কেউ কেউ বলে যে, আমরা নাকি শানে মুস্তফার ﷺ কথা বেশি বলি। আরে ভাই, কেনই বা বলবো না তাঁর কথা!! বুখারী মুসলিমে তো আছে যে, কবরে শুধু এটাই জিজ্ঞাসা করা হবে যে, এ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহাম্মদ ﷺ সম্পর্কে তুমি কী বলতে বা কি ধারণা পোষণ করতে?

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তার সাথীরা এতটুকু মাত্র দূরে যায় যে, সে তখনও তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়। এ সময় দু’জন ফেরেশতা তার নিকট এসে তাকে বসান এবং তাঁরা বলেন, এ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহাম্মদ ﷺ সম্পর্কে তুমি কী বলতে বা কি ধারণা পোষণ করতে? তখন মু’মিন ব্যক্তি বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহ্‌র বান্দা এবং তাঁর রাসূল। তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থান স্থলটির দিকে নজর কর, আল্লাহ্ তোমাকে তার বদলে জান্নাতের একটি অবস্থান স্থল দান করেছেন। তখন সে দু’টি স্থলের দিকেই দৃষ্টি করে দেখবে। কাতাদাহ (রাঃ) বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে ব্যক্তির জন্য তাঁর ক্ববর প্রশস্ত করে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি (কাতাদাহ রাঃ) পুনরায় আনাস (রাঃ)-এঁর হাদীসের বর্ণনায় ফিরে আসেন। তিনি [(আনাস) (রাঃ)] বলেন, আর মুনাফিক বা কাফির ব্যক্তিকেও প্রশ্ন করা হবে তুমি এ ব্যক্তি (ﷺ) সম্পর্কে কী বলতে বা কি ধারণা পোষণ করতে? সে উত্তরে বলবে, আমি জানি না। লোকেরা যা বলত আমি তা-ই বললাম। তখন তাকে বলা হবে, তুমি না নিজে জেনেছ, না পড়েছ/ শিখেছ। আর তাকে লোহার মুগুর দ্বারা এমনভাবে আঘাত করা হবে, যার ফলে সে এমন বিকট চিৎকার করে উঠবে যে, দু’ জাতি (মানুষ ও জ্বিন) ছাড়া তার আশপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে। (সহিহ বুখারী ১৩৭৪, ১৩৩৮)

এছাড়াও

আম্মাজান ‘আয়িশাহ্ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, এমন কোন জিনিস নেই যা আমাকে দেখানো হয়নি আমি এ জায়গা হতে সব কিছুই দেখেছি। এমন কি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখলাম (সুবহান আল্লাহ)। আমার নিকট ওয়াহী পাঠানো হয়েছে যে, তোমাদেরকে কবরে মাসীহ্ দাজ্জালের ফিতনার ন্যায় অথবা তিনি বলেছেন, সে ফেতনার কাছাকাছি ফিতনায় ফেলা হবে। (অর্থাৎ তোমাদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হবে) তোমাদের প্রত্যেককে (কবরে) উঠানো এবং প্রশ্ন করা হবে, এ ব্যক্তি (রাসূলুল্লাহ্ ﷺ) সম্পর্কে তুমি কী জান? তখন মু’মিন অথবা মুকিন (নবী ﷺ এ দু’টোর মধ্যে কোন শব্দটি বলেছিলেন এ ব্যাপারে বর্ণনাকারী হিশামের মনে সন্দেহ রয়েছে) বলবে, তিনি হলেন, আল্লাহর রাসূল, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ , তিনি আমাদের নিকট সুস্পষ্ট দলীল (মু'জিযা) ও হিদায়াত নিয়ে এসেছিলেন। অতঃপর আমরা ঈমান এনেছি, তাঁর আহবানে সাড়া দিয়েছি, তাঁর আনুগত্য করেছি এবং তাঁকে সত্য বলে গ্রহণ করেছি। তখন তাঁকে বলা হবে, তুমি ঘুমিয়ে থাক, যেহেতু তুমি নেককার। তুমি যে তাঁর প্রতি ঈমান এনেছ তা আমরা অবশ্যই জানতাম।

আর মুনাফিক বা মুরতাব (সন্দেহ পোষণকারী) (এ দু’টোর মধ্যে কোন্ শব্দটি বলেছিলেন এ সম্পর্কে বর্ণনাকারী হিশামের মনে সন্দেহ রয়েছে)-কেও প্রশ্ন করা হবে যে, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী জান? উত্তরে সে বলবে, আমি কিছুই জানি না। অবশ্য মানুষকে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছি, আমিও তাই বলতাম। হিশাম (রহ.) বলেন, ফাতিমা (রাঃ) আমার নিকট যা বলেছেন, তা সবটুকু আমি উত্তমরূপে স্মরণ রেখেছি। তবে তিনি ওদের প্রতি যে কঠোরতা করা হবে তাও উল্লেখ করেছেন। (সহিহ বুখারী ৯২২)

আরে দেখুনঃ সহিহ বুখারী ৮৬, ১৮৪, ৭২৮৭; সবগুলোতেই একটিমাত্র প্রশ্নের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বুখারী মুসলিমে না আসা সত্ত্বেও আমরা সকলে বিশ্বাস করি যে, তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কি? প্রশ্নগুলোও করা হবে যা আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত হয়েছে।

কবরের প্রশ্নগুলো স্পষ্টতই ঈমান-আকীদা তথা বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। তাই আমলের পাশাপাশি ঈমানের বিষয়েও সতর্ক থাকা চায়। অন্যথায় আমল যে, মূল্যহীন। ঈমান বাঁচাতে শানে রিসালাতে যারা বেয়াদবী করে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকা চাই অন্যথায় কবরের প্রশ্নে আপনিও ফেঁসে যেতে পারেন। শানে রিসালাতে বেয়াদবী-কারীদের তাওবারও সুযোগ হবে না। এরই ইঙ্গিত পাওয়া যায় সূরা হুজরাতের ২ নম্বর আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের সকল কাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও (টের) করতে পারবে না। সূরা হুজরাতের ২-৩ নং আয়াতের তাফসীরে, তাফসীরে জালালাইনের হাশিয়াতে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল ﷺ এঁর প্রতি আদব প্রদর্শন ও তাকওয়া (আল্লাহভীতি) পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাদের অন্তরে যত বেশি খোদাভীতি রয়েছে তারা নবী করীম ﷺ এঁর প্রতি ততবেশি আদব প্রদর্শন করবে, তাঁকে ভালবাসবে, তাঁর অনুগত থাকবে। পক্ষান্তরে যাদের অন্তরে খোদাভীতির বালাই নেই তারা যে, নবী করীম ﷺ এঁর প্রতি শুধু অশ্রদ্ধাই পোষণ করবে তা-ই নয়, তাঁকে অপমানিত করতেও কুন্ঠিত হবে না। নবী করীম ﷺ এঁর সাথে বেয়াদবী করা অন্তরে খোদাভীতির অনুপস্থিতিকেই প্রমাণিত করে, যা মূলত কুফরীরই লক্ষণ। এছাড়াও সেখানে এই আয়াতখানাও আনা হয়েছে, "আর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।" (সূরা হজ্জ্ব, আয়াত ৩২)

যে যাকে ভালবাসে সে তার প্রশংসা, আলোচনা করতে ভালবাসে। মানুষের মুখে তার প্রশংসা, আলোচনা শুনতেও তার ভাল লাগে। আমার আল্লাহ বলছেন,

"(হে নবী) এবং আমি (আল্লাহ) আপনার জন্য আপনার স্মরণকে/ আলোচনাকে সমুন্নত করেছি।" (সূরা ইনশিরাহঃ ৪)

কালিমা, আযান, নামাজ, কুরআন সবকিছুতেই তাঁর নাম। তাঁর আলোচনা। তাঁর জিকির জড়িয়ে দিলেন।

আম্মাজান আয়িশাহ সিদ্দিকা রা. কে জিজ্ঞেস করা হল, "হে উম্মুল মু‘মিনীন! আমাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর চরিত্র সম্বন্ধে বলুন। তিনি বললেন, আপনি কি কুরআন পড়েন না? গোটা কুরআনই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর চরিত্র।) (সুনান আবূ দাউদ ১৩৪২, সহিহ মুসলিম ১৬২৪)

মহান আল্লাহ যাকে প্রিয় হাবিব (বন্ধু) বানিয়েছেন সর্বত্রই তার আলোচনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আপনি যাকে ভালবাসেন, তার আলোচনা করেন তো! তার আলোচনা শুনতে ভালো লাগে তো! যে যাকে ভালবাসবে, সে তার সাথেই থাকবে। জানেন তো!

আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ) এঁর জন্য মসজিদে একটি মিম্বার স্থাপন করেছিলেন যেন তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর প্রশংসার কবিতা পাঠ করেন অথবা তিনি বলেছেন, যেন তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর পক্ষ হতে কাফিরদের নিন্দাবাদের উত্তর দেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ রূহুল কুদস [জিবরীল (আঃ)] দ্বারা হাসসানকে সাহায্য করেন যতক্ষণ সে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রশংসা করবে কিংবা কাফিরদের নিন্দার উত্তর দেবে।

(শামায়েলে তিরমিযী, সুনান আবূ দাউদ ৫০১৫)

ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘উমর (রাঃ) লোকদেরকে আল্লাহর বাণীঃ
إِذَاجَآءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ

অর্থঃ এবং আপনি লোকদেরকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। (সূরা নাসর ১১০/২)

এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, এ আয়াতে শহর এবং প্রাসাদসমূহের বিজয় গাঁথা বর্ণিত হয়েছে। এ কথা শুনে ‘উমর (রাঃ) বললেন, হে ইবনে ‘আব্বাস রা.! আপনি কী বলেন? তিনি বললেন, এ আয়াতে ওফাত অথবা মুহাম্মাদ ﷺ এঁর দৃষ্টান্ত এবং তাঁর শান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী ৪৯৬৯)

আহ! তাঁর প্রেমিকরা বুঝি এভাবেই সবজায়গাতে তাঁর শানই খুঁজে পায়।

কবি নজরুল লিখলেন,

নবী মোর পরশ মনি
নবী মোর সোনার খনি
নবী নাম জপে যে জন সেইতো দোজাহানের ধনী।।

ঐ নামে সুর ধরিয়া
পাখী যায় গান করিয়া।
ঐ নামে মজনু হইলো
মাওলা আমার কাদের গনি।।

ওই নামে মধু মাখা
ওই নামে যাদু রাখা।
ঐ নামে আকুল হয়ে ফুল ফোটে সোনার বরণী ।।

নিদানে আখেরাতে
ত্বরাইতে পুল সিরাতে
কান্ডারী হইয়া নবী পার করিবেন সেই তরণী।

আপনিও আবার ঐ কাটমোল্লার মত, নবীর নাম জপা মানে মুহাম্মদ মুহাম্মদ বলা বুঝিয়েন না,

নামাজ কালাম কুরআন দরুদ সব জায়গায় যেহেতু তাঁর নাম আছে, সেগুলো আদায় করলে তাঁর নামও তো জপা হয়, তাঁর আলোচনা করা হয়, তাঁকে স্মরণ করা হয়। এছাড়াও তাঁর নাম না নিলে (দরুদ না পড়লে) তো দোয়াও কবুল হয়না, আসমান ও জমিনের মাঝে ঝুলে থাকে বলে নবীজি ﷺ বলেছেন। তাঁর নাম জপা মানে তাঁর স্মরণে সময় কাটানো, তাঁর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ ঘটানো। আমি বলি, তাই তো নজরুল লিখলেন, নবী নাম জপে যে জন সেইতো দোজাহানের ধনী।।

আপনার তৈরি করা কোন জিনিস বা লেখা কোন বইয়ের প্রশংসা করা মানে আপনার প্রশংসা নয় কি?? রাসূলুল্লাহ ﷺ হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালার সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা-ই যাঁর আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, যার আলোচনা দিয়ে কুরআনুল কারীমকে সাজিয়েছেন। তাহলে আল্লাহ'র সেই সৃষ্টির প্রশংসা করলে আল্লাহ তায়ালা কি খুশি হবেন না!! তাঁর সৃষ্টির প্রশংসা কি তাঁর মাহাত্ম্যকেও প্রকাশ করে না!! (সৃষ্টির যদি এত মর্যাদা হয়, স্রষ্টার মর্যাদা আরো কত মহান হবে!)
 
Top