পবিত্র ক্বোরআনের শপথ: হুযূর-ই আকরাম আল্লাহ্র রসূল
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন –
يٰسۤ- وَالْقُرْاٰنِ الْحَكِيْمِ- َاِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ-

তরজমা: ইয়া-সী—-ন। হিকমতময় ক্বোরআনের শপথ! নিশ্চয় আপনি প্রেরিত (রসূল)। [সূরা ইয়া-সীন: আয়াত ১-৩] এ আয়াত শরীফও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর না’ত (প্রশংসা)। মক্কার কাফিরগণ বলতো, ‘‘আপনি আল্লাহর রসূল নন।’’ এর জবাবে মহান রব এরশাদ করেছেন, ‘‘হে মাহবূব! ক্বোরআনের শপথ, আপনি আমার রসূল।’’
এ আয়াতে তিনটি কলেমা বা বাক্য রয়েছে- ১. ইয়া-সী—-ন, ২. ওয়াল ক্বোরআ-নিল হাকীম এবং ৩. ইন্নাকা লামিনাল মুরসালীন। এ তিনটি কলেমায় পৃথক পৃথক তৃপ্তি, মজা বা সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে-
‘ইয়া-সী—-ন।’ এ দু’টি অক্ষর ‘মুতাশা-বিহাত’ (দ্ব্যর্থ বোধক শব্দাবলী)’র অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক অর্থ মহান রব জানেন এবং তাঁর মাহবূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম জানেন; তবুও তাফসীরকারকগণ কতিপয় ভিন্ন অর্থ (তা’ভীল)-ও করেছেন। যেমন-
প্রথম, ‘ইয়া- সী—-ন’ হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম মুবারক। আর এর পূর্বে ‘ইয়া’ উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ ওহে ইয়া-সীন—-ন!
দ্বিতীয়, ‘ইয়া’ হলো সম্বোধন সূচক শব্দ, আর ‘সী—-ন’ মানে সরদার। এটা দ্বারা ‘সাইয়্যেদুল আলামী-ন’ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ- হে বিশ্ববাসীদের সরদার!
তৃতীয়, এটা সূরার নাম।
এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বোরআন-ই করীমের শপথ করেছেন। এ’তে ক্বোরআন-ই পাকের মহত্ব প্রকাশ পায়। কেননা, মহান রব যে বস্তুর শপথ করেন, এ শপথ দ্বারা ওই বস্তুর মহত্ব প্রকাশ পায়। আমরা (সাধারণ মানুষ) যে সব শপথ করি, ওই গুলো দ্বারা আমাদের বক্তব্যকে মজবূত করাই উদ্দেশ্য থাকে। (আর আল্লাহ্ তা‘আলা যে জিনিসের শপথ করেন, ওই শপথ দ্বারা ওই জিনিসের মহত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এখানে হুযূর-ই আকরামের রিসালতের ব্যাপক বর্ণনা করেছেন। (এখানে আরো লক্ষণীয় যে,) অন্য কোন নবীর নবূয়তের পক্ষে শপথ করা হয়নি।
মোটকথা, এ আয়াত দ্বারা কয়েক পদ্ধতিতে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর না’ত (প্রশংসা) প্রমাণিত।


ইসলাম গ্রহণের ফলে পূর্ববর্তী সব গুনাহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়
‘আবদ’ মানে গোলামও, ‘খাদিম’ও
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
قُلْ يَاعِبَادِىَ الَّذِيْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰى اَنْفُسِهِمْ لَاتَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ- اِنَّ اللهَ يَغْفِرُا الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا-

তরজমা: হে হাবীব, আপনি বলে দিন, হে আমার ওই সব বান্দা! যারা নিজেদের প্রাণের প্রতি যুল্ম করেছো, আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ্ সব গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন। [সূরা যুমার: আয়াত- ৫৩] এ আয়াত শরীফও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট না’ত বা প্রশংসা। এর শানে নুযূল (অবতরণের প্রেক্ষাপট) হচ্ছে- এক দল মানুষ আরয করলো, ‘‘হে আল্লাহ্র হাবীব! আমাদের গুনাহ্ও কি মাফ হয়ে যাবে?’’ এর উত্তরে এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে এবং এতে এরশাদ হয়েছে- হে মাহবূব! আপনি বলে দিন, ‘‘হে আমার বান্দারা! যারা অপরাধ (গুনাহ) করেছো, মহান রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা, ইসলামে এসে যাও! আর এ রহমতের সমুদ্রে ডুব দাও, ফলে সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা থেকে পবিত্র হয়ে যাবে।
এ আয়াতে যেই عبادى (আমার বান্দারা) এরশাদ হয়েছে, তা দ্বারা হয়তো আল্লাহর বান্দাগণ বুঝানো উদ্দেশ্যে, তখন কিন্তু এর পূর্বে এ কয়েকটা শব্দ উহ্য মানতে হবে-
এক. يَقُوْلُ اللهُ يَاعِبَادِىْ (অর্থাৎ আল্লাহ্ বলছেন, ‘‘হে আমার বন্দারা!) কেননা, তখন তা قُلْ (আপনি বলুন)-এর সাথে সম্পৃক্ত হবে না।
দুই. اَسْرَفُوْا عَلٰى اَنْفُسَهُمْ (যারা নিজেদের প্রাণের উপর যুল্ম করেছে)-এর অর্থে এ শর্ত জুড়ে নিতে হবে যে, তা থেকে মুশরিক ও কাফিররা খারিজ থাকবে; শুধু ঈমানদারগণই তাতে শামিল থাকবে। কেননা, আল্লাহর বান্দা তো সবাই। কিন্তু মুশরিকদের শির্কের তো ক্ষমা হতে পারে না। কারণ, অন্যত্র আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- اِنَّ اللهَ لَايَغْفِرُ اَنْ يُشْرِكَ بِهِ- (নিশ্চয় আল্লাহ্ এটা ক্ষমা করেন না যে, তাঁর সাথে শির্ক করা হবে।) আল্লাহ্্ তা‘আলা শির্ক (কুফর) ক্ষমা করেন না।
অথবা, يَاعِبَادِىْ মানে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বান্দাগণ। অর্থাৎ তাঁর গোলামগণ। عَبْد শব্দের অর্থ عابد (আবিদ বা ইবাদতকারী) ও হতে পারে خادم (খাদিম)ও হতে পারে।
সুতরাং এখন আয়াত শরীফের অর্থ দাঁড়ায়- ‘হে মাহবূব! আপনি বলে দিন, ‘‘হে আমার গোলামরা!’’ এতদ্ভিত্তিতে, তা থেকে কাফিরগণ আপসে বের হয়ে গেলো। কেননা, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর খিদমতগার তো মুসলমানগণই। এমতাবস্থায় আয়াতে কোন অতিরিক্ত বাক্য উহ্য মানার দরকার হলো না।
এখন দেখুন- এ অর্থের সমর্থনে কতিপয় উদ্ধৃতি-
এক. ওহাবী-দেওবন্দীদের মান্যবর ব্যক্তি মৌলভী আশরাফ আলী থানভী সাহেব এ অর্থ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, এখানে عبادى (আমার আবদগণ!) মানে হুযূর আলায়স্ িসালাতু ওয়াস্ সালাম-এর বান্দাগণ।
দুই. মসনভী শরীফও এ অর্থ নিয়েছে। যেমন-
بدইهٔ خود خواند احمد در رشاد- جمله عالم را بخواں قل يا عباد
يا عبادى كهه كے هم كو شاه نے- اپنا بدনه كر ليا پرح تجھ كو كيا

অর্থাৎ খোদ হুযূর-ই আকরাম আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম يَاعِبَادِىْ (হে আমার বান্দাগণ) বলে আমাদেরকে তাঁর বান্দা করে নিয়েছেন। এতে তোমার ক্ষতি কি?
মাসআলা
‘আবদুন্নবী’ (عبد النبى) ও ‘আবদুর রসূল’ (عبد الرسول) ইত্যাদি নাম রাখা সম্পূর্ণ জায়েয এবং পবিত্র ক্বোরআন দ্বারা প্রমাণিত। মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন-مِنْ عِبَادِكُمْ وَاِمَائِكُمْ (তোমাদের খাদিম ও তোমাদের দাসীগণ!) আরবে আমভাবে বলা হয়- عَبْدِىْ অর্থাৎ আমার গোলাম।
তিন. ‘দুররুল মুখতার’ প্রণেতার ওস্তাদের ওস্তাদ মহোদয়ের নাম ‘আবদুন্নবী খলীল’ (عبد النبى خليل) (দেখুন- র্দুরুল মুখ্তার-এর ভূমিকা, যেখানে তিনি তাঁর ওস্তাদদের শাজরা (জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পরম্পরা) উল্লেখ করেছেন।
হাদীস শরীফে এ মর্মে যেই নিষেধ এসেছে- عَبْدِىْ ও اَمَتِىْ বলো না, এ নিষেধ মুস্তাহাব নির্দেশক। যেমন- বলা হয়েছে- আঙ্গুরকে ‘কারাম’ বলো না। কেননা, ‘কারাম’ হচ্ছে মুসলিম। [বোখারী ইত্যাদি] সাহাবা-ই কেরাম বারংবার বলেছেন- كُنْتُ عَبْدَهُ وَخَادِمَهُ (আমি তাঁর অর্থাৎ হুযূর-ই আকরামের গোলাম ও খাদিম ছিলাম)। এর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ‘জা-আল হক্বক্বু ওয়া যাহাক্বাল বাত্বিল’ নামক পুস্তকে দেখুন। তাতে এমন সব প্রমাণ দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর খণ্ডন, ইন্শা-আল্লাহ্, বিরুদ্ধবাদীগণ করতে পারবে না।
لَاتَقْنَطُوْا (তোমরা নিরাশ হয়ো না) থেকে বুঝা গেলো যে, আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হওয়া বান্দার জন্য শোভা পায় না, বরং নিজের গুনাহ্গুলো দেখে মহান রবকে ভয় করবে। আল্লাহ্র রহমতের মধ্যে গভীরভাব চিন্তা-ভাবনা করে সেটার প্রার্থী হয়ে থাকবে। আ’লা হযরত বলেন-
گنه رضا كا حساب كيا وه اگر چه لاكهوں سے هيں سوا
مره ائے عفو ترے عفو كا نه حساب هے نه شمار هے

অর্থাৎ রেযার গুনাহ্র আবার হিসাব কি জিনিস? তা যদিও লক্ষকেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু হে মহা ক্ষমাশীল, তোমার ক্ষমার না হিসাব আছে, না গণনা।
মহান পবিত্র খোদা সমস্ত গুনাহ্ ক্ষমা করবেন, কিন্তু বান্দাদের হক্বগুলোর বেলায় প্রাপকদের থেকে ক্ষমা করিয়ে নেবেন। যেমন আক্বাইদের কিতাবাদি ইত্যাদিতে উল্লেখ করা হয়েছে।


 
Top