বিষয়: আবু দাউদের হাদিস নিয়ে কিছু কথা!
কৃত: মিসবাহুল ইসলাম আকিব
অনলাইন এক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ। 
সুনানে আবু দাউদের হাদিস:

যাদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে (সনদ):
মুসাদ্দাদ–ইয়াহিয়া–সুফিয়ান–আতা ইবনে সায়েব–আবু আব্দুর রহমান সুলামী রাহিমাহুমুল্লাহ–মাওলায়ে কায়েনাত মাওলা আলী রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু।

হাদিসের মূল ভাষ্য:
হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত: এক আনসারী ব্যক্তি তাঁকে এবং আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে দাওয়াত করলেন। তাতে মদ হারাম হবার পূর্বে উভয়ই মদ্যপান করলেন। অতঃপর আলী (রা.) মাগরিব নামাজের ইমামতি করলেন এবং পাঠ করলেন (কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন)। তারপর তাতে উলট-পালট করে ফেললেন। তাৎক্ষণিক এ আয়াতটি নাজিল হলো: হে ইমানদারগণ, তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না' (সুনানে আবু দাউদ, ৩৬৭৩)।

এই হাদিস দিয়ে শেরে খোদা মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক মদ পানের পক্ষে একচেটিয়া দলিল দেয়া হয়েছে। হুকুমের ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তা একদম স্পষ্ট করা হয় নি। এ যেন অনেকটা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা! 
ব্যাপারটা 'দুধ কা দুধ পানি কা পানি'র মত পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যেই মূলত আমি গুনাহগারের এই লেখাটা। এ লেখা থেকে 'ডেটল শিউর' জানা যাবে, হাদিসটির সনদে কোন বর্ণনাকারীকে নিয়ে 'কী কথা' আছে।

যদি উপরোক্ত হাদিসের সনদটার দিকে একটু তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, এতে বর্ণনাকারী হিসেবে একজন 'সুফিয়ান' আছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন উস্তাদ আতা ইবনে সায়েব থেকে। আর ইলমে হাদিসে প্রসিদ্ধ 'সুফিয়ান' আছে মোট দু'জন। এক, সুফিয়ান সাওরী, অন্যজন সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা। দু'জনেই আবার প্রাগুক্ত আতা ইবনে সায়েবেরই শাগরেদ। মানে, তার থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন এ দুই সুফিয়ান। প্রথমজনের ব্যাপারে হাদিস বিশেষজ্ঞদের সার্বজনীন অভিমত হচ্ছে, 'আতা ইবনে সায়েব থেকে সুফিয়ান সাওরীর হাদিস সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য'। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আবু দাউদের এই সনদে যেই 'সুফিয়ান' আছেন, তিনি কি সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য খ্যাত সে-ই 'সুফিয়ান' সাওরী, না অপর 'সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা'। ব্যাপারটা দ্রুত স্পষ্ট করা দরকার। তার আগে বলে রাখি, আবু দাউদের মূল কিতাবে 'সুফিয়ান' বলতে বাস্তবে কোন সুফিয়ানকে বোঝানো করা হয়েছে, তা ইমাম আবু দাউদ নিজ কলমে স্পষ্ট করে যান নি। সেজন্য যেটুকু আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে, সেটুকু হয়ত শুধুমাত্র আবু দাউদেরই কোনো ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে, নয়ত অন্যকোনো টিকা বা তাহকীক থেকে হবে। 

এক্ষেত্রে, মুবারকপুরীর মত বেশ ক'জন সালাফি ঘরানার আলেমের আধুনিক টিকা ও ব্যাখ্যাগ্রন্থে উক্ত সনদের 'সুফিয়ান' হিসেবে 'সুফিয়ান সাওরী'র নামই উল্লেখ করা আছে। তার বিপরীতে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)-এর জগৎবিখ্যাত শিষ্য, সুফি, মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে রাসলান (রহ.) লিখিত আবু দাউদের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থে এসেছে, 'এই সুফিয়ান বলতে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা— সুফিয়ান সাওরী উদ্দিষ্ট নন'। 

একদিকে, আধুনিক ও সালাফি ঘরানার কিছু আলেমের মন্তব্য, অন্যদিকে ছয়শত বছর আগেকার প্রাচীন, প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে রাসলানের বক্তব্য— সিদ্ধান্ত নিন, আপনি কোনটা মানবেন? যারা সালফে সালেহীনের প্রতি নির্ভর করেন, তারা সন্দেহাতীতভাবে একথাই বলবেন, 'আতা ইবনে সায়েব থেকে এখানকার বর্ণনাকারী সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য 'সুফিয়ান সাওরী' নন; বরং তিনি সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা'। কারণ, তা আল্লামা ইবনে রাসলান নিজ বক্তব্যে স্পষ্ট করে গেছেন। আবু দাউদের এই বর্ণনাকারী 'সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা'— এটাই পাকা সিদ্ধান্ত। 

এবার প্রশ্ন থাকতে পারে, আতা ইবনে সায়েব থেকে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার এই হাদিস কতটুক গ্রহণযোগ্য হবে? অপরদিকের নির্ভরযোগ্য সুফিয়ান সাওরীর 'মদপান না করা'র হাদিসের বিপরীতে দাঁড়িপাল্লায় এটা কতটুক ভারী হতে পারে? (মদপান না করার হাদিসটি ইমাম হাকেম তাঁর মুস্তাদরাক গ্রন্থে সুফিয়ান সাওরী থেকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন)

আসমাউর রিজালের কিতাব অন্বেষণ করলে দেখা যায়, আতা ইবনে সায়েব থেকে 'সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা'র বর্ণনা ইমাম হুমাইদী ছাড়া আর কেউ হুজ্জত হিসেবে গ্রহণ করেন নি। আতা ইবনে সায়েব থেকে যে সাতজনের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য বলে ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে 'সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা'র নাম নেই। সে হিসেবে আতা ইবনে সায়েব থেকে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার এই বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য। উপরের আলোচনা থেকে দুটি জিনিস প্রমাণিত।
১. আবু দাউদের বর্ণনায় সুফিয়ান বলতে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা উদ্দেশ্য।
২. আতা ইবনে সায়েব থেকে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার বর্ণনা মুহাদ্দিসগণের হুজ্জত নয়; বিধায় আবু দাউদের ঐ সনদের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ কথা বলেছেন।

এ ব্যাপারে জগৎবিখ্যাত হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম মুনজিরীর বক্তব্যটাই প্রণিধানযোগ্য। নিজ সংকলন 'মুখতাসার আবু দাউদ'-এ মদ্যপান করা না করা সম্পর্কিত হাদিসগুলোর প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: "এই হাদিসগুলোর সনদের মধ্যে ভিন্নতা হচ্ছে, সেগুলো আতা ইবনে সায়েব থেকে সুফিয়ান সাওরী এবং আবু জাফর রাজী 'মুসনাদ' সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আর সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, ইবরাহিম ইবনে তাহমান এবং দাউদ ইবনে জিবরিকান— এ ৩ জন 'ইরসাল' করেছেন, অর্থাৎ 'মুরসাল' সূত্রে বর্ণনা করেছেন"। 

বুঝা গেল, ইমাম মুনজিরীর মতে, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার বর্ণনা অর্থাৎ, আবু দাউদের এই হাদীসটি 'মুরসাল' এবং তার বিপরীতে ইমাম হাকেমের 'মুসতাদরাক' গ্রন্থে সুফিয়ান সাওরীর সূত্রে বর্ণিত সেই হাদিসটি 'মুসনাদ'— যেখানে মাওলা আলী শেরে খোদা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মদপান ও ইমামতির কথা নেই। সেই হিসেবে 'মুরসাল' বর্ণনার বিপরীতে 'মুসনাদ' হাদীস গ্রহণ করাই উসুলে হাদিসের নীতি। সুতরাং মাওলা আলী শেরে খোদা রাদিয়াল্লাহু আনহু মদ পান করেন নি, এটাই উসুলে হাদিসের নীতির আলোকে প্রমাণিত। 

এবার সালাফি ঘরানার লেখকদের তথ্য বিকৃতির 'ভয়ংকর চিত্র' দেখুন। ইমাম মুনজিরী যে সুফিয়ান সাওরীর বর্ণনাকে 'মুসনাদ' বলে অভিহিত করেছেন, যার দ্বারা মাওলা আলী শেরে খোদা আলী মর্তুজা রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মদ পান না করা প্রমাণিত হয়; সেই সুফিয়ান সাওরীর বর্ণনাটাকে ইমাম মুনজিরীর রেফারেন্স দিয়েই তারা 'মুসনাদে'র পরিবর্তে উল্টো 'মুরসাল' উল্লেখ করেছে। এবং সুফিয়ান সাওরীর বর্ণনাটাকে 'মুরসাল' বলা মানে, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু'র মদ পান না করার হাদিসকে দুর্বল প্রমাণ করা। এটাকে দুর্বল প্রমাণ করতে পারলেই তার বিপরীতে মদ পান করার হাদীসটা 'অটোমেটিক গ্রহণযোগ্য' হয়ে উঠবে!
মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মদ পান করেছেন, একথা প্রমাণ করার জন্য মুবারকপুরী গংরা আবু দাউদের হাদিস নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে দুটি হাস্যকর খেয়ানত করেছে। 
১. 'সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা'কে 'সুফিয়ান সাওরী' বলে চালিয়ে দিয়েছে।
২. সুফিয়ান সাওরীর যে বর্ণনাকে ইমাম মুনজিরী 'মুসনাদ' বলেছেন, সে-ই বর্ণনাকে তারা 'মুরসাল' সাজিয়ে উল্লেখ করেছে। তাও আবার ইমাম মুনজিরীর তথ্যটা বিকৃত করে!!

এই খেয়ানতের ফলাফল সুস্পষ্ট:
১. মাওলা আলী শেরে খোদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মদপান না করা সংক্রান্ত সুফিয়ান সাওরীর সর্বাধিক সহি ( اصح ) স্বীকৃত হাদিসকে 'দুর্বল' বানানো।
২. এবং তার বিপরীতে মদ পান করা সংক্রান্ত হাদিসগুলোকে 'অটোমেটিক গ্রহণযোগ্য' করে তোলা।
এটাও সালাফীদের একটা ষড়যন্ত্র নয় তো! هذا ما عندي و العلم عند الله

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: যুগে যুগে শিয়াদের হাতে যেমন সাহাবায়ে কেরামের সম্মান আক্রান্ত হয়েছে, অনুরূপভাবে খারেজী-সালাফীরা আবহমান কাল ধরে আহলে বাইতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।
 
Top