জন্ম ও পরিচয়:
ঈসায়ী ১৫৬১ খৃষ্টাব্দ, মুতাবিক ৯৭১ হিজরীর ১৪ই শাওয়াল, শুক্রবার দিনগত রাতে ইমামে-রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে সানি শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দী (রহ:) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর কুনিয়াত ছিল- আবুল বারাকাত, লকব ছিল-বদরুদ্দিন এবং তিনি প্রথম কাইউমরূপে পরিচিত।
একজন প্রসিদ্ধ ওলী, হযরত শায়খ আহমদ জাম (রহ:) প্রায় চার শত বছর আগে এ পূণ্যময় সন্তানের নামকরণ করেন ‘আহমদ’। তাঁর জন্মের সময় তাঁর জননী যে গায়েবী আওয়ায শুনেছিলেন, তা ছিল এরূপ। ফলে নবজাত শিশুর নাম রাখা হয়। ‘শায়খ আহমদ’। হযরত ইমামে রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:)-এর পিতার নাম হযরত শায়খ আব্দুল আহাদ (রহ:)। তিনি ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.)-এর সাতাশ তম (২৭) অধস্তন পুরুষ, এ পর্যায়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের দু‘আ উল্লেখযোগ্য। যিনি দু‘আ করেন :
হে আল্লাহ্! উমর ইবন খাত্তাব অথবা আবু জেহেলের দ্বারা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী করুন।
মহানবী (স.)-এর এ দু‘আ হযরত উমর ফারুক (রা) কর্তৃক বাস্তবে রূপায়িত হয় এবং তাঁর খিলাফতকালে দ্বীন ইসলাম উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের হাজার বছর পর যখন সমস্ত পৃথিবী পুনরায় শিরক, বিদ্‘আত ও কুফরীতে ভরপুর হয়ে যায়, তখন হযরত উমর (রা)-এর বংশধর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:) দ্বারা দ্বীন-ইসলাম পুনরায় শিরক-বিদ্‘আত থেকে মুক্ত হয়।
হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রহ:)-এর পিতা হযরত শায়খ আব্দুল আহাদ (রহ:) হিজরী ১০০৭ সালে, ১৭ই রজব ৮০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। সিরহিন্দ শরীফের উত্তর দিকে তাঁর মাযার রয়েছে।

শৈশবের কয়েকটি ঘটনা:

যে বৃক্ষ ভবিষ্যতে প্রকাশ্য মহীরুহে পরিণত হবে, তা যেমন ছোট থাকতেই বোঝা যায়, তেমনি যারা পরিণত বয়সে মহাপুরুষের মর্যাদা লাভ করবেন, তাঁদের মধ্যে ক্সশশব থেকেই বহু অলে․কিক ও বিস্ময়কর ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রহ:)-এর শৈশবে ও কিছু আশ্চর্যজনক ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। যেমন, তিনি মাতৃগর্ভ থেকেই ‘মাখতুন’ হালতে অর্থাৎ খাতনাকৃত অবস্থায় ভূমিষ্ট হন। উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলে পাক (স.) ও ‘মাখতুন’ অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করেন।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ:)-এর শৈশবকালীন আরো একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই যে, তিনি কখনো নগ্নদেহে থাকতেন না। কখনো তাঁর সতর অনাবৃ ত হলে, সাথে সাথে তা ঢেকে নিতেন। তিনি সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও হাসি মুখে থাকতেন। তাঁর প্রত্যেকটি আচার-আচরণ ও চাল-চলনের মধ্যে এক বিশেষ নিদর্শন পরিলক্ষিত হতো।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ:) দুদ্ধপোষ্য শিশু থাকাবস্থায় একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তার পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সকলে তাঁর জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন। এ সময় হযরত শাহ কামাল কায়থিলী (রহ:) সিরহিন্দ শরীফে আসেন। এখবর পেয়ে শায়খ আব্দুল আহাদ (রহ:) তাঁর অসুস্থ শিশুকে দু’আ করার জন্য তাঁর কাছে নিয়ে যান। শিশুকে দেখা মাত্রই হযরত শাহ সাহেব বলেন
আল্লাহ তায়ালা এই শিশুর হায়াত দারাজ করুন। এর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জল। পরিণত বয়সে সে আলেমে হাক্কানী ও আরিফে কামিল হবে এবং আমার মত হাজার হাজার লোক তাঁর আত্মিক তালিমে উপকৃত হবে। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ প্রাপ্তির যে আলো সারা দুনিয়াতে ছড়াবে, তা কিয়ামত পর্যন্ত কখনো নিস্প্রভ হবে না।
এরপর শাহ সাহেব তাঁকে কোলে নিয়ে নিজের পবিত্র জিহবা তাঁর মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেন। শিশু মুজাদ্দিদে (রহ:) অনেকক্ষণ পর্যন্ত উক্ত জিহবা লেহন করতে থাকেন। অত:পর শাহ সাহেব তাঁর পিতাকে সান্তনা দিয়ে বলেন :
চিন্তা করবেন না, ইনশা আল্লাহ্ শিশু আরোগ্য লাভ করবে। আল্-হামদু লিল্লাহ, শিশু কাদেরিয়া তরীকার সব নিয়ামত লাভ করলো। আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারা তাঁর দ্বীনের খিদমত নিবেন।

শিক্ষা জীবন:

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:) শৈশব অতিক্রম করে কৈশোরে পদার্পন করলে তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি পিতা-মাতা বিশেষ যত্ন নিতে আরম্ভ করেন। অল্প বয়সে, অতি অল্প সময়ে তিনি কুরআন মযীদ হিফয করেন। এরপর ‘ইল্মে দ্বীনের অনেক কিতাব তিনি তাঁর পিতা শায়খ আব্দল আহাদ (র)-এর নিকট অধ্যয়ন করেন। সিরহিন্দের অন্যান্য বিখ্যাত আলিমের নিকট থেকে ও তিনি দ্বীনি ইল্ম হাসিল করেন। হযরত শায়খ ইয়াকুব কাশ্মিরী (র.), হযরত মাওলানা কাযী বাহ্লুল (র.), স্বনামধন্য তর্কশাস্ত্রবিদ হযরত মাওলানা কামাল (র.) প্রমুখ আলিম ও বুযুর্গানে-দ্বীন তাঁর উস্তাদ ছিলেন।
ইল্মে তাসাউফ বা মারিফাত সম্বন্ধীয় কিতাব ‘তাসাউফ’, আওয়ারিফুল মাআরিফ, ফুসুসুল হিকাম-প্রভৃতি তিনি সে যুগের শ্রেষ্ঠ উস্তাদদের নিকট পাঠ করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জাহেরী ও বাতেনী ইলমের এক বিরাট ভান্ডারে পরিনত হন।
এরপর তিনি ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিভিন্ন দেশে থেকে দলে দলে শিক্ষার্থী তাঁর নিকট আসতে থাকে এবং দিন-রাত শিক্ষা দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। তাঁর দারসে হাদীস ও তাফসীরের হাল্কা সব সময় শরগরম থাকতো। বহু লোক তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে সনদ হাসিল করেন। অবশেষে তিনি ‘ইলমে-জাহেরীতে’ বা জাহেরী-ইলমে’ এরূপ কামালাত অর্জন করেন যে, তিনি মুজতাহিদের দরজায় উন্নীত হন।
উল্লেখ্য যে ইমামে রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (র.)-এর পূর্ব পুরুষগণ সবাই ছিলেন মারিফাত পন্থী। তাই ‘ইল্মে মারিফত অর্জনের বিষয়টি তিনি ওয়ারিছ সূত্রেই লাভ করেন। প্রথমে তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে ‘ইল্মে মারিফাত অর্জন করেন এবং তাঁরই নিকট থেকে চিশ্তীয়া তরীকার খিলাফত প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি কাদেরীয় তরীকার শ্রেষ্ঠ বুজর্গ হযরত শাহ সিকান্দার (র.)-এর নিকট থেকে এই তরীকার খিলাফত লাভ করেন। সে সময় ‘কুব্রাবিয়া’ তরীকার খুবই প্রসিদ্ধি ও প্রসার ছিল। হযরত মাওলানা ইয়াকুব (র.) ছিলেন এই তরীকার বিখ্যাত বুজর্গ। হযরত মুজাদ্দিদ (র.) তাঁর থেকে এই তরীকার খিলাফত লাভ করেন। এসময় তাঁর পিতা শায়খ আব্দল আহাদ (র.)-এর অন্তিম মূহুর্ত এসে পড়ে। ইন্তিকালের আগে তিনি তাঁর পুত্র মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র) কে তাঁর সমস্ত বাতেনী শক্তি দান করে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। এভাবে তিনি সে সময় প্রচলিত সমস্ত তরীকার কামালিয়াত হাসিল করেন এবং পিতার নির্দেশ মতো নক্শাবন্দীয়া তরীকায় পরবর্তী কালে কামালিয়াত হাসিল করে ‘ইল্মে মারিফাতের মহাসাগরে পরিণত হন।
জাহেরী ও বাতেনী ইল্ম হাসিলের পর মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (র.) বাদশাহ আকবরের রাজধানী আগ্রায় যান। বাদশার সেনা-বাহিনীর অনেকেই তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হন। এ সময় অনেক ‘আলিম তাঁর নিকট থেকে ইল্মে হাদীস ও তাফসীরের সনদ গ্রহণ করনে।’ এর ফলে তাঁর ‘ইল্মে ও ইজ্তিহাদের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আগ্রায় অবস্থান কালে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র.)-এর খ্যাতি এমন ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শাহী দরবারের দর্শন ও তর্কশাস্ত্রে বিখ্যাত ‘আলিম আবুল ফযল ও ফৈযী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং মাঝে মাঝে তারা তাঁর মজলিসে আগমন করতেন।

শাদী মুবারক:

ইমামে রাব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) দীর্ঘদিন আকবরাবাদে অবস্থান করার পর তাঁর পিতা হযরত আব্দুল আহাদ (র.) তাঁকে সিরহিন্দ শরীফে নিয়ে যান। পথিমধ্যে বাদশাহ আকবরের এক বিশেষ আমাত্য শায়খ সুলতানের কন্যার সাথে হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) -এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নযোগে শায়খ সুলতানকে এ বিবাহ সম্পর্কে ইশারা প্রদান করেন। শায়খ সুলতান ছিলেন সে সময় থানেশ্বরের শাসন কর্তা। দিল্লীর বাদশার পক্ষে তিনি থানেশ্বর এলাকা শাসন করতেন। একদা তিনি স্বপ্নে দেখেন, হযরত রাসূলে পাক (স.) তাঁকে বলছেন :
হে সুলতান! তুমি তোমার মেয়েকে শায়খ আহমদ সিরহিন্দীর সাথে বিয়ে দাও।
সুলতান তাঁকে চিনতেন না।, তাই এ নির্দেশ কিরূপে পালন করবেন, তা নিয়ে মহা চিন্তায় পড়েন। এসময় তিনি আবার স্বপ্ন দেখেন এবং এ সময় তাঁকে শায়খ আহমদ সিরহিন্দীর সুরতও দেখান হয়। কয়েকদিন পর শায়খ আহমদ খানেশ্বর যান এবং সুলতানের সাথে তাঁর দেখা হয়। তাঁকে দেখেই সুলতান চিনতে পারেন যে, ইনিই সেই যুবক, যার সাথে তাঁর কন্যার বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে উপযাচক হয়ে একজন অপরিচিত যুবকের কাছে নিজের কন্যার বিয়ের প্রস্তাব দিতে ইত:স্তত বোধ করছিলেন। ফলে আবার তিনি নবী করীম (স.) কে স্বপ্নে দেখেন। তিনি (স.) বলেন
এ ব্যক্তি সম্পর্কেই আমি তোমাকে বলেছি। তুমি সরাসরি তাঁর কাছে প্রস্তাব দাও।
এরপর শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ)-এর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পেশ করা হলে, তিনি তাঁর পিতার সম্মতি নিয়ে এ বিয়েতে রাজী হন এবং যথা সময়ে শাদী মুবারক সম্পন্ন হয়। এ বিয়ের দ্বারা তাঁর আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হয় এবং তিনি বসবাসের জন্য সিরহিন্দে বাড়ী এবং ইবাদাতের জন্য খানকাহ নির্মান করেন, যা এখন ও রয়েছে।

নকশ্‌বন্দীয়া তরীকা হাসিল:

ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর মনে আগে থেকেই বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রওযা পাকের যিয়ারত করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অসুস্থ ও বৃদ্ধ পিতার খিদমতের জন্য তিনি হজ্জ আদায় করতে পারেননি।
হিজরী ১০০৭ সালে তাঁর বুজর্গ পিতার ইনতিকালের পর তিনি ঐ বছরই হজ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দিল্লীতে উপনীত হন। এ সময় তাঁর বন্ধু ও খাজা বাকী বিল্লাহ (র.) - এর মুরীদ মাওলানা হাসান কাশ্মীরীর সাথে তার দেখা হয়। এ সময় মাওলানা সাহেব তাঁর নিকট হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (র.) -এর কামালাতের বিষয় প্রকাশ করে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন-
খাজা সাহেব নকশ্‌বন্দীয়া তরীকার একজন অতুলনীয় রত্ন, এ রকম লোক বর্তমানে দুর্লভ। তাঁর একটি নেক-নজরে তালেবগণ এমনই ফয়েয লাভ করেন, যা দীর্ঘদিন সাধনা ও চিল্লার দ্বারা হাসিল হয় না।
ইতিপূর্বে হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) এই তরীকা সম্পর্কে তাঁর বুজর্গ পিতার নিকট থেকে বহু কিছু শুনে এবং বইপত্র পড়ে অবগত হয়েছিলেন, এবং এই তরীকার প্রতি তাঁর স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকার তিনি দেরী না করে তখনই মাওলানা হাসান সাহেবের সাথে খাজা সাহেবের দরবারে হাযির হন। কার ও প্রতি কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করার অভ্যাস হযরত খাজা (র.)-এর ছিলনা। তা সত্বেও তিনি তাঁর আদতের খিলাফ করে হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) কে কিছুদিন তাঁর খানকায় থাকার জন্য অনুরোধ করেন । তিনি সেখানে এক সপ্তাহ থাকবেন বলে ওয়াদা করলেও, প্রায় আড়াই মাস হযরত খাজার দরবারে অবস্থান করেন। দু’দিনের মধ্যে তিনি নিজের মধ্যে হযরত খাজার প্রভাব উপলব্ধি করে বায়আত হওয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। ফলে, খাজা সাহেব সাথে সাথেই তাকে বয়আত করে ‘ক্বলবে’ যিকিরের তালিম দেন এবং তাঁর ‘ক্বলব’ তখনই জারী হয়ে যায়।

নকশ্‌বন্দীয়া তরীকার প্রতিষ্ঠা ও এর বৈশিষ্ট্য:

ইমামুত তরীকত ও শরীয়ত হযরত খাজা বাহাউদ্দীন মুহাম্মদ বুখারী (র.) এ তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৭১৮ হিজরীর মুহাররম জন্ম গ্রহণ করেন। বংশের দিক দিয়ে তিনি ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হুসাইন (রা.) -এর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। শৈশবকাল হতেই বেলায়েতের নূর তাঁর পবিত্র চেহারায় ফুটে উঠে। সে যুগের শ্রেষ্ঠ গুলীদের তারবীয়ত ও সোহবত লাভে তিনি ধন্য হন এবং দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর কঠোর রিয়াযাত ও সাধনা দ্বারা কামালিয়াত অর্জন করেন্ এ সময় তিনি বুখারার সব খানকাহ ও মাদ্রাসার প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতেন, তাছাড়া আল্লাহ্র ওলী ও দরবেশদের খিদমত ও তাদের পেশাব খানা ও পায়খানা পরিস্কার করার কাজও করতেন।
উল্লেখ্য যে নাফসের পবিত্রতা লাভের জন্য দীর্ঘ চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি চিন্তা করেন যে, পরবর্তী সময়ের মানুষের হায়াত দীর্ঘ হবে না এবং আল্লাহ্ তায়ালার মারিফাত ও মহব্বত হাসিলের জন্য তারা এত কষ্ট দ্বীকার করতে পারবে না। কারণ, যতই দিন যাবে, ততই মানুষ দুনিয়ামুখী হবে এবং দুনিয়ার ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে। তাই একটি সহজ তরীকা লাভের আশায় তিনি আল্লাহর দরবারে লাগাতার পনের দিন সিজদায় পড়ে থাকেন। নামাযের সময় হলে শুধুমাত্র জামাতে ফরয নামায আদায় করতেন এবং বাকী সময় সিজদায় পড়ে থাকতেন। এ সময় কোন দিন তিনি এক লোকমা খানা বা এক ফোঁটা পানি স্পর্শ করেননি। খাজা বাহাউদ্দীন নকশ্‌বন্দ (র.) সিজদায় পড়ে এরূপ দু’আ করতেন:
ইয়া আল্লাহ্! আপনি আমাকে এরূপ তরীকা দান করুন, যে তরীকায় সহজে তোমার মারিফাত বা পরিচয় লাভ করা যায় এবং ‘তালেবে মাওলা’ যেন মাহরম না হয়।
কখনো কখনো তিনি এরূপ মনে করতেন যে, যদি তাঁর দু’আ কবুল না হয়, তবে তিনি সিজ্দার মধ্যেই নিজেকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করবেন। সে জন্য তিনি বলতেন  :
ইয়া আল্লাহ্! আপনার দরবারে সিজদার মধ্যে যদি আমার ইনতিকাল হয়ে যায়, তবে আমি আমার খুন মাফ করে দিলাম। আমি উম্মতে-মুহাম্মদীর জন্য আসান বা সহজ তরীকার দাবী আদায় না করে সিজ্দা থেকে মাথা উঠাব না।
এ সময় সিজ্দার মধ্যে মাঝে মাঝে এরূপ ‘ইল্হাম’ হতো :
আমি যেরূপ চাই, তুমি সেরূপ তরীকা গ্রহণ কর।
আর তিনি বলতেন :
ইয়া আল্লাহ্! আপনার বান্দা বাহাউদ্দীন যেমন আসান তরীকা চায়, তাকে তাই দান করুন।
অবশেষে পনের দিন আল্লাহ্ তায়ালার তরফ থেকে এরূপ ‘ইল্হাম’ বা নির্দেশ আসে :
আমি তোমাকে এমন তরীকা দান করব, যে তরীকায় দাখিল হওয়ার পর কেউ মাহরম বা বঞ্চিত হবে না।
আরো ‘ইলহাম’ হলো :
মানুষের শরীরে দশটি লতীফা আছে, এর মধ্যে পাঁচটি লতীফা ‘আলমে-আমর’ বা সূ² জগতের এবং পাঁচটি লতীফা আলমে-খালক’ বা জড় জগতের। ‘আলমে-আমরের পাঁচ লতীফা হলো : কল্ব, রূহ, সির, খফী ও আখ্ফা নূরের তৈরি, সে জন্য তা নূরানী।
মহান আল্লাহ্ ‘আমর’ শব্দের ব্যাখ্যায় আল্-কুরআনে ইরশাদ করেনেঃ
বস্তুত আল্লাহ্ তায়ালা যখন কোন কিছু সৃষ্টি করতে চান, তখন তিনি বলেন : হও, আর অমনি তা হয়ে যায়।
— আল্-কুরআন, সূরা ইয়াসিন, আয়াত : ৮৪
অর্থাৎ ‘কুন’ শব্দ দ্বারা যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে ‘আলমে-আমরের’ পাঁচ লতীফা শামিল। পক্ষান্তরে ‘আলমে খালক’ বা জড় জগতের পাঁচ লতীফা যুল্মত বা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর তা হলো: আগুন, পানি, মাটি,বাতাস ও নাফ্স।
উল্লেখ্য যে, নকশ্‌বন্দীয়া তরীকা প্রচার ও প্রসারের পূর্বে বুজু র্গানে দ্বীন প্রথমে ‘নাফসের তাযকীয়া’ বা প্রবৃত্তি পরিশুদ্ধ করার শিক্ষা দিতেন, কিন্তু নাফ্স যুল্মত বা কালো কয়লার মত কালো হওয়ার কারণে তা ইসলাহ বা সংশোধন হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হতো। নাফসের ইসলাহের জন্য আগের যামানার বুজুর্গরা ‘তালেবে মাওলাকে’ [1] যে পথ অনুসরণের উপদেশ দিতেন, তা ছিল ‘তরকে হাকীকী বা দুনিয়ার সব কিছু ত্যাগ করা। নাফসের পবিত্রতা হাসিলের জন্য ‘তালেবে মাওলাকে’ যে কঠিন ও কঠোর সংগ্রাম করতে হতো, তা হযরত অহেদ উদ্দীন কিরমানী (র.)-এর কবিতায় বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন :
আওহাদী শশ্ত সাল সখ্তী দীদ্!
তা-শবে রুয়ে নেক বখ্তী দীদ!
অর্থাৎ “অহেদ উদ্দীন ষাট বছর কঠোর সাধনার পর এক রাতে সে․ভাগ্যের মুখ দর্শন করনে।”
আল্লাহ্ তায়ালার তরফ থেকে হযরত খাজা বাহাউদ্দনি নকশ্‌বন্দ বুখারী (র.)-এর উপর এরূপ ‘ইল্হাম’ হয় যে, ‘নাফ্সের ইস্লাহ খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর ‘ক্বল্ব’ যেহেতু ‘নূর’ হতে সৃষ্ট স্বচ্ছ আয়নার ন্যায়, তাই তুমি প্রথমে ‘ক্বলবের’ ইস্লাহ কর, তাহলে মানুষের অন্তর অতি দ্রুত বাতিনী নূরের আলোকে নূরান্বিত হবে। বস্তুত : ‘তালেবে মাওলার’ অন্তরে যখন আল্লাহ্ তায়ালার মহব্বতের নূর পয়দা হয়, তখন আস্তে আস্তে গায়রুল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, এরূপ নির্দেশ পাওয়ার পর হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (রহ:) আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করে সিজদা থেকে মাথা উঠান এবং নির্দেশ মতো আল্লাহ্ প্রাপ্তির জন্য যারা আসতো, তাদের তালীম ও তারবীয়ত দেয়া শুরু করেন। তিনি হলেন নকশবন্দীয়া তরীকার ইমাম বা ‘আসান তরীকার’ [2] প্রতিষ্ঠাতা। এ তরীকার মূলনীতি হলো :
১. নিজের পীরকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা। অন্যথায় রূহানী ফয়েয থেকে বঞ্চিত হয,
২. এই তরীকার মুর্শিদ সাইয়েদেনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) কে নবী গণের পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষরূপে মনে করা। এই তরীকার মাধ্যমে শরীয়ত ও তরীকত উভয়েরই পূর্ণতা সাধন হয়। এ ছাড়া সুন্নতের পায়রবী করা ও বিদ্’আত সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করা ও এই তরীকার অন্যতম মূলনীতি। হযরত রাসূলে করীম (স.)-এর বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামের ন্যায় বেশ-ভূষা, পোষাক-পরিচ্ছদ, জীবন-যাপন, জিকির-আজকার, নাফসের হিসাব-কিতাব গ্রহণ করা ছাড়াও সব সময় হুজুরী-ক্বলব, পীরের প্রতি আদব রাখা, তাঁর খিদমত করা এবং তাঁর সাথে মহব্বত রাখা জরুরী।
এ ছাড়া কম পরিশ্রম, বেশী বেশী ফয়েয জারী হওয়া এবং কামালাতে বেলায়েত’ ছাড়া ও ‘কামালাতে নবূওতের’ শিক্ষা এই তরীকায় আছে। এতে চিল্লাকাশির [3] প্রয়োজনীয়তা নেই এবং জোরে জোরে জিকির করা ও বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে সিমা ও কাওয়ালী ইত্যাদির নিয়ম নেই। তাছাড়া কবরের উপর বাতি জ্বালানো, গিলাফ ও চাদর ইত্যাদির সাহয্যে কবর ঢাকা, স্ত্রীলোকদের মাযারে ভীড় করা, সিজদায়ে তাযীমি বা পীরের সামনে মাথা ঝুকানো, চুমা দেয়া, তাওহীদে অজুদী, আনাল হক, হামাউস্ত ইত্যাদির দাবী, স্ত্রীলোক-মুরীদের জন্য পীরের সামনে বে-পর্দা হওয়া ইত্যাদির অনুমাতি এই তরীকায় নেই [4] এ তরীকার বুনিয়াদ চারটি :
১. হুশ্‌ দর দম বা সর্বদা যিকিরের খেয়াল রাখা।
২. নযর বর কদম বা সর্বদা সামনে দৃষ্টি দেয়া। অর্থাৎ এক মাকামের পর অন্য মাকামের খেয়াল করা।
৩. সফর দর ওয়াতন বা নিজের সত্তার মধ্যে ভ্রমন করা এবং
৪. খেলাওত দর আন্-জুমান বা জনতার মধ্যে ও নির্জনতা।

খিলাফত প্রাপ্তি:

হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (র.) হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.)-এর ন্যায় একজন সুযোগ্য মুরীদের তালিম ও তারবিয়তের [1] মাধ্যমে কামালিয়াতের দরজায় পৌঁছানোর সুযোগ পাওয়ায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। তিনি তাঁর কামালাত[2] ও হালাতের [3] প্রশংসা করে এক মুবারক সময়ে তার খিলাফাতের ‘খেলাতে’ বা মর্যাদায় বিভূষিত করেন এবং পরে সিরহিন্দ শরীফে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
ইমামে রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) নিজ জন্মভূমি সিরহিন্দ শরীফে ফিরে আসার পর নিজ বুজর্গ মুর্শিদের হিদায়েত ও ইরশাদ বা নির্দেশ অনুযায়ী তালেবদের বা ইলমে মারিফাত অনুসন্ধানকারীদের শিক্ষা-দীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শত শত তালেবে মারিফাত বা মারিফাত অন্বেষণকারীরা দুনিয়া ও আখিরাতের চিরকল্যাণ লাভ করে ধন্য হয়।

মুজাদ্দিদ উপাধি লাভ:

হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.) তাঁর মুর্শিদের নির্দেশে সিরহিন্দ শরীফে ফিরে আসলে দলে দলে লোক তাঁর খিদমতে হাযির হয়ে বায়আত হতে থাকে। এসময় একদিন তিনি ফজরের নামাযের পর তাঁর হুজরায় মুরাকাবায় মশগুল থাকা অবস্থায় দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রুহানীভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফিরিশ্তা, আউলিয়া ও গাওস কুতুবদের সাথে সেখানে তাশরীফ এনেছেন। নবী করীম (স.) তাঁর পবিত্র হাতে শায়খ আহমদ (রহ.)কে একটি অমূল্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পোশাক পরিয়ে দিয়ে বলেনঃ
শায়খ আহমাদ মুজাদ্দিদের প্রতীকস্বরূপ আমি তোমাকে এই ‘খিলআত’ বা পোশাক পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য আমি তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। আমার উম্মাতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ হতে তোমার উপর অর্পিত হলো।
উল্লেখ্য যে, এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল শুক্রবার ফযরের নামাযের সময় সংঘটিত হয়। নবী রাসূলগণ সাধারণতঃ যে বয়সে নবূওতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন, সেই বয়সে অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়সের সময় হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) “মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী” উপাধিতে ভূ ষিত হন। এ ঘটনার দ্বারা বু ঝা যায় যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর উপর নবী-রাসূলস্বরূপ দায়িত্বের বোঝা অর্পন করেছিলেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) এ সম্পর্কে বলেনঃ
আমার উপর মুজাদ্দেদীয়াত বা সংস্কারকের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে, শুধু পীরি-মুরিদি করার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয় নি । মুরীদদের মারিফাতের বা আল্লাহ্ প্রাপ্তির তালিম দেয়া আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। যে মহান দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে, তা অনেক ব্যাপক ও বড়। মুরীদদের তরীকতের তালিম বা শিক্ষা দেয়া এবং মানুষকে কামালিয়াত বা পূর্ণতার স্তরে পৌঁছানো রাস্তা থেকে কুড়ানো তুচ্ছ জিনিসের মত।
— শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.), মাকতূবাতে ইমামে রাব্বানী, ২য় খন্ড, মাকতূব নং- ৬ দ্রষ্টব্য

মুজাদ্দিদ কাকে বলে ?

`মুজাদ্দিদ’ আরবী শব্দ। এর অর্থঃ দ্বীনের সংস্কারক। মানুষ যখন ধর্ম বিমুখ হয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ও শয়তানের পায়রবী শুরু করে, নৈতিক ও জাতীয় জীবন হয় কলুষিত, তখন তাদের হিদায়েতের প্রয়োজনে আল্লাহ্ তায়ালা বিশেষ দায়িত্ব সহকারে তাঁর তরফ থেকে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এটাই চিরন্তন রীতি। নবূওত ও রিসালাতের ধারা বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে তাদের আগমন ঘটেছে। তাঁরা সবাই পথহারা, গুমরাহের মানুষদের সত্যপথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। এ ধারা বন্ধ হয়ে গেলে, নবী চরিত্রের যাবতীয় গুণাবলীর অধিকারী নায়েবে নবীদের উপর এ মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়।
সত্য-দ্বীনের অনুসারী আলিম-উলামা, কামিল-মুকাম্মিল আল্লাহ্র ওলী, পীর দরবেশগণ সকলে নবীর নায়েব বা প্রতিনিধিরূপে মানব জাতিকে হিদায়েত দান করেন। কিন্তু ‘মুজাদ্দিদ’ পদটি অন্য সব উপাধি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ। কাউকে ‘মুজাদ্দিদ’ রূপে গ্রহণ করার অর্থ হলোঃ ইলম ও আখলাক, উভয় ক্ষেত্রে তার মহত্বকে স্বীকার করা। বস্তুতঃ দ্বীনের সংস্কার সাধন নবীদের কাজ এবং এই কাজ কেবল তারাই করতে পারেন, যারা আখলাকে নাবী বা নবী চরিত্রের জীবন্ত প্রতীক এবং দ্বীনের সংস্কার বা ধর্মের প্রকৃত রূপায়নের কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার মত পরিপূর্ণ যোগ্যতার অধিকারী।
উল্লেখ্য যে, যে কোন ব্যক্তি নিজের চেষ্টা ও সাধনা বলে বড় আলিম ও কামিল হতে পারে, কিন্তু নবুওত যেমন স্বীয় চেষ্টা ও সাধনা বা দলীয় সমর্থন দ্বারা লাভ করা সম্ভব হয়না, তেমনি মুজাদ্দিদ উপাধি লাভ করাও সম্ভব নয়। নবূওত যেমন আল্লাহ্ তায়ালার একটি মহান দায়িত্ব, তেমনি ‘মুজাদ্দিদ’ উাপাধি প্রদান ও তাঁর আরেকটি বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন, তিনিই কেবল এই মহান পদের অধিকারী হতে পারেন। কারও পক্ষে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এ পদে উন্নীত হওয়া আদে․ সম্ভব নয়। কাজেই সাধারণ ‘হাদী’ বা পথপরিদর্শক এবং ‘মুজাদ্দিদ’ এক কথা নয়; বরং উভয়টির মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন নবী-রাসূলদের আবির্ভাব সম্পর্কে আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে بعثت ‘বে‘সাত শব্দ ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ প্রেরণ। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেনঃ
তিনিই সে মহান স্রষ্টা, যিনি নিরক্ষর লোকদের নিকট তাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন।
— আল্-কুরআন, সূরা জুম’আ, আয়াত নং- ২
আমি কখনো আযাব দেইনা, যতক্ষণ না আমি তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করি।
— আল্-কুরআন, সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত নং ১৫
আমি তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছিলাম।
এখানে একথা পরিস্কার যে, কুরআনের পরিভাষা অনুযায়ী বে‘সাত শব্দটি দেখলেই বোঝা যায়, এখানে কোন নবীর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে। কাজেই এ শব্দটি নবূওতের জন্য খাস বা নির্দিষ্ট। পক্ষান্তরে, হাদীস শরীফে ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধির ক্ষেত্রে ও বে‘সাত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ
নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালা এই উম্মতের হিদায়েতের জন্য প্রতি শতকে এমন এক মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিতি তার যুগে দ্বীনের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক হন।
— আল্-হাদীস, আবু দাউদ শরীফ বর্ণিত
উল্লেখ্য যে, বেসাত শব্দটি নবূওতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য অথচ উপরোক্ত হাদীসে মুজাদ্দিদ প্রেরণ সম্পর্কে একই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। অতএব একথা স্পষ্ট যে, নবূওত ও মূজাদ্দেদীয়াত এই উভয় পদের মনোনয়ন একমাত্র মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই হয়। তফাত এতটুকু যে, নবূওত হলো ‘আসল’ বা মূল বৃক্ষ এবং মুজাদ্দেদীয়াত তার প্রতিবিম্ব বা ছায়া। নবীর প্রত্যাদেশ, কুরআনের ভাষায় যাকে ‘ওহী’ বলা হয়েছে, তা চুড়ান্ত ও ধ্রুব সত্য, আর মুজাদ্দিদের ‘ইল্হাম’ ও তার নিকটবর্তী সত্য। ইল্হাম নবীর ওহীর পরিপন্থী না হলে তা-ও ধ্রুব সত্য।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী:

মুজাদ্দিদ’ শব্দের অর্থ সংস্কারক। ‘আলফুন’ অর্থ হাজার এবং ‘সানী’ অর্থ দ্বিতীয়। সুতরাং “মুজাদ্দিদে আলফে সানী”-এ শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ “দ্বিতীয় হাজার বছরের সংস্কারক”। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১০১০ হিজরীর, ১০ই রবিউল আউয়াল, সাইয়েদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রূহানীভাবে হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দীকে ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিতে ভুষিত করেন। উল্লেখ্য যে, হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর কর্ম জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি শুধু শতকের ‘মুজাদ্দিদ’ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন হাজার বছরের মূজাদ্দিদ। পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার আলোকে পরিস্কার ভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, ফিত্না-ফাসাদ পূর্ণ অবস্থার মধ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) যে বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করে ভারত বর্ষের তৎকালীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনধারার সংস্কার সাধন করেছিলেন, তাই তার সংস্কারকে শত বছরের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, হাজার বছরের সংস্কার কর্মের রূপরেখায় ব্যাপ্ত করে দিয়েছে।
হযরত রাসূলে করীম (স.) তাঁর উম্মতের উপর একবার পাঁচশো বছর পর, আবার এক হাজার বছর পর ভীষণ দুর্যোগ নেমে আসবে বলে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বস্তুত তাঁর সে ভবিষ্যদ্বানী বাস্তবে রূপায়িত ও হয়। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইনতিকালের পাঁচশো বছর পর মুসলিম জাহানে দেখা দেয় বর্বর তাতারদের হামলা, তাতারী হামলার কবলে পড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া উপক্রম হয়েছিল। তখন মহান আল্লাহ্ স্বীয় কুদরতে ‘উসমানিয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে, তাদের দ্বারাই দ্বীন ইসলামের হিফাযত করেন। অর্থাৎ যারা এক সময় ইসলামের শত্রু ছিল, আল্লাহ্ তায়ালা তাদের অন্তরে ইসলাম প্রীতি উজ্জীবিত করে দেন; ফলে তারাই শেষ পর্যন্ত ইসলামের বন্ধু ও রক্ষকে পরিণত হয়।
উল্লেখ্য যে, তাতাদের ধ্বংসলীলার পর ৬ষ্ঠ শতকে ইসলাম ও মুসলিম কাওমের জীবন ধারা নতুন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নতুন যুগের সূচনা হয়। মুসলিম দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ আলিম-ফাযিল, ওলী-দরবেশ, জ্ঞানী-গুণী ও বিভিন্ন মনীষীর আবির্ভাব ঘটে। তাদের জ্ঞান-গরিমা ও উন্নত চরিত্রের পরশে ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয় । ধন্য হয় সারা মুসলিম জাহান এবং মুসলিম কাওম আবার শান-শওকত ও শৌর্য-বীর্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে সক্ষম হয়। এই ধারা পাঁচশো বছর ধরে অব্যাহত থাকে। তারপর আবার শুরু হয় মুসলমানদের পতনের যুগ। অর্থাৎ প্রথম হাজার বছর শেষ হওয়ার পর।
দ্বিতীয় হাজার বছরের শুরু থেকে মুসলিম জাহানে পুনরায় দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়। এ সময় ইহুদী, নাসারা, মুশরিক, মুরতাদ ও মুনাফিকরা নানাভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য বদ্ধপরিকর হয় । অন্যদিকে মুসলিম সমাজের মাঝে ধর্মের নামে অধর্ম এবং পীরি-মুরীদীর নামে অনেক বিদ্‘আত ও ফাসেকী কর্মকান্ড দেখা দেয়। শিয়া-সুন্নী ও রাফেজী খারেজী ইত্যাদি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এক কথায়- বাইরের শত্রুর আক্রমণ এবং নিজেদের পারস্পরিক কোন্দল, স্বার্থের হানাহানি ও হীন চক্রান্তের মাঝে পড়ে মুসলমানরা অতল তলে নিমজ্জিত হতে থাকে। বিশেষত: তদানীন্তন ভারতে মুসলমানদের অবস্থা সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থায় এসে পৌঁছে । স্বেচ্ছাচারিতার উদ্যাম সয়লাবের মুখে মহানবী (স.) এর আদর্শ হেয়, লাঞ্ছিত ও পদদলিত হতে থাকে। ঠিক এমনি দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহঃ) কে আল্লাহ্ তায়ালা মুজাদ্দিদ রূপে প্রেরণ করেন। হযরত মুজাদ্দিদ (রহঃ) আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন, যার ফলে এই উপ মহাদেশে মৃত প্রায় ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়।
উল্লেখ্য যে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ) হলেন সেই মহান ব্যক্তি, যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (স.) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বানী করেন। তিনি বলেনঃ
একাদশ শতকের প্রারম্ভে মহান আল্লাহ্ দুনিয়ার বুকে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি উজ্জ্বল ‘নূর’ স্বরূপ হবেন। তার নামকরণ করা হবে আমারই নামানুষারে। দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশার যুগে তাঁর আবির্ভাব হবে। তাঁর তালিম ও তরবীয়তে অসংখ্য লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।
— মাওলানা হাসান কাশ্মী (র); রওজাতুল কাইয়ুমিয়া। পৃ. ৩৭-৩৮
উপরোক্ত হাদীসে যে দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশার কথা বলা হয়েছে, তারা ছিলেন সম্রাট আকবর ও তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর। আকবরের শাসনামলে প্রকৃতপক্ষে হযরত মুজাদ্দিদ (রহঃ)-এর সংস্কারমূলক কাজ শুরু হয় এবং জাহাঙ্গীরের আমলে তা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।

হযরত গাওসে আজম বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর ভবিষ্যদ্বানী:

রওযাতুল কাউইমিয়া গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত গাওসে আজম বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) বাগদাদের কোন এক জঙ্গলে মুরাকাবায় মশগুল ছিলেন। এ সময় কাশ্ফের হালতে তিনি দেখেন যে, হঠাৎ একটি নূর আসমান থেকে প্রকাশ পায়, ফলে সমস্ত বিশ্বজগত আলোকিত হয়। এ সময় তাঁকে বলা হয়, এখন থেকে পাঁচশ বছর পর যখন সারা দুনিয়াতে শিরক ও বিদ'আত ছড়িয়ে পড়বে, তখন একজন অসাধারণ বুজর্গ ওলী উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে জন্ম গ্রহণ করবে। সে দুনিয়া থেকে শিরক ও বিদ্‘আত দূর করে দ্বীন-ইসলামকে উজ্জীবিত করবে। তাঁর সোহবত স্পর্শ মনির মত হবে এবং তাঁর পুত্র ও খলীফাগণ দ্বীনি খিদমত উত্তমরূপে সম্পন্ন করবে।
এরপর হযরত গাওসে আজম (রহ.) তাঁর খাস খিরকাকে কামালাতে ভরপূর করে স্বীয় পুত্র সৈয়দ তাজুদ্দীন আব্দুর রাজ্জাক (রহ.)-কে সোপর্দ করে নির্দেশ দেনঃ যখন ঐ বুজুর্গের প্রকাশ হবে, তখন যেন এটা তাঁকে প্রদান করা হয়। সেই সময় থেকে ঐ খিরকা মুবারক পর্যায়ক্রমে হস্তান্তরিত হয়ে হযরত পীরানে-পীর (রহঃ)-এর দৌহিত্র হযরত শাহ সেকেন্দার (র) এর মারফতে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ)-এর নিকট পৌঁছে । [1]
এছাড়া হিজরী পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি হযরত শায়খ আহমদ জাম (রহ.) নামক একজন বুজুর্গ ভবিষ্যদ্বানী করেন যে, তাঁর চারশ বছর পর ইসলাম জাহানে ‘আহমদ’ নামে একজন বুজুর্গ ব্যক্তির জন্ম হবে, যিনি মৃতপ্রায় ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। হযরত শায়খ আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী (রহ.) ও হযরত শায়খ সেলিম চিশতী (রহঃ) উভয়েই মুরাকাবার মাধ্যমে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ)-এর জন্মের বাতেনী ইঙ্গিত পেয়েছিলেন।[1]

হযরত মুজাদ্দিদ (রহঃ) কর্তৃক সমস্ত তরীকার নিসবত লাভের ঘটনা:

হযরত ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) যেভাবে এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হন, সে ঘটনাটি জাওয়াহেরে-মুজাদ্দেদীয়া গ্রন্থে এভাবে বর্ণিত আছেঃ
একদা অভ্যাস অনুযায়ী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) যখন মুরীদদের সাথে ফযরের সালাত আদায়ের পর হালকার মধ্যে মুরাকাবায় রত ছিলেন, তখন হযরত শাহ্ কামাল কায়থিলী (র.)-এর দৌহিত্র হযরত শাহ্ সেকান্দার (র.) সেখানে উপস্থিত হন এবং একটি খেরকাহ্ বা জামা হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর কাঁধের উপর রাখেন। হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) মুরাকাবা থেকে ফারেগ হয়ে হযরত শাহ্ সেকেন্দার (র.) কে দেখে তাঁর সাথে আলিঙ্গন করেন এবং সম্মানের সাথে বসতে অনুরোধ করেন। তখন হযরত শাহ্ সেকেন্দার (র.) বলেনঃ আমি আপনার কাঁধের উপর যে খেরকাটি রেখেছি, তা হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) -এর স্মৃতির পবিত্র নিদর্শন। এটা আমাদের খান্দানের কাছে দীর্ঘদিন থেকে আছে। আমার বুজর্গ পিতাসহ শাহ কামাল কাযখিলী (র.) ইনতিকালের সময় এ জুব্বাটি আমাকে দিয়ে বলেনঃ
"এটা আমানতস্বরূপ তোমার কাছে রাখ, আমি যখন এটা কাউকে দিতে বলি, তখন তাকে দিয়ে দিও।"
কিছুদিন থেকে তিনি এ জুব্বাটি আপনাকে দেওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু কাদেরীয়া খান্দানের এ অমূল্য সম্পদ হস্তান্তর করতে আমার মন চায়নি। এরপর যখন আমার বুজর্গ পিতামহ বার বার আমাকে তাগিদ দিতে থাকেন, এমন কি তাঁর নির্দেশ অমান্য করলে, তিনি আমার কামালাত ও নিসবত ছিনিয়ে নেয়ার ধমক দেন; তখন আমি বাধ্য হয়ে এ দুর্লভ আমানত আপনার খিদমতে পেশ করার জন্য নিয়ে এসেছি।
উল্লেখ্য যে, হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) সেই পবিত্র খেরকাহ্ পরিধান করে যখন তাঁর হুজরায় গমণ করেন, তখন তাঁর মনে এরূপ ভাবের উদয় হয়ঃ “যদি এই মাশায়েখে কিরাম আমাকে প্রথম থেকেই খলীফা বানাতেন এবং খেরকাহ্ প্রদান করতেন, তাহলে ভাল হতো। এ সময় হঠাৎ তিনি দেখতে পান যে, হযরত শাহ্ আব্দুল কাদের জিলানী (র.), আমীরুল মুমেনীন সাইয়েদেনা হযরত আলী (রা.)-এর সাথে সমুদয় খলিফা, এমনকি শাহ্ কামাল কায়থিলী (রহ.) সেখানে উপস্থিত। পবিত্র রূহ্গণের সে এক বিরাট জলসা! তখন বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) কে স্বীয় নিস্বত ও বাতেনী কামালাত দ্বারা ভরপুর করে দেন। পরে হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর মনে এরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, আমার তারবিয়ত বা প্রতিপালন তো নকশবন্দীয়া তরীকার মাশায়েখগণ করেছেন, কাজেই আমি তো সেই বুজর্গদের দলভুক্ত। এরূপ চিন্তা করার পরেই তিনি দেখতে পান যে, সেখানে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর রূহের সাথে হযরত আব্দুল খালেক গাজদেওয়ানী (র.) থেকে শুরু করে, হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ.) পর্যন্ত সমস্ত নক্শবন্দীয়া তরীকার মাশায়েখ তাশরীফ এনেছেন এবং হযরত বাহাউদ্দীন নকশ্বন্দ (রহ.) হযরত শাহ আব্দুল কাদের জিলানী (র)-এর নিকট উপবেশন করেছেন। এ সময় তারা পরষ্পর আলোচনা শুরু করেন। নক্শ্বন্দীয়া তরীকার মাশায়েখরা বলেনঃ
শায়েখ আহমদ সিরহিন্দী (র.) আমাদের তার বিয়তের দ্বারা কামালিয়াত হাসিল করেছে, আপনি অনর্থক তাকে আপনার দলভুক্ত করার চেষ্টা করছেন।
এর জাবাবে বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) বলেনঃ “শায়খ আহমদ (র.) প্রথমে আমাদের তরীকা থেকে ফয়েজপ্রাপ্ত হয়েছেন; কাজেই তিনি আমাদের রূহানী সন্তান।
এরূপ আলোচনা চলার সময় সেখানে চিশ্তীয়া, কুবরায়ীয়া, ও সোহরাওয়ার্দীয়া তরীকার মাশায়েখরা তাশ্রীফ আনেন এবং তাঁরা ও শায়খ আহমদ (রহ.)-কে তাদের তরীকাভুক্ত ও রূহানী সন্তান বলে দাবী করেন। কেননা. হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) প্রথম দিকে তাঁর পিতার মাধ্যমে এ সব তরীকার ফয়েজ ও নিসবত হাসিল করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, মাওলানা হাশিম কাশমী (র.) এবং মোল্লা বদরুদ্দীন (র.) তাঁদের রচিত ইতিহাসে এরূপ লিপিবদ্ধ করেছেনঃ
এ সময় সমস্ত উম্মতে মুহাম্মাদীর ওলীগণ রূহানীভাবে সিরহিন্দ শরীফে সমবেত হন। আর এ পবিত্র সময়টি ছিল হিজরী ১০১১ সনের ১১ ই শাবানের সকাল থেকে জোহরের নামাযের শেষ সময় পর্যন্ত। অবশেষে সাইয়েদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সেখানে রূহানীভাবে তাশরীফ আনেন। তখন আলোচিত বিষয়টি ফয়সালার জন্য তাঁর খিদমতে পেশ করা হয়।
তখন সব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এরূপ ফয়সালা দেনঃ
যেহেতু শায়খ আহমদ (র.)-এর তাকমিল বা পূর্ণতা লাভ ‘তরীকায়ে নক্শবন্দীয়াতে হয়েছে, সেহেতু এ তরীকারই রেওয়াজ বা প্রচলন করা হোক এবং বাকী অন্যান্য তরীকার সব নিসবত তাঁকে প্রদান করা হোক। যারফলে, শায়খ আহমদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ‘মুজাদ্দেদীয়া তরীকাহ’ সমস্ত তরীকার সার হিসেবে পরিণত হবে এবং তোমরা ও সকলে সমভাবে সওয়াবের অধিকারী হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ
যেহেতু নবী-রাসূলদের পর শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) হতে নক্শবন্দীয়া তরীকার উৎপত্তি এবং এই তরীকার মধ্যে অন্য তরীকার চাইতে দৃঢ়তার সাথে সুন্নতের অনুসরণ ও বিদ’আত বর্জনের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়, সে জন্য এর তরীকাই তাজ্দীদ বা দ্বীনের সংস্কার ও পূনরুজ্জীবনের জন্য অধিক সহায়ক।
এভাবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত তরীকার মাশায়েখরা নিজ নিজ তরীকার পূর্ণ কামালাত ও নিস্বত হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) কে প্রদান করেন। এর সাতে যুক্ত হয় দ্বিতীয় হাযার বছরের মুজাদ্দিদের খাস কামালাত ও নিস্বত তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত খাস কামালাত সমূহ।
উল্লেখ্য যে, এছাড়া এর সাথে আরো মিলিত হয় কাইউমিয়াত, ইমামত, খাজিনাতু র রহমত বা রহমতের ভান্ডার ইত্যাদি বিশেষ কামালাত। এর ফলে জন্ম নেয় এক ‘সমষ্টিভূত তরীকা’, যা পূর্ববর্তী সমস্ত ওলীদের প্রতিষ্ঠিত তরীকার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে। সব তরীকার কামালাতের আধার নতুন এই সিলসিলার নাম হলোঃ “তরীকায়ে মুজাদ্দেদীয়া” ।এ তরীকার সিলসিলাহ্‌ অনুসরণ করলে, পূর্ববর্তী সমস্ত ওলীদের সিল সিলার ফয়েজ ও বরকত হাসিল হয়ে থাকে।” (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দী ও জাওয়াহেরে মুজাদ্দেদীয়া, পৃষ্ঠা নং-৩৮।) উল্লেখ্য যে, উপরে বর্ণিত সমস্ত ঘটনা রূহানী ভাবে সংঘঠিত হয়।

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহঃ)এর মুজাদ্দেদীয়াত:

উল্লেখ্য যে, আকায়ে নামদার তাজেদারে মদীনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবী-রাসূলদের মাধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তাঁর পর দুনিয়াতে আর কোন নবী-রাসূল আসবেন না। এ জন্য আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর দ্বীনকে কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়াতে জারী রাখার বিশেষ ব্যবস্থা, তথা ‘মুজাদ্দিদ’ প্রেরণের ব্যবস্থা করেছেন। যেমন আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে প্রত্যেক শতকে একজন ‘মুজাদ্দিদ’ পাঠানোর সুসংবাদ আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন
নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেক শতকের শুরুতেই এই উম্মতের দ্বীনের সংস্কারের জন্য একজন ‘মুজাদ্দিদ’ প্রেরণ করবেন।
— আবূ দাউদ শরীফ বর্ণিত।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফিজ ইবন হাযার আস্কালানী (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক শতকের জন্য একজন মুজাদ্দিদই যথেষ্ট। অবশ্য কারো কারো মতে, একের অধিক মুজাদ্দিদ ও হতে পারে। শাহ্ ওলীউল্লাহ (রহ.) এ মতের অনুসারী।
“মুজাদ্দিদ’ সম্পর্কে এ আলোচনার পর, হযরত মু জাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সম্বন্ধে একথা উল্লেখ্য যে, তাঁর আগে সাধারণতঃ শতকের মুজাদ্দিদ প্রেরিত হতেন; কিন্তু হাজার বছরের মুজাদ্দিদ কেউ হননি। কেননা, এ হিজরী দ্বিতীয় হাযার বছর শুরু হয়নি। আর প্রথম হাযার বছরের মধ্যে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পবিত্র হাস্তিই (অস্তিত্ব) বিদ্যমান ছিল।
বস্তুতঃ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর আগে যত মুজাদ্দিদ ছিলেন, তাঁর কেউ-ই দ্বীনের সমুদয় শাখা-প্রশাখার জন্য মুজাদ্দিদ ছিলেন না; বরং তাঁর দ্বীনের বিশেষ বিশেষ শাখার মুজাদ্দিদ ছিলেন। এ কারণে একই সময় কয়েক জন মুজাদ্দিদ হতেন। যেমন কেউ ইল্মে হাদীসের মুজাদ্দিদ, কেউ ইল্মে ফিকাহের মুজাদ্দিদ এবং কেউ ইলমে মারিফাতের মুজাদ্দিদ। কিন্তু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে দ্বীনের সব শাখার উপর মুজাদ্দেদীয়াত দান করে তাঁকে এক বিশেষ মাকামে উন্নীত করেন।
এর অর্থ এই যে, পূর্ববর্তী সকল ‘মুজাদ্দিদ’ জনাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের তরফ থেকে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করেন। কিন্তু হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের তরফ থেকে সর্ব বিষয়ে পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব হাসিল করেন। এই দুই প্রকারের প্রতিনিধিত্বের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, কেননা, তাঁর পূর্ববর্তী মূজাদ্দিদগণের খিদ্মতের প্রভাব ছিল মাত্র এক শতকের জন্য। কিন্তু তাঁর মুজাদ্দেদীয়াতের প্রভাব হলো আগামী এক হাযার বছরের জন্য। উল্লেখ্য যে, কোন মুজাদ্দিদের জন্য, তাঁর মুজাদ্দিদ হওয়ার ইল্ম বা জ্ঞান থাকা জরুরী নয়। কিন্তু হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.) পূর্ণভাবে নিজ মুজাদ্দেদীয়াত সম্পর্কে ওয়াকিভহাল বা অবহিত ছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর লিখিত মাক্তূবাত শরীফের ২য় খন্ডের ৪র্থ নং মাকতূব বা চিঠিতে লিখেছেনঃ
এই ফকীর আইনুল ইয়াকীন ও হাক্কুল ইয়াকীন সম্পর্কে কী বর্ণনা করবে ? আর যদি কিছু বর্ণনা করে, তবে তা কে বুঝবে? এই মারিফাত গুলো ‘বেলায়েতের ’ বা ওলীদের সীমার বাইরে। সাধারণ ওলীরা জাহিরী আলেমদের মত বুঝতে অক্ষম। কেননা, এই ইল্ম নবূওতের প্রদীপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা দ্বিতীয় হাযার বছরের তাজ্দীদের জন্য প্রকাশ লাভ করেছে। এই ইলম ও মারিফাতগুলোর অধিকারী হলো এই দ্বিতীয় হাযারের মুজাদ্দিদ। যা থেকে জানা যায় যে, তাঁর এই ‘ইল্ম ও মারিফাত জাত, সিফাত, হাল, ওয়াজদ, তাজাল্লীয়াত ও জযবা ইত্যাদি বিষয়ে সম্পর্ক রাখে .......।
— মাকতুবাত শরীফ, ২য় খন্ড, মাকতুব নংঃ ৪
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) আরো লিখেছেনঃ
জেনে রাখ যে, প্রত্যেক একশ’ বছর পর একজন মুজাদ্দিদ চলে গেছেন। আর শত ও হাযার বছরের মুজাদ্দিদ এক নয়। শত ও হাযারের মধ্যে যে পরিমান প্রভেদ, ঐ পরিমাণ, বরং তার চেয়েও অধিক প্রভেদ উভয় মুজাদ্দিদের মধ্যে বিদ্যমান। দ্বিতীয় হাযার বছরের মুজাদ্দিদ ঐ ব্যক্তি, যার মাধ্যমে ঐ সময় কুত’ব, আওতাদ, আব্দাল, নুজাবা ও নুকাবা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও উম্মতের নিকট ফয়েজ পৌঁছে।
মুজাদ্দিদের সব চেয়ে বড় পরিচয় হলো তাঁর কাজকর্ম, যা দ্বারা দ্বীনের হিফাযত, সুন্নত প্রতিষ্ঠা ও বিদ’আত দূর হয়। মুজাদ্দিদের মূল কাজ হলো বিদ্’আত রহিত করা, উম্মতের ইস্লাহ বা সংশোধন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা এবং এই বিশেষ কর্তব্য পালনে কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতার পরোয়া না করা। তাঁর কাজ কর্ম সর্ব সাধারণের নিকট ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে। তিনি ও তাঁর অনুসারীগণ বিদআতি, বাতিলপন্থী ও দুনিয়াদার আলেমদের জন্য “লা হাওলা অলা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহের’ প্রভাব রাখেন। তিনি ও তাঁর মুরীদগণ বাতিল পন্থীদের জন্য আকাশের বজ্রপাত ও ইয়ামনী তরবারীর ন্যায়। কেননা, তারা বাতিল পন্থীদের সমূলে বিনাশ ও জাহেলী যুগের কুসংস্কার ও আকীদার উচ্ছেদ সাধন কারী হন।
— মাকতুবাত শরীফ, ২য় খন্ড, মাকতুব নংঃ ৪
উল্লেখ্য যে, হিন্দুস্থানে বাদশাহ আকবর [1] ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে দ্বীন-ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং ধর্মের মধ্যে অনেক বিদআত অনুপ্রবেশ করে। এ সময় হিন্তুস্থানে দ্বিতীয় হাজার বছরের মুজাদ্দিদরূপে হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.)-এর আগমণ আল্লাহ্ তায়ালার কুদরতের অন্যতম নিদর্শন। তিনি আল্লাহর অসীম রহমতে দ্বীন-ইসলামের পূর্ণ হিফাযত করে তাঁর বিপ্লবী সংস্কারের মাধ্যমে দ্বীনের তাজ্দীদের দায়িত্ব পালন করেন। ‘জামেউদ্দোরার’ নামক কিতাবে হাদীস বর্ণিত আছে যে, হযরত নবী করীম (স.) ইরশাদ করেছেনঃ
হিজরী এগার শতকের শুরুতে আল্লাহ্ তায়ালা এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি হবেন এক বিশাল নূর। তাঁর নাম আমার নামের অনুরূপ হবে। দু ’জন অত্যাচারী বাদশার মধ্যে তাঁর আবির্ভাব হবে এবং তাঁর শাফাআতে অংখ্য ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে।
উল্লেখিত হাদীসটি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কারণ তাঁর পবিত্র নাম ছিল শায়খ আহমদ (রহ.), এবং তিনি হিজরী এগার শতকের শুরুতে আকবর ও জাহাঙ্গীর এই দুই অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী সম্রাটের যুগে দ্বিতীয় হাযার বছরের মুজাদ্দিদরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন।
যার অর্থ হলো আল্লাহ্ ছাড়া ইলাহ্ নেই এবং আকবর হলো আল্লাহর খলীফা। এর ফলে আকবরের যুগে হযরত মুহাম্মদ (স.) কে রাসূল বলে স্বীকার করা রাষ্ট্রীয় বিধানে দন্ডনীয় অপরাধ বলে সাব্যস্ত হয়ে। উল্লেখ্য যে, ‘রওজাতুল কাইউমিয়া’ নামক গ্রন্থেও এ হাদীসটি বর্ণিত আছে[2] ।
এ সম্পর্কে আরো কিছু বক্তব্যঃ
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বের ওলীগণের উন্নতি বেলায়েতের স্তর পর্যন্ত ছিল। হযরত রাসূরে করীম (স.)-এর মধ্যে ছিল যেমন নবুওতের কামালাত, তেমনি ছিল বেলায়েতের কামালাত।’ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সর্বপ্রথম ‘বেলায়েতের’ উপরে এবং নবূওতের’ নীচে ‘কাইউমিয়াতের’ মাকামের বর্ণনা দেন এবং বলেনঃ তাঁর মাকামগত উন্নতি চার খলিফার ন্যায় বেলায়েত হতে নবুওত পর্যন্ত হয়েছিল এবং বেলায়েতের উপরে কাইউমিয়াতের স্তর তাঁর জন্য খাস করে দেয়া হয়। তাই তিনি উম্মতে মুহাম্মদীর প্রথম কাইউমরূপে আখ্যায়িত হন।
তাঁর বংশের আরো তিনজন কাইউম হলেনঃ
দ্বিতীয় কাইউম ছিলেন খাজা মুহাম্মাদ মাসুম
তৃতীয় কাইউম ছিলেন খাজা মুহাম্মদ নকশবন্দ (র.) এবং
চতুর্থ কাইউম ছিলেন খাজা মুহাম্মদ জুবাইর (র.)।
উল্লেখ্য যে কাইউম যে ব্যক্তি হয়, যাঁর খামিরের সাথে নবী করীম (স.)-এর খামিরের পরিত্যক্ত অংশ মিশ্রিত থাকে। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বলেছেনঃ
আমার খামির হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পরিত্যক্ত খামিরের অংশ হতে গ্রহণ করা হয়েছে।
— মাকতুবাত শরীফ, ৩য় খন্ড, মাকতূব নং- ১০০
‘ইমামে রাব্বানী’ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর ‘লকব’ বা উপাধি। আর ইমামতের পদ নবূওতের নূরের অংশ। ইমামের ফিত্রত বা স্বভাব নবী (আ.) গণের ফিতরতে নিকটবর্তী। এ ছাড়া তাঁকে ‘খাজিনাতুর রহমত’ বা রহমতের ভান্ডার উপধিতে ভূষিত করা হয়। [3] বস্তুতঃ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর তরিকাই সর্বশ্রেষ্ঠ তরীকা। শেষ যামানায় যখন ইমাম মেহেদি (আ.) আসবেন, তখন তিনি তাঁরই তরীকার খলীফাগণের অন্তর্ভূক্ত হবেন। তিনি ছিলেন একই সাথে কুতুবে মাদার ও ‘কুতুবে ইরশাদ’। পরবর্তীতে তারই সিলসিলায় ‘কুতুবে মাদার’ ও ‘কুতুবে ইরশাদ’ হবেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর তরীকাভুক্ত মুরীদগণের পরিচয় তাঁকে জানানো হয়েছে।
তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে যে, তিনি মাধ্যম ব্যতীত আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন। তিনি ‘ইলমে লাদুন্নী’ বা আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত বিশেষ ইলেমের অধিকারী ছিলেন। তাঁর নিকট আল্ কুরআনের হরুফে মুকাত্তিয়াতের’ ভেদ সমূহ প্রকাশ করা হয়। হযরত আলী (রা.) তাঁকে আসমানের ইলম শিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং হযরত খিজির (আ.) ও ইলিয়াস (আ.) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে হায়াত ও মউতের গুপ্ত রহস্য জানিয়ে দেন। তাঁকে অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাসমূহ জানানো হয়েছিল।

হাকীকতে কাবা'র সিরহিন্দ শরীফে আগমণ:

উল্লেখ্য যে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) হজ্জে বায়তুল্লাহ’ আদায় করতে পারেননি। আল্লাহর তায়ালার নির্দেশে ‘হাকীকতে কা’বা সিরহিন্দ শরীফে যিয়ারতের জন্য এসেছিল। তখন তাঁর খানকা শরীফের কূপগুলি জমজমের পানিতে ভরে গিয়েছিল। তাঁর খানকা শরীফের যমীনকে জান্নাতী বা বেহেশতী যমীনের মর্যাদা দেওয়া হয়। মসজিদের উত্তর দিকে উক্ত যমীন এবং ‘আবে জমজমের’ বা জমজম পানির উৎস এখন ও বিদ্যমান আছে!
প্রকাশ থাকে যে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর ‘রওজা মুবারক’ যেখানে অবস্থিত, সেখানে মদীনা মনওয়ারার রাসূলে পাক (স.)-এর ‘রওজা শরীফের’ কিছু মাটি আছে। এই মাটি নূহ (আ.)-এর তুফানের সময় মদীনা মনওয়ারা হতে এখানে এসেছিল। সার কথা এই যে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর কামালাত ও পরিপূর্ণ মর্যাদার কথা বর্ণনা করা মোটে ও সম্ভব নয়। কারণ, তিনি তা নিজেই গোপন রাখেন।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) আরো বলেনঃ
..... এই ফকীর দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখছে যে নবী করীম (স.)-এর দ্বীনের দাওয়াত পেঁ․ছেনি, এমন কোন জায়গা পৃথিবীতে নেই। এমন কি ইয়াজুজ ও মাজুজদের কাছে এ দাওয়াত পৌঁছে গেছে। আগের উম্মতদের প্রতি খেয়াল করলে দেখা যায়, নবী-রাসূল প্রেরিত হননি, এমন কোন স্থান নেই। এমন কি সুদূর হিন্দুস্তানেও নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা হিন্দুদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে আমি হিন্দুস্তানের সেই শহর গুলি নির্দিষ্ট করে দিতে পারি।
সিরহিন্দ শরীফের পূর্ব দিকে ‘বরছ’ নামক স্থানে কয়েকজন নবীর মাযার আছে। হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.) কাশ্ফ মারফত এখবর অবগত হয়েছিলেন। সিরহিন্দ শরীফ থেকে এ স্থানের দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার।
  • মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (রহঃ) জীবন ও কর্ম (লেখকঃ ডক্টর আ. ফ. ম. আবু বকর সিদ্দীক)
 
Top