সেমা’র বর্ণনা-


❏ প্রশ্ন-১২৭ঃ সেমা তথা ধর্ম-সঙ্গীত সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের অভিমত কি এবং এর ফয়সালার পদ্ধতি কি? বর্ণনা কর।


✍ উত্তরঃ هوالمستعان সুর সংযোজন করে সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত পরিবেশন করার মাসআলা প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াত ও পবিত্র হাদীস শরীফ পরস্পর বিরোধী ও বৈপরীত্য অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,


وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ . 


‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ 

168. সূরা লোকমান, আয়াতঃ ৬।


এই পবিত্র আয়াত সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে।

হযরত আবু উমামা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)    ইরশাদ করেন, যখন কোন ব্যক্তি সুর ধ্বনি দিয়ে আওয়াজ উঁচু করে, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তার কাঁধের ওপর দু’জন শয়তান পাঠিয়ে দেন যারা তার বক্ষের ওপর গোড়ালী দ্বারা আঘাত করে, যাতে সে সুর সঙ্গীত থেকে ফিরে আসে। 

169. তাবরানী রচিত আল-কবীর।


উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা গায়িকা রমণী, তার ক্রয়ক্রিয়া, উপার্জন এবং শিক্ষা বিষয়কে হারাম করে দিয়েছেন। 

170. তাবরানী রচিত আওসত।


হযরত জাবের (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)    ইরশাদ করেন, গান বা সুর সঙ্গীত মানুষের অন্তরে পাপের জন্ম দেয়, যেমনিভাবে পানি ক্ষেত উৎপাদন করে। 

171. শু‘আবুল ঈমান।


গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার ব্যাপারে আরো অনেক দলিল রয়েছে। 

এখন সেমা বা সুর-সঙ্গীত মুবাহ হওয়ার দলিলসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ 

উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ সেমা, গান, সুর-সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এমনও কতিপয় হাদীস শরীফ রয়েছে যা এটি জায়েয ও মুবাহ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে তাশরিফ আনলেন, সে সময় দু’জন বালিকা আমার নিকট গান গাইতেছিল। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে।)

অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) তাঁর নিকট আসলেন। এমন সময় দু’জন বালিকা আমার নিকট দফ্ বা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিল। আর রাসূলুল্লাহ   তাঁর কাপড় দ্বারা মুখমন্ডল মুবারক ঢেকে রাখেন। তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضى الله تعالي عنه) গায়িকা বালিকাদেরকে নিষেধ করেন। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেহারা মুবারক হতে কাপড় সরিয়ে বললেন, আবু বকর তাদেরকে ছেড়ে দাও। যেহেতু আজ খুশির দিন।

‘সবিলুর রাশাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, যখন রাসূলে পাক   মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ নিয়ে বনু নাজ্জার গোত্রে আরাম করছিলেন। তখন উক্ত গোত্রের মেয়েরা গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন


نحن جوار من بنى نجّار ۞  وحبذا محمد من جار .


‘আমরা হলাম বনি নাজ্জার গোত্রের রমণি। কি যে মুবারক ও সৌভাগ্যের কথা যে, আল্লাহ'র নবী মুহাম্মদ (ﷺ) হয়েছেন আমাদের প্রতিবেশী।’


ইমাম বায়হাকী (رحمه الله تعالي ) ‘দলাইলুন্ নবুয়ত’ গ্রন্থে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنه) হতে হাদীস বর্ণনা করেন। যা হুযূর(ﷺ)তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় নাজ্জার গোত্রের রমণীরা নিম্নোক্ত কবিতা ছন্দাকারে পাঠ করার বর্ণনা রয়েছে। 


طلع البدر علينا ۞ من ثنيات الوداع

وجب الشكر علينا ۞ ما دعى لله داع .


‘সনইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।’

ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) তাঁর কবিতা চর্চা, দফ বাজানো এবং সুরেলা কন্ঠ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। 

মুহাম্মদ বিন হাতেব (رضى الله تعالي عنه) হতে বর্ণিত আছে যে,  রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)    ইরশাদ করেছেন, হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিবাহে সবাই দফ্ বাজাবে এবং গান-বাজনা করবে। 

172. জামে‘ তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফ।


হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضى الله تعالي عنها) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলে পাক(ﷺ)ইরশাদ করেছেন, উক্ত বিবাহের প্রচার কর। আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব ফারূকে আযম (رضى الله تعالي عنه) একদা এক নতুন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ঢোলের আওয়াজ শুনে জিজ্ঞেস করলেন যে, এখানে কি হচ্ছে কিসের শব্দ? উত্তরে বলা হলো, খৎনার উৎসব। তখন তিনি নিরবতা অবলম্বন করেন এবং নিষেধও করেন নি।

ফয়সালাঃ এখন যেহেতু সেমা বা সুর-সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে হালাল-হারাম নিয়ে বিপরীতমুখী দলিল এসেছে। তাই সৈয়্যদুনা ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) সতর্কতামূলক এটাকে হারাম বলেছেন। যেমন, উসূলে ফিকহের কায়েদা বা মূলনীতি হচ্ছে, দলিল পরস্পর বিপরীতমুখী হলে, তখন হারামকে হালালের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। এমনকি তিনি ওয়ালিমাতেও গান জায়েয রাখেন নি। 

173. হেদায়া-মাকরূহ অধ্যায়।


যে ব্যক্তি ওয়ালিমা কিংবা অন্য কোন যিয়াফতে আমন্ত্রিত হয়ে দাওয়াতে গিয়ে সেখানে গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধূলা দেখতে পান। তখন সেখানে বসে তার খাবার গ্রহণ করাতে কোন অসুবিধা নেই।

ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) বলেন, আমি নিজেই এরকম অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম, তবে আমি ধৈর্যধারণ করেছিলাম। হিদায়া গ্রন্থকার বলেন, উক্ত মাসআলা একথা প্রমাণ করে যে, খেলাধূলার সকল সামগ্রী হারাম। এমনকি বাঁশি বাজিয়ে গান করাও হারাম। এজন্য ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمه الله تعالي ) ‘নিজে লিপ্ত হয়েছি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেননা ‘লিপ্ত হওয়া’ শব্দটি হারাম বিষয়ে ব্যবহার করা হয়।

হযরত ইমাম শাফেয়ী (رحمه الله تعالي ) সুর দিয়ে গান করার ওই সকল হাদীসকে নিষিদ্ধ বলেছেন, যা শুধু গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধূলার আনন্দ উপভোগ করার নিমিত্তে করা হয় অথবা যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফিৎনা-ফাসাদের আশঙ্কা থাকে। আর যে সকল গান-বাজনা সৎ উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। যেমন, বিবাহের প্রচার করা কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন বিষয়ের ওপর করা হয়, তাঁর মতে এটা মুবাহ। হানাফী মাযহাবের কিতাবসমূহেও এমন বর্ণনা বিদ্যমান আছে। অতএব হিদায়া গ্রন্থের ‘কিতাবুল গজব’ অধ্যায়ে লিখা আছে যে, গাজীদের লুন্ঠিত মাল এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে দফ বা সুরেলা কন্ঠে গান-বাজনা করা মুবাহ। এগুলো নষ্ট করাতে দায়িত্বশীলতাকে আবশ্যক করে।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) ‘ইহইয়াউল উলূম’ শরীফে বলেছেন যে, গান ও বাদ্যযন্ত্র হারাম সম্পর্কে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা ওই সকল গান-বাজনার ওপর প্রযোজ্য হবে, যা কেবল কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থের নিমিত্তে এবং রূপক ইশ্ক প্রেম দ্বারা শয়তানী চাহিদা ও উদ্দেশ্য পূরণে করা হয়। কিন্তু যে গান ও বাদ্যযন্ত্র আল্লাহর মুহাব্বত সৃষ্টি করে, তা সত্তাগতভাবে বৈধ ও মুবাহ। যখন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান-বাজনা দ্বারা আনন্দ উৎসব বৃদ্ধি পায়; এ রকম আনন্দ উপভোগ করা যদি মুবাহ ও বৈধ হয়, তাহলে গান-বাজনা করাও মুবাহ ও বৈধ।

সুতরাং ঈদের দিন, বিবাহের দিন, প্রিয়জনের আগমনের দিন, ওয়ালিমার দাওয়াতে, সন্তান জন্ম লাভের উৎসবে, আকীকাহ, সুন্নাতে খাৎনা এবং কোরআন মজিদ হিফজ সমাপ্ত হওয়ার দিন ইত্যাদি খুশির দিনে গান-বাজনা ও খেলাধূলা করা বৈধ ও মুবাহ। 

‘খযানাহ্’ ও ‘কাফি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি নিষিদ্ধের ভিত্তি শুধুমাত্র খেলাধূলার সাথে সীমাবদ্ধ। আর গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে করা হয় যেমন, বিবাহের সময়, ওয়ালিমায়, মুজাহিদদের বিজয়ে, সৈন্যবাহিনীর আগমনে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দা সুফি দর্শনে অনুসারীদের আত্মার কোমলতা সৃষ্টির লক্ষে যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সব ধরনের নিয়ম-পদ্ধতি অবলম্বন করা হানাফি মাযহাব মতে হারাম নয়।

ইম্সা‘ কিতাবে উল্লেখ আছে, গান ও ধর্ম-সঙ্গীত শুনাতে অন্তরের কোমলতা, আল্লাহভীতি এবং আল্লাহর দিদার লাভের আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার উদ্ভব হয় এবং আল্লাহ'র গজব ও আযাবের ভীতি সৃষ্টি হয়। অতএব যে কাজের ফলাফল ইবাদতই হয়। যদি গান-বাজনা শুনাতে অবস্থা যদি এরকমই হয়, তাহলে সেখানে খেলাধূলা ও অনর্থক কাজের স্থানই বা কোথায়?

আলিমকুল শিরোমণি অলিকুল সরদার হযরত সৈয়দ শায়খ সিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمه الله تعالي ) ‘আওয়ারিফুল মু‘আরিফ’ শরীফে বলেছেন, 


السماع يستحب الرحمة من الله الكريم 


‘সেমা আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত নিয়ে আসে।’


হযরত খাজায়ে খাজেগান খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (رحمه الله تعالي ) সেমা সম্পর্কে বলেন যে,  


ونہ انكار ميكنم ونہ ايں كار ميكنم 


অর্থাৎ ‘আমি এটাকে অস্বীকারও করিনা এবং আমি এটা নিজেও করি না।’


যেহেতু তার তরিকার ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে সুন্নাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, বিধায় তিনি তা করতেন না। নিঃসন্দেহে গান শ্রবণ করা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)এবং সাহাবা-ই কিরামের নিয়ম ও রীতি ছিল না। তাই তিনি নিষেধ করতে গিয়ে বলেন, نہ ايں كار ميكنم অর্থাৎ- ‘আমি এ কাজ বা আমল করি না’। আর যেহেতু তাঁর নিকট সেমা হারাম হওয়ার প্রমাণ ছিল না, তাই বলেছেন, نہ انكار ميكنم অর্থাৎ- ‘আমি অস্বীকারও করি না’। যদি তিনি হারাম মনে করতেন তাহলে অবশ্যই অস্বীকার করতেন। অতএব বলা যায় বিবাহ প্রচারকল্পে যদি দফ্ বাজানো হালাল বা মুস্তাহাব হয়ে থাকে, তাহলে ঢোল, সঁাতারা ও বাঁশী ইত্যাদি বাজানো দফের স্থলে তা হলে পার্থক্যটা কি? খেলাধূলা ও অনর্থক পাপাচারের ক্ষেত্রে সব কিছুই হারাম। আর সৎ উদ্দেশ্য ও পূণ্য কাজের জন্য সবই জায়েয।

বিবাহ-শাদীর প্রচার সকল কিছু দ্বারা করা যায়। দফ্ ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য করা এটা অযৌক্তিক কথা। বাদ্য-বাজনা ও গীত-বাঁশী বাজানো নিষিদ্ধ মেনে নিলেও তা অকাট্য দলিল দ্বারা হারাম নয়। কেননা কেবল অকাট্য দলিল কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াত, মুতাওয়াতির হাদীস এবং ইজমা-ই উম্মত দ্বারা প্রমাণিত হয়।

যদি বলা হয় যে, সেমা বা বাদ্যযন্ত্র সহকারে ধর্ম-সঙ্গীত পরিবেশন করা মুবাহ বা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে এটির আহ্ল বা উপযুক্ত হওয়া শর্ত। তবে এটা সত্য। কিন্তু বর্তমান যুগের অধিকাংশ দরবেশ লোক এটির আহ্ল বা উপযুক্ত নয়, বরং তারা বানোয়াট ও নামে মাত্র লোক দেখানো ওয়াজদ্ বা উম্মত্ততা প্রকাশ করে।

তার জবাব হচ্ছে, এমন কথা বলা উচিত হবে না যে, বর্তমান যুগে এমন লোক কেউ নেই, যারা এর উপযুক্ত। কেননা রাসূলুল্লাহ   ইরশাদ করেছেন, 


لا يزال من أمتي قائمة 


আমার উম্মতের মধ্যে বরাবরই এমন একটি দল প্রত্যেক যুগে বিদ্যমান থাকবেন যারা আল্লাহ'র হুকুমের ওপর অটল ও অবিচল থাকবে। তাদেরকে পরিত্যাগকারী কিংবা বিরোধীতাকারী ব্যক্তি তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তিনি   আরো বলেন, 


مثل امتى كمثل المطر لايدرى اوّلها او اخرها . 


‘আমার উম্মতের উদাহরণ ওই বৃষ্টি বারিধারা ন্যায়, যা সম্পর্কে ধারণা করা যায় না যে, এটির প্রথম উত্তম, না শেষাংশ উত্তম।’ 


জেনে রাখা আবশ্যক যে, আহলে ওয়াজদ বা খোদা প্রেমে আসক্তি তিন প্রকারঃ

প্রথমতঃ আহলে কামাল বা পূর্ণ উৎকর্ষতার অধিকারী দল। যাদের অন্তরাত্মায় আল্লাহ্ প্রেমের অযীফা ও যিকিরের সৃষ্টি হয় এবং যা তাদেরকে ইচ্ছাশক্তি বহির্ভূত ও ক্ষমতাহীন করে দেয়। এঁরা হচ্ছেন আল্লাহর দল। এঁদের অস্বীকার করা অবশ্যই দ্বীনের ক্ষতি সাধনকে আবশ্যক করে। 


দ্বিতীয়তঃ ওই সকল লোক যারা উত্তম অবস্থা সৃষ্টির লক্ষে গান-বাজনা ও ধর্ম-সঙ্গীত শুনেন এবং চেষ্টা করেন যে, উক্ত কর্মপন্থা অবলম্বন করে খোদা প্রেমের উত্তম অবস্থা অর্জন করা যায়। এটাও প্রশংসিত দল।

তৃতীয়তঃ ওই সকল লোক যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আবেগাপ্লুত ও ভাবোদ্দীপনার ভাব দেখায়, যাতে লোকেরা তাকে আহলে কামাল বা পূর্ণ উৎকর্ষতা অর্জনকারী লোক মনে করে। এরা হলেন ফাসিক, বদকার ও বিদ‘আতী।

ইমাম গাজ্জালী (رحمه الله تعالي ) বলেছেন, বানোয়াট ও লোক দেখানো ওয়াজদ্ বা ভাবোদ্দীপনা ভাব দেখানো এক প্রকার মন্দ ও নিন্দনীয়। আর তা হচ্ছে, বানোয়াটির মাধ্যমে লোক দেখানো অতীব ভদ্র ও প্রশংসিত অবস্থা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করা। আর এটা একদিক দিয়ে প্রশংসিত- যারা উক্ত অবস্থা অর্জন করার আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যয় নিয়ে এ পন্থা অবলম্বন করেন। তাদের উক্ত অবস্থা এ ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া এবং আধ্যাত্মিকতা অর্জন করা। কেননা অব্যাহত প্রচেষ্টা ও অর্জনের মাধ্যমে অবস্থার সৃষ্টি করার সফলতা আসে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সকল কোরআন তিলাওয়াতকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, কোরআন তিলাওয়াতের সময় যাদের কান্না না আসে, তারা যেন ইচ্ছে করে অন্তরে কোমলতা সৃষ্টির লক্ষে কান্নার ভান করে এবং চিন্তিত, বিষণ্ন চেহরা ও অনুতপ্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করে। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় যদিও ছলনা ও কৃত্রিমতার মাধ্যমে করা হলেও পরিশেষে বাস্তবিকপক্ষে সত্যি সত্যিই ওই প্রকৃত অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়।

স্মতর্ব্য যে, সেমার সময় যাদের ওয়াজদ্ বা ভাবাবেগ সৃষ্টি হতে দেখা যায়, তাদের অস্বীকার করা উচিত নয়। 

174. কাজী ছানা উল্লাহ পানিপথি রহ রচিত ‘আস-সেমা’ গ্রন্থ হতে সংকলিত।


মাহবুবে ইলাহী হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (رحمه الله تعالي ) ‘ফাওয়াইদুল ফুয়াদ’ গ্রন্থে বলেছেন, বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গান বাজনা ও ধর্ম-সঙ্গীত নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে জায়েয।


১. সঙ্গীত গায়ক নারী ও বালক না হওয়া। 

2.অশ্লীল ও অনর্থক কথা গানের মধ্যে না থাকা।

৩. সঙ্গীত শ্রবণকারী সকলই আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকা এবং এতে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা পূরণকারী না থাকা।

৪. পেশাদার বাদ্যযন্ত্রকার ও গায়ক দ্বারা বাদ্য বাজনা না করা। 


অতএব, উপরোক্ত শর্তাবলীর কোন একটি না থাকলে সেমা বা ধর্ম-সঙ্গীত শ্রবণ করা হারাম।

 
Top