তারাবীহ নামাযের রাকাআত সংখ্যা; খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল ও উম্মতের ইজমাঃ-

ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান
অধ্যক্ষ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা।
ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।

রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে আগমন করেছে পবিত্র মাহে রমযান। এ রমযানের সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-

يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

‘ওহে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের উপর অলংঘনীয় (রেজিস্টার্ড) বিধান হিসাবে সিয়াম সাধনার বিধান দেয়া হয়েছে যেভাবে অলংঘনীয় বিধান হিসাবে পূর্ববর্তীদের উপরও দেয়া হয়েছিল।  যাতে তোমরা তাকওয়া তথা (শারীরিক, আত্মিক, মানুষিক, আর্থিক, চারিত্রিক) সংযমী, খোদাভীতি অর্জন করতে পার। (সূরা বাকার-১৮৩)।

এ তাকওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা, শোনা, হৃদয়ঙ্গম করা, কুরআনকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। এ কুরআন তিলাওয়াত ও শোনার অন্যতম মাধ্যম হল সালাতুত তারাবীহ। লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত এ কুরআন যখন হাফেজ ছাহেব প্রাণ উজাড় করে সুললিত কন্ঠে তিলাওয়াত করে, রোজাদার পূত পবিত্র অন্তর নিয়ে ধারাবাহিকভাবে শোনে তখন আল্লাহর ভাষায়-
وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُه زَادَتْهُمْ إِيمَانًا-
‘যখন তাদেরকে তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনানো হয় তাদের ঈমান বাড়তেই থাকে।
(সূরা আনফাল: ২)।

আল্লাহর সামনে দাড়িয়ে ইমাম ও মুক্তাদী যেন আল্লাহর সাথে কথা বলে। যদিও দূর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু আলেম ও হাফেজ তাড়াহুড়া করে এমনভাবে তিলাওয়াত করেন মুসল্লিগন বুঝাতো দূরের কথা অন্য আলেমও বুঝতে পারে না। রুকু সিজদায়, দু’সেজদার মধ্যে ধীর গতিতে বসা যে ওয়াজিব তারা তা না মেনে তারাবীহ নামাজ পড়ে নিজের আমল যে বরবাদ করে দিচ্ছে তার খবরও রাখে না। এ যেন আল্লাহ তায়ালার সাথে একধরনের ঠাট্টা মশকারী। সারা দিন রোযা রেখে ইফতারে আল্লাহর মেহমান হিসেবে মনের আনন্দে শোকরিয়া জানিয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলতে এলে কে আমাদের তাড়া করে যে আমরা কুরআন নিয়ে উপহাস করছি? এটা কুরআন, নামাজ সর্বোপরি আল্লাহর সাথে বেয়াদবীর শামিল। রোযাদার মুসল্লি ভাইয়েদের বিষয়টি একটু ভাবতে হবে যে আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষনা দিয়েছেন-
وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا-
আমি এ কুরআন কে তারতিল সহকারে তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছে।
(সূরা ফুরকান-৩২)।

তারতীল অর্থ সহী শুদ্ধকরে على مكث অর্থ্যাৎ থেমে থেমে সুস্পষ্ট করে বুঝার মত করে তিলাওয়াত করা। মাহে রমযানে পবিত্র কুরআনের সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টির সুবর্ণ সুযোগ। যার সমান্যতম ঈমান আছে সে এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। সাহাবায়ে কেরাম বেশিরভাগ সময় এশার নামায শুরু করে তারাবীহ শেষ করত সাহরীর সময় পর্যন্ত। কোন কোন সময় একটু কমবেশী হত, তারা ৪ রাকাআত পড়ে দীর্ঘ সময় বিশ্রাম নিতেন। আবার প্রাণভরে কুরআন তিলাওয়াত শুনতেন, আবার দীর্ঘ সময় বিশ্রাম নিতেন। এ জন্য এ সালাতের নামই হয়েছে বিশ্রামের নামায। আমরা যদিও এত সময় দিতে অভ্যস্ত নই অন্ততঃ কুরআনের হক আদায় করার জন্য তাজবীদ মোতাবেক সহিহ শুদ্ধ ভাবে তিলাওয়াত করা ও শোনা অত্যাবশ্যকীয়।

তারাবীহ সালাতের পূর্বে ২ মিনিট কুরআন মাজীদের ১টি করে শব্দের উচ্চারণ ও তরজমা শেখানোর ব্যবস্থা করা গেলে সাধারণ মানুষ ৩০ দিনে ৩০টি শব্দ শেখে ফেলত। এছাড়া তারাবীহ শুরুর পূর্বে ইমাম সাহেব যদি ১০ মিনিট  পঠিতব্য আয়াত সমূহের মূল বক্তব্য তুলে ধরতেন তাহলে মুসল্লিগণ কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হত।

তারাবীহ অর্থ কী?

শাব্দিক পরিচয়: তারাবীহ অর্থ আরাম, অবসর, বিশ্রাম, বিরতি।

শরীয়তের পরিভাষায়: রমজানুল মোবারক রাতে এশার নামাজের পর যে নামায পড়া হয় তাকে তারাবীহ এর নামায বলা হয়।

ইমাম ইবনু নুজাইম আল হানাফী (জন্ম-৯২৬হি., মৃত্যু-৯৭০), তার বিখ্যাত আল বাহরুর রায়েক শরহু কানযুদ দাকায়েক গ্রন্থে লিখেন-

التراويح جمع ترويحة وهي في الأصل مصدر بمعنى الاستراحة سميت به الأربع ركعات المخصوصة لاستلزامها استراحة بعدها كما هو السنة فيها

التراويح শব্দটি ترويح
শব্দের বহুবচন।
মূলত শব্দটি মাসদার। যার অর্থ বিশ্রাম নেয়া। প্রতি চার রাকাত নামাযের পর সম পরিমাণ সময় আরাম বা বিশ্রাম নেয়া হয় বলে একে সালাতুত তারাবীহ বলা হয়। এ সময়  কিছু সময় বিশ্রাম নেয়া বা বিরতি দিয়ে পড়া সুন্নত।
(খ- ২, পৃ. ৭১)।

তারাবীহ সালাত পড়া কি?

التراويح سنة موكدة لمواطبة الخلفاء الراشدين للرجال والنساء اجماعا والجماعة فيها سنة على الكفاية-
তারাবীহ এর সালত আদায় করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ, কেননা খোলাফায়ে রাশেদীন এ সালাত গুরুত্বের সাথে আদায় করেছেন। এ সালাত পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এ বিষয় সম্পর্কে সাহাবা ও উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত। যে ইজমার বিরোধিতা করা সম্পুর্ণ অবৈধ। জামাতে আদায় করা সুন্নাতে কেফায়া  (অর্থাৎ মহল্লায় জামাতে সাথে আদায় করা হলে যে ব্যক্তি কোন কারনে জামাতে শামিল হতে পারেননি তাদের সুন্নাতও আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কোন জামাত না হয় তাহলে ঐ মহল্লার সবাই গুনাহগার হবে। (আদ দুররুল মোখতার)

ফাতওয়ায়ে শামীতে এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে আবেদীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন:-
وَهُوَ الْمَرْوِيُّ عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ .وَذَكَرَ فِي الِاخْتِيَارِ أَنَّ أَبَا يُوسُفَ سَأَلَ أَبَا حَنِيفَةَ عَنْهَا وَمَا فَعَلَهُ عُمَرُ ، فَقَالَ : التَّرَاوِيحُ سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ ، وَلَمْ يَتَخَرَّجْهُ عُمَرُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ ، وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ مُبْتَدِعًا ؛ وَلَمْ يَأْمُرْ بِهِ إلَّا عَنْ أَصْلٍ لَدَيْهِ وَعَهْدٍ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ . وَلَا يُنَافِيهِ
অর্থাৎ তারাবীহ যে সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ তা ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে ফাতওয়ায় বিদ্যামান রয়েছে ফাতওয়ায়ে আল এখতিয়ার গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে- ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে এ তারাবীহ ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তার জবাবে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তারাবীহ সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ থেকে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। একাজ কোন বিদআত বা নব উদ্ভাবিত ছিল না। তিনি যে হুকুমজারী করেছেন তার ভিত্তি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এ তারাবীহ আদায় হয়েছিল। আর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এ হুকুমের কোন বিরোধীতাকারী ছিল না। (রাদ্দুল মোহতার, ফাতওয়ায়ে শামী, খন্ড:৫, পৃ:৪৭২)।

তারাবীহ কি প্রিয় নবীজির সুন্নত?

হ্যাঁ, তারাবীহ প্রিয় নবীজির সুন্নাত। যে সকল আলেম নামধারী তারাবীহকে প্রিয়নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত নয় বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন, তারা হাদিসখানা অনুধাবন করা প্রয়োজন-
عن ابن عباس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كَانَ يُصَلِّي فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْر
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে বিশ রাকাআত এবং বিতির পড়তেন।
(১)আল মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, ইবনু আবী শাইবা রহমাতুল্লাহি আলাইহি, খ- ২, পৃ. ৩৯৪।
(২) আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, খ- ১১, পৃ. ৩৯৩, হাদীস নং ১২১০২।
(৩) মাজমাউজ যাওয়াইদ ওয়া মানবাউল ফাওয়াইদ- হায়শামী, খ- ৩, পৃ. ৪০২।
(৪) আস সুনানুল কোবরা লিল বায়হাকী, হাদীস নং ৪৩৯১।
(৫) মুসনাদে ইবনু হোমায়েদ, খ- ১, পৃ. ২১৮।

عن جابر بن عبد الله قال خرج النبى صلى الله عليه وسلم ذات ليلة في رمضان فصلى الناس أربعة وعشرين ركعة وأوتر بثلاثة
হযরত জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রমজান মাসের এক রাতে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাহিরে তাশরীফ নিয়ে এলেন। আর সাহাবায়ে কেরামকে ২৪ রাকাআত (৪ রাকাআত ঈশার, আর ২০ রাকাআত তারাবীহের) নামায পড়ালেন। আর তিন রাকাআত বিতির পড়ালেন’।  (তারীখে জুরজান,  আবুল কাশেম হামযা ইবন ইউসূফ আল যুরযানী, খ- ১, পৃ. ৩১৬। )

তারাবীহ ২০ রাকাআত এ বিষয়ে খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরামর ইজমা প্রতিষ্ঠিত।

এ বিষয়ে একটি মূলনীতি স্বরন রাখতে হবে, ইলামী শরীয়তে চরটি মূলনীতি সর্বজন স্বীকৃত- (১) কিতাবুল্লাহ (২) সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (৩) ইজমা (৪) কিয়াস।

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ
অর্থাৎ, তোমাদের জন্য আমার সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাত মেনে চলা অত্যাবশ্যকীয়। সর্বশক্তি নিয়োগ করে এ সুন্নাত পালন করবে।
(১) সুনানে ইবনু মাজা, হাদিস নং ৪২, খন্ড:১, পৃ:৪৯।
(২) জামেউল উসুল ফী আহাদিসির রাসুল, আল্লামা ইবনু আসীর, খন্ড:১, পৃ:১১৭।
(৩) তাহাবী শরীফ, ইমাম তাহাবী, খন্ড:৩, পৃ:১৮৩।

২০ রাকাআত তারাবীহের উপর সকল সাহাবা ইজমা করেছেন, কেউ কোন আপত্তি তোলেননি। হারামাইন শরীফাইনে প্রায় দীর্ঘ ১৫ শত বছর ২০ রাকাআত তারাবীহ চলছে দুনিয়ার সবত্র ২০ রাকাআত তারাবীহ চলছে। এখন যারা বিশ রাকাআত তারাবীহ মানতে চাননা তারা কি আহলে হাদীস দাবী করার কোন অধিকার রাখেন? হযরত ওমর ও সাহাবায়ে কেরামের আমলকে যারা মানেন না তারা কোনদিন হাদীসের অনুসারী হতে পারেন? এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহকে ভাবতে হবে, এরা কারা? যে মানুষকে ১২ রাকাআত নামাযে ২৪ টি সেজদা ও ১২ টি রুকু থেকে বঞ্চিত করার অপ-প্রয়াস চালাচ্ছে। এদেরকে চিহ্নত করতে হবে। তাদের এ ষড়যন্ত্রকে যে কোন মূল্যে রুখতে হবে।

♦তারাবীহ ২০ রাকাআতের দলীলঃ

(১) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনা মতে- প্রিয় নবীজি ২০ রাকাআত তারাবীহ আদায় করছেন
عن ابن عباس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كَانَ يُصَلِّي فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْر
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে বিশ রাকাআত এবং বিতির পড়তেন।
(১)আল মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, ইবনু আবী শাইবা রহমাতুল্লাহি আলাইহি, খ- ২, পৃ. ৩৯৪।
(২) আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, খ- ১১, পৃ. ৩৯৩, হাদীস নং ১২১০২।
(৩) মাজমাউজ যাওয়াইদ ওয়া মানবাউল ফাওয়াইদ- হায়শামী, খ- ৩, পৃ. ৪০২।
(৪) আস সুনানুল কোবরা লিল বায়হাকী, হাদীস নং ৪৩৯১।
(৫) মুসনাদে ইবনু হোমায়েদ, খ- ১, পৃ. ২১৮।

(২) হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাসনামল
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আদেশ
عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَمَرَ رَجُلاً يُصَلِّي بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَة
হযরত ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ রহমাতুল্লাহি আলাইহ থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয়ই ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাআত পড়ার হুকুম দিলেন’।(আবু বকর আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ আশ শায়বা আল আব্বাসী আল কুফী, মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, খ- ২, পৃ. ১৬৩)।

وروى مالك من طريق يزيد بن خصيفة عن السائب بن يزيد عشرين ركعة
হযরত সায়েব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সময়কালে বিশ রাকাআত তারাবীহ ছিল’। (আবুল ফজল আহমাদ ইবন আলী ইবন হাজার আল আসকালানী আশ-শাফেয়ী, ফাতহুল বারী শারহে সাহীহিল বুখারী, খ- ৪, পৃ. ২৫৩)।

عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ فِى شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَة
হযরত সায়েব ইবন ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময় আমরা রমযান মাসে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তাম’। (আবু বকর আহমাদ ইবন হুসাইন আল বায়হাকী, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, খ- ২, পৃ. ৪৯৬; আবু আবদুল্লাহ মালিক ইবন আনাস আল আসবাহী, মুয়াত্তা ইমাম মালিক, খ- ১, পৃ. ৩৫৫; আবুল হাসান আলী ইবন জা’দ ইবন আল জাওহারী আল বাগদাদী, মুসনাদে ইবন জা’দ, খ- ১, পৃ. ৪১৩; আবু জাকারিয়া মুহিউদ্দিন ইয়াহইয়া ইবন শারফুন নুরী, খুলাসাতুল আহকাম ফী মাহমাত/মুহিম্মাতুস সুনানি ও কাওয়াইদিল ইসলাম (خلاصة الأحكام في مهمات السنن وقواعد الإسلام), খ- ১, পৃ. ৫৭৬; বদরুদ্দিন আইনী আল হানাফী, উমদাতুল কারী শারহে সহীহীল বুখারী, খ- ৮, পৃ. ৪৮৫; হযরত মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ শারহে মিশকাতুল মাসাবীহ, খ- ৪, পৃ. ৪৩৫; জালালুদ্দীন আবদুর রহমান আস সুয়ূতী, আলহাবী লিল ফাতওয়া, খ- ১, পৃ. ৩৩৬)।

عن السائب بن يزيد قال: كنا نقوم في زمان عُمَر بن الخطاب رضي الله عنه بعشرين ركعة والوتر
হযরত সায়েব ইবন ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাসনামলে বিশ রাকাআত তারাবীহ ও বিতির পড়তাম’।
(আবু বকর আহমদ ইবন আল হুসাইন ইবন আলী ইবন আবদুল্লাহ আল বায়হাকী, আস সুনানে সগীর লিল বায়হাকী, হাদিস নং ৬৪৮, খ- ২, পৃ. ২৫৮; ম’রেফাতুস সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাকী, হাদিস নং ১৪৪৩, খ- ৪, পৃ. ২০৭)।

ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, সুবকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (শরহুল মিনহাজ), মোল্লা আলী কারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (শরহুল মুয়াত্তা) ও সুয়ুতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন।

عن يزيد بن رومان أنه قال: كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان بثلاث وعشرين ركعة

হযরত ইয়াজিদ ইবন রুমান বলেন, ‘লোকেরা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে রমজান মাসে বিশ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতির আদায় করতো’।
(আবু বকর আহমদ ইবন আল হুসাইন ইবন আলী ইবন আবদুল্লাহ আল বায়হাকী, মা’রেফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদিস নং ১৪৪৩, খ- ৪, পৃ. ২০৭; মালেক বিন আনাস, আল মুয়াত্তা (১৪২৫ হি.), হাদিস নং ৩৮০, খ- ২, পৃ. ১৫৯; আবু বকর আহমদ ইবন আল হুসাইন ইবন আলী ইবন আবদুল্লাহ আল বায়হাকী, আস সুনানে কাবীর লিল বায়হাকী, হাদিস নং ৪৮০২, খ- ২, পৃ. ৪৯৬)।

ইমাম বায়হাকী, আল্লামা রাজী, কুসতলনী, ইবন কুদামা, ইবন হাজার মক্কী, তাহতাবী, ইবন হুমাম, বাহরুর রায়েক প্রণেতা রহমাতুল্লাহি আলাইহিম প্রমুখগণ এ ব্যাপারে একমত হয়ে বলেন, হযরত ওমর ফরুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে বিশ রাকাআত তারাবীহের উপরই সকলের সিদ্ধান্ত স্থির হয় এবং এভাবেই চলতে থাকে। আর সুন্নত হওয়ার জন্য সেটির নিরবচ্ছিন্ন হওয়া শর্ত। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, যদি আমার পর কোন নবী হতো তবে ওমর হতো। তিনি আরো বলেছেন, দ্বীনের ব্যাপারে সবচেয়ে মজবুত হলেন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু। যদি বিশ রাকাত তারাবীহ নামায বিদআত হয়, তাহলে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ সে সময়কার সমস্ত আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণের বিদআতি হওয়ার আবশ্যক হয়।

ইবন তাইমিয়া বলেন, উবাই ইবন কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের মাঝে তারাবীহ এর নামায পড়াতেন। কোন একজনও এ ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করেনি’।
(মাজমুআয়ে ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়া, খ- ৩৩, পৃ. ১১২)

৮ রাকাআকের মুফতি সাহেবগণ কথায় কথায় ইবনে তাইমিয়া রেফারেন্স দেন তারা তার এ ফাতওয়া কি চোখে দেখেন না?

(৩) হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহ আনহু এর শাসনামল
হযরত সায়েব ইবন ইয়াজিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহ বলেন,
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাসনামলে লোকেরা বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়তেন।  আর হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাসনামলে লম্বা কেরাতের কারণে লাঠির উপর ভর দিতেন।
(আবু বকর আহমদ ইবন আল হুসাইন ইবন আলী ইবন আবদুল্লাহ আল বায়হাকী, সুনানে বায়হাকী আল কুবরা, খ- ৪, পৃ. ২৯৬)।

হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলের একজন ব্যক্তির নামও বলা যাবে না, যে ব্যক্তি আট রাকাআত পড়ে জামাত থেকে বেরিয়ে যেত।  কিংবা কেউ বিশ রাকাআত তারাবীহকে বিদআত বলেছে এমন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না।

(৩) হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাসনামল
হযরত আবু আব্দুর রহমান আস সালামী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

عن ابى عبد الرحمن السلمى عن على قال دعى القراء فى رمضان فامر منهم رجلا يصلى بالناس عشرين ركعة قال وكان على يوتر بهم

হযরত আবু আব্দুর রহমান আস সুলামী রহমাতুল্লাহি আলাইহ বলেন, হযরত হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু রমজান মাসে ক্বা’রীদের ডাকতেন।  তারপর তাদের মাঝে এক একজনকে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়াতে হুকুম দিতেন। আর বিতিরের জামাত হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেই পড়াতেন।
( আবু বকর আহমদ ইবন আল হুসাইন ইবন আলী ইবন আবদুল্লাহ আল বায়হাকী, সুনানে বায়হাকী আল কুবরা)।

(৪) জমহুর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মত

ابو حنيفة عن حماد عن ابراهيم ان الناس كانوا يصلون خمس ترويحات فى رمضان

হযরত ইমাম আবু হানীফা ইমাম হাম্মাদ থেকে তিনি হযরত ইবরাহীম (মৃ. ৯৬ হি.) থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা (সাহাবী ও তাবেয়ীগণ) রমজান মাসে পাঁচ তারবীহের সাথে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়তো’।
(কিতাবুল আসার লিআবী ইউসুফ)

عن عبد العزيز بن رفيع قال كان ابى بن كعب يصلى بالناس فى رمضان بالمدينة عشرين ركعة ويوتر بثلاثة

হযরত আব্দুল আজীজ ইবন রফী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত উবায় ইবন কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকদেরকে রমজান মাসে মদীনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতির নামায পড়াতেন।
(আবু বকর আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবি শায়বা, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, খ- ২, পৃ. ৩৯৩)

(৫) তাবেয়ীগণ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর অভিমত
হযরত সুয়াইদ ইবন গাফালা যিনি বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিলেন। তিনি ইমামতি করাতেন। হযরত আবুল হাজীব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

كان يؤمنا سويد بن غفلة فى رمضان فيصلى خمس ترويحات عشرين ركعة

হযরত সুইয়াইদ ইবন গাফালা রমজান মাসে আমাদের জামাতের সাথে পাঁচ তারবিহায় বিশ রাকাআত নামায পড়াতেন।
(আবু বকর আহমদ ইবন আল হুসাইন ইবন আলী ইবন আবদুল্লাহ আল বায়হাকী, আস সুনানে কাবীর লিল বায়হাকী, খ- ২, পৃ. ৪৯৬)

عن سعيد بن ابى عبيد ان على بن ربيعة كان يصلى بهم فى رمضان خمس ترويحات ويوتر بثلاث

হযরত সাঈদ ইবন আবু উবায়েদ থেকে বর্ণিত, হযরত আলী ইবন রাবীয়া পাঁচ তারবিহা তথা বিশ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতির জামাতের সাথে পড়তেন।
(আবু বকর আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবি শায়বা, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, খ- ২, পৃ. ৩৯৩)।

সকল হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, বিশ রাকাআতের সাথে তারাবীহ শব্দ এবং বিশ রাকাআত তারাবীহের আমল তাবেয়ীগণের মাঝে বিনা প্রতিবাদে নির্বিঘেœ প্রচলিত ছিল। আর পুরো খাইরুল কুরুনে কোন এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যাবে না, যে ব্যক্তি বিশ রাকাআত তারাবীহকে অস্বীকার করেছেন বা অপছন্দ করেছেন। কিংবা বিশ রাকাআত তারাবীহকে বিদআত বলেছেন বা আট রাকাআত জামাতের সাথে পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেছেন। পুরো খাইরুল কুরুনের মাঝে আট রাকাআতের সাথে তারাবীহ শব্দ ব্যবহার করেছেন এরকম কোন প্রমাণ কোথাও বিদ্যমান নেই।

মসজিদে নববীতে বিশ রাকাআত তারাবীহঃ-

মদীনা তায়্যিবায় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাসনামলে বিশ রাকাআত তারাবীহই পড়া হতো। আজো মদীনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাআত তারাবীহই পড়া হয়। হযরত আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহাও মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করতেন। তিনিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ ফরমান বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের মাঝে বেদআত বের করবে, তার কাজটি পরিত্যাজ্য। যদি বিশ রাকাআত তারাবীহের নামায বিদআত ও নাজায়েজ হতো, তাহলে হযরত আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা বছরের পর বছর এর উপর চুপ করে বসে থাকতেন না।

হযরত জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুও মদীনায় অবস্থান করছিলেন। তিনি ঐ হাদীসের রাবী। যাতে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি বিদআত গোমরাহী আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে নিক্ষেপকারী। তারই সামনে অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়া হচ্ছিল, অথচ তিনি এর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নি। এতে বুঝা যায় সকল সাহাবা এ বিষয়ে একমত ছিলেন।

বাইতুল্লাহ শরীফে বিশ রাকাত তারাবীহঃ-

হযরত আতা ইবন আবী রাবাহ রহমাতুল্লাহ: মক্কা মুকাররমায় হযরত আতা ইবন আবী রাবাহ রহমাতুল্লাহ (মৃ.  ১১৪ হি.) বলেন,

ادركت الناس وهم يصلون ثلاثة وعشرون ركعة بالوتر

তথা আমি লোকদের (সাহাবা ও
তাবেয়ীগণ) বেতের নামাযসহ ২৩ রাকাআত পড়তে দেখেছি।
(আবু বকর আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবি শায়বা, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, খ- ২, পৃ. ৩৯৩)।

ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ২০৪ হি.) বলেন, আমি স্বীয় শহর মক্কায় লোকদের বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়া অবস্থায়ই পেয়েছি।
(মুহাম্মদ ইবন ঈসা আবু ঈসা আত তিরমিযি, আল জামেউস সহীহ সুনানে তিরমিযি, খ-১, পৃ. ১৬৬)।

চার ইমাম রাহিমাহুমুল্লাহ এর বক্তব্য
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ। এ চার ইমামের মাঝে প্রথম ইমাম হলেন ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃত্যু ১৫০ হিজরী) ও বিশ রাকাআত তারাবীহের প্রবক্তা।
(ফাতাওয়া কাজীখান, খ- ১, পৃ. ১১২)

ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর একটি বক্তব্য বিশ রাকাআতের পক্ষে, দ্বিতীয় বক্তব্য ৩৬ রাকাআতের পক্ষে। (যাতে বিশ তারাবীহ আর ১৬ রাকাআত নফল)।
(হেদায়াতুল মুজতাহিদ, খ- ১, পৃ. ১৬৭)

ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বিশ রাকাআতের প্রবক্তা।
(আলমুগনী, খ- ২, পৃ. ১৬৭)

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর প্রসিদ্ধ বক্তব্যও বিশ রাকাআতের পক্ষে।
(আলমুগনী, খ- ২, পৃ. ১৬৭)।

৮ রাকাআত তারবীহের জবাবঃ-
৮ রাকাআত তারাবীহের পক্ষে দলিল

عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه أخبره : أنه سأل عائشة رضي الله عنها كيف كانت صلاة رسول الله صلى الله عليه و سلم في رمضان؟ فقالت ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة يصلي أربعا فلا تسل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي أربعا فلا تسل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي ثلاثا. قالت عائشة فقلت يارسول الله أتنام قبل أن توتر؟ فقال يا عائشة إن عيني تنامان ولا ينام قلبي

হযরত আবু সালমা ইবন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে জানতে চান নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায কেমন হত রামাযান মাসে? তিনি বললেন-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম রামাযান ও রামাযান ছাড়া অন্য মাসে ১১ রাকাআত থেকে বাড়াতেন না। তিনি ৪ রাকাআত পড়তেন তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জানতে চেওনা। তারপর পড়তেন ৪ রাকাআত তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা বিষয়ে জানতে চেওনা, তারপর পড়তেন ৩ রাকাআত। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার পূর্বে শুয়ে যান? তিনি বললেন, হে আয়েশা! নিশ্চয় আমার দু’চোখ ঘুমায় আমার কলব ঘুমায়না।
( মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আবু আবদুল্লাহ আল বুখারী, আল জামেউস সহিহুল মুখতাসার, খ- ১, পৃ. ৩৮৫)।

জবাব
১। এই হাদিসে অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা থাকায় এ দিয়ে দলিল দেয়া ঠিক নয়। আল্লামা কুরতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহর এই বর্ণনাটি অনেক আহলে ইলমদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছি অনেকেই এতে অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
( ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী, খ- ৩, পৃ. ১৭)

২। আসল কথা হল এই যে, এই হাদিসটি তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট। এতে তারাবীহের কথা বর্ণিত নয়। নিম্নে এ ব্যাপারে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করা হল।

হাদিসটিতে মূলত তাহাজ্জুদের বর্ণনা এসেছে একথার দলিল

১। হাদিসের শব্দ

ما كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يزيد في رمضان ولا في غيره

(নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইজি ওয়া সাল্লাম
রামাযান ও রামাযান ছাড়া অন্য সময় বাড়ান না) এটাই বুঝাচ্ছে যে, প্রশ্নটি করা হয়েছিল রামাযান ছাড়া অন্য সময়ে যে নামায নবীজী পড়তেন তা রামযানে বাড়িয়ে দিতেন কিনা? এই প্রশ্নটি এজন্য করা হয়েছে যেহেতু বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানে আগের তুলনায় অনেক নামায পড়তেন ও ইবাদত করতেন, তাই এই প্রশ্নটি করাটা ছিল স্বাভাবিক। আর রামযান ছাড়া কি তারাবীহ আছে? যে রামাযানের আগেই তারাবীহ আর বিতর মিলিয়ে ১১ রাকাআত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পড়তেন? নাকি ওটা তাহাজ্জুদ? তাহাজ্জুদ হওয়াটাই কি সঙ্গত নয়? সুতরাং এটাই স্পষ্ট বুঝা যায় তারাবীহ নয় প্রশ্ন করা হয়েছে তাহাজ্জুদ নিয়ে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদের নামায রামাযান ছাড়া যে ক’রাকাত পড়তেন তা থেকে রামাযানে বাড়িয়ে পড়তেন কিনা? এর জবাবে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ১১ রাকাআত থেকে বাড়াতেন না তাহাজ্জুদ নামায।

২। মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর রাকাত সংখ্যার অধ্যায়ের পরিবর্তে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার প্রণিত বুখারী শরীফে এই হাদিসটি নিম্নে বর্ণিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন,
(ক) বিতর অধ্যায়
(খ) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতে (নামাযের উদ্দেশ্যে) দান্ডয়মানতা রামযানে ও রামযান ছাড়া অধ্যায়ে।

৩। আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-আর আমার কাছে এটি প্রকাশিত হয়েছে যে, ১১ রাকাআতের থেকে না বাড়ানোর রহস্য এটি যে, নিশ্চয় তাহাজ্জুদ ও বিতরের নামায রাতের নামাযের সাথে খাস। আর দিনের ফরয যোহর ৪ রাকাত আর আসর সেটাও ৪ রাকাআত আর মাগরীব হল ৩ রাকাত যা দিনের বিতর। সুতরাং সমন্বয় হল, রাতের নামায দিনের নামাযের মতই সংখ্যার দিক থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে। আর ১৩ রাকাআতের ক্ষেত্রে সাযুজ্যতা হল, ফযরের নামায মিলানোর মাধ্যমে কেননা এটি দিনের নামাযই তার পরবর্তী নামাযের জন্য।
(ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী, খ- ৩, পৃ. ১৭)

ইবনে হাজার রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর এই রহস্য বা হিকমত বর্ণনা কি বলছেনা এই হাদিস দ্বারা তাহাজ্জুদ উদ্দেশ্য তারাবীহ নামায নয়? এই বক্তব্যে তাহাজ্জুদের কথা স্পষ্টই উল্লেখ করলেন ইবনে হাজার রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

চার মাযহাবের ফিক্বহের ইবারতের মাঝে কোন একটি ইবারতেও শুধু আট রাকাআত তারাবীহকে সুন্নত আর বিশ রাকাআততে বিদআত বলা হয়নি।

সর্বশেষ বলতে চাই, যারা ৮ রাকাআত তারাবীহ বলে আল্লাহর ইবাদত থেকে  মুসল্লিদের মাহরূম করছেন তারা আহলে হাদীস নন। তারা প্রিয় নবীজির  আমল, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, বিগত ফকীহগণসহ কাউকে মানতে চান না। এরা এক নব মতবাদের প্রবর্তক যা প্রত্যাখ্যাত। কোন আলেম তো দূরে থাক সাধারণ কোন বিবেকবান মুসলামানকে পাওয়া যাবে না যারা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হাজার হাজার মুহাজির আনসার সাহাবাকে বেদআতী মনে করেন। আল্লাহ আমাদেরকে চৌদ্দশত বছরের লক্ষ লক্ষ সাহাবা, ফকীহ, মুফতীগনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০ রাকাআত তারাবীহ আদায় করে  নিজেদের গুনাহ ক্ষমা পাওয়ার এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের তাওফিক দিন। আমীন বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালিন।

 
Top