বিষয়ঃ- নামাজে ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জি ধরে নাভির নীচে রাখা সুন্নত। 

১) হাদীস শরীফঃ- 

حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ مُوسَى بْنِ عُمَيْرٍ ، عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، قَالَ : رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَضَعَ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.

অনুবাদ : হযরত ওয়াইল বিন হুজর (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) বলেন: আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নামাযের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের ওপর নাভির নীচে রাখতে দেখেছি।
 
রেফারেন্সঃ- ইবনে আবী শাইবা: ৩৯৫৯

✔ হাদীসটির স্তর : সহীহ। মুসা বিন উমাইর ব্যতীত এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী-মুসলিমের রাবী। আর মুসা বিন উমাইর ثقةٌ “নির্ভরযোগ্য”। (তাকরীব: ৭৮৭৪)
☑ সারসংক্ষেপ : এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভির নীচে রাখতেন।

✔ ফায়দা : হাদীসে উল্লিখিত تحت السرةশব্দটি ইবনে আবী শাইবার মূল পান্ডুলিপিতে নেই বলে কোন কোন মুহাদ্দিস মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আরবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়খ মুহাম্মাদ আউয়ামার অনুসন্ধান অনুযায়ী উক্ত শব্দটি মূল পান্ডুলিপিতে বিদ্যমান রয়েছে এবং প্রমাণ হিসেবে তিনি মূল পান্ডুলিপির ফটোকপি কিতাবের শুরুতে পেশ করেছেন। (শায়খ মুহাম্মাদ আউয়ামার তাহকীকসহ ইবনে আবী শাইবার টিকায় বিস্তারিত দেখুন)
নামাযে হাত কোথায় বাঁধতে হবে- এ ব্যাপারে হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) থেকে একটি মারফু’ হাদীস আবু দাউদ শরীফে বিদ্যমান আছে। হাদীসটি নিম্নরূপ:

২) হাদীস শরীফঃ-

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ مَحْبُوبٍ حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُغِيَاثٍ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ إِسْحَاقَ عَنْ زِيَادِ بْنِ زَيْدٍ عَنْأَبِي جُحَيْفَةَ أَنَّ عَلِيًّارضى الله عنه قَالَ السُّنَّةُ وَضْعُالْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ ‏(رَوَاه ابُوْ دَاود فِىْ بَابِ وَضْعِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى فِي الصَّلَاةِ)‏

অনুবাদ : হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) বলেন: নামাযে নাভির নীচে বাম হাতের পাতার ওপর ডান হাতের তালু রাখা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। 

রেফারেন্সঃ- আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং- ৭৫৬।

✔ হাদীসটির স্তর : হাসান লিগইরিহী তবে এই সনদটি জঈফ। এ হাদীসের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন ইসহাক নামক রাবী জঈফ আর যিয়াদ বিন যায়েদ অপরিচিত হওয়ার কারণে অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জঈফ বলেছেন। তবে ইমাম তিরমিজী রহ. আব্দুর রহমান বিন ইসহাকের বর্ণিত হাদীসকে হাসান বলেছেন। (তিরমিজী: ৭৩৯) উপরন্তু, হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)-এর নিজের আমল নাভির নীচে হাত বাঁধা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। 

যেমন,
১)  ইবনে আবী শাইবা: ৩৯৬১, 
২) মুসনাদে আহমাদ: ৮৭৫, 
৩) দারাকুতনী: ১১০২ ও ১১০৩, 
৪) সুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী: ২৩৪০, ২৩৪১ ও ২৩৪২। 

তন্মধ্যে ইবনে আবী শাইবার হাদীসটি হাসান। সব মিলে একটি সম্মিলিত শক্তি সৃষ্টি হয়। আর দ্বীনদার জঈফ রাবীর বর্ণিত হাদীসের পক্ষে সমর্থক বর্ণনা পাওয়া গেলে সেটাকে হাসান লিগইরিহী হিসেবে গণ্য হয়। (মুকাদ্দামায়ে মিশকাত: তাদরীবুর রাবী)

উল্লেখ্য : আবু দাউদ শরীফের চারটি সংকলন রয়েছে। তন্মধ্যে হিন্দুস্তানী মুদ্রণে আবুল কাসেম লুলুঈর সংকলনের অনুসরণ করা হয়েছে। আবু দাউদ শরীফের উক্ত সংকলনে এ হাদীসটি নেই। তবে হযরত ইবনে আরাবী, ইবনে দাসা এবং অন্যদের সংকলনে এ হাদীসটি বিদ্যমান রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক অনুদিত আবু দাউদ শরীফেও হাদীসটি রয়েছে। ইমাম মিজ্জী বলেন: هذا الحديث في رواية أبي سعيد بن الأعرابي وابن داسه وغير واحد عن أبي داود , ولم يذكره أبو القاسم.“এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ রহ. থেকে আবু সাঈদ ইবনে আরাবী, ইবনে দাসা এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন। তবে আবুল কাসেম এ হাদীসটি বর্ণনা করেননি”। 

রেফারেন্সঃ- তুহফাতুল আশরাফ: হাদীস নম্বর- ১০৩১৪।

৩) হাদীস শরীফঃ-

حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ رَبِيعٍ ، عَنْ أَبِي مَعْشَرٍ ، عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : يَضَعُ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.

অনুবাদ : হযরত ইবরাহীম নাখঈ রহ. বলেন: নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখে নাভির নীচে রাখবে। 

রেফারেন্সঃ- ইবনে আবী শাইবা: ৩৯৬০।

✔ হাদীসটির স্তর : হাসান, মাকতু’। রবী’ ব্যতীত এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই বুখারী/মুসলিমের রাবী। আর রবী’র ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন: صدوق سىء الحفظ ، و كان عابدا مجاهدا“তিনি সত্যনিষ্ঠ, আবেদ এবং মুজাহিদ; তবে স্মৃতিশক্তি খারাপ”। (তাকরীব: ২০৭৩) 

৪) হাদীস শরীফঃ-

حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ قَالَ أَخْبَرَنَا الحَجَّاجُ بْنُ حَسَّانَ ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا مِجْلَزٍ أَوْ سَأَلْتُهُ ، قَالَ : قُلْتُ كَيْفَ أَصْنَعُ ؟ قَالَ يَضَعُ بَاطِنَ كَفِّ يَمِينِهِ عَلَى ظَاهِرِ كَفِّ شِمَالِهِ ، وَيَجْعَلُهَا أَسْفَلَ مِنَ السُّرَّةِ.

অনুবাদ : হাজ্জাজ বিন হাসসান রহ. বলেন: আমি হযরত আবু মিজলায রহ.কে বলতে শুনেছি যে, অথবা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি যে, আমি কীভাবে  করব? তিনি বললেন: ডান হাতের পাঞ্জা বাম হাতের পাঞ্জার ওপর রেখে নাভির নীচে রাখবে। 

রেফারেন্সঃ-  ইবনে আবী শাইবা: ৩৯৬৩।

✔ হাদীসটির স্তর : হাসান, মাকতু’। এ হাদীসের রাবীদ্বয়ের মধ্যে ইয়াযীদ বিন হারুন বুখারী-মুসলিমের রাবী। আর হাজ্জাজ বিন হাসসান صدوق“সত্যনিষ্ঠ”। (আল কাশেফ: ৯৩২)

☑ সারসংক্ষেপ : বিশিষ্ট দু’জন তাবিঈ এবং মুহাদ্দিস ও ফকীহ হযরত ইবরাহীম নাখঈ এবং হযরত আবু মিজলায রহ.-এর সিদ্ধান্ত থেকে জানা গেলো যে, নামাযে হাত রাখতে হবে নাভির নীচে।

❌ উল্লেখ্য, নামাযের মধ্যে হাত কোথায় বাঁধতে হবে, এ ব্যাপারে বিভিন্ন রকম আমল বর্ণিত আছে। নাভি বরাবর, নাভির উপরে ও নাভির নীচে। বুকের ওপরে হাত বাঁধার স্পষ্ট কোন সহীহ হাদীস সিহাহ সিত্তার ভিতরে বা বাইরে কোন কিতাবে নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক অনুদিত আবু দাউদ শরীফের ৭৫৯ নম্বর হাদীসে হযরত তাউস রহ. বুকের ওপর হাত বাঁধাকে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আমল বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সাহাবার মাধ্যম না থাকায় হাদীসটি মুরসাল। আমরা মুরসাল হাদীসকে দলীল হিসেবে স্বীকার করি। তবে ইবনে আবী শাইবার ৩৯৫৯ নম্বরে সহীহ সনদে বর্ণিত হযরত ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)-এর হাদীসের বিপরীত হওয়ায় আমরা তাউস রহ.-এর বর্ণিত হাদীসটিকে অপ্রবল মনে করি। কিন্তু যারা এর দ্বারা দলীল দেয় তারা মুরসাল হাদীসকে দলীলযোগ্য মনে করে না। সহীহ ইবনে খুযাইমার ৪৭৯ নম্বরে বুকের ওপর হাত বাঁধার একটি স্পষ্ট হাদীস বর্ণিত থাকলেও হাদীসটি জঈফ। উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারী মুআম্মাল বিন ইসমাঈল রিজাল শাস্ত্রের ইমামগণের নিকটে বিতর্কিত। ইমাম বুখারী রহ. তাঁকে মুনকারুল হাদীস বলেছেন। শায়খ শুআইব আরনাউত হাদীসটিকে জঈফ বলেছেন। (মুসনাদে আহমাদ: ১৮৮৭১ নম্বর হাদীসের আলোচনায়) আলবানীও হাদীসটিকে জঈফ বলেছেন। (ইবনে খুযাইমা: ৪৭৯ নম্বর হাদীসের তাহকীকে) মুসনাদে আহমাদের ২১৯৬৮ নম্বর হাদীসে হযরত হুলাব (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) থেকে বুকের ওপর হাত বাঁধার একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসের সনদে কবীসা নামক রাবীকে শায়খ শুআইব আরনাউত অপরিচিত মন্তব্য করে হাদীসটির সনদ জঈফ বলেছেন। আর উক্ত হাদীসের অন্নান্য বর্ণনা পেশ করে বুকের ওপর হাত রাখার অংশটিকে জঈফ বলেছেন। তিনি আরও বলেন:وقول الألباني رحمه الله في صفة الصلاة: وضعهما على الصدر هو الذي ثبت في السنة، تعنُّت لا وجه له،“ আলবানী ‘সিফাতুস সলাত’ কিতাবে বুকের ওপর হাত বাঁধাকে বহাল সুন্নাত বলে যে মন্তব্য করেছেন সেটা নিছক একগুঁয়েমী”। (মুসনাদে আহমাদ: ২১৯৬৮ নম্বর হাদীসের আলোচনায়) 

এ কারণে হয়তো চার ইমামসহ কোন বিজ্ঞ ফকীহ বা মুহাদ্দিস বুকের ওপর হাত বাঁধার আমল গ্রহণও করেননি। ইবনুল কাইয়িম বলেন: নামাযে হাত বেঁধে কোথায় রাখতে হবে তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম আহমাদ রহ. থেকে নাভি বরাবর, নাভির উপরে এবং নাভির নীচে তিনটি মতই বর্ণিত হয়েছে। (বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ: ৩/৯১)
 
ইমাম আহমাদের মতো জগতবিখ্যাত মুহাদ্দিসও বুকের ওপর হাত বাঁধার কোন মত পেশ করেননি। অবশ্য সতর সংরক্ষণে বেশী কার্যকর হওয়ায় নারীদেরকে আমরা উক্ত আমলের প্রতি উৎসাহ করে থাকি।

 
Top