عَنْ عبد الله بن عمرو رضى الله عنه اَنَّ رسولَ الله صلى الله عليه وسلم قال اربع ان كن فيك فلا عليك ما فاتك من الدّنيا حِفْظُ امانة وصدق حديث وحسنُ خليقةٍ وعفة فى طُعمة- (رواه احمد و بيهقى)

অনুবাদ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, চারটি জিনিস যদি তোমার মধ্যে থাকে দুনিয়ার কোন জিনিস হাত ছাড়া হয়ে গেলেও তোমার ক্ষতি হবে না। আমানত সংরক্ষন করা, সত্য কথা বলা, উত্তম চরিত্র ও খাবার পবিত্র হওয়া।
[সূত্র: মুসনাদে আহমদ হাদীস: ৬৩৬৫, আহমদ, বায়হাক্বী, মিশকাত, হাদীস:৪৯৯৪]

রাভী পরিচিতি
নাম আবদুল্লাহ, উপনাম আবু মুহাম্মদ, আবু আবদুর রহমান ও আবু নুসাইর, পিতার নাম আমর ইবনে আস, মাতার নাম রীতা বিনতে মুনাব্বেহ। তিনি তাঁর পিতার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ৫ম অথবা ৮ম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রিয় রাসূলের পবিত্র জীবদ্দশায় তিনি প্রায় সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে পিতা হযরত আমর ইবনে আস জেহাদের ঝাণ্ডা পুত্র আবদুল্লাহ্র হাতে তুলে দেন। তিনি অসাধারণ ধীশক্তি ও স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি হাফেজে ক্বোরআন ছিলেন, আরবি ও হিব্র“ ভাষায় তাঁর সুনিপুন দক্ষতা ছিল। আসমানী কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলের বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল। রসূলুল্লাহ্র হাদীস লিখন ও সংরক্ষণে তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। ‘সাদেকা’ নামক তাঁর লিখিত একটি রিসালা রয়েছে। তিনি ৬০০ মতান্তরে ৭০০ হাদীস বর্ণনা করেন। তৎমধ্যে সতেরটি মুত্তাফাক আলায়হি, আটটি ইমাম বোখারী এবং বিশটি ইমাম মুসলিম এককভাবে উল্লেখ করেন। ৬৫ হিজরিতে ৭২ বৎসর বয়সে মিসরের ফুসতাত নগরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। স্বীয় আবাস স্থলে তাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে একজন মুমিন বান্দাকে যে, গুণাবলী অর্জন করতে হয়। যে গুণাবলী ধারণ করলে একজন মানুষ প্রকৃত আদর্শবান ও চরিত্র মানুষরূপে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নৈকট্য অর্জনে ধন্য হয়। সর্বোপরি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে, আলোচ্য হাদীস শরীফে এমন চারটি উত্তম ও মহৎ গুণাবলী সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে।
এ চারটি গুণাবলী মুমিন জীবনের অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপস্থাপনের লক্ষ্যে এ সংক্ষিপ্ত প্রয়াস।

আমানত সংরক্ষণ করা
আমানত অর্থ কারো নিকট কোন কিছু রেখে নিরাপদে থাকা যায় বা শান্তি পাওয়া যায়। প্রচলিত অর্থে কারো কাছে কোন অর্থ সম্পদ, বস্তু, সামগ্রী, গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলা হয়। যিনি গচ্ছিত বস্তুকে বিশ্বস্ততার সাথে সংরক্ষণ করেন, যথাযথভাবে হিফাজত করেন। মালিক চাওয়া মাত্র গচ্ছিত বস্তু কোন টালবাহানা ছাড়া প্রত্যার্পন করেন। তিনি আল্ আমীন তথা বিশ্বস্ত সত্যবাদী হিসেবে স্বীকৃত। এর প্রচলন জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয়ে আমানত রক্ষা করা, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেনদেনের আমানত, কথার আমানত- যেসব বিষয়ে প্রকাশিত হলে যেসব কথা বললে, পারস্পরিক সম্পর্ক অবনতি ঘটবে, মনোমালিন্য ও সংঘাত সৃষ্টি হবে। ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হবে, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এমন বিষয় প্রকাশ না করা ও না বলা আমানত। সর্বক্ষেত্রে আমানত রক্ষা করা একজন মুমিনের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এভাবে একজন চাকরিজীবী তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদন করা পবিত্র আমানত। যেমন একজন শিক্ষক তাঁর দায়িত্ব পালনে আমানতদারিতা রক্ষা করবে। যখন তিনি তাঁর কর্তব্য কর্ম সম্পাদনে অবহেলা করবেন না, দায়িত্বে ফাঁকিবাজি করবেন না, অশিক্ষা কুশিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীকে বিপথগামী করবেন না, ভুলতথ্য, ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিক পন্থায় শিক্ষার্থীকে পরিচালিত করবেন না তখন তিনি একজন বিশ্বস্ত সত্যবাদী আদর্শবান ও আমানতদার শিক্ষকরূপে গণ্য হবেন। সে ক্ষেত্রে এ পেশায় তার বেতন ভাতা তার জন্য হালাল উপার্জন হিসেবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে তিনি যদি পাঠদানে অনীহা প্রকাশ করেন, তার জন্য বরাদ্দকৃত পূর্ণ সময় যদি তিনি সঠিকভাবে পাঠদান না করেন বিষয় বহির্ভূত আলাপ-আলোচনা কথা-বার্তা গল্প গুজব হাসি তামাশা, অপ্রাসঙ্গিক অপ্রয়োজনীয় কথা-বার্তা বলে সময় অতিক্রম করেন, শিক্ষার্থীদের মূল্যবান জীবন নষ্ট করেন, এভাবে অযথা অনর্থক সময় নষ্ট করে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যদি ধ্বংস করে দেন তাহলে মূলত তিনি আমানত খিয়ানত করলেন। এ খিয়ানতের অপরাধে শরয়ী বিচারে যতটুকু সময় দায়িত্ব পালনে খিয়ানত করেছেন ততটুকু পরিমাণ বেতন গ্রহণ করাও তার জন্য হারাম হয়ে যাবে। একজন মুমিন আমানত রক্ষা করার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। আমানত দারিতাকে আল্লাহ্ পাক মুমিনের অন্যতম গুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
والذين هم لِاَمَنَتِهِمْ وعهدهم راعون
এরা সেই লোক যারা আমানতের প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং স্বীয় অঙ্গীকার হেফাজত করে।
পবিত্র ক্বোরআনে আরো এরশাদ হয়েছে-
ان الله يأمرُكم ان تُوَدُّوا الْاَمَنَتِ الى اهلها-
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার মালিককে প্রত্যার্পণ করো।
[সূরা: আননিসা-৫৮] প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীস শরীফে আমানত দারিতার মহৎ গুণকে ঈমান বলা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
عن انس رضى الله عنه قال فلَمَّا خطبنا رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لاايمان لمن لاامانة له ولادين لمن لا عهد له- (رواه البيهقى)
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন, তিনি বলেন, যার আমানত দারিতা নেই তার ঈমান নেই, আর যে ওয়াদা পালন করে না তার মধ্যে দ্বীন নেই। [বায়হাক্বী] সততা ন্যায় পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতা রক্ষা না করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, কথায় কথায় মিথ্যাচার করা ইত্যাদি গর্হিত আচরণকে মুনাফিকির নিদর্শন রূপে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
اَيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ اِذَا حَدَّثْ كَذَب- وَاِذَا وَعَدَ اَخْلَفَ وَاِذَا اُوْتمن خَانَ-
অর্থ: মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি- কথা বললেই মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে- ভঙ্গ করে, যখন তার কাছে কোন বস্তু আমানত রাখা হয় তা খিয়ানত করে।
[সহীহ বোখারী শরীফ: হাদীস- ৩৩, সুনানে তিরমিযী: হাদীস – ২৫৫৬]

সত্য কথা বলা
সততা, সত্যবাদিতা, সত্য প্রিয়তা, মুমিন জীবনের একটি গুরুত্ব পূর্ণ মহৎগুণ, সৎ চিন্তা করলে সত্য কথা বললে, সত্য পথে চললে জীবনে সাফল্য আসে। এ পথ কুসমাস্তীর্ণ নয় কন্টকাকীর্ণ। পার্থিব জীবনে ভয় ভীতি, লোভ লালসা ভোগ বিলাসের মোহ ত্যাগ করে যে সত্যকে আঁকড়িয়ে ধরেছে, সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্যের পথে অটল অবিচল রয়েছে সত্য প্রকাশে নির্ভীক আপোষহীন, অকুতোভয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ প্রকৃত পক্ষে তারাই মুমিন মুত্তাকী, সৌভাগ্যবান জান্নাতী ব্যক্তি। সত্যবাদীদের পদাঙ্ক অনুসরণ, তাদের সঙ্গ ও সাহচর্য লাভের জন্য, মহান আল্লাহ্ পাক মুমিন বান্দাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। এরশাদ হয়েছে-
يَااَيها الَّذِيْنَ اَمَنُوْا اَتَّقُوْا الله وَكُونُوا مَعَ الصَّدقِيْنَ-
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। [সূরা: আত্ তাওবা- ১১৯] শঠতা, কপটতা, মুনাফিকি চরিত্র, দ্বিমুখী, ভ্রান্ত মতবাদী, অসৎ চিন্তা চেতনার অধিকারী বাতিল মতাদর্শী নবীদ্রোহী ক্বোরআন সুন্নাহর বিকৃতকারী, অপব্যাখ্যাকারী, ব্যক্তি স্বার্থে ও দলীয় স্বার্থে ইসলাম নামধারী মুনাফিক চক্রের সকল প্রকার অশুভ তৎপরতা, পরকালে তাদের ধ্বংস অনিবার্য করে তুলবে। জাহান্নাম তাদের জন্য অপরিহার্য ও সুনিশ্চিত হয়ে যাবে। একমাত্র সত্যান্বেষী সত্যপন্থী সত্যবাদী লোকেরাই কিয়ামতের দিবসে প্রকৃতভাবে লাভবান হবে। ইসলামের একমাত্র সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শালোকে সত্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে যারা অবিরাম দৃঢ় প্রত্যয়ী পরকালের কঠিন সময়ে তারাই হবে সফলকাম ও বিজয়ী। তাদের সততা, নিষ্ঠা, সত্যবাদীতা তাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবে, পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
قَالَ اللهُ هَذَا يَوْمَ يَنْفَعُ الصِّدِّقِيْنَ صِدْقُهُمْ-
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে। [সূরা: মায়িদাহ্-১১৯] হাদীস শরীফে এসেছে-
عليكم باالصدق فان الصدق يهدى الى البر وان البر يهدى الى الجنة-
তোমাদের উপর সত্যবাদিতা অপরিহার্য। নিশ্চয়ই সত্যবাদিতা সৎকর্মের দিকে পরিচালিত করে। সৎকর্ম জান্নাতের পথ প্রদর্শন করে।

উত্তম চরিত্র
চরিত্র মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। মহান আল্লাহ্ ও তার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একজন আদর্শ মানুষের জন্য যে সব উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন অপরিহার্য করেছেন তা অর্জন করতে পারলে একজন ব্যক্তির ইহলৌকিক পারলৌকিক জীবন শান্তিময় হয়। তাকওয়াভিত্তিক আদর্শ জীবনই উত্তম চরিত্রের মাপকাঠি। এ ক্ষেত্রে গোটা বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ চরিত্রের অনন্য অনুপম মডেল হচ্ছেন, আমাদের প্রিয় নবী সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম আদর্শ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শই বিশ্ব মানবতার জন্য উত্তম চরিত্রের এক উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তাঁর সুমহান আদর্শ চরিত্রের প্রশংসায় মহান আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-
اِنَّكَ لَعَلَى خُلْقٍ عَظِيْم-
অর্থ: নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।
[সূরা: কালাম-৬৮] প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অসীম ত্যাগ ধৈর্য্য মাধুর্য চরিত্র ও ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ দিয়ে আরবের মানুষ গুলোকে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিলেন। তিনি এরশাদ করেছেন-
بعثت لاتمم مكارم الاخلاق-
আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি। বর্তমানেও পৃথিবীর অশান্ত পরিবেশ পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ আদর্শ সমাজ বিনির্মানে রসূলুল্লাহ্র পবিত্র জীবনাদর্শই একমাত্র সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।

হালাল রিযক ও পবিত্র খাবার
হাদীসে বর্ণিত শেষোক্ত বাণীটি মুমিন জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। বান্দার সকল প্রকার ইবাদত বন্দেগী পূণ্যময় আমল নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, দান-সাদকা, আল্লাহর দরবারে প্রতিটি আমলের গ্রহণযোগ্যতা হালাল রিযক তথা পবিত্র খাবারের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ্ পাক আমাদের আমল করার তৌফিক দিন। আ-মী-ন।

 
Top