👉ক্বারীন জ্বীন: আপনার নিত্যসঙ্গী এ ভয়ানক শয়তান সম্পর্কে আপনি কতটা সচেতন?

🔰প্রশ্ন: আমি শুনেছি, প্রত্যেক মানুষের সাথে একটি করে জ্বীন থাকে। তাকে না কি ‘কারীন জ্বীন’ বল হয়। আরও বলা হয়ে থাকে: ‘কোন ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে সে সাথী হারা হয়ে পড়ে এবং মৃত ব্যক্তির রূপ নিয়ে মানুষকে ভয় দেখায়।” এটা কতটুকু সঠিক? আর যাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাদের কারীন জ্বীন এর অবস্থান কোথায় থাকে?
আর কারীন জ্বীন এর কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে কি সকাল সন্ধ্যার আমলেই যথেষ্ট?

উত্তর:

কারীন ((قرين)) আরবি শব্দ। এর অর্থ হল: সঙ্গী, সাথী ও সহচর।

কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রতিটি মানুষের নিকট একজন করে জ্বীন-শয়তান নিযুক্ত করা আছে। তার কাজ মানুষকে পথভ্রষ্ট করা, অন্যায়, অশ্লীল ও কুকর্মে প্ররোচিত করা এবং ভালো কাজে নিরুৎসাহিত করা বা বাধা দেয়া। একেই কারীন বা সহচর শয়তান বলা হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটও এই জিন-শয়তান ছিল কিন্তু সে ইসলাম কবুল করেছিলো। যার কারণে সে নবী সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুমন্ত্রণা দিতে সক্ষম হত না। যেমন:
▪ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
ما مِنكُم مِن أحَدٍ، إلَّا وقدْ وُكِّلَ به قَرِينُهُ مِنَ الجِنِّ قالوا: وإيَّاكَ؟ يا رَسولَ اللهِ، قالَ: وإيَّايَ، إلَّا أنَّ اللَّهَ أعانَنِي عليه فأسْلَمَ، فلا يَأْمُرُنِي إلَّا بخَيْرٍ. غَيْرَ أنَّ في حَديثِ سُفْيانَ وقدْ وُكِّلَ به قَرِينُهُ مِنَ الجِنِّ وقَرِينُهُ مِنَ المَلائِكَةِ.
“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার সহচর জ্বীন (শয়তান) নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি।
সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: আপনার সাথেও কি হে আল্লাহর রাসূল?
তিনি বললেন: আমার সাথেও তবে আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে ( বা আমার অনুগত হয়ে গেছে)। ফলে সে আমাকে কেবল ভাল কাজেরই পরামর্শ দেয়।”
সুফিয়ানের বর্ণনায় আছে:
وقد وكِّل به قرينُه من الجنِّ وقرينُه من الملائكة
“(তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে) তার সহচর জ্বীন (শয়তান) এবং সহচর ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেয়া হয় নি।” [সহিহ মুসলিম, হা/২৮২৪]

▪ কুরআনেও আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী
এই শয়তান এবং মানুষের মাঝে বাক-বিতণ্ডার কথা উল্লেখ করেছেন:
قَالَ قَرِينُهُ رَبَّنَا مَا أَطْغَيْتُهُ وَلَكِنْ كَانَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ * قَالَ لَا تَخْتَصِمُوا لَدَيَّ وَقَدْ قَدَّمْتُ إِلَيْكُمْ بِالْوَعِيدِ
“তার কারীন বা সঙ্গী শয়তান বলবে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি। বস্তুত: সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত। আল্লাহ বলবেন: আমার সামনে বাকবিতণ্ডা করো না। আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আজাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম।” (সূরা ক্বাফ: ২৭ ও ২৮)
ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যাখ্যায় বলেন:
هو الشيطان الذي وُكِّل به
”এটাই হল, নিয়োগ কৃত শয়তান।”
ইকরিমা, মুজাহিদ প্রমুখ তাফসীর কারকগণও একই কথা বলেছেন।

▪ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ يُصَلِّي فَلاَ يَدَعْ أَحَدًا يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْهِ فَإِنْ أَبَى فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّ مَعَهُ الْقَرِينَ
“তোমাদের কেউ যখন সালাত পড়ে, তখন সে যেন তার সামনে দিয়ে কাউকে অতিক্রম করতে না দেয়। যদি সে অস্বীকার করে (বাধা মানতে না চায়) তবে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কেননা তার সাথে তার সঙ্গী শয়তান রয়েছে।” (সহিহ মুসলিম, হা/৫০৬)

💠 মানুষ মারা যাওয়ার পর তার কারীন (সহচর শয়তান) কি সঙ্গী হারা হয়ে উক্ত মৃত মানুষের রূপ ধরে অন্যদেরকে ভয় দেখায়? বা পরিণতি কী হয়?

“মানুষ মারা যাওয়ার পর তার কারীন (সহচর শয়তান)
উক্ত মৃত মানুষের রূপ ধরে অন্যদেরকে ভয় দেখায়”-এ কথা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং হাদিস থেকে বুঝা যায়, মানুষের সাথে নিযুক্ত শয়তানের কাজ তাকে বিপথগামী করার জন্য প্ররোচিত করা এবং পাপাচার ও নানা অন্যায়-অপকর্মের রাস্তা দেখানো।
সুতরাং সে ব্যক্তি যখন মারা যায় -চাই তার স্বাভাবিক মৃত্যু হোক অথবা অস্বাভাবিক অথবা আত্মহত্যা হোক- তখন তার কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে মানুষ মৃত্যুর পর তার সহচর শয়তান কোথায় থাকে বা তার পরিণতি কী হয় সে ব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় কিছু বলা হয় নি। সুতরাং আমরা সে ব্যাপারে কিছু জানি না। অবশ্য মানুষ এটাও বলে থাকে যে, সে মানুষের কবর পর্যন্ত যায় কিন্তু এটাও ভিত্তিহীন কথা। এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় কোনো বক্তব্য আসে নি।
তাই বলব, আল্লাহু আলাম-আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

💠 কারীন বা সঙ্গী জ্বীন-শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে কী সকাল সন্ধ্যার আমলেই যথেষ্ট?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে সকাল-সন্ধ্যা ও দৈনন্দিন জীবনে যে সকল দুআ, জিকির ও আমল শিক্ষা দিয়েছেন (যেমন: টয়লেটে প্রবেশ ও টয়লেট থেকে বের হওয়ার দুআ, বাড়ি থেকে বের হওয়া, বাড়িতে প্রবেশ, কাপড় পরিধান, কাপড় খুলে রাখা, পানাহার করা, স্ত্রী সহবাস করা ইত্যাদি) সে সকল দুআ ও জিকির পাঠ করলে সর্বপ্রকার শয়তানের কুমন্ত্রণা ও অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তাআলা হেফাজত করবেন।

উপরের আলোচনা থেকে বুঝা গেল, আমাদের চিরন্তন দুশমন একটি জ্বীন শয়তান (কারীন) আমাদের সাথে সাথে নিযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সে সার্বক্ষণিক আমাদের সাথে বসবাস করে এবং সর্বদা আমাদেরকে অন্যায়-অপকর্মের দিকে প্ররোচিত করে। আমরা যখন দুনিয়াবি কর্ম ব্যস্ততায় আল্লাহকে ভুলে থাকি তখন আমাদের এই অসচেতনতার সুযোগে আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে, টেনে নিয়ে যেতে পারে অন্যায়, অশ্লীলতা ও পাপাচারের অন্ধকার জগতে।
সুতরাং আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি এবং আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনার পাশাপাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক শেখানো সকাল-সন্ধ্যার দুআ জিকির পাঠ ও নির্দেশনা মেনে চলা অপরিহার্য।
আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।


 
Top