আল্লাহর পরিচয়ে সংক্ষেপে রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অর্থাৎ “আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছু নেই। আপনিই শেষ, আপনার পরে কিছু নেই। আপনিই প্রকাশ্য, আপনার উপরে কিছু নেই। আপনিই গোপন, আপনার নিচে কিছু নেই”।



সূত্রঃ মুসলিম শরীফ, হাদীস নং২৭১৩।



আল্লাহর জন্য সৃষ্টির সঙ্গে সামান্যতম সাদৃশ্যও বা তুলনা দেয়াও কুফরী। কেননা তিনি ইরশাদ করেছেন, তার সদৃশ কিছু নেই। তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন, আরশ-কুরশী সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন, এখনও আছেন। মহাবিশ্ব ধ্বংসের পরও থাকবেন। সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে যেমন সময় ও স্থান থেকে পবিত্র অবস্থায় ছিলেন, এখনও তিনি সব ধরনের স্থান ও সময় থেকে পবিত্র। সৃষ্টি পরিবর্তনশীল, স্রস্টা নন। কেননা পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তক প্রয়োজন, আর আল্লাহর ক্ষেত্রে পরিবর্তন মানলে, এখানে প্রশ্ন আসবে কে তাঁর পরিবর্তক? (নাউযুবিল্লাহ্)।



আল্লাহ্ ক্বুরআনে সুরা ইখলাস এ ২ নং আয়াতে বলেন- আল্লাহুস সামাদ অর্থাৎ “আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষি নন।”



আমরা বলতে জিহ্বা এর, শুনতে কান এর, দেখতে চোখ এর, ধরতে হাত এর মুখাপেক্ষি আর আল্লাহ দেখেন চোখ বাদে, তিঁনি ধরেন হাত বাদে, তিঁনি বলেন জিহ্বা বাদে, তিঁনি শুনেন কান বাদে। কেননা তাঁকে দেখতে চোখের,ধরতে হাতের প্রয়োজন হলে তো তিনি চোখ-হাতের মুখাপেক্ষী হয়ে যাবেন, নাউযুবিল্লাহ যা সুরা ইখলাস ২ নং আয়াতের বিপরীত হবে। তাঁকে কোনো জায়গা এর মুখাপেক্ষি করা যাবে না। তিনি জায়গা ছাড়াই উপস্থিত। জায়গা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন, স্রস্টার জন্য নয়। কেননা এক সময় ছিল যখন আল্লাহ ব্যতীত  কোনো কিছুই ছিলনা।



বুখারী শরীফ-এর ষষ্ঠ খন্ড ২৮৬নং হাদিসে রাসূলে পাক ( ﷺ ) বলেন- “কানাল্লাহু ওয়ালাম ইয়াকুন শাইউন গাইরুহু” অর্থাৎ “আল্লাহ তখনো ছিলেন যখন আল্লাহ ব্যতীত কিছুই ছিলনা।” মানে আসমান-জমিন, আরশ-কুরসি, উপর-নিচু, ডান-বাম, সামনে-পিছে কিছুই ছিলনা ; তখনো আল্লাহ ছিলেন এই সবকিছুর অমুখাপেক্ষী, আজও তিনি আছেন এই সবকিছুর অমুখাপেক্ষী।







ইমাম আবু হানিফা রহ. তার আল-ফিকহুল আবসাতে বলেছেন-“: ﻗﻠﺖُ : ﺃﺭﺃﻳﺖَ ﻟﻮ ﻗﻴﻞ ﺃﻳﻦ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ؟ ﻓﻘﺎﻝ ـ ﺃﻱ ﺃﺑﻮ ﺣﻨﻴﻔﺔ ـ : ﻳﻘﺎﻝ ﻟﻪ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﻻﻣﻜﺎﻥ ﻗﺒﻞ ﺃﻥ ﻳﺨﻠﻖ ﺍﻟﺨﻠﻖ، ﻭﻛﺎﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﺃﻳﻦﻭﻻ ﺧَﻠْﻖ ﻭﻻ ﺷﻰﺀ، ﻭﻫﻮ ﺧﺎﻟﻖ ﻛﻞ ﺷﻰﺀ ”



অর্থ- “যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়? এর উত্তরে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোন স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়া’লা ছিলেন। আল্লাহ তায়া’লা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিলো না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা”



[সূত্রঃ আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ.২০]।



স্থান ও সময় দু’টোই আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। তিনি সৃষ্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন, বরং সকল সৃষ্টি তার নিয়ন্ত্রণে। অনেক নির্বোধ একথা মনে করে থাকে, আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিক থেকে পবিত্র বিশ্বাস করলে তো আল্লাহ কোথাও নেই এটা বলা হয়। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বই না কি অস্বীকার করা হয়। এই নির্বোধকে জিজ্ঞাসা করা হবে, যখন কোন স্থান বা দিকই ছিলো না, তখন আল্লাহ কোথায় ছিলেন? সে যদি এটা বিশ্বাস না করে যে, আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক সৃষ্টির পূর্বে ছিলেন, তাহলে সে নিশ্চিত কাফের হয়ে যাবে। কোন সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে আল্লাহর অবস্থানের জন্য যখন কোন স্থানের প্রয়োজন হয়নি, তাহলে এখন কেন আল্লাহ তায়ালাকে স্থানের অনুগামী বানানো হবে?



ইমাম বায়হাক্বী রহঃ বলেন, নিশ্চয়ই আমাদের ও সকল মুসলমানদের জানা অত্যাবশ্যক যে, আমাদের প্রভু আকৃতি ও অবয়ববিশিষ্ট নহেন| কেননা, আকৃতি 'কেমন' এর চাহিদা রাখে| অথচ কেমন প্রশ্নটি আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়| কোনো ক্ষেত্রে যদি আকৃত্রি প্রকাশের কথা আসে তা হবে তাঁর সিফাত বা গুণাবলি|



সূত্রঃ  ইমাম বায়হাকী, কিতাবুল

আসমা ওয়াল সিফাত, ২/৬৬ পৃঃ, হাদীস নং

৬৪১, সৌদিয়া, জেদ্দা



ইমাম আবুল মানসুর মাতুরীদি (রহঃ) বলেন, মহান আল্লাহ তায়ালা দেহ, কোন সৃষ্টির সাদৃশ্য, দেহ বা শরীর, আকার, আকৃতি, মাংসবহুশ, রং, বড় দেহবিশিষ্ট, বস্তু বা পদার্থ

এগুলো থেকে পবিত্র| ইমাম বুখারী রহঃ এর উস্তাদ বলেন,

 যে মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করবে সে কাফির|



তাফসীরে ইবনে কাসির বলা আছে, যারা আল্লাহকে আরশে সমাসীন বলেন তারা পথাভ্রষ্ট| বর্তমানে লা মাযহাবীরা বলেন,

আল্লাহ আরশে বসে আছেন| এটা ভ্রান্ত এবং কুফরী | তাদের কথামত আল্লাহ যদি আরশে বসে থাকেন, এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, যখন আরশ ছিল না, তখন আল্লাহ কোথায় ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আহলে হাদিসদের শায়খ ইবনে তাইমিয়ারও পক্ষে সম্ভব নয়|

কারণ আরশ হলো আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি| আরশ যখন ছিলনা তখনও আল্লাহ ছিলেন, এখনও আছেন এবং থাকবেন|



আরশে বসার জন্য দৈহিক আকৃতি তথা পাছা,পিঠ প্রয়োজন এবং বসার জন্য আরশের মুখাপেক্ষী হতে হয় অর্থাৎ আরশের উপর হেলান দিতে হয়| কিন্তু আল্লাহ সূরা

ইখলাসের ২ নং আয়াতে বলেছেন, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী| অর্থাৎ তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন| তার বসা, হেলান দেয়ার,

নিদ্রার প্রয়োজন নেই|



অন্যভাবে বলা যায়, যদি কুরসিতে বসা মানে, তাহলে হয়তো কুরসী বড় হবে নাহলে আল্লাহ? অথচ আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, **কেউ তার সমকক্ষ নয়**|

★সূরা ইখলাস



আল্লাহর সাথে কোনো ব্যক্তি, বস্তুর তূলনা হয় না| তিনি তাঁর বৈশিষ্টে স্বতন্ত্র| ইমাম আহলে সুন্নাত আবু মানসুর মাতুরীদি

বলেন, *মুতাযিলা ও কাদিয়ানীগণ বলেন, আল্লাহ সব স্থানে উপস্থিত| কিন্তু আল্লাহ স্থানের মুখাপেক্ষী নন| আল্লাহ হলেন সেই সত্ত্বা, যখন স্থান, কাল, সময় কিছুই ছিলনা তখনও তিনি ছিলেন| দেওয়ানবাগীসহ কিছু ভণ্ড আল্লাহকে নূরের আকৃতি মানে, এরাও পথভ্রষ্ট|



ফানা ফিল্লাহ কথাটি রুপক অর্থে ব্যবহৃত| এর সঠিক অর্থ করতে গেলে, অর্থ হবে শরীয়তের প্রত্যেক টি বিধান মেনে নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দরুদ) খুশী করার নিমিত্তে দুনিয়ার সামগ্রিক চাহিদা ভুলে নিজেকে আল্লাহর ধ্যানে হারিয়ে ফেলা| অর্থাৎ দুনীয়াকে প্রাধাণ্য না দিয়ে আখিরাত

কে প্রাধাণ্য দেয়া



ইমাম তাহাভী (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'য়ালাকে মানবীয় গুনাবলি হতে কনো গুণের দ্বারা গুণান্বিত করবে সে কাফির|



সূত্রঃ আকিদাতুত তাহাভী,

৪১ পৃঃ, মাকতাবাতুল ইসলামী, লেবানন|



ইমাম আবু হানিফা রহঃ বলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির কোনো বস্তুর মতো নন|



সূত্রঃ আল ফিকহুল আকবার, পৃঃ ১৪



আল্লাহ বলেন, তার কোন দৃষ্টান্ত তথা উপমা কিছুই নেই|

সূরাঃ সূরা শু'রা আয়াতঃ ১১

*

*

আমরা জানি, পদার্থ তিন প্রকার| কঠিন, তরল ও বায়বীয়| তিনটা পদার্থই সৃষ্টি| আল্লাহ তায়ালা এই তিনটা পদার্থ থেকে পবিত্র| কারণ সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার কোনো সাদৃশ্য নেই|



পঞ্চ ইন্দ্রিয় (নাক, কান, জিহ্বা, চোখ এবং ত্বক)।

১. চোখঃ কালো, সাদা, লাল, নীল, স্ত্রী, পুরুষ চিহ্নিত করতে সাহায্য করে চোখ।

২. কানঃ পুরুষ, স্ত্রীর কণ্ঠ চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

৩. নাকঃ দুর্গন্ধ, সুগন্ধ চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

৪. জিহ্বাঃ ঝাল, টক, মিষ্টি, তেতো, টকমিষ্টি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

৫. ত্বকঃ  নরম, শক্ত, ঠাণ্ডা, গরম ইত্যাদি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।



চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক প্রত্যেক টি ইন্দ্রিয় মস্তিষ্ক / জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত।



যার চোখে দৃশ্যমান তা মস্তিষ্কেও অনুভূত, কানে যা শ্রবণ হয় তা মস্তিষ্কে অনুভূত, নাকে যে ঘ্রাণ আসে তা মস্তিষ্কে অনুভূত, জিহ্বা'য় যে স্বাদ অনুভূত হয় তা মস্তিষ্কেও অনুভূত, স্পর্শে যে অনুভূতি হয় সেটাও মস্তিশষ্কে অনুভূত।  অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয়সহ শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মস্তিষ্কের সাথে আন্তঃসম্পর্কিত।



কিছুদিন হলো বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, মানুষের চামড়ায় 'পেইন রিসেপ্টর' আছে, ফলে হাতে চিমটি দিলে, শরীরের যে কোন স্থানে ব্যথা পেলে মস্তিষ্কে ব্যথা অনুভূত হয়।



কিন্তু আল্লাহ হাতের স্পর্শে আসেন না, কানে শ্রবণ হন না, চোখে দৃশ্যমান হন না, জিহ্বা দ্বারা আল্লাহ কে টেস্ট (স্বাদ গ্রহণ) করা যায় না, আল্লাহর ঘ্রাণ নেয়া যায় না, তিনি (আল্লাহ) মানুষের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে, চিন্তায় আসেন না। কারণ তিনি অনন্ত, অসীম, নিরাকার, আলিমুল গায়েব ->(অদৃশ্য)।  আল্লাহ কে না দেখেই তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঠিক এমন আক্বিদা ছিল সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু'র।



আল্লাহ নিরাকার। কিছু মানুষের প্রশ্ন হতে পারে, এমন অনেক কিছুই আছে যার আকার নেই কিন্তু অস্তিত্ব আছে। যেমনঃ বাতাস, রাগ, ক্ষুধা, ইলম (জ্ঞান) ইত্যাদি। আল্লাহ নিরাকার' রাগ, বাতাস, ক্ষুধা, জ্ঞান নিরাকার, পার্থক্য কি?



প্রথমেই বলি, বাতাস, রাগ, ক্ষুধা, জ্ঞান ইত্যাদি হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার তুলনা হয় না। এছাড়াও বাতাস, রাগ, ক্ষুধা, জ্ঞান এসবের শুরু আছে, শেষও আছে, এদের অস্তিত্ব কোন একদিন বিলিন হয়ে যাবে কিন্তু আল্লাহ চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী।



 
Top