শেখ সাদী (রহঃ) এর শিক্ষনীয় মজার গল্প

Text Ready : Muhammad Foysal

*উপকারী মিথ্যাঃ
বাদশাহ আদেশ দিলেন, অপরাধীর প্রাণদন্ড হওয়া উচিত।  লোকটিকে শূলে চড়াও।
বাদশাহ'র অমান্য করে কে! লোকটিকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসা হল শূলে চড়ানোর জন্য।
লোকটা কাতর অনুনয়-বিনয় করল। কিন্তু,  বাদশা অনড়। লোকটা বুঝলো তার বাঁচবার কোনো আশা নেই। তখন সে বাদশাহ'র উদ্দেশ্য গালাগালি শুরু করল। হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করতে লাগল।
বাদশাহ বসে আছেন দূরে।  লোকটির চিৎকার চেঁচামেচির কোনো অর্থ তিনি বুঝতে পারলেন না। পাশে বসা একজন সভাসদকে জিঙ্গেস করলেন, লোকটি কী বলতে চাই ?
সভাসদ দেখলেন ভারি বিপদ!  সত্য বল্লে বাদশাহ হয় তো ভয়ানক রেগে যাবেন। তাই তিনি বললেন-বাদশাহ লোকটি বলছেঃ যে ব্যাক্তি অপরাধীকে ক্ষমা করে সে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করে।
বাদশাহ বললেন আমিও তো সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করতে চাই। বাদশাহ লোকটির কথা শুনে খুব খুশি হলেন। বল্লেন ওকে মুক্ত করে দাও।
পাশেই দাড়িয়ে ছিলেন আরেক সভাসদ।
প্রথম সভসদের উপর তার ছিল ভারি রাগ।
সে তারাতারি বল্ল - বাদশাহ ঐ সভাসদ মিথ্যা কথা বলছে।
লোকটা আপনাকে গালাগালি দিচ্ছে। একে মুক্ত করা উচিত নয়। এই সভাসদের কথা শুনে বাদশাহ বেশ উত্তেজিত হলেন।রাগ করলেন তিনি
বাদশাহ সভাসদের দিকে তাকিয়ে বললেন- ওর মিথ্যা কথা অনেকগুণে ভাল। কারণ ও মিথ্যা বলছে একটা লোকের প্রাণ রক্ষার জন্যে আর তুমি সত্য কথা বলছো দুটো লোকের ক্ষতি করার জন্য।
তাহলে আমি কার কথা শুনবো ? 
ক্ষতিকর সত্যের চেয়ে উপকারী মিথ্যা আমার কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
বাদশাহ কথা শুনে সভাসদগণ ধন্য ধন্য করতে লাগল। 
*নুনের দামঃ
ইরান এক সুন্দর দেশ। 
সেই দেশের এক সম্রাট -নাম তার নওশের।
প্রজাদের তিনি ভালবাসেন। সত্য ও সুন্দর কথা বলে। ন্যায়ভাবে শাসন করেন রাজ্য। চারদিকে তার সুনাম। সকলেই সম্রাট নওশেরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। 
সম্রাট একদিন সদলবলে শিখারে গিয়েছেন।বনের এদুকে ঘুরে বেড়ান, ওদিকে ঘুরে বেড়ান। চারদিকে চমৎকার এক আনন্দ উৎসব। দুপুর বেলা, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে নওশের বিশ্রাম নিতে বসলেন।
এখন খাওয়া দাওয়ার সময়। সম্রাট নওশের ক্ষুধার্ত। তাঁর সঙ্গীদেরও একই অবস্থা। খেতে বসে দেখা গেল খাবার-দাবার সব ঠিক আছে, কিন্তু লবণ আনা হয় নি ভুলে।
একজন সিপাই সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া দিল ছুটিয়ে লবণের সন্ধানে। সম্রাট তাকে বললেন-তুমি যাচ্ছো কোথায়? 
বনের ধারে কোনো বাড়িতে। দেখি সেখানে লবণ পাওয়া যায় কি না। যেখানেই যাও-না কেনো,  যার কাছ থেকেই লবণ আনো-না কেনো, পয়সা দিয়ে কিনে এনো কিন্তু। 
সিপাই ঘোড়া নিয়ে ছুটল। খুব তারাতারি লবণ জোগাড় করে ফেলল সে।
ফিরে এল আরো দ্রুত। মুখে তার সার্থকতার হাসি। সম্রাট তখনো খাওয়া শুরু করেন নি। 
সিপাই বলল - বাদশাহ নামদার,  লবণ সংগ্রহ করে এনেছি। সম্রাট জিঙ্গেস করলেন - পয়সা দিয়ে কিনে এনেছো তো? যার কাছ থেকে লবণ এনেছো তাকে পয়সা দিয়েছো তো?এমনি এমনি চেয়ে আসো নি তো লবন? 
নওশের ব্যাকুল হয়ে তা জানতে চাইলেন। এই দেখে এক উজিরে আযম মৃদু হেসে বললেন -সম্রাট আপনি এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?  বারবার আপনি জানতে চাইছেন-পয়সা দিয়ে কিনে আনা হয়েছে কিনা।
কারো কাছ থেকে যদি একটু লবণ এমনি এমনি নিয়ে আসা হয় তাহলে ক্ষতি কী?
সম্রাট বললেন-না না এটা হওয়া উচিত নয়। 
আমি যদি অন্যয়ভাবে কারো গাছ থেকে একটা আপেল নিই, তবে দেখা যাবে আমার সঙ্গীরা গাছটাই উপড়ে দিয়েছে।
আমি যদি সিপাইকে বলি যাও বিনা মূল্য একটা ডিম নিয়ে আসো, -ও গিয়ে তাহলে কারো বাড়ি থেকে মুরগিসুদ্ধ ধরে নিয়ে আনবে।
এটা কি ঠিক হবে?
সকলেই মাথা ঝাঁকালেন। 
না, এটা করা ঠিক হবে না।
বাদশাহ নওশের বললেন - সম্রাট হয়ে অন্যায় করা উচিত নয়।বাদশাহ যদি একটু অন্যায় করে তাহলে রাজকর্মচারীরা অন্যায় করবে আরো বেশি।
তাই ক্ষমতাবান সম্রাটকে থাকতে হবে আরো সচেতন। আমি শুধু সেটুকুই চেষ্টা করি।
দরবারের সকলেই সম্রাটের প্রতি আরো ভক্ত অনুরক্ত হয়ে গেল এবং আরো গভীরভাবে ভালবাসতে লাগলো বাদশাহ উন্নত চরিত্র দেখে।
*কাজের ফলঃ
আবদুল একজন কাঠের ব্যবসায়ী ।
সে ছিল খুব অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর এক লোক | জোর করে সে অন্যের গাছ কেটে ফেলত । কাঠ কেটে নিয়ে আসত আর বিক্রির সময় দাম হাকাত অনেক বেশি । কেউ কেউ বলত : আবদুল, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে এভাবে ব্যবসা করো না। গুরুজনেরা উপদেশ দিত, নিন্দুকেরা নিন্দা করত । কিন্তু আবদুল কোনোকিছু গ্রাহ্যই করত না। একদিন একজন তাকে বলল : আবদুল, গরিবদের ওপরে অত্যাচার করো না।
গরিবদের চোখের অশ্রুতে যে অভিশাপ একদিন তার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে । আবদুল নির্বিকার । এসব কথা তার কানেই ঢোকে না । বরং সে বিরক্ত হয় ৷ একদিন ঘটলও
এক দুর্ঘটনা । আবদুলের কাঠের দোকানে আগুন লাগল । দাউ দাউ করে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ল নীল আকাশে । আবদুলের সমস্ত কাঠ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু আবদুলের এই দুঃখে কেউ সমব্যথী হল না । কেউ এসে তার পাশে দাড়াল না। আবদুল বুক চাপড়ে হায় হায় করতে লাগল । হায় হায়, আমার কী হল!
আজ সেই লোকটি আবদুলের কাছে এসে বলল : আবদুল, মনে রেখো
তুমি এতদিন অত্যাচারের আগুন জ্বালিয়েছিলে লোকের মনে, সেই আগুনেই
সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল । অত্যাচারী ব্যক্তি কখনও সুখী হতে পারে না।
তাকে একদিন শাস্তি ভোগ করতেই হয় ।
*চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনীঃ
পাহাড়ি রুক্ষ ধু-ধু প্রান্তর | ছোট-বড় পাহাড় । এরই মধ্যে রাস্তা । একদল
বণিক চলেছে নিজেদের গন্তব্যে | কিন্তু তারা পথিমধ্যে আক্রান্ত হল ভয়ংকর
দস্যুদের কবলে । দস্যুরা প্রথমেই “হারে রে রে হারে রে রে' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বণিকদলটির ওপর তারপরে শুরু করল নির্মমভাবে মারধোর। মালপত্র যা ছিল সব লুঠ করে নিল নিমেষের মধ্যে বণিকেরা অসহায় । তারা করুণভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল । তারা
বলতে লাগল : তোমরা সব লুঠ করে নিলে আমরা এই পাহাড়ি পথে
না-খেয়ে মারা পড়ব । আমাদের এতবড় বিপদে তোমরা ফেলো না। কিন্তু দস্যুরা বড় ভয়ংকর । তারা খুব নির্মম ও নিষ্ঠুর । কোনো কথাই
তাদের কানে প্রবেশ করছে না।
বণিকদলের মধ্যে ছিলেন একজন জ্ঞানীব্যক্তি | তার নাম লোকমান হাকিম । বণিকরা তখন জ্ঞানীব্যক্তিকে বারবার অনুরোধ করতে
লাগল-আপনি দস্যুদের উদ্দেশে কিছু বলুন ৷ উপদেশবাণী দিন | যদি এতে
দস্যুদের মনে কোনো দয়ার উদ্রেক হয় । তারা যদি এতে শান্ত হয় । এই জঘন্য পাপকাজ থেকে তাদের মুক্ত হওয়া উচিত ৷ জ্ঞানীব্যক্তিটি তখন হেসে ফেললেন। নাহে, যারা পশুর মতো আচরণ করে তাদের উপদেশ দিয়ে কোনো লাভ নেই । তারা যুক্তি বিবেচনা করে না । তাদের সঙ্গে কথা বলা আর মরুভূমিতে দীড়িয়ে চিৎকার করা একই ব্যাপার । যে লোহায় মরচে পড়ে গেছে--সেটা হাঁজারবার ঘষলেও উজ্জ্বল হবে না কখনো। যাদের হৃদয়ে মরচে পড়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াই বোকামি ।
*ক্ষমাঃ
বিখ্যাত সম্রাট হারুন-অর-রশিদ। আরবভূমিতে তার নাম ছড়িয়ে আছে।
একজন সুশাসক ও প্রজাবৎসল সম্রাট হিসেবে। তিনি গরিবের উপকার করতেন। দুঃখী ও বিপদগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন ভালাে মানুষদের পক্ষে। মন্দ মানুষদের বিপক্ষে।
একদিন।
সম্রাট হারুন-অর-রশিদ বসে আছেন সভাকক্ষে । মন্ত্রীদের সঙ্গে গভীর এক বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করছেন। কী করে প্রজাদের উপকার করা যায়—এই ছিল তাঁর সারাক্ষণ কর্ম ও ধ্যান।
এমন সময় একটি লােক প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করল ।
প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সােজা প্রবেশ করল সভাকক্ষে। সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল লােকটি। সম্রাট বললেন—কী হয়েছে তােমার?
-বাদশাহ নামদার, একজন আপনাকে ও আপনার মাকে নিয়ে যা-তা গালাগালি করছে রাস্তায়। এ আমি সহ্য করতে পারলাম না। তাই ছুটে এলাম। এই লােকের এখনই বিচার হওয়া উচিত।
সম্রাট মন দিয়ে সবটুকু শুনলেন।
মন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন-
লােকটিকে কী করা উচিত বলে আপনারা মনে করেন?
মন্ত্রীরা সকলেই ভয়ানক উত্তেজিত ।
এতবড় দুঃসাহস লােকটির! 
ওকে ধরে এনে এক্ষুনি ফাঁসিতে চড়াও। একজন সম্রাটকে বললেন-লােকটিকে ধরে এনে সমুচিত সাজা দেয়া উচিত। ওকে শূলে চড়ানাে প্রয়ােজন।
আরেকজন বললেন—ওকে হত্যা করে ওর মাংস কুকুর-বেড়ালকে দিয়ে খাওয়ানাে দরকার।
-ওর জিভ কেটে, চুল ছেটে ওকে শহর থেকে বের করে দেয়া উচিত। কেউ-বা বলল-বেয়াদবটাকে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে ছুড়ে হত্যা করতে হবে।
সম্রাট হারুন-অর-রশিদ সকলের বক্তব্যই শুনলেন। 
তারপর নীরবে একটু হাসলেন।
মৃদু হাসি দিয়ে সকলের উদ্দেশে বললেন—না হে, লােকটিকে ক্ষমা করে দেয়াই উচিত আমাদের। নইলে প্রমাণ হয় না আমরা ঐ লােকটির
চেয়ে বড়। 
লােকটি আমাকে গালাগালি দিয়েছে। 
ও নীচুমনের পরিচয় দিয়েছে। আমি যদি ওকে গালি দিতে চাই তবে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়?
আমিও তাে তবে ওর মতাে হয়ে যাই । ওকে ক্ষমা করে দাও। ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ।
*বিচার নেইঃ
বাদশাহ'র কঠিন অসুখ । সারাদিন তিনি বিছানায় শুয়ে থাকেন। শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হচ্ছে। মনে কোনাে সুখ নেই। কাজকর্ম করতে পারেন না। বেঁচে থাকার আর কোনাে আশা নেই তার। বাদশাহ বুঝলেন, মৃত্যু তাঁর দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসকরা এল। নানারকমের ওষুধ দিল । কিন্তু কিছুতেই কোনাে উপকার হয় না।
সকলেই খুব চিন্তিত।
চিকিৎসক এলেন ইরান-তুরান থেকে । চিকিৎসক এলেন কাবুল-কান্দাহার থেকে। শেষে এক চিকিৎসক এলেন গ্রিস থেকে। গ্রিসের চিকিৎসক বেশ কয়েকদিন ধরে সবধরনের পরীক্ষা করলেন
বাদশাহকে। নাড়ি টিপে দেখলেন। শরীরের তাপ নিলেন। 
তারপর তিনি বললেন, এ বড় কঠিন অসুখ। তবে এর চিকিৎসা আছে। 
একজন অল্পবয়স্ক বালক প্রয়ােজন, যার হৃৎপিণ্ড থেকে ওষুধ তৈরি করতে হবে। 
সেই ওষুধে বাদশাহ সুস্থ হয়ে উঠবেন।
বাদশাহ'র অসুখ । 
প্রয়ােজন অল্পবয়স্ক বালক । দিকে দিকে লােক ছড়িয়ে পড়ল। খুঁজতে খুঁজতে একটা ছেলেকে পাওয়াও গেল । ছেলের বাবা টাকার
বিনিময়ে খুব অনায়াসে ছেলেটিকে বিক্রি করে দিল বাদশাহ’র লােকদের কাছে। টাকাও পেল বিপুল পরিমাণ।
আর কাজি বিচারসভায় রায় দিলেন, এই ছেলের জীবন বধ করা অন্যায় কোনাে কাজ নয়। কারণ, এই ছেলের তুচ্ছ জীবনের বিনিময়ে বাদশাহ'র মূল্যবান জীবন রক্ষা পাবে। ছেলেটি এইসব ঘটনা দেখে সারাক্ষণ মিটিমিটি হাসে। জল্লাদ তাকে হত্যা করার জন্যে ধরে-বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমিতে । তার হৃৎপিণ্ড থেকে
তৈরি হবে ওষুধ। ছেলেটি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে হাে হাে করে হাসতে লাগল।
বাদশাহ পেছনে ছিলেন। ছেলেটির হাসির শব্দ শুনে তিনি খুব বিচলিত হলেন। 
একটু পরেই তার মৃত্যু হবে! মাটিতে লুটিয়ে পড়বে তার সুন্দর দেহ। তবে ছেলেটি প্রাণ খুলে হাসে কেন? বাদশাহ তাকে
ডেকে পাঠালেন।
—তুমি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে এরকম ভাবে হাসছ কেন?
ছেলেটি হাসতে হাসতেই বলল-হায়, আমার জীবন! আমি হাসব-না
তাে কে হাসবে বলুন? পিতামাতার দায়িত্ব সন্তানদের রক্ষা করা। কিন্তু দেখুন, কিছু অর্থের বিনিময়ে আমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন ।
কাজির দরবারে মানুষ যায় কেন? সুবিচারের আশা নিয়ে। 
কিন্তু, কাজি সাহেব অন্যায়ভাবে বাদশাহ’র পক্ষ নিলেন। আমাকে হত্যা করার
হুকুম দিলেন তিনি। আর বাদশাহ’র কর্তব্য কী? বাদশাহ তাে গরিব-দুঃখী, অত্যাচারিত, নিপীড়িত প্রজাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু এখন
কী ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে? বাদশাহ নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য অন্যের জীবনকে তুচ্ছ করছেন। কিন্তু অপরের জীবনও যে তার নিজের কাছে অতি মূল্যবান—এই সামান্য কথা তিনি মনেই রাখলেন না।
হায়! একটু পরেই আমার মৃত্যু হবে। আমি হাসব-না তাে কে হাসবে!
জগৎ-সংসারের এইসব খেলা দেখে একমাত্র আমিই এখন প্রাণ খুলে হাসতে পারি।
বাদশাহ এই কথা শুনে অবাক হলেন। ছেলেটির প্রতি অসীম মমতায়
তিনি কাতর হয়ে উঠলেন। তিনি ছেলেটিকে মুক্ত করে দিলেন।
আর আশ্চর্যের ব্যাপার তার কিছুদিন পরেই বাদশাহ’র অসুখ সেরে গেল। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ
হয়ে উঠলেন।
*যেমন ছিলামঃ
বাদশাহ'র মন ভালো নেই । বৃদ্ধ বয়স । যে-কোনোদিন তিনি মারা যাবেন।
তিনি মারা গেলে কে বাদশাহ হবেন? কারণ তার কোনো সন্তান নেই বাদশাহ ঘোষণা করে দিলেন : কাল ভোরবেলা এই রাজধানী শহরে প্রথম যে-ব্যক্তি প্রবেশ করবে তাকেই আমি পুত্র হিসেবে গ্রহণ করব । সেই হবে এই বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী ।
পরদিন ভোরবেলা । সকলে উদগ্রীব । রাজকর্মচারীরা নগরদ্ধারে প্রস্তুত তাদের উৎসুক দৃষ্টি, কে হবে সেই ভাগ্যবান?
এমন সময় দেখা গেল একজন দীনহীন ভিক্ষুক, পরনে তার শতচ্ছিন্ন পোশাক, আপনমনে সে প্রবেশ করছে নগরে । রাজকর্মচারী প্রতিশ্রুতি
অনুযায়ী ভিক্ষুককে ধরে নিয়ে হাজির হল রাজদরবারে | একেবারে রাজার সামনে বাদশাহ তাকেই গ্রহণ করলেন । ভিক্ষুক হল তার পোষ্যপুত্র | সে হবে রাজ্যের উত্তরাধিকারী ।
ভিক্ষুকের আর আনন্দ ধরে না। দুবেলা ভাতের জন্যে তাকে ঘুরে বেড়াতে হত মানুষের দরজায় দরজায় । হঠাৎ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরে
গেছে । সে আজ অগাধ ধনসম্পদের মালিক ।
সমস্ত রাজ্য তার।
কোষাগারের সমস্ত অর্থ তার ।
এই সুখ! এই স্বাচ্ছন্দ্য! ভিক্ষুকের মাথা খারাপ হয়ে উঠল। সে ভোগবিলাসে, আনন্দ-উৎসবে জীবন কাটাতে লাগল ।
বাদশাহ একদিন মারা গেলেন ।
ভিক্ষুক বসল সিংহাসনে ।
সকলেই তাকে বাদশাহ বলে মেনে নিল ।
কিন্তু বাদশাহ হওয়ার পরেই রাজ্যজুড়ে দেখা দিল অশাস্তি । নতুন বাদশাহ'র কোনো জ্বানগম্যি নেই । রাজ্য পরিচালনার মতো বুদ্ধিও তার নেই । মন্ত্রীরা তাই এই নতুন বাদশাহকে খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারল না। তারা বাদশাহ'র হুকুম পালন করতে অপারগ ।
রাজ্যজুড়ে শুরু হল অরাজকতা ।
অন্যান্য দেশের বাদশাহরা ভাবলেন, এইতো সুযোগ । দখল করতে হবে রাজ্য ।
নতুন বাদশাহ পড়লেন মহাভাবনায় ।
দিনরাত তার দুশ্চস্তা । নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, চোখে তার ঘুম নেই।
এমন সময় ভিক্ষুকের এক পুরনো বন্ধু এল তার সঙ্গে দেখা করতে । বন্ধু এখন বাদশাহ হয়েছে । এ আনন্দ তারও । বন্ধুকে সে বলল-তুমি বাদশাহ
হয়েছ। এর চেয়ে সুখ জীবনে আর কী হতে পারে! একদিন তুমি এই রাজ্যের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে । আজ পুরো রাজ্যটাই তোমার। তোমার কোনো অভাব নেই । টাকা-পয়সার চিন্তা নেই । তোমার মতো সুখী আর কে আছে ভাই ।
নতুন বাদশাহ তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল : বন্ধু, তুমি যদি আমার মনের আসল অবস্থা বুঝতে পারতে তবে হয়তো এই কথা আর বলতে না । যখন পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম, একবেলা খেতাম, আরেকবেলা খেতে পেতাম না__সেই
জীবনই আমার ভালো ছিল । খাবার চিন্তা আজ হয়তো আমার নেই । কিন্তু প্রতি মূহুর্তে , প্রতিক্ষণে নানা দুশ্চিন্তায় দিন কাটে আমার । রাজ্য চালানো যে কী কঠিন কাজ সে তোমাকে কীভাবে বোঝাই । এই বিত্তের চেয়ে নিঃস্ব জীবনই আমার ভালো । বন্ধু, আমি সেই পুরনো জীবনেই ফিরে যেতে চাই ।
*সত্যিকার পালোয়নঃ
একজন পালােয়ান । ইয়া মােটা দশাসই চেহারা তার। বিশাল বপু । যেমন
মােটা তেমনই তাগড়া শরীর।
কিন্তু বেচারা খুব মনখারাপ করে বসে আছে রাস্তায়। কেউ একজন তাকে
খুব কটু কথা শুনিয়ে গেছে । রীতিমতাে অপমান। বলেছে, সে নাকি দেখতে
হাতির মতাে ।
পালােয়ানের মন খারাপ। বিমর্ষ বদনে সে বসে বসে ভাবছে,
এই অপমানের প্রতিশােধ নিতে হবে। সে মােটা, তাতে অন্যের কী আসে যায়!
একজন বুদ্ধিমান লােক যাচ্ছিল সেই পথ দিয়ে। গােমড়ামুখাে পালােয়ানকে দেখে সে সামনে এল, ও হে পালােয়ান ভাই, কী হয়েছে।
তােমার? মন-খারাপের কারণ কী?
পালােয়ান চুপ করে রইল। কী বলবে সে?
কী হে পালােয়ান ভাই—'
পালােয়ান তখন গালে হাত দিয়ে দুঃখী গলায় বলল, 'ভাইরে, কী আর
বলব! একজন আমাকে খুব অপমান করে গেছে। সেই অপমানের জ্বালায়
জ্বলে মরছি।'
এই-না শুনে হাে হাে করে হেসে ফেলল বুদ্ধিমান লােকটি।
“ওহে পালােয়ান ভাই, শুনে খুবই আশ্চর্য হলাম। দশ মণ, বিশ মণ।
বােঝার ভার তুমি অনায়াসে বইতে পারাে—সেই তুমি কিনা সামান্য একটু
অপমানের বােঝা বইতে পারছ না।
মনে রেখাে পালােয়ান, মানুষ মাটির তৈরি । মাটির মতােই সহনশীল
হওয়া উচিত আমাদের। প্রকৃত পালােয়ান কখনও শক্তির বাহাদুরি করে না ।
সে সকলকে ক্ষমা করে।
কারণ ক্ষমাই মানুষের মহত্তম গুণ।
*ভিক্ষা নয়ঃ
 এক ছিল দরিদ্র ব্যক্তি।
এক বেলা খায় তাে আরেক বেলা খায় না। পরনে তার হাজার তালির পােশাক। 
ক্ষুধার জ্বালায় কাতর থাকে সারাদিন। ঘর নেই, বাড়ি নেই। 
পথে ঘােরে, পথেই ঘুমায় ।
মনে তার অসীম দুঃখ ।
গরিব হলে কী হবে? লােকটির আত্মসম্মানবােধ ছিল তীব্র। 
খেতে পেত না । কিন্তু কারও কাছে হাত পাতত-না সে । কেউ যদি কিছু দিত তাকে
তবেই তার খাওয়া হত । 
নইলে উপােস।
তার এই গরিবি অবস্থা দেখে একজন বলল—ভাইরে, এত কেন কষ্ট
করছ? তার চেয়ে বরং যাও না এই শহরের সবচেয়ে ধনী লােকের কাছে।
তিনি খুব দয়ালু ও উপকারী। গরিবের দুঃখ তিনি দূর করতে চান। নিশ্চয়ই
তিনি তােমাকে সাহায্য করবেন।
এই শুনে গরিব লােকটি বললেন—না, না, তা হবে কেন? না-খেতে
পেয়ে মারা যাব তা-ও ভালাে—কিন্তু অন্যের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকা খুব
কষ্টের। 
কারও অনুগ্রহ আমি কামনা করি না। ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার চেয়ে।
মরে যাওয়া অনেক ভালাে। আর যাই হােক, আমার মনে অপার শাস্তি
আছে । আমি মনে শান্তি নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
*দুই বন্ধুঃ
দেশের নাম খােরাশান। ভারি সুন্দর এক দেশ।
সেই দেশে ছিল দুইজন সাধু ব্যক্তি।
একজন ছিল বেশ মােটাসােটা । খেতে খুব পছন্দ করত । দিনে দুইবার ভালাে ভালাে খাবার পেটপুরে না-খেলে তার শান্তি হত না।
অন্যজন ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। শরীর ছিল লিকলিকে। হাড়-জিরজিরে
দেহ। খাওয়াদাওয়া একদম পছন্দ করত না। দুইদিন পরে একদিন খেত সে।
দুজনের আবার ভারি বন্ধুত্ব।
একবার তারা একসঙ্গে দেশভ্রমণে বের হল। পাহাড়-পর্বত ছাড়িয়ে,
বন-জঙ্গল পেরিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা। নতুন দেশ, নতুন মানুষ—নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা । খুব ভালাে লাগছে তাদের। আনন্দে আনন্দে
কেটে যাচ্ছিল দিনগুলাে।
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন নতুন এক শহরে এল তারা। 
শহরে ঢােকামাত্র গ্রেফতার করা হল তাদের । বাদশাহ'র সেপাইরা ধরে নিয়ে গেল
কাজির দরবারে। 
বিচারে রায় দেয়া হল—এরা গুপ্তচর।
সাধু দুইজন বলতে থাকে : আমরা নিরপরাধ, আমাদের কোনাে দোষ।
নেই। আমরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা নিরীহ মানুষ ।
কিন্তু, কেউ তাদের কথা শুনল না।
তাদের দুজনকে বন্দি করে রাখা হল একটা চোর-কুঠুরিতে । দরজা বন্ধ করে দেয়া হল । 
না-খেতে পেয়ে ওরা যেন মারা যায়—এর চেয়ে ভয়ংকর শাস্তি আর কী হতে পারে!
কিছুদিন পরে অবশ্য প্রমাণ পাওয়া গেল, সেই দুজন আসলে গুপ্তচর নয়।
তারা সাধু ব্যক্তি। মনের আনন্দে বেরিয়েছে দেশ ঘুরতে।
বাদশাহ'র লােকেরা গেল বন্দিদের মুক্ত করতে । দরজা ভেঙে উদ্ধার
করতে হবে ওদের। কিন্তু এতদিন না-খেয়ে থাকলে মানুষ তাে বাঁচতে পারে।
নিশ্চয়ই ওরা বেঁচে নেই ।
দরজা খুলে অবাক হল সেপাইরা । একজন তখনও বেঁচে আছে । 
যে বেচারা হাড়-জিরজিরে, রােগা-পটকা দেহ সে-ই মারা যায়নি। মােটা-জন
পটল তুলেছে। সকলেই অবাক।
তখন একজন জ্ঞানীলােক বলল ; এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মােটা লােকটাই মারা যাবে। 
কারণ, সে ছিল ভােজনরসিক। খাবার ছাড়া তার। একমুহুর্ত চলে না। 
খাবার না-পেয়ে সে মারা গেছে। কিন্তু শুকনাে লােকটা খুব সংযমী। 
না-খেয়ে থাকার অভ্যেস তার আছে।
সে বন্দি কারাগারে। অনশন পালন করেছে।
জ্ঞানীলােকটি তখন সকলের উদ্দেশে বলল : যারা অভাবের মধ্যে দিন।
কাটায় তারা অভাবকে সহ্য করতে পারে। কিন্তু যারা ভােগবিলাসে জীবন।
কাটায় তারা সামান্য বিপদেই কাতর হয়ে পড়ে। এমনকি মারাও যায় ।
ওদের দুজনের ভাগ্যে সেরকম ঘটনা ঘটেছে।
*জুতোর দুঃখঃ
এই গল্পটি শেখ সাদীর মুখেই শােনা যাক :
একদা ছিল না জুতাে চরণযুগলে। অর্থাৎ আমার জুতাে নেই।
টাকাপয়সাও নেই। টাকার অভাবে জুতাে কিনতে পারছি না। মনে খুব দুঃখ । অভাবে পড়লে জীবনের চাওয়া-পাওয়া নষ্ট হয়ে যায়।
আমার অবস্থা বেগতিক। জুতাের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছি একদিন। দোকানে থরে থরে
সাজানাে রঙবেরঙের কত জুতাে। কিন্তু আমার কেনার সামর্থ্য নেই।
হঠাৎ করেই চোখ পড়ল একজন লােকের দিকে তাকিয়ে দেখি লােকটা রাস্তার ধারে গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটছে। লােকটা খোড়া। তার পা দুখানিই নেই ।
জুতাে নেই বলে আমার দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু বেচারার পা নেই। তার দুঃখ আমার চেয়ে আরাে অনেক বেশি । আমি তাে তবে ওর চেয়ে অনেক
সুখেই আছি।
জুতাে না-থাকার বেদনা আমি মুহুর্তেই ভুলে গেলাম। কারণ ঐ লােকটার
চেয়ে আমার অবস্থা অনেক অনেক ভালাে।
*হাসিঠাট্টাঃ
একজন ব্যবসায়ী। খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু বেচারা হঠাৎ করে ব্যবসায় বেশকিছু
টাকা লােকসান করে ফেলল। কী আর করা! ব্যবসা করতে গেলে লাভ-লােকসান তাে থাকবেই।
ব্যবসায়ীর একটি মাত্র পুত্র। সে বাবার সঙ্গে ব্যবসা করতো। 
পিতা একদিন পুত্রকে ডেকে বললেন—লােকসান হয়েছে বলে ভেঙে পড়াে না ।
লােকসানের কথা লােকজনকে বলার কোনাে দরকার নেই। পুত্র তাে এই শুনে অবাক!
কেন বাবা?
বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী-পিতা তখন বললেন—লােকসানের দুঃখেই আমরা।কাতর। 
লােকে যদি জানতে পারে তবে দুঃখ হবে দ্বিগুণ। ক্ষতির দুঃখ তো আছেই, তার ওপরে লােকে জানলে আমাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে,
অহেতুক উপহাস করবে—সেই দুঃখ সহ্য করা আরাে কঠিন হবে।
যদিও খুব অন্যায় তবু লােকে অন্যের বিপদ দেখলে আনন্দিত হয়।
*বিশ্বাসঃ
গজনীর সুলতান মাহমুদ।
খুব বিখ্যাত একজন শাসক, যােদ্ধা এবং বীর। 
তাঁর একজন সভাসদ ছিলেন। 
খুবই বিশ্বস্ত । নাম তার হােসেন।
| প্রায় প্রতিদিনই সুলতানের সঙ্গে কোনাে-না-কোনাে বিষয় নিয়ে তাঁর
শলাপরামর্শ হত । সেসব আলােচনা ছিল খুবই গােপনীয় । একদিন দীর্ঘক্ষণ
ধরে আলােচনা চলছে সুলতান ও সভাসদ হােসেনের মধ্যে।
| আলােচনা শেষে হােসেন বেরিয়ে এলেন বাইরে। কয়েকজন লােক তাকে
ঘিরে ঘরল—সুলতানের সঙ্গে আপনার এতক্ষণ কী কী বিষয়ে পরামর্শ হল
আমরা জানতে পারি কি?
হােসেন একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। তারপর বললেন—এই
বিষয়টা জানার জন্যে সুলতানের সঙ্গেই আপনাদের কথা বলাটা বুদ্ধিমানের
কাজ নয় কি?
লােকগুলাে কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গেল। পরে একজন বলল—বুঝতে
পেরেছি, আপনি বিষয়টা গােপন রাখতে চাইছেন আমাদের কাছে।
হােসেন বললেন—এটা তাে পানির মতাে সহজ বিষয় । গােপন রাখব
বলেই তাে সুলতানের আমি এত বিশ্বাসভাজন। আমাকে মেরে ফেললেও
আমি সুলতানের বিশ্বাস ভঙ্গ করব না।
বিশ্বাস ভঙ্গ করা মহাপাপ।
*গুণের আদরঃ
নাম তার আয়াজ।
দেখতে-শুনতে খুব একটা সুন্দর নয়। 
যেমন বেঁটে তেমনই কালাে।
চোখদুটো কুতকুতে। তােতলা। 
কথা বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে আসে।
কিন্তু, সুলতান মাহমুদ তাকে খুব ভালােবাসেন। সুলতানের অনুচরদের মধ্যে সে খুব প্রিয়। 
অন্যরা তাই খুব হিংসা করত আয়াজকে। 
রূপবান এবং শক্তিমান এত অনুচর থাকতে আয়াজকে কেন এত পছন্দ করেন সুলতান?
এই প্রশ্ন সকলের।
একদিন সুলতান মাহমুদের সভাসদ হােসেন এলেন অনুচরদের
আস্তানায় । কয়েকজন অনুচর তাকে ঘিরে ধরল। তারা জিজ্ঞেস করল-
এত শক্তিমান, রূপবান অনুচর থাকতে আমাদের প্রিয় সুলতান কেন
আয়াজকে বেশি ভালােবাসেন?
প্রশ্ন শুনে হােসেন মিটিমিটি হাসলেন।
—রূপের চেয়ে গুণের মূল্য অনেক বেশি। 
রূপ দেখে আমরা মুগ্ধ হই।
বটে কিন্তু মর্যাদা দিই গুণীব্যক্তিকে। 
মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে গুণ দিয়ে, রূপে নয়। যে সকলকে ভালােবাসে, দেখতে অসুন্দর হলেও সে সকলের ভালােবাসা পাবে। 
পৃথিবীর যারা বিখ্যাত মানুষ তাঁরা সকলেই
গুণের কারণে বিখ্যাত হয়েছেন—রূপের কারণে নয়।
আমাদের আয়াজ তােমাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে গুণবান। 
সুলতান মাহমুদ গুণের সমাদর করতে জানেন। তাই তিনি আয়াজকে সবচেয়ে বেশি
পছন্দ করেন। 
তােমরাও রূপবান হওয়ার চেয়ে গুণবান হওয়ার চেষ্টা করাে।
তাহলেই জীবনে উন্নতি করতে পারবে ।
*জীবন-মৃত্যু
বয়স তীর প্রায় একশো বছর ।
অতি বৃদ্ধ এক লোক । কঠিন তার অসুখ ৷ 
এই বুঝি তাঁর প্রাণ যায় _ এরকম অবস্থা । মৃত্যুশয্যায় সেই বুড়োলোকটা গোঙাতে লাগল ।
বিড়বিড় করে সে কথা বলছে ফারসিভাষায় ।
কিন্তু, বুড়োর মৃত্যুশষ্যায় যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের কেউই অবশ্য একবর্ণ ফারসি বোঝে না। ভারি মুশকিল । মৃত্যুশয্যায় মানুষ অনেক
প্রয়োজনীয় কথা বলে । এইসব কথা না-বুঝলে চলবে কী করে!
লোকজনেরা ছুটে গেল কবি শেখ সাদীর কাছে । কারণ শেখ সাদী একজন জ্ঞানী মানুষ । তিনি কবিতা লেখেন ।
একজন বলল,
-_কবি, শিগগির চলুন । এক বুড়ো মৃত্যুশয্যায় কী বলছেন তা কেউই
বুঝতে পারছে না।
শেখ সাদী দ্রুত এসে উপস্থিত হলেন বুড়োর রোগশয্যায় | 
বুড়ো তখন,
কবিতা আবৃত্তি করছেন । 
সেই কবিতার অর্থ হল : 
হায়রে জীবন! 
এই জীবনে কত কিছু দেখার ছিল । 
কিছুই না-দেখে আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে৷
বাগানে ঘুরে ঘুরে একটা গোলাপের পাশেই মরে গেলাম । 
পুরো বাগানটা আমার দেখা হল না।
বুড়োর বেঁচে থাকার আগ্রহ দেখে কবি শেখ সাদী ভারি অবাক হলেন ।
সকলে কবিতার অর্থ শুনে একেবারে চোখ কপালে তুলল 
একশো বছর। বেঁচে থেকেও বুড়ো আরো বাচতে চাইছেন ।
কবি তাকে প্রশ্ন করলেন- আপনি কেমন আছেন? এখন কেমন
লাগছে আপনার?
বুড়ো মৃদুস্বরে জবাব দিল--এই জীবনের চেয়ে প্রিয় আর কী আছে?
একটা দাত তোলার ব্যথা সারাজীবনে ভোলা যায় না। কিন্তু আমার প্রাণ
বেরিয়ে যাচ্হে_-এই যন্ত্রণার কথা আমি কী করে বর্ণনা করি ।
শেখ সাদী তখন বললেন_-আপনি শান্ত হন। মানুষ কখনও
চিরদিন বাচে না। 
একদিন-না-একদিন মানুষকে মরতে হবেই । শরীর থাকলে অসুখবিসুখ থাকবেই । 
আমরা চিকিৎসক ডেকে আনি ॥ 
তিনিই ব্যবস্থা করবেন।
তখন বুড়ো বললেন-_-অনেক কথাই বলা যায় । কিন্তু, সময় ও স্রোত
কারো জন্য অপেক্ষা করে না। 
যে বাড়ির দেয়ালের রং নষ্ট হয়ে গেছে,
চুন-সুরকি খসে গেছে, সেই বাড়ির চুনকাম করার কোনো মানে হয় না।
আজ আমি বুড়ো হয়েছি, জীবনের শেষপর্যায়ে এসেছি, চিকিৎসক এনে আর
লাভ কী! 
চিকিৎসক কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?
বলেই বুড়ো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
শেখ মুখে সান্ত্বনার কোনো ভাষাই নেই । 
বুড়োর মৃত্যুশয্যায় তিনি
স্থিরভাবে বসে রইলেন ৷

 
Top