কস্তুরীর চেয়েও সুগন্ধিময় ঘাম মোবারক عن انس بن مالك قال خَدَمْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عشر سنين فما قال اُفٍّ قَطٌ وما قال لشئ صَنَعْتُهُ لِمَ صَنَعْتَهُ ولا لِشَئٍ تركتُه لِمَ تركْتَهُ وكانَ رسول الله صلى الله عليه وسلم من احسن الناس خُلْقًا ولا مسْت حَزًا قطٌ وَلَا حَرِيْرًا قَطّ وَلَاشَيْئًا كَانَ اَلْيَنَ من كفّ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ شممت مسْكًا قطّ ولا عطرًا كان اطيب من عَرَق رسلول الله صلى الله عليه وسلم – (شَمَائِلُ النَّبى) অনুবাদ: হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ দশ বৎসর যাবত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমত করেছি। তিনি কখনো উহ্ (শব্দ) পর্যন্ত বলেননি। (আমার আচরণে ব্যবহারে কর্মে তিনি বিরক্তি বা অসন্তোষ প্রকাশ করেননি) আমার কৃত কোন কর্মের জন্য তিনি আমাকে কখনো বলেননি, তুমি একাজ কেন করলে? অথবা কোন কাজ না করায় এ কথাও বলেননি এটা তুমি কেন করোনি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। আমি রেশম ও পশমের মিশ্রণে প্রস্তুতকৃত কাপড়ও নিজ হস্তে স্পর্শ করে দেখেছি, এবং খাঁটি রেশমি কাপড়ও স্পর্শ করেছি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর হাতের চেয়ে অধিক নরম ও কোমল কিছু স্পর্শ করিনি। আমি কস্তুরির ঘ্রাণও নিয়েছি এবং আতরের ঘ্রাণও নিয়েছি কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর শরীরের ঘাম থেকে অধিক সুঘ্রাণযুক্ত কিছুই পাইনি। [শামায়েলে তিরমিযী]


 প্রাসঙ্গিক আলোচনা বর্ণিত হাদীস শরীফে প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর অসংখ্য গুণাবলী ও ব্যবহারিক জীবনের অনুপম আদর্শ, চরিত্র ও সৌন্দর্যের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে। তিনি ছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসরনীয় ও অনুকরণীয় আদর্শের সর্বোত্তম মডেল। ইসলামী জীবন বিধানের সমস্ত সুন্দর গুণ, বৈশিষ্ট্য ফুলের মতো ফুটে উঠে তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শে। মানব জাতি একটি সুন্দর, পবিত্র, উন্নত, আদর্শ, মহৎ জীবন, উদার নৈতিক জীবন গঠনে একটি পূতঃপবিত্র পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা খুঁজে পাবে তাঁরই পবিত্র জীবনে। তাঁর খাদেম ও সাহাবী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি তাঁর অনুপম চারিত্রিক গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর ব্যবহারিক আদর্শে। এতে আরো বর্ণিত হয়েছে তাঁর দৈহিক পবিত্রতার সৌন্দর্য, সুন্দর ও কোমলভাবে কথা বলার শিক্ষা, নিজ অধীনস্তদের প্রতি কর্কশ ভাষায় কথা না বলার শিক্ষা, কথা বার্তায় শ্রোতার অন্তরে কষ্ট না দেয়ার শিক্ষা। কথাবার্তা বলার সময় বিতর্ক না করার, অযথা, অনর্থক ও বাজে কথা না বলার এবং কথা বার্তায় অন্যকে হতাশ ও নিরাশ না করার শিক্ষা বর্ণিত হাদীস শরীফে প্রতিফলিত হয়েছে। এ ছাড়াও হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, অনুপম সুন্দরতম চিত্তাকর্ষক পরিপাটি অবয়ব অসাধারণ, সৌন্দর্যের আধাঁর নূরানিয়াতের ঝলক চিত্রিত হয়েছে। মিশক আম্বরের চেয়েও দেহের সৌরভ অনন্য অসাধারণ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর অপর বর্ণনায় এসেছে- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم ازهر اللّون كانَّ عَرَقَهُ اللَّوْلُو اذا مشى تكفّا وما مشيت ديباجَةً ولا حرِيْرًا الين من كفّ رسول الله صلى الله عليه وسلم ولاشممت مسكًا ولا عنبرة اطيب من رائحة النّبى صلى عليه وسلم- (رواه البخارى ومسلم) অর্থ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর বর্ণ ছিল স্বচ্ছ। উজ্জ্বল ঝকঝকে। তাঁর ঘাম বিন্দু ছিল যেন মনিমুক্তা, যখন তিনি চলতেন সামনের দিকে ঝুঁকে চলতেন, আমি এমন কোন রেশমি কাপড় স্পর্শ করিনি যা রাসূলুল্লাহর হস্ততালু অপেক্ষা অধিক নরম ও কোমল। আমি এমন কোন মিশক বা আম্বরের ঘ্রাণ নিইনি যা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর দেহের সৌরভ (ঘাম মোবারক) অপেক্ষা অধিক সুগন্ধিময়। [বোখারী ও মুসলিম শরীফ] তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা সাহাবায়ে কেরাম যখনই প্রিয়নবীর উপমা দিতেন চন্দ্র ও সূর্যের সঙ্গে উপমা দিতেন কেননা মানবজাতি তথা প্রাকৃতিক জগতে এ দুটি জ্যোতির্ময় সৃষ্টির চেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় পদার্থ আর কিছুই নেই। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রিয় নবীজির সৌন্দর্যের বর্ণনা ব্যক্ত করেন যে- مَا رَايْتُ شيئًا احسن من رسول الله صلى الله عليه وسلم كانّ الشمس تجرى فى وجهه واذا ضحك يتلالاء نورهُ فى الجدور- অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা অধিক সুন্দর আর কাউকে দেখিনি। তাঁর মুখমন্ডলে যেন সূর্য উদ্ভাসিত। আর যখন তিনি হাসতেন তাঁর দ্বীপ্তি প্রাচীরে চকচকে আলো ছড়াত। হযরত কা’ব ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا سرا ستنار وجهه كانه وجهه قطعة قمر وكنا نعرف ذالك- رواه البخارى ومسلم) অর্থ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন খুশী হতেন, তখন তাঁর চেহারা মোবারক ঝলমল করত। এমনকি মনে হতো তা এক টুকরা চাঁদ আমরা সকলেই তা চিনতাম। ঘাম মোবারক সংগ্রহ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর মাতা হযরত উম্মে সুলাইম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা দুপুরের বিশ্রাম অবস্থায় প্রিয় রাসূলের নির্গত ঘাম মোবারক একটি শিশিতে ভর্তি করছিলেন। প্রিয় নবী জাগ্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মে সুলাইম তুমি এ কি করছো? তিনি আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এটা আপনার ঘাম মোবারক যা আমাদের খুশবুতে মিশ্রিত করব। এটি সর্বোত্তম খুশবু। [সহীহ মুসলিম শরীফ] হুযূরের প্রস্রাব মোবারক পবিত্র প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে আয়মন নামক মহিলা সাহাবীকে বললেন, আমার এ প্রস্রাব বাইরে ফেলে দিয়ে আস। হযরত উম্মে আয়মন সবটুকু পান করে ফেললেন। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন প্রস্রাবগুলো কি করলে? বললেন, তা-তো আমি সবটুকু পান করে নিয়েছি। হযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার শরীরে দোজখের আগুন স্পর্শ হওয়া হারাম করা হয়েছে। হুযূর (দ.)’র শারীরিক সুগন্ধি মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রিয় হাবীব এর দেহ মোবারক সুগন্ধিময় করে সৃষ্টি করেছেন। যে পথে তিনি যাতায়াত করতেন সে পথের অলিগলি সুগন্ধিতে ভরে উঠতো। চারদিকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়তো। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ অবস্থার বর্ণনা করেছেন- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا مرّ فى طرق المدينة وجدوا منه رائحة الطيب وقال مرّ رسول الله صلى الله عليه وسلم من هذا الطريق- অর্থ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনায় কোনো পথ দিয়ে যাতায়াত করলে লোকেরা ওই পথে আকর্ষণীয় সুগন্ধি পেতো। তারা বলত এ পথ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গমন করেছেন। [দালায়িলুন নবুয়ত: পৃষ্ঠা ২৮০, খাসায়েসে কুবরা: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৭] হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে- انَّ النبى صلى الله عليه وسلم لم يسلك طريقا فيتبعه احد الاعرف انه قد سلكه من طيب عرقه اوقال من ريح عرقهِ- অর্থ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে পথ দিয়ে গমন করতেন সে রাস্তা সুগন্ধিতে ভরে উঠতো। অনুসন্ধানকারী সুগন্ধি পেয়ে বুঝে নিতেন যে, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ পথ দিয়ে গমন করেছেন। [মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫১৭] আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কতই সুন্দর বলেছেন- بهينى بهينى مهك پر مهكتى درود پيارى پيارى نفاست په لاكهون سلام- উচ্চারণ: ভীনি ভীনি মহক্ পর মহকতী দরূদ পিয়ারী পিয়ারী নফাসত পে লাখোঁ সালাম। অর্থাৎ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর মন মাতানো সুরভি মদীরায় সৌরভ মন্ডিত দরূদ। তাঁর প্রিয় পবিত্র সৌন্দর্যের প্রতি লক্ষ সালাম। [সূত্র: কাসীদা-এ সালাম: ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা ৫০০] ওরওয়াহ্ ইবনে মাসঊদের মন্তব্য নবীজির ঘাম মোবারক, প্রস্রাব মোবারক, থুথু মোবারক ও রক্ত মোবারক পবিত্র ও মোবারক। নবীজির প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অকৃত্রিম ভক্তি শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও অসাধারণ আনুগত্য ছিল রীতিমত অতুলনীয়। ওরওয়াহ্ ইবনে মাসউদ যিনি হুদায়বিয়ার চুক্তিকালে মক্কা থেকে দূত হিসেবে এসে নবীজির নূরানী দরবারে নবীজির প্রতি সাহাবায়ে কেরামের মহব্বত ভালোবাসার বিস্ময়কর নমুনা দেখে স্বজাতি কুরাইশদের নিকট গিয়ে আবেগময় কন্ঠে ঘোষণা করেন, হে আমার কুরাইশ জাতির ভাইয়েরা, আমি পৃথিবীর বড় বড় রাজা বাদশাহদের দরবারে গিয়েছি। রোমের বাদশা, পারস্য রাজা কাইসার ও কিসরা এবং নাজ্জাসাীর রাজ দরবারের আলীশান মর্যাদা ও শান শওকত দেখেছি। কিন্তু আল্লাহর শপথ করে বলছি, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর সাহাবীরা তাঁকে যে অকৃত্রিম মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করে তা ক্রয়কৃত ক্রীতদাসও রাজা বাদশাদের সাথে করে না। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থুথু নিক্ষেপ করলে তাঁর অনুসারীরা তা হাতে নিয়ে নেয় আপন শরীর ও মুখমন্ডলে মালিশ করে নেয়। তিনি যখন অজু করেন তাঁর ব্যবহৃত পানির এক ফোঁটা পাওয়ার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তিনি কোন বিষয়ে আদেশ করলে প্রত্যেকে সর্বাগ্রে তা পালনে সচেষ্ট হয়। তাঁর সম্মুখে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলে না। পূর্ণ দৃষ্টিতে কেউ তাঁর দিকে দেখেনা। তোমরা যদি আমার কথা শ্রবণ কর তাহলে তাঁর সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে যাও। ইসলামী জাগরণের কবি ফররুখ আহমদের অনবদ্য কাব্যের দুটি পংক্তি উল্লেখ পূর্বক লেখার যবনিকা টানছি। তোমার রওজা মোবারকে আজো সেই খুশবুর বইছে বাণ চামেলীর ঘ্রাণ অশ্রুর বাণ এখনো সেখানে অনির্বাণ। মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবীবের মর্যাদা বুঝার তৌফিক দিন আ-মী-ন।
 
Top