ছিলো।” [সর্ব-ইমাম বুখারী (رحمة الله) ও তিরমিযী (رحمة الله)]
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত জাবির ইবনে সামুরাহ (رضي الله عنه)-এর সূত্রে এ মর্মে যে জনৈক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেন:
كان وجه رسول الله ﷺ مثل السيف؟ فقال جابر: (لا بل مثل الشمس والقمر، وكان مستديراً) [يعني أن وجهه ﷺ مثل الشمس في الإشراق والضياء، ومثل القمر في الملاحة والبهاء، وفيه استدارة، ﷺ، كما في شرح المواهب.
অর্থ: “প্রিয়নবী (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক কি তরবারির মতো ছিলো?” হযরত জাবির (رضي الله عنه) উত্তর দেন, “না, বরঞ্চ সূর্য ও চাঁদের মতো, আর তা গোলাকার ছিলো।” (মানে তাঁর চেহারা মোবারক সূৃর্যের মতো উজ্জ্বল ও চাঁদের মতো প্রভাময় ছিলো, আর তা গোলাকার ছিলো - শরহে মাওয়াহিব গ্রন্থ হতে; প্রণেতা - ইমাম যুরকানী মালিকী রহমতুল্লাহি আলাইহি)
সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে হযরত কা’আব বিন মালিক (رضي الله عنه) হতে, যিনি বলেন:
(وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا سُرَّ اسْتَنَارَ وَجْهُهُ، حَتَّى كَأَنَّهُ قِطْعَةُ قَمَرٍ..) الحديث.
অর্থ: যখন প্রিয়নবী (ﷺ) খুশি হতেন, তখন তাঁর চেহারা মোবারক এমন আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠতো যেনো (মনে হতো) তা চন্দ্রের অংশবিশেষ। [আল-বুখারী, হাদীস নং ৩৫৫৬ (আন্তর্জাতিক)]
ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) বর্ণনা করেন বিখ্যাত তাবেঈ হযরতে আবূ ইসহাক্ব আল-হামদানী (رحمة الله)-এর সূত্রে এ মর্মে যে, হামদানের জনৈকা মহিলা (যাঁকে আবূ ইসহাক্ব নাম দেন, তিনি) বলেন:
حججتُ مع رسول الله ﷺ مراتٍ، فرأيتُه على بعيرٍ له يطوف بالكعبة، بيدهِ محجن عليه بُردان أحمران، يكادُ يَمَسُّ شعره منكبه إذا مرَّ بالحجر استلمه بالمحجن، ثمَّ يرفعه إلى فيه فيقبِّله، قال أبو إسحاق: فقلتُ لها: شبهيه ﷺ فقالت: (كالقمر ليلة البدر، لم أرَ قبله ولا بعده مثله).
অর্থ: “আমি কয়েকবার রাসূলূল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে হজ্জ্বব্রত পালন করি। একবার আমি তাঁকে উটের পিঠে চড়ে কা’বা শরীফের তওয়াফ করতে দেখি; তাঁর হাতে ছিলো একটি লাঠি, পরনে ছিলো দুটো লাল কাপড়/বুরদা; তাঁর চুল মোবারক প্রায় কাঁধ ছুঁয়েছিলো। যখন তিনি কালো পাথর অতিক্রম করেন, তখন সেটাকে হাতের যষ্টি দ্বারা সালাম জানান; অতঃপর সেটাকে (যষ্টিকে) (নিজ ঠোঁট বরাবর) ওপরে তুলে চুম্বন করেন।” এমতাবস্থায় হযরত আবূ ইসহাক্ব (رحمة الله) মহিলা (رضي الله عنه)-কে বলেন, “তাঁর (ﷺ) কোনো উপমা দিন।” মহিলা (رضي الله عنه) উত্তরে বলেন, “তিনি (ﷺ) চন্দ্রের মতো যখন তা পূর্ণচন্দ্রের আকার ধারণ করে। আমি তাঁর আগে অথবা পরে তাঁর মতো আর কাউকেই দেখিনি।”
নবী করীম (ﷺ) যখন (হিজরতের সময়) মদীনা মোনাওয়ারায় আগমন করেন, তখন মদীনাবাসীবৃন্দ গান গাইতে থাকেন:
طَلَعَ الْبَدْرُ عَلَيْنا
مِنْ ثَنِيَّاتِ الْوَدَاعِ
وَجَبَ الشُّكْرُ عَلَيْنَا
مَا دَعَا لِلّٰهِ دَاعٍ
أَيُّهَا الْمَبْعُوثُ فِيْنَا
جِئْتَ بِالْأَمْرِ المُطَاعِ
হেদায়াতের পূর্ণচন্দ্র আমাদের ভাগ্যাকাশে ‘আল-ওয়াদা’আ’ এলাকায় হয়েছেন উদিত,
যতোদিন আল্লাহর কোনো এবাদতকারী থাকবেন আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশে হবো বাধিত,
হে রাসূল, আপনি আমাদের মাঝেই হয়েছেন (খোদা কর্তৃক) লালিত-পালিত,
এসেছেন নিয়ে (ঐশী) এক আজ্ঞা যা হতে হবে মান্যকৃত। (ভাবানুবাদ)
প্রিয়নবী (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক নূরানী তথা জ্যোতির্ময় থাকতো অর্থপূর্ণতা ও রহস্যময়তার প্রবাহে, যা তাঁরই আল্লাহর প্রকৃত ও সত্যনিষ্ঠ রাসূল হওয়ার স্পষ্ট প্রামাণিক দলিল।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (رضي الله عنه) বলেন -
أول ما قدم رسول الله ﷺ المدينة انجفل الناس إليه ـ أي: أسرعوا إليه ـ فكنت فيمن جاءه، فلما تأملت وجهه ﷺ واستبنته ـ أي: تحققته وتبينته ـ عرفتُ أن وجهه ليس بوجه كذاب ـ أي: بل هو وجه إمام المرسلين ـ قال: فكان أول ما سمعت من كلامه أن قال: (أَيُّها الناس: أفشوا السلام، وأَطعموا الطعام، وصِلوا الأرحام، وصَلُّوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام) رواه الترمذي وصححه.
অর্থ: যখন রাসূলে করীম (ﷺ) প্রথমে মদীনা মোনাওয়ারায় প্রবেশ করেন, তখন মানুষেরা তাঁর কাছে ছুটে যান, আর আমি ছিলাম তাঁদেরই একজন। যখন আমি তাঁর চেহারা মোবারক দেখলাম এবং (গভীরভাবে) তা পর্যবেক্ষণ করলাম, তখন উপলব্ধি করলাম, তা কোনো মিথ্যুকের মুখাবয়ব নয়, বরং ইমামুল মুরসালীন তথা নবী-রাসূলবৃন্দের ইমামেরই পবিত্র মুখমণ্ডল। তাঁর উচ্চারিত প্রথম যে কথাটি আমি শুনেছিলাম তা হলো - “ওহে মানবকুল! শান্তির প্রসার করো এবং একে অপরকে আহার্য দান করো; আর পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখো; এবং রাতে সালাত আদায় করো যখন লোকেরা ঘুমোয় - (এতে) তোমরা শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণিত হাদীস; তিনি এটিকে সহীহ বলেছেন]
এ কারণেই হযরত আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (رضي الله عنه) কাব্যাকারে বলেছেন:
لو لم تكن فيه آياتٌ مبيِّنةٌ :: كانت بديهتُه تُنبيك بالخبرِ
এমন কী তাঁর মাঝে যদি (নবূয়্যতের) সুস্পষ্ট নিদর্শন নাও থাকতো,
তবুও তাঁর পুতঃঅবয়ব আপনাকে সে শুভসংবাদ জানিয়ে দিতো। [ভাব অনুবাদ]
হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন:
(كان رسول الله ﷺ أحسن الناس وجهاً، وأنورهم لوناً، لم يصفه واصفٌ قطُّ إلا شبه وجهه بالقمر ليلة البدر، وكان عرقُه في وجهه مثلَ اللؤلؤ، وأَطيبَ من المسك الأذفَر) رواه أبو نعيم وغيره.
অর্থ: সকল মানুষের মাঝে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক ছিলো সবচেয়ে সুন্দর ও নূরানী/জ্যোতির্ময়। কেউই রাতের পূর্ণচন্দ্রের সাথে তুলনা ছাড়া তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দিতেন না। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে ঘামের ফোঁটাগুলো ছিলো মুক্তার মতো, আর সর্বশ্রেষ্ঠ সুগন্ধির চেয়েও সুগন্ধময়। [ইমাম আবূ নুয়াঈম (رحمة الله) ও অন্যান্যদের বর্ণিত]
এ কারণেই আবূ তালিব (কাব্যাকারে) বলেন -
وَأَبْيَضَ يُسْتَسْقَى الغَمَامُ بِوَجْهِهِ :: ثِمَالُ اليَتَامَى عِصْمَةٌ لِلْأَرَامِلِ
শুভ্র সেই সত্তা, মেঘমালা কামনায় দোহাই যাঁর চেহারা মোবারক,
যিনি এতিম-অনাথদের লালন-পালনকারী ও বিধবাদের রক্ষক। [ভাব অনুবাদ]
সর্ব-ইমাম ইবনু আসাকির, আবূ নু’আইম ও খতীব বাগদাদী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) হাসান-সহীহ সনদে বর্ণনা করেন হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنه) হতে; তিনি বলেন:
كنت قاعدة أغزل والنبي ﷺ يخصف نعله، فجعل جبينه يعرق، وجعل عرقه يتولد نوراً، فبهت، فقال: (ما لك بهت)؟ قات: جعل جبينك يعرق، وجعل عرقك يتولد نوراً ولو رآك أبو كبير الهُذَلي لعلم أنك بِشعره أولى حيث يقول:
ومُبَرّأ من كل غُبرَ حيضَةٍ :: وفسادِ مرضعَةٍ وداءٍ مغيل
وإذا نَظرتَ إلى أسِرَّةِ وجهه :: بَرِقتْ بُروقَ العارض المتهلل
অর্থ: একবার আমি বসেছিলাম এবং সুতো সেলাই করছিলাম; আর প্রিয়নবী (ﷺ) তাঁর জুতো সেলাই করছিলেন। তাঁর কপালে ঘাম জমতে আরম্ভ করে এবং ওই ঘাম আলোর প্রভা ছড়াতে শুরু করে। আমি অবাক হয়ে যাই। অতঃপর তিনি (আমায়) বলেন, “তোমাকে কী বিষয় বিস্মিত করেছে?” আমি উত্তর দেই, “আপনার কপালে ঘাম জমতে আরম্ভ করেছে এবং ওই ঘাম এমন উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে যে, যদি আবূ কবীর আল-হুযালী আপনাকে দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি আপনাকে জানতেন আপনি ওই পদ্যের উপলক্ষ থেকেও বেশি যোগ্য, যা’তে তিনি বলেছিলেন -
মুক্ত ঋতুস্রাবের ময়লা হতে, বা নার্সিংয়ের ময়লা বা বিনাশী রোগের কবল থেকে,
আর যখন তুমি নজর দিলে তাঁর (ﷺ) পুতঃ চেহারার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দিকে,
তখন সেসব বৈশিষ্ট্য পরিণত হলো ঝিলমিল মেঘের মতো আলোকে। [ভাবানুবাদ]
[নোট: এর মানে, শিশুকে মাসিকের শেষে গর্ভে ধারণ করা হয়নি; আর তাঁর মা তাঁকে সেবাযত্ন করার এমন সময়ে আবার গর্ভবতী হননি যার দরুন তাঁর সেবাযত্ন খর্ব হতে পারে, যেমনটি লিপিবদ্ধ হয়েছে শরহু মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া গ্রন্থে - أي: لم تحمل به في بقية حيض، ولا حملت بغيره حالة رضاعه فيفسد رضاعه ـ كما في شرح المواهب]
ইবনু আবী খায়সামা (رضي الله عنه) বলেন:
(كان ﷺ أجلى الجبين، إذا طلع جبينه بين الشعر أو طلع من فلق الشعر، أو عند الليل، أو طلع بوجهه على الناس، تراءى جبينه كأنه هو السراج المتوقِّد يتلألؤ، وكانوا يقولون: هو ﷺ كما قال شاعره حسان رضي الله عنه:
متى يبدُ في الليل البهيم جبينُه :: يَلُح مثلَ مصباحِ الدُّجى المتوقِّدِ
فمن كان أو من قد يكون كأحمدٍ :: نظامٌ لحقٍّ أو نكالٌ لملحد
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ)-এর ছিলো এক স্বতন্ত্র (বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত) ললাট; তা যদি দৃশ্যমান হতো তাঁর (পবিত্র) চুলের মধ্য দিয়ে, অথবা চুলের দু ভাগের মাঝখান দিয়ে, কিংবা রাতে, বা তিনি যদি তাঁর চেহারা মোবারক মানুষের দিকে ফেরাতেন, তাহলে তাঁর পবিত্র ললাট দৃশ্যমান হতো এমনভাবে যেনো তা একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ, যা দেদীপ্যমান। মানুষেরা বলতেন, “তিনি ঠিক তেমনি যেমনটি তাঁর কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) বলেছিলেন:
তাঁর ললাট অন্ধকার নিশীথে দৃশ্যমান হয় যবে,
প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের মতো প্রভা ছড়ায় এ ভবে,
তাহলে আহমদ (ﷺ)-এর মতো কে আছে, বা হবে?
সত্যপথের বিভা, অবিশ্বাসীর সতর্ককারী বাস্তবে। [ভাবানুবাদ]
অধিকন্তু, সুনানে দারুকুতনী গ্রন্থে হযরত তারিক ইবনে আবদীল্লাহ আল-মুহারিবী (رحمة الله)-এর বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, যা’তে তিনি হযরত যাঈনাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন:
(لا تلاوموا، فقد رأيت وجه رجل ما كان ليحقركم، ما رأيت وجه رجل أشبه بالقمر ليلة البدر من وجهه) تعني بذلك وجه رسول الله ﷺ.
অর্থ: “অভিযোগ উত্থাপন কোরো না, কেননা এমন এক পুণ্যাত্মার চেহারা মোবারক দেখেছি, যিনি তোমাদেরকে অধঃপতিত করবেন না। আমি আর এমন কাউকেই দেখি নি যার মুখমণ্ডল তাঁর পূর্ণচন্দ্রসদৃশ পুতঃচেহারা ধারণ করে।” এর মানে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর চেহারা মোবারক।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র ঘাম ও তার সুগন্ধ
প্রিয়নবী (ﷺ)-এর গুণাবলীর একটি এই যে, তাঁর থেকে সুগন্ধ বের হতো, এমন কী তিনি কোনো সুগন্ধি ব্যবহার না করলেও; তবুও তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন যাতে তাঁর উম্মত এটিকে সুন্নাহ হিসেবে অনুসরণ করেন; আর এ ছাড়াও সুগন্ধি তাঁর অত্যন্ত পছন্দনীয় ছিলো, যেমনটি ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণিত হাদীসে তিনি ঘোষণা করেছেন:
(حُبِّبَ إِلَيَّ مِنْ دُنْيَاكُمْ: اَلطِّيبُ وَالنِّسَاءُ وَجُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ).
অর্থ: তোমাদের দুনিয়ার মধ্যে আমার কাছে প্রিয় করে দেয়া হয়েছে সুগন্ধি ও নারীকে, আর আমার চোখের শীতলতা (মানে প্রশান্তি) রাখা হয়েছে সালাতের মধ্যে।
নবী করীম (ﷺ)-এর সিফাত তথা গুণাবলীর মাঝে মিষ্টি সুগন্ধ যে একটি, এবং তা যে সর্বশ্রেষ্ঠ সুগন্ধ, আর তাঁর খাঁটি সুগন্ধ যে মেশকে আম্বর হতেও মিষ্টি ছিলো, সেটির অন্যতম প্রমাণ হলো সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্যদের (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) বর্ণিত ওই হাদীসটি যা হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه)-এর সূত্রে এসেছে, যা’তে তিনি বলেন:
(مَا شَمِمْتُ عَنْبَرًا قَطُّ وَلاَ مِسْكًا وَلاَ شَيْئًا أَطْيَبَ مِنْ رِيحِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ مَسِسْتُ شَيْئًا قَطُّ دِيبَاجًا وَلاَ حَرِيرًا أَلْيَنَ مَسًّا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم) .
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর (পবিত্র দেহের) চেয়ে অধিক সুগন্ধিময় কোনো আম্বর, মেশক্ বা ভিন্ন কোনো বস্তুর ঘ্রাণ আমি গ্রহণ করিনি এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর (পবিত্র দেহের) চাইতে কোমল কোনো রেশম বা নরম বস্ত্র আমি ছুঁয়ে দেখিনি।
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله)-এর বর্ণনায় এসেছে যে হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) বলেছেন:
(وَلا شَمَمْتُ مِسْكًا قَطُّ ، وَلا عِطْرًا كَانَ أَطْيَبَ مِنْ عَرَقِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ﷺ).
অর্থ: আমি এমন কোনো মেশক্ বা আতরের সুবাস পাইনি, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র ঘামের ঘ্রাণ হতে অধিক সুগন্ধিময়। [শামায়েল-এ-তিরমিযী]
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَزْهَرَ اللَّوْنِ كَأَنَّ عَرَقَهُ اللُّؤْلُؤُ إِذَا مَشَى تَكَفَّأَ وَلاَ مَسِسْتُ دِيبَاجَةً وَلاَ حَرِيرَةً أَلْيَنَ مِنْ كَفِّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ شَمَمْتُ مِسْكَةً وَلاَ عَنْبَرَةً أَطْيَبَ مِنْ رَائِحَةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন শুভ্র উজ্জ্বল বর্ণের। তাঁর ঘাম যেনো মুক্তার মতো। তিনি চলার সময় সম্মুখ পানে ঝুঁকে চলতেন। আমি নরম কাপড় বা রেশমকেও তাঁর হাতের তালুর মতো নরম পাইনি এবং মেশক ও আম্বরের মাঝেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শরীরের চেয়ে অধিক সুগন্ধ পাইনি।
সর্ব-ইমাম আবূ নুয়াইম ও খতীব বাগদাদী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মা হযরত আমিনা (رضي الله عنه) তাঁর (ﷺ) ধরাধামে শুভাগমনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন:
لما ولدته قالت: (ثم نظرت إليه فإذا هو كالقمر ليلة البدر، ريحه يسطع كالمسك الأذفَر).
অর্থ: অতঃপর আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে যেনো রাতের আকাশে পূর্ণচন্দ্র; আর তার ঘ্রাণ সর্বশ্রেষ্ঠ মেশকের।
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত জাবির ইবনু সামুরাহ (رضي الله عنه) হতে; তিনি বলেন:
صليت مع رسول الله ﷺ صلاة الأولى ـ يعني: صلاة الظهر ـ ثم خرج إلى أهله وخرجت معه، فاستقبله ولدانٌ ـ أي: صبيان ـ فجعل ﷺ يمسح خدَّيْ أحدهم واحداً واحداً. قال جابر: وأم أنا فسمح خدِّي فوجدت ليده برداً وريحاً كأنما أخرجها من جُؤنة عطار. رواه مسلم.
অর্থ: একবার প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সাথে আমি যোহরের নামায আদায় করি। অতঃপর তিনি ঘরের মানুষদের কাছে যাওয়ার জন্যে বের হন আর আমিও তাঁর সাথে বের হই। দুটি ছেলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তিনি একজন একজন করে তাদের দু জনেরই গাল মুছে দেন। তিনি আমারও গাল মুছে দেন, আর আমি তাঁর হাতকে শীতল ও সুগন্ধময় অনুভব করি ঠিক এমনভাবে যেনো তিনি তখনই তাঁর হাত কোনো আতর-বিক্রেতার (আতরের) পাত্র হতে বের করে এনেছিলেন। [মুসলিম]
ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (رحمة الله)-এর মুসনাদ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে হযরত আবী জুহাইফাহ (رضي الله عنه)-এর বর্ণনা, যা’তে তিনি বলেন:
(أن النبي ﷺ توضَّأَ وصلى الظهر ثم قام الناس، فجعلوا يأخذون يده فيمسحون بها وجوههم، قال: فأخذت يده فوضعتها على وجهي فإذا هي أبرد من الثلج، وأطيب ريحاً من المسك) ـ وأصل الحديث في الصحيحين.
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) একবার অযূ করে যোহরের নামায পড়েন। অতঃপর মানুষেরা দাঁড়িয়ে তাঁর হাত মোবারক নিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে মসেহ তথা মুছতে আরম্ভ করেন। আমিও তাঁর মোবারক হাতটি আমার মুখমণ্ডলে রাখি, আর (অনুভব করি) তা বরফের চেয়েও শীতল ও মেশকের চেয়েও বেশি সুগন্ধময়। [এ হাদীসের আসল/মূল সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিমা বর্ণনা করেছেন]
হে দ্বীনী ভ্রাতা, দেখুন কীভাবে এসব হাদীস শরীফ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মিষ্টি সুগন্ধকে, এক খাঁটি ও অবিচ্ছেদ্য মুহাম্মদী যাত মোবারকের সৌরভকে স্পষ্ট প্রমাণ করেছে, যা দ্বারা আল্লাহতায়ালা তাঁকে মাহাত্ম্য ও মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
প্রিয়নবী (ﷺ)-এর পবিত্র ঘাম দ্বারা সাহাবা (رضي الله عنه)-মণ্ডলী নিজেদের সুগন্ধময় করতেন এবং তা হতে বরকত আদায় করতেন
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) বলেছেন:
(دخل علينا النبي ﷺ فقال عندنا، فعرِق فجاءت أمي ـ أم سلَيم بنت مِلحان ـ بقارورة فجعلت تسلت العرق فيها، فاستيقظ النبي ﷺ فقال: (يا أم سُلَيم ما هذا الذي تصنعين؟) قالت: هذا عرقك نجعله في طيبنا، وهو من أطيب الطيب).
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) আমাদের গৃহে আসেন এবং মধাহ্নকালীন নিদ্রাযাপন করেন; আর এ সময় তিনি ঘর্মাক্ত হতে আরম্ভ করেন। আমার মা - উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান (رضي الله عنه) - একটি সুগন্ধির বোতল আনেন এবং ওই ঘাম বোতলে সংরক্ষণ আরম্ভ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং বলেন, “ওহে উম্মে সুলাইম, আপনি কী করছেন?” তিনি উত্তরে বলেন, “আমরা আপনার ঘাম সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করি, আর এটি সুগন্ধিসমূহের মাঝে সেরা সুগন্ধি।”
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) আরো বর্ণনা করেন হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে; তিনি বলেন:
(كان النبي ﷺ يدخل بيت أم سليم فينام على فراشها وليست فيه، قال: فجاء ذات يوم فنام على فراشها، فأُتِيَتْ فقيل له: هذا النبي ﷺ نام في بيتك على فراشك، قال: فجاءت وقد عرق واستنقع عرق ﷺ على قطعة أديم على الفراش، ففتحت أم سُليم عتيدتها فجعلت تنشف ذلك العرق فتعصره في قواريرها، ففزع النبي ﷺ فقال: (ما تصنعين يا أم سُليم؟)، فقالت: يا رسول الله نرجو بركته لصبياننا. فقال: (أصبت).
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه)-এর গৃহে আসতেন এবং তাঁর বিছানায় (মধাহ্নকালীন) নিদ্রাগত হতেন যখনি তিনি (رضي الله عنه) তাতে না থাকতেন [নোট: উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর এমন আত্মীয়া যাঁদের সাথে শরীয়তে বিবাহ হারাম]। একদিন নবী করীম (ﷺ) এসে ওই বিছানায় নিদ্রাগত হন। এমনি সময়ে হযরত উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) গৃহে এলে তাঁকে বলা হয়, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপনার কক্ষে আপনারই বিছানায় নিদ্রাগত হয়েছেন।” অতঃপর তিনি কক্ষে প্রবেশ করেন, আর তখন তাঁর ঘাম বিছানার চাদরের কিয়দংশ ভিজিয়ে ফেলেছিলো। হযরত উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) নিজের রুমাল খুলে সমস্ত ঘাম মুছে তা চিপে বোতলে সংরক্ষণ করতে থাকেন। প্রিয়নবী (ﷺ) ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং বলেন: “ওহে উম্মে সুলাইম, আপনি কী করছেন?” তিনি উত্তর দেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ), আমরা নিজেদের সন্তানদের জন্যে তা (ঘাম) দ্বারা বরকত অন্বেষণ করছি।” অতঃপর নবী করীম (ﷺ) বলেন, “আপনি সঠিক (কাজ করছেন)।”
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে হযরত উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (ﷺ) তাঁর গৃহে মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রাযাপন করতেন; আর তিনি তাঁর ঘুমোনোর জন্যে একটি ফরাশ/মাদুর বিছিয়ে দিতেন। [নোট: ইমাম নববী (رحمة الله) এই হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এমন আত্মীয়া যাঁদের সাথে বিবাহ (শরীয়তে) হারাম; অতএব, এ হাদীস দ্বারা বিবাহ হারাম এমন আত্মীয়াদের বাসায় গমন ও নিদ্রাযাপনের বৈধতা সাব্যস্ত হয়।” ইমাম নববী (رحمة الله) ‘তাহযীবুল আসমা’ কিতাবে আরো বলেন, “উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه)-এর নাম নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ‘সাহলা,’ কেউ কেউ বলেন ‘রামলা,’ কেউ কেউ বলেন ‘আনীসা,’ কেউ কেউ বলেন ‘রামীছা,’ আবার অন্যরা বলেন ‘রামীসা।’ তিনি ছিলেন মিলহান (বা মালহান)-এর কন্যা এবং প্রিয়নবী (ﷺ)-এর খাদেম সাহাবী হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه)-এর মাতা; এ বিষয়ে আলেম-উলামার মাঝে কোনো মতপার্থক্য নেই। উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) ও তাঁর বোন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুই খালা ছিলেন, দুগ্ধমাতা হিসেবে; আর তিনি ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মাঝে সেরা ফযীলতের অধিকারিনী।” অতএব, এ হাদীস থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না যে নবী করীম (ﷺ) কোনো আজনবী/অপরিচিত বেগানা নারীর সাথে নির্জনে অবস্থান করেছিলেন, কেননা উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) ছিলেন তাঁর (ﷺ) শরীয়তে বিবাহ হারাম এমন আত্মীয়া, দুগ্ধমাতাস্বরূপ তাঁরই খালা সম্বন্ধীয়। বরঞ্চ তিনি (ﷺ) এ রকম ধারণা হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং তাঁর (ﷺ) সম্পর্কে এ রকম ধারণা পোষণকে খণ্ডনও করেছিলেন। হযরত আলী বিন হুসাইন (رضي الله عنه)-এর সূত্রে সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর স্ত্রী হযরত সাফীয়্যাহ (رضي الله عنه) বলেছেন, “আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাত করতে যাই, ওই সময় তিনি এ’তেকাফে ছিলেন। অতঃপর আমি তাঁর সাথে কথা বলি এবং বাসায় ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়াই; আমায় বিদায় জানাতে তিনিও উঠে দাঁড়ান। ওই সময় দু জন আনসার সাহাবা (رضي الله عنه) স্থানটি অতিক্রম করছিলেন। প্রিয়নবী (ﷺ)-কে দেখতে পেয়ে তাঁরা তাড়াতাড়ি স্থানত্যাগ করতে থাকেন। অতঃপর তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আস্তে আস্তে চলো, এ আমার স্ত্রী সাফীয়্যা বিনতে হুয়্যাই।’ সাহাবী (رضي الله عنه) দু জন (উত্তরে) বলেন, ‘সোবহানাল্লাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)!’ এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (ﷺ) বলেন, ‘নিশ্চয় শয়তান আদম-সন্তানের মধ্যে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়; আমি আশঙ্কা করেছি সে তোমাদের অন্তরে মন্দ (অন্য বর্ণনায় এসেছে ‘কিছু একটা’) প্রক্ষিপ্ত করতে পারে’।” এই হাদীস তাঁর (যাহেরী জিন্দেগীর) পরে (আগত) উম্মতের সবার জন্যে, হোন তাঁরা উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বা উন্নত নৈতিক চরিত্রবান, এ বিধান জারি করে যে বিবাহ হারাম এমন আত্মীয়াবহির্ভূত আজনবী নারীর সাথে নির্জনে থাকা জায়েয নেই]
প্রিয়নবী (ﷺ) মধাহ্নকালীন নিদ্রার সময় অনেক ঘামাতেন এবং হযরত উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) সুগন্ধির বোতলে সেই ঘাম সংগ্রহ করতেন। নবী পাক (ﷺ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন:
(يا أم سليم ما هذا؟)
অর্থ: ওহে উম্মে সুলাইম, এটি কী?
উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه) উত্তর দেন:
عرقك أدوف به طيبي.
অর্থ: আমি আপনার ঘামকে আমার সুগন্ধির সাথে মেশাই।
ইমাম আহমদ হাম্বল (رحمة الله)-এর বর্ণনায় আরো যুক্ত রয়েছে:
فدعا لها بدعاء حسن.
অর্থ: অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত উম্মে সুলাইম (رضي الله عنه)-এর জন্যে উত্তম এক দোয়া করেন।
হযরত উতবাহ বিন ফারক্বাদ আস্ সুলামী (رضي الله عنه)-এর স্ত্রী হযরত উম্মে আসিম (رضي الله عنه) বলেন:
(كنا عند عتبة أربع نسوة ـ أي: زوجات له ـ فما منا امرأة إلا وهي تجتهد في الطيب لتكون أطيب من صاحبتها، وما يمسُّ عتبة الطيب إلا أن يمسّ دهناً يمسح لحيته، ولهو أطيب ريحاً منا، وكان إذا خرج إلى الناس قالوا: ما شممنا ريحاً أطيب من ريح عتبة، فقلتُ له يوماً: إنا لنجتهد في الطيب ولأنت أطيبُ ريحاً منا، فممَّ ـ أي: من أيّ سبب ـ ذلك؟ فقال عتبة: أخذني الشّرَى على عهد رسول الله ﷺ، فأتيته فشكوت ذلك إليه ﷺ، فأمرني أن أتّجرّد، فتجرّدت عن ثوب، وقعدت بين يديه وألقيت ثوبي على فرجي {يعني أنه ستر عورته كلَّها} فَنَفَثَ رسول الله ﷺ في يده ثم مسح ظهري وبطني بيده، فعبق {لازمه ولزق به} بي هذا الطيب من يومئذٍ) [رواه الطبراني في (الكبير والصغير)].
অর্থ: আমি ছিলাম উতবাহ (رضي الله عنه)-এর চার স্ত্রীর একজন; আর আমাদের মধ্যে এমন একজন নারীও ছিলেন না যিনি অন্যদের চেয়ে বেশি সুরভি ছড়াতে সুগন্ধি ব্যবহারে সর্বাত্মক চেষ্টা না করতেন। উতবাহ (رضي الله عنه) সুগন্ধি ব্যবহার করতেন না, ব্যতিক্রম শুধু তাঁর দাড়িতে যে তেল তিনি ব্যবহার করতেন। অথচ তাঁর ছিলো আমাদের চেয়েও বেশি সৌরভ। তিনি যখন বেরোতেন, তখন মানুষেরা বলতেন, “আমরা উতবাহ’র চেয়ে উত্তম সুগন্ধির ঘ্রাণ কখনো পাইনি।” আমি (উম্মে আসিম (رضي الله عنه) একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করি, আমরা সবাই সেরা সুগন্ধি ব্যবহারের সর্বাত্মক চেষ্টা করি, অথচ আপনি আমাদের সবার চেয়ে বেশি সুগন্ধময়; এটি কীভাবে হলো? উতবাহ (رضي الله عنه) উত্তর দেন, “প্রিয়নবী (ﷺ)-এর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে আমার ত্বকের এক সমস্যায় তাঁর দরবারে আরজি নিয়ে আমি হাজির হয়েছিলাম। তিনি আমায় জামা খুলতে বলেন, আর আমি জামা খুলে আমার দেহের শুধু আওরাহ/গোপন অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে কাপড়ে ঢেকে তাঁর সামনে দাঁড়াই; তিনি তাঁর মোবারক হাতে ফুঁ দিয়ে তা দ্বারা আমার পিঠ ও পেট মসেহ তথা মুছে দেন। ওই দিন থেকে এ সৌরভ আমার সাথে বিরাজমান। [ইমাম তবরানী (رحمة الله) কর্তৃক ‘আল-কবীর’ ও ‘আস্ সগীর’ গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত]
সর্ব-ইমাম আবূ ইয়ালা ও তবরানী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেছেন হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ঘটনা, যা’তে তিনি প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সাহায্য কামনা করেছিলেন। রাসূল (ﷺ) একটি পাত্র আনতে বলেন এবং তাতে নিজের কিছু ঘাম সংগ্রহ করে রাখেন; অতঃপর তিনি বলেন:
(مُرها فلتتطيبْ به)
অর্থ: “এটি ঝাঁকাও এবং কনেকে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করতে দাও।”
কনে যখন এ সুগন্ধি ব্যবহার করেন, তখন শহরের সবাই এর ঘ্রাণ পান এবং ওই পরিবারটি ‘সৌরভময় ঘর’ (فسُمُّوا بيت المطيّبين) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। [ফাতহুল বারী - فتح الباري]
প্রিয়নবী (ﷺ) যা স্পর্শ করতেন অথবা যে রাস্তা দিয়ে যেতেন তাতে তাঁর মিষ্টি সৌরভ লেগে থাকতো
সর্ব-ইমাম তবরানী ও বায়হাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন যে হযরত ওয়াইল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন:
روى الطَّبَرِيُّ وَالبَيْهَقِيُّ عَنْ وَائِلٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: لَقَدْ كُنْتُ أُصَافِحُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ، أَو يَمَسُّ جِلْدِي جِلْدَهُ، فَأَتَعَرَّفُهُ (فَأَعْرِفُ أَثَرَهُ بَعْدَ مُفَارَقَتِهِ لِي) بَعْدُ في يَدَيَّ، وَإِنَّهُ لَأَطْيَبُ رَائِحَةً مِنَ المِسْكِ.
অর্থ: আমি যখনই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র হাত মোসাফাহ (মানে করমর্দন) করতাম, কিংবা আমার ত্বক ও তাঁর মোবারক ত্বকে স্পর্শ লাগতো, তৎপরবর্তী সময়ে আমার হাতে তাঁর স্পর্শের ব্যাপারে আমি সচেতন হতাম। (কেননা তাঁর) সুগন্ধ মেশকের চেয়েও সৌরভময় ছিলো।
হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنه) বলেন:
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَتْ كَفُّ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ أَلْيَنَ مِنَ الحَرِيرِ، وَكَأَنَّ كَفَّهُ كَفُّ عَطَّارٍ، مَسَّهَا بِطِيبٍ أَو لَمْ يَمَسَّهَا، يُصَافِحُ المُصَافِحَ فَيَظَلُّ يَوْمَهُ يَجِدُ رِيحَهَا، وَيَضَعُ يَدَهُ عَلَى رَأْسِ الصَّغِيرِ فُيُعْرَفُ مِنْ بَيْنِ الصِّبْيَانِ بِرِيحِهَا. رواه أَبُو نُعَيْمٍ وَالبَيْهَقِيُّ.
অর্থ: নবী করীম (ﷺ)-এর পবিত্র হাতের তালু রেশমের চেয়েও নরম ছিলো, আর এ যেনো তাঁর ছিলো কোনো আতর বিক্রেতার হাত, তিনি (তাতে) আতর লাগান বা না-ই লাগান। তিনি যখন কারো সাথে মোসাফাহ তথা করমর্দন করতেন, ওই ব্যক্তি দিনের অবশিষ্টাংশ তাতে সৌরভ অনুভব করতো। তিনি কোনো শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে সুগন্ধের দরুন ওই শিশু অন্যান্য শিশুর থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতো। [সর্ব-ইমাম আবূ নাঈম ও বায়হাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহিমা বর্ণিত]
হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন:
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ إِذَا مَرَّ فِي طَرِيقٍ مِنْ طُرُقِ المَدِينَةِ، وَجَدُوا مِنْهُ رَائِحَةَ الطِّيبِ، وَقَالُوا: مَرَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ مِنْ هَذَا الطَّرِيقِ. رَوَاهُ أَبُو يَعْلَى وَالبَزَّارُ بِإِسْنَادٍ صَحِيحٍ.
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) যখন মদীনা মোনাওয়ারার কোনো রাস্তা অতিক্রম করতেন, মানুষেরা তাঁর সুগন্ধ পেয়ে জানতে পারতেন, এবং তাঁরা বলাবলি করতেন, “নবীয়ে আকরাম (ﷺ) এই পথ দিয়ে গেছেন।” [সর্ব-ইমাম আবূ ইয়ালা ও আল-বাযযার রহমতুল্লাহি আলাইহিমা সহীহ সনদে এটি বর্ণনা করেছেন]
হযরত জাবির ইবনে আবদীল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন:
وَعَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: كَانَ في رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ خِصَالٌ لَمْ يَكُنْ يَمُرُّ في طَرِيقٍ فَيَتْبَعُهُ أَحَدٌ إِلَّا عَرَفَ أَنَّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ سَلَكَهُ؛ مِنْ طِيبِ عَرَقِهِ وَعَرْفِهِ (رِيحُهُ الطَّيِّبُ) وَلَمْ يَكُنْ يَمُرُّ بِحَجَرٍ إِلَّا سَجَدَ لَهُ. رَوَاهُ الدَّارَمِيُّ وَالبَيْهَقِيُّ وَأَبُو نُعَيْمٍ.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, তিনি কোনো রাস্তা ধরে অতিক্রম করে গেলে এমন কেউই ছিলেন না যিনি নবী করীম (ﷺ)-এর ঘামের সুগন্ধ ও তাঁরই সৌরভের কারণে বুঝতে না পারতেন যে তিনি এই পথ ধরে গেছেন। আর তিনি এমন কোনো পাথরের পাশ দিয়ে যাননি এ ব্যতিক্রমস্বরূপ যে সেটি তাঁর সামনে সেজদাহ করেনি। [সর্ব-ইমাম দারিমী, বায়হাক্বী ও আবূ নুয়াইম রহমতুল্লাহি আলাইহিম বর্ণিত; আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া গ্রন্থটিও দেখুন]
আল্লাহ যেনো নিম্নের কবিতা আবৃত্তিকারীর প্রতি করুণাশীল হন:
وَلَوْ أَنَّ رَكْبَاً يَمَّمُوكَ لَقَادَهُمْ *** نَسِيمُكَ حَتَّى يَسْتَدِلَّ بِهِ الرَّكْبُ
যদি আপনার পদাঙ্ক কোনো অশ্বারোহী দল করতো অনুসরণ,
আপনার মিষ্ট সৌরভই হতো যথেষ্ট তাদের দিতে দিকনির্দেশন। (ভাবানুবাদ)
وفي مُسْنَدِ الإِمَامِ أَحْمَدَ عَنْ وَائِلِ بْنِ حَجَرٍ قَالَ: أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ فَشَرِبَ مِنْهُ، ثُمَّ مَجَّ فِي الدَّلْوِ، ثُمَّ صَبَّ فِي الْبِئْرِ أَوْ شَرِبَ مِنَ الدَّلْوِ، ثُمَّ مَجَّ فِي الْبِئْرِ، فَفَاحَ مِنْهَا مِثْلُ رِيحِ الْمِسْكِ.
মুসনাদে ইমামে আহমদ (رحمة الله) গ্রন্থে হযরত ওয়াইল ইবনে হাজর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত একটি হাদীসে তিনি বলেন, “প্রিয়নবী (ﷺ)-কে একবার একটি পানির পাত্র দেয়া হয় যা থেকে তিনি পান করেন; অতঃপর তিনি তাতে নিজ থুতু মোবারক নিক্ষেপ করেন ও পাত্রের পানি কুয়োতে রাখেন। এরপর কুয়ো থেকে মেশকের সুগন্ধির মতো সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রিয়নবী (ﷺ)-এর লালা মোবারকের অনন্য বৈশিষ্ট্য
আল্লাহতায়ালা আপন রাসূল (ﷺ)-কে তাঁর লালা মোবারকের (ريقه الشريف) ক্ষেত্রে অসংখ্য অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছেন, যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অসুস্থদের আরোগ্য প্রদান (فيه شفاء للعليل), তেষ্টা নিবারণ (ورواء للغليل), এবং শক্তি-সামর্থ্য, বরকত ও আরো অনেক কিছু। কতো রোগাক্রান্ত মানুষকেই না তিনি (ﷺ) নিজের পবিত্র লালা দ্বারা তাৎক্ষণিক আরোগ্য দান করেছেন!
সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) সাহাবী হযরত সাহল বিন সা’আদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন যে নবী করীম (ﷺ) খায়বর দিবসে ঘোষণা করেন:
(لأعطينَّ الراية غداً رجلًا يفتح الله على يديه، يحب الله ورسولَه، ويحبه الله ورسولُه)
অর্থ: আমি আগামীকাল আমার পতাকাটি এমন এক ব্যক্তিকে দান করবো, যার হাতে আল্লাহতায়ালা বিজয় এনে দেবেন। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসে; আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-ও তাকে ভালোবাসেন।
পরের দিন সকালে মানুষেরা প্রিয়নবী (ﷺ)-এর কাছে যান এই আশায় যে তিনি তাঁদেরকে পতাকাটি দেবেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করেন:
(أين عليّ بن أبي طالب؟).
অর্থ: আলী ইবনে আবী তালিব কোথায়?
তাঁরা উত্তরে বলেন:
هو يا رسول الله يشتكي عينيه.
অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), তাঁর চোখে অসুখ।
মহানবী (ﷺ) আদেশ দেন:
(فأرسِلوا إليه).
অর্থ: তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
অতঃপর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর কাছে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে নিয়ে আসা হয় - ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-এর বর্ণনানুসারে হযরত সালামা (رضي الله عنه) বলেন:
فأرسلني رسول الله ﷺ إلى عليّ، فجئت به أقوده أرمد.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর কাছে প্রেরণ করেন; আর আমি তাঁর অগ্রে অবস্থান করে তাঁকে নিয়ে আসি, (কেননা) তাঁর চোখে যন্ত্রণা ছিলো।
فبصق رسول الله ﷺ في عينيه، فبرئ كأنه لم يكن به وجع...) الحديث.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর চোখে আপন থুতু দেন এবং তিনি এমনভাবে সুস্থ হয়ে যান যেনো তাঁর চোখে কখনোই ব্যাধি ছিলো না। (আল-হাদীস)
ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) নিজ ‘যওয়াইদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুরায়দাহ (رضي الله عنه) বলেছেন:
سمعت أبي يقول: إن رسول الله ﷺ تَفَل في رِجل عمرو بن معاذ حين قُطعتْ رجله فبرأ.
অর্থ: আমি আমার পিতাকে শুনেছি এ কথা বলতে: “নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমর ইবনে মুয়ায (رضي الله عنه)-এর পায়ে থুতু দেন যখন তাঁর পা কেটেছিলো, এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান।”
মহানবী (ﷺ)-এর লালা মোবারক ছিলো পুষ্টিময় খাদ্য তাঁদের জন্যে, যাঁরা তা গ্রহণ করেছিলেন (وإن ريقه الشريف ﷺ غذاء للمغتذي); যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) তাঁর ‘আদ্ দালায়েল’ পুস্তকে এ মর্মে যে -
كما روى البيهقي في (الدلائل) أن النبي ﷺ كان يوم عاشوراء يدعو برضعائه ـ أي: صبيانه الذين ينسبون إليه ـ وبرُضعاء ابنته السيدة فاطمة رضي الله عنهما، فيتفل في أفواههم ويقول للأمهات: (لا ترضعنهم إلى الليل...) فكان ريقه ﷺ يكفيهم عن الرضاع.
অর্থ: নবী করীম (ﷺ) আশুরার দিনে তাঁর পরিবারের শিশুদের, অর্থাৎ তাঁর সাথে যাঁরা সম্পর্কিত সেসব শিশু, এবং তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)-এর ছেলেদের নিয়ে আসতে বলতেন; অতঃপর তিনি তাঁদের মুখে থুথু দিতেন এবং তাঁদের মায়েদের বলতেন: “রাত না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে বুকের দুধ খাওয়াবে না...।” এটি ছিলো তাঁর (ﷺ) লালা মোবারক, যা ওই শিশুদেরকে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট হতো।
ইমাম ইবনু আসাকির (رحمة الله) বর্ণনা করেন:
وأعطى النبي ﷺ الحسن بن علي رضي الله عنه لسانه، وكان قد اشتدَّ عليه الظمأ، فمصه حتى روي.
অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ) একবার তাঁর নাতি ইমাম হাসান বিন আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর প্রতি আপন জিহ্বা মোবারক বের করে দেন যখন তিনি তীব্র তৃষ্ণায় ভুগছিলেন। ইমাম হাসান (رضي الله عنه) তা হতে (পানি) চুষেন (তথা পান করেন), যতোক্ষণ না তাঁর তেষ্টা মিটেছিলো।
সর্ব-ইমাম তবরানী ও আবূ নু’য়াইম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন যে হযরত আমীরাহ বিনতে মাসউদ আল-আনসারীয়্যাহ (رضي الله عنه) ও তাঁর বোনেরা প্রিয়নবী (ﷺ)-এর প্রতি বাই’আত তথা আনুগত্যের শপথ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাঁর দরবারে আসেন। তাঁরা ছিলেন পাঁচ জন। তাঁরা তাঁর (ﷺ) দেখা পান গো-মাংস ভক্ষণরত অবস্থায়। অতঃপর তিনি ওই গোস্ত থেকে কামড়ে এক টুকরো অংশ তাঁদের জন্যে দেন। হযরত আমীরাহ (رضي الله عنه) বলেন:
(ثم ناولني القديدة فقسمتها بينهن، فمضغت كل واحدة قطعة فلقينَ الله تعلى وما وجد لأفواههنَّ خلوف) ـ أي: تغيُّر رائحة فم.
অর্থ: অতঃপর তিনি (ﷺ) আমাকে গোস্তটুকু দিলেন, আর আমি সেটি তাঁদের (মানে ৫ বোনের) মাঝে বণ্টন করলাম। তাঁরা তা খেলেন। সেদিন থেকে তাঁরা আল্লাহর সাথে (পরলোকে) মিলিত হওয়া পর্যন্ত তাঁদের নিঃশ্বাসের সুগন্ধ কখনোই পরিবর্তিত হয়নি।
রাসূল (ﷺ)-এর পুতঃপবিত্রতা এবং পবিত্র থাকার পক্ষে তাঁর নির্দেশ (نظافته ﷺ وأمره بالنظافة)
আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে পুতঃপবিত্র সৃষ্টি প্রিয়নবী (ﷺ) - তাঁর মোবারক শরীরে, জামাকাপড়ে, ঘরদোরে এবং তাঁরই সামাজিক মজলিশে। তাঁর পবিত্র শরীর থাকতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জ্যোতির্ময়, যেমনটি এসেছে হিন্দ ইবনে আবী হালা (رضي الله عنه)-এর বর্ণিত হাদীসে, যা বিবৃত করে - أنور المتجرَّد - অর্থাৎ তাঁর দেহের উন্মুক্ত (অংশের) ত্বক নূরানী তথা আলোকিত থাকতো। এর মানে তাঁর শরীর মোবারকের যেসব অংশ কেশদাম বা বস্ত্রাবৃত না থাকতো, সেসব অংশ পুতঃপবিত্রতার ও পরম সৌন্দর্যময় উজ্জ্বলতার দীপ্তি ছড়াতো (وذلك أن أعضاءه المتجرّدة عن الشعر والثوب هي في غاية الحسن، و نصاعة اللون)। এটাই তাঁর পবিত্রতার দলিল, যেমনটি বিবৃত হয়েছে একই হাদীসে - كأنَّ عنقه جيد دُمية في صفاء الفضة - অর্থ: তাঁর গলা মোবারক যেনো এক খাঁটি রূপোর পুতুলের মতো (মসৃন)।
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন আবী তোফায়েল (رضي الله عنه) হতে, যিনি বলেন:
(كان رسول الله ﷺ أبيض مليحاً مقصّداً) ـ أي: متوسطاً بين الطول والقصر.
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুভ্র ও সুদর্শন; আর গড়নে মধ্যম আকৃতির।
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন ইবনে আবী জুহাইফাহ (رضي الله عنه) হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, যিনি বলেন:
رأيت النبي ﷺ وعليه حلة حمراء، كأني أنظر إلى بريق ساقيه.
অর্থ: ‘নবী পাক (ﷺ)-কে আমি একটি লাল চাদর পরিহিত দেখতে পাই। তাঁর পুতঃচরণযুগলকে আমি চকচকে দেখেছি।’ এর কারণ তাঁর চাদর হাঁটুর নিচে ঝুলে ছিলো।
নবী করীম (ﷺ)-এর ঘামের প্রাকৃতিক সুগন্ধ তাঁরই জিসম/শরীর মোবারকের পরিচ্ছন্নতার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন যে হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেছেন:
وفي الصحيحين عن أنس رضي الله عنه قال: (ما مسست حريراً ولا ديباجاً ألينَ من كف النبي ﷺ، ولا شممت ريحاً قطّ أو عَرْفاً ـ وفي رواية: أو عرقاً ـ أطيب من ريح أو عرق النبي ﷺ).
অর্থ: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাত মোবারকের চেয়ে বেশি নরম কোনো পশমি বা রেশমি কাপড় আমি স্পর্শ করি নি; এবং তাঁর (পুতঃশরীরের) ঘ্রাণের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত কোনো মিশক্ বা আম্বরও পাইনি।” অপর এক বর্ণনায় এসেছে, “কিংবা কোনো ঘামকে তাঁর নিঃশ্বাস ও সুগন্ধের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত পাইনি।”
আবী ক্বিরসাফা বলেন:
لما بايعنا رسول الله ﷺ أنا وأمي وخالتي، ورجعنا من عنده منصرفين، قالت لي أمي وخالتي: (يا بني ما رأينا مثل هذا الرجل، ولا أحسنَ منه وجهاً، ولا أنقى ثوباً، ولا ألين كلاماً، ورأينا كأنَّ النور يخرج من فِيْهِ).
অর্থ: রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি আমার মা, খালা এবং আমি বাইয়াত গ্রহণ করে তথা আনুগত্য প্রকাশ করে যখন বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর দরবার থেকে প্রস্থান করছিলাম, তখন আমার মা ও খালা আমায় বলেন, “ওহে বৎস, আমরা এ পুণ্যাত্মার মতো কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি; তাঁর পুতঃ মুখমণ্ডলের চেয়ে সুন্দর কোনো মুখও দেখিনি; তাঁর চেয়ে পরিচ্ছন্ন কাপড় পরতেও কাউকে দেখিনি; আর তাঁর মতো মৃদুভাষীও কাউকে দেখিনি। এ যেনো তাঁর পবিত্র মুখ হতে নূরের (মানে আলোর) প্রভা বেরিয়ে আসতে দেখেছি আমরা।” [মজমাউয্ যাওয়াইদ গ্রন্থপ্রণেতা বলেন, “(এই হাদীসের) বর্ণনাকারী ইমাম তবরানী (رحمة الله) এবং এর ইসনাদে বর্ণনাকারীদের আমি চিনি না”]
অতএব, প্রিয়নবী (ﷺ) তাঁর পবিত্র শরীর ও জামাকাপড়ে আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সৃষ্টি। বাসা হতে বেরোবার এবং প্রবেশের সময় তিনি তাঁর দাঁত মোবারক নিয়মিত মাজতেন।
পবিত্রতার পক্ষে তাঁর আদেশ (أمره ﷺ بالنظافة)
প্রিয়নবী (ﷺ) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তথা পবিত্রতা রক্ষার আদেশ দিতেন এবং পরিচ্ছন্নতাকে উৎসাহিত করতেন, আর অপরিচ্ছন্নতাকে নিরুৎসাহিত করতেন। তাঁর কাছ থেকে এ আজ্ঞা বহু আকারে এসেছে।
প্রথমতঃ তিনি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আমাদের ইসলাম ধর্মের মূলনীতিগুলোর একটি। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হযরত সা’আদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেছেন:
(إن الله تعالى طيِّب يحب الطيِّب، نظيف يحب النظافة، كريم يحب الكريم، جَواد يحب الجود، فنظِّفوا أَفنيتكم ولا تشَبَّهوا باليهود).
অর্থ: আল্লাহতায়ালা পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন [লেখকের নোট: এর মানে আল্লাহ যে কোনো ধরনের ঘাটতি থেকে মুক্ত এবং ত্রুটি ও ভ্রান্তিরও ঊর্ধ্বে; তিনি ভালোবাসেন ধার্মিকতাকে, যা পবিত্র ঐশী বিধান অনুসারে মূলে/আকীদা-বিশ্বাসে এবং আমলে/প্রয়োগে হালাল, যা ধোঁকাবাজি ও অনুরূপ ত্রুটি হতে মুক্ত (ফায়যুল ক্বাদীর গ্রন্থ হতে সংগৃহীত)]; তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ভালোবাসেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে [লেখকের নোট: আল্লামা খাফফাজী (رحمة الله) সংক্ষেপে বলেন, এ হাদীসে আল্লাহকে ‘পরিচ্ছন্ন’ হিসেবে বর্ণনা, যদিও কেউই এটাকে তাঁর কোনো পবিত্র নাম মোবারক বলে উল্লেখ করেন নি, তবুও এটাকে সাদৃশ্যের (বাচনিক) অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে; যাকে প্রাথমিক যুগের আলেম-উলামা যুগ্মীকরণ (মানে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা) সংজ্ঞায়িত করেছেন; অতএব, এর প্রতি কোনো আপত্তি উত্থাপন করা উচিত নয়। এর অর্থ ‘আল-কুদ্দূস তথা পুতঃপবিত্রও বলা হয়েছে]; আল্লাহ হচ্ছেন করীম/মহান বা উদার, আর তিনি মহত্ত্ব তথা উদারতাকে ভালোবাসেন [লেখকের নোট: তিনি মহৎ/মহানুভব ও উদার (ফায়যুল ক্বাদীর গ্রন্থ)]; অতএব, তোমাদের উঠোনকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখো এবং ইহুদীদের মতো হয়ো না।
হযরত সুলায়মান বিন সুরাদ (রাদ্বিয়াল্লাহুআনহু) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
(استاكوا؛ وتنظفوا؛ وأوْترا فإنَّا الله عز وجلّ وتر يحب الوتر).
অর্থ: তোমাদের দাঁত মিসওয়াক করো তথা মাজো; এবং নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখো; আর বেজোড় (বিতর) সংখ্যায় আমল/ধর্মানুশীলন করো, কেননা আল্লাহ হচ্ছেন বেজোড় সংখ্যক (শব্দ) এবং তিনি বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। [সর্ব-ইমাম আবী শায়বাহ ও তবরানী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) এই হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুনাবী (رحمة الله) বলেন যে এ হাদীসটি হাসান পর্যায়ের, অন্যান্য হাদীসের সমর্থনের কারণে।]
হযরতে আয়েশাহ (رضي الله عنه) হতে ইমাম খতীব (رحمة الله) ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (ﷺ) ঘোষণা করেছেন:
(إنَّ الإسلام نظيف؛ فتنظفوا، فإنه لا يدخل الجنة إلا نظيف).
অর্থ: ইসলাম পুতঃ তথা পরিচ্ছন্ন; অতএব, তোমরা নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখো; কেননা জান্নাতে কেউই প্রবেশ করতে পারবে না স্রেফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তথা পুতঃপবিত্র মানুষ ব্যতিরেকে।
হযরতে আবূ হোরায়রাহ (رضي الله عنه) মারফূ’ (শ্রেণির) হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন:
(تنظفوا بكل ما استطعتم فإن الله تعالى بنى الإسلام على النظافة، ولن يدخل الجنة إلا كل نظيف).
অর্থ: তোমাদের সামর্থ্য অনুসারে তোমরা নিজেদের পরিচ্ছন্ন রেখো, কেননা আল্লাহতায়ালা ইসলাম ধর্মকে পুতঃপবিত্রতার ওপর (ভিত্তি করে) গড়েছেন; আর কেউই জান্নাতে প্রবেশ করবে না কেবল পুতঃ তথা পরিচ্ছন্ন মানুষ ব্যতিরেকে। [ইমাম খাফফাজী (শরহে শিফা গ্রন্থে) এই হাদীসকে ইমাম রাফিঈ (رحمة الله)-এর (তারীখে ক্বাযউয়ীন গ্রন্থের) প্রতি আরোপ করেছেন এবং বলেছেন, “আমরা যেমনটি উল্লেখ করেছি, এ হাদীস অনেকগুলো তরীক্ব তথা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যা এটির দুর্বলতাকে সুদৃঢ় করেছে, আর তাই এটিকে দুর্বল বিবেচনা করা যায় না, বরং হাসান পর্যায়ের বিবেচনা করা যায়। এর মানে সহীহ এবং এটি শরীয়ত মোয়াফিক্ব তথা মোতাবেক (সিদ্ধ)।]
🕌দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ﷺ) সকল ধরনের শারীরিক পবিত্রতার প্রতি গুরুত্বরোপ করেছিলেন
দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ﷺ) সকল ধরনের শারীরিক পবিত্রতার প্রতি গুরুত্বরোপ করেছিলেন:
তিনি (ﷺ) গোসলের আদেশ দিয়েছিলেন এবং তা পরিত্যাগের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন:
ইমাম আহমদ হাম্বল (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত জাবির (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে প্রিয়নবী (ﷺ) বলেছেন:
(على كلِّ رجلٍ مسلم في كل سبعة أيام غسل يوم، وهو يوم الجمعة).
অর্থ: প্রত্যেক মুসলমান পুরুষের ক্ষেত্রে এটি আবশ্যক যে প্রতি সপ্তাহে (অন্তত) একবার সে গোসল করবে; আর তা হলো জুমআ/শুক্রবার। [সর্ব-ইমাম নাসাঈ ও ইবনে হিব্বান রহমতুল্লাহি আলাইহিমা এটি বর্ণনা করেন]
তিনি (ﷺ) সম্পূর্ণ শরীরের পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে তাকিদ দিয়েছিলেন; আর এটিকে ধুলো/ময়লা হতে মুক্ত রাখতে বলেছিলেন যা সকল রিসালাতের ঐশী বিধানের অংশবিশেষ:
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) হযরতে মা আয়েশাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (ﷺ) বলেছেন:
عشر من الفطرة:
অর্থ: ফিতরাত তথা বুনিয়াদি স্বভাবগত আচারের দশটি দিক (বিদ্যমান)। [নোট: অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে যেসব বুনিয়াদি ধর্মীয় স্বভাব/অভ্যেস চর্চা করার আদেশ দিয়েছেন; যেমন তিনি ঘোষণা করেছেন - فِطْرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ ٱللَّهِ ذَلِكَ ٱلدِّينُ ٱلْقَيِّمُ - আল্লাহর স্থাপিত বুনিয়াদ, যার উপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর বানানো বস্তুকে বিকৃত কোরো না; এটিই সরল দ্বীন (কুর’আন, ৩০/৩০, নূরুল ইরফান)। এটি এমন একটি বিষয় যা সকল রাসূল (আলাইহিমুস সালাম) নিয়ে এসেছিলেন এবং তাতে তাঁদের শরীয়তগুলো সর্বসম্মত]
(অতঃপর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ফরমান):
قصّ الشارب، وإعفاء اللحية، والسوال، واستنشاق الماء، وقصُّ الأظفار، وغسل البراجم، ونتف الإبِط، وحلق العانة، وانتقاص الماء.
অর্থ: মোচ ছাঁটাই করা; দাড়িকে বাড়তে দেয়া; দাঁত মাজার ডাল ব্যবহার করা; নাক পানি দ্বারা ধোয়া; নখ ছোট করা; হাতের গ্রন্থি পরিষ্কার করা; পায়ের গ্রন্থিও পরিষ্কার করা; বগলের লোম কাটা; গোপন অঙ্গের লোম কাটা; এবং তা পানি দ্বারা ধোয়া। [নোট: ইনতিক্বাস আল-মা’আ হলো মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله)-এর মতানুসারে ইসতিনজা শব্দটির সমার্থক, যা ব্যক্ত করে ‘প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার পরে পানি দ্বারা গোপন অঙ্গ ধোয়া’ (শরহে শিফা)]
প্রিয়নবী (ﷺ) এগুলোকে (মানে উপরোক্ত কাজগুলোকে) দীর্ঘ সময় যাবৎ অবহেলার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, যেমনটি ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله)-এর ‘সুনান’ পুস্তকে ইমাম হাসান (رضي الله عنه)-এর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, যা’তে তিনি বলেছিলেন:
وَقَّتَ لنا رسول الله ﷺ في قص الشارب، وتقليم الأظفار، ونتف الإبط وحلق العانة، أن لا تُترك أكثر من أربعين ليلة ـ يعني أنه إذا دعت الحاجة إلى الترك أو لم يتمكن من الغسل والقص والتقليم في كل أسبوع، فلا يجوز له أن يؤخر أكثر من أربعين ليلة، فإنا حينئذٍ آثم، كما نصَّ الفقهاء على ذلك.
অর্থ: “মোচ কাটা, নখ কর্তন, বগলের নিচে লোম এবং গোপন অঙ্গের লোম কাটার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন এ মর্মে যে তা চল্লিশ রাতের বেশি তরক করা যাবে না।” এর মানে হলো, যদি এসব কাজ ছেড়ে দেয়ার কোনো কারণ দেখা দেয়, কিংবা প্রতি সপ্তাহে গোসল, (মোচ) ছাঁটাই ও (নখ) কর্তন করা কারো পক্ষে কোনো কারণে সম্ভব না হয় তবে তা চল্লিশ রাতের বেশি পরিহার করে থাকার কোনো অনুমতিই নেই। যদি তারা এর চেয়েও বেশি সময় ধরে তা ছেড়ে দেয়, তাহলে তারা গুনাহগার হবে; যেমনটি ফক্বীহ-মণ্ডলীর (এতদসংক্রান্ত) দলিলে ব্যক্ত হয়েছে। [নোট: কর্তিত নখ ও চুল/লোম (মাটিতে) দাফন করা ওয়াজিব, কেননা ইমাম হাকীম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন হযরতে মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে এ মর্মে যে তিনি বলেছেন - أن النبي ﷺ كان يأمر بدفن سبعة أشياء من الإنسان: الشعر، والظفر، والدم، والحيضة، والسن، والقلفة، والمشيمة - অর্থ: “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব দেহের সাতটি বস্তুকে দাফন করার আদেশ দিয়েছেন: চুল/লোম, নখ, রক্ত, ঋতুস্রাব, দাঁত, খতনাকৃত চামড়া ও গর্ভের ফুল।” - روى بعض ذلك الطبراني أيضاً؛ كما في الفتح الكبير - এর কিছু অংশ ইমাম তবরানী রহমতুল্লাহি আলাইহিও বর্ণনা করেছেন, যেমনটি লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘আল-ফাতহুল কবীর’ গ্রন্থে।]
🕌তৃতীয়তঃ হুজূরে পূর নূর (ﷺ) পানাহারের পরে হাত ধোয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন
তৃতীয়তঃ হুজূরে পূর নূর (ﷺ) পানাহারের পরে হাত ধোয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। ইমাম হাকীম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে রাসূলে পাক (ﷺ) ঘোষণা করেছেন:
(قصُّوا أظافركم، وادفنوا قلاماتكم، ونقّوا براجمكم، ونظفوا لِثاتكم من الطعام، واستاكوا، ولا تدخلوا عليَّ قُحْراً بُخْراً).
অর্থ: “নখ কর্তন কোরো এবং তা দাফন কোরো; আর (হাতের) গ্রন্থিগুলো পরিষ্কার কোরো; এবং খাবার গ্রহণের পরে মাড়ি হতে তা পরিষ্কার কোরো; অতঃপর দাঁত মেজো; আর তোমাদের দাঁতে খাবার লেগে থাকা অবস্থায় এবং মুখের দুর্গন্ধ নিয়ে আমার কাছে এসো না।” [নোট - كذا في الجامع الصغير وفسر المناوي في شرحه الكبير (قحراً): مصفرة من شدة الخلوف، وبخراً: من البَخَر بفتحتين، وهو نتن الفم، ثم قال: هكذا الرواية، لكن قال الحكيم: المحفوظ عندي قحلا فلجاً ولا أعرف القحر. اهـ - অর্থ: (এটাই ওই হাদীস যা) উল্লেখিত হয়েছে আজ্ জামিউস্ সগীর গ্রন্থে ইমাম মুনাবী (رحمة الله)-এর শরাহ/ব্যাখ্যাসমেত ’শরহুল কবীর’ পুস্তক হতে - “তোমাদের দাঁতে খাবার লেগে থাকা অবস্থায়” মর্মে (হাদীসের) চূড়ান্ত অভিব্যক্তির প্রসঙ্গে; যদিও তিনি উল্লেখ করেন যে ইমাম হাকীমের বর্ণনায় এসেছে - “(আমার কাছে এসো না) শুষ্ক ও হিমশীতলতা নিয়ে;” উপরন্তু, তিনি (ইমাম হাকীম তিরমিযী) “(দাঁতে) খাবার লেগে থাকা” মর্মে কোনো বর্ণনা সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল নন।]
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত সালমান (رضي الله عنه) হতে যে রাসূলে খোদা (ﷺ) বলেছেন:
(بركة الطعام: الوضوء قبله، والوضوء بعده).
অর্থ: “খাদ্যে বরকত নিহিত রয়েছে তা গ্রহণের আগে অযূ করার মধ্যে; এবং তার পরে অযূ করার মধ্যেও।”
এখানে উল্লেখিত ‘অযূ’ শব্দটির ‘লোগাত’ তথা আভিধানিক অর্থ দুই হাত ধোয়া; শরীয়তে আদিষ্ট অযূ যা’তে শরীরের সুনির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধোয়া হয়, তা কিন্তু এটি নয়। যেমন, এর দলিল হলো ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) কর্তৃক হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসটি, যেখানে বিবৃত হয় যে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সামনে খাবার পরিবেশন করা হয়েছিলো এবং তাঁকে বলা হয়েছিলো, “আমরা কি আপনার কাছে অযূর (পানি) নিয়ে আসবো না?” তিনি উত্তরে বলেন:
(إنما أمرتُ بالوضوء إذا قمت إلى الصلاة).
অর্থ: “আমাকে (কেবল) তখনই অযূ করার আদেশ করা হয়েছে যখন আমি নামাযে দাঁড়াবো।”
🕌চতুর্থতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বস্ত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন
চতুর্থতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বস্ত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমনটি সর্ব-ইমাম তবরানী ও আবূ নুয়াইম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন হযরতে উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে নবী করীম (ﷺ) বলেছেন:
(إن من كرامة المؤمن على الله نقاء ثوبه ورضاه باليسير) أي: من أمور الدنيا.
অর্থ: “আল্লাহর কাছে মু’মিন বান্দার সম্মান বা মাহাত্ম্যের মধ্যে রয়েছে তার (পরিধেয়) বস্ত্রের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সামান্য কিছুতেই তার সন্তুষ্টি।” এর মানে দুনিয়াবী বিষয়াদির ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্টি।
ইমাম আবূ নুয়াইম (رحمة الله) আরো বর্ণনা করেন হযরতে জাবির (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার জনৈক ব্যক্তিকে দেখতে পান যার কাপড় ছিলো ময়লা; অতঃপর তিনি বলেন:
(أما وجد هذا شيئاً ينقي به ثيابه؟).
অর্থ: “এই ব্যক্তি কি এমন কোনো কিছু খুঁজে পায়নি যা দ্বারা তার কাপড় পরিষ্কার করা যায়?”
এখানে আমরা দেখতে পাই যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ময়লা জামা-কাপড়ের সমালোচনা করেছেন। তিনি সরাসরি ব্যক্তিটিকে সম্বোধন করেননি যাতে সে যা পছন্দ করতে নাও পারে তা দ্বারা তাকে মর্মাহত করা না হয়; আর এ বিষয়টিও প্রদর্শন করতে যে এই হুকুমটি ওই ব্যক্তির প্রতি খাস্ বা সুনির্দিষ্টভাবে জারি হয়নি। বরঞ্চ এটি ছিলো সমালোচনা সেসব লোকেরই প্রতি, যারা কাপড় ময়লা পরিধান করে থাকে।জ
প্রিয়নবী (ﷺ) জামাকাপড়ে ধুলোবালি/ময়লা লাগানোর ব্যাপারেও নিষেধ করতেন, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) কর্তৃক নিজ ‘শামায়েল’ গ্রন্থে হযরতে আশ’আস্ বিন সালীম (رضي الله عنه) হতে একটি হাদীসে, যা’তে তিনি বলেন:
سمعت عمتي تحدث عن عمها قال: بينا أنا أمشي في المدينة إذا إنسان خلفي يقول: (ارفع إزارك، فإنه أنقى ـ وفي رواية: أتقى ـ وأبقى) فإذا هو رسول الله ﷺ فقلت: يا رسول الله إنما هي بُرْدة مَلْحاء.
অর্থ: আমি আমার খালার কাছে শুনেছি যে তাঁর মামা বলেছিলেন, “একবার আমি মদীনায় হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম, এমন সময় আমার পেছনে এক ব্যক্তি বলেন, ‘তোমার জামা (পায়ের গোড়ালির) ওপরে তুলে ধরো, কেননা এতে তা আরো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে।’ অপর এক বর্ণনায় এসেছে - ‘পুতঃপবিত্র’ (أتقى) [নোট: খোদাভীরুতার দরুন দম্ভ ও আত্মম্ভরিতা হতে দূরে সরে ময়লাকে এড়ানো (শরহে যুরক্বানী)] - এবং ‘দীর্ঘস্থায়ী (وأبقى)।’ আমি (বক্তা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে চিনতে পেরে আরজ করলাম, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এটি তো স্রেফ একটি ধূসর (বর্ণের) বুর্দা/জুব্বা [নোট: আস্ সিহাহ অনুসারে مَلْحاء অর্থ সাদা-কালোর মিশ্রণ; আর এও বলা হয়েছে এর মানে কালো ও সাদা-রেখাবিশিষ্ট; এ কথার মানে হলো এই জামা সমাবেশ ও উৎসবে পরা হয় না, জাঁকজমকের জন্যে নয়, বরং কাজের জামা (শরহে শামায়েল)]।’
অতঃপর প্রিয়নবী (ﷺ) উত্তর দেন:
فقال: (أما لك فيَّ أسوة؟!) فنظرت فإذا إزاره ﷺ إلى نصف ساقيه. أخرجه الترمذي في الشمائل بهذا اللفظ.
অর্থ: ‘আমি কি তোমার জন্যে কোনো (অনুকরণীয়) দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ নই?’ আমি তাকিয়ে দেখি তাঁর জামার প্রান্তভাগ পায়ের (গোড়ালি ও হাঁটুর) মাঝখানে অবস্থিত। [নোট: এই হাদীস আমাদেরকে পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়, আর তার সুরক্ষা ও যত্ন নিতে বলে; কেননা এতে অবহেলা মানে নষ্ট ও অপচয়] {ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক এ শব্দচয়নে হাদীসটি নিজ শামায়েল গ্রন্থে বর্ণিত}
🕌পঞ্চমতঃ নবী করীম (ﷺ) ঘরদোর ও উঠোন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন
পঞ্চমতঃ নবী করীম (ﷺ) ঘরদোর ও উঠোন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন, যেমনটি ঘোষিত হয়েছে নিম্নের হাদীস শরীফে:
(فنظِّفوا أفنيتكم، ولا تشبهوا باليهود).
অর্থ: “অতএব, তোমাদের উঠোন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখো, আর ইহুদীদের মতো হয়ো না।”
🕌ষষ্ঠতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন
ষষ্ঠতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন; আর তিনি এটিকে একটি ইবাদত ও সেরা আমল/ধর্মানুশীলনগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে স্পষ্ট করেন।
সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন হযরতে আনাস (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে প্রিয়নবী (ﷺ) ঘোষণা করেছেন:
(عُرِضَتْ عَلَىَّ أُجُورُ أُمَّتِي حَتَّى الْقَذَاةُ يُخْرِجُهَا الرَّجُلُ مِنَ الْمَسْجِدِ وَعُرِضَتْ عَلَىَّ ذُنُوبُ أُمَّتِي فَلَمْ أَرَ ذَنْبًا أَعْظَمَ مِنْ سُورَةٍ مِنَ الْقُرْآنِ أَوْ آيَةٍ أُوتِيَهَا رَجُلٌ ثُمَّ نَسِيَهَا).
অর্থ: আমার উম্মাতের সকল সাওয়াব আমার সামনে উপস্থাপন করা হয়, এমন কী মাসজিদ হতে জঞ্জাল দূর করার সাওয়াবও। আমার উম্মাতের গুনাহসমূহও আমার সামনে উপস্থাপন করা হয়। কাউকে কুর’আনের কোনো সূরা বা আয়াত প্রদান করার পর তা বিস্মৃত হওয়ার চাইতে বড় গুনাহ আমি আর দেখিনি। [সুনানে আবী দাউদ, ৪৬১ (আন্তর্জাতিক); সুনানে তিরমিযী ২৯১৬ (আন্তর্জাতিক)]
সহীহ মুসলিম শরীফ ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে হযরতে আবূ যর্র গিফারী (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান:
(عُرضت عليَّ أمتي بأعمالها، حسنها وسيئها، فرأيت في محاسن أعمالها: إماطة الأذى عن الطريق، ورأيت من سيء أعمالها النخامة في المسجد لم تدفن).
অর্থ: আমার উম্মত ও তাদের আমল - নেক বা মন্দকর্ম (দুটোই) - আমার সামনে পেশ করা হয়। আর আমি নেক/উত্তম কর্মগুলোর মধ্যে রাস্তা হতে ক্ষতিকারক প্রতিবন্ধকতা অপসারণকে দেখতে পাই। অপরদিকে, মন্দ কর্মগুলোর মধ্যে মসজিদের মেঝেতে কফ নিক্ষেপকে দেখতে পাই, (অথচ তা) মাটিতে দাফন না করেই (ফেলে রাখা হয়েছে)। [রিয়াদুস্ সালেহীন, কিতাবুল মুকাদ্দেমা, হাদীস নং ১১৯]
মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, এমন কী (তা হতে) একটি ক্ষুদ্র বাধা অপসারণও মহা পুরস্কার লাভের কাজ; আর তাতে কফ ও ময়লা ফেলে রাখা বড় ধরনের ক্ষতির কারণ। ঈমানদার ব্যক্তিকে মসজিদ হতে কফ অপসারণের আদেশ দেয়া হলে এবং মসজিদে দেখতে পেলে তা (পরিষ্কার না করে) ছেড়ে যেতে তাঁকে নিষেধ করা হলে মসজিদে থুতু ফেলা কিংবা যে-কোনোভাবে মসজিদকে ময়লা হতে দেয়া তাঁর পক্ষে জায়েয/বৈধ হতে পারে কীভাবে? এ তো আরো বড় একটি গুনাহ।
শাস্তির ভয়ে বা পুরস্কারের আশায় মুসলমানদের জন্যে তাঁদের মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা অত্যাবশ্যক
প্রিয়নবী (ﷺ) মসজিদসমূহকে সুগন্ধিযুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। হযরতে আয়েশাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন:
(أمرنا رسول الله ﷺ ببناء المساجد في الدور، وأن تُنَظَّف وتُطيَّب).
অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে নিজ নিজ বসতঘরে মসজিদ নির্মাণের এবং সেগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধময় রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। [নোট: ইমাম মুনযিরী (رحمة الله) বলেন, “এটা বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম আহমদ হাম্বল ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) যিনি এটাকে সহীহ ঘোষণা করেছেন; এটা আরো বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও ইবনু মাজাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) - قال المنذري: ورواه أحمد والترمذي وصححه وأبو داود وابن ماجه]
হযরতে সামূরাহ ইবনু জুনদুব (رضي الله عنه) বলেন:
(أمرنا رسول الله ﷺ أن نتخذ المساجدَ في ديارنا وأمرنا أن ننظفها).
অর্থ: মহানবী (ﷺ) আমাদের প্রতি নিজেদের বসতবাড়িতে নামায-কক্ষ নির্মাণ এবং সেগুলো পরিষ্কার রাখার আদেশ করেছিলেন। [নোট: এটা বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম আহমদ হাম্বল ও তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) যিনি এটাকে সহীহ সাব্যস্ত করেন (যেমনটি বিবৃত হয়েছে আত্ তারগীব গ্রন্থে) - رواه أحمد والترمذي وصححه. كما في الترغيب]
অতএব, রাসূলে করীম (ﷺ) মসজিদসমূহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার পক্ষে আদেশ করেছিলেন - চাই তা হোক আম/সাধারণ্যের (মসজিদ), অথবা খাস/সুনির্দিষ্ট - যা বসতঘরের মধ্যে নির্মিত হবে মানুষের নফল (نوافل) বা (রাত জেগে-قيام) তাহাজ্জুদ নামায দ্বারা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী পালনের উদ্দেশ্যে; আর এটা ফক্বীহ-মণ্ডলীর মতানুসারে কাঙ্ক্ষিত সুন্নাহ/নস্ (শরঈ দলিল)।
🕌সপ্তমতঃ মহানবী (ﷺ) রাস্তাঘাট ও সর্বসাধারণ্যের স্থানগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন
সপ্তমতঃ মহানবী (ﷺ) রাস্তাঘাট ও সর্বসাধারণ্যের স্থানগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন এবং সেগুলো ময়লা-আবর্জনা ও ক্ষতিকর বস্তু দ্বারা দূষিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করেছিলেন। তিনি এটিকে ঈমানের শাখাগুলোর মধ্যে একটি বলে ঘোষণা করেছিলেন, যা ছাড়া ঈমান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে [নোট: আরবী - وبيانه أن ذلك يعتبر شعبةً من شعب الإيمان التي لا يتم الإيمان إلا بها - আমাদের বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমানের করুণ অবস্থা এর নিরিখে বিচার করা যায়; ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া ইত্যাদি রোগ-বালাই এখানে লেগেই আছে]।
সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন হযরতে আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
(الإيمان بضع وسبعون ـ وفي رواية: وستون ـ شعبة، فأفضلها: قول لا إله إلا الله، وأدناها إماطة الأذى عن الطريق).
অর্থ: ”ঈমানের শাখা সত্তরটিরও কিছু বেশি।” অন্য বর্ণনায় আছে, “ষাটটিরও কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ/উপাস্য নেই’ - এ কথা স্বীকার করা, আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা।” [সহীহ বুখারী, আন্তর্জাতিক নম্বর ৩৫]
অতএব, যদি কোনো ঈমানদারের ধর্মবিশ্বাস (ঈমান) রাস্তায় তাঁর দেখা কোনো বাধা-বিঘ্ন (অপসারণ না করে) ফেলে রেখে যাবার অনুমতি তাঁকে না দেয়, আর যদি তিনি তা অপসারণে সক্ষম হন যা অন্য কেউই অপসারণ করবেন না, তাহলে এটি আরো সত্য (হক্ব) ও অত্যাবশ্যক (ওয়াজিব) হবে যে রাস্তায় কোনো বাধা-বিপত্তি স্থাপন করা তাঁর পক্ষে একেবারেই না-জায়েয বা অবৈধ (সাব্যস্ত)।
অতঃপর ভাবুন, ওহে মুসলিম, এবং জেনে রাখুন যে রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ঈমানের অংশ; তা কোনো ফযীলত/অতিরিক্ত গুণ কিংবা অনুরূপ কিছু নয় যা নিয়ে বড়াই করা যায়।
রাসূলে আকরাম (ﷺ) রাস্তা হতে ক্ষতিকর বস্তু অপসারণের পক্ষে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) ইমাম বাযযার (رحمة الله) হতে একটি হাদীস শরীফে; নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন:
(نَحِّ الأذى عن طريق المسلمين).
অর্থ: “মুসলমানদের রাস্তা থেকে ক্ষতিকর বস্তু অপসারণ করো।”
হাবীব (ﷺ) মুসলমানদের রাস্তাগুলোতে তাঁদের ক্ষতি বা অনিষ্টকারী লোকদের ব্যাপারেও সতর্ক করেছিলেন, যেমনটি সহীহ সনদে হযরতে হুযায়ফাহ বিন উসায়দ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন ইমাম ত্ববরানী (رحمة الله) একটি হাদীস শরীফে, যা’তে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করেন:
(مَنْ آذى المسلمين في طرقهم وجبت عليه لعنتهم).
অর্থ: “যে ব্যক্তি মুসলমানদের রাস্তার উপরে তাঁদের ক্ষতি/অনিষ্ট সাধন করে, সে নিজের উপরে তাঁদের লা’নত তথা অভিসম্পাত ওয়াজিব বা অত্যাবশ্যক করে তোলে।”
সর্ব-ইমাম ত্ববরানী ও বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন হযরতে আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে প্রিয়নবী (ﷺ) ঘোষণা করেছেন:
(مَنْ غسل سخيمته على طريق من طرق المسلمين، فعليه لعنة الله والملائكة والناس أجمعين).
অর্থ: “যে ব্যক্তি আপন ময়লা-আবর্জনা/বর্জ্য (سخيمته) মুসলমানদের রাস্তাসমূহের মধ্যে কোনো একটি রাস্তায় ধোয়, তার উপর আল্লাহর লা’নত, ফেরেশতা ও মানবজাতিরও লা’নত।” [নোট: এখানে ‘সাখীমাত’ বলতে তাদের ময়লা-আবর্জনা বোঝানো হয়েছে - (المراد بالسخيمة هنا الأقذار والأوساخ) - যদি সকল সভ্যতা মানুষের ও শহরসমূহের পরিচ্ছন্নতা দাবি করে, তাহলে ঈমানদারবৃন্দের ধর্মবিশ্বাস ও তাঁদের ইসলামী সভ্যতা তাঁদের কাছে সবচেয়ে নিখুঁত প্রকারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দাবি করে।]
বঙ্গানুবাদকের আরজ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম
আম্মা বা’আদ।
সিরিয়ার সূফী শাইখ ইমাম আবদুল্লাহ সিরাজউদ্দীন আল-হুসাইনী সাহেব (রহমতুল্লাহি আলাইহি - বেসাল: ৪ঠা মার্চ, ২০০২)-এর প্রণীত এ বইটির ইংরেজি সংস্করণ আমি মার্কিন এমাজন-ডট-কম থেকে আনিয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। এটি অনুবাদ করেছিলেন নও-মুসলিম জনাব খালিদ উইলিয়ামস্। হল্যাণ্ডের রটারড্যাম-ভিত্তিক সুন্নী পাবলিকেশন্স এটি ছেপেছিলো ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে। এতে সিরিয়ার শাইখ মুহাম্মদ বিন ইয়াহইয়া নিনোভী সাহেবের প্রারম্ভিক কিছু কথা লিপিবদ্ধ আছে। এই সংস্করণের পাশাপাশি আমি অনলাইন থেকে আরবী সংস্করণও ডাউনলোড করে নিয়েছি, যাতে উভয় সংস্করণের মাঝে সমন্বয় সাধন করে বাংলায় ভাষান্তর করা যায়। নও-মুসলিম অনুবাদকের নোটগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তা এখানে সন্নিবেশিত করা হবে, ইন-শা-আল্লাহ। উল্লেখ্য যে, সূচিপত্র, প্রারম্ভিক আলোচনা, অনুবাদকের বক্তব্য ইত্যাদির অনুবাদ বই আকারে প্রকাশের সময় পেশ করা হবে, মওলার মর্জি।
-কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন