জিজ্ঞাসা–৫০৪: আমার হাজব্যান্ড ইতালিতে থাকে। ও তার মায়ের কথা শুনে আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করে না। এখন কী আমল করলে তার ভালবাসা পাব। প্লিজ, একটু ব্লুন।–ইচ্ছাকৃতভাবে নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয় নি।

জবাব:

এক- প্রিয় বোন, মূলত পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রেখে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই একজন নারীর সফলতা। আর আপনার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, স্বামীর ভালবাসা ও প্রীতি অর্জন করার ক্ষেত্রে আপনি ব্যর্থ হচ্ছেন এবং এর ‘কারণ’ হল, আপনার সঙ্গে আপনার শাশুড়ির বনিবনা না হওয়া। এজন্য আমরা প্রথমে সমস্যার ‘কারণকে সামনে রেখে কিছু পরামর্শ দিচ্ছি। এরপর -ইনশা আল্লাহ- কিছু পরামর্শ দিব ‘সমস্যা’-কে সামনে রেখে। আশা করি, সুখের পায়রা ফিরিয়ে আনার জন্য হলেও পরামর্শগুলো মেনে চলবেন।

১. প্রিয় বোন, আপনার মূল প্রয়োজন স্বামীর ভালবাসা অর্জন। কিন্তু স্বামী কে? তিনি তো আপনার শাশুড়িরই ছেলে। শাশুড়িকে বাদ দিয়ে স্বামীকে জয় করতে পারবেন কি? সংসার-জীবনের এই অংকটা বোঝার চেষ্টা করুন। সুতরাং তিক্ততা আর নয়; বরং এখন থেকে শাশুড়িকে গুরুত্ব দিন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করুন। তাঁর সাথে তর্কে জড়াবেন না। নিজের মায়ের মত তাঁকেও সম্মান করুন। তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিন। শরীর খারাপ হলে তাঁর কাছে এসে সেবা করার চেষ্টা করুন।

যদিও শরিয়তের দৃষ্টিতে শুশুর-শাশুড়ির সেবা করতে আপনি আইনত বাধ্য নন তবে যদি সেবা করেন তাহলে এর বিনিময়ে সাওয়াব তো পাবেনই; উপরন্তু এটি হবে আপনার সমস্যা কাটানোর অন্যতম হাতিয়ার। আপনি ভুলে যাবেন না যে, এখন আপনাকে কিছুটা কৌশলী হতে হবে। শাশুড়ির মন জয়ের চেষ্টা করতে হবে।

এক কথায়, এখন থেকে আপনি আপনার শাশুড়ির সঙ্গে তেমন আচরণ দেখাবেন, যেমন আচরণের আশা আপনি তাঁর কাছ থেকে আপনার ব্যাপারে করে থাকেন। যেমন, আপনি চান তিনি যেন আপনার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন, সুতরাং তিনি না করলেও আপনি তাঁর সঙ্গে ভাল ব্যববহার করুন। তিনি আপনাকে মেয়ের মত মনে না করলেও আপনি তাকে মায়ের মর্যাদা দিন। রাসূল্লাহ ﷺ বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ مِنْ الْخَيْرِ

মুহাম্মদ  এর প্রাণ যার হাতে তাঁর কসম! তোমাদের কেউ পূর্ণ মু’মিন হবে না, যে পর্যন্ত না সে অন্যের জন্য সেই কল্যাণ পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে থাকে। (নাসাঈ ৫০১৬)

২. প্রিয় বোন, একটু ভেবে দেখুন তো, আপনার সমস্যার জটিলতার নেপথ্যে আপনার শাশুড়িই কি এককভাবে দায়ী? এক্ষেত্রে আপনার কি মোটেও দোষ নেই? দেখুন তো, আপনার অহংকার কিংবা বেসামাল যবান এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রেখেছে কিনা? যদি তাই হয়, তাহলে এখন থেকে বিনয়ী হোন এবং যবানের সঠিক ব্যবহার করুন। কোন কিছু নিয়েই অহংকার করবেন না। কেননা, মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে বিনয়ী হওয়া। আর যবানের অপব্যবহারের কারণে মানুষ পাহাড়সম জটিলতা ও অহেতুক ফ্যাসাদ মাথায় নিয়ে বসে। জ্ঞানীরা বলেন, ‘বুদ্ধিমান কথা বেল ভেবে-চিন্তে। পক্ষান্তরে নির্বোধরা প্রথমে বলে তারপর ভাবে। সাধারণত দেখা যায়, রাগের সময় পুরুষের হাত নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং মহিলাদের যবান নিয়ন্ত্রণে থাকে না।’

দুই- এবার আসুন, আপনার মূল ‘সমস্যা’-কে সামনে রেখে আপনার প্রতি আমাদের পরামর্শ–

প্রিয় বোন, মূলত আমাদের উক্ত পরামর্শ অনুযায়ী যদি চলতে পারেন, তাহলে -ইনশা আল্লাহ- দেখবেন, অচিরেই আপনার ভাগ্যাকাশে সুখের সোনালী চাঁদ উদিত হবে। পাশাপাশি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতিও খেয়াল রাখবেন।

১. স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। যোগাযোগ হলে তাঁর কাছে বারবার মাফ চান, তাঁর সময় ও মেজাজ বুঝে প্রেম-ভালবাসা মিশ্রিত বাক্যালাপ করুন, তাঁর সঙ্গে সম্মান ও শ্রদ্ধামূলক আচরণ করুন। বিতর্ক বা উঁচু কণ্ঠে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন, কেননা, নারীর সৌন্দর্য তার নম্র কন্ঠে। (মাওলানা আশরাফ আলী থানভি রহ. রচিত বেহেশতি জেওর) এবং তাঁর মনের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করুন। তারপর সে অনুপাতে চলুন।

২. সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব না হলে তাঁর কাছে ম্যাসেজের মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে বারবার সালাম ও ভালবাসা মিশ্রিত কালাম (কথা) পাঠান। কেননা, হাদিস শরিফে এসেছে, সালামের বিনিময়ে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ সৃষ্টি হয়। (মুসলিম ৮১)

৩. অধিকহারে ইস্তেগফার পড়ুন। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। (আবূদাউদ ১৫২০)

৪. ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে (اَلْوَدُوْدُ) ‘আল-ওয়াদুদু’ ( অর্থ-প্রকৃত বন্ধু) একটি। এ পবিত্র নামের আমলে স্বামী-স্ত্রী অমিল ও দূরত্ব কমে যায়। সুতরাং অধিকহারে পড়ুন- ‘ইয়া ওয়াদুদু’।

৫. কোনো কোনো আলেম বলেন, শুক্রবার অর্ধরাত অতিবাহিত হবার পর অজু করে নিম্নোক্ত দুআটি তিনবার পড়লে স্বামীর ভালবাসা পুনরায় তৈরি হবে–

فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ।

৬. বেশি বেশি দোয়া করুন। বিশেষ করে কোরআনে বর্ণিত এ দোয়াটি করতে পারেন; ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে সুখী করবেন- رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا’হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জীবনসঙ্গীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ দান করুন।’ (সূরা ফুরকান ৭৪)

আল্লাহ আপনাকে সুন্দর ও বরকতময় জীবন দান করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
 
Top