♥ মি'রাজের ঘটনা প্রকৃতি পর্ব (৪) ♥

বর্ণিত আছে এই সময় আম্বিয়ায়ে কেরাম আল্লাহ'তাআলার প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত সুলায়মান (আঃ) এবং হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন। তাঁদের প্রশংসা এবং খোতবা ঐ সমস্ত ফজিলত, কারামত ও মুজিযাসমূহের বর্ণনা সম্বলিত ছিল, যার মাধ্যমে আল্লাহ'তাআলা তাঁদেরকে ধন্য করেছিল, আল্লাহ'তাআলার শোকরগুজারীর জন্য তাঁদের জবান মুবারক খুলে দিয়েছিল। এরপর সাইয়েদ 'আলম, খাতেমুন্নবীয়্যীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর জবান মুবারক খুলেন, তিনি বলেন, আপনারা সকলেই আল্লাহ রব্বুল ইজ্জতের শানে হামদ, ছানা পেশ করেছেন। এখন আমিও আল্লহর উদ্দেশ্যে হামদ, ছানা পেশ করছি 'সমস্ত প্রশংসা ওই-

আল্লাহ'তাআলার জন্য যিনি আমাকে সমগ্র আলমের রহমত সরূপ, সমস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদ দানকারী এবং ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি আমার উপ কোরআন নাযিল করেছেন। যার মধ্যে সব কিছুই স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। আমার উম্মতকে মধ্যম উম্মত বানানো হয়েছে। মর্যাদার দিক দিয়ে তারাই প্রথম উম্মত আর আগমনের দিক দিয়ে সর্বশেষ। যিনি আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিয়েছেন এবং আমার দায়িত্বের বোঝাকে সহনীয়তা করে দিয়েছেন। আমার নামের আলোচনা উন্নত করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে নবুওয়াতের সিলসিলা উদ্বোধনকারী এবং সমাপ্তকারী বানিয়েছেন।' নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উক্ত প্রশংসা বাণী শুনার পর হযরত -

ইব্রাহীম (আঃ) অন্যান্য আম্বিয়া কেরামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আপনাদের সকলের চেয়ে উত্তম।  এর পর জিব্রাইল (আঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে সাথে নিয়ে ঊর্ধ্ব আকাশ পানে ছুটে চললেন। মুহূর্ত মধ্যে তাঁরা প্রথম আসমানের প্রবেশ দ্বারে এসে উপনীত হলেন, বদ্ধ দরজা আঘাত করতেই ভিতর থেকে সাড়া জাগল, প্রশ্ন ভেসে এল, 'কে?' জিব্রাঈল (আঃ) উত্তর করলেন, 'আমি জিব্রাঈল' পুনরায় প্রশ্ন করা হল, 'তোমার সাথে কে? তিনি কি আল্লাহ্র বাণীপ্রাপ্ত হয়েছেন? জিব্রাঈল আঃ উত্তর দিলেন, ইনি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ। জিব্রাঈল (আঃ) উত্তর শুনার সাথে সাথে দরজা খুলে গেল-

নবীজী (সাঃ) ভিতরে প্রবেশ করলেন সাথে রইলেন জিব্রাঈল (আঃ)। দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁকে দেখিয়ে জিব্রাঈল (আঃ) হুযুর (সাঃ) কে বললেন, 'ইনি আপনার আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এঁকে সালাম করুন।' হযরত রাসূল করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাজিমের সাথে তাঁর পূর্বপুরুষকে সালাম জানালেন। হযরত আদম (আঃ) রাসূলে করীম (সাঃ) কে স্নেহভরে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, 'মুবারক হো, হে আমার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব।' এর পর এই স্থান ছেড়ে জিব্রাইল (আঃ) কে নিয়ে নবী করীম (সাঃ) দ্বীতীয় আসমানে পৌঁছলেন। সেখানে হযরত ঈসা (আঃ) রাসূলে করীম কে লক্ষ্য করে বললেন, 'হে ন্যায়দর্শী ভাই আমার, খোশ আমদেদ স্বাগতম। এভাবে রাসূলে মকবুল (সাঃ) একে একে সবগুলো আসমান অতিক্রম করেন।' তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর-

সাথে সাক্ষাত হলে আন্তরিকতার সাথে সালাম বিনিময় হয়। "মিশকাত শরীফে" আছে নবী করীম (সাঃ) হযরত ইউসুফ (আঃ) এর রূপ লাবন্যের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি (সাঃ) বলেছেন, হযরত ইউসুফ (আঃ) কে দেখে মনে হল যেন সৌন্দর্যের একটা বিরাট অংশ আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত তাঁকে দান করেছেন। তিবরানী ও বায়হাকীতেও বর্নিত আছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, 'ইউসুফ সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দর।' অন্যান্য  মানুষের সাথে তাঁকে তুলনা করলে বলতে হবে অগণিত নক্ষত্রের মধ্যে চন্দ্রের যে সৌন্দর্য তিনি তেমনি সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাক্ষাৎ হয়। পঞ্চম আসমানে দেখা হয় হযরত হারুন (আঃ) এর সাথে। তিনি সালাম বিনিময়ের পর ফিরেশতারা মারহাবা, শুভাগমন বলে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এরপর তিনি ষষ্ঠ আসমানে উপনীত হন। জিব্রাইল আলাইহিসালাম এখানেই হযরত মূসা আলাইহিসালাম এর সাথে নবী  মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাঁর  পরিচয় করিয়ে দেন। উভয়ের মধ্যে সালাম ও প্রীতি সম্ভাষণ বিনিময়ের পর জিব্রাইল আলাইহিসালাম  হরযত সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা-কে নিয়ে আরও উর্ধাকাশে রওয়ানা হবার প্রস্তুতি নিলেন, তখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম কাঁদতে লাগলেন।  ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি বলতে লাগলেন, এমন পয়গম্বর যাঁকে দুনিয়াতে আমার পরে পাঠানো হল অথচ আমার উম্মতের আগেই জন্নাতে প্রবেশ করবে।

 উলামায়ে কিরাম বলেন, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম  এর এ ধরনের উক্তি প্রতিহিংসা জনিত ছিলনা। বরঞ্চ আল্লাহ পাক স্বীয় কালাম দ্বারা তাঁকে সম্মানিত করেছেন। উক্ত উচ্চ মর্যাদা থেকে  বঞ্চিত হবার কারণে আফসোস করে তিনি এমন বক্তব্য রেখেছেন।  আফসোস করার আরেকটি কারণ এও হতে পারে যে, তাঁর উম্মতের এতোবেশী মতানৈক্য ও বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। যা তাঁর পুণ্যে স্বল্পতা এনেছিল।  নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি হযরত মূসা আলাইহিসালাম  এর কোনো প্রতিহিংসা ছিলনা। তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁর উম্মতের প্রতি হযরত মূসা আলাইহিসালাম এর দয়াও স্নেহ মমতা। তাঁর ওসীলায় উম্মতে মুহাম্মদী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি নামাযের হুকুম পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে পাঁচ ওয়াক্তে নেমে আসে।
 
উলামায়ে কেরাম বলেন, এই উম্মতের প্রতি তার স্নেহ পরায়ন হওয়ার কারণ হল, তাওরাত কিতাবে তিনিনেই উম্মতের মর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠ করেছিলেন এবং এতে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।  আল্লাহতালা যেন এই উম্মতকে তাঁর উম্মত বানিয়ে দেন।  আল্লাহতালা জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই উম্মত তো তার হাবীব এর জন্য নির্ধারিত। সুতারাং তিনি (মূসা- আলাইহিসালাম) যেন এই আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করেন। তখন হযরত মূসা আলাইহিসালাম নিবেদন করেছিলেন, হে আল্লাহ! তাহলে তুমি আমাকে সেই নবীর উম্মত বানিয়ে দাও।
(মাদারেজুন নবুওয়ত - ২য় খন্ড)। 


(চলবে)

 
Top